রবিবার, ৩০ জুন, ২০২৪

পাহাড়ি ফুল (এক অচেনা যুদ্ধের কাহিনী): চৌধুরী আহসান

বাবুছড়া ক্যাম্পের অপরিসর আঙিনায় সৈনিকরা জলপাই রঙের ম্যাট বিছিয়ে রাইফেল পরিষ্কারে ব্যস্ত। প্রতিমাসে একবার গোটা ক্যাম্প জুড়ে চলে পরিষ্কার ঘষামাজার কাজ। এই শত্রুপুরীতে সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু মিলিমিটার চাইনিজ রাইফেল সৈনিকদের একমাত্র ভরসা। বুট, রাইফেল, রুটি এই তিন ঠিক তো সৈনিক ঠিক। একবেলা ভাত না খেলেও সই কিন্তু এক মুহূর্ত রাইফেল ছাড়া থাকা বিপদজনক।

হাবিলদার মন্তাজ মিয়া কাঠের টুলে বসে সৈনিকদের তদারকি করে। দুপুরের মিঠা রোদে ঝিম ধরে আসতে চায়। ঝিম ধরলেও সৈনিকদের একরত্তি উপায় নেই ওর চোখকে ফাঁকি দেয়। ফাঁকি দিবেই বা কেমন করে? তিরিশ বছরের চাকুরি জীবনে মাসের-পর-মাস, বছরের-পর-বছর এই কাজেই তো দিন গুজরান

করলো। এ্যাই! রমজান এতো তাড়া কিসের, ট্রেন ধরবি নাকি? দেখি তোর ব্যারেলটা? হাবিলদার মন্তাজ আলোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বাম চোখ বন্ধ করে নানাভাবে উল্টেপাল্টে দেখে। আরও পরিষ্কার হবে রে। হাবিলদার মন্তাজ নিজেই ক্লিনিং রড উঠিয়ে তাতে যত্নের সাথে সাদা ফ্লানেল কাপড় জড়ায়। দেখিয়ে দেয় যুতসই পরিষ্কার করতে হয় কেমন করে। নো তাড়াহুড়া, রাইফেল পরিস্কার করতে হয় ধীরে সুস্থে মহব্বতের সাথে। বিবির গায়ে যখন হাত লাগাস তখন যেমন মহব্বত দেখাস আর এই রাইফেলে হাত দিতে হয় ওর চেয়ে দশগুণ মহব্বতের সাথে। বিবি নারাজ হলে বড়জোর খানায় নুন হবে না বা রাতে শোয়ার সময় গাইগুই করবে কিন্তু অস্ত্র নারাজ হলে প্রাণে মরবি তো ছাগলের দল। হাবিলদার মন্তাজ হাসতে হাসতে বলে। এই উদাহরণ ইতিপূর্বে তারা দীর্ঘ চাকুরি জীবনে বহুবার দিয়েছে। মেয়ে মানুষের কথায় সৈনিকদের মনে আনন্দ আসে আর ফুর্তি না এলে কাজও যে হয় লাউজাবরা।

 ২

আওরত আল্লাহপাকের এক আজব সৃষ্টি না থাকলে জীবন শুখা সাহারা আর থাকলেও জীবন বরবাদ। পারলো ওর ঘর ওয়ালীকে ধরে রাখতে। হাবিলদার মন্তাজ কিঞ্চিৎ বিষণ্ণতা বোধ করে। আওরত আসবে আওরত যাবে মরদেব কষ্ট সে তো জোয়ারের পানি। পাত্তা দিলে চলে না।

ওস্তাদ-কাকে বিবির গল্প শোনান, ওতো বিয়াই করেনি।

সিপাই মনির হোসেন মাথা না তুলেই বলে। বিয়া করেনি তাতে কি মাগীর গায়ে হাত দেয়নি বলতে চাস?

সিপাই রমজান নেত্রকোনার কেন্দুয়ার ছেলে, নতুন রিক্রুট, ট্রেনিং শেষে হিলে

পোস্টিং নিয়ে এসেছে। লজ্জায় রমজানের মাথা একটু নুয়ে আসে। কিরে রমজান এখনও বললি না আওরত ধরতে কেমন?

সৈনিকদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়। সৈনিকেরা সমস্বরে বলে, বল রমজান বল। রমজানের মাথা আরও নুয়ে আসে ও ধীর হাতে ম্যাগাজিনের রিসিভার ক্যাচে তেল মাথায়।

থাক অনেক হয়েছে বেচারাকে ক্ষান্ত দে। তোদেরকে বরং একটা সওয়াল পুছি। ঠিক ঠিক ভেবে জওয়াব দিবি। মন্তাজ বলে।

সৈনিকেরা এ ওর মুখের দিকে তাকায় চাওয়া-চাওয়ি করে। ধরার চেষ্টা করে ওস্তাদ কোন লাইনে কথা বলতে চায়। বলতো সৈনিকে যোগ দেয় বাপ মায়ের কোন পোলা? কারও মুখে রা নেই। সৈনিকদের আটকাতে পেরে হাবিলদার মস্তাজের কৃতকতে চোখ জোড়া আনন্দে আরও ছোট হয়ে আসে। মন্তাজ জানে কেউ পারবে না। আগেও কেউ পারেনি। আর পারবে কি করে ছ'আনি বিদ্যা আছে ওদের আর বিদ্যা থাকলে কেউ জওয়ান হয়। জানতাম পারবি না শূয়োরের দল। আর্মিতে আসে বাপ মায়ের সবচেয়ে জাউরা পোলা। সৈনিকেরা হা-হা করে হাসে। ঠিক বলেছেন ওস্তাদ ক্ষেতি বাড়ি ছেড়ে এই মরার পাহাড়ে জাউরা পোলা

ছাড়া আর কেউ আসে নাকি? ল্যান্স নায়েক মঞ্জুর বলে। ওস্তাদ মাইয়া মানুষের কথা তুলে দিলেন তো সব মাটি করে। এখন হাত তো নিসপিস করছে, থামাই কেমনে। সিপাই গোলজার বলে। গোলজারের বাড়ি দিনাজপুরের চিরির বন্দর। ওকে সবাই জোকার হিসাবে জানে। গোলজারের কথায় সায় দেয় কেউ কেউ, অন্যরা খ্যাক খ্যাক করে হাসে। এই বনবাদাড়ে প্রতিদিন মৃত্যু আর ভয় নিয়ে সিঁটিয়ে থাকলে তিন মাসও টিকতে হবে না কারও। তাই সবাই নানা ছলে ভুলে থাকতে চায় মৃত্যু নামক দিন রাতের ভয়ংকর খেলা। নানা ছলছুতায় নিজেদের মাতিয়ে রাখে।

 ৩

চিন্তা করিস না। বেঁচে থাকলে তোর হাতের নিসপিসানিওএই পাহাড়ে বন্ধ করার ব্যবস্থা আছে। হাবিলদার মন্তাজ কথা শেষে ডান চোখ টেপেন।

এই পাহাড়ে, ওস্তাদ যে কি বলেন? গোলজার মন্তাজকে উসকিয়ে দেয়। তার এই বিষয় ছেড়ে অন্য নীরস বিষয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা ওর নেই। বীজ ছাড়া দই জমে না আর মেয়ে মানুষ ছাড়া কি পুরুষের কথা জমে?

ওস্তাদ যা বলে ঠিকই বলে। মানুষ পারে না এমন কিছু নাই। চেষ্টা থাকলে বাঘের চোখও মেলে আর সেখানে মেয়ে মানুষ। বনজঙ্গল তাতে কি? বনেও পাহাড়ি ফুল ফোটে রে গোলজার। হাবিলদার নিজের রসিকতায় নিজেই অবাক হয়। এত যুতসই উত্তর দিতে পারবে ও ভাবেনি। কথাটা মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এই হাতে কত মেয়ে ঘেটেছে তাদের চেহারাও আজ মনে পড়ে না। সৈনিকের শরীর গরম তো বুদ্ধি নাশ আর বুদ্ধি নাশ হলেই সর্বনাশ। যেখানে প্রতিদিন বাঁচা মরার লড়াই চলে সেখানে হতে হয়, শিয়ালের মতো ধূর্ত আর শশকের মতো সাবধানী।

এই ছোকরা তোর নামটাই খালি বারে বারে ভুলে যাই। হাবিলদার মন্ডাজ শান্ত আলাভোলা চেহারার নতুন সৈনিককে লক্ষ্য করে বলে। দেখি তোরটা কেমন পরিষ্কার হল?

ওস্তাদ আমার নাম মুজতবা আরমান শাহ।

ওরে বাবা নাম তো দেখি ঢকের সাহেবী নাম। তা জনাবের বাড়ি কোথায়?

ওস্তাদ মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট।

ও মোড়েলগঞ্জের ঘোড়েল বাবু তুমি। আমার সিক্সপাশ মুখে তোর কেতাবী নাম উঠবে না, দাঁত নড়ে যাবে। আমি তোকে মোস্তফা বলেই ডাকবো। আজ মন্তাজের হলো কি, ওকে নিশ্চয় কাব্য রোগে পেয়েছে। কাব্য বেরাম তো জানি বেকারের হয়। ওর মতো খাটুয়া সৈনিকের ধারেও ঘেঁষার কথা না। লক্ষণ ভালো না। পাহাড়ে লক্ষণ খারাপের মানে তো একটাই। হাবিলদার মন্ডাজ কিছুটা আনমনা হয়।

মুজতবা দায়ে পড়ে আর্মিতে ঢুকেছে। গত বছর এস.এস.সিতে তিনটা লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল। বাপহীন পাঁচ ভাই বোন মামার সংসারে মানুষ। যেখানে প্রতিদিনের আহার জোগানোই সাধ্যাতত সেখানে লেখাপড়া তো বিলাসিতা। মঞ্জু আর পাস দিয়ে কি করবি? আর পাঁচ সাত বছর পড়েও তো সেই চাকরিই খুঁজতে হবে বরং লাইনে দাঁড়িয়ে যা। কিসমতে থাকলে এই লাইনেও উন্নতির সুযোগ আছে। মামা বলেন। মামাই নিয়ে এলেন বাগেরহাট সরকারি কলেজের মাঠে। কি ভিড়! চারিদিকে থই থই মানুষ। এত মানুষের চাকুরি দরকার, অন্যদের মতো সেও দাঁড়িয়ে পড়লো লাইনে। অফিসার গোছের লোকটা বেতের লাঠি হাতে লাইনের পাশে হাঁটে আর পিছনে ফাইল নিয়ে হাঁটে বিশাল ভয়ংকর চেহারার লোকটা। মানুষটা যেমন ঝিম কালো তেমনি কুৎসিত। মুজতবা তার সাতজন্মে এত কালো লোক দেখেনি।

ছেলেরা সব খালি গায়ে বুক উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অফিসার হেঁটে যাওয়ার সময় কাউকে লাঠি দিয়ে ছুঁতেই ভয়ংকর দর্শন লোকটা বুকে থপাস করে সিল মারে। ওর বুকেও সিল পড়তে জীবনটা যেন মুহূর্তেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল। মামা ওকে জড়িয়ে ধরেন। ওরে মজু বেঁচে গেলি আর চিন্তা নাই। তোর জন্য দু'রাকাত নফল নামাজ মানত করেছিলাম। আল্লাহ পাক গরিবের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। আর্মির আর সেই দিন নেই রে মজু ওরা এখন সকাল বিকাল বিদেশ যায়।

মুজতবার সম্বিত ফিরে আসে। ব্যারেলে তেল লাগায়। এই বনে মুজতবা আর মোস্তফায় কিছু যায় আসে না। তাছাড়া এখানে ওর আলাদা অস্তিত্বের কিইবা প্রয়োজন। খুলনার মাসুদ, বরিশালের সাইফুল, যশোরের নীতিশ সব উর্দির আড়ালে চাপা পড়ে যায়। তখন ওরা সবাই নামহীন, গোত্রহীন, বিশেষত্বহীন সৈনিক। হুকুমের দাস। এই পাহাড়ে কত সৈনিক এল আর গেল। কেউ মরে গুলিতে আর কেউ মরে ম্যালেরিয়ায়। কে রাখে কার খোঁজ। সৈনিক যেদিন গায়ে উর্দি চাপায় সেই দিনই বিবেক, মানুষত্ব ডানা মেলে উড়ে যায়। তাছাড়া বিবেক আর মানুষত্ব থাকলে আর যাই করা যাক মানুষ মারা যায় না।

 ৪

সৈনিকরা ভোর হতেই কাজে নামে। কেউ শাবল, গাঁইতি দিয়ে ব্যস্ত ট্রেক কাটায়, কেউ বস্তায় বালি ভরে ডিফেন্স ওয়াল গড়ে আর কেউ খোদে ফক্সহোল। শান্তিবাহিনীর দৌরাত্ম্য দিনের পরদিন বেড়েই চলেছে তাই এই অতিরিক্ত সাবধানতা। তালে তালে গাইতি-শাবল উঠানামা করে যেন এর মধ্যেও কেমন জানি ছন্দ আছে। সৈনিকদের পিচ্ছিল শরীর হতে দরদরিয়ে ঘাম ঝরে, শক্ত পেশি আরও ফুলে উঠে। পিঠের ঘাম কণাগুলো ভোরের কমলা আলোয় ঝকঝক করে। সৈনিক আর ইস্পাতের ছুরি হলো একই জাতের অব্যবহারে ধার কমে, মরিচা জমে। সৈনিকদের রাখাও হয় সবসময় কাজের উপর। শুয়ে বসে থাকলে শরীর ভারী হয়, গিঁটে গিঁটে বাত জমে। শুধু কি তাই অলস মন শয়তানের কারখানা, কোনে না কোনো হুজ্জত বাঁধায়। তাছাড়া এতগুলো জোয়ান মরদ দিনের পর দিন কাজ ছাড়া বসে থাকেই বা কি করে?

কাজ নাই তো ঘাস কাট না হলে একখানের গর্ত খুঁড়ে অন্যখানের গর্ত ভর, তবুও বসিয়ে রাখা যাবে না। হাবিলদার মন্তাজ জানে ওদেরকে কিভাবে ব্যস্ত রাখতে হয়। ও শিপডগ ভেড়ার পালদের আগলে রাখাই ওর কাজ; একটু চোখ সরিয়েছো তো মরেছো; কোনো না কোনো অনর্থ বাঁধিয়ে ফেলবে। এতকিছুর পরও এই কাঁচা বয়সের ছেলেগুলোর জন্য সে গভীর মমত্ব অনুভব করে। সামান্য কিছু টাকা আর দুবেলা ভাতের জন্য কোথাকার পোলাপান কোথায় এসে ঠেকেছে। ওরাই তো দিনভর রোদে পুড়ে বাদলায় ভিজে দেশের জন্য যুদ্ধ করছে। ওরা আছে বলেই দেশের বাকি অংশের লোকেরা প্রতি রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যেতে পারে। সৈনিকরা কেউই জানে না প্রাণ নিয়ে একদিন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে পারবে কী না। এই নিশ্চয়তাহীন জীবন বন্দির জীবনের চেয়েও কষ্টের। এটা তো সত্য এদের মধ্যে কেউ না কেউ কোনোদিনই ফিরবে না। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু। রক্তহীন, মৃত্যুহীন যুদ্ধ বলে কিছু নেই। ওর পরিচিত অনেকেই আজ বেঁচে নেই। নিজ হাতে গোর খুঁদে কবর দিয়েছে কারও কারও। ওদের মৃত্যু মন্তাজ মিয়াকে যে ভাবায় না তা নয়, তবে ও ভাবতে চায় না। ভাবলে কষ্ট বাড়ে; কি লাভ কষ্ট বাড়িয়ে যারা গেছে তারা তো আর ফিরবে না বরং তার সারাদিন মাটি হবে। জালাল, নাসির, মুজতবা, তাপস ক্যাম্পের পূর্ব পাশের ট্রেঞ্চ কাটায় ব্যস্ত।

ভ্যাপসা গরমে নেয়ে উঠেছে সবাই, গেঞ্জি, সর্টস ঘামে জবজব করে। কপাল হতে ঘাম টুপটুপ করে ঝরে শুকনো মাটিতে। শুকনো মাটিও ভিজে কিন্তু হাবিলদার মস্তাজের মন ভেজানো কঠিন। শালার মা বাপের ঠিক নাই; খানকির পোলা- জালাল গালি শেষে একদলা থুতু মাটিতে ছোঁড়ে। মাঝে মাঝে ঘামের নোন্‌তা জল চোখে ঢুকে জ্বালা ধরায়; সাময়িক দৃষ্টি ঝাপসা করে। কাজে ফাঁকি দেওয়ার জো নেই, একজনের কাজের ঘাটতি দলের অন্যদের তা পুষিয়ে নিতে হবে। সৈনিকেরা হাবিলদার মন্তাজের সিটি বাজানোর অপেক্ষায় থাকে। সিটি বাজলেই ব্রেক, তখনই ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর পাবে জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ।

মন্তাজ মিয়া হুইসেল বাজায়। নাসির চটজলদি বিড়ি ধরায়। এত খাটুনির পর যখন মুখ ভরে উঠে নীলাভ ধোঁয়ায় তখন খাটুনিকে আর খাটুনি বলে মনে হয় না। মেজাজ মর্জি ফুরফুরে হয়ে উঠে। বিড়ির প্রতি টানে কষ্টের অনুভূতিগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। বেদনার তীক্ষ্মতাও ভোঁতা হয়ে আসে। বিড়ি আছে বলেই বাঁচা কিছুটা সহজ মনে হয়।

লাগবে নাকি? নাসির মুজতবাকে উদ্দেশ্য করে বলে। রোদে পুড়ে মজুর ফর্সার মুখ লালচে হয়ে উঠেছে। কপাল, নাকের ডগা, পিঠের খাদ বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরে। মজু ডান হাতের চেটো দিয়ে কায়দা করে কপাল হতে ঘাম ঝরায়। বিড়ির গন্ধের মাঝেও ঘুমের ভুকতো নোনা গন্ধ আলাদা করা যায়। ওর গা গুলিয়ে ওঠে। না-না ও চলবে না। মজু বেশি পাত্তা দেয় না। আরে টেনেই দেখ না; মাইরি বলছি ভালো লাগবে। তাপস ওর আধা খাওয়া বিড়ি এগিয়ে দেয়। উহু ভালো ছেলেরে আমার, বিড়ি ফোঁকে না। যেন এখনও দুদু ছাড়েনি। মা

এসে কই মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে লোকমা তুলে দিবে। জালাল টিটকারী মারে।

দেখ জালাইল্যা মায়ের কথা তুলবি তো...। মুজতবা গাঁইতি উঁচিয়ে আসে। আরে আরে করিস কি? নো গাঁইতি-ফাইতি, নো মারামারি। বকোয়াজ বন্ধ রাইট নাও। নাসির মুজতবাকে ঠ্যালা দিয়ে সরায়।

যাদু হিলে যখন এসে ঠেকেছো তখন শালারা এমনিই মরবি। নিজেদের মধ্যে মারামারির দরকার হবে না। নাসির দু'জনকেই জোরে ধমক লাগায়। ওদের গ্রুপে ওই সিনিয়র কিছু ঘটলে ওকেই জবাবদিহি করতে হবে। কে চায় আজাইড়া হুজ্জত

বিড়ি না চললে অন্য ব্যবস্থাও আছে। নাসির প্যান্টের পকেট হতে হাতে মোড়ানো একটা সিগারেট বের করে। তাপসের চোখ জ্বলজ্বল করে, ও জানে ওটা কি?

