বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৪

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?


বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির
নিকট
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর-
আবেদন পত্র
গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী শাসনতন্ত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনতান্ত্রিক অধিকার যাতে গৃহীত হয় তজ্জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রতিনিধিদল গতই ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ ইংরেজী তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এই স্মারকলিপিখানি মনে প্রাণে সমর্থন করি এবং গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী শাসনতন্ত্রে "নবজীবনের" প্রতীক্ষায় রয়েছি। স্মারকলিপিতে নিম্নলিখিত "চারিটি বিষয়" উত্থাপন করা হয়েছে:-
১। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল হবে এবং ইহার একটি নিজস্ব আইন পরিষদ থাকবে।
২। উপজাতীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য "১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির" ন্যায় অনুরূপ সংবিধি ব্যাবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।
৩। উপজাতীয় রাজাগণের দফতর সংরক্ষণ করা হবে।
৪। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় নিয়ে কোন শাসনতান্ত্রিক সংশোধন বা পরিবর্তন যেন না হয়, এরূপ সংবিধি ব্যাবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।
স্মারকলিপিতে বর্ণিত "চারিটি বিষয়" যে আমাদের ন্যায় সঙ্গত দাবী, তজ্জন্য আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি। এক কথায় বলতে গেলে "চারিটি বিষয়" হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জাতীয় অস্তিত্বের চাবিকাঠি। নিজস্ব আইন পরিষদ সহ একটি স্বায়ত্ত্ব শাসিত অঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিণত করার জন্য আমরা আমাদের দাবী উত্থাপন করেছি। বছরকে বছর ধরে ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ আমলের দিন থেকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ধ্বংসের দিন পর্যন্ত আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীরা খুবই দুর্বিসহ জীবন যাপন করেছি; যার ফলে আমাদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে এবং আমাদের জাতীয় উন্নতি ব্যাহত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামএকটি পৃথক শাসিত অঞ্চল (Excluded Area)। কিন্তু ভাগ্যের এমন নির্মম পরিহাস যদিও পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশে "উপজাতীয় জনগণের আবাসভূমি" হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল তথাপি বাস্তবে ইহা মিথ্যা এবং প্রহসন ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।
বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামরে একটি পৃথক শাসিত অঞ্চলরূপে রাখার জন্য শাসনের সুবিধার্থে আইন প্রয়োগের জন্য ১৯০০ সালে ব্রিটিশ সরকার "১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি" ঘোষণা করেন। এই শাসনবিধি পুরোপুরি ত্রুটি পূর্ণ। এই শাসন বিধি একটি অগণতান্ত্রিক শাসনবিধি। এই শাসনবিধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রতিনিধিদের কোন বিধি ব্যাবস্থা গৃহীত হয়নি। বাংলাদেশের গর্ভপরের হাতে সকল ক্ষমতা ন্যাস্ত করা হয়েছে এই শাসনবিধি দ্বারা। গর্ভণর খুবই ক্ষমতাশালী। তিনি যেকোন সময়ে যখন মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সুশাসন ও শান্তির পক্ষে ইহা প্রয়োজন, উপযোগী এবং উপযুক্ত, তখন তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন প্রয়োগ করেন, নতুন রুলস ও রেগুলেশন প্রনয়ণ করেন। তিনি এতই শক্তিশালী যে স্বেচ্চারমূলকভাবে তিনি অনেক কিছু করতে পারেন। তিনি কোনও আইন পরিষদের নিকট জবাবদেহি হতে বাধ্য নন। গর্ভপর হলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন পরিষদ। গর্ভণর আইন প্রনয়ণ করেন এবং তার জেলা প্রশাসন ইহা কার্যকরী করেন। ফলে পৃথক শাসিত অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ব্যাবস্থা অর্থহীন হয়ে পড়ে। সর্বক্ষেত্রে আগের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ পিছিয়ে পড়ে থাকলো।
ব্রিটিশ সরকার আমাদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের হতভাগ্য জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। জনগণের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিবার জন্য ব্রিটিশ সরকার একটি অদ্ভুত অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবর্তন করে। জনগণ গর্ভণর ও তার প্রশাসনের দয়ার উপর নির্ভর করে বাস করতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে বঞ্চিত করে ব্রিটিশ সরকার বাইরের মানুষকে প্রশাসন বিভাগে নিয়োগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসন কার্য চালিয়ে যাবার ব্যাবস্থা করে এবং এইভাবে কালক্রমে বহিরাগতদের প্রভাব জেলা প্রশাসনে প্রাধান্য লাভ করে। ব্যাবসা-বানিজ্যের কেন্দ্র অর্থাৎ বাজার, নদী বন্দর প্রভৃতি সমস্ত ব্যবসায়ী কেন্দ্র সমূহ বহিরাগতদের হাতে চলে যায়। এই রূপে রাজনৈতিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ জেলা প্রশাসন থেকে চ্যুত হয় এবং দুরে সরে পড়ে থাকতে বাধ্য হয়, অর্থনৈতিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বহিরাগত ব্যবসায়ীদের শোষণের শিকারে পরিণত হয়। ব্রিটিশ সরকারের ন্যায় পাকিস্তান সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রামের হতভাগ্য জনগণকে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসেনি। বরং পক্ষান্তরে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের সত্বাকে চিরতরে লুপ্ত করে দিবার পথ প্রশস্ত করে দেয়। অন্যায় অবিচার সমগ্র জেলায় চরম নৈরাশ্য ও ভীতির রাজত্ব সৃষ্টি করে। কাপ্তাই বাঁধের ফলে ৯৯ হাজার ৯ শত ৭৭ জন মানুষ ১৯৬০ সালে গৃহহারা, জমিহারা হয়ে যায়। সরকার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও উপযুক্ত পূর্ণবাসনের কোন ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করেনি। স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামত যাচাই না করে ১৯৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের সত্বাকে চিরতরে ঘুচিয়ে দিবার জন্য পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একটি শাসনতান্ত্রিক সংশোধনী প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেয়। স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের অগণতান্ত্রিক এবং নিপীড়নমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ প্রতিবাদ করতে পারেনি। সুতরাং শেষ পর্যন্ত অনন্যোপায় হয়ে জন্মভূমি চিরতরে ত্যাগ করে প্রায় পঞ্চাশ হাজার নরনারী ১৯৬৪ সালে ভারতে আশ্রয় পাবার আশায় সীমান্ত পাড়ি দেয়।
বেআইনী অনুপ্রবেশ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনসংখ্যা ছিল ৯৪.৪৭% অমুসলমান ২.৫৯% এবং মুসলমান ২.৯৪%। মুসলমান ও অমুসলমান জনসংখ্যার কিছু অংশ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিম বাসিন্দা আর বাদবাকী অংশ ছিল বাইরে থেকে আগত ব্যবসায়ী ও সরকারী কর্মচারীবৃন্দ। কিন্তু গত চব্বিশ বছরে বহিরাগতদের সংখ্যা অসম্ভব রকমভাবে বেড়ে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বারবার পাকিস্তান সরকারকে এই বেআইনী অনুপ্রবেশ বন্ধ করে দিবার জন্য অনুরোধ জ্ঞাপন করে। বহিরাগতদের দ্বারা বেআইনী জমি বন্দোবস্তী ও বেআইনী জমি বেদখল তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায়। "১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি" অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনও রকমের বন্দোবস্তী বহিরাগতদের জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গর্ভণর এবং তার জেলা প্রশাসন এই শাসনবিধিকে কার্যকরী করেনি। পক্ষান্তরে গর্ভণর ও তার জেলা প্রশাসক বহিরাগতদেরকে বেআইনী জমি বন্দোবস্তী ও বেআইনী জমি বেদখলের পথ নীরবে প্রশস্থ করেছে। "১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি" বেআইনী অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে পারেনি, পারেনি বেআইনী জমি বন্দোবস্তী ও বেআইনী জমি বেদখল বন্ধ করে দিতে। এই শাসনবিধি অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের স্বত্বা জনগণের মুগ যুগ ধরে পিছিয়ে পড়ে থাকার অবস্থার কোন পরিবর্তন এনে দিতে পারেনি। কালক্রমে এই পৃথক শাসিত অঞ্চলের স্বত্বা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের নিকট অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।
জনগণের অধিকার সংরক্ষণের ব্যপারে পৃথক শাসিত অঞ্চলের সত্বা যথেষ্ট নয়। ইহা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জাতীয় অস্তিত্বের নিরাপত্তাবোধ এনে দিতে পারেনি। গণতান্ত্রিকশাসন ব্যবস্থা ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ করা যাবেনা। এই জন্যই আমরা "চারিটি বিষয়" উত্থাপন করে নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত একটি আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসনের দাবী তুলে ধরেছি। সুতরাং-
ক) আমরা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সত্ত্বেও পৃথক অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পেতে চাই।
খ) আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার থাকবে, এরকম শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন চাই।
গ) আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষিত হবে এমন শাসন ব্যবস্থা আমরা পেতে চাই।
ঘ) আমাদের জমি স্বত্বা জুম চাষের জমি ও কর্ষণযোগ্য সমতল জমির স্বত্বা সংরক্ষিত হয় এমন শাসন ব্যবস্থা আমরা পেতে চাই।
ঙ) বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল হতে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন কোন বসতি স্থাপন করতে না পারে তজ্জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার প্রবর্তন চাই।
আমাদের দাবী ন্যায় সঙ্গত দাবী। বছরকে বছর ধরে ইহা একটি অবহেলিত শাসিত অঞ্চল ছিল। এখন আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পার্বত্য চট্টগ্রামকে গণতান্ত্রিক পৃথক শাসিত অঞ্চল অর্থাৎ আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসিত অঞ্চলে বাস্তবে পেতে চাই। ভারত তার বিভিন্ন জাতিসমূহের সমস্যাসমূহ সমাধান করেছেন। ভারতের জাতিসমূহ-বড় বা ছোট সকলে শাসনতান্ত্রিক অধিকার পাচ্ছে । ভারতের জাতি সমূহ ক্রমান্বয়ে ইউনিয়ন টেরিটরি এবং রাজ্য পর্যায়ের মর্যাদার অধিকারী হতে চলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নও তার জাতি সমূহের সমস্যার সমাধান করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সকল জাতি সমূহকে শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা দিয়েছে এবং গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ইউনিয়ন রিপাবলিক, স্বশাসিত রিপাবলিক, স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল ও জাতীয় অঞ্চলে বিভক্ত করে জাতি সমূহের সমস্যার সমাধান করেছে। পাকিস্তান সরকার আমাদিগকে নির্মমভাবে নিপীড়ন করেছে। গত চব্বিশ বছর আমরা সকল মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা অর্থাৎ প্রত্যেক বিষয়ে আমরা আগের মতো পিছিয়ে পড়ে রয়েছি। এখনও আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার মানুষ অর্ধ নগ্ন পরিবেশে বাস করছে, এখনও হাজার হাজার মানুষ আদিম যুগের পরিবেশে বাস করছে। এখন নিপীড়নকারী, স্বৈরচারী পাকিস্তান সরকারের দিন আর নেই। আমরা স্বৈরচারী মানুষ আদিম যুগের পরিবেশে বাস করছে। এখন নিপীড়নকারী, স্বৈরচারী পাকিস্তান সরকারের দিন আর নেই। আমরা স্বৈরচারী পাকিস্তান সরকারের সর্বরকমের নিপীড়ন ও অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়েছি। আমাদের বাংলাদেশ এখন মুক্ত। উপনিবেশিক শাসনের জোয়াল ভেঙে গেছে। এখন আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ চারিটি মূলনীতি-গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে উর্দ্ধে তুলেধরে উজ্জল ভবিষ্যত নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও বাংলাদেশের অন্যান্য অংশের ভাই বোনদের সাথে একযোগে এগিয়ে যেতে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ মনে করে এবং বিশ্বাস করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের যুগযুগান্তের অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ভুলে দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জাতীয় অস্তিত্বের সংরক্ষণের অধিকার দেবেন।
জয় বাংলা।


