বৃহস্পতিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৩

রক্তাক্ত ১০ই নভেম্বর


সেই এক হৃদয় বিদারক, বিভীষিকাময় ঘটনা, উদ্বেলিত হৃদয়ের রক্তকণিকা খসে পড়া একটি মুহুর্ত…।

অসংখ্য তারকাখচিত উদার আকাশ থেকে হঠাৎ যদি কোন উল্কাপিণ্ড খসে পড়ে মানুষের চমক লাগার মত কিছুই নয়; কিন্তু উজ্জ্বল শশীকলার আলোর বন্যায় যদি রাহুগ্রাসে হঠাৎ বিষাদের কালো ছায়া নামে তাহলে সারা দুনিয়ার মানুষ ব্যথিত ব্যাকুল ও হতচকিত না হয়ে পারে না।

বিশ্বের বিভিন্ন জাতির ইতিহাসে যেমনি রয়েছে সেই অতি শোকাবহ ও বিষাদের কালো দিন, তেমনি রয়েছে আমাদেরও।

জাতীয় অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে আমরাও জুম্ম জনগণ করে যাচ্ছি প্রতিবাদ, পাশবিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম আর ষড়যন্ত্র ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছি প্রতিরোধ।

তাই স্বভাবতই যাবতীয় অত্যাচারী শক্তি ও ষড়যন্ত্রকারী ভণ্ডামীই হয়েছে আমাদের শত্রু। সেই ভণ্ড শত্রুদেরই বিষাক্ত নখের আঁচড়-জাতীয় ইতিহাসের সব চাইতে জঘন্যতম, ঘৃণ্যতম ১০ নভেম্বর – যা গোটা বিশ্বকে করেছে হতবাক আর জুম্ম জাতি হয়েছে সান্ত্বনাহীন ব্যথিত ও শোকাভিভূত।

জুম্ম জাতির ইতিহাসে গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র (গিরি – ভবতোষ দেওয়ান, প্রকাশ – প্রীতি কুমার চাকমা, দেবেন-দেবজ্যোতি চাকমা ও পলাশ – ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান) একটি কলঙ্ক ও একটি জঘন্যতম ষড়যন্ত্র। অতি শোকাবহ ও মর্মান্তিক ১০ নভেম্বর-এর কালো দিবসের স্মৃতি রোমন্থনের পূর্বাহ্নে জুম্ম জাতির কুলাঙ্গার গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের হীন চরিত্র ও উদ্দেশ্য উন্মোচন করা অপরিহার্য।

গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র যদিও দীর্ঘদিন যাবৎ পার্টির পতাকাতলে সমবেত হয়ে কাজ করেছে তথাপি পার্টি নেতৃত্বকে কখনই মেনে নিতে পারেনি।

দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতালিপ্সা, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, ব্যভিচার, উচ্চাভিলাষ এদের স্বভাব চরিত্রে মজ্জাগত ছিল।

অথচ এই কুচক্রীরা শ্রদ্ধেয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে পশ্চাতে ও সঙ্গোপনে অনেক বিরূপ মন্তব্য ও অপপ্রচার যেমন কখনও বলতো ধর্মভীরু, কখনও বা আপোসপন্থী, কখনও বলতো একরোখা, সর্বোপরি তার একনিষ্ঠ ও যোগ্যতর সহকর্মীদের বিশেষত সন্তু লারমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও কুৎসা রটনা করতে বরাবরই প্রয়াসী ছিল। সমগ্র পার্টিতে একটা প্রভাব বিস্তারের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।

কিন্তু সামনাসামনি কোন মন্তব্য করার সৎসাহস কারোর ছিল না।

পক্ষান্তরে তারাই উপযুক্ত, তারাই সবজান্তা, তারাই জুম্ম জাতির জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে দাবি করতো নির্লজ্জভাবে। তাই এই নেতত্বকে তারা বিষাক্ত আগাছা বলেই মনে করতো। এ কারণে তারা এই নেতৃত্বের প্রতি তাদেরই মধ্যে গালমন্দ করতো, ঘৃণাভরে ভর্ৎসনা করতো এবং মুখ বিকৃত করে অভিশাপ দিত আর নেতৃত্বের বিষোদগার করতে সচেষ্ট থাকতো। কিন্তু শ্রদ্ধেয় নেতার পিতৃহৃদয় ও বিপ্লবীসত্ত্বা বরাবরই বিশ্বাস করতো – তাদের একদিন না একদিন সুমতি হবে এবং আত্মসমীক্ষা করে একদিন সৎপথে ফিরে আসবে।

কিন্তু নেতার এই সহনশীলতা ও ক্ষমাশীল মনোভাবকে তারা দুর্বলতা বলে বিবেচনা করতো এবং পরিশেষে একদিন ক্ষমতা কেড়ে নেবার উন্মত্ততায় ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিল।

১৯৮২ সালের জাতীয় সম্মেলনে তারা সশস্ত্র বাহিনীকে উস্কানী দিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পার্টির সর্বময় ক্ষমতা দখলের এক বিরাট অপচেষ্টা চালায়।

কিন্তু সচেতন কর্মীবাহিনীর সামনে সেসব ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও পার্টি নেতৃত্বে তাদেরকে ক্ষমা প্রদর্শন পূর্বক পুনর্বার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করে।

কিন্তু অবিশ্বাসের ভূত তাদের কায়-মন-বাক্য থেকে কখনই সরে পড়ল না। পুনরায় তারা ষড়যন্ত্রের পথে পা বাড়াতে থাকে। তারা পার্টির অভ্যন্তরে থেকে পার্টির বিরুদ্ধেই স্যাবোটেজ আরম্ভ করে দেয় এবং ভাতে মারা ও পানিতে মারা বিষবাষ্প সৃষ্টি করে।

তার ফলে সমগ্র পার্টিব্যাপী এক চরম সঙ্কট ও অচলাবস্তা সৃষ্টি হয়। তারপর একসময় আকস্মাৎ ঘটল বিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণে পেটের নাড়িভূড়ি সব বেরিয়ে পড়ল এবং কুরুক্ষেত্রে কলিজা ফাটা আর্তনাদ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হলো।

পরিণতিতে চক্রান্তকারীদের সার্বিক অবস্থা দ্রুত ডুবন্ত সূর্যের মতই যখন মুমূর্ষু হয়ে দেখা দিল তখন হন্যে হয়ে সমঝোতার পথ খুঁজতে থাকে।

অতপর পার্টি নেতৃত্ব জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ‘ক্ষমা করা ও ভুলে যাওয়া নীতির’ ভিত্তিতে গণতন্ত্রের পথ সুগম করার মানসে এক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে।

কিন্তু পৃথিবীতে যত ধর্মের কাহিনীই থাকুক না কেন চোররা তা শুনতে কখনই রাজী নয়। তারা আরো নতুন কায়দায় ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে গোপনে গোপনে। সংক্ষেপে এই হলো ১০ নভেম্বরের পূর্বকালীন অবস্থা।

এইভাবে চলতে থাকে একদিকে ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে প্রতিরোধ। এমনিভাবে বর্ষা চলে গেল। শরতের আগমন ঘটল। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু করতে করতে একদিন শারদীয় নির্মল দিনগুলোও নিরসমুখে বিদায় নিল।

চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র তবুও শেষ হলো না। চক্রদের হোতা গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসার কথা ছিল কিন্তু তারা এলো না।

একসময় প্রকাশ জানালো সে তার অনুগামীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। তাই কেন্দ্রের সাহায্য চেয়ে এক জরুরী চিঠি পাঠালো। অনেকের সন্দেহ হলো সমঝোতায় হয়তো চক্রান্তকারীরা আসতে নারাজ।

এ ব্যাপারে নেতার কাছে পরামর্শ চাওয়া হলে শ্রদ্ধেয় নেতা ধৈর্য্য, সহিঞ্চুতা ও দৃঢ়তা নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পরামর্শ দিলেন।

তাই তখনকার অস্থায়ী ব্যারাকটা অন্যত্র সরে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলো কারণ চক্রদের হোতা গিরি ঐ অস্থায়ী ব্যারাক থেকেই চলে গিয়েছিল।

নভেম্বর পয়লা সপ্তাহ। পূর্বের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য রিপ ও সেক্টর কমান্ডার মেজর দেবংশীর নেতৃত্বে বিশ্বাসঘাতক প্রকাশের চিঠি মূলে চক্রান্তকারীদের সাহায্য করতে ও উদ্ভুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে একটা দল বাইরে চলে গেল।

হঠাৎ দুই নম্বর সেক্টর থেকে জরুরি ভিত্তিতে খবর আছে যে, চক্রান্তকারীদের জৈনক কমান্ডার তাদের কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছে এবং সঙ্গে এ কথাও বলেছে যে, চক্রান্তকারীরা আবারো চক্রান্ত করার পাঁয়তারা করছে।

সপ্তাহের শেষ দিন। শোনা গেল বাংলাদেশ বেতার থেকে খবর পরিবেশিত হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। প্রথমে হুঁশিয়ারি সংকেত, পরে বিপদ সংকেত। এভাবে বিপদ সংকেত নম্বর ৩, ৪, ৫ হতে এক সময় মহাবিপদ সংকেত দেয়া হলো।

সঙ্গে সঙ্গে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। আমরা ভাবলাম দুর্যোগ বুঝি এখনো কেটে যায়নি। প্রকৃতির এই ভয়ংকরতা ও রৌদ্ররূপ হৈমন্তীর দিনগুলোকেও বুঝিবা রেহাই দিচ্ছে না। আমাদের সতর্কতা আরো বাড়ানো হলো।

বিশেষ প্রোগ্রামে শ্রদ্ধেয় লীডার একটু বাইরে গেলেন; কড়া পাহাড়ার মধ্যে তিনি ফিরে এলেন রাত্রে। সেদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে এবং শীতল হাওয়ার শিকার হয়ে লীডার অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

নভেম্বর দ্বিতীয় সপ্তাহ। আবহাওয়া আরো খারাপ হয়েছে। প্রায়ই ঝড়ো হাওয়া এসে গোটা পরিবেশটাকে বিষণ্ণ করে তুলেছে।

ডা: জুনির নিরবিচ্ছিন্ন পরিচর্যার সত্ত্বেও লীডার নিরাময় হয়ে উঠতে পারলেন না। রাত প্রায় তিনটে লীডার অসুকে ছটফট করছেন, নিরন্ন মুখে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন। আমরা যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়লাম।

এদিকে সন্তু স্যারও প্রেসিডেন্ট এরশাদের ৩ অক্টোবরের ঘোষণার বিপরীতে খোলা চিঠি লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

তাই আর অস্থায়ী ব্যারাকটা স্থানান্তরিত করা সম্ভব হলো না। নভেম্বর ৯ তারিখ বৃষ্টির প্রকোপ কিছুটা কমেছে বটে কিন্তু প্রায় সময়টা জুড়ে বায়ুপ্রবাহ বয়ে চলেছে।

সারাক্ষণ কাকের কা-কা রবে প্রকৃতি যেন কিসের এক আশঙ্কায় বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। বিকেলে লীডারকে কিছু বিস্কুট খাওয়াবার চেষ্টা করা হলো কিন্তু তিনি খেতে পারলেন না। ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো।

সবাই যার যার বিছানায় শুঁয়ে পড়েছে। রাত ৮টা নাগাদ পাশের ঝিরিতে কি যেন একটা গড়িয়ে পড়ার শব্দ শোনা গেল।

দু’জন সৈনিক টর্চলাইটের আলো দিয়ে জায়গাটা চার্জ করে এলো। কিছুই দেখতে না পেয়ে প্রকৃতির ঘটনা ভেবে তারাও ঘুমিয়ে পড়লো। রাত ১১ থেকে ১২ টা পর্যন্ত আমরা চার জন প্রহরায় ছিলাম।

তখনও প্রায় ভারী শুষ্ক হাওয়া বয়ে চলছিল। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে জোছনার আলো পৃথিবীর সাথে লুকোচুরি খেলছিল।