দোস্ত তোর পায়ে পড়ি আমাকে একটা দিবিই দিবি। তাপস বলে।

নো চিন্তা ডু ফুর্তি। আরও আছে। নাসির তাপসের গাল টেনে উত্তর দেয়। মজু এটা কিন্তু তোকে টানতে হবে। মাইরি বলছি খোদার কসম একদম স্বর্গে পৌঁছে যাবি। শান্তিবাহিনী আর ম্যালেরিয়া পালিয়ে কূল পাবে না। নাসির বলে। নাসির লম্বা দম দেয়। সিগারেটের আগুন তেতে উঠে এক টানেই মাঝ বরাবর। কয়েক সেকেন্ড দম বন্ধ রাখে তারপর জিভ দিয়ে মুখের উপরের তালুতে টাক্ টাক্ শব্দ তুলে বার কয়েক। নাক-মুখ দিয়ে গলগলিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে তাপসের দিকে এগিয়ে দেয়। তাপস এ খেলায় পুরোনো। চোখ বুজে লম্বা টানে এগিয়ে দেয় জালুর হাতে। তাপসের আধবোঁজা চোখ ভালো লাগায় তিরতির করে কাঁপে।

জালু তোর পর দিস তো, আজ সব খাবো। খেয়ে শালা মারা যাবো। মজুর কথায় সবাই খ্যাক খ্যাক করে নেশার হাসি হাসে।

ছেলে দেখি একদিনেই সাবালক হয়ে উঠেছে। জালাল কথা শেষে দাঁতের ফাঁক দিয়ে কৌশলী ভঙ্গিতে পিচকারী দিয়ে থুতু ফেলে।

এতে কেউ মরে না। তুইও এত সহজে মরবি না বরং আমরা তোর বাঁচার ব্যবস্থা করছি। তাপস বলে। মুজতবা লম্বা টান দেয়। থক্ থক্ করে কাশে। বুক ধরে মাটিতে বসে পড়ে।

কি যে ছাইপাস খাস তোরা। মুজতবা ফেলে দিতে উদ্যত হয়। না না খবরদার। তাপস একরকম ওর হাত হতে কেড়েই নেয় সিগারেটের প্রায় শেষাংশ।

এক দমে কেষ্ট নষ্ট, দুই দমে স্বর্গলাভ। আজ তোকে স্বর্গ না দেখিয়ে ছাড়ছি না। ধীরে ধীরে লম্বা টানে ধোঁয়া গিলে ফেল তারপর ছাড়বি দমে-দমে, থেমে- থেমে। তাপস দেখিয়ে দেয়।

মজু বাধ্য ছাত্রের মতো অনুসরণ করে। ওর মাথা হাল্কা হয়ে উঠে। চোখে নামে চুলটুলানী ভাব। কেমন জানি চিন্তাহীন, অদ্ভুত ভালো লাগা। এটাই তাহলে নেশা। নিজেকে প্রথমবারের মতো স্বাধীন পূর্ণ যুবক মনে হয় ওর। এই

ভাবলেশহীন মেকী আত্মবিশ্বাসকে ও তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চায়। 

 ৫

মন্তাজ মিয়ার নেকড়ের নাক। বুঝতে পারে সৈনিকরা কি ধরিয়েছে? খাও বাবা খাও; জী ভরকে খাও। খাবে না তো কি করবে? এই পাণ্ডব বর্জিত শত্রুপুরীতে নার্ভ ঠাণ্ডা করতে না জানলে বাঁচার কোনো উপায় নাই। সেও খায়। তবে ও পারতপক্ষে সৈনিকদের সামনে ধরায় না। গ্যাপ রাখতে হয়, গ্যাপ না থাকলে বাঁদর মাথায় চড়তে দেরি করবে না। ও ধরাবে রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন। বাঁশের বেঞ্চিতে শুয়ে তারায় তারায় ভরা খোলা আকাশের নিচে। চাঁদের মায়াবী অস্ফুট ধোঁয়াশে আলোয় ও ডুবে ডুবে একটু একটু করে টানবে। ওই সময় ওর বড়ো কাঁদতে ইচ্ছা করে। ও জানে না ও কার জন্য, কি জন্য কাঁদে? শুধু জানে কাঁদতে ওর ভালো লাগে। রাত এখন একটা পাঁচ। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। মাঝে সেন্ট্রিপোস্টের

গার্ডদের নড়াচড়ার মৃদু শব্দ, রাতের নীরবতাকে তো ভাঙ্গে না বরং আরও যেন বাড়িয়ে দেয়। কয়েকটা দলছুট বাঁদুর ভারী পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে যায় ক্যাম্পের পশ্চিম সীমানা ঘেঁষে। আজকের আকাশটা বড়ো ফকফকে পরিষ্কার। চাঁদটাও বড়ো করে উঠেছে। মন্তাজ বেঞ্চিতে শুয়ে নিয়মমাফিক টানে। চাঁদের ঘোরটা আজ তাড়াতাড়ি ওকে পেয়ে বসে। মন্তাজ অনুভব করে চোখের কোণা দিয়ে নামে তপ্ত অশ্রুর ঢল। ও টানে আর চাঁদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। মন্তাজ কান্না থামানোর কোনো চেষ্টাই করে না। মানুষ জানে হাসায় সুখ কিন্তু সুখ তো আসলে কান্দনে। বোকা মানুষ শত বাহানায় কান্না লুকায়। মস্তাজ মানুষের না জানা বোকামীতে অবাক হয়।

মন্তাজ তুই কান্দস ক্যান? চাঁদ বলে।

জানি না, তুই জানস? মন্তাজ মিয়া উত্তর দেয়।

হ-জানি। তুই পাপী তাই কান্দস।

মন্তাজ মাথা নাড়ে। একদম হাঁচা কথা। সে জঘন্য পাপী মানুষ। সে চাঁদের কথা মেনে নেয়।

তুই পাপী হলেও তোর মনটা ভালা। আরা যাইহোক তুই জালিম না। চাঁদ বলে। জালিম আর পাপীর পার্থক্য বুঝস? চান্দ জানতে চায়।

না জানি না।

জালিমের চোখে পানি আসে না, পাপীর আসে।

মন্তাজ দ্বিতীয় সিগারেট ধরায়। মনে হয় চান্দখান আরও নিচে নেমে আসে। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে চাঁদের শরীর। ওর বুক উথলে আবার কান্না আসে। মন্তাজ ছোট ছেলের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। বুকের মধ্যে অবয়বহীন চিনচিনে এক কষ্টের অনুভূতি ওকে একটু একটু করে গ্রাস করে। ধীরে ধীরে ওর কান্নার বেগ শ্লথ হয়ে আসে। চাঁদের সীমানা ক্রমশ ভোঁতা হয়ে আসে; এলোমেলো ভাঙচুর চলে। ধীরে ধীরে চাঁদের রূপালী শরীরে ভেসে আসে জরির আবছা মুখ। জরি ওর মেয়ে; দশ বছর আগে শেষবারের মতো যখন দেখেছিল তখন জরির বয়স বারো বছর। লম্বাটে ধরনের শুকনো শ্যামলা মুখে বড়ো বড়ো গভীর কালো চোখ। ও মার চোখ পেয়েছে। বারো বছরের মেয়ের চোখে এতো বেদনা লুকিয়ে থাকে জরির চোখ না দেখলে মস্তাজ মিয়া কোনদিনও জানতো না।

বাবা আমি জরি।

হ্যাঁ মা আমি জানি।

জরি মৃদু হাসে। সামান্যই সেই হাসি। জরির চোখের বেদনাগুলো ঠোঁট গলে চাঁদের ধোঁয়াশে আলোয় মিশে যায়। বাবা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। জরি বলে।

আমি জানি মা। মন্তাজ মিয়া ঈযৎ কেঁপে উঠে।

তুমিও আমাকে খুব ভালোবাসো। এটাও আমি জানি বাবা।

মন্তাজ চোখের কোণায় গরম পানির প্রবাহ অনুভব করে।

বাবা কেন আমাদের দশ বছর দেখা হলো না? জরির চোখ সামান্য সরু হয়।

আমি পারিনি জরি।

কেন পারনি বাবা? আমি তোমার নিজের মেয়ে নই তাই।

জরি জানতে চায়।

তুই আমার মেয়ে। বল তুই আমার মেয়ে। মস্তাজ বলে।

বাবা আমি তো শুধু তোমাকেই বাবা হিসাবে জানি।

তাহলে তুমি রোজ রাতে কাঁদ কেন? জরি প্রশ্ন করে।

জানি না মা। মানুষ মায়ের কষ্ট দেখে বাবার কষ্ট দেখে না।

মন্তাজ মিয়া অস্ফুটভাবে উত্তর দেয়।

মন্তাজ এখন ঘরে যা। ও অন্তর ভালা পাপী মানুষ ঘরে যা।

চাঁদ বলে।

অন্তর ভালা পাপীরা পাপ ছাড়ে না কিন্তু পাপের বিষে কষ্ট পায় আবার ভালোও হতে পারে না কারণ ভালোর কষ্ট ওরা নিতে পারে না। যারে মন্তাজ যা। ঘরে যা। চাঁদ তাড়া দেয়।

মস্তাজ মিয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুম জড়ানো চোখে ঢুলতে ঢুলতে ঘরে ফিরে আসে। চাঁদ ওকে জোর করেই ভাগিয়ে দেয় কারণ আর কিছুক্ষণ পর নামবে চাঁদের ভুলভুলিয়া ঘন সময়। এই সময় মানুষ ঘর ছাড়ে, পাগল হয়, কেউ কেউ পাহাড় হতে লাফ দেয়।

চান্দ চায় না এই পাপী ভালো মানুষটা এখনই শেষ হয়।

 ৬

এখনও সন্ধ্যা নামতে কিছুটা সময় বাকি। হলদেটে আলোয় লালচে আভা কেবল ছুঁয়েছে মাত্র। পাহাড়ে সন্ধ্যা ঝপ করে নামে না গ্রহণের মতো একটু একটু করে বিকালের আলোকে গ্রাস করে। যখন ওয়াইন থং পাহাড়ের চূড়া অপার্থিব গাঢ় কমলা আলোয় মাতবে তখনই সন্ধ্যার পূর্ণ সময়। তারপর ক্রমশ ক্ষয়ের পালা। সন্ধ্যা নামলেই পাখিদের মাঝে কেমন জানি অস্থিরতা কাজ করে। একি শুধুই ঘরে ফেরার তাড়া না অন্য কিছু। একের পর এক পাখির দল দিনের ইতি টেনে ডানা ঝাপটে ফিরে চলে। সব পাখি একসাথে ফিরে না। নানা জাতের ফেরার নানা সময়। কেউ কেউ অপেক্ষা করে সন্ধ্যার শেষ আলো পর্যন্ত। সবাই ফিরলেও ফিঙের যেন কোনো তাড়া নেই। সন্ধ্যার শেষ আলোকটুকু নিঃশেষ হওয়ার পরও কালো পিঠ টান টান করে বসে থাকে বাঁশের ডগায়।

ক্যাপ্টেন জামিলের ঘরের জানালা খোলা। জানালার গা ঘেঁষে কাঠের শক্ত পোক্ত সাধারণ টেবিল। টেবিলের পিছনের হাতল ওয়ালা। ভারী চেয়ারে জামিল বসে আছে। রোজই বসে এই সময়টাতে। জানালা দিয়ে দূরের পাহাড়ের গায়ে আলোর হুটোপুটি খেলা দেখতে ভালোই লাগে। তবে আজ বসেছে অন্য কারণে। চিঠি লিখতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মন মতো হচ্ছে না কিছুই। বুঝতে পারছে না ওর কি লেখা উচিৎ। ঘরের ভিতরে একটু একটু করে অন্ধকার জমে। ওর এখন দেখতে কষ্ট হচ্ছে। জামিল তাড়া অনুভব করে। বুঝে উঠতে পারে না কি লেখা উচিত কারণ মেয়েটার সাথে ওর সম্পর্ক এখনও স্পষ্ট না। না প্রেমিকা না বন্ধু আবার এর মাঝামাঝি যে কিছু তাও দিব্যি দিয়ে বলা যায় না। মেয়েটা ওর চাইতে বছর দুয়েকের বড়ো। টিএসসিতে আসগরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল তখনই পরিচয়। ওরা একই পার্টি করে। যে সমস্ত মেয়েরা রাজনীতি করে ওদের জামিলের একদম সহ্য হয় না। ভাবটা যেন ওদের কাছে সমাজের সব সমস্যার সমাধান আছে তারপর জ্ঞানী জ্ঞানী মুখ করে যখন কার্লমার্কস, লেনিনের উদাহরণ দেয় অথবা সমাজ পরিবর্তনের কথা বলে কতকগুলো পরিচিত রাজনৈতিক বুলি আওড়ায় তখন পিত্তি একদম জ্বলে যায়। কিন্তু ওই মেয়েটাকে দেখে জামিলের তেমন কিছু হয় না মেয়েটা খুব সহজ ভঙ্গিতে কথা বলে। আমি দিলু। জামিল মেয়েটার দিকে স্বাভাবিক নিয়মেই তাকায় তারপর অবাক হওয়ার পালা শুরু। চোখ নামাতে চেয়েও পারে না। এত জীবন্ত, প্রাণোচ্ছল চোখ বুঝি কারও হয়। এমন চোখের মেয়েদের মুখে কিছু বলতে হয় না চোখই সব বলে দেয়। সাদামাটা সালোয়ার-কামিজ, চটির স্লিপার, রবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো অগোছালো চুলের এই শ্যামলা মেয়েটিকে অন্য দশটা মেয়ে হতে আলাদা করা যাবে না যদি না

দিলুর চোখ জোড়া....। জামিল অনিচ্ছায় চোখ নামিয়ে নেয়। দিলু আপা, ও জামিল আমার বচবণ কা দোস্ত, আর্মিতে আছে। আসগর পরিচয় করিয়ে দেয়।

ভার্সিটি আর্মি, পুলিশের জন্য ভালো জায়গা না, তোমার বন্ধুকে আবার বিপদে ফেল না যেন। দিলু বলে।

জামিল দিলুর উত্তরে বিরক্ত বোধ করে। এমন কথা ও আগেও বহুবার শুনেছে।

আমি বুঝি না এখানকার ছেলেরা আর্মি, পুলিশের উপর এত ক্ষেপে থাকে কেন? আমরা তো এই দেশেরই ছেলে, ভিনদেশী কোনো সৈনিক না। জামিল উত্তর দেয়। এ্যাইরে হলো তো তোর বন্ধুকে দেখি সত্যি সত্যি ক্ষেপিয়ে দিলাম। দিলুর

চোখে কপট হাসি। না না আমি ক্ষেপিনি, শুধু জানতে চাইছি মাত্র। জামিল উত্তর দেয়।

আজ না ভাই। ইস আমার এখনই উঠতে হবে, একটু পরেই ক্লাশ। দিলু হাত ঘড়ির দিকে তাকায়।

মিস দাও না কেন? তুমি যে মিস দাও না তা তো আর নয়। আসগর বলে।

নারে দিতে পারলে আজ সত্যি দিতাম। হুদা স্যারের ক্লাশ। আগের দুটা ক্লাশ মিস করেছি এবার দিলে আর পাস হবে না। আসগর তোর বন্ধুকে আর একদিন আসতে বল। চুটিয়ে আড্ডা দিবো। কি আসবে তো? আজ চলিরে। দিলু চটি স্যান্ডেলে চটাস চটাস শব্দ তুলে চলে যায়।

তোর দিলু আপুটা কিন্তু খুব কিউট দেনা লাগিয়ে। জামিল বলে।

মানে? আসগর ভ্রূ কুঁচকায়।

এত মানে মানে করছিস কেন? ভার্সিটিতে পড়িস হারামজাদা লাগিয়ে দেনা

বুঝিস না। জামিল ব্যঙ্গ করে।

তুই দিলু আপার কথা বলছিস? আসগর জানতে চায়।

তাহলে আবার কার কথা বলব। এখানে আমি কটা মেয়েকে জানি। জামিল বলে।

পাগল নাকি? জানিস আমাদের দুবছরের সিনিয়র। মাস্টার্সের ছাত্রী, তাও যে সে ডিপার্টমেন্টে না ম্যাথসে পড়ে বুঝলি। তুই তো আবার ম্যাথসে, থাক আর

