রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৪

উপেন্দ্র লাল চাকমার ভূমিকা[পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিবাহিনী জিয়া হত্যা মনজুর খুন: মহিউদ্দিন আহমদ]

 


উপেন্দ্র
লাল চাকমার ভূমিকা[i]

পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আলোচনায় উপেন্দ্র লাল চাকমা সরকার শান্তিবাহিনীর মধ্যে দূতিয়ালি করেছেন বললে কম বলা হবে। তিনি অনেক ক্ষেত্রেই ছিলেন অনুঘটক। তবে তাঁর পথটি মসৃণ ছিল না। অনেক সময় তাঁকে দুপক্ষের মধ্যে 'ক্রসফায়ারে' পড়তে হতো। সব সময় সব পক্ষের মন জুগিয়ে চলা ছিল রীতিমতো কষ্টকর।

শান্তি আলোচনার সূচনাটি হয় ১৯৭৯-৮০ সালে, যখন চট্টগ্রামে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ছিলেন মে. জে. মনজুর। পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মনজুরের দৃষ্টিভঙ্গিতে ফারাক ছিল অনেক। এর এক পর্যায়ে জিয়া মনজুর দুজনই নৃশংসভাবে নিহত হন। তাঁদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির কোনো সংযোগ আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এরপর সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শান্তি আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ১৯৮৪ সালের ২৩ জুন তিনি উপেন্দ্র লাল চাকমাকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। মাত্র ছয় মাস তিনি দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮৫ সালের ১৫ জানুয়ারি তিনি প্রতিমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। জেনারেল এরশাদ বেশি নির্ভর করেছিলেন সামরিক অসামরিক আমলাতন্ত্রের ওপর। এটি আশানুরূপ ফল দেয়নি।

১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করে। ওই সময় শান্তি প্রক্রিয়া আবার চালু হয়। পর্যায়ে আলোচনায় সরকারি দলের নেতৃত্বে ছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। পরে একটি সংসদীয় উপকমিটির প্রতিনিধি হিসেবে রাশেদ খান মেনন শান্তিবাহিনীর নেতাদের সঙ্গে ছয়বার বৈঠকে বসেন। ১৯৯৫ সালের শেষ দিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে সরকার কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যায়। এর ফলে শান্তি আলোচনা থেমে যায়।[1]

একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে উপেন্দ্র লাল চাকমা প্রায় ১০ বছর ছোটাছুটি করেছেন। ১৯৮৯ সালের ৩ মার্চ খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে আয়োজিত এক মুক্ত আলোচনায় তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। ভাষণটি পরে লিখিত আকারে খাগড়াছড়ি জেলায় প্রচার করা হয়। ভাষণে উপেন্দ্র লাল চাকমা বলেন:

আপনারা জানেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজিত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময় বারবারই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।...২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ছিলেন আমাদের প্রয়াত মেজর জেনারেল মনজুর সাহেব। মূলত তাঁর আমল থেকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। আমি যখন ১৯৭৯ সালে এতদঞ্চল থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হই, তখন প্রয়াত জেনারেল মনজুর আমাকে ডেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যা কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায়, সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেছিলেন। আমি তাঁর সদিচ্ছা এবং ঐকান্তিক আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। যার জন্য আমি এখনো তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় উৎসাহিত হয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম যোগাযোগ কমিটি যদিও তখন একটি অনুমোদিত সংস্থা হিসেবে গঠিত হয়নি, তবু এই প্রক্রিয়ায় শুধু আমি একা ছিলাম না। এই প্রক্রিয়ায় ছিলেন এতদঞ্চলের-পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। আমরা এটুকুই মনে করেছিলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার যদি সমাধান করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশ সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সেটা করতে হবে।...

এরপর যখন জেনারেল নূর উদ্দিন ২৪ পদাতিক ডিভিশিনের জিওসি হিসাবে কর্মভার গ্রহণ করলেন, তিনি আবার জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ আলাপ- আলোচনায় এ সমস্যা সমাধানের জন্য আগ্রহী হলেন। তিনি এক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি-এ তিনটি জেলার বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দকে আহ্বান করে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তাদের মতামত বা সিদ্ধান্ত চেয়েছেন। তখন আমরা তিন জেলার নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিলাম যে, জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তখন সর্বসম্মতভাবে একটি যোগাযোগ কমিটি গঠিত হয়। সেই যোগাযোগ কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম যোগাযোগ কমিটি হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে এবং যোগাযোগ কমিটিতে আমাকে আহ্বায়ক করে রামগড় থেকে বাবু নকুল চন্দ্র ত্রিপুরা এবং বান্দরবান থেকে বাবু কে এস প্রু চৌধুরীকে সদস্য করে এ তিনজনের সমন্বয়ে যোগাযোগ কমিটি গঠিত হয়েছিল। জনসংহতি সমিতির সঙ্গে যোগাযোগের ভার আমাদের এ তিনজনের ওপর দেওয়া হলো।...এই যোগাযোগের প্রক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ এবং জনসংহতি সমিতির পক্ষের মধ্যে ১৯৮৫ সালের অক্টোবর মাসে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তেমন কোনো ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।...