                                                                                                            মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা
তারিখ-রাঙ্গামাটি,                                                              গণ পরিষদ সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ
২৪শে এপ্রিল, ১৯৭২ সন।                                                                                এবং
                                                                                                                  আহ্বাবায়ক,
                                                                                            পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি।

সংগৃহীত

বিশেষ সাক্ষাৎকার: জেলে না গিয়ে বঙ্গভবনে শপথ নিলাম: ড. ইউনূস

 


বিশেষ
সাক্ষাৎকার

জেলে না গিয়ে বঙ্গভবনে শপথ নিলাম: . ইউনূস 

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক . মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন। দেশের অভাবনীয় এক পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের বিশেষ অনুরোধে তিনি এই দায়িত্ব নেন। নতুন বাংলাদেশ নিয়ে মানুষের স্বপ্ন, গুরুত্বপূর্ণ নানা খাতে সংস্কারের মাধ্যমে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন, গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং চলমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম

আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ

প্রথম আলো: . মুহাম্মদ ইউনূস আপনাকে শুভেচ্ছা। দুই মাস হয়নি আপনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন। একদম নতুন সময়, একদম নতুন দায়িত্ব, যেটা হয়তো আগে কখনো ভাবেননি। এই দায়িত্ব আপনার কেমন লাগছে? আপনি কেমন আছেন?

. মুহাম্মদ ইউনূস: আছি। ভালো আছি। একটা নতুন দায়িত্ব। বড় দায়িত্ব। দায়িত্ব সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। হঠাৎ করে যে একটা দায়িত্ব এল, সেটা বহন করার মতো যোগ্যতা অর্জন করা, সেটাকে কাজে পরিণত করতে সচেষ্ট আছি।

প্রথম আলো: আমরা জানি যে দুই দশক ধরে আপনাকে অনেক গালাগাল শুনতে হয়েছে। আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরতে হয়েছে। পদ্মার পানিতে আপনাকে চুবানোর কথাও হয়েছে। আপনার তো জেলে যাওয়ার কথা, হয়তো সময় আপনার জেলে থাকার কথা ছিল। হঠাৎ করে সবকিছু বদলে গেল। আপনিই এখন রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একটা অবাক করা, অদ্ভুত বিস্ময়কর পরিবর্তন। এমন কিছু যে হতে পারে, আপনি কি কখনো ভেবেছিলেন?

. ইউনূস: এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতার মতো। আমি দুদিন আগে জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরছিলাম। হঠাৎ করে জেলে না গিয়ে আমি বঙ্গভবনে গিয়ে শপথ গ্রহণ করলাম। একেবারে উল্টো একটা অবাক চিত্র। অতীতেও রকম আহ্বান জানানো হয়েছিল আমাকে। সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। মাফ চেয়েছি বরাবর। এটা কোনো দিন সিরিয়াসলি ভাবিনি যে দায়িত্ব নিতে হবে। এবার ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি। জন্য দায়িত্বও নিয়েছি।

প্রথম আলো: আপনি কীভাবে এই বিরাট পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগটা কীভাবে হলো? আপনি কোন পর্যায়ে এসে সম্মতি দিলেন?

. ইউনূস: ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। পত্রিকায় টেলিভিশনের নিউজে তাঁদের দেখছিলাম। বরাবর যেভাবে আন্দোলন হয়, এভাবেই দেখছিলাম। আমি তখন বিদেশে ছিলাম যখন এই আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছিল। প্যারিস অলিম্পিকে একটা দায়িত্ব পালন করছিলাম। ওটার ডিজাইনিংয়ে আমি ইনভলভড ছিলাম। সময়ে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। সেই সময় প্যারিসের একটা রাস্তার নাম আমার নামে নামকরণ করা হয়েছিল, সেটার উদ্বোধন করেছিলাম। কাজেই আমি এদিকে দেখছি, ওই দিকেও দেখছি, দূরের দৃশ্য হিসেবে।

আমার অফিস থেকে আমার সঙ্গে যারা যোগাযোগ রাখে তারা বলছিল: ‘স্যার এখন ফিরবেন না, এখন অবস্থা ভালো না। এলেই বোধ হয় আপনাকে জেলে নিয়ে যাবে। আপনি একটু দূরে থাকেন। পরিস্থিতি বুঝে আপনাকে বলব, কখন আসতে হবে।কাজেই আমি পরিকল্পনা করছিলাম বার্লিনে যাব, বার্লিনের পর রোমে যাব। তারপর ব্রাজিল যাব ইত্যাদি। দেশে ফিরে আসব এবং রকম একটা দায়িত্ব নিতে হবে, এটা একদম মাথায় ছিল না। সময় ছাত্রদের একজন আমার অফিসকে জানাল যে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। ছাত্রদের কথা এই প্রথম শুনলাম। জানতে চাইলাম, কী আলাপ করতে চায়। তখন আমাকে জানানো হলো, আপনাকে সরকারের দায়িত্ব নিতে হবে। আমি বললাম, এটা তো ভিন্ন কথা। তাকে বললাম, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে? সে জানাল, আলাপ হয়েছে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমিও আলাপ করি, কী বলে দেখি। সে যোগাযোগ করিয়ে দিল, আমি আলাপ করলাম। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমাকে এই দায়িত্ব দিয়ো না। বরাবরই আমি এই দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থেকেছি। এই দায়িত্ব নেওয়া ঠিক হবে না। তোমরা অন্য একজনকে ভালো করে খুঁজে দেখো। তারা বলল, না স্যার আর কেউ নেই। আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি তাদের আবার বললাম, তোমরা খোঁজ করো। খোঁজ করার পর আমাকে বলো, কী দাঁড়াল। তখন সে আমাকে জানাল, ঠিক আছে স্যার, কাল আপনাকে জানাব। পরদিন আবার সে ফোন করল। সে জানাল, স্যার, উপায় নেই। আপনাকেই আসতে হবে। আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। অবিলম্বে আসতে হবে।

অতীতে আমরা সংস্কারের দিকে যাইনি। শুধু এক সরকার থেকে আরেক সরকারে চলে গিয়েছি। এবার সংস্কারের একটা বিষয় এসেছে এবং সেটাকে আমরা সামনে রেখেছি।

            . মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান উপদেষ্টা


আমি তখন জানালাম, আমি তো এখন হাসপাতালে। আমি তো অত তাড়াতাড়ি আসতে পারছি না। আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে দেখি, কী বলেন উনি। তবে তোমরা যখন এত প্রাণ দিয়েছ এবং বলছ যে আমাকে দায়িত্ব নিতে হবে, যতই আমার আপত্তি থাকুক, আমি ব্যাপারে সম্মতি দিলাম। তবে আমি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে বলতে পারব, আমি কখন আসতে পারব। সে বলল, না স্যার, আপনাকে তাড়াতাড়ি আসতে হবে। আমি হাসপাতালে ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করলাম। ডাক্তার

 বললেন, আপনার তো আগামী দিনও হাসপাতালে থাকার কথা। আমরা চেষ্টা করি আপনাকে আগামীকাল ছেড়ে দিতে পারি কি না। পরদিন সকালে ওঠার পর ডাক্তার বললেন যে আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন। ডাক্তার ছেড়ে দিলেন। আমি দেশে চলে এলাম।

প্রথম আলো: এই সিদ্ধান্ত তো আপনি নিলেন। ছাত্রনেতারা ছাড়া বাইরের আর কারও সঙ্গে কি আপনার পরামর্শ করার সুযোগ হয়েছিল?

. ইউনূস: আর কে যে আছে, তা তো আমি জানি না। আমার কিছু জানা ছিল না।

প্রথম আলো: ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক...

. ইউনূস: এদের কারও সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না। তারা কারা, ঢাকায় এসে তাদের চেহারা আমি দেখেছি। তাদের সঙ্গে কথা হলো। এয়ারপোর্টে তারা ছিল। তখন তাদের সঙ্গে পরিচয় হলো।

প্রথম আলো: আপনি দেশের একটা সংকটময় পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছিলেন, দুই মাস আগে। সময়টা ছিল যথেষ্ট ঘটনাবহুল। সময়টা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

. ইউনূস: একেবারে দ্রুতগতিতে সবকিছু ঘটেছে। আমি ফিরে এলাম। সেদিন রাতেই শপথ গ্রহণ করলাম। সব ওলটপালট। দেশে ফিরে এসে কোথায় জেলে যাব, এখন অন্য দিকে চলে গেলাম! কী করতে হবে? এরা কারা? শপথ গ্রহণে কারা কারা থাকবে? সবকিছুই নতুন! সবকিছু ভিন্ন পরিস্থিতি। তবু মনে করলাম দায়িত্ব যখন তারা নিতে বলেছে, আমি রাজি হয়েছি, কাজেই আমি সে দায়িত্ব পালন করব। এভাবেই একটা অপরিচিত জগতের মধ্যে অপরিচিত সঙ্গী নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হলো। 

প্রথম আলো: আপনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। এরপর আপনার কখনো বঙ্গভবনে, গণভবনে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। নাকি গিয়েছেন?


. ইউনূস: আমি গিয়েছি যদ্দিন আওয়ামী লীগের বাইরের সরকার ছিল, তারা আমাকে আমন্ত্রণ করেছে। আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও আমি দাওয়াত পেয়েছিলাম এবং সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম।

প্রথম আলো: এবার আপনি আবার জাতিসংঘ অধিবেশনেও যোগ দিয়ে এলেন। সব প্রথা ভেঙে জো বাইডেনের সঙ্গে আপনার বৈঠক হলো। তারপর বিল ক্লিনটন। এর বাইরেও আরও অনেক রাষ্ট্রনেতা। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। আমরা দেখলাম, অনেক উৎসাহউদ্দীপনা বাংলাদেশের পরিবর্তনে এবং সেটা আপনাকে কেন্দ্র করে। আপনার উপস্থিতি, আপনার পরিচিতি অনেক কাজে লেগেছে। অনেক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। অনেক অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন। সব মিলিয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া পেলেন নতুন বাংলাদেশ নিয়ে?