বললাম না। থামলি কেন বলেই ফেল না। জামিল তাড়া দেয়।

আগে যেটুকু বা জানতিস আর্মিতে ঢোকার পর তোর বুদ্ধি কি আর মাথায় আছে লেফট রাইটের চোটে হাঁটুতে নেমে গেছে। এখন যোগ, বিয়োগও ঠিকমতো করতে পারবি কিনা সন্দেহ।

আসগর হাসতে হাসতে বলে।

দোস্ত তুই যা বললি, তার সবই সত্যি। তা অহেতুক এত আপা আপা করিস না তো। তোকে লাগাতে বলেছি তুই লাগিয়ে দিবি, এতো প্যাচাল পাড়ছিস কেন? জামিল বলে।

দোস্ত তোদের ঠোলাদের এই এক সমস্যা। যে মেয়ে দেখিস তারই প্রেমে পড়িস। ঘন ঘন আসতে থাক, চোখ ঠিক হয়ে যাবে। আর প্রেমই যখন করবি তখন আর্টস ফ্যাকাল্টির মেয়েদের সাথে ভজিয়ে দিবো। দে আর জুসি টাইপ। জানিস তো ভালো ছাত্রীরা সুন্দরী হয় না আর সুন্দরীদের এতো আদাজল খেয়ে পড়তেও হয় না, তার আগেই ফুটুস।

থাক তোর আর ক্লাশিফিকেশন করতে হবে না। যা বললাম তাই কর গে যা। তোর দিলু আপুর চোখ জোড়ায় আমি আটকে গেছি। আই এ্যাম লস্ট। জামিল কথা শেষে আসগরকে ডান চোখ টিপে।

ওমা! এই কয় মিনিটের পরিচয়ই অনেক ডিপে চলে গেছিস দেখছি। ভেরি ব্যাড সিমটম। আজ ভাগ আর একদিন আসিস আমার অনেক চিকা মারতে হবে।

আসগর ওর হাতের পোস্টারগুলোর দিকে ইঙ্গিত দেয়।

জামিল যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

দাঁড়া, জামিল তোর সিগারেটের প্যাকেটটা রেখে যা, পকেট একদম খালি। আসগর হাসতে হাসতে বলে।

জামিল সিগারেটের পাকেটটা ছুঁড়ে মারে।

আসগর দক্ষ হাতে ধরে। আই এ্যাম টেকিং ইট এ্যাজ ডাউন পেমেন্ট। দোস্ত কোনো চিন্তা করিস না। উই শ্যাল ওভারকাম।

সিপাই হারুন টেবিলে হারিকেন রাখে, বিছানার চাদর ঝেড়ে টান টান করে।

সিপাই হারুন ওর রানার। স্যার আর কিছু লাগবে।

না তুই বরং হাবিলদার মন্তাজকে সালাম দে।

জামিল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না মন্তাজ লোকটা কেমন।

গত সপ্তাহে হিলে ওর তিন মাস হলো। খুবই সংক্ষিপ্ত সময় বিশেষ করে এই অশান্ত পাহাড়ি অঞ্চলে। ক্যাম্পে ওই একমাত্র অফিসার। হাবিলদার মন্তাজের সাথে ওর সম্পর্কটা ভালো থাকা জরুরি। কারও সাথে সম্পর্ক ভালো থাকলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই। আর হিলে এটা আরও দরকারী যেখানে গুলির কোনো একাউন্টটিবিলিটি নাই। মন্তাজের চেহারাটা ভয়ংকর ধরনের হঠাৎ দেখলে ভিতরটা কেঁপে উঠে অবশ্য এর জন্য দায়ী না। শান্তিবাহিনীর গুলি ওর বাম চোয়াল ঘেঁষে বাম চোখের নিচ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কয়েক মিলিমিটার ডান ঘেঁষে গেলে চোখটা রক্ষা পেতো কিনা সন্দেহ এমনকি যমের দেখা পাওয়াও অসম্ভব ছিল না। মন্তাজের বাম গালের চামড়া কুৎসিতভাবে কুঁচকে থাকে আর বাম চোখটা পুরোপুরি বন্ধ হয় না। বিশ্রী অভিব্যক্তিহীন বাম চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না, মরা মানুষের মতো নিশ্চল জীবনহীন দৃষ্টি। গত পরশু রাতে মন্তাজ বেঞ্চিতে শুয়ে বিড় বিড় করে কার সাথে যেন কথা বলছিল। সেই সাথে থেমে থেমে কান্নার চাপা গোঙানী। একা একা কথা বলে শিশু আর পাগলে কিন্তু ওকে ঠিক পাগল বলে মনে হয় না আবার কেমন জানি পুরোপুরি স্বাভাবিকও নয়। হাবিলদার মন্তাজের স্বাভাবিক হওয়া বা না হওয়াতে ওর কিছু যায় আসে না তবে শয়তান না হলেই চলে। পাগলের সাথে পারা যায় কিন্তু শয়তানের সাথে পারা কঠিন।

ক্যাপ্টেন জামিল চুরুট ধরায়। বিয়েল গোর্খা ব্লাক ড্রাগন চুরুট, গত পরশু রইসা নাড়ী বাজার হতে আনিয়েছে। কি নেই ওখানে উজি সাব মেশিন গান থেকে প্লক শর্টগান সবই পাওয়া যায়। চুরুটের টানে ওর মাথাটা পরিষ্কার হয়ে আসে। বড্ডো কড়া মাল।

স্যার ডেকেছেন। মন্তাজ মিয়া নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ায়। জামিলের একটু রাগও হয়। আরে শালা তুই কি এখন পেট্রোলে যে তোর চুপিসারে হাঁটতে হবে। মন্তাজ কি জানে আমি ওকে ভয় পাই? তাই উল্টাপাল্টা ভয় খাইয়ে নিশ্চয় মজা পেতে চায়। হয়তো ওর হাঁটাই অমন খামোখা আকাশ-পাতাল ভাবছে। মানুষের মন যা ভাবে চোখ শুধু তাই দেখে তা না হলে কি করে মানুষ অন্যের মনের গভীর ভাব সহজেই উপলব্ধি করে আবার সেই মানুষই চোখের সামনের ঘটনাও অবলীলায় এড়িয়ে যায়।

তা মন্তাজ মিয়া ক্যাম্পের খবর কি?

কোন খবর স্যার?

এই সৈনিকদের খবর মানে এনি থিং আর কি?

হাবিলদার মন্তাজ ডান চোখ সরু করে। স্যারের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে। কত অফিসার এল গেল। কচি পোলাপান সব। একেকজনের একেক হিসাব কিতাব। জামিল স্যারের টাইপটা ভীতু ধরনের। বড়লোকের পোলা হবে। বড় লোকের পোলারা ভীতু হয় কিন্তু স্যার মানুষ ভাল। মন্তাজ মিয়ার তেলেসমাতি ক্ষমতা আছে, একদিনের পরিচয়েই বলতে পারে কোন মানুষটা কমিনের জাত আর কোনটা শরীফ আদমী। জামিল স্যার দ্বিতীয় দলের। হাবিলদার মন্তাজ ক্যাপ্টেন জামিলের জন্য মায়া অনুভব করে। মায়া বড়ো আজব চিজ কখন যে কার প্রতি জেগে উঠবে বলা মুশকিল। সবাই মোটামুটি ভালো স্যার, তবে সিপাই জয়নালের গাটা গরম। মনে হয় ম্যালেরিয়া ধরেছে। মন্তাজ উত্তর দেয়।

স্যার সাবধানে থাকবেন। আপনে নতুন মানুষ। মন্তাজ নিচু স্বরে বলে। আমার দুবার ম্যালেরিয়া হয়েছে। আমি জানি ওটা কি জিনিস? হিলে থাকবো আর ম্যালেরিয়া হবে না এতো আশা ঠিক না। জামিল বলে।

হাবিলদার মস্তাজ হা হা করে হেসে উঠে। ঠিকই বলেছেন স্যার, পানিতে নামবো আর চুল ভেজাবো না তাকি হয়।

জামিল হাসানোর জন্য কথাটা বলেনি কিন্তু মন্তাজ মিয়া গলা ফাটিয়ে হাসলো। লোকটা জানে না কখন কি ধরনের হাসি হাসতে হয়। হয়তো হাসিটা দেখানো। কেউ হয়তো ওর মাথায় বসে বলছে মন্তাজ মিয়া এটা হাসির কথা তোর হাসা উচিৎ, না হলে লোকে ভুল বুঝবে। মন্তাজের জন্য জামিলের চিন্তা হচ্ছে ওকে ব্রেন রং সিগন্যাল দিচ্ছে। নাকি শালা পাকা বদমাশ হাসি দিয়ে বোঝাতে চাইছে দিলখোলা মানুষ।

ওকে কি চলে যেতে বলবে? জামিল কিছুটা চিন্তিত।

না থাক এরকম সময় ভুল কিছু করা ঠিক হবে না। এখনও জামিল সিওর না লোকটা পাগলা কিসিমের না নিরেট শয়তান।

মন্তাজ একদৃষ্টিতে মাটির দিকে চেয়ে আছে ওর দৃষ্টি স্বাভাবিক না। মন্তাজ পরিস্থিতি ইদানিং গরম মনে হচ্ছে। ব্যাপার কিছু জান নাকি? জামিল পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে। মন্তাজ ডানে-বামে বারকয়েক তাকায়, তারপর গলা লম্বা করে ফিসফিসিয়ে বলে, স্যার গরম বললে কম বলা হবে খুবই খারাপ অবস্থা। ওই হারামজাদারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

আচালং আর তাইদং আক্রমণের পর পরিস্থিতি কিছুদিন শান্ত ছিল এখন আবার তেতে উঠছে। আল্লাহ মালুম আবার কিনা কি ঘটে। মন্তাজ মিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে।

স্যার আর এই মৃত্যু-মৃত্যু খেলা ভালো লাগে না। আমরা হুকুমের দাস। আপনারা হুকুম দেন আমরা গুলি ফুটাই। আর করবোই বা কি? গুলি ছোঁড়া ছাড়া জীবনে অন্য কিছু তো শিখিনি। মন্তাজ কথা শেষে দম নেয়।

ভুল বললে মন্তাজ, আমি হুকুম দেই না; আমার দেওয়ার ক্ষমতাও নাই আর কোথা থেকে যে হুকুম আসে আমি জানি না আর জেনেই বা লাভ কি?

স্যার আর তো পারি না, মানুষ মেরে মেরে ঘেন্না ধরে গেছে। এই হিলে চিড়িয়ারও দাম আছে খালি দাম নাই পাহাড়ির জীবনের।

তুমি যা বললে তার সবই সত্যি। তোমার আমার গুলি ফুটানো ছাড়া কিছুই করার নাই। আমরা এই যুদ্ধে আটকে গেছি, জানি না এর শেষ কবে। সৈনিক শুধু যুদ্ধ করে, যুদ্ধ শুরুও করে না আর থামায়ও না। এটা রাজনীতিবিদদের কাজ। জামিল কথা শেষে চুরুটে লম্বা টান দেয়। মন্তাজকে এখন আগের মতো ভয়াবহ কুৎসিত মনে হয় না। লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিল হয়তো অতো খারাপ না তবে মাথায় কিছুটা ছিট আছে।

না স্যার এমনিই বললাম খারাপ লাগে তাই। আগে মানুষ মেরে ঘুম হতো না এখন ওসব সয়ে গেছে। ভাবলে আর যাইহোক মানুষ মারা যায় না। স্যার বেয়াদবি যদি না নেন তাহলে একটা কথা বলি।

বলো। জামিল কিছুটা আন্দাজ করতে পারে মন্তাজ কি লাইনে কথা বলতে চায়। স্যার হিলে টিকতে হলে নার্ভ ঠাণ্ডা রাখা জরুরি। আপনার যদি কিছু লাগে জানাবেন, ব্যবস্থা আছে। আমি আসি স্যার।

ক্যাপ্টেন জামিল হারিকেনের আলো উসকে দেয়। বাঁশের বেড়ার দেয়ালে এলোমেলো ভৌতিক ছায়া ঘোরাঘুরি করে। যত রাতই হোক ওকে শেষ করতে হবে কারণ কাল পোর্টার আসার দিন।' দু'সপ্তাহ অন্তর পোর্টাররা মালামাল আনা নেওয়া করে। কাল মিস করলে পনের দিনের ফ্যারে পড়ে যাবে। অংকের মতো নিরাভরণ দিলুর চিঠিতে অহেতুক কথার মারপ্যাঁচ নেই।

প্রিয় গুণ্ডা,

তোকে আজ দেখতে ইচ্ছে করছে। গতকালও করেনি কিন্তু আজ করছে। পারলে চলে আয় এখুনি মাথা, হাত-পাসহ। ওখানে যে যুদ্ধ চলছে ভয় হয় কিছু আবার রেখে আসিস কিনা। কোনো পাহাড়ি সুন্দরীর দেখা মিললো? পেলে বলিস, দুঃখ করবো মোটেও তা ভাবিস না। যাওয়ার আগে যে ব্যবহারটা করলাম এখন ভাবছি তা না করলেও পারতাম। প্লিজ কিছুদিনের জন্য হলেও আয়, এবার পুষিয়ে দিবো।

ইতি

দিলু

পুনশ্চ: বেশি সাধছি বলে আবার দাম বাড়াস না যেন।

টি.এস.সিতে দেখা হলো, কথা হলো তারপরই তো শেষ হতে পারতো কেন যে হলে দেখা করতে গেল। তা না হলে রাত জেগে চিঠি লিখতে হতো না। জামিল ভাবে। সব সম্পর্কেই ভয় থাকে, হারানোর ভয় আর হারানোর ভয় আছে বলেই তো থাকে যাতনাময় পাওয়ার আকুতি। কেন যে মানুষ যেচে যেচে কষ্ট নেয়।

কোন আফার লগে দেখা করবার চান? হলের বুয়া জানতে চায়।

দিলু।

দুইজন দিলু আছে। আপনে কারে চান?

আরও কিছু ছেলে ভিড় জমিয়েছে। অনেকের চোখে মুখে অধৈর্য ভাব। বুয়ার হাতে সময় নাই। ভার্সিটির ছেলেরা মাথায় আগুন নিয়ে ঘোরে ডাকতে দেরী হলে অনর্থ বাঁধাবে।

কি এহনতর কইলেন না কোন দিলু-পাগলী না অংক দিলু।

বুয়া ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।

ব্লু ছিল তা না হলে আজ একটুর জন্য পাগলী দিলুর পাল্লায় পড়েছিল আর কি। -মা তুমি, আমি ভাবছিলাম.... দিলু হাসতে হাসতে বলে। কি অন্য কারও অপেক্ষায় ছিলে? জামিল জিজ্ঞেস করে।

অংক দিলু। জামিল হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। যাক বাবা বাঁচা গেল। ভাগ্যিস প্রশ্নে যথেষ্ট কি করছিলে?

না না, ভাবছিলাম এই অসময়ে কে না কে এল?

সত্যি বলবো। দিলুর চোখে কৌতুক।

মিথ্যা বলতে চাইছো মনে হয়? বলতে না চাইলে থাক। জামিল সরু চোখে দিলুকে দেখে।

জামিলের কৌতূহল বাড়ে আবার লজ্জাও লাগে। মেয়েটা যে ফটাফট কথা বলে কি বলতে যেয়ে কি বলবে শেষে সে না আবার অস্বস্তিতে পড়ে। এরকম সময় দিলু কি করছিল? হলের মেয়েরা এই অলস দুপুরে কি কি করতে পারে? জামিলের মাথায় বিশ্রী চিন্তা ঘোরাঘুরি করে।

এ্যাই ছেলে যা ভাবছো তা না। দিলু বলে।

আমি কি ভাবছি?

ছেলেদের মাথায় এইটি পার্সেন্ট টাইম নোংরা চিন্তা ঘোরাফেরা করে। আমি অংক করছিলাম, নিশ্চয় এটা ভাবোনি। দিলু হাসে।

কি বললে অংক। এই ভরদুপুরে। আমি ভুল শুনছি না তো?

ভুল শুনবে কেন? অংকের ছাত্রী অংক করবে না সাইকোলজির ফ্রয়েড আওড়াবে। মেয়েদের কি ভাবো তোমরা? ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে সারাদিন তোমাদের অপেক্ষায় থাকবে। দিলু বলে।

তা নারে বাবা, অংকের কথা শুনলেই গায়ে জ্বর আসে। আর্মিতে যেয়ে বেঁচে

গেছি। কপালে হাত দিয়েই দেখো না একবার। তা কি অংক করছিলে-যোগ-

বিয়োগ-গুণ-ভাগ কোনটা?

এ্যাই ইয়ার্কি রাখতো। ফ্লুইড ডিনামিক্সের ইকুয়েশন অব টার্বুলেন্সের কিছু

অংক। দিলু উত্তর দেয়।

ওহ গড! স্টপ ইট। নো মোর প্লিজ। সত্যি আমার বমি হয়ে যাবে। জামিলের

গলায় আকুতি।

ওকে আমি তাহলে আসি। তোমার জ্বর-জারি আর বাড়াতে চাই না। আমি

বরং শিপ্রা অথবা লুবনাকে পাঠিয়ে দেই।

ওরা আবার কারা?

