শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৩

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ এর সব ধারা সমূহঃ

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ এর সব ধারা সমূহঃ

===========================
পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের চলমান রাজনৈতিক সমস্যা সংকট ও অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানির অবসান ঘটিয়ে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সাথে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেএসএস সন্তু লারমা মধ্যকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়।
বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি (পিসিজেএসএস)-এর মধ্যে সম্পাদিত ১৯৯৭-২ রা ডিসেম্বরের সম্পাদিত চুক্তির সম্পূর্ণ ধারা সমূহ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিম্নে বর্ণিত চারি খন্ড (ক, খ, গ, ঘ) সম্বলিত চুক্তিতে উপনীত হইলেন:
(ক) সাধারণ
১) উভয়পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে বিবেচনা করিয়া এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন;
২) উভয়পক্ষ এ চুক্তির আওতায় যথাশিগগির ইহার বিভিন্ন ধারায় বিবৃত ঐক্যমত্য ও পালনীয় দায়িত্ব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আইন, বিধানাবলী, রীতিসমূহ প্রণয়ন, পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজন আইন মোতাবেক করা হইবে বলিয়া স্থিরীকৃত করিয়াছেন;
৩) এই চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পরিবীক্ষণ করিবার লক্ষ্যে নিম্নে বর্ণীত সদস্য সমন্বয়ে একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হইবে;
ক) প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত একজন সদস্য : আহ্বায়ক
খ) এই চুক্তির আওতায় গঠিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান : সদস্য
গ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি : সদস্য
৪) এই চুক্তি উভয়পক্ষের তরফ হইতে সম্পাদিত ও সহি করার তারিখ হইতে বলবৎ হইবে। বলবৎ হইবার তারিখ হইতে এই চুক্তি অনুযায়ী উভয় পক্ষ হইতে সম্পাদনীয় সকল পদক্ষেপ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই চুক্তি বলবৎ থাকিবে।
(খ) পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ/পার্বত্য জেলা পরিষদ
উভয়পক্ষ এই চুক্তি বলবৎ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যমান পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯, বান্দরবন পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯) এবং-এর বিভিন্ন ধারাসমূহের নিম্নে বর্ণীত পরিবর্তন, সংশোধন, সংযোজন ও অবলোপন করার বিষয়ে ও লক্ষ্যে একমত হইয়াছেন:
১) পরিষদের আইনে বিভিন্ন ধারায় ব্যবহৃত ‘উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকিবে।
২) ‘পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ’ এর নাম সংশোধন করিয়া তদপরিবর্তে এই পরিষদ ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ নামে অভিহিত হইবে।
৩) ‘অ-উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা’ বলিতে যিনি উপজাতীয় নহেন এবং যাহার পার্বত্য জেলায় বৈধ জায়গা-জমি আছে এবং যিনি পার্বত্য জেলায় সুনির্দিষ্ট ঠিকানায় সাধারণতঃ বসবাস করেন তাহাকে বুঝাইবে।
৪) (ক) প্রতিটি পার্বত্য জেলা পরিষদে মহিলাদের জন্যে ৩ (তিন) টি আসন থাকিবে। এসব আসনের এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) অ-উপজাতীয়দের জন্যে হইবে।
(খ) ৪ নম্বর ধারার উপ-ধারা ১, ২, ৩ ও ৪ মূল আইন মোতাবেক বলবৎ থাকিবে।
(গ) ৪ নম্বর ধারার উপ-ধারা (৫)-এর দ্বিতীয় পংক্তিতে অবস্থিত ‘ডেপুটি কমিশনার’ এবং ‘ডেপুটি কমিশনারের’ শব্দগুলি পরিবর্তে যথাক্রমে ‘সার্কেল চীফ’ এবং ‘সার্কেল চীফের’ শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত হইবে।
(ঘ) ৪ নম্বর ধারার নিম্নোক্ত উপ-ধারা সংযোজন করা হইবে ‘কোন ব্যক্তি অ-উপজাতীয় কিনা এবং হইলে তিনি কোন সম্প্রদায়ের সদস্য তাহা সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/পৌর সভার চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেট দাখিল সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট সার্কেলের চীফ স্থির করিবেন এবং এতদসম্পর্কে সার্কেল চীফের নিকট হইতে প্রাপ্ত সার্টিফিকট ব্যতীত কোন ব্যক্তি অ-উপজাতীয় হিসাবে কোন অ-উপজাতীয় সদস্য পদের জন্যে প্রার্থী হইতে পারিবেন না।
৫) ৭ নম্বর ধারায় বর্ণীত আছে যে, চেয়ারম্যান বা কোন সদস্য পদে নির্বাচিত ব্যক্তি তাহার কার্যক্রম গ্রহণের পূর্বে চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনারের সম্মুখে শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা করিবেন। ইহা সংশোধন করিয়া ‘চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার’-এর পরিবর্তে ‘হাই কোর্ট ডিভিশনের কোন বিচারপতি’ কর্তৃক সদস্যরা শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা করিবেন-অংশটুকু সন্নিবেশ করা হইবে।
৬) ৮ নম্বর ধারার চতুর্থ পংক্তিতে অবস্থিত ‘চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনারের নিকট’ শব্দগুলির পরিবর্তে ‘নির্বাচন বিধি অনুসারে’ শব্দগুলি প্রতিস্থাপন করা হইবে।
৭) ১০ নম্বর ধারার দ্বিতীয় পংক্তিতে অবস্থিত ‘তিন বৎসর’ শব্দগুলির পরিবর্তে ‘পাঁচ বৎসর’ শব্দগুলি প্রতিস্থাপন করা হইবে।
৮) ১৪ নম্বর ধারায় চেয়ারম্যানের পদ কোন কারণে শূন্য হইলে বা তাহার অনুপস্থিতিতে পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত একজন উপজাতীয় সদস্য সভাপতিত্ব করিবেন এবং অন্যান্য দায়িত্ব পালন করিবেন বলিয়া বিধান থাকিবে।
৯) বিদ্যমান ১৭নং ধারা নিম্নে উল্লেখিত বাক্যগুলি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হইবে: আইনের আওতায় কোন ব্যক্তি ভোটার তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইতে পারিবেন, যদি তিনি- (১) বাংলাদেশের নাগরিক হন; (২) তাহার বয়স ১৮ বৎসরের কম না হয়; (৩) কোন উপযুক্ত আদালত তাহাকে মানসিকভাবে অসুস্থ ঘোষণা না করিয়া থাকেন; (৪) তিনি পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হন।
১০) ২০ নম্বর ধারার (২) উপ-ধারায় ‘নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ’ শব্দগুলি স্বতন্ত্রভাবে সংযোজন করা হইবে।
১১) ২৫ নম্বর ধারার উপ-ধারা (২) এ পরিষদের সকল সভায় চেয়ারম্যান এবং তাহার অনুপস্থিতিতে অন্যান্য সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত একজন উপজাতীয় সদস্য সভাপতিত্ব করিবেন বলিয়া বিধান থাকিবে।
১২) যেহেতু খাগড়াছড়ি জেলার সমস্ত অঞ্চল মং সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত নহে, সেহেতু খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার আইনে ২৬ নম্বর ধারায় বর্ণিত ‘খাগড়াছড়ি মং চীফ’-এর পরিবর্তে ‘মং সার্কেলের চীফ এবং চাকমা সার্কেলের চীফ’ শব্দগুলি প্রতিস্থাপন করা হইবে। অনুরূপভাবে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সভায় বোমাং সার্কেলের চীফেরও উপস্থিত থাকার সুযোগ রাখা হইবে। একইভাবে বান্দরবন জেলা পরিষদের সভায় বোমাং সার্কেলের চীফ ইচ্ছা করিলে বা আমন্ত্রিত হইলে পরিষদের সভায় যোগদান করিতে পারিবেন বলিয়া বিধান রাখা হইবে।
১৩) ৩১ নম্বর উপ-ধারা (১) ও উপ-ধারা (২) এ পরিষদে সরকারের উপ-সচিব সমতুল্য একজন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সচিব হিসাবে থাকিবেন এবং এই পদে উপজাতীয় কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার প্রদান করা হইবে বলিয়া বিধান থাকিবে।
১৪) (ক) ৩২ নম্বর ধারার উপ-ধারা (১) এ পরিষদের কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের নিমিত্ত পরিষদ সরকারের অনুমোদনক্রমে, বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারির পদ সৃষ্টি করিতে পারিবে বলিয়া বিধান থাকিবে।
(খ) ৩২ নম্বর ধারার উপ-ধারা (২) সংশোধন করিয়া নিম্নোক্তভাবে প্রণয়ন করা হইবে ঃ ‘পরিষদ প্রবিধান অনুযায়ী তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে কর্মচারী নিয়োগ করিতে পারিবেন এবং তাহাদেরকে বদলি ও সাময়িক বরখাস্ত, বরখাস্ত, অপসারণ বা অন্য কোন প্রকার শাস্তি প্রদান করিতে পারিবে। তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলার উপজাতীয় বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার বজায় রাখিতে হইবে’।
(গ) ৩২ নম্বর ধারার উপ-ধারা (৩) এ পরিষদের অন্যান্য পদে সরকার পরিষদের পরামর্শক্রমে বিধি অনুযায়ী কর্মকর্তা নিয়োগ করিতে পারিবে এবং এই সকল কর্মকর্তাকে সরকার অন্যত্র বদলি, সাময়িক বরখাস্ত, বরখাস্ত, অপসারণ অথবা অন্য কোন প্রকার শাস্তি প্রদান করিতে পারিবে বলিয়া বিধান থাকিবে।
১৫) ৩৩ নম্বর ধারার উপ-ধারা (৩) এ বিধি অনুযায়ী হইবে বলিয়া উল্লেখ থাকিবে।
১৬) ৩৬ নম্বর ধারার উপ-ধারা (১) এর তৃতীয় পংক্তিতে অবস্থিত ‘অথবা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত অন্য কোন প্রকার’ শব্দগুলি বিলুপ্ত করা হইবে।
১৭) (ক) ৩৭ নম্বর ধারার (১) উপ-ধারার চতুর্থতঃ এর মূল আইন বলবৎ থাকিবে।
(খ) ৩৭ নম্বর ধারার (২) উপ-ধারা (ঘ)-তে বিধি অনুযায়ী হইবে বলিয়া উল্লেখিত হইবে।
১৮) ৩৮ নম্বর ধারার উপ-ধারা (৩) বাতিল করা হইবে এবং উপ-ধারা (৪) সংশোধন করিয়া নিম্নোক্তভাবে এই উপ-ধারা প্রণয়ন করা হইবে ঃ কোন অর্থ-বৎসর শেষ হইবার পূর্বে যে কোন সময় সেই অর্থ-বৎসরের জন্যে, প্রয়োজন হইলে, একটি বাজেট প্রণয়ন ও অনুমোদন করা যাইবে।
১৯) ৪২ নম্বর ধারার নিম্নোক্ত উপ-ধারা সংযোজন করা হইবে: পরিষদ সরকার হইতে প্রাপ্য অর্থে হস্তান্তরিত বিষয়সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করিতে পারিবে, এবং জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত সকল উন্নয়ন কার্যক্রম পরিষদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ/প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন করিবে।
২০) ৪৫ নম্বর ধারার উপ-ধারা (২) এর দ্বিতীয় পংক্তিতে অবস্থিত ‘সরকার’ শব্দটির পরিবর্তে ‘পরিষদ’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করা হইবে।
২১) ৫০, ৫১ ও ৫২ নম্বর ধারাগুলি বাতিল করিয়া তদপরিবর্তে নিম্নোক্ত ধারা প্রণয়ন করা হইবে : এই আইনের উদ্দেশ্যের সহিত পরিষদের কার্যকলাপের সামঞ্জস্য সাধনের নিশ্চয়তা বিধানকল্পে সরকার প্রয়োজনে পরিষদকে পরামর্শ প্রদান বা অনুশাসন করিতে পারিবে। সরকার যদি নিশ্চিতভাবে এইরূপ প্রমাণ লাভ করিয়া থাকে যে, পরিষদ বা পরিষদের পক্ষে কৃত বা প্রস্তাবিত কোন কাজ-কর্ম আইনের সহিত সংগতিপূর্ণ নহে অথবা জনস্বার্থের পরিপন্থী তাহা হইলে সরকার লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিষদের নিকট হইতে তথ্য ও ব্যাখ্যা চাহিতে পারিবে এবং পরামর্শ বা নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবে।
২২) ৫৩ ধারার (৩) উপ-ধারার ‘বাতিল থাকার মেয়াদ শেষ হইলে’ শব্দগুলি বাতিল করিয়া তদপরিবর্তে ‘এই আইন’ শব্দটির পূর্বে ‘পরিষদ বাতিল হইলে নব্বই দিনের মধ্যে’ শব্দগুলি সন্নিবেশ করা হইবে।
২৩) ৬১ নম্বর ধারার তৃতীয় ও চতুর্থ পংক্তিতে অবস্থিত ‘সরকারের’ শব্দটির পরিবর্তে ‘মন্ত্রণালয়ের’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করা হইবে।
২৪) (ক) ৬২ নম্বর ধারার উপ-ধারা (১) সংশোধন করিয়া নিম্নোক্তভাবে এই উপ-ধারাটি প্রণয়ন করা হইবে : আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, পার্বত্য জেলা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ও তদনিম্ন স্তরের সকল সদস্য প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং পরিষদ তাহাদের বদলি ও প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে তাহাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে। তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলার উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার বজায় রাখিতে হইবে।
(খ) ৬২ নম্বর ধারার উপ-ধারা (৩) এর দ্বিতীয় পংক্তিতে অবস্থিত আপাততঃ বলবৎ অন্য সকল আইনের বিধান সাপেক্ষে শব্দগুলি বাতিল করিয়া তদপরিবর্তে ‘যথা আইন ও বিধি অনুযায়ী’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করা হইবে।
২৫) ৬৩ নম্বর ধারার তৃতীয় পংক্তিতে অবস্থিত ‘সহায়তা দান করা’ শব্দগুলি বলবৎ থাকিবে।
২৬) ৬৪ নম্বর ধারা সংশোধন করিয়া নিম্নোক্তভাবে এই ধারাটি প্রণয়ন করা হইবে :
(ক) আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, পার্বত্য জেলার এলাকাধীন বন্দোবস্তযোগ্য খাসজমিসহ কোন জায়গা-জমি পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে ইজারা প্রদানসহ বন্দোবস্ত, ক্রয়, বিক্রয় ও হস্তান্তর করা যাইবে না।
তবে শর্ত থাকে যে, রক্ষিত (Reserved বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় শিল্প কারখানা ও সরকারের নামে রেকর্ডকৃত ভূমির ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হইবে না।
(খ) আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোন প্রকারের জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিষদের সাথে আলোচনা ও ইহার সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করা যাইবে না।
(গ) পরিষদ হেডম্যান, চেইনম্যান, আমিন, সার্ভেয়ার, কানুনগো ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)দের কার্যাদি তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবে।
(ঘ) কাপ্তাই হ্রদের জলে ভাষা (Fringe Land) জমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জমির মূল মালিকদেরকে বন্দোবস্ত দেয়া হইবে।
২৭) ৬৫ নম্বর ধারা সংশোধন করিয়া নিম্নোক্তভাবে এই ধারা প্রণয়ন করা হইবে। আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, জেলার ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের দায়িত্ব পরিষদের হস্তে ন্যস্ত থাকিবে এবং জেলায় আদায়কৃত উক্ত কর পরিষদের তহবিলে থাকিবে।
২৮) ৬৭ নম্বর ধারা সংশোধন করিয়া নিম্নোক্তভাবে এই ধারা প্রণয়ন করা হইবে : পরিষদে এবং সরকারী কর্তৃপক্ষের কার্যাবলীর মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন দেখা দিলে সরকার বা পরিষদ নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করিবে এবং পরিষদ ও সরকারের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে কাজের সমন্বয় বিধান করা যাইবে।
২৯) ৬৮ নম্বর ধারার উপ-ধারা (১) সংশোধন করিয়া নিম্নোক্তভাবে এই উপ-ধারা প্রণয়ন করা হইবে : এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে বিধি প্রণয়ন করিতে পারিবে এবং কোন বিধি প্রণীত হওয়ার পরেও উক্ত বিধি পুনর্বিবেচনার্থে পরিষদ কর্তৃক সরকারের নিকট আবেদন করিবার বিশেষ অধিকার থাকিবে।
৩০) (ক) ৬৯ ধারার উপ-ধারা (১) এর প্রথম ও দ্বিতীয় পংক্তিতে অবস্থিত ‘সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে’ শব্দগুলি বিলুপ্ত এবং তৃতীয় পংক্তিতে অবস্থিত ‘করিতে পারিবে’ এই শব্দগুলির পরে নিম্নোক্ত অংশটুকু সন্নিবেশ করা হইবে ঃ তবে শর্ত থাকে যে, প্রণীত প্রবিধানের কোন অংশ সম্পর্কে সরকার যদি মতভিন্নতা পোষণ করে তাহা হইলে সরকার উক্ত প্রবিধান সংশোধনের জন্য পরামর্শ দিতে বা অনুশাসন করিতে পারিবে।
(খ) ৬৯ নম্বর ধারার উপ-ধারা (২) এর (হ) এ উল্লেখিত ‘পরিষদের কোন কর্মকর্তাকে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা অর্পণ’ এই শব্দগুলি বিলুপ্ত করা হইবে।
৩১) ৭০ নম্বর ধারা বিলুপ্ত করা হইবে।
৩২) ৭৯ নম্বর ধারা সংশোধন করিয়া নিম্নোক্তভাবে এই ধারা প্রণয়ন করা হইবে : পার্বত্য জেলায় প্রযোজ্য জাতীয় সংসদ বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ গৃহীত কোন আইন পরিষদের বিবেচনায় উক্ত জেলার জন্য কষ্টকর হইলে বা উপজাতীয়দের জন্যে আপত্তিকর হইলে পরিষদ উহা কষ্টকর বা আপত্তিকর হওয়ার কারণ ব্যক্ত করিয়া আইনটির সংশোধন বা প্রয়োগ শিথিল করিবার জন্যে সরকারের নিকট লিখিত আবেদন পেশ করিতে পারিবে এবং সরকার এই আবেদন অনুযায়ী প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে পারিবে।
৩৩) (ক) প্রথম তফসিল বর্ণীত পরিষদের কার্যাবলীর ১ নম্বরে ‘শৃঙ্খলা’ শব্দটির পরে ‘তত্ত্বাবধান’ শব্দটি সন্নিবেশ করা হইবে।
(খ) পরিষদের কার্যাবলীর ৩ নম্বরে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ সংযোজন করা হইবে: (১) বৃত্তিমূলক শিক্ষা, (২) মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা, (৩) মাধ্যমিক শিক্ষা।
(গ) প্রথম তফসিলে পরিষদের কার্যাবলীর ৬(খ) উপ-ধারায় ‘সংরক্ষিত বা’ শব্দগুলি বিলুপ্ত করা হইবে।
৩৪) পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্য ও দায়িত্বাদির মধ্যে নিম্নে উল্লেখিত বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত হইবে ঃ
ক) ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা;
খ) পুলিশ (স্থানীয়);
গ) উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার;
ঘ) যুব কল্যাণ;
ঙ) পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন;
চ) স্থানীয় পর্যটন;
ছ) পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতীত ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্ট ও অন্যান্য স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান;
জ) স্থানীয় শিল্প-বাণিজ্যের লাইসেন্স প্রদান;
ঝ) কাপ্তাই হ্রদের জলসম্পদ ব্যতীত অন্যান্য নদী-নালা, খাল-বিলের সুষ্ঠু ব্যবহার ও সেচ ব্যবস্থা;
ঞ) জন্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য পরিসংখ্যান সংরক্ষণ;
ট) মহাজনী কারবার;
ঠ) জুম চাষ।
৩৫) দ্বিতীয় তফসীলে বিবৃত পরিষদ আরোপনীয় কর, রেইট, টোল এবং ফিস-এর মধ্যে নিম্নে বর্ণীত ক্ষেত্র ও উৎসাদি অন্তর্ভুক্ত হইবে:
ক) অযান্ত্রিক যানবাহনের রেজিষ্ট্রেশন ফি;
খ) পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের উপর কর;
গ) ভূমি ও দালান-কোঠার উপর হোল্ডিং কর;
ঘ) গৃহপালিত পশু বিক্রয়ের উপর কর;
ঙ) সামাজিক বিচারের ফিস;
চ) সরকারী ও বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের উপর হোল্ডিং কর;
ছ) বনজ সম্পদের উপর রয়্যালিটির অংশ বিশেষ;
জ) সিনো, যাত্রা, সার্কাস ইত্যাদির উপর সম্পূরক কর;
ঝ) খনিজ সম্পদ অন্বেষণ বা নিষ্কর্ষণের উদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অনুজ্ঞা পত্র বা পাট্টাসমূহ সূত্রে প্রাপ্ত রয়্যালটির অংশ বিশেষ;
ঞ) ব্যবসার উপর কর;
ট) লটারীর উপর কর;
ঠ) মৎস্য ধরার উপর কর।
(গ) পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ
১) পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ অধিকতর শক্তিশালী ও কার্যকর করিবার লক্ষ্যে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯ ইং (১৯৮৯ সনের ১৯, ২০ ও ২১নং আইন)-এর বিভিন্ন ধারা সংশোধন ও সংযোজন সাপেক্ষে তিন পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হইবে।
২) পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণের দ্বারা পরোক্ষভাবে এই পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হইবেন যাহার পদমর্যাদা হইবে একজন প্রতিমন্ত্রীর সমকক্ষ এবং তিনি অবশ্যই উপজাতীয় হইবেন।
৩) চেয়ারম্যানসহ পরিষদ ২২ (বাইশ) জন সদস্য লইয়া গঠন করা হইবে। পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য উপজাতীয়দের মধ্য হইতে নির্বাচিত হইবে। পরিষদ ইহার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করিবেন। পরিষদের গঠন নিম্নরূপ হইবে :
চেয়ারম্যান – ১ জন
সদস্য উপজাতীয় (পুরুষ)- ১২ জন
সদস্য উপজাতীয় মহিলা)- ২ জন
সদস্য অ-উপজাতীয় (পুরুষ)- ৬ জন
সদস্য অ-উপজাতীয় (মহিলা)- ১ জন
উপজাতীয় পুরুষ সদস্যদের মধ্যে ৫ জন নির্বাচিত হইবেন চাকমা উপজাতি হইতে, ৩ জন মার্মা উপজাতি হইতে, ২ জন ত্রিপুরা উপজাতি হইতে, ১ জন মুরং ও তনচৈঙ্গ্যা উপজাতি হইতে এবং ১ জন লুসাই, বোম, পাংখো, খুমী, চাক ও খিয়াং উপজাতি হইতে।
অ-উপজাতি পুরুষ সদস্যদের মধ্যে হইতে প্রত্যেক জেলা হইতে ২ জন করিয়া নির্বাচিত হইবেন।
উপজাতীয় মহিলা সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে চাকমা উপজাতি হইতে ১ জন এবং অন্যান্য উপজাতি থেকে ১জন নির্বাচিত হইবেন।
৪) পরিষদের মহিলাদের জন্য ৩ (তিন) টি আসন সংরক্ষিত রাখা হইবে। এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) অ-উপজাতীয় হইবে।
৫) পরিষদের সদস্যগণ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণের দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হইবেন। তিন পার্বত্য জেলার চেয়ারম্যানগণ পদাধিকারবলে পরিষদের সদস্য হইবেন এবং তাহাদের ভোটাধিকার থাকিবে। পরিষদের সদস্য প্রার্থীদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্যদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার অনুরূপ হইবে।
৬) পরিষদের মেয়াদ ৫ (পাঁচ) বৎসর হইবে। পরিষদের বাজেট প্রণয়ন ও অনুমোদন, পরিষদ বাতিলকরণ, পরিষদের বিধি প্রণয়ন, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিষয় ও পদ্ধতি পার্বত্য জেলা পরিষদের অনুকূলে প্রদত্ত ও প্রযোজ্য বিষয় ও পদ্ধতির অনুরূপ হইবে।
৭) পরিষদে সরকারের যুগ্মসচিব সমতুল্য একজন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা থাকিবেন এবং এই পদে নিযুক্তির জন্য উপজাতীয় প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হইবে।
৮) (ক) যদি পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হয় তাহা হইলে অন্তরবর্তীকালীন সময়ের জন্য পরিষদের অন্যান্য উপজাতীয় সদস্যগণের মধ্য হইতে একজন তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্যগণের দ্বারা পরোক্ষভাবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হইবেন।
(খ) পরিষদের কোন সদস্যপদ যদি কোন কারণে শূন্য হয় তবে উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে তাহা পূরণ করা হইবে।
৯) (ক) পরিষদ তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড সমন্বয় সাধন করাসহ তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন ও উহাদের উপর অর্পিত বিষয়াদি সার্বিক তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করিবে। ইহা ছাড়া অর্পিত বিষয়াদির দায়িত্ব পালনে তিন জেলা পরিষদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব কিংবা কোনরূপ অসংগতি পরিলক্ষিত হইলে আঞ্চলিক পরিষদের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত বলিয়া পরিগণিত হইবে।
(খ) এই পরিষদ পৌরসভাসহ স্থানীয় পরিষদসমূহ তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করিবে।
(গ) তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের ব্যাপারে আঞ্চলিক পরিষদ সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধান করিতে পারিবে।
(ঘ) পরিষদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনাসহ এনজিও’দের কার্যাবলী সমন্বয় সাধন করিতে পারিবে।
(ঙ) উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার আঞ্চলিক পরিষদের আওতাভুক্ত থাকিবে।
(চ) পরিষদ ভারী শিল্পের লাইসেন্স প্রদান করিতে পারিবে।
১০) পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পরিষদের সাধারণ ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে অর্পিত দায়িত্ব পালন করিবে। উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার যোগ্য উপজাতীয় প্রার্থীকে অগ্রাধিকার প্রদান করিবেন।
১১) ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইন, বিধি ও অধ্যাদেশের সাথে ১৯৮৯ সনের স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনের যদি কোন অসংগতি পরিলক্ষিত হয় তবে আঞ্চলিক পরিষদের পরামর্শ ও সুপারিশক্রমে সেই অসংগতি আইনের মাধ্যমে দূর করা হইবে।
১২) পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ভিত্তিতে আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সরকার অন্তরবর্তীকালীন আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করিয়া তাহার উপর পরিষদের প্রদেয় দায়িত্ব দিতে পারিবেন।
১৩) সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আইন প্রণয়ন করিতে গেলে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে ও ইহার পরামর্শক্রমে আইন প্রণয়ন করিবেন। তিনটি পার্বত্য জেলার উন্নয়ন ও উপজাতীয় জনগণের কল্যাণের পথে বিরূপ ফল হইতে পারে এইরূপ আইনের পরিবর্তন বা নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে পরিষদ সরকারের নিকট আবেদন অথবা সুপারিশমালা পেশ করিতে পারিবেন।
১৪) নিম্নোক্ত উৎস হইতে পরিষদের তহবিল গঠন হইবে:
(ক) জেলা পরিষদের তহবিল হইতে প্রাপ্ত অর্থ;
(খ) পরিষদের উপর ন্যস্ত এবং তৎকর্তৃক পরিচালিত সকল সম্পত্তি হইতে প্রাপ্ত অর্থ বা মুনাফা;
(গ) সরকার বা অন্যান্য কর্তৃৃপক্ষের ঋণ ও অনুদান;
(ঘ) কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান;
(ঙ) পরিষদের অর্থ বিনিয়োগ হইতে মুনাফা;
(চ) পরিষদ কর্তৃক প্রাপ্ত যে কোন অর্থ;
(ছ) সরকারের নির্দেশে পরিষদের উপর ন্যস্ত অন্যান্য আয়ের উৎস হইতে প্রাপ্ত অর্থ।
(ঘ) পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন ও অন্যান্য বিষয়াবলী
পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃস্থাপন এবং এই লক্ষ্যে পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন ও সংশ্লিষ্ট কার্য এবং বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ নিম্নে বর্ণীত অবস্থানে পৌঁছিয়াছেন এবং কার্যক্রম গ্রহণে একমত হইয়াছেন:
১) ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থানরত উপজাতীয় শরণার্থীদের দেশে ফিরাইয়া আনার লক্ষ্যে সরকার ও উপজাতীয় শরণার্থী নেতৃবৃন্দের সাথে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় ৯ মার্চ ’৯৭ ইং তারিখে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী ২৮ মার্চ ’৯৭ ইং হইতে উপজাতীয় শরণার্থীগণ দেশে প্রত্যাবর্তন শুরু করেন। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকিবে এবং এই লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির পক্ষ হইতে সম্ভাব্য সব রকম সহযোগিতা প্রদান করা হইবে। তিন পার্বত্য জেলার আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের নির্দিষ্টকরণ করিয়া একটি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।
২) সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন এবং উপজাতীয় শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পর সরকার এই চুক্তি অনুযায়ী গঠিতব্য আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে যথাশীঘ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ কাজ শুরু এবং যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতঃ উপজাতীয় জনগণের ভূমি মালিকানা চুড়ান্ত করিয়া তাহাদের ভূমি রেকর্ডভূক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করিবেন।
৩) সরকার ভূমিহীন বা দুই একরের কম জমির মালিক উপজাতীয় পরিবারের ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করিতে পরিবার প্রতি দুই একর জমি স্থানীয় এলাকায় জমির লভ্যতা সাপেক্ষে বন্দোবস্ত দেওয়া নিশ্চিত করিবেন। যদি প্রয়োজন মত জমি পাওয়া না যায় তাহা হইলে সেই ক্ষেত্রে টিলা জমির (গ্রোভল্যান্ড) ব্যবস্থা করা হইবে।
৪) জায়গা-জমি বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন (ল্যান্ড কমিশন) গঠিত হইবে। পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমি-জমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও এ যাবৎ যেইসব জায়গা-জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হইয়াছে সেই সমস্ত জমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিলকরণের পূর্ণ ক্ষমতা এই কমিশনের থাকিবে। এই কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপিল চলিবে না এবং এই কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া বিবেচিত হইবে। ফ্রীঞ্জল্যান্ড (জলে ভাসা জমি)-এর ক্ষেত্রে ইহা প্রযোজ্য হইবে।
৫) এই কমিশন নিম্নোক্ত সদস্যদের লইয়া গঠন করা হইবে :
(ক) অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি;
খ) সার্কেল চীফ (সংশ্লিষ্ট);
গ) আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান/প্রতিনিধি;
ঘ) বিভাগীয় কমিশনার/অতিরিক্ত কমিশনার;
ঙ) জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (সংশ্লিষ্ট)।
৬) (ক) কমিশনের মেয়াদ তিন বছর হইবে। তবে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে পরামর্শক্রমে উহার মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাইবে।
(খ) কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন।
৭) যে উপজাতীয় শরণার্থীরা সরকারের সংস্থা হইতে ঋণ গ্রহণ করিয়াছেন অথচ বিবদমান পরিস্থিতির কারণে ঋণকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করিতে পারেন নাই সেই ঋণ সুদসহ মওকুফ করা হইবে।
৮) রাবার চাষের ও অন্যান্য জমি বরাদ্ধ ঃ যে সকল অ-উপজাতীয় ও অ-স্থানীয় ব্যক্তিদের রাবার বা অন্যান্য প্লান্টেশনের জন্য জমি বরাদ্দ করা হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে যাহারা গত দশ বছরের মধ্যে প্রকল্প গ্রহণ করেন নাই বা জমি সঠিক ব্যবহার করেন নাই সে সকল জমি বন্দোবস্ত বাতিল করা হইবে।
৯) সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের লক্ষ্যে অধিক সংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করিবেন। এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করার লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করিবেন। এবং সরকার এই উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করিবেন। সরকার এই অঞ্চলের পরিবেশ বিবেচনায় রাখিয়া দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের জন্য পর্যটন ব্যবস্থার উন্নয়নে উৎসাহ যোগাইবেন।
১০) কোটা সংরক্ষণ ও বৃত্তি প্রদান: চাকরি ও উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সমপর্যায়ে না পৌঁছা পর্যন্ত সরকার উপজাতীয়দের জন্যে সরকারী চাকরি ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখিবেন। উপরোক্ত লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপজাতীয় ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য সরকার অধিক সংখ্যক বৃত্তি প্রদান করিবেন। বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় বৃত্তি প্রদান করিবেন।
১১) উপজাতীয় কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার জন্য সরকার ও নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ সচেষ্ট থাকিবেন। সরকার উপজাতীয় সংস্কৃতির কর্মকান্ডকে জাতীয় পর্যায়ে বিকশিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা করিবেন।
১২) জনসংহতি সমিতি ইহার সশস্ত্র সদস্যসহ সকল সদস্যের তালিকা এবং ইহার আওতাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন অস্ত্র ও গোলাবারুদের বিবরণী এই চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে সরকারের নিকট দাখিল করিবেন।
১৩) সরকার ও জনসংহতি সমিতি যৌথভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমাদানের জন্য দিন, তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করিবেন। জনসংহতি সমিতির তালিকাভুক্ত সদস্যদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমাদানের জন্য দিন তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করার জন্য তালিকা অনুযায়ী জনসংহতি সমিতির সদস্য ও তাহাদের পরিবারবর্গের স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের জন্যে সব রকমের নিরাপত্তা প্রদান করা হইবে।
১৪) নির্ধারিত তারিখে যে সকল সদস্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিবেন সরকার তাহাদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করিবেন। যাহাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা আছে সরকার ঐ সকল মামলা প্রত্যাহার করিয়া নিবেন।
১৫) নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে কেহ অস্ত্র জমা দিতে ব্যর্থ হইলে সরকার তাহার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবেন।
১৬) জনসংহতি সমিতির সকল সদস্য স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের পর তাহাদেরকে এবং জনসংহতি সমিতির কার্যকলাপের সাথে জড়িত স্থায়ী বাসিন্দাদেরকেও সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হইবে।
(ক) জনসংহতি সমিতির প্রত্যাবর্তনকারী সকল সদস্যকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে পরিবার প্রতি এককালীন ৫০,০০০/- টাকা প্রদান করা হইবে।
(খ) জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সদস্যসহ অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে যাহাদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতারী পরোয়ানা, হুলিয়া জারি অথবা অনুপস্থিতিকালীন সময়ে বিচারে শাস্তি প্রদান করা হইয়াছে, অস্ত্রসমর্পন ও স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের পর যথাশীঘ্র সম্ভব তাহাদের বিরুদ্ধে সকল মামলা, গ্রেফতারী পরোয়ানা, হুলিয়া প্রত্যাহার করা হইবে এবং অনুপস্থিতকালীন সময়ে প্রদত্ত সাজা মওকুফ করা হইবে। জনসংহতি সমিতির কোন সদস্য জেলে আটক থাকিলে তাহাকেও মুক্তি দেওয়া হইবে।
(গ) অনুরূপভাবে অস্ত্র সমর্পণ ও স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের পর কেবলমাত্র জনসংহতি সমিতির সদস্য ছিলেন কারণে কাহারো বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বা শাস্তি প্রদান বা গ্রেফতার করা যাইবে না।
(ঘ) জনসংহতি সমিতির যে সকল সদস্য সরকারের বিভিন্ন ব্যাংক ও সংস্থা হইতে ঋণ গ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু বিবদমান পরিস্থিতির জন্য গৃহীত ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহার করিতে পারেন নাই তাহাদের উক্ত ঋণ সুদসহ মওকুফ করা হইবে।
(ঙ) প্রত্যাগত জনসংহতি সমিতির সদস্যদের মধ্যে যাহারা পূর্বে সরকার বা সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত ছিলেন তাহাদেরকে স্ব-স্ব পদে পুনর্বহাল করা হইবে এবং জনসংহতি সমিতির সদস্য ও তাহাদের পরিবারের সদস্যদের যোগ্যতা অনুসারে চাকরিতে নিয়োগ করা হইবে। এইক্ষেত্রে তাহাদের বয়স শিথিল সংক্রান্ত সরকারী নীতিমালা অনুসরণ করা হইবে।
(চ) জনসংহতি সমিতির সদস্যদের কুটির শিল্প ও ফলের বাগান প্রভৃতি আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজের সহায়তার জন্যে সহজশর্তে ব্যাংক ঋণ গ্রহণের অগ্রাধিকার প্রদান করা হইবে।
(ছ) জনসংহতি সমিতির সদস্যগণের ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হইবে এবং তাহাদের বৈদেশিক বোর্ড ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হইতে প্রাপ্ত সার্টিফিকেট বৈধ বলিয়া গণ্য করা হইবে।
১৭) (ক) সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলী কদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হইবে। আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন বা সময় অনুযায়ী সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করিতে পারিবেন।
(খ) সামরিক ও আধা-সামারিক বাহিনীর ক্যাম্প ও সেনানিবাস কর্তৃক পরিত্যক্ত জায়গা-জমি প্রকৃত মালিকের নিকট অথবা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হইবে।
১৮) পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সরকারী, আধা-সরকারী, পরিষদীয় ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারী পদে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়োগ করা হইবে। তবে কোন পদে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের মধ্যে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি না থাকিলে সরকার হইতে প্রেষণে অথবা নির্দিষ্ট সময় মেয়াদে উক্ত পদে নিয়োগ করা যাইবে।
১৯) উপজাতীয়দের মধ্য হইতে একজন মন্ত্রী নিয়োগ করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হইবে। এই মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করিবার জন্য নিম্নে বর্ণিত উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হইবে।
(ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী
(খ) চেয়ারম্যান/প্রতিনিধি, আঞ্চলিক পরিষদ
(গ) চেয়ারম্যান/প্রতিনিধি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ
(ঘ) চেয়ারম্যান/প্রতিনিধি, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ
(ঙ) চেয়ারম্যান/প্রতিনিধি, বান্দরবন পার্বত্য জেলা পরিষদ
(চ) সাংসদ, রাঙ্গামাটি
(ছ) সাংসদ, খাগড়াছড়ি
(জ) সাংসদ, বান্দরবন
(ঝ) চাকমা রাজা
(ঞ) বোমাং রাজা
(ট) মং রাজা
(ঠ) তিন পার্বত্য জেলা হইতে সরকার কর্তৃক মনোনীত পার্বত্য এলাকার স্থায়ী অধিবাসী তিনজন অ-উপজাতীয় সদস্য।
এই চুক্তি উপরোক্তভাবে বাংলা ভাষায় প্রণীত এবং ঢাকায় ১৮ই অগ্রহায়ণ ১৪০৪ সাল মোতাবেক ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ইং তারিখে সম্পাদিত ও সইকৃত।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসিদের পক্ষে
(আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ্)
আহ্বায়ক
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি বাংলাদেশ সরকার।
(জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা)
সভাপতি
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।

বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৩

আজ নৃশংস নানিয়াচর গণহত্যা

 


রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়াচর একটি উপজেলা। উপজেলা সদরেই নানিয়াচর বাজারটি গড়ে উঠে। ১৯৯৩ সালে ২রা নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের বিষাদময় ইতিহাসে নানিয়াচর গণহত্যার ঘটনা এই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নৃশংস সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ডগুলোর এক নতুন সংযোজন বলা চলে। রাঙ্গামাটি থেকে ২০ মাইল উত্তরে হ্রদ বেষ্টিত নানিয়াচরের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে পানির পথে নৌযান। লঞ্চঘাটের একমাত্র যাত্রীছাউনিতে দীর্ঘদিন ধরে ৪০ ইবিআর, রাষ্ট্রীয়বাহিনী চেকপোস্ট বসিয়ে পাহাড়ী বৌদ্ধ যাত্রীদের নিয়মিত তল্লাশি নামে হয়রানি-নির্যাতন চালানো হতো। এখানে কর্তব্যরত রাষ্ট্রীয়বাহিনীর সদস্যরা পাহাড়ি বৌদ্ধ নারীদের উত্যক্ত করতো দীর্ঘ দিন ধরে। ২৭শে অক্টোবর খাগড়াছড়ি গামী পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দকে আটকে রেখে হয়রানি, নির্যাতন চালানো ও নেতৃবৃন্দকে খাগড়াাছড়ি পায়ে হেটে যেতে বাধ্য করা হয়। তাই পাহাড়ি বৌদ্ধ ছাত্র সমাজ হয়রানি আটকের প্রতিবাদ এবং গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারের দাবীতে সোচ্ছার হয় এবং বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্নভাবে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। ১৭ নভেম্বর সংঘটিত এই বর্বর গণহত্যায় ২৯ জন জুম্ম ছাত্র-জনতা-নারী-শিশু-বৃদ্ধ, আহত হয় শতাধিক।