. ইউনূস: একটা হলো, তাদের সবার মনে উৎসাহ জেগেছে। উৎসাহ জেগেছে যে এই দেশটা আবার নতুন করে দাঁড়াতে পারবে। দেশের যে গতিপ্রকৃতি তারা দেখছিল, তাতে তারা উৎসাহ বোধ করছিল না। এই পরিবর্তনের ফলে এবং আমাকে সামনে পেয়ে এদের অনেকেই খুব উৎসাহ বোধ করেছে। এদের অনেকেই ছিল আমার পরিচিত মুখ বন্ধু, যাদের সঙ্গে আমার আগে থেকে ঘনিষ্ঠতা ছিল। কাজেই আমাকে কাছে পেয়ে তারা খুব উৎসাহ বোধ করেছে। এবং সেই উৎসাহ তারা নানাভাবে প্রকাশ করেছে।

আমরা আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছি। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বৈঠক বন্ধুদের বৈঠকে পরিণত হয়েছে। আলাপ হয়েছে, কী দরকার তোমরা বলো, সেভাবে আমরা ব্যবস্থা নেব। সত্যি সত্যি তারা তাদের লোকজন নিয়ে এসেছে। অফিসারদের অনেকে আমাকে চেনে, যেহেতু নানা কাজে নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সেভাবেই তারা গ্রহণ করেছে এবং খুব উৎসাহসহকারে করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের সাহায্যসহযোগিতা কী দরকার আমাদের। আমিও একেবারে পরিষ্কারভাবে বলেছি যে অতীতের মতো করে দেখলে হবে না। নতুন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং নতুন ভঙ্গিতে চিন্তা করতে হবে। আগের ক্যালকুলেশন বাদ দিতে হবে। অনেক বড় স্তরের ক্যালকুলেশন দিতে হবে। আমরা বড় জাম্পে যেতে চাই। এবং আগে অনেক শর্ত দিয়ে যেভাবে রাখছিল, সেভাবে না। যার সঙ্গেই আলাপ হচ্ছিল, এই একটা বিষয়ে জোর দিচ্ছিলাম। তারাও অ্যাপ্রিশিয়েট করছিল। সঙ্গে সঙ্গে একজন তো ওখান থেকে ফোন করে নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছিল, ওইটা করে দাও।


আমরা কথা বলছি আর ফাঁকে ফাঁকে নির্দেশও চলে যাচ্ছে। তো খুব উৎসাহ বোধ করলাম। আমি বললাম, শুধু টাকার অঙ্ক বাড়ালে হবে না, এটার যে গতি...আমরা এখানে চুক্তি সই করলাম, ওই টাকা আসতে আসতে বহু বছর লেগে যায়, শেষ পর্যন্ত ওটা কাজে লাগে না। আমি বলেছি, আমাদের দ্রুতগতিতে দরকার। এই পরিবর্তনে আশু পরিবর্তন দরকার। কাজেই সব রকমের আয়োজনের যে ব্যবস্থা তোমাদের

 আছে, তা সংক্ষিপ্ত করে আমরা যাতে কাজে লেগে যেতে পারি, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে করো। সবাই অ্যাপ্রিশিয়েট করে বলল: আমরা বিষয়টা বুঝেছি। দ্রুতগতিতে যাতে হয়, আমরা সেটার ব্যবস্থা করব।

প্রথম আলো: তারা দ্রুতগতিতে করল। আপনাকেও তো সবাইকে নিয়ে দেশে কিছু করার বিষয়টি দেখতে হবে। সে জন্য সংস্কারের যে উদ্যোগগুলো আপনি নিয়েছেন, সেগুলো জরুরি।

. ইউনূস: অবশ্যই। আমাদের জোর ছিল সংস্কারে। আমাদের যদি সংস্কার করতে হয়, দ্রুতগতিতে করতে হবে। ধীরেসুস্থে সংস্কার করার সুযোগ আমাদের নেই। কাজেই সেই সংস্কারগুলো আমাদের এখন থেকে শুরু করতে হবে। একটা বিধ্বস্ত কাঠামোর ওপর আমরা শুরু করেছি।

প্রথম আলো: আমি এখানটায় আসছিলাম। আপনি তো বাইরে থেকে সরকারের ভেতরটা অতটা জানতেন না। সাধারণভাবে জানতেন অন্যায়, অবিচার, রাজনীতিকরণ, দুর্নীতি ইত্যাদি। তো আপনি এসে কী দেখলেন? কী পেলেন?

. ইউনূস: ভাঙা হাট। কোনো জিনিস ফাংশন করে না। একটা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্ট্রাকচার আছে, এক ব্যক্তিপূজার জন্য যা যা লাগে, সে ব্যবস্থাগুলো আছে। ওনার হুকুমে কী কী হয়, ওনার ইচ্ছাপূরণের জন্য সব ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের ইচ্ছাপূরণের জন্য তাদের কোনো ব্যস্ততা নেই। কাজেই রকম একটা ভাঙাচোরা জনপ্রশাসন নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হয়েছে।

প্রথম আলো: আপনাদের যাত্রা তো অনেক কঠিন...

. ইউনূস: অত্যন্ত কঠিন।

প্রথম আলো: আপনি আসার আগে এতটা বুঝেছেন কি?

. ইউনূস: ভেতরে ঢুকে পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল। আগে আবছা আবছা বুঝতাম যে এটা রকম। কিন্তু এটা যে এত ভাঙা, তা বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল। নির্দেশ কী উদ্দেশ্যে দিয়েছিল, কী করেছিল এবং টাকাটা কীভাবে খরচ হয়েছিল, চুক্তিটা কেন হয়েছিল, নানা রকম বিষয়। কাজেই টাকার বণ্টন কীভাবে হয়েছিল? সবকিছুর উদ্দেশ্য ছিল, যে যেখানে পারো নিয়ে নাও, এই হলো সুযোগ। এভাবেই চলেছে। সেই পরিস্থিতি থেকে নিয়মশৃঙ্খলায় আসা, আমাদের তো আর কোনো রাস্তা নেই। কাজেই এটাকে পরিষ্কার করে নিয়ে আসা খুব কঠিন কাজ।

প্রথম আলো: কাজটা কঠিন আবার সময়সাপেক্ষ। গত আগস্ট বিমানবন্দরে নেমেই বলেছিলেন, আপনার প্রথম কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করা। ক্ষেত্রে আপনারা কতটুকু সফল হলেন?

. ইউনূস: চেষ্টা করছি। এখনো সফল হইনি। এখনো তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। নানা রকম ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যার মধ্যে যেতে চাই না। কিন্তু এখনো উন্নতি হয়নি। কিঞ্চিৎ হয়েছে হয়তো। কিন্তু যে পর্যায়ে আসার কথা, সেই লেভেলে হয়নি। কাজেই আমাদের সার্বিক চেষ্টা হবে, ওটাকে আগে স্থির করা। এটা প্রথম কাজ। এটা না করলে তো বাকি জিনিস করতে পারছি না।

প্রথম আলো: অবশ্য কাজটা এত সহজও নয়। পুলিশ বাহিনী ভেঙে পড়েছে। এখন মানুষকে আশ্বস্ত করবেন কী দিয়ে? আপনি কি প্রশাসন থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন?

. ইউনূস: ওপর থেকে তো সব সহযোগিতা আছে। কিন্তু গুঞ্জন শুনি, এখানে গোপনে বসে আছে। আমরা এগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। এগুলো শুনলে কিন্তু কোনো কাজ করা যাবে না। যেভাবে আছে, সেভাবেই আমরা চলছি। যেহেতু পুলিশের পুরোপুরি সার্ভিসটা আমরা পাচ্ছিলাম না, সে জন্য আমরা সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন এগিয়ে আসে। তারা এগিয়ে এল। তারপর বলল, আমাদের তো কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। জন্য তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার প্রসঙ্গটি উঠল। আমরাও রাজি হলাম। প্রাথমিকভাবে তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দুই মাসের জন্য দিলাম। যাতে করে তারা মাঠে নামতে পারে।

প্রথম আলো: দুই মাস সময়টা কি আপনি যথেষ্ট মনে করছেন?

. ইউনূস: আমরা মনে করলাম, প্রথম দুই মাস দিয়ে দেখি। যদি মনে হয় কাজ হচ্ছে, তাহলে তো তা বাড়াতে হবে। আশা করি, তারাও সম্মত হবে। এটা নিয়ে আমরা অগ্রসর হতে চাইছি। তবে দুই মাস পরীক্ষামূলক বিষয়। নানা রকমের দুশ্চিন্তাও আসে। এটাতে ক্ষমতার অপব্যবহার হয় কি না। একজন না বুঝে ক্ষমতার একটা অপব্যবহার করে ফেলল, তাহলে তো সেনাবাহিনীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সেনাবাহিনীর একজন সদস্য, অফিসার যদি তা করে, এটার দুর্নাম সেনাবাহিনীর ওপর আসবে। আমাদের ওপরও আসবে, কেন আপনি এটা দিলেন। আমরা সেটাও দেখতে চাইছি, তারাও সুন্দরভাবে করার চেষ্টা করছে।

প্রথম আলো: আপনি বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছেন। কাজের যা অগ্রগতি, তাতে কি আপনি সন্তুষ্ট?