পানছড়ির পুজগাংমুখ কমিউনিটি সেন্টার হলে এই পাঁচটি বৈঠক হয়েছিল কতগুলি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে। বৈঠক অনুষ্ঠানের তিন দিন পূর্বে জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের অনুরোধক্রমে কতগুলি ক্যাম্প সাময়িকভাবে সরিয়ে নেওয়া হতো। কিন্তু ৫ম বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আলোচনা স্তিমিত হয়ে পড়ে।... ২য় থেকে ৪র্থ বৈঠকে তারা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসংবলিত দাবিনামা পেশ করেছিল। সেই দাবিনামা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সংবিধানের পরিপন্থী বিধায় গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসংবলিত দাবিনামা সরকার গ্রহণ না করলে আলোচনা অর্থহীন হবে বলে মত প্রকাশ করায় আলোচনার পথ অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে।... ৬ষ্ঠ বৈঠকে অনুষ্ঠিত হয় ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৮ তারিখে। এই বৈঠক দুই দিন চলেছিল। জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিবৃন্দের তরফ থেকে বাংলাদেশ সরকার পক্ষের নিকট সংশোধিত দাবিনামা পেশ করা হয়।...

ষষ্ঠ বৈঠকে একটিমাত্র সিদ্ধান্ত হলো যে, যথাশীঘ্র সম্ভব ৭ম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।...৫ম সপ্তাহ চলে গেল, চিঠিপত্র এল না।... জনসংহতি সমিতির যারা পারতপক্ষে দুই সপ্তাহ পর ৭ম বৈঠক অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা, আশ্বাস দিয়েছিল, সে ক্ষেত্রে ৫ম সপ্তাহেও কেন আমরা চিঠি পাচ্ছি না।...

জনসংহতি সমিতির তরফ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি (১৯৮৯) একটা চিঠি পেয়েছি। চিঠি পেয়ে আমি মনে করলাম হয়তো বৈঠকের সুনির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে চিঠিটা এসেছে। চিঠি খুলে পড়ার পর দেখি তারা সপ্তম বৈঠকে আসতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। তারা বলল, যে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, সে ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে জাতীয় সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে জেলা পরিষদ বিল এবং ১৯০০ সালের চট্টগ্রাম হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েল রহিতকরণ বিল উত্থাপিত হলো। এটা সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধান না করার একটা হীন চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত এই বিল সরকার কর্তৃক জাতীয় সংসদ থেকে প্রত্যাহার করা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বৈঠকে বসতে অক্ষমতা প্রকাশ করল।[2]

উপেন্দ্র লাল চাকমা ১৯৮৯ সালের মার্চের শেষে বা এপ্রিলের গোড়ার দিকে ভারতে চলে যান। খাগড়াছড়ির ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম এ প্রসঙ্গে কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণ দিয়েছেন।

আমরা নানাভাবে উপেন্দ্র লাল চাকমার সহযোগিতা নিচ্ছিলাম। চট্টগ্রামের জিওসি মে. জে. আবদুস সালাম ও আমার সুপারিশ ছিল, মন্ত্রীর মর্যাদায় উপেন্দ্র লাল চাকমাকে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা করা হোক। রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পরামর্শটি গ্রহণ করেন। জিওসি জেনারেল সালাম আমাকে বললেন, ওকে আমার কাছে পাঠাও। আমি আমার সহকারী ক্যাপ্টেন এমদাদকে তাঁর খাগড়াছড়ির বাড়িতে পাঠালাম। এমদাদ তাঁকে খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলেন, তিনি রাঙামাটি চলে গেছেন।

উপেন্দ্র লালের ওপর শান্তিবাহিনীর লোকেদের নজরদারি ছিল। তাঁকে সেনাবাহিনীর লোকেরা হন্যে হয়ে খুঁজছে, এ রকম একটি বার্তা শান্তিবাহিনীর কাছ থেকে চলে যায় উপেন্দ্র লালের কাছে। শান্তিবাহিনী চেয়েছিল তাঁর সঙ্গে সেনাবাহিনী তথা সরকারের একটা দূরত্ব তৈরি করতে। উপেন্দ্র লালের কাছে বার্তা গেল-'ইবরাহিম তোমারে খুঁজতেছে। আজই তোমার শেষ দিন।'