ঘটনার সূত্রপাত : নির্ভযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, ২রা নভেম্বর ১৯৯৩ সালে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ যাত্রী ছাউনি থেকে রাষ্ট্রীয়বাহিনীর চেকপোস্ট প্রত্যাহারের সময় বেঁধে দেয় ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত। দিনটি ছিল বুধবার, নানিয়ারচর (নান্যেচর) এর সাপ্তাহিক বাজার দিন। তাই স্বাভাবিকভাবে দুর-দূরান্ত থেকে বাজারে এসেছিল শত শত জুম্ম শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে। ১৭ নভেম্বর যেহেতু ছাত্রদের বেঁধে দেয়া শেষ সময়, তাই ছাত্ররা সেই দিন বেলা ১২ টায় মিছিলের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ছাত্রদের সাথে যোগ হয় জনতাও। ঠিক বেলা ১২ টায় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে মিছিলটি স্থানীয় লাইব্রেরী প্রাঙ্গন থেকে শুরু হয়। যাদের প্রধান দাবীগুলো ছিল, যাত্রী ছাউনি থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চেকপোস্ট প্রত্যাহার, পিসিপি’র (পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ) ৫দফা দাবী মানাসহ গণধিকৃত জেলা পরিষদ বাতিলের দাবী। কয়েক হাজার পাহাড়ী বৌদ্ধ ছাত্র-জনতার মিছিলে স্লোগানে উজ্জীবিত। মিছিল থেকে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক অধিকারের দাবী উচ্চকন্ঠে জানানো হচ্ছিল। মিছিলটি শান্তিপূর্ণভাবে শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ শেষে কৃষি ব্যাংক এর সামনে সমাবেশ করে। অন্যদিকে বাঙ্গালী অনুপ্রবেশকারীদের সংগঠন পার্বত্য গণপরিষদও একটি জঙ্গী মিছিল বের করে। তারা মিছিল থেকে সাম্প্রদায়িক স্লোগান তুলতে থাকে। এক পর্যায়ে সেটেলার গণপরিষদের মিছিল থেকে হামলা করে এক বৃদ্ধ পাহাড়ী বৌদ্ধকে আহত করা হয়। এতে করে জুম্মদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। এক পর্যায়ে পাহাড়ী বৌদ্ধ ছাত্র জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাষ্ট্রীয়বাহিনী ও সেটেলাররা। ফলে ঘটে যায় বিংশ শতাব্দীর নৃশংসতম সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ড।


ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি : ১৭ নভেম্বর ১৯৯৩ সালে সংঘটিত এই বর্বর গণহত্যায় ২৯ জন নিহত হয় এবং জুম্ম ছাত্র-জনতা-নারী-শিশু-বৃদ্ধ, আহত হয় শতাধিক। এই জঘন্য বর্বর গণহত্যায় রাষ্ট্রীয়বাহিনীর বন্দুক গর্জে উঠেছিল নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার মিছিলে,রাষ্ট্রীয়বাহিনীর পরিকল্পিত ইশারায় সেদিন ধারালো দা, বর্শা, বল্লম নিয়ে নানিয়াচর বাজারে আগত নিরিহ পাহাড়ী বৌদ্ধদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বগাছড়ি, বুড়িঘাট থেকে আগত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী সেটেলাররা। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল পাহাড়ী বৌদ্ধদের ২৭টি বসত বাড়ি। নানিয়াাচর বাজারে পাহাড়ী বৌদ্ধ ছাত্র, জনতার শান্তিপুর্ন মিছিলে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে বাঙ্গালি সেটেলার ও রাষ্ট্রীয়বাহিনী হত্যা যজ্ঞ চালায়। এই বর্বর গণত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিল সেটেলারদের সংগঠন পার্বত্য গণপরিষদের নেতা মোঃ আয়ুব হোসাইন, প্রাক্তন চেয়ারম্যান বুড়িঘাট, তৎকালীন বুড়িঘাট ইউ,পি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ, নানিয়াচর জোনের জোন কমান্ডার মেজর সালাউদ্দিন। এতে নিহত হয় ২৯ জন পাহাড়ী বৌদ্ধ নাগরিক আহত হয় শতাধিক। এতে জুম্ম ছাত্ররা যখন প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে তখন সেনা ক্যাম্প হতে জুম্ম ছাত্রদের উপর এলোপাথারি গুলি বর্ষণ করা হয়। এক পর্যায়ে অনুপ্রবেশকারী বাঙ্গালীদের মিছিল থেকে দা, বল্লম ইত্যাদি দিয়ে হামলা হলে জুম্ম ছাত্র সমাজ জনতাকে নিয়ে প্রবল প্রতিরোধ করে। এতে সেটেলার বাঙ্গালীরা পিছু হটলে কর্তব্যরত আর.পি ল্যান্স নায়ক জুম্ম জনতার উপর ব্রাশ ফায়ার করেন। এতে মূর্হুতের মধ্য ৮জন জুম্ম ছাত্র শহীদ হন। গুলিতে আহত হন অনেকে। এতে জুম্মদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। বিচ্ছিন্ন হওয়া জুম্মদের উপর ঝাপিয়ে পরে সশস্ত্র রাষ্ট্রীয়বাহিনী ও বাঙ্গালী সেটেলাররা। সেনাবাহিনীর বন্দুকের আঘাতে মূর্মুষ করার পর কাপুরুষেরা অনেককে পশুর মত জবাই করেছে। অনেকে কাপ্তাই লেকের পানিতে ঝাঁপিয়েও প্রাণ বাচাঁতে পারেনি। জেট বোট ও নৌকার উপর থেকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে অনেককে। যারা পাহাড়িদের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল তাদেরকে টেনে হিচড়ে বের করে হত্যা করা হয়েছে অথবা পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পাশের জুম্ম গ্রামগুলি লুটপাট করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সময় রাঙ্গামাটি থেকে আসা লঞ্চ পৌঁছালে সেখানেও হামলা করে অনেককে হতাহত করা হয়। এতে ভদ্রিয় নামক এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আক্রমণ করে গুরুতর আহত করেন। এভাবে প্রায় দু’ঘন্টা ধরে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় জুম্মদের উপর।


বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ঢাকায় মিছিল: নানিয়াচর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ ঢাকায় মৌন মিছিল করেন। এটি ছিল পার্বত্য ভিক্ষুসংঘের রাজধানী বুকে প্রথম মৌন মিছিল। এ মৌনমিছিলে অংগ্রহকারী এক বৌদ্ধ ভিক্ষু বলেন, এ হত্যাকান্ডে শ্রীমৎ ভদ্রিয় মহাথের নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু গুরুতর আহত হন। তখন পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সভাপতি পদে ছিলেন শ্রীমৎ তিলোকানন্দ মহাথের। এ মৌন মিছিলে প্রায় তিনশত জন বৌদ্ধ ভিক্ষু অংশগ্রহন করেন। জাতীয় শহীদ মিনার হতে প্রেসক্লাবে গিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত সভার মাধ্যমে শেষ হয়। এ সংক্ষিপ্ত সভায় অন্যান্যদের মধ্যে ভিক্ষুসংঘ হতে শ্রীমৎ প্রিয়তিষ্য ভিক্ষু ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে দোষী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করে বক্তব্য প্রদান করেন। তিন পার্বত্য জেলা হতে ঢাকার বুকে গিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু এ মিছিলে অংশ গ্রহন করে। শান্তপ্রিয় বৌদ্ধদের উপর অথ্যাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে রাজ পথে নামতে বাধ্য হয়। পরিশেষে বলা যায় যে, এই গণহত্যার হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও সরকারে পক্ষ থেকে নিহতের ২০ জন বলে জানানো হয়েছিল। সেই সময়ের পত্রিকা মারফত এই সংখাকে ২৭ বা তারও বেশী বলে দাবী করা হয়েছে। তবে ভুক্তভোগী জুম্মরা এই সংখ্যা শতাধিক বলে জানিয়েছেন। যেহেতু ঘটনার পর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি ছিল, তাই প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ বার বার উঁকি মারে। গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষন এই সব মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ বার বার প্রশ্ন বিদ্ধ করেছে পার্বত্য অঞ্চলে সামরিক, বেসামরিক, প্রশাসক ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা।


তথ্যসূত্র: (১) জুম্ম সংবাদ বুলেটিন, বুলেটিন ১৫,৩য় বর্ষ, শুক্রবার, ৩১শে ডিসেম্বর,১৯৯৩ ইং। (২) সিএউটিবিডি ডটকমনেট, “পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত গণহত্যা” ০৯ নভেম্বর, ২০১১ইং। (৩) জনকন্ঠ, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং । (৪) প্রথম আলো, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং। (৫) দৈনিক পূর্বকোণ, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং। (৬) দৈনিক আজাদী, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৩ইং ।

বৃহস্পতিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৩

রক্তাক্ত ১০ই নভেম্বর


সেই এক হৃদয় বিদারক, বিভীষিকাময় ঘটনা, উদ্বেলিত হৃদয়ের রক্তকণিকা খসে পড়া একটি মুহুর্ত…।

অসংখ্য তারকাখচিত উদার আকাশ থেকে হঠাৎ যদি কোন উল্কাপিণ্ড খসে পড়ে মানুষের চমক লাগার মত কিছুই নয়; কিন্তু উজ্জ্বল শশীকলার আলোর বন্যায় যদি রাহুগ্রাসে হঠাৎ বিষাদের কালো ছায়া নামে তাহলে সারা দুনিয়ার মানুষ ব্যথিত ব্যাকুল ও হতচকিত না হয়ে পারে না।

বিশ্বের বিভিন্ন জাতির ইতিহাসে যেমনি রয়েছে সেই অতি শোকাবহ ও বিষাদের কালো দিন, তেমনি রয়েছে আমাদেরও।

জাতীয় অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে আমরাও জুম্ম জনগণ করে যাচ্ছি প্রতিবাদ, পাশবিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম আর ষড়যন্ত্র ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছি প্রতিরোধ।

তাই স্বভাবতই যাবতীয় অত্যাচারী শক্তি ও ষড়যন্ত্রকারী ভণ্ডামীই হয়েছে আমাদের শত্রু। সেই ভণ্ড শত্রুদেরই বিষাক্ত নখের আঁচড়-জাতীয় ইতিহাসের সব চাইতে জঘন্যতম, ঘৃণ্যতম ১০ নভেম্বর – যা গোটা বিশ্বকে করেছে হতবাক আর জুম্ম জাতি হয়েছে সান্ত্বনাহীন ব্যথিত ও শোকাভিভূত।

জুম্ম জাতির ইতিহাসে গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র (গিরি – ভবতোষ দেওয়ান, প্রকাশ – প্রীতি কুমার চাকমা, দেবেন-দেবজ্যোতি চাকমা ও পলাশ – ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান) একটি কলঙ্ক ও একটি জঘন্যতম ষড়যন্ত্র। অতি শোকাবহ ও মর্মান্তিক ১০ নভেম্বর-এর কালো দিবসের স্মৃতি রোমন্থনের পূর্বাহ্নে জুম্ম জাতির কুলাঙ্গার গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের হীন চরিত্র ও উদ্দেশ্য উন্মোচন করা অপরিহার্য।

গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র যদিও দীর্ঘদিন যাবৎ পার্টির পতাকাতলে সমবেত হয়ে কাজ করেছে তথাপি পার্টি নেতৃত্বকে কখনই মেনে নিতে পারেনি।

দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতালিপ্সা, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, ব্যভিচার, উচ্চাভিলাষ এদের স্বভাব চরিত্রে মজ্জাগত ছিল।

অথচ এই কুচক্রীরা শ্রদ্ধেয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে পশ্চাতে ও সঙ্গোপনে অনেক বিরূপ মন্তব্য ও অপপ্রচার যেমন কখনও বলতো ধর্মভীরু, কখনও বা আপোসপন্থী, কখনও বলতো একরোখা, সর্বোপরি তার একনিষ্ঠ ও যোগ্যতর সহকর্মীদের বিশেষত সন্তু লারমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও কুৎসা রটনা করতে বরাবরই প্রয়াসী ছিল। সমগ্র পার্টিতে একটা প্রভাব বিস্তারের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।

কিন্তু সামনাসামনি কোন মন্তব্য করার সৎসাহস কারোর ছিল না।

পক্ষান্তরে তারাই উপযুক্ত, তারাই সবজান্তা, তারাই জুম্ম জাতির জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে দাবি করতো নির্লজ্জভাবে। তাই এই নেতত্বকে তারা বিষাক্ত আগাছা বলেই মনে করতো। এ কারণে তারা এই নেতৃত্বের প্রতি তাদেরই মধ্যে গালমন্দ করতো, ঘৃণাভরে ভর্ৎসনা করতো এবং মুখ বিকৃত করে অভিশাপ দিত আর নেতৃত্বের বিষোদগার করতে সচেষ্ট থাকতো। কিন্তু শ্রদ্ধেয় নেতার পিতৃহৃদয় ও বিপ্লবীসত্ত্বা বরাবরই বিশ্বাস করতো – তাদের একদিন না একদিন সুমতি হবে এবং আত্মসমীক্ষা করে একদিন সৎপথে ফিরে আসবে।

কিন্তু নেতার এই সহনশীলতা ও ক্ষমাশীল মনোভাবকে তারা দুর্বলতা বলে বিবেচনা করতো এবং পরিশেষে একদিন ক্ষমতা কেড়ে নেবার উন্মত্ততায় ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিল।

১৯৮২ সালের জাতীয় সম্মেলনে তারা সশস্ত্র বাহিনীকে উস্কানী দিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পার্টির সর্বময় ক্ষমতা দখলের এক বিরাট অপচেষ্টা চালায়।

কিন্তু সচেতন কর্মীবাহিনীর সামনে সেসব ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও পার্টি নেতৃত্বে তাদেরকে ক্ষমা প্রদর্শন পূর্বক পুনর্বার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করে।