ওরা আমার রুমমেট। শিপ্রা বাংলার আর লুবনা ইংরেজির। লুবনা তো আর্মি অফিসার বলতে পাগল। ওদের সাথে কথা বললে তোমার

বমি-জ্বর সব কেটে যাবে।

হেল নো। অংক যখন শুরু করেছি তখন উত্তর না মিলিয়ে ছাড়ছি না। জামিল

হাতজোড় করে।

উদ্ অংকের কথা শুনে মাথার পিছনটা কেমন টন্টন করছে। তোমার আপত্তি না থাকলে চলো কোথায় ঘুরে আসি। জামিল বলে।

কোথায় যাবে? দিলু জানতে চায়।

এ্যানি হোয়ার, যেখানে কোনো ম্যাথ নেই। জামিল উত্তর দেয়।

যেখানেই যাও না কেন সেখানেই ম্যাথ আছে। দেয়ার ইজ নাথিং উইদাউট ম্যাথ আর ম্যাথকে যত খারাপ ভাবছো ম্যাথ তত ভয়ংকর না। দিলু হাসতে

হাসতে জবাব দেয়।

আই হ্যাড এনাফ, নো মোর ম্যাথ টক প্লিজ। লেট্ট্স গেট লস্ট। জামিল তাড়া

লাগায়।

তা যাবো কিসে? তোমার ওই ভটভটিতে।

চারচাকা আর পাবো কই?

সরি, আমি ওটা মিন করিনি। তবে ন্যাকা মেয়েদের মতো দুই পা একদিকে ঝুলিয়ে কিন্তু চড়তে পারবো না তা আগেই বলে নিচ্ছি। তাছাড়া ওভাবে বসাও রিসকি। দিলু বলে।

ইওর ম্যাজেসটি। তোমার যেভাবে বসতে ইচ্ছা করে তুমি বসো। তুমি যে ব্রেনলেস ক্যাপ্টেনের সাথে যেতে রাজী হয়েছো তাতেই আমি কৃতার্থ।

কখন যে একটা সম্পর্ক চুপিসারে জেনে অথবা না বুঝে স্তরে স্তরে গড়ে উঠে ক্রমশ পরিণত হয়। সব সম্পর্কই শুরু হয় নিছক তারুণ্যের কৌতূহলে তারপর অপরিকল্পিত, অগোছালো এ্যাডভ্যাঞ্চারিজমের মধ্যদিয়ে একটু একটু করে নিজস্ব অবয়ব নেয়। আনন্দ, ভয়, বেদনা আর জেলাসির মাঝে সে বুঝতে পারে সে জড়িয়ে গেছে। জামিল ক্যাম্পের প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে ফিরে যায় একটা জীবস্ত, বর্ধিষ্ণু সৃষ্টির মাঝে।

সেদিন সারা ঢাকা চষে বেড়িয়েছিল, শাহবাগ, রমনা, সোনারগাঁও, সাভার। এক হাত দিয়ে দিলু জড়িয়ে ছিল ওর কোমর। ওপিঠ দিয়ে অনুভব করছিল একটা নারী শরীরের স্পর্শ। জামিল পিঠ দিয়েই বুঝেছিল দিলু কামিজের নিচে কিছু পরেনি। জামিলের মনে হচ্ছিল ওর পিঠ নিজস্ব এক সত্ত্বা লাভ করেছে যার উপর ওর কোনো ক্ষমতা নেই, সে যেন দিলুর অপরিণতসম স্তনদ্বয়ের স্পর্শে বিভোর। জামিলের মেজর রেজার কথা মনে পড়ে। মেজর রেজা বলেছিলেন-সব পুরুষরা দুই ভাগে বিভক্ত। আইদার দ্যে আর বুবম্যান অর বুটিম্যান।

জামিল বুঝে না কোন ম্যান। দিলুর হালকা পাতলা গড়নে দুটিরই অনধিক্য। আসলে আইম্যান। দিলুর নিষ্পাপ, প্রাণবন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে কাটাতে পারে সারাজীবন।

বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে, সেই সাথে থেমে থেমে দমকা হাওয়া। থামার নাম গন্ধ পর্যন্ত নেই। হাওয়ার তোড়ে বুঝি ক্যাম্পের বেড়া ছাউনি সব যেন উড়ে যাবে। পাহাড়ে বৃষ্টি তো নিত্যসহচর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝিরঝিরিয়ে বিরামহীন নামতে পারে কিন্তু এবারের বৃষ্টিটা যেন বেয়াড়া রকম মারমুখী, থামা তো দূরে থাক; বরং সময়ের সাথে বেড়েই চলেছে। যেমন বৃষ্টির তোড় ঠিক তেমনি দ্রুত ছড়া দিয়ে হিসহিসিয়ে নেমে যাচ্ছে বৃষ্টির জল। ছড়া দিয়ে জল সাত তাড়াতাড়ি না গড়ালে আজ নির্ঘাৎ নূহুর প্লাবন নামতো।

সৈনিকরা ব্যারাকে অলস সময় কাটায়। ক্যাম্পের এই ঘরটিতে বারজন থাকে। থাকা বললে ভুল হবে, গরুর হাটের মতো গাদাগাদি আর কি। সারি সারি কাঠের চৌকি সরলরেখায় সাজানো। এক চৌকি হতে অন্য চৌকির ধার আধ হাতেরও কম। অন্যের নিঃশ্বাস আর একজনের মুখে এসে ছোঁয়। কেউ কেউ মেঘলা দিনটা ঘুমিয়ে পার করতে চায়, এই পাহাড়ে দিন পার করা নিয়েই কথা, কিভাবে হলো তা বড়ো ব্যাপার না। নায়েক সালামের বিছানায় তাপস, জালাল আর কোলবালিশ ফারুক তাস পিটাতে ব্যস্ত। ক্যাম্পে দুইজন ফারুক আছে। একজন টাইক্যা ফারুক অন্যজন কোলবালিশ ফারুক। কিছুটা নাদুস-নুদুস বলে একজনের নাম হয়েছে কোলবালিশ। মানুষ খুব বিশ্রীভাবে একজন হতে অন্যজনকে আলাদা করে এবং এক সময় কুশ্রী বিশেষণটা নামের অংশ হয়ে যায়। যাকে নাম দেওয়া হয় সে সহ সবাই যেন স্বাভাবিকভাবে মেনেও নেয়। এটাই যেন নিয়ম।

কাঠের জানালায় বাতাসের দাপাদাপির হিসহিস শব্দের মাঝেও ওদের কথা শোনা যায়। ঘুপচি ঘরে সোঁদা গুমোট অন্ধকার একটু একটু করে জমে যদিও দুইটা লাইট টিমটিম করে জ্বলছে। এই বাতিগুলো চলে সোলার প্যানেলের সাহায্যে। সূর্য যদি অচিরেই মুখ না তোলে তাহলে কপালে খারাবি আছে। এই শেষ আলোটুকুও নিভে গেলে কতদিন যে অন্ধকারে কাটাতে হবে তা খোদাই মালুম তবে বৃষ্টির যা লক্ষণ সূর্যের দেখা যে সহজে হচ্ছে না তা বুঝাই যায়। মুজতবা ইতিমধ্যে হারিকেন ধরিয়েছে। ও ঘুম আনানোর চেষ্টা করছিল অনেকক্ষণ কিন্তু এল না কিছুতেই। আবার না ঘুমিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা আরও বেশি কষ্টের। তবে কেউ কেউ পারে, সিপাই আকতারের রাতদিন যখন তখন ভাল্লুকের মতো ঘুমাতে ওর ক্লান্তি নেই। মুজতবা চৌকির নিচের ট্রাংক হতে চিঠি লেখার প্যাড বের করে। অনেকদিন মাকে লেখা হয়নি। মা ওকে নিয়ে খুব চিন্তা করে, অকল্যাণের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে সব সময়। এছাড়া কি করারই বা আছে। ক্ষুধার কাছে ভয়, ভালোবাসা সব যে বাঁধা পড়ে। গরিবের অনুভূতি তীব্র হওয়া ভালো না।

বাইরে সজোরে বৃষ্টি হলেও ঘরের ভিতর নোনা ভ্যাপসা গরম। সিগন্যালম্যান কামরুল হাত পাখা দিয়ে নিজেকে বাতাস করে। হাতপাখার চারিধারে লাল ফিতার ঝালর, ঝালরের সাথে লাগানো কুরুশ কাটার কাজ। মেয়েলি হাতের মমতা মাখা সূচিকর্ম।

কি রে কাকে লিখিস? কামরুল জানতে চায়।

আর কাকে। মাকে। মুজতবা একটু বিরক্ত হয়।

লেখ লেখ। ভালো করে লেখ। আমার মাও নেই লেখার ঝামেলাও নেই।

মা নেই তো বাবাকে লেখ। মুজতবার বিরক্ত ভাব কাটে না। ওর এখন গল্প জমাবার ইচ্ছা নেই।

কেউ থাকলে তো লিখব। আমার সাতকূলে কেউ নেই। আমি এতিমখানায় মানুষ; মুক্তবিহঙ্গ; মরলাম কি বাঁচলাম তাতে কারও কিছু যায় আসে না। হা-হা।

কামরুল হাসে।

সরি দোস্ত না বুঝে বলেছি, মাফ করে দিস। মুজতবা লজ্জা পায়।

সরি ফরির কোনো ব্যাপার না। এতিম হওয়াতেও এক ধরনের আনন্দ আছে।

মন যা চায় তাই করি, কারও কাছে ঠেকা নই আর কেউ আমার কাছেও ঠেকা না অবশ্য স্বাধীন গাছাড়া ভাবটা যে সব সময় ভালো লাগে তাও ঠিক না। কামরুলের

গলা হঠাৎ নিচু স্বরে নেমে আসে।

এখানে আত্মীয় থাকাও যা, না থাকাও তা। পাহাড়ে আমরাই তো একে অপরের আত্মীয়। মুজতবা ব্যাপারটা হালকা করার চেষ্টা করে।

তা দোস্ত তোমার হাত-পাখা, নকশী বালিশের কাভার দেখে তো মনে হয় না নিজেকে যতখানি দড়িছেঁড়া গরু বলে চালাতে চাও তার পুরোটাই বুঝি সত্যি না। ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়। মুজতবা কৌতুকের চোখে তাকায়।

ওহ! এগুলো, এসব কনকের হাতের কাজ। কামরুলের নিষ্প্রভ চোখজোড়ায় খুশির ঝলক খেলে। সামান্য সেই ঝলক।

তা কনকটা আবার কে গো?

দেখবি, দেখ। কামরুল মানিব্যাগ হতে পাসপোর্ট সাইজের ছবি বের করে মুজতবাকে দেয়।

সাদা কালো ছবি। ছবিতে হলদেটে ছোপ ধরেছে ঘাম অথবা স্যাঁতস্যাঁত পরিবেশের কারণে। সাধারণ চেহারার ছিপছিপে ধরনের মুখ। দুইটা মোটা বেনি নেমে গেছের বুকের উপর দিয়ে। শান্ত মায়াময় মুখ, যে মেয়ে শত কষ্টকেও মুখ বুজে সহ্য করে হাসতে পারে। মুজতবা ছবি ফিরিয়ে দেয়।

তা কেমন দেখলি বললি না? কামরুল জানতে চায়।

ভালোই তো। চেহারায় খুব লক্ষী লক্ষী ভাব আর লক্ষী নাহলে কারও হাতের কাজ এতো তুরুপ হয়। তা বন্ধু আর কত পকেটে নিয়ে ঘুরবে সামনের ছুটিতে বুকে বেঁধে ফেল না কেন? হা-হা। মুজতবা হাসে।

কনক আসলেই লক্ষী বরং একটু বেশি লক্ষী। এত লক্ষী হওয়াও সব সময় ভালো না। দোস্ত বুকে আর কোনোদিনই বাঁধা হবে না আর সবাই কি বাঁধতে পারে বা বাঁধতে জানে? গত বছর পৌষ মাসে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। কামরুল স্বাভাবিক গলায় বলে।

মুজতবা বনে যায়, কিছু বলতে পারে না। ঘরের অন্ধকার গাঢ়তর হয়েছে। কামরুলের চোখ জোড়া দেখা যায় না। না দেখতে পাওয়াতে ভালোই হয়েছে। মানুষের চোখ আনন্দ লুকাতে জানলেও বিষাদ লুকাতে পারে না।

কামরুলই আবার শুরু করে। আমার মতো গোত্রহীন, জাতহীন, পরিচয়হীন মানুষের সাথে কোনো বাপ মাই বা মেয়ের বিয়ে দিতে চায় বল। কনক পালিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আমি পারিনি। অধিকার, দাবী এই সমস্ত ব্যাপারগুলো আমার চিরজীবনের অচেনা। আমি জোর করতে শিখিনি। জীবনভর সব কিছু মেনে নিয়েছি, মেনে নিতেই শুধু জানি। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, না পাওয়ার কষ্ট আমার চেনা কিন্তু চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়া ওটি বোধহয় সহ্য হতো না। আমার সব খবরই তো শুনলে তা তোমার খবর কি? দেখিস চিড়িয়া যেন আমার মতো উড়াল না দেয়। কামরুল এখন অনেকটা স্বাভাবিক।

দোস্ত ফাঁদ পেতে বসে আছি কিন্তু কোনো চিড়িয়াই ধরা দেয় না, আজকালকাল চিড়িয়ারাও বড়োই সেয়ানা। মুজতবা কামরুল হো-হো করে হাসে কিন্তু সব হাসিতে কি গুমোটভাব কাটে?

মানুষ কিভাবে একজীবনে এতো দুঃখ সয়। মুজতবা ভাবে।

রমজান, রমজান ওঠ। সিপাই গোলজার রমজানের পিঠে মৃদু ঝাঁকুনি দেয়। রমজান সামান্যই চোখ খুলে অস্ফুট গোঙানির মতো শব্দ করে পাশ ফিরে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। ঘরে ঝিম অন্ধকার। দুইদিন হলো ক্যাম্পে কোনো লাইট নাই। শুধু সেন্ট্রিপোস্টে কালিমাখা অস্বচ্ছ হারিকেন টিমটিম করে জ্বলে। আজ নিয়ে টানা তিনদিন বৃষ্টি ঝরছে তবে আজ জোর অনেক কম। সিপাই গোলজার এরকম আগে কোনোদিন দেখেনি, না ভুল বললো আর একবার হয়েছিল। ওর ভয় হয়। প্রায় তিন বছর আগে আগুনটিলা ক্যাম্পে যখন ছিল তখন এমন জোর বৃষ্টি নেমেছিল। সেই সাথে থেমে থেমে প্রচণ্ড দমকা বাতাস আর বিদ্যুতের চমকের সাথে পিলে কাঁপানো শব্দ, যেন মাথায় আসমান ভেঙ্গে নামবে। সেন্ট্রিপোস্টের মাটি বৃষ্টিতে বসে গিয়েছিল। বৃষ্টি থামার দুই দিন পর ওরা রুটিন পেট্রোলে বেরিয়েছিল। আর দশটা দিনের মতো বৈচিত্র্যহীন সাদা-মাটা আর একটা দিন। পেট্রোল কেবল টিপরা পাড়া ছাড়িয়ে ছড়ার কাছে মোড় নিয়েছে তখনই শান্তিবাহিনীর আক্রমণ। বৃষ্টির মতো গুলি আসছিল চারদিক হতে। চারজন মারা যায় ওর চোখের সামনে। একটা গুলি সোঁ-সোঁ শব্দ করে ডান কানের পাশ ঘেঁষে দূরের গাছে গিয়ে লাগে। ভেবেছিল মরে গেছে। কি ভয়াবহ সেই দিন। জীবন আর মৃত্যু যে কতো কাছাকাছি সেদিন গোলজার হাড়ে হাড়ে বুঝেছিল। ওতো চারজনের একজন হতে পারতো। তার বেঁচে থাকায় কোনো কৃতিত্ব নেই। তার সময় এখনও আসেনি বলে বেঁচে আছে তবে অচেনা বনে নিঃসঙ্গ ভাবে মরে যাওয়া চায় না। সেইদিন থেকে গোলজারের মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। বেঁচে থাকার অপরাধ। এই নাছোড়বান্দা বৃষ্টি সেই বীভৎস স্মৃতিগুলো পাক ঘেঁটে আবার তুলে নিয়ে এল। স্মৃতিকে হয়তো সাময়িক ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় কিন্তু কোনো স্মৃতিই মরে না।

রমজান নাক ডাকে। শালার ঘুম কতো রে। কেন যে এসব আদরের দুলালরা মরতে আর্মিতে ঢোকে।

রমজান, রমজাইন্যা, হালার পুত ওঠ। সিপাই গোলজার রমজানের পিঠে জোরে ঝাঁকি দেয়।

 

রমজান ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে। বারকয়েক চোখ ডলে। কে? কে তুই ওখানে?

চুপ শালা, আমি গোলজার। তাড়াতাড়ি রেডি হো।

কেন? কি হয়েছে? কোথায় যাবো? রমজানের গলায় বিরক্তি, এরকম জমাট ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য।

গেলে বুঝবি। সবাই গেছে তুই শুধু গাধার মতো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস। জিনিস আছে। গোলজার উত্তর দেয়।

বেচারাকে এভাবে তোলাতে গোলজারের খারাপ লাগে। হাবিলদার মন্তাজ না বললে ওকে ডাকতো না। একজন ভালো মানুষকে খারাপ করার দরকার কি? পৃথিবীতে এমনিতেই খারাপ মানুষের অভাব নেই। কি লাভ এতে আর একজন যোগ করে। ভালো মানুষ খারাপ মানুষকে সহ্য করতে পারলেও খারাপ মানুষ ভালো মানুষকে সহ্য করতে পারে না। তাই তো ভালো মানুষের পদে পদে বাঁধা।

গোলজার বলতে চেয়েছিল-ওস্তাদ বাদ দেন রমজানের কথা, বাচ্চা ছেলে কিন্তু হাবিলদার মন্তাজের চোখের দিকে চেয়ে বলতে সাহস হয়নি। শয়তানের চোখও বোধহয় সেই দৃষ্টির কাছে হার মানে। মাঝে মাঝে শালাকে মানুষ মনে হয় না।

কোথায় যাচ্ছি বললি না? রমজান জিজ্ঞেস করে।

চারুকারবারীর বাসায়।

ওখানে কেন? এতো রাতে?

