শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৪

মরুভূমি ফুল[i]

 

                             মরুভূমি ফুল[i]

ওয়ারিশ ডাইরে ক্যাটলীন মিলার

অনুবাদ: প্রধীর তালুনদার

শিশুর বালিকাটি ছিল বৃষ্টির পর মরুভূমিতে যে ফুল ফোঁটে সেই ফুলের মতই সুন্দর দৃঢ়চেতা। তার শৈশব কাটে মরুভূমির প্রচন্ড গরম, খরা চরম অভাব এবং অবহেলার মধ্যে। কিন্তু তাকে অতি বেদনাদায়ক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় যখন তাদের এক সামাজিক রীতির করালগ্রাসে তার যৌনাঙ্গ আক্রান্ত হয়। অথচ আশ্চর্য হলেও সত্য বর্তমানে ওয়ারিশ ডাইরে পৃথিবীর বিখ্যাত ফ্যাশন জগতের মডেল তারকাদের মধ্যে একজন। আফ্রিকা মহাদেশের সোমালিয়ার কোন এক প্রত্যন্ত মরু অঞ্চলের কুঁড়েঘর থেকে পালিয়ে যাওয়া বালিকার মর্মস্পর্শী বৃত্তান্ত প্রকাশিত হয়েছে "আধুনিক ফ্যাশন" নামক বইয়ের পাতায় পাতায়। তার বেদনাময় আজীবন বয়ে বেড়ানো গোপনীয় ক্ষত প্রকাশ করতে গিয়ে সাহসী এই নারী আশা ব্যক্ত করেছেন যে প্রতিবছর অসংখ্য নিষ্পাপ আফ্রিকান নারী যে সামাজিক কঠোরতম বিধানের শিকার হয়ে কষ্ট পায় তার থেকে মুক্তি পাবে।

মরুভূমির একলা পথে আমার পরিবারটি ছিল সোমালিয়ার মরুভূমির এক পশুপালনকারী উপজাতি। আমার শৈশব কাটে মরুভূমির অবারিত প্রকৃতির দৃশ্য, শব্দ আর সুগন্ধে ভরপুর আনন্দের মধ্যে। আমরা প্রায়ই দেখি সিংহের মরুভূমিতে লুটোপুটি খেলা। শেয়াল, জেব্রা আর জিরাপের সাথে খেলেছি দৌড়াদৌড়ি। ইঁদুরের ন্যায় ছোট মরুপ্রাণী ধরতে ধরতে কেটেছে শৈশবের অনেকটা সময়। সুখেই কাটছিল দিন।

কালক্রমে সেই সুখের দিন উধাও হয়ে যায়। জীবন হয়ে উঠে কঠিন কষ্টকর। আমার বয়স যখন পাঁচ বছর তখনই টের পাই একজন আফ্রিকান নারী হওয়া কত অভিশাপের। অসহায়ের ন্যায় এক ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্যে জীবন নেমে আসে আফ্রিকান মেয়েদের। আফ্রিকায় মেয়েরাই রোজগাড়ের প্রধান ভূমিকা নেয় যার কারণে তাদের বেশীর ভাগ কাজ করতে হয়। তবুও তারা আজো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরাধীন। তাদের নেই কোন বলার অধিকার। এমনকি কাকে যে তাদের বিয়ে করতে হবে তাও তারা জানেনা।

ক্রমে ক্রমে আমার বয়স যখন ১৩ তখন থেকে বুঝতে শুরু করি আমাদের সমাজের নানা বিধি বিধান। মেয়েদের পরাধীন রাখার তথাকথিত সমাজের রীতিনীতির নির্মম অত্যাচার নিবৃত্তে অনুভব করা ছাড়া এই বয়সের এক নারীর আর কিছু করার নেই। আমি চরমভাবে বুঝতে শুরু করি যে নারী হিসেবে কষ্টভোগ করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সুতরাং সেই থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি পালিয়ে যাবো। আমার বুকচাপা আর্তনাদ আর সীমাহীন কষ্টের যাত্রা শুরু হয় যেদিন আমার বাবা জানালেন যে আমার বিয়ে তিনি ঠিক করেছেন। যখন বুঝতে পারলাম যে আমাকে দ্রুত সম্মতি দিতে হবে তখন মাকে বললাম আমি পালিয়ে বাঁচতে চাই। আমার পরিকল্পনা ছিল দেশের রাজধানী মোগাদিসুতে বসবাসকারী আমার এক আন্টিকে খুঁজে পাওয়া। অথচ যে মোগাদিসুতে আমি কোনদিন যাইনি।

এক গভীর রাতে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখি সঙ্গে নেয়ার মত জল, দুধ বা খাদ্য কোনটাই নেই। খোলা পায়ে কেবল একটি স্কার্প গলায় জড়িয়ে অন্ধকার মরুভূমিতে দৌড়াতে থাকি। আমি জানতাম না কোনদিকে গেলে মোগাদিসু। আমি কেবল দৌড়তে থাকি। প্রথম প্রথম ধীরে ধীরে দৌড়তে থাকি কারণ আমি কিছুই দেখতেই পাইনা। আফ্রিকার গজলা হরিণের মতোই কিছুটা ঘনান্ধকার মরুসাগরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পালাতে থাকি। পরের দিন দ্বিপ্রহরে আমি পৌঁছে গেলাম গভীর উত্তপ্ত মরুভূমির এক সীমাহীন অঞ্চলে। ধীরে ধীরে আমি ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত ও দূর্বল হয়ে পড়লাম।

যখন আমি আমার ভবিষ্যতের পরিণতি নিয়ে ভাবছিলাম তখনই শুনতে পাই বহু দূর থেকে আমার বাবার "ওয়ারিশ" "ওয়ারিশ" বলে ডাকার শব্দ। আমি ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে যাই। কারণ আমি জানি বাবা আমাকে ধরতে পারলেই আমাকে বিয়ে করতে হবে এক ষাটোর্ধ বৃদ্ধকে। আমাদের কুঁড়েঘর থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেও বাবা আমাকে অনুসরণ করে আসেন আমার পদচিহ্ন লক্ষ্য করে। তিনি আমার একেবারেই নিকটে চলে আসেন।

আমি আবার জোরে দৌড়তে থাকি। আমি দেখলাম বাবা পিছন পাহাড় বেয়ে আমাকে তাড়া করছেন। তিনি যে আমাকে দেখতে পেয়েছেন জেনে আমি আরো ভীত হয়ে পড়লাম এবং প্রাণপণ দৌড়তে থাকি। আমরা বালির ঢেউয়ের মধ্যে লুকোচুরি খেলতে লাগলাম। আমি যখন এক পাহাড়ে উঠি তখন বাবাকে পিছনের পাহাড় বেয়ে নামতে দেখি। এভাবে প্রায় চার ঘণ্টা আপ্রাণ দৌড়ে পালাতে পালাতে আমি অবশেষে বুঝলাম বাবাকে আর দেখা যাচ্ছে না। তিনি আর আমাকে ডাকছেন না।

আমি এভাবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৌড়তে থাকি। মরুভূমির দেশে আবার রাত নেমে এলো। আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। দেখলাম আমার পা রক্তাক্ত হয়ে গেছে। আমি একটা গাছের নীচে বসে পড়লাম আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি।

পরের দিন সকালে দেখি মরুভূমিতে সূর্যের আলো এসে পড়েছে। বালু চিক্ চিক্ করছে। আমি উঠে পড়লাম এবং আবার দৌড়তে থাকি। রাত যখন গভীর হয়, চোখে যখন আর কিছুই দেখি না তখন বালুর উপর ঘুমিয়ে পড়ি। দিনের বেলায় যখন বালু সমুদ্র প্রচন্ড গরমে জ্বলতে থাকে তখনও গাছের নীচে শুয়ে থাকতাম। এভাবে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয় আর কষ্টের মধ্যে দিনের পর দিন পালিয়ে যেতে যেতে আমি দিশেহারা ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। একদিন আমি যখন ঘুমে আচ্ছন্ন তখন শুনতে পাই এক নিঃশ্বাসের শব্দ। আমি জেগে উঠে চোখ খুলেই দেখি এক আফ্রিকান সিংহ আমাকে শুরুতে শুরু করেছে। আমি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার ক্লান্ত শরীর এবং পায়ে আর মোটেই শক্তি নেই। আমি কুঁজো হয়ে রইলাম। পরে বহু কষ্টে ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে এক গাছের আড়ালে চলে গেলাম। আফ্রিকান জ্বলন্ত সূর্যের ন্যায় এই সিংহের থাবা থেকে কিভাবে বাঁচবো এই ভাবতে লাগলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম মরুভূমিতে আমার দিশাহীন এ যাত্রার বুঝি সমাপ্তি হলো। মৃত্যুর জন্য তৈরী হয়ে নিলাম আমি। সিংহকে বললাম আসো খেয়ে ফেলো আমাকে, আমি তৈরী। আফ্রিকার এই বিশালকায় বিড়ালটি আমাকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে দেখলো আমিও তাকে স্থিরভাবে চেয়ে রইলাম। সে কিছুক্ষণ লেহন করে নিলো আমার পেছন দিকটা। আগুনের ফুলকির মতো তার নিঃশ্বাস আমার শরীরের উপর পড়লো। ভাবলাম এই মুহূর্তে এই দানব আমাকে ছিন্নভিন্ন করে গিলে ফেলতে পারে। অবশেষে দেখলাম সে ধীরে ধীরে আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেলো। হয়তো ভাবল যে মাংসহীন এই ছোট্ট নারী শিশুটি খেলে তার পেট ভরবে না। যখন বুঝলাম সিংহটি আর আমাকে খাবে না তখন ভাবলাম ভগবান হয়তো আমাকে বাঁচিয়ে রাখলো আমাকে নিয়ে তার কোন পরিকল্পনা পূরণ করতে। কি সেই পরিকল্পনা? এই ভাবতে ভাবতে পা বাড়ালাম আর বললাম হে নিয়তি নিয়ে চলো আমাকে সেই গন্তব্যের দিকে।

মরুভূমির শিশু: ঘর থেকে পালিয়ে আসার আগে আমার জীবন গড়ে উঠেছে প্রকৃতি আর

পরিবার নিয়ে আর দশটা মেষপালক সোমালী শিশুর মতই গবাদিপশু, ভেড়া, ছাগল চড়াতে চড়াতে। নিত্যদিন আমাদের বাঁচিয়ে রাখত আমাদের উটেরা। কারণ তাদের দুধ আমাদের পুষ্টি যোগাত আর আমাদের তৃষ্ণার নিভৃতি ঘটাতো অতি মূল্যবান জলের মতোই যখন আমরা থাকতাম শুষ্ক মরুভূমিতে যেখানে জল পাওয়াই যেত না। উটের দুধই হতো আমাদের সকালের ব্রেকফাস্ট আর নৈশভোজের খাবার। ভোরেই আমাদের সূর্য উঠার সাথে সাথে ঘুম ভাঙতো। সকালেই আমাদের কাজ শুরু হতো মরুভূমিতে চড়তে চড়তে হারিয়ে যাওয়া পশুদের খোঁজাখুজির মধ্যে দিয়ে। দুধ দোহন করাও আমাদের নিত্যদিনের কাজ। আমরা যখন বেরুতাম তখন গাছের পাতা সংগ্রহ করতাম পশুদের জন্য যাতে তারা রাত্রে অন্যত্র কোথাও খাবারের জন্য হারিয়ে না যায়। আমরা পশুপালন করতাম প্রধানত দুধের জন্য ও তাদের বিক্রি করে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে। আমি চোট্ট হলেও আমাকে ৬০ থেকে ৭০টি ছাগল মরুভূমিতে চড়াতে হতো। আমি আমার লম্বা লাঠি হাতে নিয়ে গান গাইতে পশুপাল চড়াতে নিয়ে যেতাম।