. ইউনূস: এটা নির্ভর করে আপনি কি এক্সপেক্ট করেন। সরকার একটা মহাইঞ্জিন। এই মহাইঞ্জিন আমরা চালু করার চেষ্টা করছি। প্রথমে আমরা ফার্স্ট গিয়ার দিয়ে চেষ্টা করছি, চালানো যায় কি না। এটা নড়লে আমরা সেকেন্ড গিয়ার, থার্ড গিয়ারের দিকে যাব। এটা হলো বিষয়। আমরা এক ধাপে থার্ড গিয়ারে চলে গেলাম, ফুল স্পিডে চলে গেলাম, এটা সম্ভব না। কাজেই ওই গতিটা আমাদের অ্যাডজাস্ট করতে হবে। তারপর যেন পুরো স্পিডে যেতে পারি। এটা কিন্তু বেশি সময় দিলে তা হচ্ছে না। আমাদের তো কাজের মধ্যে নামতে হবে। কাজ তো অনেক, অফুরন্ত কাজ আছে।

প্রথম আলো: আপনি যে গতির কথা বললেন, মানুষের একটা আকাঙ্ক্ষা যে দৃশ্যমান উদ্যোগ, গতি যেন তারা দেখতে পায়, বুঝতে পারে। রকম একটা অবস্থা। এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।

. ইউনূস: আমাদেরও মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। যেটা হচ্ছে তাতে আমরাও তো খুব খুশি না। এটা ঠক্কর ঠক্কর করে চলা তো কারও ইচ্ছা না। দেখেন যত দ্রুত আমরা চালু করে ফেলতে পারি, অগ্রসর হতে পারি নরমাল স্পিডে, সেটাই আমাদের চেষ্টা।

মুখে যে যা বলুক না কেন, ভেতরে সবাই সংস্কার চায়। ছাড়া গত্যন্তর নেই। আপনি পার পেয়ে যাবেন, আপনার ছেলেমেয়ে আটকে যাবে। এই গর্তের মধ্যে আবার পড়তে হবে। যেই গর্ত থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম। যেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আমরা বের হয়ে এলাম, সেই ধ্বংসস্তূপ আবার সৃষ্টি হবে। 

প্রথম আলো: এটাও তো বাস্তবতা যে এত পুঞ্জীভূত সমস্যার দ্রুত সমাধান করে ফেলা সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষ তারপরও দেখতে চায় যে আপনারা চেষ্টা করছেন।


. ইউনূস: কিছু ভালো হচ্ছে। যেমন সবাই বলছেন ব্যাংকিং সেক্টরে কিছু ভালো হচ্ছে। আবার এদিকে বলে যে পুঁজিবাজারে গোলমাল হচ্ছে। কাজেই একটা ভালো হয় তো আরেকটা খারাপ হয়। একটা শুধরে আসি তো আরেকটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

এর মধ্য থেকে আমাদের আসল কাজগুলো করে ফেলতে হবে। আমাদের নিয়মের মধ্য নিয়ে আসতে হবে সবকিছু। নিয়মটা যেন আমরা পালন করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচল ছিল, সেগুলো সচল করা ছাত্রদের নিয়ে আসা, ভিসি নিয়োগ করা। অফুরন্ত কাজ। কাজের কোনো শেষ নেই। যেদিকে দেখবেন, এগুলো খালি। অনেক বড় কাজ। এর মধ্যেই গতি সঞ্চার করা। একটা হলো কাজটা শুরু করা।

 

প্রথম আলো: আপনার এই বড় মেশিনে কাজ চালু করার জন্য আরও কোনো উদ্যোগ নেবেন। নতুন কোনো সদস্য উপদেষ্টা পরিষদে যোগ করবেন? আরও কিছু কমিশন করবেন?

. ইউনূস: কমিশনটা আমি অন্যভাবে দেখছি। যন্ত্রটার কথা বলি। যন্ত্রটা চালু করার জন্য মাঝেমধ্যে আলাপ হয়েছে যে আরও কয়েকজন সদস্য নিলে ভালো হয়। ব্যাপারে পাকা কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টা খোলা আছে। অবস্থাতেই আমরা আছি। তবে আমরা উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যসংখ্যা খুব একটা বাড়াতেও চাই না। এতেও একটা বড় রকমের সমস্যার সৃষ্টি হয়।

প্রথম আলো: আপনি জানেন যে বিগত সরকারগুলোর আমলে মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা ৬০৭০ ছিল...

. ইউনূস: আমরা ওই ধরনের চিন্তা করছি না। আমরা খুব ছোট আকারে যেতে চাইছি। দেখা যাক আমরা কত দূর পারি। সমস্যা হলো কি, টিম যত বড় হয়, তাতে ইশারা এবং একজনের সঙ্গে অন্যজনের সংগতিপূর্ণ কাজ করাটা মুশকিলের হয়ে যায়। ছোট টিমেও সমস্যা। নতুনভাবে সবাই সবার পরিচিত নয়। কাজেই টিম গঠন করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, সেটা দ্রুত করতে পারি না। চেষ্টার কমতি নেই। কিন্তু সফল হয়েছি, কথা বলার সময় আসেনি। 

প্রথম আলো: শিক্ষার্থীদের সমন্বয়কদের সরকার পরিচালনার অংশ করেছেন। তাঁরা উপদেষ্টা পরিষদেও আছেন। এটা একেবারেই নতুন এক অধ্যায়। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?


. ইউনূস: একটা হলো আমার অভিজ্ঞতা। একটা হলো আমার ধারণা। আমি বরাবরই বলে এসেছি যে তরুণদের হাতে পৃথিবী ছেড়ে দেওয়া দরকার। তারা আরেক জগতের মানুষ। আমরা তাদের আটকে রেখেছি। আমরা যারা বয়স্ক, তারা পুরোনো চিন্তা, পুরোনো ধারণা, পুরোনো কাঠামো নিয়ে তাদের আটকে রেখেছি। নতুনেরা তাদের নতুন ধারণা, নতুন চিন্তা, নতুন কাঠামো নিয়ে অগ্রসর হবে। পথ ছেড়ে দিতে হবে। কাজেই আমরা বলছি যে যত তাড়াতাড়ি পারি সব দায়িত্ব তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। আমাদের দায়িত্ব বাহবা দেওয়া। এটা আমার বক্তব্য ছিল। এখানে এসে সেই সুযোগ পেলাম। ওরা রাজি আমিও রাজি যে ঠিক আছে, আমরা কাজটা করি। যাঁরা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আছেন, তাঁদের চেয়ে এই ছাত্র দুজন

কোনো অংশে কম কেউ বলতে পারবেন না। শুধু আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে না, অতীতেরও উপদেষ্টামণ্ডলীর সঙ্গে যদি তুলনা করেন, কেউ বলতে পারবে না, এঁরা তাঁদের চেয়ে দুর্বল। তাঁরা অনেক সজাগ, সতর্ক। অনেক চিন্তাভাবনা করে কাজ করছেন।

প্রথম আলো: এটাও তো আমাদের দেশের জন্য একটা নতুন ধারণা।৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৯০এই আন্দোলনগুলো মূলত ছাত্রদের নেতৃত্বেই হয়েছিল। কিন্তু পরে দেশ পরিচালনা বা এটাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্ররা সেই সুযোগটা পায়নি। কাজেই এটা তো আমাদের জন্য একদমই নতুন।

. ইউনূস: আমাদের দেশের জন্য নতুন। অন্য দেশে তরুণদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অন্য দেশে তরুণেরা প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেছেন। ৩০৩৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট। কাজেই তরুণদের অবহেলা করার কোনো কারণ নেই।

প্রথম আলো: সেটা তো শুধু জুলাইআগস্ট নয়, কয়েক বছর ধরে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেটা তারা প্রমাণ করেছে। নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনা নতুন ধরনের নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

. ইউনূস: অবশ্যই।

প্রথম আলো: /১১এর সরকারকে সেনাবাহিনীর সরকার বলা হয়ে থাকে। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে সেনাবাহিনী ছিল, সামনে কয়েকজন ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তি। এখন সেনাবাহিনী আপনার সঙ্গে আছে, উদ্যোগ নিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে। বিশেষ করে জুলাইয়ের শেষ দিনগুলো, আগস্টের প্রায় দুই সপ্তাহ। মোটামুটি প্রক্রিয়াটাকে একটা জায়গা নিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা তাদের ছিল। এখন নির্বাচন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ভূমিকা আপনি কী দেখেন? কী চান? বা কী মনে করেন?

. ইউনূস: আমি যেটা মনে করি, সেনাবাহিনীও সেটা বোঝে। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা হওয়া উচিত, সে ভূমিকা পালন করবে। সেটা সরকারের যেসব নির্দেশ থাকবে, সেটা তারা পালন করে যাবে। সেটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নমুনা। শুরুতেই যদি আমরা সেই ভূমিকাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলি, তাহলে তো গণতন্ত্র আর এগিয়ে যেতে পারল না। এখানেই শেষ হয়ে গেল। তো সেখানে আমাদের আর থাকারইবা দরকার কী! যেখানে গণতন্ত্র নেই, সেখানে আমাদের কোনো ভূমিকাও নেই।

প্রথম আলো: এবার কিন্তু আমরা /১১এর চেয়ে অন্য রকম দেখি। সেনাবাহিনী সামনে আসছে না। এটা হয়তো আপনাদের প্রতি তাদের বিশ্বাস, আস্থা। এটাও একটা বড় কারণ।

. ইউনূস: আমিও সে কথাই বলছি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা হওয়া উচিত, সে ভূমিকাই তারা পালন করছে এবং করে যাবে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর যে ভূমিকা হওয়া উচিত, সে ভূমিকাই তারা পালন করছে এবং করে যাবে।

. মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান উপদেষ্টা

 

প্রথম আলো: সেখানে আপনি তাদের সব সহযোগিতা পাচ্ছেন?

. ইউনূস: আমাদের তো পর্যন্ত কোনো কমপ্লেইন করার সুযোগ হয়নি। বরং আমি বাহবা দিয়ে এসেছি। বাহবা দিয়েছি জন্য যে পরিবর্তনটা হলো, সেনাবাহিনী যদি এগিয়ে না আসত, এটা তো রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে যেতে পারত। কাজেই তারা এগিয়ে এসেছে। ঠান্ডা মাথায় কাজটা করেছে এবং ছাত্রদের সামনে রেখে। বলেনি যে তোমরা সরো, এবার আমরা নিয়ে নিলাম। বলেনি তারা।

প্রথম আলো: অনেক রক্তারক্তির মধ্যে তারা এসেছে। পরে এসে তারা এটাকে সামাল দিয়েছে। প্রক্রিয়াটাকে অগ্রসর করে দিয়েছে। 

. ইউনূস: না হলে তো আরও রক্তারক্তি হতে পারত। যদি সেটা তারা সে সময় না করত; ভয়ংকর ব্যাপার হতো। 

প্রথম আলো: বিশেষ করে আগস্ট তাদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, জনগণের বিরুদ্ধে তারা গুলি ছুড়বে না।


. ইউনূস: এটা মস্ত বড় একটা সিদ্ধান্ত।

প্রথম আলো: আমরা দেখছি যে আপনাদের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে এটা হয়, হওয়া উচিত। কমিটি গঠন, পুনর্গঠন, কোনো সিদ্ধান্তএতে মানুষের মধ্যে কিছু প্রতিক্রিয়া আছে। এটা সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ কি না, সেটাও আলোচিত হয়। আবার কখনো মনে হয় সমন্বয়হীনতা। রকম কিছু সমস্যা কি আপনি দেখেন?

. ইউনূস: একেকজন একেকভাবে দেখতে পারে। আমি বলব, সরকারের একটা স্ট্রং পয়েন্ট হচ্ছে, আমরা ভুল করলে শুধরে নিচ্ছি। আমরা গোঁয়ার্তুমি করে ধরে রাখলাম না। আমি সরকার বলে ফেলেছি, এটা আর পাল্টানো যাবে না, যা হওয়ার হবে। রকম তো আমরা করছি না। পরে আমরা দেখলাম, এভাবে না করে অন্যভাবে করলে ভালো হয়, পরে সেটা করে দিয়েছি। আমাদের এটা সবলতা মনে করি। আমাদের পুনর্চিন্তা করার শক্তি আছে। ভুল মনে করলে সংশোধন করছি। আরও ভালো করার চেষ্টা করছি। যেটা যথাযথ, সেটাই করছি।

প্রথম আলো: একটা বড় পরিবর্তন হয়ে গেল। সুযোগ আগেও এসেছিল।৯০এর এরশাদ পতন, কয়েকটা ভালো নির্বাচন, ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ইত্যাদি। তারপরও তো তেমন পরিবর্তন হয়নি। চরম স্বৈরতান্ত্রিক একটা সরকার পেলাম আমরা। আমরা তো শিক্ষা নিই না। এবার কি আমরা শিক্ষা নেব? আপনি কতটুকু আশাবাদী?