তখন কেই বা জানতো প্রকৃতির মধ্যে কোন বিভীষিকাময় ঘটনা কারোর জন্য অপেক্ষা করছে কিনা। প্রহরী বদল করে আমরা শুঁয়ে পড়লাম।

আমার পাশের সঙ্গীটার সামান্য জ্বর ছিল। অতএব তাকে কোনোরকম বিরক্ত না করে একটু অসুবিধার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।

১০ নভেম্বর ভোর রাত তিনটে বাজতে তখনও কিছু বাকি। গভীর তন্দ্রা থেকে বিদঘুটে এক স্বপ্নের শিহরণে আমি হঠাৎ জেগে গেলাম। শয্যার উপর বসে চারিদিকে একটু তাকালাম, দেখলাম প্রহরী বদল হচ্ছে।

হাতের ঘড়িটা টর্চের আলোতে দেখে নিয়ে আবার গা এলিয়ে দিলাম। ভাবলাম বোধকরি একটু অসুবিধার মধ্যে ঘুমুতে গিয়ে এভাবে দু:স্বপ্নের মধ্যে ঘুম ভাঙলো।

তারপর আস্তে আস্তে ঘুমের তন্দ্রা পাচ্ছে। পায়ের কাছে একটু কড়মড় শব্দ হওয়াতে টের পেলাম পিনহোল টর্চের আলো দিয়ে কে যেন বাইরে যাচ্ছে, আর একটু পরেই আকস্মাৎ কারবাইনের ব্রাশ ফায়ার হলো ট-ট-ট-টশ্।

সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পায়ের দিকের মাটিতে লাইন পজিশন নিলাম। ‘মুই রিপন, রিপন‘ কথাটা শুনতেই তাকিয়ে দেখি রিপনদা ‘ওমা’ ‘ওমা’ করতে করতে উঠানে গড়াগড়ি দিচ্ছেন।

কিছু একটু বোধগম্য না হতেই চিৎকার দিয়ে বললাম কি হয়েছে, কি হয়েছে! তখন উত্তরপশ্চিম কোণের পায়খানা ঘরের রাস্তার মুখে (বড় ব্যারাকে একদম সন্নিকটে আমাদের এলএমজি ম্যানের খুব কাছাকাছি) থেকে একজন সোজা দক্ষিণ দিকে লীডারকে লক্ষ্য করে ক্রমাগত ব্রাশ ফায়ার করছে, অন্যজন আমাকে আর সন্তু স্যারকে লক্ষ্য করে ব্রাশ ফায়ার করে চলেছে।

আর বিশ্বাসঘাতকেরা ‘ইয়া আলী…, ইয়া আলী…’ শব্দ করছে এবং অাবুল্যা এডভান্স করে বিকৃত গলার স্বরে শব্দগুলো উচ্চারণ করছে। ততক্ষণে আরো ৪/৫ জন আমাদের ব্যারাকের খুব কাছে (আমার ৫/৬ গজ দূরত্বে) এসে একসাথে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে দিয়েছে।

বোঝা গেল চক্রান্তকারীরা বাংলাদেশ আর্মি ভান করে বিশ্বাসঘাতকতামূলক আক্রমণ করতে এসেছে। ট্রেঞ্চে গিয়ে পজিশন নিলাম। সেখানে সন্তু স্যার ও মিহিরদাকে নাগাল পেলাম।

ততক্ষণে সেকেন্ড লেফটেনান্ট মণিময় ও কর্পোরেল অর্জুন উত্তর পার্শের ট্রেঞ্চগুলোতে পজিশন নিতে গিয়ে সরাসরি শত্রুদের ফায়ারের মুখে পড়ে ইহলীলা সংবরণ করল। ঐ দুটো অস্থায়ী ব্যারাকে আমরা ২০/২২ জন মানুষ ছিলাম।

ঠিক সেই মুহূর্তে সব চাইতে অসুবিধার দিকটা ছিল এই যে, শক্ররা রয়েছে উত্তর প্রান্তেভ আর আমরা পজিশন নিতে বাধ্য হয়েছি দক্ষিণ প্রান্তে।

মাঝখানে রয়ে গেছে দুটি ব্যারাক ও বাদবাকি মানুষগুলো। তাই বাদবাকি মানুষগুলোর কথা ভেবে আমরা ঠিকমত ফায়ারই করতে পারছিলাম না। কারণ সেই অন্ধকারে কাউকে সঠিকভাবে চেনা যাচ্ছিল না।

আমরা অস্থায়ীভাবে তিন ভাগে ভাগ হয়ে অবস্থান করছিলাম। পাহাড়ের সর্বোচ্চ উত্তর দক্ষিণ লম্বালম্বি ব্যারাক, সেখান থেকে ৪০/৫০ গজ নিচে পাহাড়ের মাঝামাঝিতে সামনাসামনি দুটি ব্যারাক।

ব্যারাকের পাশে দক্ষিণমূখী হয়ে একজন সেন্ত্রী থাকে। সেখান থেকে ২০/২৫ গজ নিচে ঝরণার কাছাকাছিতে পাকঘর-কাম-ব্যারাক দুটো পাশাপাশি।

সেদিন পূর্বমুখী একজন সেন্ত্রী ও উপরের ব্যারেকের উত্তর-দক্ষিণ হয়ে দুটো সেন্ত্রী মিলে সর্বমোট ৪ জন সেন্ত্রী সবসময় থাকতো। কিন্তু শত্রুরা মুহুর্মুহু ফায়ার ও হাত বোমার আওয়াজ করতে করতে মধ্য ব্যারাকের উঠোন বরাবর ও ব্যারাকের নিচে ঢুকে পড়েছিল।

উপর্যুপুরি ব্রাশ ফায়ার ও হাত বোমার বিস্ফোরণে মনে হচ্ছিল প্রতিহিংসার উন্মত্ততায় শত্রুরা যেন প্রতিটি ঝোপপাড়কেও ধ্বংস করে দিতে চাইছে।

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ট্রেঞ্চের কাছাকাছিতে দুটো হাত বোমা ফেটে যায় এবং প্রবল গোলা বর্ষণ করতে থাকে। ফিল্ড কমান্ডার সন্তু স্যার উপরে ফাইটিং গ্রুপ নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করতে সংকেত দিতে সচেষ্ট থাকেন।

ইতিমধ্যে কর্পোরেল জাপানকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা ও পার্টির বিভিন্ন ইউনিটের সাথে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদানেও সন্তু স্যার ব্যাপৃত থাকেন।

এমন সময় উপর থেকে আমাদের ফাইটিং গ্রুপ এস শত্রুদেরকে পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করে। চতুর্দিক থেকে ফায়ারিং আওয়াজ শুনে শত্রুরা মন্ত্রী-মন্ত্রী বলে ডাকাডাকি শুরু করে দেয় এবং কয়েকবার লম্বা লম্বা বাঁশি বাজানোর পর পূর্বদিকে ছড়া (ঝরনা) বেয়ে চলে যায়।

কিন্তু ততক্ষণে ৮ জন ঘটনাস্থলে শহীদ হন এবং কর্পোরেল সৌমিত্র ও কর্পোরেল বকুল আহত হন। কিন্তু সৌমিত্র গুরুতরভাবে আহত হয়ে লীডারের জায়গা থেকে সামান্য দূরের ঝোপে আড়াল করা একটি গর্তে নিজেকে কোনমতে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হন। তিনি আহত অবস্থায় দুইদিন বেঁচে থাকেন।

তাঁর প্রত্যক্ষ বিবরণ থেকে জানা যায় – লীডার প্রথমে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। কিন্তু অসুস্থ শরীর ও দুর্বলতা হেতু সরে যেতে পারেননি।

শত্রুরা ব্যারাকের ভিতরে ঢুকে লীডারকে আহতবস্থায় দেখতে পায়। তখন লীডার হত্যাকরীদের সাথে কথা বলার সুযোগ পান। লীডার প্রথমে বলেন – ‘কি, তোমাদের ক্ষমা করে আমরা অন্যায় করেছি?

আমাকে কিংবা তোমাদের বন্ধুদের মেরে জাতি কি মুক্ত হবে? যাক, তোমরা প্ররোচিত ও উত্তেজিত হয়ে যাই করো না কেন জাতির দুর্দশাকে তোমরা কখনো ভুলে যেও না আর জাতির এ আন্দোলনকে কখনো বানচাল হতে দিও না।’

লীডারের কথা শুনে উপস্থিত দু’জন বিভেদপন্থী নীরবে চলে যায়। তারা আর ফিরে আসেনি। ততক্ষণে তাদের মধ্যে কড়া ভাষায় কথা কাটাকাটি হতে শোনা যায় এবং সন্ত্রস্ত কণ্ঠে ‘ও যেদং ভিলে, যেদং’ শব্দ শোনা যায়।

সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎগতিতে কে একজন এসে লীডারের গায়ে উপর উঠে কোন কথা না বলে ব্রাশ ফায়ার করে দ্রুত পালিয়ে যায়।

তার কিছুক্ষণ পরেই ঐ জায়গাটি আমাদের পুনর্দখলে আসে এবং সমস্ত শত্রুদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কর্মীরা এসে শ্রদ্ধেয় লীডারের বুক জড়িয়ে ধরে এবং আবেগাকুল ও উদ্বেলিত কণ্ঠে বলতে থাকে – ‘স্যার, ও স্যার আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না। তুমি ছাড়া আমি কোথায় থাকবো স্যার।’

শ্রদ্ধেয় লীডারের বুক তখনও উঞ্চ ছিল। তিনি কোনমতে চোখ মেলে তাকালেন এবং হাত দিযে কি যেন সান্ত্বনা দিতে চাইলেন কিন্তু কোন কথা বেরুল না, কোন অশ্রু ঝরলো না।

শুধু বুকের তাজা রক্ত বিছানা গড়িয়ে টপ্ টপ্ করে ঝরে পড়তে লাগলো। তারপর চোখ খোলা রেখে লম্বা এক বুকভরা শ্বাস নিয়ে অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় চিরশায়িত হয়ে রইলেন।

নির্মম এই পৃথিবী যিনি নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত জাতির সেবায় নিজের শেষ রক্ত বিন্দুটুকুও দান করে গেলেন সেই জাতি তাদের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূতকে এক ফোঁটা ঔষধ খাওয়াবার সুযোগ পেল না।

তাঁর স্বাভাবিক উজ্জ্বল চেহারা তাঁর খোলা চোখ যেন তিনি এখনও স্বাভাবিক। দেখে মনে হয় মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও কোন প্রকার ভয়ভীতি তাঁকে যেমন ছোঁয়াতে পারেনি, তেমনি জন্মভূমির মায়া, প্রকৃতির আলো বাতাস দু’চোখ ভরে দেখার স্বাদ এখনো মিটেনি।

উত্তপ্ত রক্ত প্রবাহের বিদ্যুৎ খেলানো শান্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা শত্রুকে তাড়া করে ফিরে এসেই জিজ্ঞেস করে স্যার কোথায়? যখন দেখে স্যারের নিষ্প্রাণ দেহখানি পড়ে রয়েছে তখন আর কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পারে না।

কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে ‘শেষ.., সব শেষ চক্রান্তকারী গুণ্ডারা আজ স্যারকে হত্যা করে আন্দোলনকে ধ্বংস করলো। তোমাদের একদিন এই পাপের প্রয়শ্চিত্ত করতে হবে।’

সেদিনের কান্না প্রিয়নেতাকে হারানোর ব্যথা, চিরবঞ্চিত দৃষ্টিশক্তিকে হারানোর চাইতেও গভীর ও মর্মন্তুদ।

যে মানুষটি জুম্ম জাতির মুক্তি কামনায় বছরের পর বছর কঠোর সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন, যে বিপ্লবী কণ্ঠ ছিল দুনিয়ার সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার সেই অগ্রনায়ক, জাতির কর্ণধার, জাতীয় চেতনার আলোকবর্তিকা যেন তার সমস্ত সলিতা বিসর্জন দিয়ে নিজের দায়িত্ব সমাপন করলেন।

কিন্তু জাতিকে তার আরো অনেক কিছু দেবার মত ছিল।

সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে…, হৃদয়ের গভীরতম আবেগে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রয়েছে দেখে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম। অশ্রু মুছে নিলাম।