কিন্তু অবিশ্বাসের ভূত তাদের কায়-মন-বাক্য থেকে কখনই সরে পড়ল না। পুনরায় তারা ষড়যন্ত্রের পথে পা বাড়াতে থাকে। তারা পার্টির অভ্যন্তরে থেকে পার্টির বিরুদ্ধেই স্যাবোটেজ আরম্ভ করে দেয় এবং ভাতে মারা ও পানিতে মারা বিষবাষ্প সৃষ্টি করে।

তার ফলে সমগ্র পার্টিব্যাপী এক চরম সঙ্কট ও অচলাবস্তা সৃষ্টি হয়। তারপর একসময় আকস্মাৎ ঘটল বিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণে পেটের নাড়িভূড়ি সব বেরিয়ে পড়ল এবং কুরুক্ষেত্রে কলিজা ফাটা আর্তনাদ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হলো।

পরিণতিতে চক্রান্তকারীদের সার্বিক অবস্থা দ্রুত ডুবন্ত সূর্যের মতই যখন মুমূর্ষু হয়ে দেখা দিল তখন হন্যে হয়ে সমঝোতার পথ খুঁজতে থাকে।

অতপর পার্টি নেতৃত্ব জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ‘ক্ষমা করা ও ভুলে যাওয়া নীতির’ ভিত্তিতে গণতন্ত্রের পথ সুগম করার মানসে এক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে।

কিন্তু পৃথিবীতে যত ধর্মের কাহিনীই থাকুক না কেন চোররা তা শুনতে কখনই রাজী নয়। তারা আরো নতুন কায়দায় ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে গোপনে গোপনে। সংক্ষেপে এই হলো ১০ নভেম্বরের পূর্বকালীন অবস্থা।

এইভাবে চলতে থাকে একদিকে ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে প্রতিরোধ। এমনিভাবে বর্ষা চলে গেল। শরতের আগমন ঘটল। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু করতে করতে একদিন শারদীয় নির্মল দিনগুলোও নিরসমুখে বিদায় নিল।

চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র তবুও শেষ হলো না। চক্রদের হোতা গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসার কথা ছিল কিন্তু তারা এলো না।

একসময় প্রকাশ জানালো সে তার অনুগামীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। তাই কেন্দ্রের সাহায্য চেয়ে এক জরুরী চিঠি পাঠালো। অনেকের সন্দেহ হলো সমঝোতায় হয়তো চক্রান্তকারীরা আসতে নারাজ।

এ ব্যাপারে নেতার কাছে পরামর্শ চাওয়া হলে শ্রদ্ধেয় নেতা ধৈর্য্য, সহিঞ্চুতা ও দৃঢ়তা নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পরামর্শ দিলেন।

তাই তখনকার অস্থায়ী ব্যারাকটা অন্যত্র সরে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলো কারণ চক্রদের হোতা গিরি ঐ অস্থায়ী ব্যারাক থেকেই চলে গিয়েছিল।

নভেম্বর পয়লা সপ্তাহ। পূর্বের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য রিপ ও সেক্টর কমান্ডার মেজর দেবংশীর নেতৃত্বে বিশ্বাসঘাতক প্রকাশের চিঠি মূলে চক্রান্তকারীদের সাহায্য করতে ও উদ্ভুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে একটা দল বাইরে চলে গেল।

হঠাৎ দুই নম্বর সেক্টর থেকে জরুরি ভিত্তিতে খবর আছে যে, চক্রান্তকারীদের জৈনক কমান্ডার তাদের কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছে এবং সঙ্গে এ কথাও বলেছে যে, চক্রান্তকারীরা আবারো চক্রান্ত করার পাঁয়তারা করছে।

সপ্তাহের শেষ দিন। শোনা গেল বাংলাদেশ বেতার থেকে খবর পরিবেশিত হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। প্রথমে হুঁশিয়ারি সংকেত, পরে বিপদ সংকেত। এভাবে বিপদ সংকেত নম্বর ৩, ৪, ৫ হতে এক সময় মহাবিপদ সংকেত দেয়া হলো।

সঙ্গে সঙ্গে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। আমরা ভাবলাম দুর্যোগ বুঝি এখনো কেটে যায়নি। প্রকৃতির এই ভয়ংকরতা ও রৌদ্ররূপ হৈমন্তীর দিনগুলোকেও বুঝিবা রেহাই দিচ্ছে না। আমাদের সতর্কতা আরো বাড়ানো হলো।

বিশেষ প্রোগ্রামে শ্রদ্ধেয় লীডার একটু বাইরে গেলেন; কড়া পাহাড়ার মধ্যে তিনি ফিরে এলেন রাত্রে। সেদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে এবং শীতল হাওয়ার শিকার হয়ে লীডার অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

নভেম্বর দ্বিতীয় সপ্তাহ। আবহাওয়া আরো খারাপ হয়েছে। প্রায়ই ঝড়ো হাওয়া এসে গোটা পরিবেশটাকে বিষণ্ণ করে তুলেছে।

ডা: জুনির নিরবিচ্ছিন্ন পরিচর্যার সত্ত্বেও লীডার নিরাময় হয়ে উঠতে পারলেন না। রাত প্রায় তিনটে লীডার অসুকে ছটফট করছেন, নিরন্ন মুখে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন। আমরা যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়লাম।

এদিকে সন্তু স্যারও প্রেসিডেন্ট এরশাদের ৩ অক্টোবরের ঘোষণার বিপরীতে খোলা চিঠি লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

তাই আর অস্থায়ী ব্যারাকটা স্থানান্তরিত করা সম্ভব হলো না। নভেম্বর ৯ তারিখ বৃষ্টির প্রকোপ কিছুটা কমেছে বটে কিন্তু প্রায় সময়টা জুড়ে বায়ুপ্রবাহ বয়ে চলেছে।

সারাক্ষণ কাকের কা-কা রবে প্রকৃতি যেন কিসের এক আশঙ্কায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। বিকেলে লীডারকে কিছু বিস্কুট খাওয়াবার চেষ্টা করা হলো কিন্তু তিনি খেতে পারলেন না। ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো।

সবাই যার যার বিছানায় শুঁয়ে পড়েছে। রাত ৮টা নাগাদ পাশের ঝিরিতে কি যেন একটা গড়িয়ে পড়ার শব্দ শোনা গেল।

দু’জন সৈনিক টর্চলাইটের আলো দিয়ে জায়গাটা চার্জ করে এলো। কিছুই দেখতে না পেয়ে প্রকৃতির ঘটনা ভেবে তারাও ঘুমিয়ে পড়লো। রাত ১১ থেকে ১২ টা পর্যন্ত আমরা চার জন প্রহরায় ছিলাম।

তখনও প্রায় ভারী শুষ্ক হাওয়া বয়ে চলছিল। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে জোছনার আলো পৃথিবীর সাথে লুকোচুরি খেলছিল।

তখন কেই বা জানতো প্রকৃতির মধ্যে কোন বিভীষিকাময় ঘটনা কারোর জন্য অপেক্ষা করছে কিনা। প্রহরী বদল করে আমরা শুঁয়ে পড়লাম।

আমার পাশের সঙ্গীটার সামান্য জ্বর ছিল। অতএব তাকে কোনোরকম বিরক্ত না করে একটু অসুবিধার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।

১০ নভেম্বর ভোর রাত তিনটে বাজতে তখনও কিছু বাকি। গভীর তন্দ্রা থেকে বিদঘুটে এক স্বপ্নের শিহরণে আমি হঠাৎ জেগে গেলাম। শয্যার উপর বসে চারিদিকে একটু তাকালাম, দেখলাম প্রহরী বদল হচ্ছে।

হাতের ঘড়িটা টর্চের আলোতে দেখে নিয়ে আবার গা এলিয়ে দিলাম। ভাবলাম বোধকরি একটু অসুবিধার মধ্যে ঘুমুতে গিয়ে এভাবে দু:স্বপ্নের মধ্যে ঘুম ভাঙলো।

তারপর আস্তে আস্তে ঘুমের তন্দ্রা পাচ্ছে। পায়ের কাছে একটু কড়মড় শব্দ হওয়াতে টের পেলাম পিনহোল টর্চের আলো দিয়ে কে যেন বাইরে যাচ্ছে, আর একটু পরেই আকস্মাৎ কারবাইনের ব্রাশ ফায়ার হলো ট-ট-ট-টশ্।

সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পায়ের দিকের মাটিতে লাইন পজিশন নিলাম। ‘মুই রিপন, রিপন‘ কথাটা শুনতেই তাকিয়ে দেখি রিপনদা ‘ওমা’ ‘ওমা’ করতে করতে উঠানে গড়াগড়ি দিচ্ছেন।

কিছু একটু বোধগম্য না হতেই চিৎকার দিয়ে বললাম কি হয়েছে, কি হয়েছে! তখন উত্তরপশ্চিম কোণের পায়খানা ঘরের রাস্তার মুখে (বড় ব্যারাকে একদম সন্নিকটে আমাদের এলএমজি ম্যানের খুব কাছাকাছি) থেকে একজন সোজা দক্ষিণ দিকে লীডারকে লক্ষ্য করে ক্রমাগত ব্রাশ ফায়ার করছে, অন্যজন আমাকে আর সন্তু স্যারকে লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করে চলেছে।

আর বিশ্বাসঘাতকেরা ‘ইয়া আলী…, ইয়া আলী…’ শব্দ করছে এবং অাবুল্যা এডভান্স করে বিকৃত গলার স্বরে শব্দগুলো উচ্চারণ করছে। ততক্ষণে আরো ৪/৫ জন আমাদের ব্যারাকের খুব কাছে (আমার ৫/৬ গজ দূরত্বে) এসে একসাথে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে দিয়েছে।

বোঝা গেল চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশ আর্মি ভান করে বিশ্বাসঘাতকতামূলক আক্রমণ করতে এসেছে। ট্রেঞ্চে গিয়ে পজিশন নিলাম। সেখানে সন্তু স্যার ও মিহিরদাকে নাগাল পেলাম।

ততক্ষণে সেকেন্ড লেফটেনান্ট মণিময় ও কর্পোরেল অর্জুন উত্তর পার্শের ট্রেঞ্চগুলোতে পজিশন নিতে গিয়ে সরাসরি শত্রুদের ফায়ারের মুখে পড়ে ইহলীলা সংবরণ করল। ঐ দুটো অস্থায়ী ব্যারাকে আমরা ২০/২২ জন মানুষ ছিলাম।

ঠিক সেই মুহূর্তে সব চাইতে অসুবিধার দিকটা ছিল এই যে, শক্ররা রয়েছে উত্তর প্রান্তেভ আর আমরা পজিশন নিতে বাধ্য হয়েছি দক্ষিণ প্রান্তে।

মাঝখানে রয়ে গেছে দুটি ব্যারাক ও বাদবাকি মানুষগুলো। তাই বাদবাকি মানুষগুলোর কথা ভেবে আমরা ঠিকমত ফায়ারই করতে পারছিলাম না। কারণ সেই অন্ধকারে কাউকে সঠিকভাবে চেনা যাচ্ছিল না।

আমরা অস্থায়ীভাবে তিন ভাগে ভাগ হয়ে অবস্থান করছিলাম। পাহাড়ের সর্বোচ্চ উত্তর দক্ষিণ লম্বালম্বি ব্যারাক, সেখান থেকে ৪০/৫০ গজ নিচে পাহাড়ের মাঝামাঝিতে সামনাসামনি দুটি ব্যারাক।

ব্যারাকের পাশে দক্ষিণমূখী হয়ে একজন সেন্ত্রী থাকে। সেখান থেকে ২০/২৫ গজ নিচে ঝরণার কাছাকাছিতে পাকঘর-কাম-ব্যারাক দুটো পাশাপাশি।

সেদিন পূর্বমুখী একজন সেন্ত্রী ও উপরের ব্যারেকের উত্তর-দক্ষিণ হয়ে দুটো সেন্ত্রী মিলে সর্বমোট ৪ জন সেন্ত্রী সবসময় থাকতো। কিন্তু শত্রুরা মুহুর্মুহু ফায়ার ও হাত বোমার আওয়াজ করতে করতে মধ্য ব্যারাকের উঠোন বরাবর ও ব্যারাকের নিচে ঢুকে পড়েছিল।

উপর্যুপুরি ব্রাশ ফায়ার ও হাত বোমার বিস্ফোরণে মনে হচ্ছিল প্রতিহিংসার উন্মত্ততায় শত্রুরা যেন প্রতিটি ঝোপপাড়কেও ধ্বংস করে দিতে চাইছে।

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ট্রেঞ্চের কাছাকাছিতে দুটো হাত বোমা ফেটে যায় এবং প্রবল গোলা বর্ষণ করতে থাকে। ফিল্ড কমান্ডার সন্তু স্যার উপরে ফাইটিং গ্রুপ নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করতে সংকেত দিতে সচেষ্ট থাকেন।

ইতিমধ্যে কর্পোরেল জাপানকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা ও পার্টির বিভিন্ন ইউনিটের সাথে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদানেও সন্তু স্যার ব্যাপৃত থাকেন।

এমন সময় উপর থেকে আমাদের ফাইটিং গ্রুপ এস শত্রুদেরকে পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করে। চতুর্দিক থেকে ফায়ারিং আওয়াজ শুনে শত্রুরা মন্ত্রী-মন্ত্রী বলে ডাকাডাকি শুরু করে দেয় এবং কয়েকবার লম্বা লম্বা বাঁশি বাজানোর পর পূর্বদিকে ছড়া (ঝরনা) বেয়ে চলে যায়।

কিন্তু ততক্ষণে ৮ জন ঘটনাস্থলে শহীদ হন এবং কর্পোরেল সৌমিত্র ও কর্পোরেল বকুল আহত হন। কিন্তু সৌমিত্র গুরুতরভাবে আহত হয়ে লীডারের জায়গা থেকে সামান্য দূরের ঝোপে আড়াল করা একটি গর্তে নিজেকে কোনমতে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হন। তিনি আহত অবস্থায় দুইদিন বেঁচে থাকেন।

তাঁর প্রত্যক্ষ বিবরণ থেকে জানা যায় – লীডার প্রথমে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। কিন্তু অসুস্থ শরীর ও দুর্বলতা হেতু সরে যেতে পারেননি।

শত্রুরা ব্যারাকের ভিতরে ঢুকে লীডারকে আহতবস্থায় দেখতে পায়। তখন লীডার হত্যাকরীদের সাথে কথা বলার সুযোগ পান। লীডার প্রথমে বলেন – ‘কি, তোমাদের ক্ষমা করে আমরা অন্যায় করেছি?