. ইউনূস: আমি এভাবে দেখি। মস্ত বড় একটা সুযোগ এসেছে আমাদের জাতির জীবনে। রকম সুযোগ অতীতের যত বর্ণনা দিলেন, কোনোকালেই আসেনি। ছাত্ররা একটা সুন্দর বাক্য ব্যবহার করেছে এবং আমরা সবাই সেটা গ্রহণ করি। সেটা হলো সংস্কার। অতীতে আমরা সংস্কারের দিকে যাইনি। শুধু এক সরকার থেকে আরেক সরকারে চলে গিয়েছি। এবার সংস্কারের একটা বিষয় এসেছে এবং সেটাকে আমরা সামনে রেখেছি। এই হলো মুখ্য বিষয়।

এই অন্তর্বর্তী সরকারের বড় বিষয় হলো সংস্কার। নির্বাচন তো যেকোনো সময় যে কেউ দিতে পারে। আছে নিয়মমাফিক দিলাম, কেউ ভোট চুরি করল, দখল করলাম। কিন্তু এবার হলো সংস্কার। সংস্কার মানে হলো অতীতে যা যা ঘটেছে, আমরা সেগুলোর পুনরাবৃত্তি হতে দেব না। এটার জন্য আমাদের বুদ্ধিতে যতটুকু কুলায় ১০০ ভাগ হয়তো হবে না, তবে কাছাকাছি যতটা যাওয়া যায়, সারা জাতিকে একত্র করে করতে হবে। গায়ের জোরে নয়। অন্তর্বর্তী সরকার বসে কিছু করবে না। সবাইকে নিয়ে করবে। আপনারা বলেন, কী হলে সে জিনিসগুলো ভবিষ্যতে হবে না, সে জিনিসগুলো দিন। আমরা সবাইকে বোঝাই, রাজনৈতিক দলগুলোকে বোঝাই, বলেন আপনারা কী কী সংস্কার করতে চান। সুযোগ কিন্তু আপনারা আর পাবেন না। নির্বাচিত সরকার এসে গেলে সুযোগ আর পাবেন না। সম্ভব হবে না। আইনতই সম্ভব হবে না। আমাদের দিয়ে সেটা করিয়ে নিতে পারেন। যেমন সংবিধান সংশোধন। পারবেন না। এটা আমাদের দিয়ে করিয়ে নিতে পারবেন। আপনাদের কাজটাই আমরা করে দেব। আমরা একটা খসড়া বানিয়ে দিচ্ছি আপনাদের। কাজের সুবিধার জন্য। এটা ছিঁড়ে ফেলে দিন। আরেকটা বানিয়ে নিন। আমাদের আরেকটা দিন। আপনাদের নিয়ে করি।

আমি বরাবরই বলে এসেছি যে তরুণদের হাতে পৃথিবী ছেড়ে দেওয়া দরকার। তারা আরেক জগতের মানুষ। আমরা তাদের আটকে রেখেছি। আমরা যারা বয়স্ক, তারা পুরোনো চিন্তা, পুরোনা ধারণা, পুরোনো কাঠামো নিয়ে তাদের আটকে রেখেছি। 

প্রথম আলো: এই সংস্কারের কাজে আপনার একদুইতিন লক্ষ্য কী?


. ইউনূস: প্রথম হলো সংবিধান, মস্ত বড় বিষয়। সংবিধান সংশোধন করতে হবে। জুডিশিয়ারি সংশোধন করতে হবে। ছয়টা যে কমিশন করলাম, এর প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আরও কমিশন নিয়ে আসছি। কয়েক দিনের মধ্যে এগুলো পেয়ে যাবেন। সেগুলো আসলে দেখবেন যে অনেকগুলো বিষয় আমরা দিচ্ছি। মনের মধ্যে

অনেক কথা জমে আছে। লেখালেখি আপনারা অনেক করেছেন। শুধু একটা কাগজ সামনে রেখে সবাইকে একমত করে বলেন, কত দূর যেতে চান। আপনারা যেভাবে ঠিক করে দেবেন, সেভাবেই হবে। আমাদের কাজ শুধু ফেসিলিটেট করা। সুযোগটা এখন আছে আমাদের কাছে। আপনারাই এটা সৃষ্টি করেছেন। আমরা সৃষ্টি করিনি।

প্রথম আলো: এখন চারপাশে যা দেখেন, এতে কি আপনি আশাবাদী? রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে নিয়ে কমিশনের উদ্যোগে আপনারা কত দূর পর্যন্ত করে যেতে পারবেন?

. ইউনূস: আমি এক ভাগ আশাবাদী। কারণ, সবাই সংস্কার চায়। মুখে যে যা বলুক না কেন, ভেতরে সবাই সংস্কার চায়। ছাড়া গত্যন্তর নেই। আপনি পার পেয়ে যাবেন, আপনার ছেলেমেয়ে আটকে যাবে। এই গর্তের মধ্যে আবার পড়তে হবে। যেই গর্ত থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম। যেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আমরা বের হয়ে এলাম, সেই ধ্বংসস্তূপ আবার সৃষ্টি হবে। কাজেই সংশোধনের দায়িত্ব আপনাদের, আমরা শুধু ফেসিলিটেট করে যাচ্ছি।

প্রথম আলো: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় অনেক হত্যাকাণ্ড হয়েছে, বিচার সবাই চাইছেন। অনেক কথা বলা হচ্ছে, আপনি বলছেন। শেখ হাসিনার বিচার চাওয়া হচ্ছে। তিনি এখন ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁর বিচারটা বা তাঁর প্রত্যর্পণ নিয়ে, তাঁকে ফিরে পাওয়ার কথাটাও বলা হচ্ছে। এই বিচার বা শেখ হাসিনার বিচার, তাঁকে ফিরে পাওয়া বিষয়ে কোনো চিন্তা আপনার বা আপনাদের আছে?

. ইউনূস: এসবে আমাদের থাকার দরকার নেই। আমরা বিচারব্যবস্থা সংস্কারে বসেছি। বিচারব্যবস্থার সংস্কার করলে সংস্কারের ভেতর দিয়ে কার বিচার করবেন, কীভাবে বিচার করবেন, কে বিচার করবে, সবকিছু আসবে। এখন আমরা তো পলিটিক্যাল ডিসিশন দিতে যাচ্ছি না। আমরা শুধু পরিমণ্ডলটা সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। এই পরিমণ্ডল দিয়ে যেভাবে অগ্রসর হতে চান, সেভাবে হবে। আপনারাই বানিয়ে দিয়েছেন, আমরা শুধু ফেসিলিটেট করে দেব।

প্রথম আলো: কিন্তু এসব অন্যায়-অবিচারের পেছনে একটি সরকার, সরকারপ্রধান, মন্ত্রিপরিষদ বা নেতৃবৃন্দ ছিলেন, তাঁদের ব্যাপারে তো আলোচনা বা দাবি এসেছে...

. ইউনূস: সে জন্য তাঁদের যেখানে পাওয়া যাচ্ছে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সবকিছু হচ্ছে। বিচার করছি না কিন্তু। বিচারটা আগে ঠিক করেন, কীভাবে বিচারপ্রক্রিয়া হবে। সেই বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার করবেন।

প্রথম আলো: এই গ্রেপ্তারগুলো নিয়ে বা মামলা দেওয়ার বিষয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। কতটুকু সত্য বা কতটুকু অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে বা মামলা করে এই বিচারকে কতটুকু এগিয়ে নেওয়া যাবে। এসব প্রশ্ন মানুষের মনে আছে। সন্দেহ দাঁড়িয়ে গেছে। অনেকে বলতে চায় যে অতীতের মতোই মামলাগুলো হচ্ছে, গায়েবি মামলা। দায় তো আপনাদের ওপর এসে পড়ছে, যদিও সরকার মামলা করছে না। দায় তো আপনি এড়াতে পারছেন না।

. ইউনূস: সে জন্যই জুডিশিয়ারির সংস্কার দরকার। আমি একা বলে দিলে তো হবে না। এটা তো তাহলে বিচার হলো না। এটা আইনের ভেতর দিয়ে আইনমতো হচ্ছে। কিন্তু আইনটা ভালো নয়। আইনগুলো পাল্টানো দরকার। কাজেই সেভাবেই আসতে হবে। আমরা এককভাবে একটা ঘোষণা দিয়ে দিলাম, তাহলে তো আবার আমরা একনায়কতন্ত্রের দিকে চলে গেলাম। আমরা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসতে চাচ্ছি। ধীরে আসতে চাচ্ছি। বিচারপ্রক্রিয়া এমন জিনিস, এখানে যে ভুল হচ্ছে না, তা নয়। ভুল হচ্ছে। ভুলটা ধরিয়ে দিলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করার চেষ্টা করছি। আবার বলছেন আপনারা সিদ্ধান্ত পাল্টান। জন্যই আমাদের ভুল ধরিয়ে দিলে আমরা সিদ্ধান্ত পাল্টাই।

প্রথম আলো: এর মধ্যে সমাজে হানাহানি-বিদ্বেষ, এগুলো খুব দেখা যায়।মব জাস্টিসবলে একটা জিনিস চালু হয়ে গেছে। বেশ কিছু মানুষ মারা গেছেন।  সমাজের মধ্যে একটা অস্থিরতা এসে গেছে। এটাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?

. ইউনূস: ওই যে অ্যান্ড অর্ডার স্টাবলিশ করা। এগুলো হলো অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশনের বিষয়। এখানে কোনো রাজনৈতিক বিষয় নেই। এখানে যে হত্যাকাণ্ড, মব জাস্টিস হচ্ছে, এগুলো হচ্ছে অ্যান্ড অর্ডারের বিষয়। অ্যান্ড অর্ডার শক্ত করতে পারলে জিনিসগুলো হবে না। সামাজিক তৎপরতা যদি বাড়াই, মানুষ মানুষের প্রতি যত্ন নেয়, তাহলে এগুলো হবে না। সরকার গিয়ে মারামারি থামাতে পারবে না। মারামারি করলে শাস্তি হবে, এটুকু আমরা বলতে পারি। আমরা বারবার বলছি, আমরা একটি পরিবার। আমাদের মতের ভিন্নতা থাকতে পারে। জন্য কেউ কারও শত্রু নই। জিনিসটা যেন আমরা পরিষ্কার রাখি।

 

প্রথম আলো: আরেকটা বড় দাবি এসে যাচ্ছেআওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, বেআইনি করা হোক। তাদের রাজনৈতিক তৎপরতা করতে দেওয়া না হোক; তারা যাতে নির্বাচনে যোগ দিতে না পারে। বিষয়ে কী বলবেন?