উপেন্দ্র লাল এই বার্তা পেয়ে একটা ব্যাগ নিয়ে চিটাগাংয়ের পথে রওনা দিলেন। তিনি রামগড়-সাবরুমের পথে না গিয়ে কুমিল্লা- আখাউড়া হয়ে চলে যান আগরতলায়। শান্তিবাহিনীর লোকেরাই তাঁকে এস্কর্ট দিয়েছে।

ঘটনাটি ঘটে যায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। তিন দিন পর আমি খবর পাই যে তিনি ইন্ডিয়া চলে গেছেন। আমি কপাল চাপড়াইলাম। এটা ছিল সময়ের মিসম্যাচ আর শাস্তিবাহিনীর গোয়েন্দা-সাফল্য।[3]

অন্যান্য সূত্রে জানা যায় যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী উপেন্দ্র লাল চাকমাকে যথেষ্ট চাপে রেখেছিল। একপর্যায়ে তিনি আর এটা মেনে নিতে পারেননি। অন্যদিকে তাঁর ওপর শান্তিবাহিনীরও যথেষ্ট চাপ ছিল। তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন। শেষমেশ তিনি ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রয় নেন।

সমঝোতা হলো না

সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির আলোচনা শুরু করার জন্য উভয় পক্ষই মরিয়া ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসুক, এটা অনেকেই চাইতেন। আবার অনেকেই এ নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। এখানে নানান দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত ছিল। এ প্রসঙ্গে বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মে. জে. খলিলুর রহমানের ভাষ্যটি কৌতূহল জাগায়, পুরো ক্যানভাসটি বর্ণনা করেছেন এভাবে:

বোধ হয় ১৯৮৮ সাল। বিডিআর ইফতার পার্টি। প্রেসিডেন্ট এরশাদ প্রধান অতিথি। সাবেক বিডিআর-প্রধান হিসেবে আমাকেও উপস্থিত হতে হলো। খাওয়ার সময় প্রধান অতিথিকে এড়িয়ে বেশ নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে বসলাম। কিন্তু ডাক পড়ল, প্রেসিডেন্টের টেবিলে বসতে হবে। গিয়ে দেখি, প্রেসিডেন্টের পাশে মন্ত্রী কর্নেল মালেক বসে আছেন। আমাকে দেখে এরশাদ কর্নেল মালেককে তাঁর স্বভাবজাত মিষ্টি সুরেই বললেন উঠে আমাকে জায়গা দিতে।

ইফতার শুরু হলো। কুশল বিনিময়ের পর এরশাদ জিজ্ঞেস করলেন, কেমন চলছে দেশ? এসব প্রশ্নের ছককাটা উত্তর, ভালোই তো, বেশ ভালো, আগের চেয়ে ভালো ইত্যাদি। কিন্তু এরপরও যখন তিনি পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, কোনো বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য আছে কি না, তখন মনে হলো, সত্যিই তিনি আমার অভিমত জানতে চান। আমাদের সুসম্পর্ক সৈনিক জীবন থেকে এবং সামাজিকভাবেও তা ছিল উষ্ণ ও শ্রদ্ধামিশ্রিত। অতএব, মনে হলো, এরপর আমার কিছু বলা উচিত। তখনকার দিনে রাষ্ট্রীয়ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটাই আমার কাছে সমূহ বিপজ্জনক বলে মনে হতো। সুতরাং ভাবলাম, সে সমস্যাটাই তুলে ধরি। আমার পরামর্শ গ্রহণ করা না-করা তাঁর ব্যাপার।

বললাম, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্বন্ধে আমি একটি সুপারিশ করতে চাই। এরশাদের উত্তর, 'বলুন খলিল ভাই।' বুঝলাম, এরশাদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নয়, সামাজিকভাবেই কথা বলতে চাইছেন। বললাম, বার্মাসহ এই উপমহাদেশের প্রতিটি দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়জনিত আঞ্চলিক সমস্যা আছে। শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তানে এই সমস্যা অত্যন্ত গুরুতর। এসব সমস্যা নিয়ে জাতীয়ভাবে তারা হিমশিম খাছে এবং তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, এমনকি জাতীয় অস্তিত্ব বিপদের সম্মুখীন। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে এতকাল এই সমস্যা ছিল না। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে তা শুরু হয়ে গেছে। এ সমস্যার সমাধান এখনই না করতে পারলে তাতে দেশের বিরাট ক্ষতি হতে পারে। বর্তমানে স্বল্প মূল্যে যার মীমাংসা পাওয়া যাবে, ভবিষ্যতে হয়তো বহু মূল্যেও তা পাওয়া যাবে না। জানি, বর্তমানে ভাসা-ভাসাভাবে এর সমাধানের চেষ্টা চলছে। কিন্তু তাতে ফল হবে না। সমস্যাটার সমাধান রাজনৈতিকভাবে করতে হবে, সামরিকভাবে তা অসম্ভব।