আমাকে কিংবা তোমাদের বন্ধুদের মেরে জাতি কি মুক্ত হবে? যাক, তোমরা প্ররোচিত ও উত্তেজিত হয়ে যাই করো না কেন জাতির দুর্দশাকে তোমরা কখনো ভুলে যেও না আর জাতির এ আন্দোলনকে কখনো বানচাল হতে দিও না।’

লীডারের কথা শুনে উপস্থিত দু’জন বিভেদপন্থী নীরবে চলে যায়। তারা আর ফিরে আসেনি। ততক্ষণে তাদের মধ্যে কড়া ভাষায় কথা কাটাকাটি হতে শোনা যায় এবং সন্ত্রস্ত কণ্ঠে ‘ও যেদং ভিলে, যেদং’ শব্দ শোনা যায়।

সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎগতিতে কে একজন এসে লীডারের গায়ে উপর উঠে কোন কথা না বলে ব্রাশ ফায়ার করে দ্রুত পালিয়ে যায়।

তার কিছুক্ষণ পরেই ঐ জায়গাটি আমাদের পুনর্দখলে আসে এবং সমস্ত শত্রুদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কর্মীরা এসে শ্রদ্ধেয় লীডারের বুক জড়িয়ে ধরে এবং আবেগাকুল ও উদ্বেলিত কণ্ঠে বলতে থাকে – ‘স্যার, ও স্যার আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না। তুমি ছাড়া আমি কোথায় থাকবো স্যার।’

শ্রদ্ধেয় লীডারের বুক তখনও উঞ্চ ছিল। তিনি কোনমতে চোখ মেলে তাকালেন এবং হাত দিযে কি যেন সান্ত্বনা দিতে চাইলেন কিন্তু কোন কথা বেরুল না, কোন অশ্রু ঝরলো না।

শুধু বুকের তাজা রক্ত বিছানা গড়িয়ে টপ্ টপ্ করে ঝরে পড়তে লাগলো। তারপর চোখ খোলা রেখে লম্বা এক বুকভরা শ্বাস নিয়ে অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় চিরশায়িত হয়ে রইলেন।

নির্মম এই পৃথিবী যিনি নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত জাতির সেবায় নিজের শেষ রক্ত বিন্দুটুকুও দান করে গেলেন সেই জাতি তাদের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূতকে এক ফোঁটা ঔষধ খাওয়াবার সুযোগ পেল না।

তাঁর স্বাভাবিক উজ্জ্বল চেহারা তাঁর খোলা চোখ যেন তিনি এখনও স্বাভাবিক। দেখে মনে হয় মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও কোন প্রকার ভয়ভীতি তাঁকে যেমন ছোঁয়াতে পারেনি, তেমনি জন্মভূমির মায়া, প্রকৃতির আলো বাতাস দু’চোখ ভরে দেখার স্বাদ এখনো মিটেনি।

উত্তপ্ত রক্ত প্রবাহের বিদ্যুৎ খেলানো শান্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা শত্রুকে তাড়া করে ফিরে এসেই জিজ্ঞেস করে স্যার কোথায়? যখন দেখে স্যারের নিষ্প্রাণ দেহখানি পড়ে রয়েছে তখন আর কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পারে না।

কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে ‘শেষ.., সব শেষ চক্রান্তকারী গুণ্ডারা আজ স্যারকে হত্যা করে আন্দোলনকে ধ্বংস করলো। তোমাদের একদিন এই পাপের প্রয়শ্চিত্ত করতে হবে।’

সেদিনের কান্না প্রিয়নেতাকে হারানোর ব্যথা, চিরবঞ্চিত দৃষ্টিশক্তিকে হারানোর চাইতেও গভীর ও মর্মন্তুদ।

যে মানুষটি জুম্ম জাতির মুক্তি কামনায় বছরের পর বছর কঠোর সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন, যে বিপ্লবী কণ্ঠ ছিল দুনিয়ার সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার সেই অগ্রনায়ক, জাতির কর্ণধার, জাতীয় চেতনার আলোকবর্তিকা যেন তার সমস্ত সলিতা বিসর্জন দিয়ে নিজের দায়িত্ব সমাপন করলেন।

কিন্তু জাতিকে তার আরো অনেক কিছু দেবার মত ছিল।

সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে…, হৃদয়ের গভীরতম আবেগে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রয়েছে দেখে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম। অশ্রু মুছে নিলাম।

সান্ত্বনা দেবার জন্য কিছু বলতে যেয়েই কণ্ঠরোধ হয়ে এলো বিধাতা সেদিন বাকশক্তিকে কেড়ে নিয়েছেন। সমস্ত দেহটা অবসন্ন বোধ করছি।

মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো। মিহিরদা সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন – ‘যা হবার তো হয়েই গেছে সেটা ফেরাবার আর নেই।

তোমরা ধৈর্য্য ধরো। আর আহত সৌমিত্রকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করো।’ অবশেষে সমস্ত শক্তি দিয়ে আত্মসংবরণ করলাম। লীডারের গোছানো জিনিসগুলো এক জায়গায় জড়ো করে প্রয়াত নেতার মরদেহের উপর কাপড় জড়িয়ে দিলাম।

কিন্তু মুখ ঢেকে দেবার সাহস হলো না। যেই মুখ উগ্র ধর্মান্ধ স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার ও উগ্র বাঙালি মুসলমান জাতীয়তাবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দু্র্গ গড়ে তুলেছিল, সেই অভূতপূর্ব মুখখানি ঢেকে দিতে সাহস হলো না।


সেদিনের আকাশ ছিল মেঘলা, মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়া এসে সমস্ত পরিবেশটাকে স্যাঁতস্যাঁতে করে রেখেছিল। ব্যারাকের সমস্ত জিনিসপত্র বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ছিটানো। উঠানে ও মেঝেতে হাত বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত কালো দাগগুলো সমস্ত পরিবেশটাকে কলুষিত করে রেখেছিল।

বেপরোয়া গুলির আঘাতে সমস্ত কাপড়-চোপড় ছিন্নভিন্ন হয়ে এলোপাতাড়ি পড়ে রয়েছে; ইতস্ততভাবে গোলাগুলি পড়ে রয়েছে। ব্যারাকের ভিতরে লাশ, উঠানে লাশ, রাস্তার উপরে লাশ সবাই যেন বিছানাহীন শয্যায় অনাদরে লুটোপুটি দিচ্ছে।

আমরা সব মরদেহগুলো এক জায়গায় জড়ো করে কাফন মুড়িয়ে দিচ্ছিলাম। দেখতে পেলাম চক্রান্তকারী শত্রুরা ঐ মরদেহগুলোর উপর অহেতুক গুলি বর্ষণ করে তাদের প্রতিহিংসার ঝাল মিটিয়েছে।

পাষণ্ডতার এই কুলক্ষণ উন্মত্ত পাগলা কুকুরকেও অনায়াসে হার মানিয়ে দেবে।

তখনও বাতাসে সর্বত্রই পোড়া বারুদের উগ্রগন্ধ। প্রকৃতির বিমর্ষতাও যেন নাছোড়বান্দা। মৃদু সঞ্চারমান মেঘের ফাঁকে ফাঁকে কখনও এক ঝলক রোদ এসে ধরণীর অশ্রু মুছিয়ে দেবে এটুকু ক্ষীণ আশাও সেদিন ছিল না।

মাননীয় ফিল্ড কমান্ডার সন্তু লারমা মিহিরদাকে আহতদের চিকিৎসার ভার দিলেন। আশেপাশের সমস্ত এলাকা চার্জ করে দেখার নির্দেশ দিলেন আমাদেরকে।

তার পরদিন অন্যান্য সব ইউনিটগুলোতে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে দ্রুত খবর পাঠানোর ব্যবস্থা নিলেন এবং ঔষধ সংগ্রহের জন্য লোক নিয়োগ করলেন।

ইতিমধ্যে দু:সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশে বন্ধু-বান্ধবরা দলে দলে এস ভীড় জমাতে শুরু করছে। সবাই প্রয়াত নেতাকে শেষবারের মত দেখতে চায়। অবশেষে সন্তু স্যার এসে পৌঁছালে উপস্থিত লোজনদের প্রিয়নেতার শেষ দর্শনের অনুমতি দিলেন।

ব্যারাকের ভিতরে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। একজন বৃদ্ধ লোক এসে প্রয়াত নেতার কাফন খুলে দেখলেন। তার গুলিবিদ্ধ ঝাঁঝড়া বুক দেখে আস্তে ধীরে বসে পড়লেন এবং কপালে হাত রেখে অশ্রুসিক্ত বিস্ফোরিত নয়নে বিলাপ করতে শুরু করলেন- ‘হে দেশমাতৃকার প্রকৃতি সন্তান!

আমরা জানি শত প্রলোভন তোমাকে মোহিত করতে পারেনি; একটা আগ্রাসী জাতির যাবতীয় হুমকি তোমাকে বিচলিত করতে পারেনি; তোমাকে মানসিক দৃঢ়তায় কোনদিন ভাটা পড়তে দেখিনি।

তোমার স্বার্থত্যাগ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তোমার প্রেরণায় গোটা জাতি আজ বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে সাহসী হয়েছে। তবুও তোমার শত্রুরা জাতির কুলাঙ্গারেরা তোমাকে হত্যা করলো।’

তিনি ঢুকরে কেঁদে উঠলেন। সবাই অশ্রু সজল নেত্রে একবাক্যে বলে উঠলাম – সত্যিই বিনা মেয়ে বজ্রঘাতের মতই হয়েছে। সবাই বলে উঠলো – হে ভগবান, তুমি এই খুনীদের, এই বেঈমানদের বিচার করো।

জনতার সারি থেকে আরো একজন বৃদ্ধ এসে অশ্রু মুছে নিয়ে প্রয়াত নেতার কপালে হাত রেখে বুদ্ধ ধর্ম সংঘ বলে আশীর্বাদ দিতে দিতে বললেন- ‘তুমি তো যেখানেই যাও না কেন সবসময় ‘সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্ত’ (সকল প্রাণী সুখী হোক) বলে ধর্মীয় বাণী প্রচার করতে, কতবার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কাজ করতে দেখেছি, কাউকে তুমি হিংসা করো না। তুমি স্বর্গবাসী হবে; পরিনির্বাণ লাভ করবে। কোন প্রাণীকে তুমি হত্যা করতে না। তোমার এই সৎকর্মের ফল ইহকালে না হলেও পরকালে ভোগ করবে।’

উপস্থিত জনতা সবাই সমস্বরে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো – ‘শান্তিবাহিনী ভাইয়েরা, মূর্খ শিষ্যের চেয়ে পণ্ডিত শত্রুও ভালো। গৌতম বুদ্ধের এই উপদেশটা কখনও ভুলে যেয়ো না। যারা মূর্খ, যারা বেঈমান তাদেরকে ক্ষমা করার কোন দরকার নেই।’

ততক্ষণে আশেপাশে বাহিনীর সকল সদস্যগণ এসে জড়ো হয়েছেন। সবাই পুরো ব্যাপারটা জেনে নেবার জন্য নানা প্রশ্ন করছেন।

পরে উপস্থিত জনতা সরে গেলে প্রিয়নেতার বিদেহী আত্মার প্রতি শেষ সম্মান প্রদর্শনের জন্য নীরবে অশ্রুসিক্ত নয়নে ব্যারাকে উঠে এসেছেন।

এভাবে কর্মীরা যখন আসতো প্রিয়নেতা তাড়াতাড়ি এসে অভ্যর্থনা জানাতেন। সবার সাথে করমর্দন করতেন এবং আন্তরিকভাবে আলিঙ্গন করতেন। তারপরে তাঁর পাশে বসিয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে তৎপর হয়ে পড়তেন।

কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর কুশলবার্তা ও পরিস্থিতির খবরাখবরগুলো অতি নিখুঁতভাবে জেনে নিতেন। তাঁর এ বিনয়ী মনোভাব, মহানুভবতা ও স্নেহপূর্ণ ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত।

পার্থিব জগতের দু:খ বেদনা অভাব অভিযোগ সব কিছুই ভূলে যেত তাঁর এই অমায়িক ব্যবহারে। তাঁর সাথে আলাপ করে প্রত্যেকটি কর্মী নতুন প্রেরণা লাভ করে উজ্জীবিত হয়ে ফিরে যেত।

কিন্তু এই দিনের কত কর্মী এসে জড়ো হয়েছে সে প্রেরণা কেউ পেল না। কারো সাথে করমর্দন হলো না, কাউকে আলিঙ্গন করলেন না। তিনি রয়েছেন তারই প্রিয় বিছানায় নির্বিকার চিত্তে; চিরশায়িত হয়ে। কোন রকম উত্তেজনা, কোন রকম শোকার্ত কান্না তাঁকে আর বিচলিত করবে না।