সান্ত্বনা দেবার জন্য কিছু বলতে যেয়েই কণ্ঠরোধ হয়ে এলো বিধাতা সেদিন বাকশক্তিকে কেড়ে নিয়েছেন। সমস্ত দেহটা অবসন্ন বোধ করছি।

মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো। মিহিরদা সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন – ‘যা হবার তো হয়েই গেছে সেটা ফেরাবার আর নেই।

তোমরা ধৈর্য্য ধরো। আর আহত সৌমিত্রকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করো।’ অবশেষে সমস্ত শক্তি দিয়ে আত্মসংবরণ করলাম। লীডারের গোছানো জিনিসগুলো এক জায়গায় জড়ো করে প্রয়াত নেতার মরদেহের উপর কাপড় জড়িয়ে দিলাম।

কিন্তু মুখ ঢেকে দেবার সাহস হলো না। যেই মুখ উগ্র ধর্মান্ধ স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার ও উগ্র বাঙালি মুসলমান জাতীয়তাবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দু্র্গ গড়ে তুলেছিল, সেই অভূতপূর্ব মুখখানি ঢেকে দিতে সাহস হলো না।


সেদিনের আকাশ ছিল মেঘলা, মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়া এসে সমস্ত পরিবেশটাকে স্যাঁতস্যাঁতে করে রেখেছিল। ব্যারাকের সমস্ত জিনিসপত্র বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ছিটানো। উঠানে ও মেঝেতে হাত বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত কালো দাগগুলো সমস্ত পরিবেশটাকে কলুষিত করে রেখেছিল।

বেপরোয়া গুলির আঘাতে সমস্ত কাপড়-চোপড় ছিন্নভিন্ন হয়ে এলোপাতাড়ি পড়ে রয়েছে; ইতস্ততভাবে গোলাগুলি পড়ে রয়েছে। ব্যারাকের ভিতরে লাশ, উঠানে লাশ, রাস্তার উপরে লাশ সবাই যেন বিছানাহীন শয্যায় অনাদরে লুটোপুটি দিচ্ছে।

আমরা সব মরদেহগুলো এক জায়গায় জড়ো করে কাফন মুড়িয়ে দিচ্ছিলাম। দেখতে পেলাম চক্রান্তকারী শত্রুরা ঐ মরদেহগুলোর উপর অহেতুক গুলি বর্ষণ করে তাদের প্রতিহিংসার ঝাল মিটিয়েছে।

পাষণ্ডতার এই কুলক্ষণ উন্মত্ত পাগলা কুকুরকেও অনায়াসে হার মানিয়ে দেবে।

তখনও বাতাসে সর্বত্রই পোড়া বারুদের উগ্রগন্ধ। প্রকৃতির বিমর্ষতাও যেন নাছোড়বান্দা। মৃদু সঞ্চারমান মেঘের ফাঁকে ফাঁকে কখনও এক ঝলক রোদ এসে ধরণীর অশ্রু মুছিয়ে দেবে এটুকু ক্ষীণ আশাও সেদিন ছিল না।

মাননীয় ফিল্ড কমান্ডার সন্তু লারমা মিহিরদাকে আহতদের চিকিৎসার ভার দিলেন। আশেপাশের সমস্ত এলাকা চার্জ করে দেখার নির্দেশ দিলেন আমাদেরকে।

তার পরদিন অন্যান্য সব ইউনিটগুলোতে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে দ্রুত খবর পাঠানোর ব্যবস্থা নিলেন এবং ঔষধ সংগ্রহের জন্য লোক নিয়োগ করলেন।

ইতিমধ্যে দু:সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশে বন্ধু-বান্ধবরা দলে দলে এস ভীড় জমাতে শুরু করছে। সবাই প্রয়াত নেতাকে শেষবারের মত দেখতে চায়। অবশেষে সন্তু স্যার এসে পৌঁছালে উপস্থিত লোজনদের প্রিয়নেতার শেষ দর্শনের অনুমতি দিলেন।

ব্যারাকের ভিতরে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। একজন বৃদ্ধ লোক এসে প্রয়াত নেতার কাফন খুলে দেখলেন। তার গুলিবিদ্ধ ঝাঁঝড়া বুক দেখে আস্তে ধীরে বসে পড়লেন এবং কপালে হাত রেখে অশ্রুসিক্ত বিস্ফোরিত নয়নে বিলাপ করতে শুরু করলেন- ‘হে দেশমাতৃকার প্রকৃতি সন্তান!

আমরা জানি শত প্রলোভন তোমাকে মোহিত করতে পারেনি; একটা আগ্রাসী জাতির যাবতীয় হুমকি তোমাকে বিচলিত করতে পারেনি; তোমাকে মানসিক দৃঢ়তায় কোনদিন ভাটা পড়তে দেখিনি।

তোমার স্বার্থত্যাগ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তোমার প্রেরণায় গোটা জাতি আজ বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে সাহসী হয়েছে। তবুও তোমার শত্রুরা জাতির কুলাঙ্গারেরা তোমাকে হত্যা করলো।’

তিনি ঢুকরে কেঁদে উঠলেন। সবাই অশ্রু সজল নেত্রে একবাক্যে বলে উঠলাম – সত্যিই বিনা মেয়ে বজ্রঘাতের মতই হয়েছে। সবাই বলে উঠলো – হে ভগবান, তুমি এই খুনীদের, এই বেঈমানদের বিচার করো।

জনতার সারি থেকে আরো একজন বৃদ্ধ এসে অশ্রু মুছে নিয়ে প্রয়াত নেতার কপালে হাত রেখে বুদ্ধ ধর্ম সংঘ বলে আশীর্বাদ দিতে দিতে বললেন- ‘তুমি তো যেখানেই যাও না কেন সবসময় ‘সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্ত’ (সকল প্রাণী সুখী হোক) বলে ধর্মীয় বাণী প্রচার করতে, কতবার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কাজ করতে দেখেছি, কাউকে তুমি হিংসা করো না। তুমি স্বর্গবাসী হবে; পরিনির্বাণ লাভ করবে। কোন প্রাণীকে তুমি হত্যা করতে না। তোমার এই সৎকর্মের ফল ইহকালে না হলেও পরকালে ভোগ করবে।’

উপস্থিত জনতা সবাই সমস্বরে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো – ‘শান্তিবাহিনী ভাইয়েরা, মূর্খ শিষ্যের চেয়ে পণ্ডিত শত্রুও ভালো। গৌতম বুদ্ধের এই উপদেশটা কখনও ভুলে যেয়ো না। যারা মূর্খ, যারা বেঈমান তাদেরকে ক্ষমা করার কোন দরকার নেই।’

ততক্ষণে আশেপাশে বাহিনীর সকল সদস্যগণ এসে জড়ো হয়েছেন। সবাই পুরো ব্যাপারটা জেনে নেবার জন্য নানা প্রশ্ন করছেন।

পরে উপস্থিত জনতা সরে গেলে প্রিয়নেতার বিদেহী আত্মার প্রতি শেষ সম্মান প্রদর্শনের জন্য নীরবে অশ্রুসিক্ত নয়নে ব্যারাকে উঠে এসেছেন।

এভাবে কর্মীরা যখন আসতো প্রিয়নেতা তাড়াতাড়ি এসে অভ্যর্থনা জানাতেন। সবার সাথে করমর্দন করতেন এবং আন্তরিকভাবে আলিঙ্গন করতেন। তারপরে তাঁর পাশে বসিয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে তৎপর হয়ে পড়তেন।

কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর কুশলবার্তা ও পরিস্থিতির খবরাখবরগুলো অতি নিখুঁতভাবে জেনে নিতেন। তাঁর এ বিনয়ী মনোভাব, মহানুভবতা ও স্নেহপূর্ণ ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত।

পার্থিব জগতের দু:খ বেদনা অভাব অভিযোগ সব কিছুই ভূলে যেত তাঁর এই অমায়িক ব্যবহারে। তাঁর সাথে আলাপ করে প্রত্যেকটি কর্মী নতুন প্রেরণা লাভ করে উজ্জীবিত হয়ে ফিরে যেত।

কিন্তু এই দিনের কত কর্মী এসে জড়ো হয়েছে সে প্রেরণা কেউ পেল না। কারো সাথে করমর্দন হলো না, কাউকে আলিঙ্গন করলেন না। তিনি রয়েছেন তারই প্রিয় বিছানায় নির্বিকার চিত্তে; চিরশায়িত হয়ে। কোন রকম উত্তেজনা, কোন রকম শোকার্ত কান্না তাঁকে আর বিচলিত করবে না।

সবাই ধীরে ধীরে তাঁর শবদেহের পাশে হাতিয়ার রেখে দুই হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়ে কৃত্জ্ঞতার সাথে সম্মান জানাচ্ছে, কেউ কেউ দু’পায়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করছেন – স্যার, তুমি আর আদর করবে না স্যার? তুমি কি আলাপ করার জন্য আর কাছে ডাকবে না স্যার! হায়রে অবুঝ হৃদয়! এতকিছু দেখেও বিশ্বাস করতে পারছো না?… তবুও তো বাস্তবতাকে মানতে হয়।

তারপর কয়েকজন মিলে আমরা তাঁর জিনিসপত্রগুলো তদন্ত করে দেখলাম। অনুসন্ধান করে দেখা গেল, চক্রান্তকারী শয়তানেরা প্রিয় লীডার ও সন্তু স্যারের যাবতীয় দলিলপত্রসহ অন্যান্য জিনিসপত্রাদি প্রায়ই লুঠ করে নিয়ে গেছে।

সেই সঙ্গে বেশ কয়েকখানা হাতিয়ার গোলাবারুদসহ অন্যান্য অনেকেরই জিনিসপত্রাদি নিয়ে পালিয়ে গেছে। অবশিষ্টাংশের মধ্যে দেখতে পেলাম তাঁর ব্যবহারের একটি কেটলি, একটা পানির কন্টেনার ও একটা পানির চোঙা তখনও পানি ভর্তি অবস্থায় পড়ে আছে।

তাঁর ব্যবহারের জন্য মাত্র দুটো কম্বল, একটা গিলাপ কাপড় যা দিয়ে বালিশ বানানো, একটা পেন্ট, একটা শার্ট ও এক জোড়া মোজা পায়ে জড়ানো। তাছাড়া বহু পুরানো এক জোড়া জুতা, একটা পুরানো গেঞ্জি, একটা লুঙ্গি ও একটা দেশীয় ঝোলা রয়েছে।

ফেলে যাওয়া তাঁর সুটকেসটা খুলে দেখা গেল – অনেকগুলো বই, কিছু ঔষধ, একটা ডায়েরি ও একটা ছোট ফটো এ্যালবাম ও শিষ কলম কয়েকটা।

দেখলাম তাঁর ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা আছে ‘মহান জুম্ম জনগণের আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক, সারা দুনিয়ার নিপীড়িত জনগণ এক হও। জয় আমাদের হবেই-হবে।’

তাঁর প্রিয় ডায়েরির সাথে আরো রয়েছে অনেকগুলো পেপার কাটিং সেগুলো তিনি খুবই সযত্নে সংরক্ষণ করতেন। সংস্কৃতিবান ও ছিমছাম জীবনের অধিকারী প্রিয়নেতার এ্যালবাম দেখা গেলো – তাঁর অতি প্রিয় দু‘টি সন্তানের ছবি, তাছাড়া ছাত্র ও শিক্ষক জীবনের এবং এলএলবি পাশ করে এডভোকেট হওয়াকালীন তোলা সযত্নে রাখা ফটো।

তাঁর সেই ছবিগুলো দেখে দীর্ঘদিন কারাভোগের পর দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে প্রথম দেখা স্মৃতিগুলো আমাকে মনে করিয়ে দিল।

এছাড়া আরো অনেকগুলো ফটো একের পর এক করে দেখছিলাম তখন হঠাৎ একজন নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠলো – ‘এমনিতে এ স্যার অতিরিক্ত দয়ালু। কি প্রয়োজন ছিল এই চক্রান্তকারী শত্রুদের ক্ষমা দেয়ার।’

সে কথা শুনে অন্য একজন তাড়াতড়ি বলে উঠলো – ‘দেখ ভাই ভূল ধরলে অনেক কিছু পারা যায়। নেতার মহৎ হৃদয়কেও দোষ দেয়া যায়। কিন্তু তাঁর এই ক্ষমা গুণ না থাকলে এতক্ষণে আমাদের কার কি অবস্থা হতো ইয়ত্তা আছে?