সোমালিয়ায় পশুচারণ ভূমির মালিক কেউ নয়। তাই আমাকে একাই খুঁজে নিতে হতো নতুন চারণভূমি যেখানে অনেক অনেক ঘাস জন্মায়। পশু চড়াতে দিয়ে আমি লক্ষ্য রাখতাম কখন শিকারী হায়েনা মেষ পালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খেয়ে খেয়ে ফেলে। আফ্রিকান সিংহেরও ভয় ছিল কখন ভেড়া বা মেষ পালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খেয়ে ফেলে।

আমাদের পরিবারের সবার মতোই আমি জানতাম না আমার বয়স কত। আমরা শৈশব থেকে বেড়ে উঠতাম ঋতু আর সূর্যের সাথে তাল মিলিয়ে আর ভেবে নিতাম বৃষ্টির জলের জন্য কোন দিকে স্থানান্তরিত হবো। আমাদের ঘরটি হতো ছোট তাবুর মত মরুভূমিতে পাওয়া ঘাস দিয়ে তৈরী। উচ্চতায় ও প্রন্থে বড় জোর দুই মিটার। যখন আমরা স্থান বদল করতাম তখন ছোট ঘরটি কিছুক্ষণের মধ্যে ভেঙে ফেলতাম আর তল্লাতুল্লি বেঁধে উটের পিটে চাপিয়ে দিতাম। ঘুরতে ঘুরতে যখন কোথাও একটু জলের সন্ধান পেতাম তার আবার ঘর বাঁধতাম।

আমাদের ঝুপড়ির মতো ঘরটি দ্বিপ্রহরের প্রচন্ড দাবদাহ থেকে রক্ষা করতো আর দুধ সংগ্রহে রাখার জন্য কাজে লাগতো। রাতের বেলায় আমরা পরিবারের ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়তাম খোলা আকাশের সীমাহীন তারা গুনতে গুনতে একটি মাদুরে একসাথে জড়াজড়ি করে। আমার বাবা মাও ঘুমিয়ে পড়তো আমাদের দুই দিকে রাতের হিংস্র জন্তুর কাছ থেকে রক্ষা করার জন্যে।

আমার বাবা দেখতে সুদর্শন। প্রায় ছয় ফুট লম্বা, স্বাস্থ্যবান। মা কিছুতা হ্যাঙলা রোগা তবে খুবই সুন্দরী। তার গায়ের চামড়া কালো মসৃণ এবং মুখমন্ডল মঙ্গোলীয় রমণীর মতোই দেখতে। স্বভাবে মা খুবই শান্ত ও স্বপ্নভাষী। কিন্তু যখন মা কথা বলতে শুরু করেন তখন এতই হাস্যরসিকতা করেন যে আমাদের কেবল হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যেতো। মা আমার বড় হয়েছেন মোগাদিসুতে যেখানে তাদের পরিবারের অর্থ ও প্রতিপত্তি ছিল। অন্যদিকে আমার বাবা শুধুই মরুভূমির এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। যখন আমার বাবা মাকে বিয়ে করার জন্য তার হবু শ্বশুরকে প্রস্তাব দেন তখন আমার মায়ের বাবা বলেন-"কখনো আমার মেয়ে তোমাকে বিয়ে দেবো না।" তবুও মার যখন ১৬ বছর বয়স তখন মোগাদিসু থেকে পালিয়ে বাবাকে বিয়ে করেন। আমার মা আমাকে আদর করে ডাকতেন এবডোহল নামে। যার অর্থ হলো ছোট্ট মুখ। পরে মা আমাকে ওয়ারিশ নামেই ডাকতেন। ওয়ারিশ হলো মুরুভূমির একপ্রকার ফুল। আমাদের মরু দেশে কখনো কখনো মাসের পর মাস বৃষ্টি হয়না। কেবল কিছু কিছু গাছ গাছালি বেঁচে থাকে তখন। অবশেষে যখন বৃষ্টি নামে তখন হাজারো কমলা ও হলুদ রঙের ফুল ফোঁটে প্রকৃতির খেয়ালেই।

একজন নারী হওয়া: আমাদের মত যাযাবর আদিম জাতিগোষ্ঠী যেখানে আমার জন্ম সেই সমাজে অবিবাহিত নারীদের কোন স্থানই নেই। কাজেই আমাদের সমাজে মায়েরা চাইত মেয়ে যেন অবশ্যই একজন স্বামী পায়। সোমালিয়ায় আজো নারীকে মনে করা হয় একটি কলুষিত যন্ত্র হিসেবে। নারীর দুই পায়ের মাঝখানের যৌনাঙ্গে রয়েছে ময়লা তাই নারী তখন বিবাহযোগ্য হয় যখন তার যৌনাঙ্গের ঐ বিশেষ অংশ কেটে বাদ দেয়া হয়। যৌনাঙ্গের ঐ অংশ কেটে ফেলে সেলাই করে দেয়া হয়। প্রস্রাবের জন্য কেবল রেখে দেয়া হয় একটুখানি ছিদ্র। যৌনাঙ্গের এই অংশ কেটে ফেলার যে রীতি এ দেশে প্রচলিত এতে একটি পরিবারের অনেক খরচের ভার বহন করতে হয়। এই কাজের জন্য তাই প্রত্যেক পরিবারের আয়ের একটা অংশ জমা রাখতে হয়। মরুভূমির এ দেশে তা না হলে কোন যুবতী বিবাহযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনা।

কিভাবে যৌনাঙ্গ কাটা হয়, কেন কাটা হয় ইত্যাদি কোনটাই আগে থেকে বলে দেয়া হয় না কোন বালিকাকে। কাজেই এ কাজটা আফ্রিকান দেশের এ অংশ নারীদের একটা আতংক ও অজানা আশংকার বিষয়। বয়স হলে কেবল বুঝতে হবে যে কিছু একটা কাটাকাটির ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে কোন বালিকার জীবনে। তাই এ দেশের নারী শিশুরা ভয়ের সাথে অপেক্ষা করতে থাকে কবে একজন পরিপূর্ণ নারী হওয়ার সময় আসবে নিজের জীবনে। আগে যখন প্রথম ঋতুস্রাব হয় তখনই বুঝতে হয় সময় হয়েছে যৌনাঙ্গ কাটার। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন অনেক কম বয়স থেকেই এ কাজটা করা হচ্ছে। আমার বয়স যখন পাঁচ তখন একদিন মা বললেন বাবা জীপসি মহিলার খোঁজে গেছে। যে কোনদিন তিনি ঐ জীপসি মহিলাকে নিয়ে বাড়ীতে আসতে পারে। যে রাতে আমার লিঙ্গাগ্রচ্ছেদ অনুষ্ঠান সেদিন আমাদের বাড়ীতে বেশ ব্যস্ততা। আমাকে অনেক আদর করে বেশী করে খাওয়ানো হলো। মা বললেন বেশী যেন জল বা দুধ পান না করি। আমি জেগে জেগে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন কি করতে হয়। বাইরে তখনো বেশ অন্ধকার। মা আমার পাশে এসে বসলেন। আমি কম্বল জড়িয়ে মায়ের পাশে শুয়ে রইলাম। আমরা ঘরের বাইরে একটা ঝোঁপের মধ্যে গেলাম। মা বললেন আমরা এখানে অপেক্ষা করি। আমরা ঠান্ডা বালির উপর বসে পড়লাম। তখনো পৃথিবীতে সূর্যের আলো আসতে বাকী যদিও কিছুটা সকালের আভাস আসতে শুরু করেছে। ভোর হতে হতে টের পেলাম জীপসি বুড়ী চপল পায়ে এসে পড়ছে। আমি তাকে দেখার আগেই সে আমার খুব নিকটে এসে আমাকে বলল এখানে বসো ঐ সমতল পাথরটার উপর। কোন কথা বলার প্রয়োজন বোধ হলো না তার। কারণ সে কেবল তার ব্যবসায়িক কাজ করতেই এসেছে। মা আমাকে পাথরটার উপর বসালেন। তিনি আমার পেছনে বসে আমার মাথা তার কোলে নিয়ে বসলেন এবং একটা গাছের শিকড় আমাকে দাঁতে দিয়ে কামড়িয়ে রাখতে বললেন। আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম। মা আমাকে কানে কানে চুপি চুপি বললেন-"লক্ষ্মী হয়ে থাকো মা। তোমার মায়ের জন্য অন্তত সাহসী হও। খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে কাজটা।" আমার কান্না আসতে চাইল। আতংকে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমি আমার দু' পায়ের মধ্যে বসা অবস্থায় দেখে। নিলাম জীপসি বুড়ী আমাকে ভয়ংকর ভাবে দেখছে। দেখলাম তার অতি ময়লা একটা ব্যাগ থেকে খুবই পুরনো ভাঙা ব্লেড বের করছে। দেখলাম ব্লেডের গায়ে তখনো পুরনো রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। জীপসি বুড়ী যখন আমার যৌনাঙ্গে তার ভাঙা ব্লেড দিয়ে কাটা শুরু করে দিয়েছে মা তখন আমার চোখ ঢেকে দিলেন তার দু হাতে।

পর মুহূর্তে বুঝলাম আমার যৌনাঙ্গের মাংস কেটে ফেলছে জীপসি মহিলাটি। জীপসি বুড়ী যখন তার বোঁটা ব্লেড দিয়ে আমার যৌনাঙ্গের অগ্রভাগের চামড়া কাটা শুরু করেছে আমি প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলাম। এ যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। আমি নড়াচড়া করতে পারলাম না। ভাবলাম নড়াচড়া করলে আরো যন্ত্রণা বাড়বে। কিন্তু আমার পা দুটো কষ্টের জন্য আপনা থেকেই নড়তে লাগল। প্রার্থনা করতে লাগলাম ঈশ্বর ও যন্ত্রণা তাড়াতাড়ি শেষ হোক। হে ঈশ্বর আমাকে বাঁচাও। অবশেষে জীপসি বুড়ী তার অপারেশন শেষ করল বুঝলাম। চোখ খুলে দেখি সে হাতের কাছের থর্ন জাতীয় একটা গাছ থেকে কাঁটা ভেঙে সে কাঁটা দিয়ে আমার যৌনাঙ্গের চামড়া ছিদ্র করতে করতে তার ময়লা ব্যাগ থেকে বের করা পুরনো সূতো দিয়ে সেলাই করল। আমি গভীর যন্ত্রণায় গোঁঙাতে শুরু করলাম। ভাবলাম আমি মরেই যাবো। আমি সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। চোখ যখন খুললাম তখন দেখি জীপসি বুড়ীটি চলে গেছে। আমার দু' পা শক্তভাবে বেঁধে আমাকেও বেঁধে রাখা হয়েছে যাতে নড়াচড়া করতে না পারি। চোখ খুলে ভালো করে দেখি যে পাথরে শোয়ায়ে আমার লিঙ্গাগ্রচ্ছেদ করা হয়েছে সে পাথরটি রক্তে লাল হয়ে আছে যেন কোন পশু বলি দেয়া হয়েছে একটু আগে। পাথরের উপর তখনো পড়ে আছে রোদে শুকিয়ে যাওয়া আমার মাংসের অংশ। মরুভূমির গরম হাওয়া এসে আমার মুখের উপর বইতে লাগল। মা ও আমার বড় বোন আমান আমাকে টেনে নিয়ে ঘরের পাশে ঝুপড়ির ভেতর রাখল যেখানে আমার জন্য তারা আগে থেকেই একটা জায়গা তৈরী করে রেখেছিল। সাধারণভাবে একটা গাছের নীচেই তৈরী করা হয় এই জায়গা। এই জায়গায় আমাকে থাকতে হবে একাই পরবর্তী দু' সপ্তাহ। সোমালিয়ার এ অঞ্চলের পশ্চাদ পদ জনগোষ্ঠীদের এটাই প্রচলিত সামাজিক বিধান।