. ইউনূস: এটাও আমাদের কোনো সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। কাজেই যখন রাজনৈতিক দলগুলো বসবে, তারা সিদ্ধান্ত নেবে। যত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আছে, সেগুলো আমরা রাজনীতিবিদদের কাছে নিয়ে যাব। তাঁরা যেভাবে সিদ্ধান্ত দেন।

প্রথম আলো: কিন্তু আপনাদের একটা অবস্থান তো থাকবে। সেটা তাহলে কমিশনের মাধ্যমে আসবে?

. ইউনূস: কমিশন যদি মনে করে যে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে, যখন নির্বাচনের বিষয় আসবে, সেখানে আলাপ হবে। অতএব ওটাও আবার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যাবে। ওটা খসড়া করবে তারা। কমিশন করলেই যে সেটা চূড়ান্ত হয়ে গেল, তা কিন্তু নয়। কমিশনের সুপারিশ রাজনৈতিক দলের কাছে যাবে। রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করে, আলাপ-আলোচনা করে এটার সিদ্ধান্ত দেবে, কোন দিকে আমরা অগ্রসর হব।

প্রথম আলো: মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বহুল আলোচিত বিষয়। বিগত সরকারের আমলে এবং এর আগেও এটা নানাভাবে ব্যাহত হয়েছে। আমরা নানাভাবে নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছি। আপনি আমাদের কীভাবে আশ্বস্ত করবেন যে ভবিষ্যতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সত্য বলা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অব্যাহত থাকবে?

. ইউনূস: আপনি ১৫ বছর পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকতে পেরেছেন। এই ১৫ বছরে আপনাকে ঢোকার সুযোগ আগের সরকার দেয়নি। এই যে সরকারের কাছে যেতে পারাটা, এটা হিমালয় পর্বত অতিক্রমের মতো। এখন অতিক্রম হয়ে গেছে। এখন তো কোনো বাধা আপনার জন্য নেই। আপনি কখন আসবেন, কখন যাবেন, কখন চাইবেন, সেটা আপনার ওপর নির্ভর করবে। আমাদের এটার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রথম আলো পত্রিকা কার কাছে যেতে পারবে, কার কাছে যেতে পারবে না, সেই নির্দেশ দেওয়ার মালিক তো আমি নই। কারা বিজ্ঞাপন পাবেন, আর কারা বিজ্ঞাপন পাবেন না, সেটা বলার কোনো ক্ষমতা আমার নেই। আমরা এই ক্ষমতা চাই না। কেন আমরা সেই ক্ষমতা নিতে যাব? আপনারা মন খুলে লেখেন। সমালোচনা করেন। না লিখলে আমরা জানব কী করে যে কী হচ্ছে আর কী হচ্ছে না। আমরা তো ফেরেশতা নই যে সবকিছু ঠিকমতো হয়ে যাচ্ছে। কাজেই আপনারা বললে আমরা একটু সতর্ক হই।

তারপরও তো কতগুলো আইনকানুনের ব্যাপার আছে। বিধিমালা-নীতিমালা রয়েছে। পুরোনো আইন আছে, যেগুলো ক্ষতিকর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য।

. ইউনূস: সে জন্য আমরা মিডিয়া কমিশনের কথা বলেছি। মিডিয়া কমিশন আমাদের ধরিয়ে দেবে, হয় আইনগুলো পাল্টানো দরকার, না হলে বাতিল করে দেওয়া দরকার। আমরা এখানে কোনো আইনের জন্য লড়াই করছি না। আমাদের তো কোনো স্বার্থ নেই; যাতে পরবর্তী সময়ে কোনো প্রজন্ম এই অভিযোগ আমাদের দিতে না পারে যে এরা বাধার সৃষ্টি করে গেছে।

# বিচারব্যবস্থার সংস্কার করলে সংস্কারের ভেতর দিয়ে কার বিচার করবেন, কীভাবে বিচার করবেন, কে বিচার করবে, সবকিছু আসবে। এখন আমরা তো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দিতে যাচ্ছি না।
#
আমরা এককভাবে একটা ঘোষণা দিয়ে দিলাম, তাহলে তো আবার আমরা একনায়কতন্ত্রের দিকে চলে গেলাম।
#
যত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আছে, সেগুলো আমরা রাজনীতিবিদদের কাছে নিয়ে যাব। তাঁরা যেভাবে সিদ্ধান্ত দেন, সেভাবে কাজ হবে।

প্রথম আলো: একটা প্রশ্ন আছে, আপনারা কত দিন দায়িত্বে থাকবেন? নির্বাচন কবে দেবেন? কথা এসেছে দেড় বছর, দুই বছর। অনেকে আবার বলেন তিন বছর। এমন কোনো সময়সীমা নির্ধারণের সুযোগ আপনার হয়েছে?

. ইউনূস: আমরা নিজেদের মধ্যে বিষয়ে আলাপ করি। আমাদের কাছে কাজটা তো পরিষ্কার। কাজটা হলো নির্বাচনের প্রস্তুতি। এই কাজ আমাদের শুরু করে দিতে হবে। কাজেই নির্বাচনের প্রস্তুতির একটা স্টিম চলতে থাকবে। তার সঙ্গে সংস্কারের কাজ। দুটি একসঙ্গে যাবে। এটি কোনো আলাদা জিনিস নয়। একটা শেষ করে আরেকটা ধরব। নির্বাচনের প্রস্তুতি দিয়ে নির্বাচন চলবে। কখন, কোথায় কী করা যায়, কত দূর যাব। আবার সংস্কার। কারণ, সংস্কার হলো আমাদের কেন্দ্রবিন্দু। এই নির্বাচনটা হচ্ছে সংস্কারকে এস্টাবলিশ করার জন্য। কাজেই যখন দেখা যাবে নির্বাচনের প্রস্তুতিও হয়ে গেছে, সংস্কারের কাজ গোছানো হয়ে গেছে। এক্সিকিউট করা হয়নি। তখন প্রশ্ন উঠবে, সংস্কারটা করে যাবেন, নাকি নির্বাচনে চলে যাবেন। এটা আপনাদের বিষয়। আমরা প্রস্তুতিটা চালিয়ে যাব। আপনারা দেখবেন, আমরা কোনটাতে কত দিন খাটাচ্ছি। এটা আপনাদের দৃষ্টিতে থাকবে। কাজেই সময় বেঁধে দিলাম, এর মধ্যে দেব। এর মধ্যে যা পান দিয়ে যান, রকম তো বিষয়টা নয়। বিষয়টা হলো দুটি প্রস্তুতি থাকবে। যদি বলেন যে নির্বাচন দিন। নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত তো আমরা আছি। আগে নির্বাচন হলে সেটা ভুল কাজ হবে। আরেকটা হতে পারে, আগে সংস্কারটা করে দেন। নির্বাচনটা পেছনে রেখে এসেছি, যাতে আমরা সময়টা পাই। আমরা নির্বাচন সংস্কার নিয়ে একই গতিতে যাব। এক জায়গাতে গিয়ে নির্বাচনের কাজ সমাপ্ত হয়ে যাবে। যেকোনো তারিখ ঘোষণা করলে নির্বাচন হয়ে যাবে। বলব যে আমরা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করব, নাকি আরেকটু এগিয়ে যাব। সেভাবেই সময় নির্ধারণ হবে।

প্রথম আলো: তার মানে নির্বাচনের সময়সীমার বিষয়টি সংস্কারের ওপর নির্ভর করছে?

. ইউনূস: অনেকটা নির্ভর করে। পুরো জিনিসটা হচ্ছে আপনারা কী চান, সেটার ওপর নির্ভর করছে। তারিখ ঘোষণা করে আমার কী লাভ। যদি কেউ মনে করে ওদের একটা অভিসন্ধি আছে। বহুদিন ধরে থাকতে চায়। আপনি তাঁদের (উপদেষ্টাদের) চেহারাগুলো দেখেন। সব বন্দীর মতো রয়েছে, আমাদের ছেড়ে দিন, আমরা যাই। কেউ কেউ বলে যে আমি তো ছেলেমেয়ে নিয়ে বাঁচতে পারব না। আমাকে যে বেতন দেন, আমি একটা ছেলেকে বিদেশে পাঠাই। খরচ দিতে হয়, আমি কোথা থেকে দেব। তাড়াতাড়ি শেষ করে দিই আমরা হলো আমাদের অবস্থা। আমরা কেউ থাকার দিকে নই। আমরা চাই বিষয়গুলো যেন সঠিক হয়। সেটাই আমাদের লক্ষ্য। বারবার যে কথাটা বলছি, জাতির জীবনে এই সুযোগ আর আসবে না। এই সুযোগ তো এখন আছে। সুযোগটা পুরোপুরি ব্যবহার করুন। আমাদের উপলক্ষ করে কাজটা আপনারা করেন, যেন আমরা সবাই মিলে বলতে পারি আমাদের সুযোগ এসেছিল, আমরা সেই সুযোগটা গ্রহণ করেছিলাম। কেউ যেন না বলে সুযোগ এসেছিল, আমরা সেই সুযোগ গ্রহণ করিনি। তোমরা পারোনি।

শুধু যদি গত ১৫ বছরই ধরি, আমরা তো শুধু দলাদলি শিখেছি, বিভক্তি শিখেছি, দূরত্বই শিখেছি। কে কাকে মারবে, কাটবে, কেড়ে নেবে, কাকে কত দূরে সরাবে, কাজেই সে সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

প্রথম আলো: সবার সঙ্গে বন্ধুত্বএটাই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি। এবং এই নীতি নিয়েই আমরা চলি। আমাদের দেশের ভৌগোলিক ভূরাজনৈতিক কারণে নানা দেশের সঙ্গে নানা অবস্থান আমাদের নিতে হয়। ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। অতি সম্প্রতি দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। কথায়, আচরণে, ব্যবহারে তার প্রকাশ ঘটছে। এই অবস্থার পরিবর্তন, দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক হয় এবং তা যেন ভারসাম্যমূলক হয়, জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

. ইউনূস: আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কটা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় নেই। এটা তাদেরও দরকার, আমাদেরও দরকার। এটা অর্থনীতি, নিরাপত্তা, পানির প্রবাহযেদিক থেকেই চিন্তা করুন না কেন। একে অপরকে ছাড়া চলা তো আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে যাবে। কাজেই এটা স্বাভাবিক যে আমাদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ হতে হবে, সুসম্পর্ক হতে হবে সবকিছুতেই। কারও মনে যাতে এমন ধারণা না হয় যে কেউ কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে। সার্বভৌম দুটি দেশের মধ্যে যে ধরনের সুসম্পর্ক হয়, সে ধরনের সম্পর্ক এটা। এটা আমরা সব সময় চেষ্টা করে যাব। হয়তো ভারত মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে যে সমস্ত ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে তাতে। তারা এই পরিবর্তনগুলো পছন্দ করেনি। এটা তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে, সারা পৃথিবী যখন আমাদের গ্রহণ করছে, তারা আমাদের গ্রহণ না করে কোথায় যাবে। যেহেতু তাকে সুসম্পর্কে আসতে হবে এটা এমন নয় যে আমরা তাকে বাধ্য করছি। এটা তার নিজের কারণেই প্রয়োজন। আমাদের প্রয়োজনে যেমন তাদের দরকার, তেমনি তাদের প্রয়োজনে আমাদের দরকার। কাজেই সাময়িক বিষয়গুলো আমাদের ভুলে যেতে হবে। কে কার সম্পর্কে কী বলল, কটু মন্তব্য করল, এগুলো বলে লাভ নেই। এগুলো কথার ফুলঝুরি। মূল জিনিসটা হলো আমাদের সুসম্পর্ক করতে হবে। সে জন্য যা কিছু দরকার, সেটা নিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।