তাঁর মতো মহৎ হৃদয় না থাকলে আমাদের শাস্তি পেতে পেতে মাথার চুলও চলে যেত। কত ধৈর্য ধরে তিনি আমাদেরকে বার বার বুঝাতেন, শিখাতেন তাঁর সূক্ষ চিন্তাধারা। তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি না থাকলে আমাদের এ জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটতো না, জুম্ম জাতি এতক্ষণ ধ্বংস হয়ে যেতো।’

এসব কথা শুনে ঔ দলের কমান্ডার বলে উঠলেন – ‘দেখ ভাইয়েরা, আমাদের এই মহান নেতার অবদান ও মহত্ব তাঁর শত্রুরাও অস্বীকার করতে পারবে না।

তিনি খাঁটি বৌদ্ধ। তোমরা তো নিজেরাই জান তিনি একটা পিঁপড়েকেও মারতে দিতেন না। ঘাটের চিংড়ি ও কাঁকড়াগুলোকে মারতে দিতেন না বলে ওরা আমাদেরকে ভয় করতো না, পায়ের কাছে কাছে এসে আহার যোগাড় করতো।

দেখ দয়া করলে পশুপক্ষীরা পর্যন্ত পোষ মানে। আজ নেতার মৃত্যুর মাধ্যমে জাতি তার সবচাইতে সম্মানিত সম্পদটাই হারালো।

এ ক্ষতি কোনোদিন পূরণ হবার নয়। তাঁর আন্দোলনের জ্ঞান, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্ম, আইন ইত্যাদি সর্বজ্ঞানে গুণান্বিত মানুষ জাতি আর কোনোদিন পাবে কিনা সন্দেহ।

তোমরা দুর্বল হয়ো না ভাইয়েরা, বাস্তব জগত থেকে তাঁর অস্তিত্ব মুছে যেতে পারে কিন্তু তাঁর অবদান ও তাঁর অমরবাণী আমাদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। এসো ভাইয়েরা নেতার মরদেহ ছুঁইয়ে আমরা নতুন করে শপথ নিই এই মহান নেতার স্বপ্ন আমরা পূরণ করবোই।

সবাই একসাথে বলে উঠলো – ‘জনসংহতি সমিতি জিন্দাবাদ, শান্তিবাহিনী জিন্দাবাদ, জুম্ম জনগণ দীর্ঘজীবী হোক। প্রিয়নেতার ঐতিহাসিক অবদান অমর হোক, অমর হোক।’

দেখতে দেখতে দিবসের শেষ ভাগ নেমে এলো। বিকেল ৫টা বেজে আরও গড়িয়ে গেছে। উপস্থিত জনতা ও বাহিনীর সদস্যরা মিলে মরদেহগুলো দাহন করার ব্যবস্থা নেয়া হলো।

চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের কোণ ঘেষে আঁকাবাঁকা হয়ে ছড়া (ঝর্ণা) চলে গেছে। ছড়ার দু‘ধারে মাথা উঁচু উঁচু করে দাঁড়ানোর তরুরাশির ছায়াই বহুলতাগুল্মের ঘেরা একটুখানি সমতল জায়গা।

ঐ জায়টায় সাফ করে মরদেহগুলোর সমাধি বানানো হয়েছে। তারপর এক এক করে মরদেহগুলো শ্মশানে নিয়ে আসা হচ্ছে।

সবাইকে নিয়ে আসা হলে মেজর পেলের নেতৃত্বে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা ও উপস্থিত জনতা সবাই প্রথমে লীডারের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করেন এবং পরে অন্যান্যদেরকেও করা হয়।

তারপর জনতার পক্ষ থেকে অন্যান্য মরদেহগুলোর পরিচয় করিয়ে দেবার অনুরোধ জানানো হয়। তখন দলের পক্ষ থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ একজন সদস্য শহীদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি জানিয়ে দিলেন এইভাবে – এই হচ্ছেন আমাদের নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত জুম্ম জনগণের নেতা লারমা।

যিনি জুম্ম জনগণের জাতীয় জাগরণ এনে দিয়েছেন। যিনি জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।

দশ ভাষাভাষী জুম্ম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। জুম্ম জাতির জাগরনের অগ্রদূত, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, চিন্তাবিদ, নিপীড়িত মানুষের একনিষ্ঠ বন্ধু, মহান দেশপ্রেমিক ও রাজনীতিবিদ আজ আমাদের মাঝে নেই।

কিন্তু তিনি দিয়ে গেছেন মুক্তির মন্ত্র। ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের নেতা লারমা ভদ্র, বিনয়ী, ক্ষমাশীল, স্নেহবৎসল, অতিথিপরায়ণ, সুশৃঙ্খল, কর্তব্যনিষ্ঠ, সদালাপী ছিলেন। তিনি বিবাহিত। তাঁর এক পুত্র ও এক কন্যা।

শোক সন্তপ্ত তাঁর পরিবার পরিজনের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাই। মেজর পরিমল বিকাশ চাকমার মরদেহ হচ্ছে এটি। ছাত্র অবস্থা থেকে তিনি বিলুপ্ত প্রায় জুম্ম জাতির কথা ভাবতেন।

তাই ছাত্র জীবন থেকেই তিনি দেশ সেবায় আত্মনিমগ্ন ছিলেন। কলেজ জীবন শেষ করার পরই তিনি সক্রিয়ভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি একজন অতি বিশ্বস্থ, সৎ, বিনয়ী, সাচ্চা দেশপ্রেমিক ছিলেন।

দীর্ঘ এক যুগ ধরে তিনি প্রয়াত নেতার পাশে পাশে নিরাপত্তা ও সেবা শুশ্রূষার দায়িত্বভার নিজেই বহন করতেন। শত্রুরা সর্রপ্রথম তাঁর উপরেই গুলি বর্ষণ করেছিল। তিনি সদ্য বিবাহিত ছিলেন।

এই হচ্ছেন শুভেন্দু প্রভাস লারমা (তুফান)। তিনি প্রয়াত নেতার বয়োজ্যেষ্ঠ ভাই। মাত্র গতকাল তিনি প্রয়াত নেতার অসুখের খবর শুনে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন।

যুব সমিতির তিনি একজন আঞ্চলিক পরিচালক ও আঞ্চলিক কমিটির একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য। জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।

এপর্যন্ত তিনি একনিষ্ঠার সাথে পার্র্টি প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ও জনদরদী মানুষ। তাঁর অঞ্চলে অনেক মানুষকে তিনি নিজের সম্পত্তি দিয়ে নিজের শক্তি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।

চক্রান্তকারী পলাশের ভাইদের যাবতীয় পড়াশুনার ভার তিনিই বহন করেছিলেন। কিন্তু বিধাতার নির্মম পরিহাস সেই পলাশ চক্র তাঁর মরদেহের উপর অহেতুক গুলি বর্ষণ করে সারা দেহখানি ঝাঁঝড়া করে দিয়ে গেছে। তিনি বিবাহিত। স্বীয় পত্নী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে রেখে তিনি শহীদ হয়েছেন।

তারপরেই গ্রাম পঞ্চায়েৎ বিভাগের সহকারী পরিচালক অর্পণা চরণ চাকমার (সৈকত) মরদেহখানি সকলের সামনে খুলে ধরলেন।

সে সময় তাঁর পরিবারের আত্মীয় স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁর ডান চোখের ভ্রুতেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তাঁকে দেখার সাথে সাথে তাঁর শোক সন্তপ্ত পত্নী, দুই ছেলে ও এক কন্যা হো-হো করে আর্তনাদ করে উঠলো।

পিতৃহারা সন্তানেরা মায়ের বুক ছেড়ে বুক ফাটা ক্রন্দনে বাপকে ধরতে চায় – ধরণীর বুকে স্বামীহারা স্ত্রী, পিতাহারা সন্তানদের করুণ আকুতি দেখে মুর্ছাহত হয়ে পড়ে।

এই মর্মভেদী দৃশ্য দেখে উপস্থিত লোকজন তাদেরকে বোঝাবার ভাষা হারিয়ে তারাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মা ও ছেলেমেয়েদের অবস্থা দেখে বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মীটি অস্থির হয়ে পড়েন এবং কোন মতে আত্মসংবরণ করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলেন, তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিত মানুষ।

খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে লাঞ্চিত ও ধৃত হন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ছিলেন দেশপ্রেমিক।

একনিষ্ঠ, বিশ্বস্থ ও সুদ্ধিদীপ্ত এই বিপ্লবী বিচক্ষণতা ও যোগ্যতার সাথে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব এযাবৎ সুষ্ঠুভাবে পালন করে গেছেন।

রাঙ্গামাটি শাহ্ হাই স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় থেকে তিনি জুম্ম জনগণের জাতীয় সংগ্রামের মহান কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে পড়েন এবং পাহাড়ী ছাত্র আন্দোলনে একজন পরামর্শদাতাও ছিলেন। তিনি সবসময় বৌদ্ধ ধর্মের নীতির সাথে দলীয় নীতির সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করতেন।

আজ তাঁরই স্ব-বান্ধবের সাথে মিলিত হবার কথা ছিল। কিন্তু সে মিলয় আর হলো না। সমস্ত আত্মীয়-পরিজনদের সমবেদনা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করছি।

কল্যাণময় খীসা (জুনি) ছিলেন হাসিখুশি স্বভাবের। পিতার একমাত্র সন্তান। তিনি গ্রাম পঞ্চায়েত বিভাগের আঞ্চলিক পর্যায়ে সহকারী পরিচালক ছিলেন।

তৎপরে পার্র্টির আর্মোয়ার বিভাগেরও একজন সহকারী ছিলেন। তাঁর ডাক্তারী ও সেলাই কাজে অভিজ্ঞতা ছিল। ততক্ষণে তাঁর স্ত্রী পুত্রকন্যারা তথায় উপস্থিত হওয়াতে পরিস্থিতি আরো ঘনীভূত ও মর্মান্তিক হয়ে ওঠে।

শুধু ভগবানের নাম ডেকে উচ্চস্বরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তাঁর অসহায় পত্নী ও স্বজনেরা। এ হৃদয়ের রক্ত শুকিয়ে যাওয়া কান্নায় সারা সমাধিক্ষেত্র মুহূর্তেই করুণ আর্তনাদে ভরে যায়। এই মর্মভেদী কান্নার মধ্যেই সন্তু স্যার বললেন – ‘মা বোন বাপ ভাইয়েরা, আপনারা ধৈর্য ধরুন, বাস্তবতাকে মেনে নেবার চেষ্টা করুন।’

মৃদুভাষী, বিনয়ী, একনিষ্ঠ ও সরল মনের অধিকারী শহীদ জুনি মৃত্যুর আগেও প্রয়াত নেতাকে সেবা করে তাঁর স্বদেশপ্রেম, ধৈর্য ও সৎ মনোভাবের পরিচয় দিয়ে গেছেন। আমরা আজ এ মুহূর্তে অশ্রুজলে ও মনের কৃতজ্ঞতায় তাঁকে বিদায় দেব।

এই হচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ অনার্স কোর্সের ছাত্র সৎ, সাহসী ও একনিষ্ঠ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মনিময় দেওয়ান (স্বাগত) যিনি শত্রুর চোখে ধূলো দিয়ে বার বার পার্র্টিকে শত্রুর অনেক গোপন তথ্য সরবরাহ করেছিলেন।

পার্টি তথা গোটা জাতি এই জন্যে উপকৃত হয়েছিল। তিনি ছিলেন বর্তমান জুম্ম ছাত্র সমাজের একজন ঘনিষ্ট বন্ধু এবং শান্তিবাহিনীর একজন বীরযোদ্ধা। শত্রুর বিরুদ্ধে ও দু:সাহসীক কাজে তিনি ছিলেন পারদর্শী ও সুচতুর।