বেশ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর মনে হলো আমি মরে যাচ্ছি। আমি আমার বোন আমানকে ডাকলাম। সে আমাকে ঠেলে বালুর মধ্যে একটা গর্তের দিকে ইঙ্গিত করে বলল ঐ দিকে চলে যাও। আমার যৌনাঙ্গের চামড়া জ্বলতে লাগল যেন এসিড দিয়ে কেউ আমাকে আঘাত করেছে। জীপসি বুড়ী অপারেশনের পর যৌনাঙ্গে যে ছিদ্র রাখা হলো তা হলো কেবল প্রস্রাব ও ঋতুস্রাবের সময় রক্ত বেড়িয়ে আসার মত অতি ছোট একটা ছিদ্র যা একটা ম্যাচস্টীকের ব্যাসার্ধের অর্ধেক মাত্র।

দিন যতই যেতে লাগল আমি শুয়ে শুয়ে রোগাক্রান্ত হলাম। আমার যৌনাঙ্গের ক্ষত স্থানে ইনফেকশন হলো। আমার প্রচন্ড জ্বর এলো। মাঝে মধ্যে আমি অজ্ঞান হতে লাগলাম। মা আমার জন্য পরবর্তী দু সপ্তাহ খাবার ও পানীয় জল এনে দিলেন। তখনো আমার দু'পা বাঁধা। পড়ে রইলাম একা একা সেই জায়গায় পুরো দু'সপ্তাহ যাবত। আমি ভাবতে থাকি কেন করা হয় এসব কান্ড? এই বয়সে আমি সেক্স সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমি শুধু জানলাম যে আমার নিজের মায়ের অনুমতি নিয়েই আমার যৌনাঙ্গের অগ্রভাগ কেটে ফেলা হয়েছে। তার জন্য আমি যন্ত্রণা সহ্য করলাম। তবে আমি নিজেকে আরো ভাগ্যবান মনে করলাম যখন জানলাম যে এই কারণে প্রতি বছর অনেক অনেক নারী শিশুর অকাল মৃত্যু হয়। রক্ত ক্ষরণের কারণে, ধনুষ্টংকারে বা ইনফেকশনে মারা যায় বেশীর ভাগ। যুগ যুগ ধরে যেভাবে এই ট্রাডিশন পালন হয়ে আসছে তাতে অবাক লাগে আমরা কিভাবে বেঁচে রয়েছি।

বিয়ে: আমার বয়স যখন ১৩ তখন বাবা একদিন সন্ধ্যে বেলা বাড়ীর বাইরে থেকে এসে নরম গলায় আমাকে ডাকলেন-"এদিকে এসো মা।" বাবা যেহেতু সাধারণভাবে কঠিন তাই আমার একটু সন্দেহ হলো। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম বাবার পাশে। তিনি বলতে লাগলেন-"তুমি এখন বেশ বড় হয়ে গেছো মা।" আমি মনে মনে ভাবলাম আরো ভয়াবহ কিছু হতে যাচ্ছে আমার জীবনে। বাবা আরো বললেন-"তুমি এখন বড় মানুষের মত কাজ করতে পারো। পোষা পশুপালকে ভালোই যত্ন নিতে পারো এবং আমি চাই তুমি জানো যে আমি তোমাকে বিয়ে ঠিক করে দিয়ে হারাতে বসেছি।" তিনি যখন বলে যাচ্ছিলেন তখন হয়তো ভাবছিলেন আমি পালিয়ে যাবো। কারণ আমার বড় বোন আমানকে যখন বিয়ের কথা বলেছিলেন তখন সে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি বাবাকে আশ্বস্থ করলাম যে আমি পালিয়ে যাচ্ছি না। তিনি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন-"তুমি তো লক্ষ্মী মেয়ে আমার। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। মা তোমার জন্য একজন স্বামী খুঁজে পেয়েছি।" আমি বাবাকে মাথা নাড়িয়ে বললাম না বাবা আমি বিয়ে করবো না।

আমি বড় হয়েছি নির্ভয়ে। আমার আশৈশব গড়ে উঠেছে দুরান্তভাবে। বাবা আমার জন্য স্বামী খুঁজে দিয়েছেন যখন আমি একজন দামী পণ্যে পরিণত হয়েছি। কারণ কোন আফ্রিকান পুরুষ চায়না তার স্ত্রীর জন্য সে চ্যালেঞ্জ-এর মুখোমুখী হতে। যাই হোক আমি অসুস্থ ও আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। পরের দিন আমি যখন দুধ দোয়াতে গেলাম তখন বাবা আবার আমাকে ডাকলেন। তিনি বললেন- "ইনি মি:..." আমি আর বাবার কোন কথা শুনতে পেলাম না। আমার দৃষ্টি একজন বসা ভদ্রলোকের উপর নিবদ্ধ হলো। দেখলাম সে কম করে হলেও ৬০ বছর বয়সের হবে যাকে আমার বিয়ে করতে হবে। সেই পাকা দাঁড়িওয়ালা একটি বৃদ্ধ লোক বেত হাতে বসে আছে। বাবা বললেন-"ওয়ারিশ মি: গ্যালোলকে হ্যালো বলো। দু' একটি কথা বলো তার সাথে।" আমি খুব নীচু স্বরে বললাম হ্যালো। বুড়ো ভদ্রলোকটি আমার কাছেই এসে তার লাঠিতে ভর দিয়ে আমাকে দেখতে লাগল। আমি অবাক হয়ে রইলাম। বাবা আমার হাবভাব বুঝতে পারলেন মনে হলো। তিনি বললেন-"যাও, তোমার ঘরের টুকিটাকি কাজগুলো সেরে ফেলো।" আমি আমার ছাগল পালের পিছনে ছুটলাম।

পরের দিন সকালে বাবা আমাকে ডাকলেন। "তুমি জানো সেই লোকটিই তোমার ভাবী স্বামী।" কিন্তু বাবা,সে তো খুব বুড়ো লোক। তার সাথে আমার বিয়ে হবে? বাবা বললেন- "এ ধরনের পাত্রের মধ্যে ইনিই সবচেয়ে ভালো। তার বয়স হয়েছে তাই সে তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। তোমায় ভালো আদর যত্ন করবে। আর তাছাড়া সে আমাকে পাঁচটা উট দেবে।" এই উট দেয়ার কথাটি বাবা একটু জোরের সাথে এবং কিছুটা গর্বের সাথে বললেন। আমি দেখলাম এটাই আমার শেষ সময়। বাবার পশুপাল আমি পালন করলাম। মনে মনে ঐ বুড়ো লোকটির সাথে আমার সংসারের একটা চিত্র ভাবলাম। ভাবলাম কোন এক জনমানবহীন নির্জন মরু প্রান্তরে আমি বাড়ীর সব কাজ কর্ম করছি আর বুড়ো স্বামীটি লাঠি হাতে বসে বসে দেখবে। বুড়ো স্বামীটি দু'এক বছর পর যখন হার্ট এটাকে মারা যাবে তখন চার পাঁচটা বাচ্চা নিয়ে আমি দিশাহীন ও অসহায়ভাবে এ সংসারে হাবুডুবু খাবো। আমি মনে মনে ভাবলাম এ আমার জীবন হতে পারে না।

সেদিন রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল আমি মায়ের কাছে গেলাম। মা তখনো আগুনের কাছে বসে বসে ভাবছে হয়তো। মাকে চুপি চুপি বললাম-"মা আমি পালিয়ে যাচ্ছি।" মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-"তুমি কোথায় যাচ্ছো" বললাম-মোগাদিসু। যেখানে আমার বোন আমান থাকে সেখানে যাবো মা। আমি উত্তরে বললাম। মা বললেন চুপচাপ শুতে যাও। মায়ের কড়া চাহনি দেখে বুঝলাম যে আমার বিয়ের বিষয়টা পাকাপাকি। এ বিষয়ে আর কিছুই বলার নেই। আমি দুশ্চিন্তায় শুতে গেলাম। আমার আর ঘুম আসতে চায় না। গভীর রাতে মা আমাকে কানে কানে বললেন যাও পালিয়ে যাও তোমার বাবা জেগে উঠার আগেই। মরুভূমির অজানা দিশায় আমার যাত্রা শুরু হলো। আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। প্রাণভরে আদর করলেন। আমি নিজেকে শক্ত করে রাখতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। আমার দু' চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। আমিও মাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মা বললেন "তুমি ভালো থেকো। সব সময় সতর্ক থাকবে। খুব সাবধানে থেকো মা। আর ওয়ারিশ একটা কথা-তোমার কথা কোনদিন ভুলো না।" না মা আমি কোনদিন তোমাকে ভুলবো না। মাকে শেষ বারের মত চুম্বন করে অন্ধকারের মধ্যে দৌড়তে লাগলাম।

মোগাদিসু: ভারত মহাসাগরের তীরে বন্দর নগরী মোগাদিসু তখন একটি সুন্দর শহর। মোগাদিসুর বড় রাস্তায় একলা হাটতে দেখলাম সারি সারি পাম গাছের ফাঁকে ফাঁকে সুউচ্চ সাদা সাদা দালান দাঁড়িয়ে আছে। আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে রয়েছে নানা রঙের ফুলের বাগান। অদ্ভুত সুন্দর এ মোগাদিসু শহর ইটালিয়ান স্থপতিদের তৈরী বিশাল বিশাল বিল্ডিংয়ের সমারোহ বৈ কিছু নয়। এ শহরটি যখন ইটালিয়ান সোমালিল্যান্ড ছিল তখনই একে রাজধানী হিসেবে সাজানো হয়েছিল। তাই এ শহরকে মনে হয় ভূমধ্যসাগরীয় নগরীতুল্য।

এ শহরে আমি পৌঁছলাম ঘর থেকে বেড়িয়ে তিন সপ্তাহ একটানা হাটার পর। আমার কাকাই আমাকে সারাটা পথ নানাভাবে সাহায্য করেছে। তিনি আমাকে আমানের খোঁজ খবর দিয়েছেন আর কিছু পয়সা দিয়েছেন যার কারণে আমার মরুভূমির যাত্রা সমাপ্ত করতে পেরেছি। মোগাদিসু শহরে যখন আমার বোন আমানের খোঁজ করতে লাগলাম তখন একদিন বাজারে বোনের এক প্রতিবেশীর সাথে আকস্মিকভাবে পরিচয়। সেই মহিলা আমাকে বাজারে ঘুরতে দেখে বললেন-"তোমাকে যে বেশ চেনা চেনা লাগছে।" তুমি কি আমান নামে কারো বোন হও?"