আমি বারবার সার্কের কথা বলে এসেছি। এবারও বলেছি। উৎসাহ ছিল। সার্কের সরকারপ্রধানেরা আমার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু শুধু ভারতের সঙ্গে আমার বৈঠকটা হলো না। না হলে সবার সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। শ্রীলঙ্কা আসতে পারেনি। কারণ, মাত্র সে প্রেসিডেন্ট হয়েছে। এলে তার সঙ্গেও বৈঠক হতো। কাজেই আমরা চেষ্টা করছি অন্তত আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে হলেও সার্কের দেশগুলো দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুললাম, এই সার্কের সঙ্গে আমরা একত্রে আছি।

প্রথম আলো: তার মানে আপনারা পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কটাকে ভারসাম্য করার ওপর প্রাধান্য দিচ্ছেন?

. ইউনূস: সম্পর্কটাকে অত্যন্ত মজবুত করা এবং একই সঙ্গে সার্ককে জোরদার করা।

প্রথম আলো: সার্ককে আপনি অনেকটা সামনে নিয়ে এসেছেন। এক দশক ধরে সার্কের কার্যকারিতা নেই।

. ইউনূস: সার্কের জন্ম থেকে আমি এটার পেছনে আছি। আমি মনে করি যে এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি এত ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ববিভেদ থাকা সত্ত্বেও জোট করে ঘনিষ্ঠভাবে চলতে পারে, আমাদের তো ওই রকম দ্বন্দ্বের কোনো ইতিহাস নেই। আমরা কেন পারব না? একত্রে হলে আমাদের কত সুযোগ-সুবিধা বেড়ে যেত। সার্কে আমাদের ঘুরেফিরে আসতে হবে, সেটা আমরা সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। আমার সঙ্গে যাদের দেখা হয়েছে, তারা সবাই বলেছে, আমরা সার্ক চাই।

প্রথম আলো: কিন্তু প্রধান সমস্যা তো ভারত আর পাকিস্তানের সম্পর্কটা?

. ইউনূস: ওটা তো সমাধান করা যায়। সমস্যা হলেই যে রাখতে হবে বলে তো কথা নেই। এটার সমাধান আছে তো। আমি সার্ক রাখব এবং এই সমস্যা জিইয়ে রাখব, ওটা তো হবে না। সমস্যার যে শেষ সমাধান হতে হবে, তা নয়। একটা মোটামুটি সমাধান সার্ক চলার মতো আমরা করতে পারি। যে সমস্ত বিষয় আপনি স্থগিত রাখতে চান, পাকিস্তানের সঙ্গে সেগুলো রেখেও তো এগোনো যায়। কাজেই এটা আমার একটা বড় নীতি থাকবে, আমি চেষ্টা করব।

আরেকটা হলো আসিয়ান। আসিয়ানের সদস্যপদ আমরা যেন পাই। তাহলে সার্ক একদিকে আর আসিয়ান একদিকে, মাঝখানে বাংলাদেশ। দুই জোটের সঙ্গে একত্রে থাকলাম। তাহলে আমরা একটা বৃহত্তর অবস্থানে থাকলাম।

প্রথম আলো : আসিয়ানে যোগ দেওয়ার বিষয়ের সঙ্গে কি অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, কূটনৈতিক, নাকি অন্য কোনো দিক আছে?

. ইউনূস: মূলত অর্থনৈতিক। বিরাট বাজার, এই বাজারের সঙ্গে আমরা সংযুক্ত হলাম। ইন্দোনেশিয়া বলে যে একটা দেশ আছে, বাংলাদেশের মানুষ তো খবরই রাখে না। বিশাল এক দেশ আসিয়ানের অন্তর্ভুক্ত। এখন আমরা তাকে অবহেলা করে ফেলে রেখেছি। অথচ আমাদের দরকার ছিল তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। তাদের সুযোগসুবিধা আমাদের গ্রহণ করা। আমাদের জগৎটাকে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে নিয়ে আসা।

প্রথম আলো: আপনার একটা বিখ্যাত বক্তৃতা শুনেছিলাম অনেক বছর আগে, গ্রোয়িং আপ উইথ টু জায়ান্টস, ইন্ডিয়া অ্যান্ড চায়না? ভারতের পর চীনের সঙ্গে সম্পর্কটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

. ইউনূস: বহু বছর আগে আমি বলেছিলাম, এটা আমাদের একটা বড় সুবিধা। আমরা যে দুই বিশাল অর্থনীতির মাঝখানে আছি, এটা আমাদের দুর্বলতা নয়, সবলতা। দুই দেশের কাছ থেকে আমরা শিখব। দুই দেশ আমাদের বাজার হবে। দুই দেশই আমাদের কাছে আসবে। এই দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই আমাদের চলতে হবে। এটা আমাদের সুযোগ।

প্রথম আলো: এরই মধ্যে তো চীনের সঙ্গে আমাদের একটা বড় ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাদের কাছ থেকে এখন কী আশা করেন?

. ইউনূস: চীনের শক্তি আর সামর্থ্য তো ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ক্রমাগতভাবে দেশটিতে সায়েন্টিফিক ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। কাজেই তার সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বহু সুযোগ আছে। বহু জিনিস তার দরকার নেই, সেগুলো আমরা নিয়ে নিতে পারি। আমাদের দেশে সেগুলো আসতে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত একটি বিষয়। আমি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি, তিনিও সম্মতি দিয়েছেন। সমস্ত জিনিস তাদের লাগছে না। তাদের বাজার সংকুচিত হয়ে গেছে, আমেরিকানরা তাদের জিনিস কিনবে না। নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কাজেই আমি বললাম যে তোমাদের ওই শিল্পগুলো এখানে রিলোকেট করো। এখানে দাও। আমরা উৎপাদন করে সারা দুনিয়ায় বিক্রি করি। সোলার এনার্জির সুযোগ তো ক্রমাগত বাড়বে, কমবে না। কাজেই আমরা সেই সুযোগটা গ্রহণ করি। এবার জাতিসংঘে গিয়ে সবার কাছে বলেছি, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আমরা এক নম্বর হতে চাই। কে কত রিনিউয়েবেল এনার্জি দেবে, কোন কোন সূত্রে দেবে...নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি বললেন, আপনার যত হাইড্রো এনার্জি দরকার, নিয়ে যান। আপনার যত বিদ্যুৎ দরকার আমরা দেব। টাকারও অসুবিধা নেই। শুধু বিষয়টি হচ্ছে ভারতের মাঝখান দিয়ে ট্রান্সমিশন লাইনটা। এটা আমরা ভারতের সঙ্গে আলাপ করে করব।

আমার একটাই কথাসংস্কার, সংস্কার, সংস্কার। সংস্কারের জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হোন। এই সুযোগ আর আসবে না। প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান মুহূর্ত।

প্রথম আলো: আপনি যে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন, এখানে তো মাঝেমধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।

. ইউনূস: অন্তত হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি আনা বা সোলার এনার্জি করার ব্যাপারে চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব হবে বলে মনে হয় না। এটা তো কারও বিপক্ষে যাচ্ছে না।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের তো একটা স্ট্র্যাটেজিক লোকেশন আছে। ভূরাজনীতির একটা বিষয় তো আছেই। সেখানে তারা একে অন্যকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। জায়গায় নিজেদের প্রভাববলয়টা রাখতে চায়।

. ইউনূস: চিন্তাগুলো পরিষ্কার করতে হবে, নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। সেখানেও সংস্কার দরকার। আগের মতো করে একই ভঙ্গিতে চিন্তা করলে তো হবে না। আমরা ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনছি না! তাহলে নেপাল থেকে আনলে সমস্যা কোথায়! এবং সেটা হাইড্রো। যেটার জন্য আমাদের পৃথিবী সর্বনাশ হয়ে যাবে!

আমি বারবার বলে যাচ্ছি, আমাদের তিন শূন্যের পৃথিবী গড়তে হবে। তিন শূন্যের পৃথিবী হলো সমাধান, এর আগেপরে কোনো সমাধান নেই। জিরো নেট কার্বন এমিশন, জিরো ওয়েলথ কনজাম্পশন, জিরো আনএমপ্লয়মেন্ট। এই তিনটাকে সামনে রেখে আমাদের সব চিন্তাভাবনাকে সামনে আনতে হবে। আমাদের শুধু উন্নয়নের পেছনে ঘুরলে তো হবে না। আমাদের এটাকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে ফেলতে হবে। এটা উন্নয়নের মহাসড়ক নয়, এটা সামাজিক সমঝোতার মহাসড়ক। এই সামাজিক সমঝোতা এবং আবহাওয়ার সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত হবে না। জন্য নেট কার্বন এমিশন নাম্বার ওয়ানে। তারপর হবে জিরো ওয়েলথ কনজাম্পশন। সম্পদের সদ্ব্যবহার।

# আপনারা মন খুলে লেখেন। সমালোচনা করেন। না লিখলে আমরা জানব কী করে যে কী হচ্ছে আর কী হচ্ছে না।
#
কাজেই নির্বাচনের প্রস্তুতির একটা ধারা চলতে থাকবে। তার সঙ্গে সংস্কারের কাজ। দুটি একসঙ্গে যাবে। এটা কোনো আলাদা জিনিস নয়।
#
হয়তো ভারত মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে যে সমস্ত ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে তাতে। তারা তো এই পরিবর্তনগুলো পছন্দ করেনি।

প্রথম আলো: জো বাইডেন প্রথার বাইরে গিয়ে আপনার সঙ্গে বৈঠক করলেন। তারপর ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে আপনার আলোচনা হলো। তাঁদের সঙ্গে তো আপনার অনেক কথা হলো। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কী বার্তা পেলেন আপনি?