শত্রুরা তাঁকে আটক করে নানাভাবে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও দুর্জয় মনোভাবের কাছে সে সবই পন্ড হয়ে গিয়েছিল।

তিনি যুব সমিতি ও ছাত্র সমিতির একজন সহকারী পরিচালক ছিলেন। দু:সাহসী এই তরুণ যোদ্ধা চক্রান্তকারীদের মারাত্মক আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে আজ মরেও অমর হয়ে রইলেন।

তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর এই মহৎ কৃতিত্ব আমাদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

একজন সংঘটক ও কৌশলীকর্মী হিসেবে সুপরিচিত এই সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট অমর কান্তি চাকমা (মিশুক)। তিনি একজন ভদ্র, বিনয়ী, একনিষ্ঠ, সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক ছিলেন।

তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে দুই নম্বর সেক্টরের একজন জোন কমান্ডার হিসেবে আরএম জোনের যাবতীয় বিশৃঙ্খল ও জটিলতাকে পার্র্টি অনায়াসে সামলে উঠতে পেরেছিল।

মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে তিনি খবর পেয়েছিলেন তার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। তাঁর একমাত্র নবজাত সন্তানের মুখ দর্শনে বঞ্চিত হয়ে তিনি এই চক্রান্তকারীদের গুলিতে শহীদ হলেন।

সদ্য প্রসূতা স্ত্রী তাঁর স্বামীকে হারিয়ে কী নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাবেন তা আজ আমাদের ভাষায় ব্যক্ত করার নয়। তাঁর স্ত্রী ও নবজাত শিশুকে আমরা আন্তরিক সমবেদনা ও সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি।

সব চাইতে নিরীহ ও সরল প্রাণের অধিকারী কর্পোরেল অর্জুন ত্রিপুরা। তাঁর একনিষ্ঠ অধ্যবসায় ও সাহসীকতার কারণে অল্প সময়ে তিনি বাঘের মতই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন চক্রান্তকারীদের উপর।

মৃত্যুর আগে তিনি বিধবা মায়ের জন্য কিছু কাপড় জোগাড় করে রেখেছিলেন। চিরদু:খিনী তাঁর মাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য চিঠি লিখেছিলেন।

তিনি একজন সৎ, সাহসী, একনিষ্ঠ যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর মাতৃ ভালোবাসা ও বীরত্বপূর্ণ সাহসীকতাকে আমরা গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

কমান্ডার অর্জুনের জীবন প্রদীপ আজ নিভে গেছে বটে কিন্তু তাঁর ত্যাগ, সাহসীকতা আমাদের সংগ্রামের পথে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। করুণ ও বেদনাঘন পরিবেশে সবাই আগুনের কুণ্ডলী হস্তে ধারণ করে দাঁড়িয়েছেন। শ্রদ্ধেয় সন্তু স্যার লীডারের মরদেহের পায়ে মাথা রেখে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করেছেন। সকলেরই মন ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছে; তবুও তো দিতে হবে বিদায়। মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধা, মানুষের প্রেমপ্রীতি মায়া মমতা তাঁর সমস্ত হৃদয়ের আকুতি দিয়ে প্রিয়জনদেরকে ধরে রাখতে চায় -তবু তো যায়না রাখা।

…তাঁরপর সবাই চিতায় অগ্নি সংযোগ করতে এলো। হে অগ্নিকুণ্ড! তুমি দ্বিধা হয়ো না। তোমার শক্তি দিয়ে এই বিদেহী পবিত্র আত্মাগুলো তুমি বরণ করে নাও। দেখতে দেখতে আগুনের প্রলয় শিখা দুম দুম শব্দে সব কিছুকে গ্রাস করে নিল।

আমরা দেখতে পেলাম চির বিদায়ী অভিসংবাদিত নেতার দক্ষিণ হস্ত অর্ধ চন্দ্রাকারে উত্তোলিত হয়েছে যেন আগের মতই তাঁর সর্বশেষ নির্দেশ আমাদেরকে দিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এবার আর সেই অনলবর্ষী ভাষায় নয়, শুধু হাতের ইশারায়…। হতভাগ্য জাতির স্বপ্নের একটি দেদীপ্যমান প্রদীপ উজ্জ্বল নক্ষত্র, যে নিজের আলো বিকিরিত করে জাতির তন্দ্রা ভেঙেছে, বেঁচে থাকার বাসনা জাগিয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস দিয়েছে, বাস্তবে তিনি আর নেই। কিন্তু থাকবে তাঁর অমর বাণী, সেই সংগ্রামী সোপান, যে সোপান বেয়ে জাতি তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।

তারও দু’দিন পর বলীষ্ট ও সুঠাম দেহকে বিদীর্ণ করা তিনটা গুলির আঘাতে সীমাহীন ভোগের পর মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে কর্পোরেল সৌমিত্রের জীবণ প্রদীপ নির্বাপিত হয়ে গেল। তিনি ছিলেন সাহসী ও একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক।

অপার মাতৃস্নেহের লালিত কমান্ডার সৌমিত্র ছিলেন মায়ের পুঞ্জীভূত স্নেহের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। দুর্যোগপূর্ণ দিন গুলোতে তাঁর মায়ের করুণাসিক্ত হৃদয় পুত্র দর্শনের জন্য বড্ডো ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল।

তাই ঠিক হয়েছিল তিনি নিজে এসে প্রিয়তম সন্তানের মুখ দর্শন করে বিদগ্ধ হৃদয়কে প্রশমিত করবেন; ছেলেকে সোহাগ করে অন্তরের সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে যাবেন। কিন্তু চক্রান্তের এই বিভীষিকা উত্তপ্ত মাতৃ হৃদয়কে করে দিয়েছে আরো হাহাকার, ফেলে দিয়েছেন সীমাহীন শোক সাগরে।

মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্তে এই অদম্য দেশপ্রেমিক সন্তান মায়ের কথা তুললো না, কারোর জন্য কাঁদলোনা, করলনা কোন অভিযোগ। মুমূর্ষ অবস্থায় শুধু বলে গেল – ‘দেশপ্রেমিক ভাইয়েরা, তোমরা দমে যেয়ো না সত্য ও ন্যায় হচ্ছে আমাদের পথ। জয় আমাদের হবেই। জয়, জ-য়, জ…।’

১০ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, একটা বিশ্বাসঘাতকতা, একটা ষড়যন্ত্র, কয়েকটা হাত বোমা ও কয়েক হাজার বুলেটই হলো নির্যাতিত, নিপীড়িত জুম্ম জাতির ইতিহাসে কলঙ্কিত উপকরণ। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত এই চক্রান্তকারীরা পাক-ভারতের মিরজাফর এবং লঙ্কার বিভীষনকেও হার মানিয়েছে।

কিন্তু ইতিহাস তার আপন গতি থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। জাতীয় চেতনা কখনো ধ্বংস হতে পারে না। এই নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে চক্রান্তকারীরা ভারিক্কী চালে ও দম্ভভরে পদচারণ করেছে।

হম্বিতম্বি করে, লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে নিজেদের সাফাই গেয়েছে আবেগে ভরা উন্নাসিকতায়। কিন্তু সর্বত্রই নেতার হত্যার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে; বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে।

স্বার্থ ও ক্ষমতার সংঘাতের ফলে ঐ চক্রান্তকারী কতিপয় নেতা সদলবলে সশস্ত্রভাবে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পার্র্টির প্রচণ্ড আক্রমণে বিশৃঙ্খল ও হতাশাগ্রস্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যকার অন্তর্দন্দ্ব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

দলীয় কোন্দলে বিশ্বাসঘাতক দেবেনের অপমৃত্যু তাদের মধ্যকার অন্তুর্দ্ব‌ন্দ্ব তাদেরকে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে। সে সময়ে পার্র্টি উপর্যুপুরি প্রচন্ড আঘাত দিচ্ছে যার ফলে চক্রান্তকারীরা হতাশায় জর্জরিত হয়েছে এবং তাদের মধ্যকার অন্তর্দন্দ্ব বেড়ে গিয়েছে।

নিজের দলীয় লোকদের হাতে দেবেনের মৃত্যু ঘটনায় তাদের অভ্যন্তরস্থ এই অন্তর্দ্বন্দের ভয়াবহ রূপ আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। অতঃপর ষড়যন্ত্রের এই কালো হাত এবং রাজনৈতিক ব্যভিচারিত্বকে জুম্ম জনগণের চিনতে আর বাকি থাকেনি।

জনগণের ধিক্কার পেয়ে তারা এখন বন্ধ্যা, পঙ্গু ও ব্যভিচারের বার্ধক্য অবস্থায়।

যে ক্ষমাশীল অগ্রদূত শুধু খাল খনন করে নয় উপরন্তু ঝর্ণা বানিয়ে জলপ্রবাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম, জাতির সেই কর্ণধারকে চক্রান্তকারীরা বারুদ ভূষণে ভূষিত করতে পারে বটে; কিন্তু গোটা আন্দোলনের মরিয়া প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

আভ্যন্তরীণ দুর্ধ‌র্ষ নদী প্রবাহ বালুকাময় পাড়কে ভাঙতে পারে কিন্তু প্রস্তুরীভূত নদীর পাড় সেই ভাঙনকে অবশ্যই রোধ করতে পারে।

১০ নভেম্বরের শহীদদের পবিত্র রক্তধারাকে স্বাক্ষী রেখে সত্য ও ন্যায়ের পথে সংগ্রামী ইতিহাস আপন গতিতে চলবে আর সেই সাথে শ্রদ্ধাচিত্তে চলবে জুম্ম জাতির করুণ মর্মবেদনাকে বয়ে নেয়া অন্তসলিলা ফল্গুধারা।


লেখকঃ তাতিন্দ্রলাল চাকমা পেলে

তথ্যসূত্রঃ ১০ ই নভেম্বর’ ৮৩ স্মরণে  (১৯৮৪ খ্রি.) 

শনিবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৩

১০ নভেম্বর পোইদ্যানে: ঈমে Injeb Changma


১০ নভেম্বর পোইদ্যানে:

 ঈমে

ও নাদিনলক! দেবাবো চোক চোক কালা পুগে উত্তুরে
ঘরত এয’ ঘরত এয’ ন’ দ-র’নে-ই! বাবর লাগত ন’ প’এয?
ও আজু , এচ্যে তেহ্ বল পিয়ে লাগের, গম লাগের মনত
ঝর এযোক, বোইয়ের এযোক বোক আর’ ভুজোল
যদক্কন ন’ উদিব পির, ন’ ফিরিবং আমি ঘরত।
জীবনান বাজি থেলে কদক আর খারা খেলে পারিবা
পুগে উত্তুরেদি রিনি চ’ ধুমো উড়ের মাদিত ফেল্লে কালা।
দেঘিনেই মরদ’ কাবে পেদ তিলোই আন্ধার অই এযের সংসারান
ইক্যে এভ’ ঝর-বোইয়ের আয় থাক্কে এয’ ঘরত ন’ খেলেয়্য আর খারা।
ও আজু, ইরবান দে ফিবেক কাবা দর গরি সমে থাগ’ তুমি ঘরত
জীঙকানি যুনি দিয়্যা পরে দিবং আমি এ খারাত।
যদ’ দরায় তত লরাই মামা কয় বার বার
এ খারা ওদি গেলে এধক্যে দোল দেচ ন’ পেবং আর।
সুগর আঝায় বাহ্ বানিলং রাঙামাত্যাত ধাবা খেই চাদিগাঙত্তুন
কাপ্তে গধা বানি আঝা সবনর ভুদি ধুবে দিল চিদ’ মনত্তুন।
বানা পরানানিলোই উদি এলং ছিদি পরলং কোণা-কুণি সেরে
সিয়ানিয়্য চোগশাল তারার কারি নেযাদন বলে বলে।
সেনে, ফিরি ন’ এবং আমি ঘরত কন’ দিন পির ন’ দিলে।
ফিবেক - বাড়িতে জাম দেওয়া।
ঈমে - প্রতিজ্ঞা।
ইরবান - শক্ত বাঁধা।
পির - জয় ।
পির দেনা – জয় অনা।

বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

বাংলা‌দে‌শের স্বাধীনতা যু‌দ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল বীর পাহাড়ী

 

বীর মু‌ক্তি‌যোদ্ধা ‌লেঃ ক‌র্ণেল (অবঃ) ম‌নিষ দেওয়ান।

আজ ১৬ই ডি‌সেম্বর ২০২২ ইং মহান বিজয় দিবসে ১৯৭১ সা‌লে বাংলা‌দে‌শের স্বাধীনতা যু‌দ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল বীর পাহাড়ী মু‌ক্তি‌যোদ্ধা‌কে শ্রদ্ধা‌চি‌ত্তে স্মরন কর‌ছি।

আদিবাসী পাহাড়িদের ১৯৭১ সা‌লে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালীন কতটা অবদান রয়েছে তা আপনি এই পোস্টি পড়লে জানতে পারবেন____
১৯৭১ সালে সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পার্বত্য অঞ্চলেও এর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশে যখন হাজার হাজার মানুষ দল-মত-বর্ণ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ্রগ্রহণ করছে তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীরাও অসীম সাহসে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস।পাহাড়ি আদিবাসীরা অসীম বীরত্ব দেখিয়েছে অনেক সম্মুখ সমরে।মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখ সমরে নিহত হয়েছেন অনেক অকুতোভয় আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করতে গিয়ে নির্মম নির্যাতন ও নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছেন অনেক পাহাড়ি আদিবাসী।
মু্ক্তিযুদ্ধের সময় তখনকার চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন বটে কিন্তু মং রাজা মংফ্রু সাইন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মং রাজার তৎকালীন রাজপ্রসাদে প্রতিদিন চট্টগ্রাম হতে ভারতে যাওয়া হাজার হাজার শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিবাহিনীকেও পার্বত্য এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি মূল্যবান পরামর্শ ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান করেন। তিনি সর্বপ্রথম বিপ্লবী সরকারের হাতে বৈদেশিক মুদ্রা তুলে দেন।
তৎকালীন ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) বাহিনীতে পাহাড়ি আদিবাসী অনেকজন ছিলেন। তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারমধ্যে সিপাহী অ্যামি মারমা যুদ্ধে বগুড়ায় নিহত হয়েছিলেন। সিপাহী রমণী রঞ্জনও রামগড়ে নিহত হন। সিপাহী হেমরঞ্জন যুদ্ধে নিখোঁজ হয়েছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তা খগেন্দ্র লাল চাকমা মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন বিধায় তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
১নং সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়।এই দলের নেতৃত্ব দেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। পরে এই দলটি কোম্পানিতে পরিণত করলে তিনি কোম্পানি কমান্ডার হন।
পাক বাহিনীরা পার্বত্য জেলা সদর রাঙ্গামাটি ও মহকুমা সদর রামগড় এবং বান্দরবান দখল করার পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ঘাঁটি স্থাপন করে এবং ঘাঁটিসমূহ সুদৃঢ় করে নেয়। তারা বিভিন্ন এলাকায় শাখা কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় রাজাকার বাহিনী গঠন করে এবং বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে বর্বর অত্যাচার চালায় ও ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়।পাকবাহিনী রামগড়, গুইমারা, মানিকছড়িসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে পাহাড়ী রমনীদের জোর পূর্বক ধরে নিয়ে অমানুষিকভাবে ধর্ষণ করে এবং ক্যাম্পে উলঙ্গ অবস্থায় বন্দী করে রাখে।
বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মু‌ক্তি‌যোদ্ধা প্রয়াত উক্য চিং মারমা।

অনেক পাহাড়ি অাদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পরে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের কাজ করেন। তাদের মধ্যে তৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান, এমএন লারমা, রাজা ত্রিদিব রায়ের আপন কাকা কে কে রায়, সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা মুক্তিযুদ্ধে সংগঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, মুক্তিযুদ্ধে স্থানীয় পাহাড়ি আদিবাসীদের সহযোগিতা ছাড়া দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জয় সম্ভব হতো না। পাহাড়ি আদিবাসীদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধে এবং মুক্তিযোদ্ধা‌দের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন।
পার্বত্য এলাকায় অবস্থানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের সুবিধা, শত্রুপক্ষের ঘাঁটি আক্রমণ এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার অন্তর্গত নাকাপা, কুমারীপাড়া, পাগলা পাড়া, মানিকছড়ি, ডাইনছড়ি, যোগ্যাছলাও গাড়ীটানা এলাকার গহীন অরণ্যে মুক্তিবাহিনীর গোপন ক্যাম্প বা আশ্রয়স্থল করা হয়। এই সমস্ত গোপন গেরিলা ক্যাম্পে ঐ এলাকার হেডম্যান কার্বারীসহ সকল স্তরের জনগণ খাদ্যশস্য সরবরাহ করত এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ঐ সমস্ত এলাকার জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পাকবাহিনীর গতিবিধি এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে সাহায্য করত।
রাজা ত্রিদিব রায়ের এক আত্মীয় লংগদু হতে তিন-চারটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় শ-খানেক খাসি রাংগামাটি পাঠিয়েছিন মুক্তিযোদ্ধা‌দের জন্য। আর সে সময়ে রাংগামাটিতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা‌দের স্থানীয় লোকজন বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে যেসব পাহাড়ি আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের তালিকা নিচে
হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা।

দেওয়া হলো—
বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্র-যুবকদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা হলেন—
১. মং রাজা মংপ্রু সাইন
২. প্রকৌশলী অমলেন্দু বিকাশ চাকমা
৩. ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট চিত্তরঞ্জন চাকমা
৪. পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল টিমের অধিনায়ক চিংহলা মং চৌধুরী মারী
৫. পুলিশ কর্মকর্তা ত্রিপুরা কান্তি চাকমা
৬. পুলিশ কর্মকর্তা বিমলেশ্বর দেওয়ান
৭. পুলিশ কর্মকর্তা খগেন্দ্র লাল চাকমা
৮. উক্য জেন মারমা
৯. ক‌র্নেল মনীষ দেওয়ান
১০. রণ বিক্রম ত্রিপুরা
১১. অশোক মিত্র কারবারী
১২. রাস বিহারী চাকমা
১৩. সুশীল দেওয়ান
১৪. নীলোৎপল ত্রিপুরা
১৫. ক্যাচিং মারমা
১৬. সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা
১৭. গোপালকৃষ্ণ দেওয়ান
১৮. মনীন্দ্র কিশোর ত্রিপুরা
১৯. বরেন ত্রিপুরা
২০. কৃপা সুখ চাকমা
২১. আনন্দ বাশী চাকমা
২২. সুবিলাশ চাকমা
২৩. রঞ্জিত দেব বর্মন
২৪. কং জয় মারমা
২৫. অাক্য মগ
২৬. প্রীতি কুমার ত্রিপুরা
২৭. প্রভুধন চাকমা
২৮. ইউ কে চিং বিবি
২৯. মাংশৈ প্রু মারমা
৩০. মংশৈহ্লা মারমা
৩১. ধুংছাই মারমা
৩২. হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা
৩৩. করুনা মোহন চাকমা
৩৪. গুলসেন চাকমা
৩৫. বিজয় কুমার চাকমা
৩৬. সাইপ্রু মগ
৩৭. বিজয় কুমার ত্রিপুরা
৩৮. চিত্ত রঞ্জন চাকমা
৩৯. সাথোয়াই মারমা
৪০. ম্নাসাথোয়াই মগ
৪১. মংমং মারমা
৪২. ফিলিপ ‌ত্রিপুরা বিজয়
৪৩. রুইপ্রু মারমা
৪৪. কংচাই মারমা
৪৫. থোয়াইঅং মগ
৪৬. আদুং মগ
৪৭. মংসাথোয়াই মগ
৪৮. থোয়াইঅংরী মগ
৪৯. মংশোয়ে অং মগ
৫০. অাথুইঅং মগ
৫১. মংমংচিং মগ
৫২. মং আফ্রুশী মগ
৫৩. রবি রশ্মি চাকমা
৫৬. নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা
৫৭. সাথোয়াই মারমা
৫৮. করুণা মোহন চাকমা
ইপিআর সদস্যদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের তালিকা—
১. হাবিলদার নলিনী রঞ্জন চাকমা
২. হাবিলদার অমৃত লাল চাকমা
৩. ল্যান্স নায়েক সঞ্জয় কেতন চাকমা
৪. ল্যান্স নায়েক স্নেহ কুমার চাকমা
৫. সিপাহি চিংমা মারমা
৬. ল্যান্স নায়েক মতিলাল চাকমা
৭. সিপাহী চাই থোয়াই প্রু মারমা
৮. সিপাহী থুই প্রু মারমা
৯. সিপাহী কংজা মারমা
১০. সিপাহী মংহলা প্রু মারমা
১১. সিপাহী অ্যামি মারমা
১২. সিপাহী কুল্লিয়ান বম
১৩. সিপাহী জিংপারে বম
১৪. সিপাহী হেম রঞ্জন চাকমা
১৫. সিপাহী মংচিনু মারমা
১৬. সিপাহী বুদ্ধিমান ছেত্রী
১৭. সিপাহী রমণীরঞ্জন চাকমা
১৮. সিপাহী উক্যজিং মারমা ( বীর বিক্রম)
১৯. সিপাহী লাল পুম বম
২০. নায়েব চিংড়ু মগ
২১. ল্যান্স নায়েক অরুন মগ
২২. ল্যান্স নায়েক অরিন্দ্রা ত্রিপুরা😢😢
উল্লেখিত ৮০ জন ছাড়াও আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যাদের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। কিছু আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাকে সরকার এখনো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন নব গঠিত শান্তিবাহিনীতে যোগদান করে স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের সময় নিহত হয়, ফলে অনেক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার নাম সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়।
মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়ি আদিবাসীদের এই চরম আত্মত্যাগের যথাযথ স্বীকৃতি দেয়ার পরিবর্তে তাদের নিয়ে তৈরি করা হয় বিভ্রান্তি। এমনি তাদের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসকে অস্বীকার করে তাদের আত্মত্যাগকে খাটো করে দেখা হয়। এখনো অনেক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। "মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী" বইয়ের তথ্য মতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক আদিবাসী যুদ্ধে শহীদ হয়। কিন্তু তাদের অনেকেই তাদের প্রাপ্য সম্মান পাওয়া তো দূরের কথা শহীদের তালিকায় তাদের নাম পর্যন্ত আসেনি।😢😢
মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাঙ্গালি জাতির জন্য এটা চরম লজ্জাও বটে।
»কালেক্ট ফ্রম--- পাহাড়ী রেডওয়াইন।

সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

নির্যাতনের অপরাধে স্ত্রীকে ৩৩ লাখ টাকা ক্ষতিপুরণ; চাকমা রাজার রায়

 


চাকমা রাজ কার্যালয়ে এক স্ত্রীর করা অভিযোগের ভিত্তিতে বিবাদী (স্বামীকে) দোষী সাব্যস্ত করে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা ক্ষতিপুরণ প্রদানের আদেশ দিয়েছে রাজ কার্যালয়ের চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়।

বনরূপার ত্রিদিব নগর নিবাসী সোমেশ তালুকদারের পুত্র সুদীপ তালুকদার (জিতু)  তার সাবেক স্ত্রী বিথী চাকমাকে এ ক্ষতিপুরণ   প্রদান করতে হবে।

জিতুর সাবেক স্ত্রী রাজবাড়ির বাসিন্দা বিথী চাকমা ২০২২ সালের ১ জুন রাজ কার্যালয়ে এ অভিযোগ করেন।

এ অভিযোগের ভিত্তিতে তিনটি শুনানীর পর সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩) দুপুরে এ রায় দেন রাজা দেবাশীষ রায়। রাজার পক্ষ হয়ে রাজ দরবারে এ রায় পড়েন রাজ কার্যালয়ের সচিব সুব্রত চাকমা।