সেভাবেই আমার বোনের বাড়ী খুঁজে পেলাম। মহিলার ছেলে আমাকে আমানের বাড়ীতেই নিয়ে গেলো। আমি যখন আমাদের ঘরে গেলাম আমান তখন ঘুমে। তাকে জাগালাম। আমাকে দেখে তার তো স্বপ্নে দেখার মতো অবস্থা। আমি তার পাশে বসে আমার সমস্ত ঘটনা বললাম। অবশেষে আমার কষ্টের কথা বলার মত একজনকে পেলাম। আমার বোন আমানের স্বামী একজন ভালো মানুষ এবং পরিশ্রমী। তারা তখন প্রথম বাচ্চা পাওয়ার সম্ভাবনায় ব্যস্ত। আমানদের ছোট্ট ঘরের দুটি রুমের একটিতে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। আমার যতদিন প্রয়োজন ততদিন থাকতে পারবো বলে তারা রাজী হলো। আমি রুম পরিস্কার করে নিলাম। কাপড় ধুয়ে নিলাম। বাজার করলাম। আমান যখন ছোট্ট একটি ফুটফুটে মেয়ে জন্ম দিলো আমি তার সেবা যত্ন করতে লাগলাম। এভাবে দিন যেতে যেতে একদিন বুঝতে পরলাম আপন দু' বোন হলেও আমান আর আমার মন এক নয়। সে এমন ব্যবহার করতে শুরু করলো যেন আমি সেই ছোট্ট বেলায় যেভাবে আমাকে খাটাতো ঠিক সেভাবেই বাড়ীর সব কাজ করতে হয়।

মোগাদিসুতে সাহরু নামে আমার মায়ের এক বোন থাকত। একদিন তার বাড়ীতে গিয়ে কড়া নাড়ালাম। জানতে চাইলাম তাদের পরিবারের সাথে কিছুদিন আমি থাকতে পারবো কিনা? সাহরু আন্টি বললেন-"তোমার এখানে একজন বন্ধু আছে। তুমি ইচ্ছা করলে আমাদের সাথে থাকতে পারো" যা ভেবেছিলাম তার বেশী ভালোভাবে দিন যেতে লাগলো। আমি আবার বাড়ীর সব কাজে নিজের মতো সাহায্য করতে লাগলাম। এভাবে মোগাদিসুতে দিন কাটতে লাগলো। মায়ের কথা প্রায়ই মনে পড়ত। তাকে একলাই ফেলে চলে এসেছি। বাড়ীর কোন কাজে তাকে সাহায্য করার আর কেউ নেই। একদিন ভাবলাম মাকে তো কিছু অর্থ পাঠাতে হয় খাতে সে কাজের মেয়ে রাখতে পারে ঘরে। তাই আমি কাজের সন্ধানে একদিন বেরুলাম। বিল্ডিং তৈরী হচ্ছে এমন এক জায়গায় কন্ট্রাক্টরকে বুঝালাম যে আমি ভালো কাজ করতে পারবো। একজন পুরুষ যেমন করতে পারে আমিও ঠিক তেমনি পরিমাণে কাজ করতে পারবো। বালু সিমেন্ট বা ইট বহন করতে পারবো ঠিক একজন পুরুষের সমান। কনস্ট্রাকশন ইনচার্জ রাজী হলেন।

পরের দিন সকাল থেকে আমার কেরিয়ার শুরু হলো একজন কনস্ট্রাকশন শ্রমিক হিসেবে। এটি খুবই পরিশ্রমের কাজ। সারা দিন কোমরভাঙা পরিশ্রম করে বালু বহন করতে লাগলাম। আমার গোটা হাতে ক্ষত সৃষ্টি হলো। অন্যান্য শ্রমিকরা হয়তো ভাবলো আমি কাজ ছেড়ে পালিয়ে যাবো। কিন্তু আমি পুরো একমাস খাটলাম। মাসের শেষে দেখি আমার ৬০ ডলারের মত জমা হয়েছে। পুরো টাকাই আমি মায়ের কাছে পাঠালাম একজন পরিচিত লোকের হাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য মা সেই টাকার এক পয়সাও পায়নি।

যাই হোক, একদিন আমি আন্টি সাহরুর ঘর পরিস্কার করছিলাম। এমন সময় লন্ডনে সোমালিয়ার এ্যামব্যাসাডর (রাষ্ট্রদূত) মোহাম্মেদ চামা ফারাহ আমার আন্টিদের বাড়ীতে বেড়াতে এলেন। তিনি আমার মায়ের এক দুর সম্পর্কের বোনকে বিয়ে করেছিলেন। তার নাম মরিয়াম। ঘর পরিস্কার করতে করতে আমি শুনলাম চামা ফারাহ আমার আন্টিকে বলছিলেন তার একজন কাজের মেয়ে দরকার। তিনি তখন লন্ডনে চার বছরের জন্য সোমালিয়ার রাষ্ট্রদূত হয়ে বদলী হচ্ছিলেন। ভাবলাম এটাই আমার সুযোগ। আমি আমার আন্টি সাহরুকে বললাম আমি তার সাথে যেতে রাজী যদি তিনি আমাকে নিয়ে যান। আন্টি সাহরু পাশের ঘরে গিয়ে চামা ফারাহ'কে বললেন-"আমার ঘরে যে মেয়েটি কাজ করছে তাকেই নিয়ে যান না কেননা সে খুব ভালো মেয়ে।" আন্টি আমাকে ডাকলেন। আমি ডাস্টার হাতে চুইংগাম চিবুতে চিবুতে তাদের ঘরে গেলাম। এমব্যাসাডর চামা ফারাহ আমার আপাদমস্তক দেখলেন। আমি আমার আন্টিকে বললাম-আন্টি উনাকে বলে দাও আমি তার ঘরে ভালো কাজ করতে পারবো এবং আমিই সবার চাইতে ভালো কাজের মেয়ে। আন্টি আবার উনাকে বললেন-"মেয়েটি ভালো এবং যুবতী। সেই ঠিকঠাক কাজ করতে পারবে।" আংকেল মোহাম্মেদ ফারাহ কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলেন। পরে বললেন-"ঠিক আছে কাল সকালে তৈরী থেকো। আমরা লন্ডন চলে যাচ্ছি।"

লন্ডন। এ জায়গাটি যে কোথায়? কোন দিকে আমার কিছুই জানা নেই। তবে আমি জানতাম লন্ডন সোমালিয়া থেকে অনেক অনেক দূরে। আমি আনন্দে উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। পরের দিন আংকেল মোহাম্মেদ ফারাহ এলেন এবং আমার পাসপোর্টটা দিয়ে গেলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম। আমার জীবনের প্রথম কাগজ যেখানে আমার নাম লেখা রয়েছে। আমি আন্টি সারাহকে খুশিতে জড়িয়ে ধরলাম আর লন্ডন যাবার আগে বিদায় জানালাম।

কাজের মেয়ে হয়ে লন্ডনে। লন্ডন এয়ারপোর্টে নেমে ড্রাইভার যখন গাড়ী এয়ারপোর্টের বাইরে নিয়ে এলো তখন লন্ডন শহরকে সকালের যানজটে ভরপুর স্বর্ণপুরী বলে মনে হলো। তবে নিজেকে একান্তই একা মনে হলো বিদেশের মাটিতে। চারিপাশে কেবল সাদা তুষারকণা লেগে রয়েছে বিল্ডিং-এর গায়ে। যখন আমরা আংকেল মোহাম্মেদ ফারাহ-এর বাড়ীর সামনে গাড়ী থেকে নামলাম তখন আমি অবাক হয়ে রইলাম। তার বাসভবনটি চারতলা এক বিশাল অট্টালিকা। আমরা সামনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলাম।

আন্টি মরিয়মরা আগেই লন্ডনের এই বিশাল বাসভবনে ছিলেন। তিনি আমাদের অভিবাদন করলেন। তিনি আমাকে ইঙ্গিত করে হাসলেন এবং বললেন-"ভেতরে এসো। শান্তভাবে বললেন দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে এসো।" আমার ইচ্ছা হলো আন্টি মরিয়মনকে জড়িয়ে ধরে খুশী প্রকাশ করি। কিন্তু তিনি পশ্চিমা পরিধানে যে স্টাইলে দাঁড়িয়েছিলেন সে অবস্থায় আমার

সেভাবে শুভেচ্ছা জানানো আর সম্ভব হলো না। তিনি আমাকে বললেন-"এসো তোমার কাজ

বুঝিয়ে দিই।" চুপি চুপি বললাম আন্টি প্লেনে চড়ে এতদূর পথ এসে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

আমি একটু বিশ্রাম চাই। আমি কি একটু ঘুমাতে পারি?

মরিয়ম আন্টি আমাকে তার রুমে নিয়ে গেলেন। রুমটি আমাদের পুরো ঘরের সমান বড়। আমি বিশাল ধবধবে বিছানায় লুটিয়ে পরলাম। জীবনে এত নরম তুলতুলে বিছানায় কি যে স্বর্গীয় অনুভব হয় তা ভাবতে পারিনি। আমি সহসা ঘুমিয়ে পরলাম। মনে হলো আমি কোন এক অন্ধকার সুরঙ্গের ভেতর চলছি। পরের দিন ভোরে জেগে আমি বিস্ময়ে সারা বাড়ী ঘর ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। আন্টি মরিয়ম উঠে আমাকে দেখে বললেন-"ভালোই হয়েছে তুমি তাড়াতাড়ি উঠেছো। এসো তোমাকে রান্নাঘরে তোমার কি কি কাজ করতে হবে বুঝিয়ে দিই। আমি দেখলাম রান্নাঘরটিও বিশাল এবং অতি সুন্দর সিরামিক টাইলস-এ মোড়া। গেওড়া রংঙের ক্যাবিনেট, ছটি গ্যাস বার্নার রান্নাঘরের কেন্দ্রে বিশাল জায়গা দখল করে রয়েছে। আন্টি মরিয়ম ক্যাবিনেটের ড্রয়ার খুলে বললেন-"এই হলো থালাবাসন। কেটলী, বাসন মাজার নাইলেন।" আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

আন্টি মরিয়ম বললেন-"তোমার প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছ'টায় প্রথম কাজ হলো আংকেল মোহাম্মেদ ফারাহকে হারবাল চা দিয়ে দু'টো ডিম পস্ত করে ব্রেকফাস্ট দেয়া। আমি চাই আমার কপিটা দেবে আমার বেড রুমে সকাল সাতটায়। তারপর বাচ্চাদের সকালের খাবার শেষ হলে ঠিক সকাল আটটায় তাদের জন্য তৈরী করতে হবে প্যান কেক। আমি জিজ্ঞেস করলাম আন্টি কে আমাকে শিখাবে এসব জিনিস? আমি তো প্যান কেক কি তাও জানি না। তিনি আমাকে একটা অবাক করার মত জিনিস দেখিয়ে ধীরে ধীরে বললেন-"ওয়ারিশ এদিকে এসো দেখো এবং মন দিয়ে শোন শিখে নাও। দ্বিতীয়বার আমি শিখাতে পারবো না।" আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম।

পরের দিনগুলো রুটিন ধরে আমার জীবন চলতে লাগলো। সারাদিন রুটিন মাফিক ঘরের কাজ করে যেতে হলো পরবর্তী টানা চার বছর ধরে। যে বালিকাটি সময় সম্পর্কে কোনদিন ভাবেনি। মরুভূমিতে পশু পালন করতে গিয়ে টাইম সম্পর্কে যার কোন জ্ঞানই নেই তার পক্ষে ঘরি ধরে চলতে হলো প্রতিনিয়ত। সকালের খাবার শেষে আমি রান্নাঘর পরিস্কার করতাম, তারপর আন্টির শোয়ার ঘর, স্নানের ঘর। তারপর চারতলা ঘরের প্রতিটি রুম এক এক করে ঝাড়ু দিতাম, মুছে নিতাম এবং পলিশিং করে যেতাম। এভাবে কাজ করতে করতে সারাদিন শেষে আমাকে মধ্য রাত অব্দি রুটিন মাফিক কাজ করে যেতে হতো। পুরো চারটি বছর এক নাগাড়ে অবিশ্রান্ত কাজ করে যেতে হলো। একটি দিনের জন্যেও বিশ্রাম পাইনি আমি।