. ইউনূস: বার্তা হচ্ছে, তারা খুশি। আমি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে গিয়েছি। নতুন যে বাংলাদেশ হবে, সে ব্যাপারে তারা আনন্দিত। দুর্নীতিমুক্ত একটা দেশ হবে। সামাজিক দিক থেকে উন্নত একটা দেশ হবে। আমরা বলে এসেছি যে পরিবর্তন হবে, সংস্কার হবে। এই বার্তাগুলো তারা গ্রহণ করেছে। তারা বলেছে, তোমাদের যা যা সাহায্য করতে পারি, আমরা করব। কাজেই এটা একটা আশ্বাস পাওয়া গেছে। এবং দেখলাম যে ব্যাপারে তারা আগ্রহী। এটা এমন নয় যে কথাবার্তা বলে, দেওয়ার বেলায় কিছু পাইনি। আমরা দুটো বিষয়ে এমফেসাইজ করেছি জাতিসংঘে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডাযাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, তাদের সবার সঙ্গেই। আমাদের বাংলাদেশের সঙ্গে আগে যেভাবে লেনদেন হতো, সেটার চিন্তা থেকে বের হয়ে যেতে হবে। এখন আমরা বড় আকারে যেতে চাই, বড় চিন্তার মধ্যে যেতে চাই। আমাদের আদান-প্রদান সেই প্ল্যাটফর্মের ওপর হতে হবে। প্রথমত, চিন্তাটা ভিন্ন করতে হবে। অতীতের চিন্তা, অতীতের ক্রমধারায় করলে হবে না। দ্বিতীয়ত দ্রুত করতে হবে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকার যদি কাজ দেখাতে না পারি, তাহলে মানুষ উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। কাজেই তুমি যদি দিতে দিতে এমন সময় লাগালে, অন্তর্বর্তী সরকার চলে গেল, আরেকটা সরকার এসে কয়েক বছর কাটিয়ে গেল, তারপর এটা দেওয়া শুরু হলো, তখন এটা হয়তো কাজে লাগবে না। অতীত হয়ে গেছে। কাজেই মানুষের মধ্যে উৎসাহ থাকতে থাকতে টাকাটা দাও, যাতে আমরা কাজগুলো করতে পারি। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। কাজেই এটাকে সবল করতে হলে তোমাদের সাহায্য দরকার। কাজেই যে অর্থনীতি আছে, এটা ভাঙাচোরা আর লুটপাট করা অর্থনীতি। এই লুটপাট করা অর্থনীতিকে সোজা করতে হলে আমাদের সাহায্য দরকার। সেই জিনিসগুলো আমরা বারবার বলেছি।

প্রথম আলো: আপনি বৈঠকের পর তো বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ সবার কাছ থেকে সহযোগিতার নতুন নতুন আশ্বাসও পেয়েছেন।

. ইউনূস: সবার কাছ থেকে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ, সবাই।

প্রথম আলো: সবকিছু নিশ্চয় আপনাকে নতুন করে আশাবাদী করে তুলেছে?

. ইউনূস: নিশ্চয়। জাতিসংঘে যে রকম উৎসাহ আমি দেখেছি, শুধু বড় রাষ্ট্রই নয়, ছোট রাষ্ট্র; আমাদের সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলো প্রত্যেকের উৎসাহ। প্রত্যেকে বলেছে, আমরা আছি। কী করতে হবে আমাদের বলেন। ইতালির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললাম, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললাম, সবাই উৎসাহী।

ইতালির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হলো। ইতালির প্রধানমন্ত্রী বললেন, তোমরা তো বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট আসো, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমর লিগ্যাল ওয়েতে কীভাবে আনতে পারি সেটার জন্য চেস্টা করি। ইতালির রাষ্ট্রদূত আজ আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, তিনিও বিষয়টি কীভাবে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে নিয়ে আসা যায়, সে বিষয়ে কথা বলেছেন।

প্রথম আলো: আপনি সব সময় জাতীয় ঐক্য, জাতীয় সমঝোতার কথা বলেন। এটাও ঠিক যে আমাদের দেশে রাষ্ট্রের যে মূলনীতিগুলো, সেখানে যদি ঐকমত্য তৈরি করতে না পারি, তাহলে চলা খুব মুশকিল। আমরা চারপাশে বিভক্তি দেখি। দলাদলি দেখি। থেকে বের হবেন কী করে? সেখানে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসটা কী হওয়া উচিত?

. ইউনূস: শুধু যদি গত ১৫ বছরই ধরি, আমরা তো শুধু দলাদলি শিখেছি, বিভক্তি শিখেছি, দূরত্বই শিখেছি। কে কাকে মারবে, কাটবে, কেড়ে নেবে, কাকে কত দূরে সরাবে; কাজেই সে সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

মিডিয়ার অধিকার রক্ষা করতে বলছেন, একইভাবে মানুষের অধিকার রক্ষার কথা বলব। মানুষ যেন কথা বলতে পারে। বলার অধিকার তার কাছ থেকে কে কেড়ে নেবে? মত ভিন্ন হতে পারে। ওই যে বললাম, আমরা একটি পরিবার। আমাদের মতের বিভেদ থাকতে পারে, আমরা কেউ কারও শত্রু নই। এই কথাটা যদি আমরা মনে রাখি, আমরা শত্রু নই।

আমরা যেকোনো উপলক্ষ বানিয়ে শত্রু বানিয়ে ফেলি। কীভাবে শত্রু বানাতে হয়, শত্রু বানানোর প্রক্রিয়াটাকে আমাদের আগের সরকার ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। আপনাকে শত্রু বানিয়েছে, আমাকে শত্রু বানিয়েছে, এখানে কতজনকে শত্রু বানিয়েছে, আপনি দেখেন। খালি শত্রু, শত্রু যে কঠিন শত্রু। এমন যে সে দেশের শত্রু, শুধু আমার শত্রু না; ওই ভঙ্গিতে নিয়ে গেছে। কাজেই ওই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আজকে সংস্কারের জন্য আমরা গলা ফাটাচ্ছি কেন? সেই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

প্রথম আলো:

আপনি যে কথাটি বললেন, স্বপ্নের কথাটা। একটা জাতীয় ঐক্য। ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়ার বাস্তবতা কি আছে?

. ইউনূস: আপনারা বলেন, আপনারা পত্রিকায় লেখেন। শুরু করেন, কথা বলেন। যদি এটা কাজে লাগে, একত্র করা, সবাই একমত হওয়া; একমত হওয়ার কাজে। একমত হতে হবে না, একত্র হতে হবে। মত যার যার হতে পারে। নানা মত থাকবে। বাপে ছেলের মতে বা মেয়ের মতে একমত হয় না, দেশের একমত কেমনে হবে? মত থাকবে, কিন্তু আমরা একমত হব।

# আমরা একটি পরিবার। আমাদের মতের বিভেদ থাকতে পারে, আমরা কেউ কারও শত্রু নই।
#
আমরা যদি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি, দেখবেন বাকি কাজটা সহজ হয়ে যাবে।
#
সংস্কার না করে যেন নির্বাচন না করি। এটা আপনাদের সবার কাছে আমার আবেদন। এই সুযোগ হারাবেন না।

প্রথম আলো: আপনি যে কমিশনগুলো করলেন, সে কমিশনগুলোর মধ্য দিয়েও তো আলোচনা আসতে পারে।

. ইউনূস:  আসতে পারে। আপনারা তাদের উৎসাহিত করুন।

প্রথম আলো: শেষ পর্যন্ত আমরা সংস্কার করি, নির্বাচন করি, সরকার করি। ভবিষ্যতে যদি এগোয়, সেখানে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে তো এগুলো অগ্রসর করে নেওয়া কঠিন। তো সেখানে আমি মনে করি, আপনার একটা বড় ভূমিকা নেওয়ার জায়গা আছে, উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রধান হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবে। আমাদের জন্য বর্তমানে এই ঐক্য সমঝোতাটা খুবই জরুরি হয়ে গেছে।

. ইউনূস: ঐক্যের জন্য একটা বিষয় লাগে। কী নিয়ে ঐক্যটা সৃষ্টি হবে, সবাই যাতে মানে, জন্য আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের ঐক্যটা এল সংস্কার থেকে। সংস্কার বিষয়ে যদি একমত হই, সেটা কিন্তু একটা মস্ত বড় ঐক্য। যত মত আছে, আমরা সংস্কারে একমত।

প্রথম আলো: সংস্কার মানে পরিবর্তন?

. ইউনূস: পরিবর্তন, আমরা অতীতে ফিরে যেতে চাই না। এটার চেয়ে বড় ঐক্য আর হতে পারে না। আমরা যদি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি, দেখবেন বাকি কাজটা সহজ হয়ে যাবে। ঠুনকো সংস্কার না, লোকদেখানো সংস্কার না, একদম ফান্ডামেন্টাল সংস্কার। এটা এমনভাবে করব আর কেউ পাল্টাতে পারবে না।

প্রথম আলো: আর এই ঐক্যটা তো আমরা দেখলাম জুলাই-আগস্টে।...

. ইউনূস: কী সুন্দর একটা ঐক্য হঠাৎ করে জমেছিল! পাথরের মতো সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে সব চুরমার হয়ে গেল। বলে যে আমরা এক।

প্রথম আলো: তার অর্থ হলো, ঐক্য সম্ভব।

. ইউনূস: অসম্ভব নয় তো! গত দুই মাস আগের ঘটনা তো। ঐক্য হলো তো। সারা দেশ এক হয়ে গেল। কোনো বিভেদ ছিল না। যে যত কথা বলে, ধর্মীয় পার্টি বলেন, বাম বলেন, ডান বলেন, মাঝ বলেনসব এক। একটা ব্যাপারে একমত, আমরা এটা চাই না, পুরোনো অতীত শেষ।

প্রথম আলো: শিশু, কিশোর, তরুণ...

. ইউনূস: সব, কেউই বাদ যায়নি। এই শক্তিটা যেন আমরা ভুলে না যাই। আমরা নানা কথার মধ্যে এগুলো ভুলে যাই। এই দুই মাসের মধ্যে আমরা ভুলে যেতে আরম্ভ করেছি। এটা যেন না হয়। এই সময়টাকে আমরা যেন রক্ষা করতে পারি। এই পিরিয়ডের ঐক্যটা এমনভাবে করব, যাতে তা স্থায়ী হয়ে যায়। যাতে করে ওই সংস্কারগুলোর মাধ্যমে একটা কাঠামোর রূপ আমরা দিতে পারি।

প্রথম আলো: কী বার্তা দেবেন দেশের মানুষের জন্য?

. ইউনূস: আমার একটাই কথাসংস্কার, সংস্কার, সংস্কার। সংস্কারের জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হোন। এই সুযোগ আর আসবে না। প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান মুহূর্ত।  কাজেই এটা নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যে যাবেন না। সংস্কারে কী কী বিষয় হবে, সেটা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা করেন। কিন্তু সংস্কার, এটা করে যেতে হবে। দুই দিন পর যদি বলেন সংস্কার বাদ দেন, আমরা নির্বাচন করে চলে যাইওটা যেন না হয়। সংস্কার না করে যেন নির্বাচন না করি। এটা আপনাদের সবার কাছে আমার আবেদন। এই সুযোগ হারাবেন না।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

. ইউনূস: আপনাকেও ধন্যবাদ।

(ঈষৎ সংক্ষেপিত)

(শেষ)

 

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...