রায় ঘোষণার সময় দরবারে বাদী বিথী চাকমা ও তার স্বজন এবং বিবাদী (সুপ্রদীপ চাকমা (জিতু), তার মাতা নমিতা চাকমা উপস্থিত ছিলেন।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, জিতু ও বিথীর ১৪ বছর প্রেম করে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু  বিবাহের ২ মাস পর সম্পর্কের অবনতি হয়।

জিতু এক নারীর সাথে পরকিয়ায় জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে বিথীকে অপমান, অসন্মান, অবহেলা, মানসিক নির্যাতন করেন। পরে ঘরে একা ফেলে কক্সবাজারে টেকনাফে চলে যান। বিষয়টি জিতুর মা নমিতা জানার পরও ছেলের পক্ষে অবস্থান নেন। ফলে এদের দাম্পত্যের জোড়া লাগেনি। জিতু সম্পর্ক বন্ধনে রাজী না হওয়ায় বিথী ক্ষতিপুরণ ও বিবাহ বিচ্ছেদ চেয়ে রাজার কাছে আবেদন করেন।

অভিযোগের সতত্য মিলায় রাজা জিতুকে  সমাজ বিরোধী নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণের জন্য ৫০ টাকা জরিমানা করেন।

এ ছাড়া লাজভার মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতনের অপরাধে ১৫ লাখ টাকা।  বাদীকে সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদা হানির অপরাধে ১০ লাখ টাকা। বিবাহ আনুষ্ঠানিকতার খরচ ৫ লাখ টাকা। বাদীর গৃহত্যাগ হতে এ পর্যন্ত মাসিক ২০ হাজার করে মোট ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা ক্ষতিপুরণ প্রদানের নির্দেশ দেন। এ টাকা আগামী ৬ মাসের মধ্যে এ ক্ষতিপুরণ প্রদান করতে হবে জিতুকে।

এছাড়া বিবাহ প্রদত্ত সকল সোনা গহনা প্রদান। বাদীর অন্যত্র বিবাহ বা আমৃত্যু পর্যন্ত মাসিক ২৫ হাজার টাকা স্বামীকে প্রদানের আদেশ দেন। এ টাকা ব্যাংক অথবা আদালতের মাধ্যমে জিতুকে প্রদান করতে হবে।

রায় শুনে বিবাদীর মা নমিতা চাকমা রায়ের অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বলেন, আমাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।

ঋণের টাকা ছিনতাই নিয়ে পানছড়িতে বিজিবি-এলাকাবাসীর সংঘর্ষ, ১ জন গুলিবিদ্ধ

২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার পুজগাঙ এলাকায় এক পাহাড়ি কর্তৃক ঋণের টাকা পরিশোধ করতে যাওয়ার সময় বিজিবি কর্তৃক টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় বিজিবি ও এলাকাবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। এক পর্যায়ে এক বিজিবি সদস্য কর্তৃক জনতার উপর গুলি করলে একজন আহত হন। এছাড়া বিজিবি কর্তৃক আরেকজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, গতকাল রবিবার (২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩) বিকাল ৪ ঘটিকার সময় বিজিবি কর্তৃক এক ব্যবসায়ীর ঋণ পরিশোধের জন্য পাঠানো ১২ লক্ষ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে এক ব্যক্তিকে আটকের চেষ্টা করলে এ ঘটনা সংঘটিত হয়।
জানা যায়, পানছড়ির ধুধুকছড়া এলাকার সীমানা পাড়া বাসিন্দা ইলা চাকমা, পিতা অনিল চন্দ্র চাকমা নামে এক ব্যবসায়ী কয়েক মাস আগে ব্যবসার জন্য ১২ লক্ষ টাকা ঋণ নেন। তিনি ওই ঋণের ১২ লক্ষ টাকা পরিশোধের জন্য তার ভাইয়ের ছেলে রিন্টু চাকমার মাধ্যমে পানছড়ি বাজারে পাঠাচ্ছিলেন।
রিন্টু চাকমা টাকাগুলো নিয়ে ধূধুকছড়া থেকে পানছড়ি বাজারে যাওয়ার সময় লোগাং বিজিবি জোনের চেকপোস্টে রিন্টু চাকমাকে আটকানো হয় এবং তাকে তল্লাশি করে একটি ব্যাগে ওই ১২ লক্ষ টাকা খুঁজে পায় এবং টাকাগুলো কেড়ে নেয়।
এসময় বিজিবি সদস্যরা রিন্টু চাকমার কাছ থেকে এই টাকাগুলো কার জানতে চান। এতে রিন্টু চাকমা টাকাগুলো ব্যবসায়ের জন্য নেয়া ঋণ পরিশোধের টাকা বলে উত্তর দিলে বিজিবি সদস্যরা তা মেনে না নিয়ে টাকাসহ তাকে আটক করে পানছড়ি থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
এ সময় ভুক্তভোগী রিন্টু চাকমার পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান চন্দ্রদেব চাকমা, লোগাং ইউপি চেয়ারম্যান জয় কুমার চাকমা ও চেঙ্গী ইউপি চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমাকে জানানো হলে তারা বিজিবির সাথে ফয়সালা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিজিবি সদস্যরা তাতে রাজী না হয়ে রিন্টু চাকমাকে আটক করে গাড়িতে তুলে পানছড়ি থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
পরে খবর পেয়ে এলাকাবাসী পুজগাং ব্রিজে বিজিবি সদস্যদের বহনকারী গাড়িটি আটকিয়ে দেন। এসময় বিজিবি সদস্যদের সাথে এলাকাবাসীর কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে হট্টগোল শুরু হলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ চলার এক পর্যায়ে এলাকাবাসী বিজিবির কাছ থেকে ওই ১২ লাখ টাকা ও রিন্টু চাকমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় বলে জানা যায়।

এসময় বিজিবি সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে গুলি চালালে মিকেল চাকমা (২৪) নামে একজন আদিবাসী যুবক পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। মিকেল চাকমা পানছড়ির লোগাঙ ইউনিয়নের বাবুরো পাড়ার লক্ষ্মী চাকমার ছেলে বলে জানা যায়।
এছাড়া পানছড়ির পুজগাঙ ইউনিয়নের দুর্গামনি পাড়ার অমিয় চাকমা ছেলে পুর্ণ রতন চাকমা (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে বিজিবি।
বর্তমানে পুজগাং এলাকায় যৌথ বাহিনী অবস্থান করছে বলে এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে। এতে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
কপি: হিল ভয়েস

 

শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রাম সম্পর্কে পশ্চিম বাংলায় চেতনা জাগ্রত করতে হবে: কলকাতা সেমিনারে তথাগত রায়


পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রাম সম্পর্কে পশ্চিম বাংলায় চেতনা জাগ্রত করতে হবে: কলকাতা সেমিনারে তথাগত রায়


হিল ভয়েস, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: “আপনারা আপনাদের সংগ্রাম করুন। এই সংগ্রামে কিন্তু ভারতকে সামিল হতে হলে পশ্চিম বাংলায় এ সম্বন্ধে চেতনা জাগ্রত করতে হবে।” কলকাতা সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে এই কথা বলেন ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায়।
‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামীকরণ বন্ধ কর’- শ্লোগানকে সামনে রেখে ক্যাম্পেইন অ্যাগেনস্ট অ্যাট্রোসিটিস অন মাইনরিটি ইন বাংলাদেশ (ক্যাম্ব) ও অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্টের যৌথ উদ্যোগে আজ শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) অপরাহ্ন ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত “মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন” বিষয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার ফাইন আর্টস একাডেমিতে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন ক্যাম্ব-এর ড: মোহিত রায় এবং সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্টের জয়েন্ট কনভেনার সুজিত শিকদার।
সম্মেলনে বক্তব্য রাখনে ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায়, বার্ক-এর প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. যিষ্ণু বসু, সিএইচটি পিস ক্যাম্পেইন গ্রুপের করুণালংকার ভিক্ষু প্রমুখ। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল কমিটির সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম কুমার চক্রবর্তী সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।
সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায় বলেন, বাঙালিরা পৃথিবীর সমস্ত জিনিস নিয়ে ভাবে। ভিয়েতনাম, কিউবা, নিকারাগুয়া, গাজা- কত রকম জিনিস নিয়ে আমরা ভাবি! শুধু আমাদের নিকটতম যারা আত্মীয়, অর্থাৎ বাংলাদেশের যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ হিন্দু বাঙালি এবং অন্য যারা আছেন, যাদের জন্য আজকের এই সেমিনার আয়োজিত হয়েছে, অর্থাৎ চাকমা এবং অন্যান্য জনজাতি রয়েছেন, এদের সম্পর্কে আমরা কম জানি। কিউবা থেকে আরম্ভ করে এত দেশের লোকেদের সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চিন্তায় ঘুম নেই, চুলচেরা বিশ্লেষণ, অথচ তাদের নিকটতম আত্মীয়- এদের সম্পর্কে কোনো চিন্তাই নেই।

তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই। আমি সাধারণভাবে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ এবং অবিভক্ত বাংলা, এর আগে ব্রিটিশ বিদায় নেবার আগে অবিভক্ত বাংলার যে লাইন মার্কস আছে, সেই লাইন মার্কসের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, অর্থাৎ হিন্দু এবং তার সঙ্গে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- এদের সম্বন্ধে একটু পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি। মূল বিষয় হচ্ছে এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চেতনা জাগ্রত করতে হবে। তিনি বলেন, আপনারা অতীত ভুলবেন না, আপনারা যদি অতীত ভুলে যান তাহলে আপনারা আবার সেই যন্ত্রণা ভোগ করবেন।
সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের পরিবর্তে সরকার অতি সুক্ষ্ম কৌশলে রোহিঙ্গাসহ সমতল জেলাগুলো থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী বসতি প্রদান করে চলেছে। মুসলিম সেটেলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসনের পরিবর্তে সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ করে জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখলে মদদ দেয়া হচ্ছে। আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে এখনো সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো হস্তান্তর করা হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিগত ২৬ বছরেও এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের স্বশাসন ব্যবস্থা এখনো যথাযথভাবে গড়ে উঠেনি।
শ্রী তালুকদার আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ তথা অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে সুরক্ষা দিতে হলে জুম্ম জনগণকে পার্বত্য চট্টগ্রামে টিকে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ দেয়া; পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুটিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে তুলে ধরার মাধ্যমে জনমত গঠন করা ও সারাবিশ্বে প্রচার ও জনমত গঠনের কাজ জোরদার করা এবং জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করার প্রস্তাব রাখেন।
ঢাবি শিক্ষক ড: মেসবাহ কামাল বলেন, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বর্তমান সরকার। আজ তারা ক্ষমতায়, কিন্তু ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি। চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় ৯২,৫০০ পরিবার মানুষ তাদের নিজেদের জায়গায় ফিরে যেতে পারেনি। আমি মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীদের সংগ্রামও অত্যন্ত ন্যায্য সংগ্রাম। কারণ বাঙালিদের সংগ্রাম যদি ন্যায্য হয়ে থাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রামও ন্যায্য। বাঙালি তার ন্যায্য অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছিল যুদ্ধ করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণেরও তার আত্মপরিচয়ের অধিকার ন্যায্য অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে বলেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী, এটা একেবারে ডাহা মিথ্যা কথা।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতি কখনো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়নি। তারা চেয়েছিল সংবিধানের মধ্যে তাদেরকে একটু জায়াগা দেওয়া। বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যে তাদেরকে জায়গা দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে দেশের জনগণ সবাই বাঙালি। এমনকি বাংলাদেশের মধ্যে বসবাসরত ৫০টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে নাম দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। বাংলাদেশ সরকার সমতল থেকে ৫ লক্ষ বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়ে সেখানে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করাতে লাগল। সেই বাঙালিদের দিয়ে স্থানীয় পাহাড়িদের উপর হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং জমি দখল করতে লাগল। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ কী করবে, জীবন বাঁচানোর জন্য তখন সেদিন প্রতিরোধে নেমেছে এবং জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিরোধ, নিজের আত্মপরিচয়কে রক্ষার জন্য প্রতিরোধ ন্যায়সঙ্গত। যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত হয় তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের যুদ্ধও ন্যায়সঙ্গত।
ড. যিষ্ণু বসু বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম যদি সত্যিই তার স্বকীয়তা হারায়, তার মানে এটা ইসলামী মৌলবাদের আখড়ায় পরিণত হবে। তাহলে এই উপমহাদেশের সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনবে। ভারতবর্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অরুণাচলে এবং অন্যান্য জায়গাতে যারা এসেছেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। একটা মানুষ তার জাতির প্রতি অন্যায় ও অন্যায্য আচরণ কখনোই মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে পারে না বলেই তারা প্রতিবাদ করে, আন্দোলন করে।
তিনি আরো বলেন, আজকে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তখন মনের ভেতরে ভয় কাজ করে। এতক্ষণ পর্যন্ত ঊষাতন বাবু তার বক্তব্যে তাদের মা-বোনদের উপর নিদারুন অত্যাচারের কথা বলেছেন তা ভাষায় বলার নয়। আমার জানা মতে ইংরেজ শাসনামল থেকে তাদের খ্রীস্টান ধর্মে ধর্মান্তর করার চেষ্টা করা হলেও তাদের খুব কম সংখ্যক লোককে ধর্মান্তর করা সম্ভব হয়েছে। কতটা নিজের জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, সংস্কৃতি মনের গভীরে গ্রোথিত রয়েছে, ভালবাসা রয়েছে সেটা তা বোঝা যায়। বাংলা বাংলাভাষি মানুষ যদি মনে করে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই চুক্তিকে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, তাহলে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সেই বিষয়ে সমর্থন প্রকাশ করা প্রয়োজন। রাস্তায় নেমে আমাদের সংগঠিতভাবে এই কথা বলতে হবে, সেই দিন আজকে এসেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির গৌতম দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ভূমি কমিশন কাজ করার জন্য যে বিধিমালাটা দরকার, এখনো পর্যন্ত সেই বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ আটকে আছে। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য টাস্ক ফোর্স করা হয়েছে। ১২ হাজার পরিবার ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী এবং ৯০ হাজার পরিবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু রয়েছেন। ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার পরিবারের মধ্যে ৯ হাজার পরিবারকে তাদের ভূমি ফেরত দেয়া হয়নি। ৯০ হাজার পরিবারের কাউকে এখনো পুনর্বাসন করা হয়নি, কোন রেশনও দেয়া হচ্ছে না। অথচ সামরিক শাসনামলে আমাদেরকে ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সংখ্যালঘু করার জন্য বাইরে থেকে যে বাঙালি মুসলমানদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আনা হয়েছে তাদেরকে এখনো পর্যন্ত রেশন দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন তো হচ্ছেই না, বরং সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে। পর্যটনের নামে জুম্মদের ভূমি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। সীমান্ত সড়ক দিয়ে জুম্মদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
নির্ধারিত আলোচকদের আলোচনা শেষে সাংবাদিক ও অংশগ্রহণকারী অনেকে মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এসময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে গৌতম দেওয়ান ও মেসবাহ কামাল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। সম্মেলনে প্রায় ১৫০ জনের মতো লোক অংশগ্রহণ করেছেন বলে আয়োজক সূত্রে জানা গেছে।

রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২৩

ভারত অনেক কিছুতে সফল হলে আমরা পারি না কেন? অনুরাগ চাঙমা

 

১৯৪৭ সালের আগে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক আইডেন্টিটি একই ছিল। আমাদের এই তিনটি দেশের কালচারও একই। ইতিহাস একই। জিওগ্রাফি এবং ক্লাইমেট একই। এসব অনেক কিছুতে মিল থাকার পরও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত অনেক কিছুতে (যেমন, সম্প্রতি চন্দ্রযান উৎক্ষেপণ) সফল হচ্ছে। কিন্ত, আমরা পারছি না কেন? Multivariate Perspective থেকে এই একটি প্রশ্নের অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে। অনেক Variable নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা যেতে পারে, যদিও আমি Institutionalist Perspective থেকে আলোচনাটা সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।

এক
পড়ে নিতে পারেন Why Nations Fail: The Origin of Power, Prosperity and Poverty বইটি। এই বইয়ের মূল আর্গুমেন্ট হল একটি দেশের উন্নতি নির্ভর করে শক্তিশালী Political Institutions এবং Economic Institutions গড়ে তোলার উপর। এজন্য একটি দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন “Institution, Institution, Institution”। Daron Acemoglu এবং James A. Robinson-দের এই আর্গুমেন্টের উপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে, ভারত উপমহাদেশের এই তিনটি দেশ সমানভাবে Institution Building করতে পারেনি। যার ফলে এই তিন দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অগ্রগতির ক্ষেত্রে তারতম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ, ভারত অনেক ক্ষেত্রে Institution Building করতে পেরেছে। যেটা বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে সম্ভব হয়নি। যেমন ধরুন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে বারবার সেনাশাসন ফিরে এসেছে। আর ভারতে কি জেনারেলরা ক্ষমতা দখল করেছে? এই একটি উদাহরণ কি প্রমাণ করে না আমাদের Political Institution Building কেন ব্যর্থ হয়েছে?
দুই
একটি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে ভারতে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ পি জে আব্দুল কালাম হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। একজন আদিবাসী নারী দ্রুপুদী মুরমু শক্তিশালী ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি। ভাদনগর রেল স্টেশনের একজন চা দোকানের মালিকের ছেলে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এটা কি প্রমাণ করে না সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে যে কেউ মেধা থাকলে সরকার প্রধান হয়ে ভারতকে নেতৃত্বে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে? আর বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণ করে কে? Political Dynasty, তাই না? একজন চা দোকানের মালিকের সন্তান, একজন রিকশাওয়ালার সন্তান, একজন সাধারণ কৃষকের সন্তান এবং একজন আদিবাসী পরিবারের সন্তান কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে? কিন্ত এটা ভারতে সম্ভব হয়। অস্ট্রেলিয়াতে সম্ভব হয়। বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রে সম্ভব হয়। কেন হয়? এসব দেশে পলিটিক্যাল লিডারশীপ নির্ধারণ হয় কোয়ালিটি দেখে। আর আমরা ফোকাস করি Political Dynasty উপর। বুঝতে পারছেন, বাংলাদেশে Political Institution Building হচ্ছে না কেন? তাই, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত অনেক কিছুতে সফল হলেও আমরা কেন পারছি না তার মূলে আছে আমাদের Institution Building-এর ব্যর্থতা।
তিন
আরেকটু পিছনে ফিরে যায়। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা গ্রহণের আগে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন শিখ পরিবারের সন্তান ডঃ মনমোহন সিং। বাংলাদেশে কি এটা সম্ভব হতে পারে? ডঃ মনমোহন সিং পড়ালেখা করেছেন পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি এবং ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে। ভারতের অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পিএইচডি শেষ করে তার কর্মস্থল পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসিবে যোগদান করেন। কাজ করেছেন জাতিসংঘেও। অধ্যাপক হিসিবে পড়িয়েছেন দিল্লি ইউনিভার্সিটির দিল্লি স্কুল অব ইকোনোমিকস-এ। এরকম একজন প্রথিতযশা এবং প্রজ্ঞাবান একাডেমিশিয়ান ভারত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। যেমন, সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর, পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান, Ministry of Finance-এর সচিব এবং ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান। আর বাংলাদেশে কি এটা ২০২৩ সালে সম্ভব হবে? সর্বশেষ নবম পে-স্কেলটা দেখুন। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে কিভাবে নিচে নামিয়েছে? এসব করে কি দেশের কোন লাভ হচ্ছে? Institution Building করতে হলে তো আপনাকে Right person in right place-এ নিয়োগ দিতে হবে। এই Institution Building-এ সফল হতে হলে ভারতের মত নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিশিয়ানদের থেকে আসতে পারে। আমাদের ক্যাডার সার্ভিস থেকে আসতে পারে। স্কুল এবং কলেজ শিক্ষকদের থেকে আসতে পারে। চিকিৎসকদের থেকে আসতে পারে। প্রকৌশলীদের থেকে আসতে পারে। It should be open, merit-based, and competitive।
মনে রাখতে হবে, সবায় তো আর ক্যাডার সার্ভিসের পরীক্ষা দেয় না। ধরুন, বাংলাদেশের যে ছেলেটি অথবা মেয়েটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। সে তো আর বিসিএস দেবে না। কিন্ত দেশের উন্নয়নে তো তার মেধা এবং স্কিল ব্যবহার করার প্রয়োজন আছে। তাকে সেই সুযোগ দেশকে দিতে হবে। যেটা ভারত করেছে। যেমন, ডঃ মনমোহন সিং তো আর ভারতের সিভিল সার্ভিসের ক্যাডার থেকে আসেনি। কিন্ত তিনি ভারতের Ministry of Finance-এর সচিব ছিলেন। আরকটি উদাহরণ যোগ করি। Gideon Rachman- এর লেখা “The Age of the Strongman: How the Cult of Leader Threatens Democracy around the World” বইটি পড়তে গিয়ে দেখলাম সেখানে Modi – Strongman Politics in the World’s Largest Democracy (2014) শিরোনামে একটি চ্যাপ্টার আছে। এই চ্যাপ্টারের ৭৯ পৃষ্টায় গিয়ে আমার চোখ আটকে যায়। ২০১৩-২০১৬ সময়ে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর হিসিবে দায়িত্ব পালন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Raghuram Rajan। আরও দেখতে পারেন ভারতের Asoka University ওয়েবসাইটটি। কি মানের শিক্ষক এখানে গবেষণা এবং পাঠদান করে? কিভাবে ভারত Institution Building করেছে তা বুঝানোর জন্য এসব উদাহরণ টানলাম। তাই, তাদের চন্দ্রযান চাঁদের মাটি স্পর্শ করবে তাতে অবাক হওয়ার কি আছে?
চার
বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে দরকার “Institution, Institution, Institution”। এই যে দেশের শেয়ার বাজার, ডিমের বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আমলাতন্ত্র, নির্বাচন এবং পার্লামেন্ট কোন কিছুই Effectively কাজ করছে না। কোন জায়গাতে জবাবদিহিতা নেই। স্বচ্ছতা নেই। সব কিছুই Politicised হয়ে গেছে। এসবে ফোকাস না করে ভারতের চন্দ্রযান-৩ নিয়ে আলোচনা করার দরকার আছে কি?

শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০২৩

৪৮ আন ইক্কুলত কন’ জনে পাস ন’ গরন

এ বঝর এসএসসি সমমানর পরিক্কে রেজাল্ট ফগদাঙ গরা অয়ে। এবার   ৮০.৩৯ শতাংশ পাস গরিলেও  ৪৮আন ইক্কুললত একজনও পাস ন’ গরন সে খবর পা যেল।  

শুক্কবার ২৮ জুলাই এসএসসি সমমানর পরিক্কে রেজাল্ট ফগদাঙ নিনেই সংবাদ মিলনি খলা জুগল গরে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

 

রেজাল্ট দেঘা যিয়ে, এ বঝর ২৯ হাজার ৭১৪আন হাই ইক্কুল সরিত অয়। এ সেরে শতভাক পাস গচ্ছে ইক্কুল ২ হাজার ৩৫৪ আন ইক্কুলর পর্বোয়া। অন্নো কিথ্যাদি ৪৮ আন ইক্কুলত কন’ জনে পাস ন’ গরন।

এ বঝর জিপিএ-৫ পিয়োন ১,৮৩,৫৭৮ জন। গেল্লে বঝর জিপিএ-৫ পিয়োন ‍২৬৯৬০২ জন পর্বোয়া।

এ বঝর  ১১আন শিক্ষা বোর্ডর ২০, ৭৮ ,২১৬ জন পর্বোয়া এলাক। এ সেরে  ১০,২৪, ৯৮০ জন আ ঝি ১০,৫৩,২৪৬ জন পার্বোয়া এলাক।

তথ্য: আরটিভি

 

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...