রমজান তুই বেশি প্রশ্ন করিস। ওস্তাদ যেতে বলেছে তাই যাবি। গেলেই দেখবি। উফ্ তোর সাথে প্যাচাল পেড়ে ওদিকে বহুত মিস হয়ে যাচ্ছে। জলদি পা চালা। গোলজার হুকুমের সুরে বলে। চারুকারবারীর বাড়ি ক্যাম্প হতে আধাঘণ্টার হাঁটা পথ। ছড়ার পাশের লোহা কাঠের মাচানের উপর সেগুন কাঠের ঘর। এই পাড়ায় প্রায় বিশ-পঁচিশ ঘর চাকমার বাস। অধিকাংশই দরিদ্র, জুমিয়া। কেউ কেউ বাড়তি রোজগারের আশায় পোর্টারের কাজ করে। সৈনিকেরা ওদের সবাইকেই প্রায় নাম ধরেই চেনে। পাড়ার অন্যদের হতশ্রী কুঁড়ের মাঝে চারু চাকমার ঘরটা চোখে পড়ার মতো। খাগড়াছড়ি হতে ছুতার আনিয়ে ঘর উঠিয়েছে। ছড়ামুখো টানা বারান্দার খিলানে, দরজা-জানালায় জাফরি কাটা ফুল, লতা-পাতা আর বুদ্ধের খোদাই কারুকাজ। কাঁচা টাকার আমদানী না থাকলে এরকম ঘর তোলা চাট্টিখানি কথা না।

রমজান আর গোলজার বারান্দার শেষ মাথায় বড়োসড়ো বসার ঘরটায় ঢোকে। গোটা ঘর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ঘরে ঢুকতেই রমজানের নাকে গাঁজার তীব্র গন্ধ ঠেকে। অধিকাংশ সৈনিকেরাই গোল করে মেঝেতে বসে আছে। জনাপাঁচেক সৈনিক গ্লাস হাতে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চোলাই মদের তীব্র চুকা গন্ধ গাঁজার গন্ধের মধ্যেও ঠাহর করা যায়। ঘরে হ্যাজাক বাতি জ্বলে কিন্তু পুরু ধোঁয়ার আস্তরণে ফ্যাকাশে ঠেকে বাতির উজ্জ্বল আলো। বাংলা আর হিন্দি সিনেমার চটুল গানের সাথে দুইটা চাকমা মেয়ে বিরামহীন নেচে চলে। নাচ বলতে আর কি শুধু পাছা আর বুকের দুলুনি। বুকের দুলুনি দেখে সৈনিকদের কেউ কেউ জোরে সিটি বাজায়। একটা ছোকরা গোছের চাকমা ছেলে যন্ত্রের মতো ভাবলেশহীন তবলা বাজিয়ে চলে। মাঝ বয়েসী মাঝখানে সিঁথি কাটা লম্বা চুলে। গায়ক একমনে হারমোনি বাজিয়ে গান গায়। পাগলা সুরের তালে ওর লম্বা চুল ডানে বামে উথাল-পাথাল করে।

সিপাই জালাল রমজানের কাছে এগিয়ে আসে, আরে রমু এতো দূরে কেন। এই প্রথম রমজান জালালকে এত ভালোভাবে কথা বলতে শুনলো। জালাল ওর হাত ধরে টেনে এনে সামনের সারিতে বসায়। কেউ কেউ বিরক্তি প্রকাশ করে জালাল তাতে আমল দেয় না। তবলার গতি ক্রমশ দ্রুত হয় সেই সাথে বুকের দুলুনি। অনেকেই বসা হতে উঠে মেয়েগুলোর সাথে নাচে যোগ দেয়। চিকন মেয়েটা ল্যাঃ নায়েক মঞ্জুরের মুখের সামনে বুক নাচায় অন্য মেয়েটা রমজানকে লক্ষ্য করে চোখ মারে। রমজানের মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশিরানি উত্তেজনা নেমে যায়। মেয়েটা এখন শব্দের তালে তালে ধীরে ধীরে পিঠ বেঁকিয়ে ডান পা ছুঁয়ে মাথার পেছনটা স্পর্শ করে। সৈনিকেরা শিস দেয়। এখন অনেকেই দাঁড়িয়ে গেছে। মঞ্জুর দশ টাকার নোট মেয়েটার প্রায় অনাবৃত বুকের খাদে গুঁজে দেয়। মেয়েটা চোখ মেরে ছিনাল হাসি দিয়ে মঞ্জুরের মুখে বুক ছুইয়েই দ্রুত সরে যায়। সিপাই তাপস এখন ছিলানিটার পিঠ আর পাছা ছুঁয়ে নাচে। এইরকম পরিবেশে কাউকেই আলাদাভাবে চেনা যায় না। সুপ্ত পাশবিক ইচ্ছা ক্রমশ তাকে উলঙ্গ করে। রমজানের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসে। চোখ দুটোতে সামান্য জ্বালা অনুভব করে। হাবিলদার মন্তাজ আধাঘণ্টার বিরতি ঘোষণা করে। টান টান উত্তেজনা ভরা

ঘরটায় নিমিষেই নীরবতা নেমে আসে। ঘরের অন্ধকার কোণায় বসে মন্তাজ আর চারু চাকমা ফিস্ফিস্ গলায় কথা বলে। ছোকরা ছেলেটা দুকাপ চা আর বনরুটি এনে মেয়ে দুটোকে দেয়। মেয়ে দুটো চায়ের কাপে রুটি ভিজিয়ে গোগ্রাসে খায়। চুমুক দিয়ে চায়ের তলানী শুদ্ধ শেষ করে। মন্তাজ চোখ দিয়ে ইশারা করতেই ওরা জগে রাখা চোলাই মদ গ্লাসে ঢালে তারপর মেয়ে দুটো গ্লাস হাতে মন্তাজের কোলে যেয়ে বসে। মন্তাজ মিয়া স্বাভাবিকভাবেই মোটা মেয়েটার পাছায় হাত রাখে আর ডান পাশে বসা চিকন মেয়েটার বুকে আলতো চুমু খায়। ওরা খিলখিল করে হাসে যেন মন্তাজ ওদের হাসির চুটকি বলেছে। মন্তাজ এক ঢোকে গ্লাসের বাকি মদটা গেলে। এতো কড়া মালেও গালের পেশি সামান্যও কাঁপে না। সৈনিকদের এলোমেলো নেশাগ্রস্ত কথায় এখন ঘরটা গমগম করে উঠে বলতে চায় কেউ শুনতে চায় না। মাতালের কথা বলার জন্য বলা শোনানোর বলা না। মন্তাজের ডান হাত এখন চিকন মেয়েটার ব্লাউজের ভেতর। মেয়েটার হলুদ লোমহীন মসৃণ বাম উরু সেলাইবিহীন পিননের ভিতর বেরিয়ে আসে। মন্তাজ অনাবৃত উরুতে আস্তে আস্তে হাত ঘষে।

এই রমজান ইদিক আয়। কিরে কেমন লাগছে? মন্তাজ জানতে চায়।

ওস্তাদ ভাল। বলেই রমজান হা-হা করে হাসে। নিজের হাসিতে নিজেই হতচকিত হয়। বুঝে উঠতে পারে না এটা ওর হাসি কিনা। সে কখনও এরকম কুৎসিতভাবে হাসেনি তবে এখন ওর গলা ফাটিয়ে হাসতে ইচ্ছা করে। মন্তাজ মৃদু ঠ্যালা দিয়ে ডান পাশের মেয়েটাকে কোল হতে নামায়। যা নিশি আজ ওকে পুরুষ বানাবি তুই। দেখি তুই কেমন পারস। চারু চাকমা চেয়ার ছেড়ে উঠে। আপনে এইখানে বসেন। চারু রমজানের উদ্দেশ্যে বলে।

আমি এখন উঠি। হাবিলদার বাবু যা বললাম মনে রাখবেন। এই বুড়ো বয়েসে রাত জাগার ধকল আর সয় না। কিছু লাগলে বলবেন আমি পাশের ঘরেই আছি। মন্তাজ ঈষৎ মাথা ঝাঁকায়।

নিশি জিভ দিয়ে রমজানকে কুৎসিত ইঙ্গিত করে তারপর রমজানের উরুতে হাত দিয়ে হালকা চাপ দেয়। নিশির শরীর দিয়ে সপ্তা ইন্ডিয়ান পারফিউমের গন্ধ আসে। রমজান মাথায় হালকা চাপ অনুভব করে। মেয়েটা আস্ত বাজারী কিন্তু হ্যাজাকের ধোঁয়াশে আলোয় আর নেশাগ্রস্ত চোখে ওকে সুন্দরীই মনে হয়। কালো খাদি আর জরিদার পিননের মাঝের সমতল অনাবৃত সোনালী অংশে রমজানের চোখ পড়ে। কিঞ্চিৎ উত্তেজনা অনুভব করে। নিশি সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকায়। রমজানের মনে হয় নিশির দৃষ্টি ওর চোখ পেট চিরেচুরে ঢুকে যাবে। সব পুরুষের চোখে একই জিনিস-ক্ষুধা। নিশি চোখ দিয়ে সেই ক্ষুধা চাগিয়ে তুলতে চায়। এই সময় সব পুরুষকেই শূকরের মতো পাঁকের নোংরা জলে গড়গড়ানি খাওয়ানো যায়। এই ছোকরাটা নতুন। নতুনদের সময় লাগে। এই সময় লাগাটা অনিচ্ছা নয় বরং ভয়। নষ্ট হওয়ার ভয়। নিশি পুরুষের সব নখরামির সাথে পরিচিত। নিশির ইচ্ছা করে ছোকরাটার গালে কষে চড় মারতে। খাবি তো বটেই তবে খামোকা আমার সময় নষ্ট করা। নিশি আর সময় বাড়াতে চায় না, খাদি উচিয়ে বাম স্তন অনাবৃত করে, তারপর রমজানের ডান হাত আলতোভাবে তুলে স্তনে রাখে আর কানের লতিতে হালকা কামড় দিয়ে বলে-তোর নাম কি রে? রমজান তলপেটে চনমনে ব্যথা বোধ করে। বুক গুলিয়ে উঠে। নিশিকে এক ঝটকায় সরিয়ে দ্রুত দরজা ঠেলে বেরিয়ে যায়।

বাইরে শুনশান রাত। কাঠের রেলিং হাত রেখে মাথা উবু করে হড়হড় করে বমি করে। এখন ওর ভালো লাগে। শরীরটা পাখির মতো হালকা মনে হয়। রমজান আকাশের দিকে তাকায়। কি শান্ত উজ্জ্বল তারা ভরা আকাশ। নিশ্বাস নেয়, গভীর নিশ্বাস। ঠাণ্ডা বাতাস ওর মুখ ছুঁয়ে যায়। ওর এখন প্রিয় কোনো মানুষের কাঁধে মাথা দিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদতে ইচ্ছা করে।

 ৯

স্যার, আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। হাবিলদার মন্তাজ বলে।

কে?

স্যার একটা মেয়ে।

এই সময়ে কি চায়? ক্যাপ্টেন জামিল কিছুটা বিরক্ত বোধ করে।

জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলে আপনাকে বলবে। তাছাড়া মেয়েটা কাঁদছিল তাই আর জেরা করিনি।

নিচের গোলঘরে বসতে বলো।

গোলঘরেই বসে আছে। মন্তাজ বলে।

ঘড়িতে দশটা পাঁচ বাজে। ক্যাপ্টেন জামিল কেবল নাস্তা সেরে পেপার- পত্রিকা আর চিঠি নিয়ে বসেছে। গতকাল পোর্টাররা দিয়ে গেছে। টানা ছয়দিন বৃষ্টির পর দুইদিন হলো রোদ উঠেছে। কয়দিন ঘরে শুয়ে বসে গায়ে শ্যাওলা জমার জোগাড়। রোদে শরীর ডুবিয়ে ঝিম মেরে বসে এলাচ আর আদা মেশানো গনগনে চা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। এই উটকো ঝামেলা আর আসার সময় পেল না। মানুষের সময় জ্ঞান বলে কিছু নেই। আরে ঝামেলা হলে তোদের হেডম্যানের কাছে যা-না, শত্রুর ডেরায় মরতে আসিস কেন?

জামিল গোলঘরে আসে। একটা চাকমা মেয়ে সাথে পাঁচ- বছরের এক ছেলে গোলঘরের বেঞ্চিতে আঁটোসাঁটো হয়ে বসে আছে। মেয়েটা বাঙ্গালি মেয়েদের মতো সালোয়ার কুর্তা পরেছে। দেখে মনেহয় বয়স বড়ো জোর ষোল- সতের হবে। 1

সালাম বাবু। মেয়েটা বসা হতে উঠে ঈষৎ মাথা ঝুকায়।

জামিলও প্রতিউত্তরে মাথা ঝুকায়।

এই রতন বাবুকে সালাম দে। মেয়েটা বলে।

ছোট ছেলেটা হাঁটুর ভিতর মাথা গুঁজে শক্তভাবে বসে থাকে। বাবুকে সা দে বললাম। মেয়েটা ছেলেটার মাথায় ঠুয়া দেয়। ইস্ আমার সালাম দিতে গেছে। আমাদেরকে মারবে আর আমি সালাম দিবো। কক্ষনো না।  কক্ষনো না।

মাথাটা সামান্য তুলে কথা সেরেই আবার হাঁটুতে মাথা গুঁজে। বাবু কিছু মনে নিবেন না। আমার ভাইটা ভারি দুষ্টু। আমি ওর হয়ে আপনার কাছে মাফ চাইছি।

আরে এসব কি বলছো? ওতো বাচ্চা ছেলে। বসো, তা কি জন্যে এসেছো?

জামিল জিজ্ঞেস করে।

আমি মায়া চাকমা। মেয়েটা বুঝে পায় না কিভাবে শুরু করবে।

তা তোমরা থাক কোথায়?

দুবলাছড়া পাড়ায়। মেয়েটা নিচু স্বরে বলে।

বাবা তো অনেকদূর, প্রায় ঘন্টা তিনেকের হাঁটাপথ। তোমার বাবাকে পাঠালেই চলতো।

মেয়েটা জামিলের মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। বা পায়ের নখ দিয়ে গোলঘরের মাটিতে আঁচড় কাটে। মেয়েটার পা খালি। পাহাড়ি পথে চটি পরে হাঁটা যায় না, তাই খালি পা- ভরসা। মেয়েটা পায়ের পাতা আর গোড়ালিতে শুকনো কাঁদা লেগে আছে। মাথা ভর্তি এলোমেলো যত্নহীনভাবে বেড়ে উঠা কালো চুল কোমরঅব্দি ছুঁয়ে আছে। চোখ দুটো ফুলো ফুলো, দেখে বোঝা যায় মেয়েটা অনেক কেঁদেছে। আমার বাবা নেই। মায়া চাকমা উত্তর দেয়। ওহ্, সরি। জামিল বলে।

নানা আপনার কি দোষ? না বললে কেউ কি জানতে পারে। মায়া কিছুটা

ধাতস্ত হয়।

এতদূর বনের পথ, তোমরা ছোট ছোট দুটো মানুষ হেঁটে-হেঁটে এসেছো। অনেক বিপদ আপদও তো হতে পারতো। তাই বলছিলাম আর কি। জামিল পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করে।

আসলে আমি আর রতন ছাড়া আমাদের কেউ নেই। মায়ার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠে।

রতন কখন যে কোন ফাঁকে গোলঘর হতে বেরিয়ে প্রজাপতি আর ঘাস

ফড়িঙের পিছু নিয়েছে।

জামিলের মা-বাবাহীন অনাথ ছেলে মেয়ে দুটোর জন্য কষ্ট হয়।

তা কি বলতে এসেছো? জামিল জানতে চায়।

বাবু দুবলাছড়ায় আমাদের দু একর সমান জমি আছে আর সেই জমিনের উপরেই আমাদের ঝুপড়ি ঘর। এই জমিতেই আমার বাবা, দাদা বছরের পর বছর আবাদ করেছে। সম্বল বলতে শুধু এইটুক জমি। শফি চেয়ারম্যানের লোকরা গত পরশু পাড়ায় এসে জমি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে। দুহপ্তার মধ্যে না ছাড়লে দুবলার জলে গলা কেটে ভাসিয়ে দিবে বলে ভয় দেখিয়েছে। বলে কিনা জমি ওদের। বাপু, নাকি শফি চেয়ারম্যানের কাছে বেচেছে। ওদের নাকি কাগজ আছে।

তুমি একটা কিছু করো বাবু। মায়ার ছলছল চোখ দিয়ে এবার সত্যিই জল নামে। মেয়েটা আর কতো কাঁদবে। এই বয়সে যার সুগন্ধী তেল মেখে মোষের হাড়ের কাঁকই দিয়ে চুল আচড়িয়ে বুনো ফুল গুঁজে বুক উচিয়ে ঘুরে ফিরে উঠতি বয়সের চাকমা ছেলেদের মাথা গরম করার কথা আর সেখানে কিনা পথে নামতে হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য।