উত্তরে এরশাদ বললেন, 'এ বিষয়ে আমিও আপনার সঙ্গে একমত। আপনি সমস্যা ও তার সমাধান আমাকে বুঝিয়ে বলুন।'

বললাম, সমস্যাটি সম্বন্ধে আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। অতএব, একটু কষ্ট করে তোমার নিজেকেই তা জানতে হবে। তবে আমার একটি ব্যক্তিগত অনুরোধ, সমস্যাটির সমাধান তোমার নিজের হাতে নাও। জেনারেল কিংবা সিভিল আমলাদের ওপর ছেড়ে দিলে সমাধান হবে না।

এরশাদ হেসে ফেললেন ও বললেন, 'কেন ওরা পারবে না?' আমি বললাম, না। কারণ প্রথমত, এ ধরনের বৃহৎ চুক্তির জন্য যে খোলামন প্রয়োজন, তা তাঁদের থাকে না। দ্বিতীয়ত, এ ব্যাপারে কতটা ছাড় দেওয়া যায়, কতটা ছাড় দিলে তুমি প্রতিপক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারবে-এসব বড় সিদ্ধান্ত শীর্ষ ব্যক্তি ছাড়া কেউ নিতে পারে না। তুমি নিজেই জেনেশুনে ঠিক করে নাও, কতটা ছাড় দিতে হবে এবং কতটা দিতে পারবে। অন্য কাউকে দিয়ে এটা হবে না। তা ছাড়া কেবল পাহাড়িরা নয়, প্রত্যক্ষভাবে ভারত ও পরোক্ষভাবে পাকিস্তানও এর সঙ্গে জড়িত।

এরশাদ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। শেষে বললেন, 'আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। দেখবেন, সমস্যাটার সমাধান আমি করবই।'

পরে খবর নিয়ে জেনেছিলাম, এরশাদ নিজেই সমস্যাটির সমাধানে লেগে গেছেন এবং কিছুদিন পর এ ব্যাপারে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিটি ছিল ২১ দফার। কিন্তু এরশাদের শাসনামলে ২১ দফার মধ্যে নাকি মাত্র চার দফা বাস্তবায়িত হয়েছিল। এর পরে আর অগ্রসর হওয়া যায়নি। জানি না, এর কারণ কী। হতে পারে এরশাদের নিজের অনীহা ও কালক্ষেপণ। কিন্তু যে সম্ভাবনাটা বেশি তা হলো, চুক্তি হওয়ার পর এরশাদ এর বাস্তবায়নের ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন সিভিল ও সামরিক আমলাতন্ত্রের ওপর। ফলে নানা রকম টানাপোড়েন, সময়ক্ষেপণ ও দুর্নীতি ইত্যাদি মিলে এসব ক্ষেত্রে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।

এরপর বিএনপির আমলে আবার খুব গুরুত্বসহকারে সমস্যাটির সমাধানের চেষ্টা হয়। মন্ত্রী কর্নেল অলিকে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি পাহাড়িদের সঙ্গে ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করেন। স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যেই কর্নেল অলি যে কাজ হাতে নেন, অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্বল্প সময়েই তিনি অনেকটা অগ্রগতি লাভ করেন ও চুক্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান। জাতি আশা করেছিল, চুক্তি বোধ হয় হয়েই গেল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে আলোচনা ভেঙে যাওয়ার কারণ আমার জানা নেই। তবে যত দূর জানি, কারণটি বৈদেশিক সম্পর্কজনিত। অর্থাৎ ভারত ও বাংলাদেশ একমতে পৌঁছাতে পারেনি। এর মধ্যে পাকিস্তানের তরফ থেকে চাপ থাকাও বিচিত্র নয়।[4]

 



[1] ইবরাহিম (২০০১)

[2] ইবরাহিম (২০০১)

[3] সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম

[4] রহমান



[i] পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিবাহিনী জিয়া হত্যা মনজুর খুন: মহিউদ্দিন আহমদ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...