সারা আফ্রিকা জুড়ে দেখা যায় স্বচ্ছল পরিবারগুলো কোন না কোন শিশু তাদের ঘরে নেয়। তারা তাদের শ্রমিক হিসেবে প্রতিনিয়ত খাটায় আর কোন কোন পরিবার লেখাপড়াও শেখায়। তবে এ সংখ্যাটি খুবই কম। আমার আন্টিদের মন মানসিকতাও হয়তো তাই। তারা কোনদিন হয়তো আমার সুখ-দুঃখ সম্পর্কে ভাবেনি। আমার কষ্ট সম্পর্কে কোনদিন অনুভব করেনি। ১৯৮৩ সালের গ্রীস্মের সময় আমার বয়স যখন ১৬ বছর হলো আংকেল মোহাম্মেদর লন্ডন প্রবাসী বোন মারা যায়। সে মারা যাবার পর তার ছোট মেয়ে সফিয়া আমাদের কাছে চলে এলো এবং এই ঘরে থাকতে আরম্ভ করলো।

একদিন ভোরে উঠে যখন সফিকে কাছের স্কুলে দিয়ে কাজ করছিলাম বাইরে তখন এক অচেনা ভদ্রলোক আংকেল মোহাম্মেদের বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়াল। অন্যমনস্ক ও লম্বা চুলওয়ালা সাদা চামড়ার ঐ লোকটির বয়স ৪০ হবে। সে তার মেয়েকে স্কুলে দিতে এসেছে বুঝলাম। সে আমাকে দেখে কি যেন বলল। আমি যেহেতু ইংরেজী বুঝতে ও বলতে পারিনা তাই ভয়ে লজ্জায় দৌড় দিয়ে সফিকে দরজায় ফেলে ভেতরে গেলাম। সে থেকে যতদিন আমি তাকে স্কুলে দেখি ততদিন সে আমার দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসত এবং তার কাজে চলে যেতো। একদিন দেখা হলে সে আমার কাছেই চলে এলো এবং একটা ছোট্ট কাগজের কার্ড হাতে দিল। আমি তার দেয়া কার্ডটি আমার পকেটে রেখে দেখলাম সে চলে গেলো। বাড়ীতে ফিরে আমি আন্টি মরিয়মের এক মেয়েকে কার্ডটা দেখালাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম এর কোন অর্থ আছে কিনা?" সে কাডটি দেখে বলল যে লোকটি একজন ফটোগ্রাফার।

আংকেল মোহাম্মেদের চাকুরী মেয়াদ যখন শেষ হতে চললো একদিন ঘোষণা করলেন তার পুরো ফ্যামিলি সোমালিয়ায় ফিরে যাচ্ছে। আমি মোটেই খুশী হলাম না সোমালিয়ায় ফিরে যাবো এই খবর শুনে। আমি ঘরে ফিরতে চাইলাম বেশিকিছু টাকা নিয়ে সার্থকভাবে। কিন্তু আমার হাতে খুব সামান্যই জমা হয়েছে ততদিনে। আমার স্বপ্ন ছিল অনেক টাকা নিয়ে আমি ফিরে যাবো সোমালিয়ায় আমার মায়ের কাছে। ফিরে মায়ের জন্য একটা বাড়ী কিনে দেবো। এই স্বপ্ন সফল করতে হলে আমাকে থেকে যেতে হবে ইংলন্ডে আরো কিছুটা সময় বেশী রোজগারের জন্য। বেশী অর্থ নিয়ে দেশে ফিরতে হবে আমাকে। কিন্তু কিভাবে থেকে যাবো এই অচেনা দেশে। কোথায় থাকবো? তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমি পারবো। আংকেল মোহাম্মেদ সবাইকে ডেকে বললেন ফিরে যাবার আগে আমাদের সবার পাসপোর্ট যেন ঠিকঠাক থাকে। আমি ঠিক করলাম আমার পাসপোর্ট পলিথিনে মুড়িয়ে বাগানের মাটির ভেতর পুটিয়ে রাখবো এবং যাবার সময় বলবো আমার পাসপোর্ট পাচ্ছি না। কোথাও হারিয়েছি। তারপর তারা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। আমার পাসপোর্ট হারিয়ে যাবার খবর পেলে আংকেল মোহাম্মেদ আমাকে গালাগাল দেবে হয়তো। আমি বলবো আমাকে এখানে রেখে যাও। আমার কিচ্ছু হবেনা। আমি থাকতে পারবো। যেদিন আংকেল মোহাম্মেদের পরিবারটি চলে যাবে সেদিন পর্যন্ত আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে তারা আমাকে সত্যি সত্যি রেখে যাবে একা এই ভিন দেশে। কিন্তু তারা সত্যি আমাকে ফেলে চলে গেলো। আমি তাদের হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালাম। চেয়ে রইলাম যতক্ষণ তাদের গাড়ীটা আমার চোখের আড়াল হল। আমি একা হয়ে ঘরের বাইরে এসে বসে বসে ভাবলাম কিছুক্ষণ। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অজানা আতংক আর অনিশ্চয়তা আমাকে গ্রাস করল। আমি আমার ছোট ডাফেল ব্যাগ কাধে নিলাম বাগান থেকে পার্সপোর্ট মাড়ি খুঁড়ে বের করলাম। বেড়িয়ে এলাম রাস্তায়। হাঁটতে শুরু করলাম অজানা উদ্দেশ্যে লন্ডনের ব্যস্ততম রাস্তায়।

আয়নায় নিজের ছবি: সেদিনই একটা বড় শপিং কমপ্লেক্স-এ ঢুকলাম। দেখলাম এক লম্বা

আফ্রিকান মেয়ে সোয়েটার কিনছে। আমি আগ বাড়িয়ে কথা বললাম। সোমালি ভাষায়। সে খুবই বন্ধুভাবাপন্ন। তার নাম হালাও। আমিও আমার নাম বললাম। সে আমাকে বলল-"হায় ওয়ারিশ কোথায় থাকো তুমি?" উত্তরে আমি বললাম শুনলে অবাক হবে আজ থেকে আমার কোথাও থাকার জায়গা নেই। নেই কোন ঠিকানা। আমি বললাম যে ঘরে আমি থাকি সে ফ্যামিলি আজই সোমালিয়া চলে গেলো। আমার সেই দূর সম্পর্কের আংকেল একজন এ্যামব্যাসেডর। কাজেই তার পরিবর্তে এখন নতুন লোক আসছে তাই আমি এখন কোথায় যাবো জানিনা। আমার সমস্যার কথা শুনে সে অবাক হলো। মনে হলো সে আমার অবস্থা নিয়ে ভাবছে। সে বলল-"ওয়াইএমসিএ হোস্টেলে আমার একটা রুম আছে। তুমি সেখানেই রাতে থাকতে পারো।

এরপর হালা আর আমি ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলাম। কয়েকদিন পর আমি নিজেই ঐ হোস্টেলের একটা রুম নিলাম। আমি চাকরী খুঁজতে শুরু করলাম। কাছের একটি ম্যাকডোনাল্ড রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে হাওলা বলল-"এখানেই চাকরী খুঁজে দেখো না কেন?" কিন্তু আমি যে ইংরেজী বলতে পারি না। তাছাড়া লন্ডনে কাজ করতে যে অনুমতিপত্রের দরকার সেটাও আমার নেই। কিন্তু হাওলার পরিচিত বলে আমি সেখানে কাজ পেয়ে গেলাম। রান্নাঘরের বাসনপত্র মাজা, গ্রিল, ফ্লোর পরিচ্ছন্ন রাখা আমার কাজ। আমি আনন্দের সাথে কাজ করতে লাগলাম। রাত্রে রুমে ফিরি হাসতে হাসতে। আমি মোটামুটি একটা নিশ্চয়তা পেয়ে ভাবলাম আমি এখন অন্তত আত্মনির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে পারবো।

আমি ফ্রি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ কোর্সে ভর্তি হলাম আর রীতিমত ক্লাশে যেতে লাগলাম। ইংরেজী বলা এবং লেখা দুটোই ধীরে ধীরে শিখতে শুরু করি। প্রথম বছর আমার কেবল কাজের মধ্যে কাটল না। কোন কোনদিন হাওলা আমাকে নাইটক্লাবে নিয়ে যেতো। ক্লাবে সবার সাথে মিশতে শুরু করলাম। নিজেকে জোর করে অন্যের সাথে কথা বলাতে চেষ্টা করলাম। সাদা, কালো, ছেলে, মেয়ে সবার সাথে মেলামেশা হতে শুরু হলো। এ নতুন পৃথিবীতে বাঁচতে শিখলাম। আমার জীবন ভালোই কেটে যেতে লাগলো। জীবন যেন দ্রুতই নাটকীয়ভাবে বদলে যাচ্ছিল।

একদিন বিকালে ম্যাকডোনাল্ড থেকে ফিরে আমার পাসপোর্টের সাথে যত্নে রাখা সেই ফটোগ্রাফারের কার্ডটি বের করলাম। হাওলার রুমে চলে গেলাম। তাকে সেই কার্ডটা দেখলাম এবং অতীতের সেই কাহিনী শুনলাম। বললাম আমি আজো জানিনা সেই ভদ্রলোকটি আমাকে কি বলেছিলেন। কি চাইছিলেন আমার কাছে। হাওলা বলল-"ভালোই। তুমি তার সাথে যোগাযোগ কর না কেন?" হাওলাকে বললাম তুমিই বলে দেখো না। আমার ইংলিশ তো খুবই কাঁচা। সে যোগাযোগ করে দিলো। পরের দিন মাইক গর-এর স্টুডিওতে তার সাথে দেখা করতে গেলাম। আমি তার কাছে কি প্রত্যাশায় গেলাম সে বিষয়েও আমার কোন ধারণাই নেই। আমি যখন তার স্টুডিওতে গিয়ে দরজা খুললাম আমার সামনে আরেক পৃথিবী আবিষ্কৃত হল। বিশাল তার হলঘর জুড়ে রয়েছে অতি সুন্দর বড় বড় সব পোষ্টার যে পোষ্টারে রয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত সব মডেল তারকাদের ছবি। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। ভাবলাম এ এক সুযোগ আমার সামনে উপস্থিত। মাইক বলল যেদিন সে আমাকে প্রথম দেখেছে সেদিন সে আমার একটা ছবি তুলতে চাইছিল। আমি ছবিগুলোর দিকে চেয়ে হা করে তাকিয়ে রইলাম। বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলাম তাই না কি? এরকম পোষ্টারের ছবিই বানিয়ে দেবেন আমাকে দিয়ে! তিনি উত্তরে বললেন "হ্যা ঠিক তাই। কারণ তোমার মধ্যেও খুবই সৌন্দর্য্য লুকিয়ে আছে। তুমিও হতে পারো একজন ভালো মডেল।"