তা তোমাদের কোন কাগজ আছে? জামিল জানতে চায়।

কি কাগজ? মেয়েটা অবাক হয়।

জমি রেজিস্ট্রির কাগজ। জামিল বলে।

মায়া ঠিক বুঝে না। বুঝবেই বা কি করে। পাহাড় আর খোলা আকাশের সরলতায় হাজার বছর ধরে বেড়ে উঠা আদি মানুষদের এতদিন এগুলোর দরকার হয়নি। তাই তো সুযোগ সন্ধানীরা নানাভাবে পাহাড়িদের হেনস্তা করে ভিটে ছাড়া

করছে।

দুবলাছড়ার কে না জানে এই জমি আমাদের। তুমি যাকেই জিজ্ঞেস করবে

সেই বলবে। এতো বছর ধরে আছি সেটা কিছু না দু'টুকরো কাগজই কি সব? মায়ার গলা ধরে আসে।

কে এই সরল কিশোরীকে বুঝাবে কোর্টে কাগজই সব। জামিল ভাবে। শুনছি ওরা নাকি এখানে করাতকল বসাবে। এটা কি মগের মুল্লুক যা ইচ্ছা

তাই করবে? ছড়ার জলে লাশ হয়ে ভাসবো তাও জমি দিবো না। মায়া বলে।

জামিল মায়ার গলার স্বরের দৃঢ়তায় একটু অবাক হয়। মায়া আমি বলতে পারছি না আমি কতোদূর কি করতে পারবো তবে আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করবো যাতে শফি চেয়ারম্যান তোমাদেরকে না জ্বালায়।

মায়া চাকমা যাওয়ার জন্য উঠে কিন্তু রতনের দেখা নেই। রতনের খোঁজ মেলে সৈনিক লাইনের লাগোয়া উঠোনে। রতন সৈনিকদের সাথে পা ছড়িয়ে বসে গরম চায়ে রুটি ভিজিয়ে খাওয়ায় ব্যস্ত। কে বলবে এই ছেলেটাই ওকে সালাম দেয়নি বাঙ্গালি বলে।

শিশুরা কি সহজেই বিভেদ ভুলে এক সাথে মিলে যেতে পারে বড়োরা তা পারে না। শিশুদের কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

সৈনিকেরা হেলিপ্যাড নেট লাগিয়ে ভলিবল খেলায় ব্যস্ত। হাবিলদার মন্তা আর নায়েক আছির আলীর টিমের মধ্যে খেলা। খেলায় টান টান উত্তেজন ক্যাম্পের আশপাশের পাহাড়িরাও ভিড় জমিয়েছে। পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা ঘেঁষে বসে আছে। খেলার উত্তেজনা ওদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। মন্তাজের টি এক গেমে হেরে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে চতুর্থ গেম শুরু হওয়ার কথা বিহাবিলদার মন্তাজের দলের ছেলেদের সাথে এখনও কথা শেষ হয়নি। এই গেম ওদের জিততেই হবে, না হলে আউট।

এ্যাই ভালো করে খেল বানচোতের দল। এই গেম না জিতলে বুঝিস কিন্তু। মন্তাজ কুৎসিত ভঙ্গি করে।

ওস্তাদ মুজতবা যে এতো ভালো খেলে তা তো জানি না, শালা তো একাই লাস্ট ম্যাচ জিতিয়ে দিলো। সিপাই গোলজার বলে। জানবি কি করে? আগে কি ওকে খেলতে দেখেছিস যে জানবি? নাম দেখে ভেবেছিলাম আনাড়ী হবে তবে

ছেলেটা খেলে ভাল। মন্তাজ জবাব দেয়। ও নবাবের পুত আপনার জার্সি দেখি ফক্ককা ক্লিন। দেখে মনে হয় নওশা সাইজ্যা বিয়াই যাবি। মন্তাজ জালালকে উদ্দেশ্য করে বলে।

ওস্তাদ বাঁশি বাজাবো। ল্যান্স নায়েক মঞ্জুর খেলা শুরু করবে কিনা জানতে চায়। দাঁড়া কিছুক্ষণ। হাবিলদার মস্তাজ চোখ টিপ দেয়।

মঞ্জুর জানে ওর কি করা উচিৎ। জলজ্যান্ত দুইটা পয়েন্ট নায়েক আছিরের টিমকে ও দেয়নি, তারপরও ওরা গেম জিতে নিলো। বেশি বড়ো চুরি করলে বিপদ। এই হিলে গোলাবারুদের কোনো মা-বাপ নেই, তাই কাউকে রাগানো ঠিক হবে না। নায়েক আছির আলীকে মঞ্জুর পছন্দ করে। বড় ধার্মিক লোক, ক্যাম্পের মসজিদের ইমামতির দায়িত্বও ওর। শুক্রবার নিয়মমাফিক চোখে সুরমা লাগায়, গা দিয়ে আতরের গন্ধ ভুর ভুর করে। নিরীহ গোবেচারা ভালো মানুষের দলের সাথে বেশি বেঈমানী করা ঠিক না, আল্লাহ নারাজ হবে। কিন্তু মন্তাজের টিম না জিতলে মঞ্জুরের খবর আছে। শালাকে কোনো বিশ্বাস নাই ও সব করতে পারে। জামিল স্যার আবার দু'শো টাকার পুরষ্কার ঘোষণা দিয়েছে, ফলে খেলাতে আরও উত্তেজনা বেড়ে গেছে। এই অফিসারদের যেন কোনো কাম কাজ নাই শুধু প্যাঁচ লাগানো ছাড়া। আরে শালা খেলছি আমরা তোর ইচ্ছা হলে দেখ না হলে বোতল খা গিয়ে। পুরস্কার-ফুরস্কার আবার কি। তুই অফিসার, তোকে তো বলার কেউ নেই। মন্তাজের চ্যাত থেকে আমাকে তো কেউ বাঁচাতে আসবে না। কোন দুঃখে যে রেফারি হতে গেলাম মঞ্জুরের কপাল চিন্তায় ঘেমে উঠে।

এই গেম যদি হারস তাহলে আর ছুটি পেতে হবে না। হাবিলদার মন্তাজ তর্জনী উঁচিয়ে খেলোয়াড়দের শাসায়। সৈনিকদের সবচাইতে নরম জায়গায় মন্ডাজ হিট করে। হিলে ছুটি পাওয়া হাতে চাঁদ পাওয়ার চাইতেও বেশি। মন্তাজের দলের ছেলেদের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। জালাল মাটিতে একদলা থুতু ফেলে তারপর জার্সির ডান হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। ক্ষমতা থাকলে ও মস্তাজের মুখে থুতু মারতো কিন্তু ওর কোনো ক্ষমতাই নাই। এই পাগলার কোনো ঠিক নাই, পাগলা সব করতে পারে। জালাল ছয় মাস ছুটিতে যায়নি ওর ছুটিরবড়োই প্রয়োজন। বউ কান্নাকাটি করে চিঠি লেখে। বেচারার কি দোষ? তিন মাসের বৌ ফেলে হিলে এসেছে ও।

মঞ্জুর খেলা শুরুর বাঁশি বাজায়। সৈনিকেরা চিৎকার দিয়ে টিমকে উৎসাহ দেয়। পাহাড়িরা উলুধ্বনি দেয়, কেউ কেউ ঢোল বাজায়। পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা দুই ভাগে বসে খেলা দেখে যেন এ খেলা ওদের এবার। সৈনিকরাও চায় এই খেলা চার গেমে শেষ না হয়। যত দীর্ঘ তত ভালো। পাহাড়ে প্রতিটি দিনই বডেড্ডা বিশ্রী রকম একঘেয়ে তারপর ম্যালেরিয়া আর শাস্তিবাহিনীর চোরাগোপ্তা আক্রমণ তো লেগেই আছে। বেঁচে থাকাটাই এখানে বিরাট ঘটনা। এরকম চাপ নিয়ে সৈনিকেরা দিনের পর দিন মাসের পর মাস পার করে, হাসে, খেলে। তাই তো এই খেলা নিয়ে অহেতুক মাতামাতি। সৈনিকেরা সামান্য, ক্ষুদ্র ঘটনাকে ফুলিয়ে-

ফাঁপিয়ে অসামান্য করে তুলতে পারে। দুই দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। সিপাই আকতারের উঠানো বলে

মুজতবা খাড়া লাফিয়ে থার্ড কোর্টে তীর্যকভাবে চাপ মারে। জালাল বাম দিকে ঝাঁপিয়েও বল তুলতে পারে না। ওর শরীর ধুলায় মাখামাখি খায়, বাম উরু ছিলে রক্ত জমে থাকে। সৈনিকেরা হৈ হৈ করে উঠে। মঞ্জুরের বাঁশি বেজে উঠে, ইঙ্গিতে বুঝায় নেট টাচ। মুজতবা তেড়ে আসে কিন্তু মঞ্জুর ডিসিশনে অনড়। আবার খেলা শুরু হয়। এতো কিছুর পরও মন্তাজের দল তিন পয়েন্ট পিছিয়ে। মঞ্জুর অনুভব করে ওর শার্টের ভিতর ঘাম দরদরিয়ে ঝরে। ও বুঝে না এটা গরম না ভয়। মন্তাজ ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। মন্তাজের দিকে তাকানোর সাহস হয় না ওর। মুজতবার উপর ওর রাগ হয়, শালা সর্বনাশের গোড়া। আর ভেবে লাভ নেই যা হবার হবে; এতো চুরির পরও না জিতলে ওর করারই বা কি আছে। মঞ্জুর ফু-উ-উ দিয়ে খেলার শেষ বাঁশি বাজায়। হাবিলদার মস্তাজের টিম দুই

পয়েন্ট বাকী থাকতে হেরে যায়। নায়েক আছিরের দল মুজতবাকে মাথায় নিয়ে খুশিতে হৈহুল্লোড় করে। তুই তো ছোকড়া দেখি বেড়ে খেলিস, হাবিলদার মস্তাজ মুজতবার পিঠ চাপড়ে বলে। জালালের দেহ ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসতে চায়। ও জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছে। শুধু চেষ্টা দিয়ে তো আর খেলা জেতা যায় না। আজ ওদের দিন না। কপালে নেই তো হয়নি ও বেশি কিছু ভাবতে চায় না ঘরে যেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়বে। হাবিলদার মন্তাজের ব্যবহার খেলা শেষে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে কিন্তু কিছুই বলা যায় না। তবে এটা ঠিক শালা যদি ছুটির লিস্টে ওর নাম

না দেয় ও নির্ঘাৎ বানচোতের মাথায় পুরো ম্যাগাজিন খালি করবে। মাঠ ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে আসে। পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা হল্লা করে ঘ

ফেরে। একটু আগেও যেখানে ছিল গমগমে কোলাহল, সেখানে ঝপ করে চেপে নেমে আসে নীরবতা। সবাই যার যার মতো জীবনের রুটিনে ফিরে যােবৃত্তের বাইরে চকিত বিচরণ বৃত্তে ফিরে আসাকে সহজ করে। আনন্দের প্রহর কেবল সংক্ষিপ্তই নয় কষ্টেরও বটে। ভুলে থাকার এই অনাদি প্রচেষ্টা বড়োই ঠুনকো, হালকা তবুও মানুষ বারে বারে ভুল করে ভুলে থাকার চেষ্টায়ই মাতে। ল্যান্স নায়েক মঞ্জুর হাবিলদার মন্তাজের চোখ এড়িয়ে সৈনিক ব্যারাকের দিকে দ্রুত পা চালায়। ও খেলেনি খেলিয়েছে তারপরও নিজেকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হয়। মনে হয় শরীরের হাড়-হাড্ডি নিজ থেকেই মড়মড় করে ভেঙ্গে পড়বে। আজকের দিনটাই কুফা। ভাবার চেষ্টা করে সকালে কার মুখ প্রথম দেখেছিল। ক্লান্ত শরীরে ভাবাও কঠিন।

দিন কয়েক ওর মন্তাজকে এড়িয়ে চলতে হবে বাকীটা আল্লাহপাকের ইচ্ছা। আরে মঞ্জুর নাকি? হনহন করে কই যাও? নায়েক আছির আলী জিজ্ঞেস

করে।

ছোট ওস্তাদ যাবো আর কই যাওয়ার জায়গা তো একটাই। ওস্তাদ আপনার দলতো বড়ো ওস্তাদকে এক হাত দেখিয়ে দিলো। মঞ্জুর বলে।

ধু্যুৎ, জেতা আর হারা বাদ দাও তো এসব। ছেলেরা হৈহুল্লোড় করে খেললো এটাই তো বড়ো কথা। খেলাও শেষ ভাবনাও শেষ।

আমার টিম জিইত্যা কি বাঘ মারছে? তা তুমি তো চেষ্টা কম করো নাই। আছির আলীর সোজা সাপ্টা উত্তর।

ওস্তাদ আপনি তো সবই বোঝেন। পাগলাকে নিয়েই তো চিন্তা। বড়ো চিন্তায়ই আছি শালা আবার ঝামেলা না বাঁধায়।

ধুরও, তোমরা খামোখা মন্তাজ ওস্তাদকে ভয় পাও। মানুষটা কিছুটা পাগলা কিসিমের বটে কিন্তু মন ভালা। আমি সিওর ওস্তাদ এখন সব ভুইল্যা দমে আছে। কোনও চিন্তা কইরো না। যদি কোনও অসুবিধা হয় জানিয়ো, সব ঠিক কইরা

দিমু। আছির আলী সান্ত্বনা দেয়।

তা মাগরিবের আর বেশি দেরি নাই। তাড়াতাড়ি যাউগ্যা, কাপড় বদলায়ে

নামাজে আসো। আছির আলী তাড়া দেয়।

আজ আর পারবো না ওস্তাদ, মাফ করে দেন।

আমি কে? মাফ দেওয়ার মালিক তো আল্লাহ। হায়রে মাবুদ, খেলায় ক্লান্তি নাই কিন্তু পাঁচ মিনিটের নামাজে যতো ক্লান্তি। সবই শয়তানের ওয়াসওয়াসা মানুষ বুঝে না। আছির আলী ধীর পায়ে মসজিদের দিকে এগোয়।

সূর্যের লালচে আভা একটু একটু করে ম্লান হয়। মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি পাহাড়ের পায়ে নদীর ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কেমন যেন অস্ফুট হাহাকার বুকের মাঝে কেঁদে উঠে। এইভাবে একটা দিনের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে শুরু

হয় নতুন দিনের জন্মের আয়োজন।

মঞ্জুর ঘুমানোর চেষ্টা করে। এত ক্লান্তির পরও ওর ঘুম আসে না।

 ১০

দিন যত যাচ্ছে পাহাড় ততই অশান্ত হয়ে উঠছে। আরো দুই ব্যাটালিয়ন সৈনিক আসার অপেক্ষায়। খাগড়াছড়িতে পাঁচটা নতুন ক্যাম্প হচ্ছে। ক্যাম্প ঘিরে গড়ে তোলা হচ্ছে বাঙ্গালিপাড়া। বগুড়া টু বরিশাল সবখান থেকেই প্রতিদিন শত শত লোক আসছে। এই সমস্ত ছিন্নমূল প্রান্তিক মানুষদের দোষ দেওয়া যায় না। যাদের জীবন কাটে অর্ধাহার আর অনাহারে, যাদের সম্পত্তি বলতে নিজের শরীর ছাড়া কিছু নেই সেখানে দুটো হালের বলদ আর দু'কাঠা জমির লোভ সামলানো কি চাট্টিখানি কথা? তারপর উপরি থাকছে বিনামূল্যে রেশনের চাল। তাই তো মানুষ হন্যে হয়ে ছুটছে শ্লেটের পুরোন লেখা মুছে নতুন জীবন রচনার স্বপ্নে। যারা আসছে তাদের সবাই যে নিরন্ন গোবেচারা মানুষ জীবনের তাগিদে পাড়ি দিয়েছে অচেনা পাহাড়ি রাজ্যে তাই বা বলা যায় কিভাবে? এদের মাঝে লুকিয়ে চুরিয়ে আসছে সিঁদেল চোর থেকে শুরু করে ডাকাত, লুটেরা, খুনের আসামী পর্যন্ত। কে রাখে কার খবর? কে রুখবে ওদের, বাংলাদেশী হিসাবে দেশের যে কোনও প্রান্তে যাওয়ার বা থাকার অধিকার ওদের তো আছে।

পাহাড়ি জুমিয়ারা এদের আসাকে সন্দেহের চোখেই শুধু দেখে না বরং ওদের মাঝে কাজ করে চাপা আতঙ্ক। প্রথমে ছিল কৌতূহল, তারপর সন্দেহ, সেই সন্দেহই একটু একটু করে দানা বাঁধে আতঙ্কে। সেই আতঙ্কই আজ পরিণত হয়েছে ঘৃণার মহীরুহে। মুক্ত নীলাভ আকাশের নিচে সীমাহীন পাহাড়, নির্ভেদী বনানী আর উপত্যকায় পাহাড়িরা নির্বিঘ্নে হেঁটে বেড়িয়েছে হাজার হাজার বছর। নিবিড় মমতায় এক জঙ্গল পুড়িয়ে জুম চাষ করে ছুটে গেছে অন্য বছর আরেক বনে। এই পাহাড়েই ওদের জীবন এই পাহাড়েই ওদের মরণ। একজন পাহাড়ির জীবনে প্রতিটি দিন যেমন নতুন অথচ একই সাথে আবার হাজার বা পুরাতন। বর্তমানের পাহাড়ি কিশোর হাঁটে হাজার বছরের পূর্ব পুরুষের ছাপ ধরে। এই নির্ভাবনাময় নিশ্চল শান্ত জীবনে যখন অচেনা মুখ ঘরের দা উঁকি-ঝুঁকি মারে, যে মুখ সহস্র বছরের সারল্যে গড়ে উঠেনি, যে চোখে সবুজের শাস্তি বরং শিয়ালের ধূর্ততা তখন তো ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। পাহাড়ে এমনিতেই সমতল জমি কম তারপর এই বাড়তি মানুষের চাপ বন সইতে পারছে না ফলে উধাও হচ্ছে বৃক্ষ, অরণ্য এমনকি পাহাড় পর্যন্ত। যেখানে পাঁচ বছর আগেও ছিল ঘন বন। বনমোরগ, হরিণ ছোটাছুটি করেছে এখন সেখানে হচ্ছে ধানের চাষ। পাহাড়িরা বংশ পরম্পরায় এই বনকে লালন করেছে মায়ের মতো। কিন্তু বাঙ্গালিদের তো সেই মন নেই। এই মন গড়ে ওঠে হাজার বছরের মমতায়, একদিন বা একজীবনে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাঙ্গালি এসেছে লুটেরার মতো, ওরা কিভাবে স্পর্শ করবে বনের আত্মা, ভালোবাসা দূরে থাক। নগদ যা পাওয়া যায় তাই তুলে নাও বাকীর কথা না ভাবলেও চলবে ফলে যা হবার তাই হচ্ছে যেখানে সেখানে বাঁধছে বাঙ্গালি-পাহাড়ি বিবাদ। এই বিবাদকেই কাজে লাগাচ্ছে শান্তি বাহিনী আর সুযোগ সন্ধানী বাঙ্গালিরা।