সবাই ধীরে ধীরে তাঁর শবদেহের পাশে হাতিয়ার রেখে দুই হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়ে কৃত্জ্ঞতার সাথে সম্মান জানাচ্ছে, কেউ কেউ দু’পায়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করছেন – স্যার, তুমি আর আদর করবে না স্যার? তুমি কি আলাপ করার জন্য আর কাছে ডাকবে না স্যার! হায়রে অবুঝ হৃদয়! এতকিছু দেখেও বিশ্বাস করতে পারছো না?… তবুও তো বাস্তবতাকে মানতে হয়।

তারপর কয়েকজন মিলে আমরা তাঁর জিনিসপত্রগুলো তদন্ত করে দেখলাম। অনুসন্ধান করে দেখা গেল, চক্রান্তকারী শয়তানেরা প্রিয় লীডার ও সন্তু স্যারের যাবতীয় দলিলপত্রসহ অন্যান্য জিনিসপত্রাদি প্রায়ই লুঠ করে নিয়ে গেছে।

সেই সঙ্গে বেশ কয়েকখানা হাতিয়ার গোলাবারুদসহ অন্যান্য অনেকেরই জিনিসপত্রাদি নিয়ে পালিয়ে গেছে। অবশিষ্টাংশের মধ্যে দেখতে পেলাম তাঁর ব্যবহারের একটি কেটলি, একটা পানির কন্টেনার ও একটা পানির চোঙা তখনও পানি ভর্তি অবস্থায় পড়ে আছে।

তাঁর ব্যবহারের জন্য মাত্র দুটো কম্বল, একটা গিলাপ কাপড় যা দিয়ে বালিশ বানানো, একটা পেন্ট, একটা শার্ট ও এক জোড়া মোজা পায়ে জড়ানো। তাছাড়া বহু পুরানো এক জোড়া জুতা, একটা পুরানো গেঞ্জি, একটা লুঙ্গি ও একটা দেশীয় ঝোলা রয়েছে।

ফেলে যাওয়া তাঁর সুটকেসটা খুলে দেখা গেল – অনেকগুলো বই, কিছু ঔষধ, একটা ডায়েরি ও একটা ছোট ফটো এ্যালবাম ও শিষ কলম কয়েকটা।

দেখলাম তাঁর ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা আছে ‘মহান জুম্ম জনগণের আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক, সারা দুনিয়ার নিপীড়িত জনগণ এক হও। জয় আমাদের হবেই-হবে।’

তাঁর প্রিয় ডায়েরির সাথে আরো রয়েছে অনেকগুলো পেপার কাটিং সেগুলো তিনি খুবই সযত্নে সংরক্ষণ করতেন। সংস্কৃতিবান ও ছিমছাম জীবনের অধিকারী প্রিয়নেতার এ্যালবাম দেখা গেলো – তাঁর অতি প্রিয় দু‘টি সন্তানের ছবি, তাছাড়া ছাত্র ও শিক্ষক জীবনের এবং এলএলবি পাশ করে এডভোকেট হওয়াকালীন তোলা সযত্নে রাখা ফটো।

তাঁর সেই ছবিগুলো দেখে দীর্ঘদিন কারাভোগের পর দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে প্রথম দেখা স্মৃতিগুলো আমাকে মনে করিয়ে দিল।

এছাড়া আরো অনেকগুলো ফটো একের পর এক করে দেখছিলাম তখন হঠাৎ একজন নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠলো – ‘এমনিতে এ স্যার অতিরিক্ত দয়ালু। কি প্রয়োজন ছিল এই চক্রান্তকারী শত্রুদের ক্ষমা দেয়ার।’

সে কথা শুনে অন্য একজন তাড়াতড়ি বলে উঠলো – ‘দেখ ভাই ভূল ধরলে অনেক কিছু পারা যায়। নেতার মহৎ হৃদয়কেও দোষ দেয়া যায়। কিন্তু তাঁর এই ক্ষমা গুণ না থাকলে এতক্ষণে আমাদের কার কি অবস্থা হতো ইয়ত্তা আছে?

তাঁর মতো মহৎ হৃদয় না থাকলে আমাদের শাস্তি পেতে পেতে মাথার চুলও চলে যেত। কত ধৈর্য ধরে তিনি আমাদেরকে বার বার বুঝাতেন, শিখাতেন তাঁর সূক্ষ চিন্তাধারা। তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি না থাকলে আমাদের এ জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটতো না, জুম্ম জাতি এতক্ষণ ধ্বংস হয়ে যেতো।’

এসব কথা শুনে ঔ দলের কমান্ডার বলে উঠলেন – ‘দেখ ভাইয়েরা, আমাদের এই মহান নেতার অবদান ও মহত্ব তাঁর শত্রুরাও অস্বীকার করতে পারবে না।

তিনি খাঁটি বৌদ্ধ। তোমরা তো নিজেরাই জান তিনি একটা পিঁপড়েকেও মারতে দিতেন না। ঘাটের চিংড়ি ও কাঁকড়াগুলোকে মারতে দিতেন না বলে ওরা আমাদেরকে ভয় করতো না, পায়ের কাছে কাছে এসে আহার যোগাড় করতো।

দেখ দয়া করলে পশুপক্ষীরা পর্যন্ত পোষ মানে। আজ নেতার মৃত্যুর মাধ্যমে জাতি তার সবচাইতে সম্মানিত সম্পদটাই হারালো।

এ ক্ষতি কোনোদিন পূরণ হবার নয়। তাঁর আন্দোলনের জ্ঞান, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্ম, আইন ইত্যাদি সর্বজ্ঞানে গুণান্বিত মানুষ জাতি আর কোনোদিন পাবে কিনা সন্দেহ।

তোমরা দুর্বল হয়ো না ভাইয়েরা, বাস্তব জগত থেকে তাঁর অস্তিত্ব মুছে যেতে পারে কিন্তু তাঁর অবদান ও তাঁর অমরবাণী আমাদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। এসো ভাইয়েরা নেতার মরদেহ ছুঁইয়ে আমরা নতুন করে শপথ নিই এই মহান নেতার স্বপ্ন আমরা পূরণ করবোই।

সবাই একসাথে বলে উঠলো – ‘জনসংহতি সমিতি জিন্দাবাদ, শান্তিবাহিনী জিন্দাবাদ, জুম্ম জনগণ দীর্ঘজীবী হোক। প্রিয়নেতার ঐতিহাসিক অবদান অমর হোক, অমর হোক।’

দেখতে দেখতে দিবসের শেষ ভাগ নেমে এলো। বিকেল ৫টা বেজে আরও গড়িয়ে গেছে। উপস্থিত জনতা ও বাহিনীর সদস্যরা মিলে মরদেহগুলো দাহন করার ব্যবস্থা নেয়া হলো।

চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের কোণ ঘেষে আঁকাবাঁকা হয়ে ছড়া (ঝর্ণা) চলে গেছে। ছড়ার দু‘ধারে মাথা উঁচু উঁচু করে দাঁড়ানোর তরুরাশির ছায়াই বহুলতাগুল্মের ঘেরা একটুখানি সমতল জায়গা।

ঐ জায়টায় সাফ করে মরদেহগুলোর সমাধি বানানো হয়েছে। তারপর এক এক করে মরদেহগুলো শ্মশানে নিয়ে আসা হচ্ছে।

সবাইকে নিয়ে আসা হলে মেজর পেলের নেতৃত্বে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা ও উপস্থিত জনতা সবাই প্রথমে লীডারের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করেন এবং পরে অন্যান্যদেরকেও করা হয়।

তারপর জনতার পক্ষ থেকে অন্যান্য মরদেহগুলোর পরিচয় করিয়ে দেবার অনুরোধ জানানো হয়। তখন দলের পক্ষ থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ একজন সদস্য শহীদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জানিয়ে দিলেন এইভাবে – এই হচ্ছেন আমাদের নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত জুম্ম জনগণের নেতা লারমা।

যিনি জুম্ম জনগণের জাতীয় জাগরণ এনে দিয়েছেন। যিনি জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।

দশ ভাষাভাষী জুম্ম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। জুম্ম জাতির জাগরনের অগ্রদূত, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, চিন্তাবিদ, নিপীড়িত মানুষের একনিষ্ঠ বন্ধু, মহান দেশপ্রেমিক ও রাজনীতিবিদ আজ আমাদের মাঝে নেই।

কিন্তু তিনি দিয়ে গেছেন মুক্তির মন্ত্র। ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের নেতা লারমা ভদ্র, বিনয়ী, ক্ষমাশীল, স্নেহবৎসল, অতিথিপরায়ণ, সুশৃঙ্খল, কর্তব্যনিষ্ঠ, সদালাপী ছিলেন। তিনি বিবাহিত। তাঁর এক পুত্র ও এক কন্যা।

শোক সন্তপ্ত তাঁর পরিবার পরিজনের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাই। মেজর পরিমল বিকাশ চাকমার মরদেহ হচ্ছে এটি। ছাত্র অবস্থা থেকে তিনি বিলুপ্ত প্রায় জুম্ম জাতির কথা ভাবতেন।

তাই ছাত্র জীবন থেকেই তিনি দেশ সেবায় আত্মনিমগ্ন ছিলেন। কলেজ জীবন শেষ করার পরই তিনি সক্রিয়ভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি একজন অতি বিশ্বস্থ, সৎ, বিনয়ী, সাচ্চা দেশপ্রেমিক ছিলেন।

দীর্ঘ এক যুগ ধরে তিনি প্রয়াত নেতার পাশে পাশে নিরাপত্তা ও সেবা শুশ্রূষার দায়িত্বভার নিজেই বহন করতেন। শত্রুরা সর্রপ্রথম তাঁর উপরেই গুলি বর্ষণ করেছিল। তিনি সদ্য বিবাহিত ছিলেন।

এই হচ্ছেন শুভেন্দু প্রভাস লারমা (তুফান)। তিনি প্রয়াত নেতার বয়োজ্যেষ্ঠ ভাই। মাত্র গতকাল তিনি প্রয়াত নেতার অসুখের খবর শুনে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন।

যুব সমিতির তিনি একজন আঞ্চলিক পরিচালক ও আঞ্চলিক কমিটির একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য। জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।

এপর্যন্ত তিনি একনিষ্ঠার সাথে পার্র্টি প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ও জনদরদী মানুষ। তাঁর অঞ্চলে অনেক মানুষকে তিনি নিজের সম্পত্তি দিয়ে নিজের শক্তি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।

চক্রান্তকারী পলাশের ভাইদের যাবতীয় পড়াশুনার ভার তিনিই বহন করেছিলেন। কিন্তু বিধাতার নির্মম পরিহাস সেই পলাশ চক্র তাঁর মরদেহের উপর অহেতুক গুলি বর্ষণ করে সারা দেহখানি ঝাঁঝড়া করে দিয়ে গেছে। তিনি বিবাহিত। স্বীয় পত্নী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে রেখে তিনি শহীদ হয়েছেন।

তারপরেই গ্রাম পঞ্চায়েৎ বিভাগের সহকারী পরিচালক অর্পণা চরণ চাকমার (সৈকত) মরদেহখানি সকলের সামনে খুলে ধরলেন।

সে সময় তাঁর পরিবারের আত্মীয় স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁর ডান চোখের ভ্রুতেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তাঁকে দেখার সাথে সাথে তাঁর শোক সন্তপ্ত পত্নী, দুই ছেলে ও এক কন্যা হো-হো করে আর্তনাদ করে উঠলো।

পিতৃহারা সন্তানেরা মায়ের বুক ছেড়ে বুক ফাটা ক্রন্দনে বাপকে ধরতে চায় – ধরণীর বুকে স্বামীহারা স্ত্রী, পিতাহারা সন্তানদের করুণ আকুতি দেখে মুর্ছাহত হয়ে পড়ে।

এই মর্মভেদী দৃশ্য দেখে উপস্থিত লোকজন তাদেরকে বোঝাবার ভাষা হারিয়ে তারাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মা ও ছেলেমেয়েদের অবস্থা দেখে বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মীটি অস্থির হয়ে পড়েন এবং কোন মতে আত্মসংবরণ করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলেন, তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিত মানুষ।

খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে লাঞ্চিত ও ধৃত হন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ছিলেন দেশপ্রেমিক।

একনিষ্ঠ, বিশ্বস্থ ও সুদ্ধিদীপ্ত এই বিপ্লবী বিচক্ষণতা ও যোগ্যতার সাথে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব এযাবৎ সুষ্ঠুভাবে পালন করে গেছেন।

রাঙ্গামাটি শাহ্ হাই স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় থেকে তিনি জুম্ম জনগণের জাতীয় সংগ্রামের মহান কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে পড়েন এবং পাহাড়ী ছাত্র আন্দোলনে একজন পরামর্শদাতাও ছিলেন। তিনি সবসময় বৌদ্ধ ধর্মের নীতির সাথে দলীয় নীতির সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করতেন।

আজ তাঁরই স্ব-বান্ধবের সাথে মিলিত হবার কথা ছিল। কিন্তু সে মিলয় আর হলো না। সমস্ত আত্মীয়-পরিজনদের সমবেদনা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করছি।

কল্যাণময় খীসা (জুনি) ছিলেন হাসিখুশি স্বভাবের। পিতার একমাত্র সন্তান। তিনি গ্রাম পঞ্চায়েত বিভাগের আঞ্চলিক পর্যায়ে সহকারী পরিচালক ছিলেন।

তৎপরে পার্র্টির আর্মোয়ার বিভাগেরও একজন সহকারী ছিলেন। তাঁর ডাক্তারী ও সেলাই কাজে অভিজ্ঞতা ছিল। ততক্ষণে তাঁর স্ত্রী পুত্রকন্যারা তথায় উপস্থিত হওয়াতে পরিস্থিতি আরো ঘনীভূত ও মর্মান্তিক হয়ে ওঠে।