দু'দিন পর আবার গেলাম আমি মাইকের স্টুডিওতে। মেকআপ করার জন্য যে মহিলা মাইকের কোম্পানিতে চাকরী করে সে আমার পাশে বসল এবং আমাকে সাজাতে শুরু করল। সে তার তুলো, ব্রাস, স্পঞ্জ, ক্রীম, রং, পাউডার দিয়ে আমার মুখের চামড়ায় কাজ করতে লাগল। অনেকক্ষণ নানাভাবে সাজানোর পর সে আমাকে আয়নার সামনে দিয়ে সে পেছন থেকে দেখে আমার দিকে সন্তুষ্টির সাথে তাকালো। আমি নিজেকে আয়নায় দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমি সত্যিই বদলে গেলাম। আমার মুখের চামড়া সোনালী ও সিল্ক রংয়ের এক অপূর্ব সৌন্দর্য্যে ভরে উঠেছে। মহিলাটি আমাকে মাইকের সামনে নিয়ে গেল। মাইক আমাকে একটা টুলের উপর বসালেন। তিনি বললেন আমি এরকম মডেল অবজেক্ট কখনো দেখিনি। তার ক্যামেরা, ব্যাটারীর আলো সবকিছু তৈরী হলো আমার ছবি নেয়ার জন্য। তিনি বললেন-"ওকে ওয়ারিশ ঠোঁট দুটো বন্ধ করো। চিবুকটা একটু উঁচু করো এবং সোজা হয়ে বসে থাকো। বেশ এটাই সুন্দর।"

অতঃপর আমি শুনতে পেলাম ক্যামেরার ক্লিক শব্দ। আকস্মিক লাইট জ্বলে উঠল। আমিও চমকে উঠলাম। ক্যামেরার ফ্লাড লাইট আমার চেহারায় পরে নিজেকে অন্য রকম সুন্দর মনে হলো। মাইক ক্যামেরা থেকে একটা শক্ত কাগজ বের করল এবং সে কাগজের উপরের অংশ তুলে নিয়ে আমাকে দেখালো। আমি দেখলাম ম্যাজিকের মতোই কাগজে ভেসে উঠল আমার অন্যরকম অপূর্ব সুন্দর ছবি। আমি নিজেকে খুব কষ্টে চিনতে পারলাম। ক্যামেরা আমাকে এমনভাবে অদ্ভূত গ্লামার দিয়ে তৈরী করল যা আমি কখনো ভাবিনি। একজন কাজের মেয়ে ওয়ারিশ থেকে আমি এখন ওয়ারিশ মডেল হয়ে আভির্ভূত হলাম।

স্বাগতম সার্জারী: কিছুদিন পর মডেলিং এজেন্সির এক ভদ্রমহিলা আমার ফটো দেখে আমাকে একটি জব কাস্টিং-এর জন্য পাঠালেন। তিনি কি বলছিলেন আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভদ্রমহিলা আমাকে ট্যাক্সির পয়সা দিলেন এবং আমি নির্দিষ্ট ঠিকানায় গেলাম। গিয়ে দেখি সব পেশাদারী মডেলরা ভীড় করেছে। যেন সিংহির দল শিকারের নেশায় জড়ো হয়েছে। আমি  ভীড়ের মধ্যে গিয়ে একজনকে হ্যালো বললাম। আমি বললাম এখানে কাজটা কি? "পাইরেলী ক্যালেন্ডার" তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আশ্চর্য হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম ওটা আবার কি?

ফটোগ্রাফার টেরেন্স ডনোভ্যান আমার জন্য চা নিয়ে এলেন এবং একটা টেবিলের উপর অনেক সুদৃশ্য ক্যালেন্ডার রেখে তার কাজগুলো দেখাতে লাগলেন। এক এক করে সব বিখ্যাত গ্লামারোয়াস মডেলদের নিয়ে তোলা সব নানা ধরনের ছবি দেখাতে লাগলেন। বললেন-"এটা গত বছরের পাইরেলী ক্যালেন্ডার।" কিন্তু এ বছরেরটা অন্য রকম হবে। ঠিক আফ্রিকান মেয়ের ছবি দিয়ে হবে। তিনি আমাকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন। এরপর আমি কিছুটা আশ্বস্থ হলাম। আমাকে নিয়ে তোলা হল মডেল ছবি। আমি যেন সত্যি সত্যি পেশাদারী মডেল হয়ে গেলাম। আমার ছবি নিয়েই সে বছর ক্যালেন্ডার কভার হলো। মডেল হিসেবে আমার ক্যারিয়ার দিন দিন বাড়তে লাগল। আমি ফ্রান্সের প্যারিস, ইটালীর মিলান, আমেরিকার ইউইয়র্ক-এ কাজ করতে লাগলাম। আমার আয় অনেক বেড়ে গেলো। অনেক অনেক টাকা জমা হলো। আমি প্রতিনিয়ত বাণিজ্যিক পণ্য যেমন, অলংকার, ফ্যাশান, আফ্রিকান পরিধান ইত্যাদিতে এডভ্যাটাইজিং মডেলিং করতে লাগলাম। বিখ্যাত রেভলন কোম্পানির সামগ্রীতে বিজ্ঞাপনে মডেল করা হলো। পরে তাদের নতুন সামগ্রী পারফিউম 'এজিই'তে বিজ্ঞাপন করা হলো। বিজ্ঞানের ভাষাটি ছিল-" আফ্রিকার হৃদয় থেকে বেড়িয়ে আসা সুগন্ধী যা সব মহিলার হৃদয়কে আলোড়িত করেছে।"

রেভলন কোম্পানির 'সিন্ডি ক্রাফোর্ট', 'ক্লাওদিয়া সাইফার' এবং 'লাউরেন হাটন' প্রভৃতি বিশ্ব বিখ্যাত পণ্যে আমার ছবি বিজ্ঞাপন আকারে বেরুল। পরে পরে আমেরিকা ও ব্রিটেনের বড় বড় ফ্যাশান ম্যাগাজিন-'ইলে', 'গ্লামার', 'ইটালিয়ান ভ্যাগ' ইত্যাদিতে আমার ছবি ছাপা হতে লাগলো। আমার নতুন জীবনে যতই সাফল্য ও সুনাম অর্জন করি না কেন আমি পুরনো সেই ক্ষত বয়ে বেড়াতে লাগলাম। যৌনাঙ্গের সেই ছিদ্র দিয়ে আমি এক একবার কেবল একটা ড্রপ প্রস্রাব করতে পারতাম। একেক বার প্রস্রাব করতে আমার প্রায় ১০ মিনিট সময় লাগত। আমার মেনেস্ট্রেশন সময়টা আমার জন্য এক ভয়াবহ সময়। প্রতি মাসেই ঐ সময়টাতে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতাম দু'তিনদিন। আমি কষ্টে শুধু প্রার্থনা করে যেতাম আমি যেন মরে যাই। যখন থেকে আংকেল মোহাম্মেদ-এর ফ্যামিলির সাথে থাকতাম এ সমস্যাটার তীব্রতা বেড়ে গিয়েছিল। একদিন সকালে রান্নাঘর থেকে ট্রে নিয়ে আসার সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। সব প্লেট ভেঙে গেলো সেদিন। আন্টি মরিয়মকে ঘটনাটি যখন বললাম তখন তিনি বললেন-"তোমাকে ডাক্তারের কাছেই নিতে হবে। আমি আজই সন্ধে বেলায় এপয়েন্টমেন্ট করে দিচ্ছি।"

ডাক্তারকে আমি আমার যৌনাগ্রচ্ছেদের ক্ষত সম্পর্কে কিছুই বলতে পারলাম না। যেহেতু ডাক্তার আমাকে কোন পরীক্ষা করলেন না তাই তিনি আমার গোপনাঙ্গের ক্ষত জানতে পারলেন না এবং তিনি বললেন-"আমি শুধু একটি কাজ করতে পারি আর তা হল আমি তোমাকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি দিতে পারি। এই বড়ি তোমার যন্ত্রণা কমাবে।" আমি টেবলেট খেতে শুরু করলাম। এতে আমি শরীরে অস্বাভাবিক পরিবর্তন এলো। আমি বুঝতে পারলাম আমি অন্যরকম হয়ে যাচ্ছি। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। ভাবলাম আমি বরং এর চাইতে কষ্টকে সহ্য করে যাই। টেবলেট খাওয়া বন্ধ করলাম। আমার যন্ত্রণা আগের চেয়ে আরো বেড়ে গেল। পরে আমি আরো কয়েকজন ডাক্তারের সাথে দেখা করলাম। তারাও আমাকে সেই বার্ট কন্ট্রোল পিল দিল। আমি ভাবলাম আামার অন্য কিছু করতে হবে। আমি আমার বন্ধু 'আনটিএ' কে বললাম বিষয়টা। সে আমাকে ভালোভাবে দেখে নিল। বলল-"তুমি ডাক্তারকে এসব কিছু বলছো নাকি?" বললাম না। আমি শুধু বলেছি আমার যন্ত্রণা হয়। আমি তা বন্ধ করে দিতে চাই। সে বলল-"লিঙ্গাগ্রচ্ছেদ আমাদের আফ্রিকান দেশের সমাজের নিয়ম। একথা এসব সাদা চামড়ার লোকদের বলতে নেই।"

যাই হোক, আমি বুঝতে পারলাম যে আমাকে সয়ে যেতে হবে নতুবা অন্য কিছু করতে হবে। না হলে মাসের তিনভাগের একভাগ সময় আমাকে যন্ত্রণার সাথে জীবন কাটাতে হবে। আমি ডাক্তার আপনার কাছে এলাম। আমি সেদিন একটা কথা বলতে পারিনি। আমি এক সোমালিয়ান নারী। কাজেই আমাদের....! তিনি আমার কথাই শুনলেন না পুরোপুরি। তিনি বললেন-"চল তোমাকে দেখি।" সে আমার হতবিহ্বল চেহারা দেখে বুঝতে পারলেন হয়তো। বললেন-"ঠিক আছে।" তিনি এক নার্স ডেকে আনলেন এবং হসপিটালে এমন কাউকে ডাকতে বললেন যে সোমালি ভাষা বুঝতে পারে। কিন্তু নার্স ফিরে নিয়ে এলেন এক সোমালি পুরুষ। মনে মনে বললাম-আমার ভাগ্যটাই খারাপ। এই সোমালি পুরুষের সামনে আমার যৌনাগ্রচ্ছেদের কথা বললে যে কি ভয়ানক কিছু হবে তা কাকে বোঝাই।

ডাক্তার ম্যাকরেস সোমালি ভদ্রলোককে বললেন-"এই মহিলাকে বুঝিয়ে দাও। সে খুব চাপা স্বভাবের। আমি অবাক হচ্ছি এতদিন সে কিভাবে এই কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের তাকে অপারেশন করাতে হবে। দেখলাম সোমালি ভদ্রলোক খুশী ভাব দেখালো না। সে তীর্যকভাবে ডাক্তারকে দেখে নিলো এবং আমাকে বললো-"ভালো। যদি তুমি সত্যি তা চাও তাহলে এরা তোমাকে উলঙ্গ করবে এবং অপারেশন করবে। কিন্তু তুমি কি জান যে, এটা তোমার সামাজিক রীতির বিরুদ্ধে? তোমার পরিবার কি জানে তুমি এটা করতে যাচ্ছো? বললাম না। "তাহলে আমি বলবো তুমি প্রথমে তাদের সাথে আলাপ করো।" আমি মাথা নাড়ালাম। সে কি আর বলবে। সেও তো আফ্রিকান পুরুষ।