ক্যাপ্টেন জামিল গোর্খা ব্লাক ড্রাগন চুরুটে দীর্ঘ একটা টান মারে। টপ ক্লাশ মাল বটে; টানের সাথে মস্তিষ্কের কোষে কোষে জমে থাকা ক্লান্তি ঝেটিয়ে বের করে আনে। থেঁতো মন নিমিষেই চনমনে হয়ে উঠে। চারিদিকে শুধু খারাপ খবর। ছ'মাস আগেও পরিস্থিতি এতটা ঘোলাটে ছিল না, সৈনিকেরা সাদা পোষাকে পাহাড়ি দোকানে সওদাপাতি করতো। পাহাড়িরাও খুশি ছিল বাড়তি বিক্রি বাটার জন্য। পানছড়িতে কাঁচা টাকা তো সৈনিক আর থানা বাবুদের হাতে। পাহাড়িদের ঘরে সাংবছরের চাল থাকলেও কাঁচা টাকাতো আর নেই। পাহাড়িরা সৈনিকদের খুশি হয়ে দিতো ফ্রি পাতার বিড়ি কিংবা ইন্ডিয়ান পাতি জর্দা দিয়ে মশলাদার পান। সেই দিনগুলো কেমন জানি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সবখানে নীরব চাপা উত্তেজনা। মুখে না বললেও বোঝা যায় কোথায় জানি সুর কেটে গেছে। ভালো দিন বেশিদিন টেকে না।

এই তো সেদিন এল। কত স্পষ্ট সেই দিন এরই মধ্যে দেখতে দেখতে নয় মাস কেটে গেছে। আগে দিনের হিসেব রাখতো এখন রাখে না। মনে হয় আর বোধহয় ফেরা হবে না। ও চিরতরে আটকে গেছে। গোটা দেহ নিয়ে ফিরতে পারলেও গোটা মন নিয়ে ফেরা এই জীবনে আর নয়। আগে দিলু নিয়মিত লিখতো এখন আর লেখে না। লিখে কি হবে? যে সম্পর্কের পরিণতি নেই আছে শুধু দীর্ঘশ্বাস। এই সম্পর্ক টেনে লম্বা করার মাঝে এক ধরনের শুদ্ধ অহংকার থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু প্রাণ থাকে না। প্রাণ থাকে দেখায়, ছোঁয়ায়, এমনকি নিঃশব্দ পাশাপাশি বসে থাকায়। স্পর্শে সুখ আছে বলেই তো অনভিপ্রেত স্পর্শহীন জীবনের ভয় সম্পর্ককেও প্রতিনিয়ত গাঢ় করে। যখন দূরত্ব দীর্ঘ স্পর্শহীনতাকে নিয়তি করে তোলে, তখন সম্পর্ক নির্বাক ফ্রেমে বন্দি ছবির মতো দেয়ালে ঝোলে। ধূপ-ধূনা জ্বালিয়ে ছবিতে ফুলের নৈবেদ্য দেওয়া যায় কিন্তু এতে রক্ত মাংসের দেহ কি শান্ত হয়? ভৌগোলিক দূরত্ব শুধু মনের দূরত্ব বাড়িয়ে ক্ষান্ত দেয় না বরং, একটু একটু করে পরিচিত জনকেও অপরিচিত করে তোলে।

এই পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশেরই অংশ অথচ মনে হয় কোনো কক্ষচ্যুত গ্রহ। এখানে যে প্রতিদিন এত রক্ত ঝরছে দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষরা জানে না কিংবা ওদেরকে জানানো হয় না। পাহাড়িদের রক্ত কি এতই মূল্যহীন?

এই মাসে দিলুর বিয়ে ঠিক হয়েছে অথচ জামিলের তেমন কিছু বোধ হয় না। না কষ্ট, না হাহাকার, হতাশা কোনো কিছুই না। এমন পরিস্থিতি অন্য কেউ হলে হাঙ্গামা বাঁধাতো, পাত্রের কাছে বেনামে কুৎসিত চিঠি লিখতো। জামিলের শুধু মনে হয় চোখের সামনে দিয়ে বায়োস্কোপের পুরোনো ঘটনার স্লাইড একের পর এক সরে যাচ্ছে। ও শুধুই দর্শক। ওর করার কিছু নেই শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া। একটা মেয়ে নিজের বিয়ে নিয়ে আর কত বেহায়াপনা করতে পারে তবুও তো ইনিয়ে-বিনিয়ে কম তো জানায়নি। কিন্তু পাহাড়ে এই অনন্ত যুদ্ধ একটু একটু করে ওকে পাল্টে ফেলেছে। যেখানে রক্ত ঝরে প্রতিদিন, শুধু বেঁচে থাকার প্রচেষ্টাই যার একমাত্র বাস্তবতা। সেখানে নিজের অনিশ্চিত জীবনের সাথে জেনেশুনে আর একটা জীবন জড়ায় কেমন করে? ভালোবাসলেই কারো উপরে শারীরিক অধিকার জন্মে যায়-তাতো না। শুধু শারীরিক দখলে ভালোবাসা পরিপূর্ণ হয় না বরং এর অকাল পরিণতি ঘটে। তবুও কষ্ট হয়, কষ্ট থাকে। ক্যাপ্টেন জামিল আর একবার দিলুর চিঠিতে মনোনিবেশ করে।

জামিল,

কাল ইত্তেফাকে তোদের হিলের খবর দেখলাম। একেবারে শেষ পাতায় গুণে গুণে সাত লাইনের খবর অথচ পাঁচজন সৈনিক মারা গেছে সেখানে খালেদার মিছিলের ছবি বড়ো করে প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। দেশটার হলো কি বলতো? তোকে না চিনলে এই খবরও বোধহয় আমার চোখও এড়িয়ে যেতো। দেশ গোল্লায় যাক। নিজের চিন্তাতেই ঘুম হারাম। তোরা সব পুরুষ স্বার্থপরের জাত, কি সুন্দর সব ভুলে কিছু না কিছু নিয়ে মেতে থাকতে পা কিন্তু মেয়েরা পারে না। মেয়েদের দোষ পায়ে পায়ে। সময় থাকতেই মেয়ে কারো না কারো গলায় ঝুলে পড়তে হয়, না পারলে গোটা বাড়িতেই সবার কাছে নিজেদের কেমন জানি অপরাধী মনে হয়। সবাই আমাকে নিয়ে ভাবছে। আমি যে নিজেকে নিয়ে ভাববো সেই ফুরসতটুকু পর্যন্ত নেই অন্যরা কি ভাবছে এই চিন্তাতেই কুল পাচ্ছি না। বাবা তো সোজা সাপ্টা মাকে একদিন বলেই বসলেন- বলেছিলাম ম্যাথ পড়ার দরকার নেই এখন হলো তো, অংকের কথা শুনে কেউ কোনো কথা বলে না। গত সপ্তাহে এক ডাক্তার ছেলে এসেছিল, দেখতে শুনতে ভালোই তবে একটু নাদুস-নুদুস। ম্যাথে মাস্টার্স শুনে রীতিমতো বিষম খেলো (এক দম সত্যি বলছি), শেষে পানি এনে বেচারার বিষম থামালাম। বলে কিনা এই প্রথম কোনো ম্যাথ পড়ুয়া মেয়ে দেখলো। এমনভাবে আমাকে দেখছিল যেন মিরপুরের বাঁদরের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

তবে গতকাল একজন এসে আংটি পরিয়ে গেছে। ছেলের পুরোনো ঢাকায় আতরের হোলসেল দোকান। ম্যাথ শুনে বলে মাশাল্লাহ বড়ই ওজনদার সাবজেক্ট। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তোকে লিখছি আর বারে বারে আংটি ঘুরিয়ে দেখছি। ভাবছি আতর বাবুর সব স্কু-বল্টু ঠিক আছে কিনা। হয়তো বেচারা স্কুলে অংকে গোল্লা পেতো বোধহয় সেই দুঃখ অন্যভাবে ঘোচাতে চাইছে। তাই একটু মায়াও হচ্ছে (বেশি না অল্প)।

তোর জন্য আজ বুকটা একটু চিচিন্ করছে। মেয়েদের শত দুঃখ তোরা বুঝবি না। বাবার খুশিতে যা একটু ভালো লাগছে। বেচারা একদম সিঁটিয়ে ছিল। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে এই মাসের আঠারো তারিখে, এখনও বারো দিন বাকী। এই বারোদিন শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববো, শুধু নিজেকে নিয়ে। হয়তো কাঁদবো, অনেক কান্না জমে আছে। মেয়েরা তো অনেক কিছু করতে চায় কিন্তু পারে না তাদেরকে তো বাঁচিয়ে রাখে চোখের জল।

এটাই তোকে লেখা আমার শেষ চিঠি। মেয়েদের বিয়ে ঠিক হলে আর পুরোনো যোগাযোগ রাখতে নেই এতে অকল্যাণ হয়। দিনে দিনে অনেক ভয় জমে গেছে তাই কোনো অকল্যাণ সইবার শক্তি আর নেই। তাই একটু বড়ো করে লিখলাম।

তুই ভালো থাক আমার গুণ্ডা। সব মুছে ফেলা গেলেও স্মৃতি কেন যায় না রে, পারলে ভালো হতো? সাবধানে থাকবি। যুদ্ধ কোনো খেলা না।

ইতি

তোর (অতীত দুঃস্বপ্ন)

দিলু

পুনশ্চ: পড়ার পর চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলিস।

 

জামিল এই নিয়ে পাঁচবার চিঠিটা পড়লো। চুরুটের আগুন কখন যে নিভে গেছে। ওর সম্বিত ফিরে এল যখন এক ফোঁটা অশ্রু সশব্দে চিঠির উপর পড়ে। অদ্ভুত! ও ভীষণ অবাক হয়। জামিল ফোঁটাটার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। ফোঁটাটা কাগজ শুষে ক্রমশ বড়ো হয়। ঠিক দুঃখ শব্দটার উপর ফোঁটা পড়েছে। 'দুঃখ' শব্দটা একটু লেপ্টেও গেছে। ও কাঁদছে। ও যে কাঁদতে পারে ও জানতো না। জামিল হাত দিয়ে চোখ মোছে। কেউ কোনোদিন জানবে না এই নির্জন বনের আলো আঁধারিতে মেশা গোলঘরে এক মানুষ আর এক মানুষের জন্য কেঁদেছিল। ও কোনোদিন কাউকে বলতেও পারবে না। নারীরা পারে পুরুষরা পারে না। তাই পুরুষের যন্ত্রণা কেউ বোঝে না। নারীর অশ্রুতে আকাশের কালো মেঘ এক সময় কেটে যায়, পুরুষের অশ্রুতে কালো মেঘ তো কাটে না বরং বায়ুহীন গুমসো মেঘলা আকাশ আরও চাপ ধরে থাকে।

জামিল তীব্রভাবে অনুভব করে ও দিলুকে গভীরভাবে ভালবাসে। ভালোবেসে তো মানুষ সুখী হতে চায় তবে সুখী হওয়ার পথে এত কষ্ট কেন? কষ্টহীন ভালোবাসা বলে কি কিছু আছে? ও জানে না।

 ১১

কড়া রোদ্দুরে গোটাবন ঝলমল করে। ক্যাম্পের পাশের পাঁকুড় গাছ ছেয়ে বসে আছে শত শত টিয়া। জীবনে ও একসাথে এত টিয়া দেখেনি আর কোনোদিনও দেখবে না। কি আনন্দে ক্যাঁক-ক্যাঁক শব্দে হুটোপুটি খেয়ে সবুজ শরীরে রোদ মাখছে। দেখেও সুখ। ওরা কি জানে এখানে যুদ্ধ চলছে। ঘৃণায় ফুঁসছে সবাই। হয়তো জানে। মানুষ পশু-পাখিদের যতখানি বুদ্ধিহীন মনে করে আসলে তা সত্যি নয়। আর ওদের বয়ে গেছে আমাদের কাছে ওদের বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা দিতে। ওরা মারামারি, খেয়োখেয়ি করলেও আমাদের মতো ঘৃণায় দাঁত পিশতে জানে না।

উফ্ কি তরতাজা দুপুর আজ। এমনদিনে ইচ্ছা হয় না যুদ্ধ নিয়ে ভাবতে। এখানে না এলে হয়তো কোনো এক ক্যান্টনমেন্টে এক বেড রুমের ছোট্ট বাসায় দিলুকে নিয়ে ছোট্ট এক সংসার পাততো। দিলু পুতুলের সংসারের মতো অহেতুক নানা কাজে অকাজে নাকাল হতো। বেডরুমের কোন দেয়ালে ওদের বিয়ের ছবি ঝুলবে এই তর্কেই কাটিয়ে দিতো মধ্য দুপুর, তারপর বিকালে ঝালমুড়ি আর ধোঁয়া উঠা চায়ে চুমুক দিয়ে ছোট্ট টিভির সামনে বসে সিরিয়াল দেখতে দেখতে ওদের সন্ধি হতো। জগৎ সংসারে কোথাও কোনোখানে একটুও ছন্দপতন হতো না অতি সামান্য এই দুই মানুষের মিলনে। কত ছোট্ট চাওয়া তাই মাঝে মাঝে কত দুর্লভ হয়ে যায়। যুদ্ধ শুধু মানুষই মারে না। যুদ্ধের ডামাডোলে পড়ে মানুষের বিবেক রক্তাক্ত হয়; মানুষ বিভক্ত হয়; বন্ধু শত্রু হয়, শত্রু পরিণত হয় বন্ধুতে। একজনের মৃত্যু শুধু একজনের শারীরিক অনুপস্থিতিতে শেষ নয় বরং তার অভাব তার পরিবার, আত্মীয়-অনাত্মীয় যাদের সাথে ছিল তার উঠাবসা সবার মাঝেই রেখে যায় বিরাট ক্ষত। এই ক্ষত উপশম হতে কয়েক প্রজন্ম সময় লাগে তবুও কি তা পরিপূর্ণভাবে মিলায়? মিলায় না। মিলে যায় না কোনোদিনই।

স্যার খুব খারাপ খবর। হাবিলদার মন্তাজের ভয়ার্ত ডাকে জামিলের চিন্তার জাল ছিন্ন হয়। ও কিছুটা চমকে উঠে। চারিদিকে শুধু খারাপ সংবাদ এখানে ভালো কিছু ঘটে না।

কি খবর?

স্যার মিনিট দশেক হলো সিপাই শাহেদুর মারা গেছে। হাবিলদার মন্তাজের গলা ভারী হয়ে আসে।

বলো কি তুমি? ওকে তো কয়েকদিন আগেও সুস্থ দেখলাম। জামিল ভারি অবাক হয়।

স্যার তিনদিনের ম্যালেরিয়ায় কেউ মারা যায় তা তো জানতাম না। আহারে কি তাজা জোয়ান মরদ পোলা। কেউ বিশবার ম্যালেরিয়াতে ভুগেও মরে না আর তিনদিনের জ্বরেই শ্যাষ। ও মাবুদ রে তোমার লীলাখেলা বোঝা ভার। মন্তাজের চোখ ছলছল্ করে।

কোথায় ও?

স্যার লাইনেই শোয়া আছে।

জামিল আর মন্তাজ সৈনিক লাইনের দিকে এগোয়।

বেশ কয়েকজন সৈনিক একটা চৌকি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখে মুখে

কেমন জানি ভাবলেশহীন থমথমে ভাব।

এ্যাই তোরা সর, স্যারকে দেখতে দে, আসেন স্যার।

হলুদ-লাল ফুল তোলা বিছানার চাদরে লাশ ঢাকা আছে। নায়েক আছির

আলী মুর্দার পাশে বসে কোরান শরীফ পড়ে। জামিলকে দেখে গলার স্বর আর একটু নিচু করে।

সিপাই মমতাজ আলতোভাবে লাশের মুখ হতে চাদর সরায়। কে বলবে মরে গেছে। দেখলে মনে হয় ঘুমিয়ে আছে। ডাকলেই ধড়মড়িয়ে উঠবে।

কি হয়েছিল রে? জামিল সবার উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন করে।

স্যার আমি দুইটা রুটি, ভাজি আর এক বাটি সুজি এনে শাহেদুরকে দেই। কুক সামাদ শুরু করে।

শাহেদুর বলে সামাদ ভাই রুটি খাইতে মন চায় না একটু ভাত আনবা, একটু নরম কিসিম।

আজ তো হগলের লাইগ্যাই চাপাতি, ভাত পামু কই। খাড়াও দেহি কি করতে

পারি? এই কথা বলে আমি ওখান থেকে চলে আসি। তারপর আমি মন্তাজ ওস্তাদের সাথে দেখা করি। ওস্তাদ কয় জ্বরের মুখে রুটি রোচে নারে, ভাত খাইতে চায় যখন দে কিছু চাল ফুটায়ে।

যখন আমি ভাজি আর আলুভর্তা দিয়ে ভাত আনি, দেহি শাহেদুর যে

দিকে মুখ ফিরায়ে একা একা কথা কয়। মা আমি আইতাছি। সাগর ব সাগরকে দেহি না ক্যান?