শুধু ভগবানের নাম ডেকে উচ্চস্বরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তাঁর অসহায় পত্নী ও স্বজনেরা। এ হৃদয়ের রক্ত শুকিয়ে যাওয়া কান্নায় সারা সমাধিক্ষেত্র মুহূর্তেই করুণ আর্তনাদে ভরে যায়। এই মর্মভেদী কান্নার মধ্যেই সন্তু স্যার বললেন – ‘মা বোন বাপ ভাইয়েরা, আপনারা ধৈর্য ধরুন, বাস্তবতাকে মেনে নেবার চেষ্টা করুন।’

মৃদুভাষী, বিনয়ী, একনিষ্ঠ ও সরল মনের অধিকারী শহীদ জুনি মৃত্যুর আগেও প্রয়াত নেতাকে সেবা করে তাঁর স্বদেশপ্রেম, ধৈর্য ও সৎ মনোভাবের পরিচয় দিয়ে গেছেন। আমরা আজ এ মুহূর্তে অশ্রুজলে ও মনের কৃতজ্ঞতায় তাঁকে বিদায় দেব।

এই হচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ অনার্স কোর্সের ছাত্র সৎ, সাহসী ও একনিষ্ঠ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মনিময় দেওয়ান (স্বাগত) যিনি শত্রুর চোখে ধূলো দিয়ে বার বার পার্র্টিকে শত্রুর অনেক গোপন তথ্য সরবরাহ করেছিলেন।

পার্টি তথা গোটা জাতি এই জন্যে উপকৃত হয়েছিল। তিনি ছিলেন বর্তমান জুম্ম ছাত্র সমাজের একজন ঘনিষ্ট বন্ধু এবং শান্তিবাহিনীর একজন বীরযোদ্ধা। শত্রুর বিরুদ্ধে ও দু:সাহসীক কাজে তিনি ছিলেন পারদর্শী ও সুচতুর।

শত্রুরা তাঁকে আটক করে নানাভাবে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও দুর্জয় মনোভাবের কাছে সে সবই পন্ড হয়ে গিয়েছিল।

তিনি যুব সমিতি ও ছাত্র সমিতির একজন সহকারী পরিচালক ছিলেন। দু:সাহসী এই তরুণ যোদ্ধা চক্রান্তকারীদের মারাত্মক আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে আজ মরেও অমর হয়ে রইলেন।

তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর এই মহৎ কৃতিত্ব আমাদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

একজন সংঘটক ও কৌশলীকর্মী হিসেবে সুপরিচিত এই সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট অমর কান্তি চাকমা (মিশুক)। তিনি একজন ভদ্র, বিনয়ী, একনিষ্ঠ, সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক ছিলেন।

তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে দুই নম্বর সেক্টরের একজন জোন কমান্ডার হিসেবে আরএম জোনের যাবতীয় বিশৃঙ্খল ও জটিলতাকে পার্র্টি অনায়াসে সামলে উঠতে পেরেছিল।

মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে তিনি খবর পেয়েছিলেন তার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। তাঁর একমাত্র নবজাত সন্তানের মুখ দর্শনে বঞ্চিত হয়ে তিনি এই চক্রান্তকারীদের গুলিতে শহীদ হলেন।

সদ্য প্রসূতা স্ত্রী তাঁর স্বামীকে হারিয়ে কী নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাবেন তা আজ আমাদের ভাষায় ব্যক্ত করার নয়। তাঁর স্ত্রী ও নবজাত শিশুকে আমরা আন্তরিক সমবেদনা ও সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি।

সব চাইতে নিরীহ ও সরল প্রাণের অধিকারী কর্পোরেল অর্জুন ত্রিপুরা। তাঁর একনিষ্ঠ অধ্যবসায় ও সাহসীকতার কারণে অল্প সময়ে তিনি বাঘের মতই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন চক্রান্তকারীদের উপর।

মৃত্যুর আগে তিনি বিধবা মায়ের জন্য কিছু কাপড় জোগাড় করে রেখেছিলেন। চিরদু:খিনী তাঁর মাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য চিঠি লিখেছিলেন।

তিনি একজন সৎ, সাহসী, একনিষ্ঠ যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর মাতৃ ভালোবাসা ও বীরত্বপূর্ণ সাহসীকতাকে আমরা গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

কমান্ডার অর্জুনের জীবন প্রদীপ আজ নিভে গেছে বটে কিন্তু তাঁর ত্যাগ, সাহসীকতা আমাদের সংগ্রামের পথে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। করুণ ও বেদনাঘন পরিবেশে সবাই আগুনের কুণ্ডলী হস্তে ধারণ করে দাঁড়িয়েছেন। শ্রদ্ধেয় সন্তু স্যার লীডারের মরদেহের পায়ে মাথা রেখে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করেছেন। সকলেরই মন ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছে; তবুও তো দিতে হবে বিদায়। মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধা, মানুষের প্রেমপ্রীতি মায়া মমতা তাঁর সমস্ত হৃদয়ের আকুতি দিয়ে প্রিয়জনদেরকে ধরে রাখতে চায় -তবু তো যায়না রাখা।

…তাঁরপর সবাই চিতায় অগ্নি সংযোগ করতে এলো। হে অগ্নিকুণ্ড! তুমি দ্বিধা হয়ো না। তোমার শক্তি দিয়ে এই বিদেহী পবিত্র আত্মাগুলো তুমি বরণ করে নাও। দেখতে দেখতে আগুনের প্রলয় শিখা দুম দুম শব্দে সব কিছুকে গ্রাস করে নিল।

আমরা দেখতে পেলাম চির বিদায়ী অভিসংবাদিত নেতার দক্ষিণ হস্ত অর্ধ চন্দ্রাকারে উত্তোলিত হয়েছে যেন আগের মতই তাঁর সর্বশেষ নির্দেশ আমাদেরকে দিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এবার আর সেই অনলবর্ষী ভাষায় নয়, শুধু হাতের ইশারায়…। হতভাগ্য জাতির স্বপ্নের একটি দেদীপ্যমান প্রদীপ উজ্জ্বল নক্ষত্র, যে নিজের আলো বিকিরিত করে জাতির তন্দ্রা ভেঙেছে, বেঁচে থাকার বাসনা জাগিয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস দিয়েছে, বাস্তবে তিনি আর নেই। কিন্তু থাকবে তাঁর অমর বাণী, সেই সংগ্রামী সোপান, যে সোপান বেয়ে জাতি তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।

তারও দু’দিন পর বলীষ্ট ও সুঠাম দেহকে বিদীর্ণ করা তিনটা গুলির আঘাতে সীমাহীন ভোগের পর মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে কর্পোরেল সৌমিত্রের জীবণ প্রদীপ নির্বাপিত হয়ে গেল। তিনি ছিলেন সাহসী ও একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক।

অপার মাতৃস্নেহের লালিত কমান্ডার সৌমিত্র ছিলেন মায়ের পুঞ্জীভূত স্নেহের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। দুর্যোগপূর্ণ দিন গুলোতে তাঁর মায়ের করুণাসিক্ত হৃদয় পুত্র দর্শনের জন্য বড্ডো ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল।

তাই ঠিক হয়েছিল তিনি নিজে এসে প্রিয়তম সন্তানের মুখ দর্শন করে বিদগ্ধ হৃদয়কে প্রশমিত করবেন; ছেলেকে সোহাগ করে অন্তরের সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে যাবেন। কিন্তু চক্রান্তের এই বিভীষিকা উত্তপ্ত মাতৃ হৃদয়কে করে দিয়েছে আরো হাহাকার, ফেলে দিয়েছেন সীমাহীন শোক সাগরে।

মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্তে এই অদম্য দেশপ্রেমিক সন্তান মায়ের কথা তুললো না, কারোর জন্য কাঁদলোনা, করলনা কোন অভিযোগ। মুমূর্ষ অবস্থায় শুধু বলে গেল – ‘দেশপ্রেমিক ভাইয়েরা, তোমরা দমে যেয়ো না সত্য ও ন্যায় হচ্ছে আমাদের পথ। জয় আমাদের হবেই। জয়, জ-য়, জ…।’

১০ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, একটা বিশ্বাসঘাতকতা, একটা ষড়যন্ত্র, কয়েকটা হাত বোমা ও কয়েক হাজার বুলেটই হলো নির্যাতিত, নিপীড়িত জুম্ম জাতির ইতিহাসে কলঙ্কিত উপকরণ। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত এই চক্রান্তকারীরা পাক-ভারতের মিরজাফর এবং লঙ্কার বিভীষনকেও হার মানিয়েছে।

কিন্তু ইতিহাস তার আপন গতি থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। জাতীয় চেতনা কখনো ধ্বংস হতে পারে না। এই নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে চক্রান্তকারীরা ভারিক্কী চালে ও দম্ভভরে পদচারণ করেছে।

হম্বিতম্বি করে, লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে নিজেদের সাফাই গেয়েছে আবেগে ভরা উন্নাসিকতায়। কিন্তু সর্বত্রই নেতার হত্যার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে; বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে।

স্বার্থ ও ক্ষমতার সংঘাতের ফলে ঐ চক্রান্তকারী কতিপয় নেতা সদলবলে সশস্ত্রভাবে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পার্র্টির প্রচণ্ড আক্রমণে বিশৃঙ্খল ও হতাশাগ্রস্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যকার অন্তর্দন্দ্ব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

দলীয় কোন্দলে বিশ্বাসঘাতক দেবেনের অপমৃত্যু তাদের মধ্যকার অন্তুর্দ্ব‌ন্দ্ব তাদেরকে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে। সে সময়ে পার্র্টি উপর্যুপুরি প্রচন্ড আঘাত দিচ্ছে যার ফলে চক্রান্তকারীরা হতাশায় জর্জরিত হয়েছে এবং তাদের মধ্যকার অন্তর্দন্দ্ব বেড়ে গিয়েছে।

নিজের দলীয় লোকদের হাতে দেবেনের মৃত্যু ঘটনায় তাদের অভ্যন্তরস্থ এই অন্তর্দ্বন্দের ভয়াবহ রূপ আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। অতঃপর ষড়যন্ত্রের এই কালো হাত এবং রাজনৈতিক ব্যভিচারিত্বকে জুম্ম জনগণের চিনতে আর বাকি থাকেনি।

জনগণের ধিক্কার পেয়ে তারা এখন বন্ধ্যা, পঙ্গু ও ব্যভিচারের বার্ধক্য অবস্থায়।

যে ক্ষমাশীল অগ্রদূত শুধু খাল খনন করে নয় উপরন্তু ঝর্ণা বানিয়ে জলপ্রবাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম, জাতির সেই কর্ণধারকে চক্রান্তকারীরা বারুদ ভূষণে ভূষিত করতে পারে বটে; কিন্তু গোটা আন্দোলনের মরিয়া প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

আভ্যন্তরীণ দুর্ধ‌র্ষ নদী প্রবাহ বালুকাময় পাড়কে ভাঙতে পারে কিন্তু প্রস্তুরীভূত নদীর পাড় সেই ভাঙনকে অবশ্যই রোধ করতে পারে।

১০ নভেম্বরের শহীদদের পবিত্র রক্তধারাকে স্বাক্ষী রেখে সত্য ও ন্যায়ের পথে সংগ্রামী ইতিহাস আপন গতিতে চলবে আর সেই সাথে শ্রদ্ধাচিত্তে চলবে জুম্ম জাতির করুণ মর্মবেদনাকে বয়ে নেয়া অন্তসলিলা ফল্গুধারা।


লেখকঃ তাতিন্দ্রলাল চাকমা পেলে

তথ্যসূত্রঃ ১০ ই নভেম্বর’ ৮৩ স্মরণে  (১৯৮৪ খ্রি.) 

শনিবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৩

১০ নভেম্বর পোইদ্যানে: ঈমে Injeb Changma


১০ নভেম্বর পোইদ্যানে:

 ঈমে

ও নাদিনলক! দেবাবো চোক চোক কালা পুগে উত্তুরে
ঘরত এয’ ঘরত এয’ ন’ দ-র’নে-ই! বাবর লাগত ন’ প’এয?
ও আজু , এচ্যে তেহ্ বল পিয়ে লাগের, গম লাগের মনত
ঝর এযোক, বোইয়ের এযোক বোক আর’ ভুজোল
যদক্কন ন’ উদিব পির, ন’ ফিরিবং আমি ঘরত।
জীবনান বাজি থেলে কদক আর খারা খেলে পারিবা
পুগে উত্তুরেদি রিনি চ’ ধুমো উড়ের মাদিত ফেল্লে কালা।
দেঘিনেই মরদ’ কাবে পেদ তিলোই আন্ধার অই এযের সংসারান
ইক্যে এভ’ ঝর-বোইয়ের আয় থাক্কে এয’ ঘরত ন’ খেলেয়্য আর খারা।
ও আজু, ইরবান দে ফিবেক কাবা দর গরি সমে থাগ’ তুমি ঘরত
জীঙকানি যুনি দিয়্যা পরে দিবং আমি এ খারাত।
যদ’ দরায় তত লরাই মামা কয় বার বার
এ খারা ওদি গেলে এধক্যে দোল দেচ ন’ পেবং আর।
সুগর আঝায় বাহ্ বানিলং রাঙামাত্যাত ধাবা খেই চাদিগাঙত্তুন
কাপ্তে গধা বানি আঝা সবনর ভুদি ধুবে দিল চিদ’ মনত্তুন।
বানা পরানানিলোই উদি এলং ছিদি পরলং কোণা-কুণি সেরে
সিয়ানিয়্য চোগশাল তারার কারি নেযাদন বলে বলে।
সেনে, ফিরি ন’ এবং আমি ঘরত কন’ দিন পির ন’ দিলে।
ফিবেক - বাড়িতে জাম দেওয়া।
ঈমে - প্রতিজ্ঞা।
ইরবান - শক্ত বাঁধা।
পির - জয় ।
পির দেনা – জয় অনা।

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...