বছর খানেক হয়ে গেলো আমি সার্জারী করেছি। অবশেষে আমি সত্যি কষ্ট থেকে মুক্ত হয়ে উঠেছি। ডাক্তার ম্যাকরেস-এর কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ। তিনি বললেন-"তুমি একা নও। অনেক মহিলা এ সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসে। বিশেষত: বেশী মহিলা আসে সুদান, মিশর, সোমালিয়া থেকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ থাকে গর্ভবতী এবং চরম খারাপ অবস্থায়। তারা অনেকেই তাদের স্বামীর অনুমতি না নিয়ে আসে। আমি আমার সাধ্যমত তাদের সাহায্য করি। আমার অপারেশনের তিন সপ্তাহ পর আমি বার্টরুমে স্বচ্ছন্দে বসতে পারি। আমি সত্যি ভালো হয়ে গেলাম। এ সুস্থ হওয়ার স্বাধীনতায় কি সুখ তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।

ব্যাক টু সোমালিয়া: ১৯৯৫ সালে বিবিসি আমার জীবন নিয়ে একজন সুপার মডেল হিসেবে একটি ডকুমেন্টারী করার জন্য প্রস্তাব দেয়। আমি ডাইরেক্টর 'গ্রে পোমারয়কে একটি শর্ত দিলাম। আমি রাজি তবে কিনা আমাকে সোমায়িলায় নিয়ে যেতে হবে। আমার প্রিয় মাকে আমি দেখতে চাই। আমার মাকে মরুভূমিতে খুঁজে বের করতে আমাকে সাহায্য করতে হবে। ডাইরেক্টরী রাজী হলেন।

বিবিসি স্টাফরা আফ্রিকার সোমালিয়া মরুভূমিতে আমার মাকে খুঁজতে শুরু করে দিলো। আমাকে ম্যাপ দিয়ে দেখিয়ে দিতে বলা হলো কোথায় থাকতো আমাদের পশুপালনকারী গরীব পরিবারটি। আমাদের পরিবারের গোত্রের নাম, সোমালিয়ার কোন কোন অঞ্চলে থাকতে পারে তার সম্ভাব্য হদিস দিতে হলো। বিবিসি স্টাফদের চিরুনী তল্লাসী চালাতে গিয়ে অনেক সোমালি মহিলা আমার মা দাবী করে বসল। কিন্তু তাদের মধ্যে আমরা মা নেই। বিবিসি ডাইরেক্টর গ্রে একটি আইডিয়া নিয়ে এলেন। "আমাদের এমন কিছু গোপনীয় জিনিস চাই যা কেবল তোমার মা ও বাবা জানে তোমার সম্পর্কে।" আমি বললাম ভালো কথা। আমার মা আমাকে 'এবডোহল'এর ডাক নামে ডাকে। "তিনি কি সেই অনেক দিনের নাম মনে রাখবেন? আমি বললাম অবশ্যই। সে থেকেই 'এবডোহল' নামটি পাসওয়ার্ড হিসেবে কাজে লাগলো। বিবিসি স্টাফরা যখন কোন মহিলার ইন্টারভিউ নিতো তখন দু' একটি প্রশ্নের পর ঐ প্রশ্নটি করতো অর্থাৎ মেয়েটিকে তিনি কি ডাক নামে ডাকেন।

অনেক অনেক দিন পর বিবিসি আমাকে ডেকে পাঠালেন। তারা বললেন-"আমরা সম্ভবত তোমার মাকে খুঁজে পেয়েছি। এই মহিলাটি কেবল ডাক নামটি বলতে পারে না। তবে তার নাকি ওয়ারিশ নামে একটি মেয়ে ছিল। সেই মেয়েটি লন্ডনে এ্যামব্যাসাডর-এর বাড়ীতে কাজ করে।" কয়েকদিন পর আমরা রওনা হলাম ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিসআবাবা। সেখানে চাটার্ড প্লেনে চড়ে চলে গেলাম গ্লাডিয়া যেখানে সোমালিয়া থেকে জাতিদাঙ্গায় পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীরা ক্যাম্পে জড়ো হয়েছে। আমি বালুর মধ্যে সেই ফেলে আসা অতীতের গন্ধ ও গরম অনুভব করতে লাগলাম। আমি সেই শিশু ও কৈশোরের সেই দিনগুলোতে হারিয়ে গেলাম। সেদিনের সব ছোট ছোট স্মৃতিরা আমার মনে ভীড় জমাতে লাগল এবং আমাকে হাতছানি দিয়ে পিছু ডাকতে লাগল। আমি দৌড়তে শুরু করলাম। আমি বালুতে লুটিয়ে পড়লাম আর খেলতে ইচ্ছে হলো বালুতে গড়াগড়ি দিয়ে। আমি মরুভূমির গাছ ছুঁয়ে যেতে লাগলাম। গাছগুলি খুবই ময়লা ও শুকনো। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে শীঘ্রই বৃষ্টি আসবে। মরুভূমিতে বৃষ্টির সময় হয়ে এসেছে তখন। আর বৃষ্টি হলেই ফুটবে নানা ফুল। আমরা দেখলাম যে মহিলাটি আমার মা বলে দাবী করছিল সে আদতে আমার মা নন। আমরা ঐ গ্রামে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। একদিন এক বৃদ্ধ এসে আমাকে বললো-"আমাকে চিনতে পারছো? না। "আমি ইসমাইল। আমি তোমার বাবার একই গোত্রের। আমি তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে।" আমি তাকে চিনতে পারলাম না বলে কিছুটা লজ্জা পেলাম। কারণ ছোট বেলার সব প্রতিবেশীর কথা কি আর মনে থাকে? সে বলল-"আমি জানি তোমার পরিবারটি কোথায় আছে। আমি তোমার মা বাবার খোঁজ দিতে পারবো। তবে আমাকে গাড়ীর তেলের জন্য পয়সা দিতে হবে।" বিবিসি স্টাফরা রাজী হলেন এবং কিছু নগদ টাকা দিলেন। সে একরাশ বালির ধোঁয়া ছেড়ে তার ট্রাক নিয়ে উধাও হয়ে গেলো। তিন দিন কেটে গেল। মা-এর কোন খবর পাওয়া গেল না। যে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। আমি বললাম আমার মা ঠিকই কালকের মধ্যে চলে আসবে আশা করি। আমি তাকে বললাম কাল বিকাল ছ'টার মধ্যে মা পৌছে যাবেন। আমি জানিনা কেন আমার সেরকম এনে হচ্ছিল। পরের দিন গ্রে বিকাল ছটা নাগাদ সত্যি সত্যি সুখবর নিয়ে এলো। সে বললো-"সে লোকটা সত্যি ফিরে এসেছে। এবং সে তোমার মাকে নিয়ে এসেছে। সে বলল এটাই তোমার মা।"

আমি দেখলাম ইসমাইলের গাড়ীর সম্মুখে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। সে মাথায় স্কার্ফ দিয়ে লজ্জাবনতভাবে দাঁড়িয়েছিল। তবে আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এই আমার মা। আমি দৌড়ে গেলাম। ডাকলাম মা মা। আমি আনন্দে মা কে জড়িয়ে ধরলাম। সেও আমাকে আদরে জড়িয়ে ধরলো আর কাঁদতে লাগল। আমরা কোন কথাই বলতে পারলাম না প্রথম প্রথম। মা বললেন- "আমাকে যখন ইসমাইল আনতে যায় তখন তোমার বাবা জল সংগ্রহের জন্য বেড়িয়েছেন। তোমার বাবা অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন। চোখে এখন কম দেখেন। তার একটা চশমা খুব প্রয়োজন।"

আমার ছোট ভাই আলীও মায়ের সাথে এসেছে। সাথে এক কাকাও। আমি ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম। আদর করতে চাইলাম। সে বলল সরে যাও আমি ছোট নই আর। আমি যে কদিন পর বিয়ে করতে যাচ্ছি। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম বিয়ে? কত হলো তোমার? সে বলল-"কত বছর তো বলতে পারবো না তবে বিয়ে করার জন্য যথেষ্ট বয়স আমার হয়েছে।"

রাত্রে মা ঘুমালেন গালাডিয়ার এক পরিবারের ছোট ঘরে। আমি আর আলী ঘুমালাম ঘরের বাইরে বালুর উপর। ঠিক সেই ছোট্ট বেলায় রাতে যেভাবে থাকতাম সেভাবে। আমি গভীর শান্তি ও প্রচন্ড সুখ অনুভব করলাম। আমার ভাই আলী নানা কিছু জিজ্ঞেস করতে লাগল। এতদিন কোথায় ছিলাম? কেমন ছিলাম? এখন কি করি? মরুভূমির ঘরে ফিরে যাবো কিনা? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। আমি উত্তরে বললাম ভাই সব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে আমি অনেক কিছু দেখেছি। অনেক কিছু শিখেছি। আমি জানি আদৌ মরুভূমির ঝোঁপ ঝাড়ে থাকতে কখনো ফিরবো কিনা। কিন্তু এসব কথা মা ও ভাইকে তেমন প্রভাবিত করতে পারল বলে মনে হলো না। তাদের ভাবনা আর আমার ভাবনার মধ্যে আজ যেন অনেক অনেক ব্যবধান। আমি মার সাথে বেশী আর যুক্তিতর্ক করতে পারলাম না। সে প্রশ্ন করল-" তুমি আজো কেন বিয়ে করোনি?" বললাম মা আমাকে কি বিয়েই করতে হবে? তুমি কি আমাকে একজন সফল ও স্বাবলম্বী নারী হিসেবে দেখতে চাওনা? মা বললেন-"তা ঠিক। কিন্তু আমি তো নাতির চেহারা দেখতে চাই মা।"

গ্রে আমার অনেক ছবি নিলেন আমার মায়ের সাথে। কিন্তু মা বার বার মুখ লুকাচ্ছিলেন। আমি আর মা দুজনেই হাসছিলাম। মা বরাবরই লজ্জাবতী নারী। তাই সে ক্যামেরার সামনে থাকতে চান না। ক্যামেরা হাতে নিয়ে গ্রে জিজ্ঞেস করলেন-"তোমার মা কি বলতে চান?" আমি বললাম কিছু না। পরদিন প্লেন যখন আমাদের নিতে আসলো আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কি মরুভূমিতে ফিরে যাবেন না আমার সাথে ইংল্যন্ডে বা আমেরিকায় থাকতে চান। মা বললেন-"সেখানে আমি কি করবো?" আমি মাকে বুঝালাম তোমার আর কাজ করে কষ্টে জীবন কাটানোর প্রয়োজন নেই। তোমার এখন বিশ্রাম নেয়া উচিৎ। মা বললেন-"না তোমার বাবা দিন দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। আমাকে তার খুব প্রয়োজন। তাছাড়া আমি কেবল কোথাও বসে বসে থাকতে পারবো না। তুমি যদি চাও তো সোমালিয়ার কোথাও একটা জায়গা দাও যেখানে আমি ক্লান্ত হলে যেতে পারবো বিশ্রামের জন্য। এটাই আমার ঘর। এটাই আমি চিরকাল ধরে জানি চিনি।" আমি বললাম মা আমি তোমার জন্য একটা বিরাট জায়গায় বাড়ী করে দিচ্ছি। আমি তোমায় ভালোবাসি মা। আমি তোমার জন্য আবার ফিরে আসবো এ মরুভূমিতে। যে মরুভুমিতে বৃষ্টির পর ওয়ারিশ ফুল ফোটে সে মাতৃভূমিতে আমাকে বার বার ফিরতে হবে। আমার ফিরতে হবে তোমার ভালোবাসার টানে একথা ভুলে যেও না মা।

আমার মিশন: ইতিমধ্যে আমার জীবন আরো বদলে গেছে। আমি বাণিজ্যিক মিউজিক ভিডিওতে, ফ্যাশন ব্যবসার বড় বড় ফটোগ্রাফারদের সাথে কাজ করতে লাগলাম। আমার জীবন স্বর্গীয় সুখে ভরে গেল। আমি মাকে বলেছিলাম আমি আমার মনের মত মানুষ পাচ্ছি না বলে বিয়ে করছি না। অনেক পরে ১৯৯৫ সালের বসন্তের সময় নিউইয়র্ক-এর এক নাইট ক্লাবে এক পুরুষ বন্ধুর দেখা পেলাম। সে ছিল একজন ড্রাম বাদক। তার নাম ডানা মুরে। যেদিন তাকে আমি দেখলাম সেদিন থেকে ভাবতে লাগলাম এই বুঝি আমার স্বপ্নের পুরুষ। পরের একদিন রাত ক্লাবে আমি তার সাথে হাসলাম বললাম-কোন একদিন আমি তোমার বাচ্চা পেতে চাই। জীবনের প্রথম আমি একজন পুরুষকে কামনা করলাম। ক'দিন বাদে আমরা দু'জন একে অন্যকে ভালোবাসতে শুরু করলাম। জীবনের বাকী সময়টা আমরা দু'জনে এক সাথে কাটিয়ে দিতে চাইলাম। আমার ছোট্ট সুন্দর স্বপ্নের ফানুস উড়ে এল একদিন। ১৯৯৭ সালের ১৩ই জুন আমাদের একটি ফুটফুটে সন্তান হল। সে খুবই সুন্দর, সিল্কি ব্ল‍্যাক রং এর তার চুল, লম্বা তার পা আর আঙ্গুল। আমি তার নাম রাখলাম 'এলেকে'। তার ছোট্ট মুখ, নরম চিবুক আর উজ্জ্বল গোলাকার মুখাবয়ব দেখতে ঠিক একজন অতি সুন্দর কালো মানুষের প্রতিচ্ছবি।

যেদিন এ শিশুর জন্ম হলো আমার জীবন আরো বদলে গেল। যত সুখ আর খুশী যেন আমি সব তার থেকে পেতে শুরু করলাম। জীবন যেন জীবনেরই উপহার। অতীতের নানা ঘটনা আমাকে বার বার নাড়া দিয়ে যায়। আমি উল্লসিত হয়ে উঠি একা একা সে সব মধুমাখা স্মৃতি যখন আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। শিশু বয়সের সেই অনিয়মিত মেনেস্ট্রেশন সাইকেল আমার পুরো ভালো হলো ছেলে জন্মদানের পর থেকে। আমি এখন মুক্ত স্বাধীন একজন নারী। মায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা 'ক্রমে গভীর থেকে গভী হল। আমার মা বুঝতেন একজন যৌনাগ্রচ্ছেদগ্রস্ত সোমালিয়ান নারীর সারা জীবন কি কষ্ট ভোগ করতে হয়। ভাবতে থাকি একজন নারীর সেই মরুভূমিতে পশু চড়াতে গিয়ে বহু বহু দূর যখন জলের সন্ধানে বেড়াতে হয় তখন তার কি যন্ত্রণা। বিশেষত মেনেস্ট্রেশনের সময়টায় যখন সে নারী দাঁড়াতেই পারে না কষ্টের জন্য সে নারী কি নির্মমভাবে সহে যাচ্ছে। যে নারী নয় মাসের গর্ভবর্তী সে যখন

মরুভূমির গরম বালুতে ছেলে মেয়েদের খাবার যোগাতে গিয়ে মাইলের পর মাইলকে সেই অপারেশন করা কষ্ট নিয়ে তার যে কি ভয়াবহ যন্ত্রণা তা সে ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। যে নারী শিশুর যৌনাঙ্গ কেটে সুই সুতা দিয়ে বেঁধে রাখা হয় তার ভাবী স্বামীর জন্য যতদিন সে বিয়ে করবে। যে নারী ইতিমধ্যে শিশু সন্তান জন্ম দিয়ে সীমাহীন যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। আমার মায়ের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যা ঘটে যাচ্ছে। তাদের যে কি বেদনা তা সত্যিই বর্ণনার অতীত। আমি একদিন অনুভব করলাম এই লাখো নারীর জন্য কিছু আমার করতে হবে।

একদিন লওরা জীব নামের এক ফ্যাশন ম্যাগাজিনের লেখিকা আমার কাছে আসলেন আমার ইন্টারভিউ নিতে। আমার তাকে ভালো লাগল। আমি তাকে বললাম ফ্যাশান মডেল নিয়ে তো অনেক কিছুই লেখা হলো। যদি তুমি ছাপাতে চাও আমি নিজের জীবনের একটা সত্যি কাহিনী বলতে পারি। সে বলল-"খুব ভাল। আমি চেষ্টা করবো।" সে তার টেপ রেকর্ডার অন করল। আমি তাকে বলতে শুরু করলাম আমার শিশু বয়সের যৌনাগ্রচ্ছেদের ঘটনা থেকে। আমি আমার পীড়াদায়ক সে কাহিনী বলতে বলতে এক সময় সে কেঁদে ফেলল। টেপ রেকর্ডার অফ করে দিল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল-"এটা সত্যি একটি নির্মম সত্য ঘটনা। অতি কষ্টের এবং ঘৃণ্য ঘটনা। আমি কখনো বিশ্বাস করতে পারি না যে আজো পৃথিবীর বুকে এরকম ঘটনা ঘটে চলেছে।"

আমি বললাম এটাই হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে আফ্রিকার মরুপ্রান্তরে। ইন্টারভিউ দেয়ার পরদিন আমি খুব বিষন্ন মনে কাটালাম। কিছুটা লজ্জাবোধ করতে লাগলাম কারণ প্রত্যেক এখন আমার গোপন বিষয়টা জেনে যাবে। আমার স্বামী আমাকে দেখে অবাক হয়ে রইলেন। সেই মরুভূমিতে ফেলে আসা আমার শৈশবের বন্ধুদের কথা স্মরণ হলো। সেই শিশু কন্যারাও আজ আফ্রিকার নানা জায়গায় বয়ে বেড়াচ্ছে তাদের যন্ত্রণা। তারা কেউ কোনদিন হয়তো তাদের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারবে না আমি যেভাবে বললাম। সে কাহিনী আজ আমি লক্ষ মানুষকে বলে বেড়াচ্ছি। দ্বিতীয়ত আমি পৃথিবীর মানুষদের জানাতে চাই যে আফ্রিকান দেশগুলোতে এ প্রথা আজো প্রচলিত। আফ্রিকান সোমালিয়ায় আজো লক্ষ্য নারী কষ্ট ভোগ করে যাচ্ছে। অনেক অনেক মরেও যাচ্ছে।

ম্যাগাজিনে আমার ইন্টারভিউ যখন বেরুল মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হল অভাবনীয়। ম্যাগাজিনের অফিস ভর্তি হয়ে গিয়েছিল পাঠকদের হাজার হাজার চিঠিতে। আমাকে আরো অনেক পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে ইন্টারভিউ দিতে হলো। বিভিন্ন ক্লাবে, কমিউনিটি হলে আমার ডাক এলো লেকচার দেয়ার জন্য আমার জীবনের হৃদয় বিদারক কাহিনী সম্পর্কে।

১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রসংঘের জনসংখ্যা তহবিল থেকে নিমন্ত্রণ করা হলো আমি যেন নারীদের এই যৌনাগ্রচ্ছেদের বিরুদ্ধে কাজ করি। ওয়ার্ল্ড হেল্ট অর্গানাইজেশন বা হু (WHO) থেকে অনেক করুণ কাহিনী প্রকাশ হতে শুরু করলো। আমি আরো জানলাম যে 'ফিমেল জেনিটাল মালটিলেশন' নামের এ কাজটি আফ্রিকা মহাদেশের ১৮টি দেশে আজো একটি প্রচলিত সামাজিক রীতি।

রাষ্ট্রসংঘের হিসেব অনুযায়ী এযাবৎ এক কোটি তিরিশ লক্ষ্য আফ্রিকান নারীর যৌনাঙ্গে এরকম ঘৃণ্য অত্যাচার করা হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় দুই লক্ষ নারী মৃত্যুর আশংকা নিয়ে জন্মায় এ পৃথিবীর বুকে। যৌনাগ্রচ্ছেদের কাজটা আজো করা হয় গ্রামের অশিক্ষিত বৃদ্ধ মেয়েদের দ্বারা। যারা ছুরি, ব্লেড এমনকি কোন কোন সময় ধারালো পাথর দিয়ে কেটে দেয়। তারা কোন সময় জীবাণু নাশক ব্যবহার করেনা।

সোমালিয়ার শতকরা আশি ভাগ নারীদের এই সামাজিক প্রথার শিকার হতে হয়। এমনভাবে যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা হয় যাতে কোন নারী জীবনে যৌনসুখ ভোগ করতে না পারে। এ প্রথা একটি অতি আদিম রীতি। যখন ভাবী আমার মত লক্ষকোটি আফ্রিকান নারী শিশুর উপর এ কাজটা করা হচ্ছে তখন আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়। আমি আক্রোশে জ্বলে উঠি।

আজ আমার গর্ব এই যে রাষ্ট্রসংঘ আমাকে এই 'ফিমেল জেনিটাল মালটিলেশন' বন্ধের জন্য বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ করেছে। আমি আজো আফ্রিকায় বার বার ফিরে যাই এবং আমার করুণ কাহিনী শুনাই। এ জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে কথা বলি নির্দ্ধিধায়।

আমি কেবল প্রার্থনা করি এমন একদিন আসুক যেদিন কোন নারী যাতে এ মর্মান্তিক যন্ত্রণার শিকার না হয়। এই 'ফিমেল জেনিটাল মালটিলেশন' ইতিহাসের আস্তাকুড়ে পড়ে থাক। এ লক্ষ্যে আমি এখন নিজেকে নিবেদিত করেছি। মনে পড়ে সেই দিনের সেই সিংহের ঘটনা। আমি যেদিন পালিয়ে যাচ্ছিলাম মরুভূমিতে সেই সিংহের পেটে আমি নিশ্চয় যেতে পারতাম সেদিন। কিন্তু না ঈশ্বর হয়তো সেদিন সেই সিংহের করালগ্রাস থেকে আমাকে বাঁচিয়েছেন। ঈশ্বরের হয়তো আমাকে নিয়ে একটা পরিকল্পনা ছিল। যার কারণে তিনি আমাকে সেদিন বাঁচিয়েছিলেন। আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বর বুঝি আমাকে সেই দায়িত্ব দিয়েছেন। এটাই আজ আমার একান্ত কামনা ও লক্ষ্য। আমি জানি আমার কর্মক্ষেত্র খুবই কণ্টকাকীর্ণ এবং । সমস্যাসংকুল। এ কাজটি বিপদজনকও বটে। কিন্তু আমি নিজেকে এখন উৎসর্গ করে দিয়েছি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি এই অঙ্গীকার নিয়ে বাঁচতে চাই।

 



[i] আফ্রিকার এই নারীর বেদনাময় অতীত উজ্জল বর্তমান পড়েছি রীডার ডাইজেস্ট-এ। তার মর্মস্পর্শী কাহিনী পড়তে পড়তে শিহরণ জাগে। মরুভূমির অযত্নে লালিত পশু চড়ানো আফ্রিকান বালিকা অবশেষে কিভাবে রাষ্ট্রসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে এখন লাখো আফ্রিকান নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন তারই বিবরণ পাওয়া যায় এই কাহিনীতে।- অনুবাদক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...