এই শাহেদুর কার লগে কথা কস? এই যে তোর খানা আনছি। শাহেদুর একটু মাথা তুলে তাকায়, চোখ দুখান দেহি জবা ফুলের লাহান লাল। শাহেদুর বিছানায় বসেই হাত ধুয়ে ভাত মাখায়। কয়েক লোকমা মুখে দিয়ে

কয়, সামাদ বাই ভালো লাগে না আর খাইতে পারুম না। আমি কইলাম আরও

কয়েক লোকমা খাও না ক্যান, এতো কষ্ট কইরা ভাত আনলাম। না আর পারুম

না, বমি আইতে চায় শাহেদুর হাত ধুয়ে শুয়ে পড়ে।

আমি ট্রেতে প্লেট গোছাই, দেহি শাহেদুর খুব কাঁপতাছে, ভাবলাম আবার জ্বর আসতাছে।

শাহেদুর কয় সামাদ ভাই আমারে শক্ত কইরা ধরো, আমি আর বাঁচুম না। আমি কই-কি কও ওসব। ম্যালেরিয়ায় ইরকম হয়, চিন্তা কইরো না, ওষুধ খাও ঠিক হইয়া যাবা। ততোক্ষণে শাহেদুরের গলা দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ হয়, চোখ দেইখ্যা মনে হয় ঘরে ওর চোখ নাই, ঘোলা ঠেকে। আমার ডর আসে, আমি ডাক দেই ওস্তাদকে কোথায় আছো জলদি আহো, শাহেদুর কেমন জানি করতাছে। বড়ো ওস্তাদ, ছোট ওস্তাদ আরও অনেকে ছুটে আসে। শাহেদুরের ঘড় ঘড় শব্দ আরও বাড়ে, লম্বা-লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে তারপর হেঁচকির লাহান জোর শব্দ তোলে, এরপর সব ঠাণ্ডা।

ও আল্লারে নিজের কোলে এইভাবে আগে কারও মরতে দেহি নাই। কুক

সামাদ চোখ মুছে। স্যার, ভয় ধইরা গেছে। হিলে মরণ লাগছে। আমরা কেউ বাঁচুম না।

সামাদের কথা ধ্বনিত হয় আরও অনেকের মাঝে। সবার চোখে মুখে এখন ভয়ের ছায়া নাচানাচি করে। এই পাহাড় ওদের সবাইকে খাবে। শুধু আগে আর পিছে।

হাবিলদার মস্তাজ চাদর দিয়ে মুর্দাকে ঢেকে দেয়। যা তোরা আর ভিড় বাড়াস নে। সৈনিকেরা একে একে চলে যায়। ক্যাপ্টেন জামিল মন্তাজকে হেলি ইভাকুয়েশনের জন্য ব্যাটালিয়নে খবর দিতে বলে। অল্পক্ষণের মধ্যে বিশ্রী শব্দ করতে করতে একটা কুৎসিত পাখির মতো জলপাই রঙের হেলিকপ্টার আসবে। হয়তো সাথে থাকবে আর একজন সৈনিক স্থান পূরণের জন্য। কোনো কিছুই পাল্টায় না বা পাল্টাবে না। এখানে মৃত্যু একটা সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান মাত্র। সৈনিকেরা আবার হাসবে, খেলবে, পেট্রোলে বের হবে। অনেক মৃত্যুর ভিড়ে কজনা মনে রাখবে এখানে কয়েকদিন আগেও একটা মানুষ ছিল যার এই সমাজে একটা অবস্থান ছিল তা যত নগণ্যই হোক না কেন? সব মানুষের জীবনে নানা গল্প থাকে তাকে জড়িয়েও নিঃসন্দেহে অনেক গল্প ছিল। আজ সেই গল্প শোনার জন্য কেউ নেই। অন্যকে নিয়ে ভাববার বিলাসিতা অন্য কোথাও থাকলেও যুদ্ধক্লিষ্ট পাহাড়ে তা নেই। শাহেদুরের মাত্র দু'বছর হলো বিয়ে হয়েছিল। গত মাসে ওর একটা ছেলে হয়েছে, ভালোবাসার প্রথম সন্তান। বেচারার সামনের মাসে ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল। ছুটিতে যেয়ে এই ছোট্ট শিশুকে ঘিরে স্বামী-স্ত্রী মিলে কতো না স্বপ্নের জাল বুনতো। শিশুদেহের মিষ্টি গন্ধ আর কচি মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই কেটে যেতো দ্রুত ছুটির দিনগুলো এখন এই শিশুকে পিতৃহীন নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা বেড়ে উঠতে হবে। যার যায় শুধু সেই বোঝে। যে গেল সে তো চলেই গেল, যারা থেকে গেল তাদের জীবন আজীবনের জন্য বদলে গেল। এতোগুলো জীবনের যে অপ্রত্যক্ষ ক্ষতি হলো তার হিসাব কে রাখে?

ক্যাপ্টেন জামিল জানে আজকের এই বিষণ্ণতা কালকেই অনেক ফিকে হয়ে যাবে। এটাই জীবনের ধর্ম কিন্তু তারপরও এক শূন্যতা মনকে ঘিরে থাকে। এত দীর্ঘ অপেক্ষার পর কিশোরী বধূ যখন জানবে তার স্বামী আর কোনোদিনই আসবে না তখন কিভাবে প্রসব ক্লান্ত কিশোরী দেহমন এই কষ্ট সইবে? কষ্টের ধকল পুরোপুরি কাটবার আগেই ওকে উঠে দাঁড়াতে হবে, জীবনের যন্ত্রণাময় পথ পাড়ি দিতে হবে শুধু ওই শিশুটার জন্য।

হায়! খোদা মানুষের এক জীবনে এত কষ্ট কেন দিলে? আর কষ্টই যদি দিবে তাহলে বুকে এত মায়া কেন দিলে? যে জীবনকে গড়লে এত পলকা, ভঙ্গুরভাবে আবার সেই জীবনকে তুমি বাঁধলে মায়ার বাঁধনে। মানুষ বড়োই অসহায় যখন এই মায়ার বাঁধন খসে পড়ে।

টিয়াগুলো অনেকক্ষণ হলো উড়ে গেছে। ওরা দল বেঁধে আসে আবার দল বেঁধে যায়। ওরাও কি কষ্ট পায় প্রিয়জনের বিরহে?

এই ধরণীতে মানুষের যেমন আধিপত্য ঠিক তেমনি বেদনায় নীল হওয়ার

কষ্টও শুধু মানুষের।

কে ওখানে? হাবিলদার মন্তাজ চেঁচিয়ে ডাকে।

একটা মানুষ মাথা উবু করে টিলার নিচে বাইর ঘরের পাশে ঘোরানো সিঁড়িতে নিখরভাবে বসে আছে। কোনো জবাব আসে না। হয়তো শুনতে পায়নি। ভাবের ঘোরে কিছুই শোনা যায় না। এখন রাত প্রায় দেড়টা সৈনিকরা দশটার মধ্যে সবাই শুয়ে পড়ে। এতক্ষণে সবাই একেবারে ঘুমে কাদা হয়ে আছে ছোকরাটা তখন হতে জেগে আছে। এখানে রাত তো একজনই জাগে সেট ও। যারা মন ভাঙ্গা পাপী তারা রাতে ঘুমায় না। ঘুমতো আল্লাহর খাস নি তার মতো পাপীদের জেগে থাকাই নিয়তি। ও কেন ঘুমায় না? কি রে জবা না? মন্তাজ গলা আরও চড়ায়।

আমি ওস্তাদ।

আমি কে?

আমি গোলজার।

কিরে ঘুম আসে না। মন্তাজ নরম গলায় বলে।

ও ভাবতেও পারেনি ওটা গোলজার। গোলজার জোকার কিসিমের। যে পোলা কথায় কথায় হাসায় সে ক্যামনে এতো রাত জাগে। মন্তাজ জানে গোলজার শুধু জেগেই আছে না সে কাঁদছিলও। ওর ফুঁপানি ওর কান এড়াতে পারেনি। মন্তাজ কান্নার কথা এড়িয়ে যায়। কেন যে পুরুষ কান্দনকে এতো ভয় পায়?

"পুরুষ কান্দে লুকায় চুরায় হায়রে নারী কান্দে ডুকরাইয়া বান্দা কান্দে মাফের লাগি, আশিক বুক ভাসাইয়া।"

মন্তাজ ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গোলজারের পাশে এসে বসে। গোলজার তোর মন কি খুব খারাপ?

না ওস্তাদ ভালো লাগে না তাই বসে আছি। সামাদের কথাই ঠিক ওস্তাদ। আমরা কেউই ফিইরা যাইতে পারবো না। হয় মরবো ম্যালেরিয়ায় না হয় গুল্লি খেয়ে। মন ভালো লাগে না। ঘুম আসে না তাই বসে আছি। গোলজার উত্তর দেয়। মন্তাজ বুঝে না এর কি জবাব দিবে। প্রিয়জন পরিবেষ্টিত হয়ে জনম পরিচিত

মুখগুলোর দিকে তাকাইয়া মরণ আর জঙ্গলে গুলি খেয়ে মরা অথবা অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে একাকী মরা কোনোদিন এক হতে পারে না।

আরে দূর পাগলা। আমরা ফিরতে পারবো না ক্যান? তয় যুদ্ধ যখন তখন কেউ তো কেউ সত্যই ফিরবো না। যুদ্ধের এটাই নিয়ম। কিন্তু সবাই ক্যান নরবো। আমাকে দেখ এই নিয়া দশ বছরে চারবার হিলে আইলাম। মুখে গুলি লাগলো কই মরলাম না তো। গোলজার কপালে মরণ থাকলে লোহার সিন্দুকে লুকালেও বাঁচবি না। মন্তাজ সান্ত্বনা দেয়। গোলজার ছেলেটাকে ও পছন্দ করে। কচি বয়স তাই একটু ভয় খাইছে। যুদ্ধ তো আর লাঠি খেলা না যে মাথা ফাটলেও

মরবো না।

ওস্তাদ যুদ্ধ তো অনেকদিন চললো। এইটা কি থামবো না?

গোলজার প্রশ্ন করে।

তুই তো দেহি বিরাট কঠিন প্রশ্ন করছস? তুই আর আমি নাইন পাশ সৈনিক। আমাদের কাজ যুদ্ধ করা যুদ্ধ থামানো না। যারা যুদ্ধ থামায় তারা যুদ্ধ করে না। তারা যুদ্ধ দেখেও না। তারা যে কই থাকে আমি জানিও না, জানার চেষ্টাও করি না। আমি দুই পয়সার হাবিলদার, হুকুমের দাস। মন্তাজের গলা কাঁপে। ওস্তাদ আপনি ঠিক কইছেন। যারা বাঁধায় তারা যুদ্ধ করে না। গোলজার সায় দেয়।

তোকে সরকার বেতন দেয়, রেশন দেয়, জামা-কাপড়, তেল-সাবান, জাংগিয়া-গেঞ্জি সব দেয়। তোকে এতো কিছু দেয় কারণ তুই কুত্তার মতো অফিসার গো কথা শুনবি। কোনো প্রশ্ন করবি না তার লাইগ্যা। যেদিন তোর পেটে সরকারি চাল ঢুকছে সেইদিন তুই কুত্তা বনছোস। এগুলো কক্ষনো ভাববি না। ভাবলে কিন্তু বাঁচবি না কইলাম মন্ডাজ কিছুটা উত্তেজিত হয়।

গোলজার কোনো উত্তর দেয় না ও আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। চাঁদটা ঢেকে আছে হালকা মেঘে। এতো পলকা মেঘ সেও চাঁদকে ঢেকে দেয়। ওস্তাদ ঠিক কথা বলেছে ওর মনের প্রশ্নগুলোও ঢেকে রাখতে হবে। সৈনিকের কাজ যুদ্ধ করা, শত্রু মারা বা মরে যাওয়া, ভাবা না। ভাবার জন্য লোক আছে। কুত্তারা মানে, ভাবে না।

নে এটা ধরা। মন্তাজ গোলজারকে দেয় এবং নিজেও একটা ধরায়। গোলজার জানে এটা কি। এটা আছে বলে ওরা এতো কিছু সয়েও বেঁচে আছে। গোলজার দীর্ঘটান দেয়। প্রতি টানে দুঃখগুলো ক্রমশ অস্বচ্ছ থেকে অস্বচ্ছতর হয়। ওর একটু একটু করে ভালো লাগা শুরু হয়। শাহেদুরের কথা মনে হয়। গোলজার অনুভব করে শাহেদুর ওর পাশে এসে বসে। গোলজার শাহেদুরের সাথে কথা শুরু করে।

শাহেদুর তুই কেমন আছিস?

খুব ভালো আছি। জানিস আমার জ্বর ভালো হয় গেছে। আমাকে আর ছুটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এই জঙ্গলে আর পচে মরতে হবে না। যুদ্ধ খুব খারাপ গোলজার। আমি মানুষ মারার খেলা হতে বেঁচে গেছি শাহেদুরের গলার স্বরে সুখী সুখী ভাব।

দোস্ত, আমারও যুদ্ধ ভালো লাগে না কিন্তু আমি আটকে আছি। গোলজার উত্তর দেয়।

শাহেদুর হা-হা করে হাসে। তোরা আটকে থাক। তোরা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে পচে মর। আমি যাইরে আমার অনেক কাজ। জীবনে কোনো স্বাধীনতা নেই, মরণ অনেক স্বাধীন। চলে আয় তুই, যত দেরী তত ফাঁকি। শাহেদুর চাঁদের দিকে ভাসতে ভাসতে চলে যায়। গোলজারের খুব কষ্ট হয়। ওর মার জন্য, বিধবা বোনের জন্য, প্রতিবন্ধী ভাইয়ের জন্য। শাহেদুর ভাগ্যবান এই নোংরা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে না।

গোলজার ঘরে যা। মন্তাজ বলে।

ও ধীরে ধীরে উঠে। চাঁদ পলকা মেঘের আড়াল হতে বেরিয়ে আনে এখন তীব্র আলো ছড়ায়। কখনই পলকা মেঘ সব সময় চাঁদকে ঢাকতে পা

 ১২

সকাল হতেই বৃষ্টি ঝরছে। ঝিরঝিরে ঢিমে তালের বাদল। আকাশে ধূসর পেঁজা মেঘগুলো এলোমেলোভাবে ভাসে। যে মেঘ ভেসে বেড়ায় সে মেঘে অল নামে না। পাহাড়ে সব কিছু হিসাব মতো হয় না। এখানে বিনা নোটিশেই বৃষ্টি নামে আবার হুট করেই চলে যায়। সেন্ট্রিপোস্টের সৈনিকরা ছাড়া বাকিরা সব লাইনের মধ্যে সেঁধিয়ে আছে। যেখানে প্রতিনিয়ত কাদা-মাটি-জল ঘেটে পেট্রোল করতে হয় সেখানে সেঁধে সেধে কে আর ভিজতে চায়?

জামিল ঘরের জানালা দিয়ে বৃষ্টি, দেখে। সবখানেই বৃষ্টি একরকম। কোথাও ঝরে কংক্রিটের ছাদে আর কোথাও নামে ঘন সবুজ বৃক্ষ-লতা ঘেরা অরণ্যের ছাদে। এই যা পার্থক্য। বৃষ্টি শুধু জলই ঝরায় না এর সাথে মেখে আসে মাটি আর বনানীর বুনো ঘ্রাণ। জামিল ঘর হতে বের হয়। ঘুমটি অন্ধকার ঘরে পেঁচার মতো বসে বৃষ্টির হাত হতে বাঁচার চাইতে মুক্তভাবে ভেজাও ভাল। ছোট ছোট হিম জলকণার স্পর্শ ও সারা শরীর দিয়ে অনুভব করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়। কখনও কখনও আকাশের দিকে মুখ হা করে বৃষ্টির ফোঁটাকে চেখে খেয়ে শিশুসুলভ আনন্দে মাতে। এই ক্ষুদ্র কণাগুলোই এক সময় ওর সারা শরীর ভিজিয়ে দেয়। ত্বকে সরষে দানার মতো শীত কাঁটা ফুটে ওঠে। তবুও ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় না। ফিরে যাওয়া মানেই তো ক্যাম্পের বন্ধ দেয়াল, যুদ্ধ, আতংক, মৃত্যু আর ঘৃণার বাস্তবতায় ফিরে আসা। মানুষ যখন তার চারপাশের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে কোনোভাবেই যখন এড়াতে পারে না তখন শরীর মন অবচেতনভাবে নিজেকে বাইরের জগত হতে রুদ্ধ করে ফেলে। অনেকেই তা পারে না; যুদ্ধ, মৃত্যু, আতংক কারো কারো মনের এতো গভীরে চলে যায় তখন সে বাস্তব আর অবাস্তবকে আলাদা করতে পারে না। মেজর শাফায়াতও পারে নি। তিন বছর হিলে থাকার পর এখন পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ অর্ডার নিয়ে ঢাকা সিএমএইচ এর মানসিক ওয়ার্ডে ভর্তি; প্রায় দু'বছর ধরে চিকিৎসা চলছে।

যুদ্ধ কেবল মানুষ মেরেই ক্ষান্ত দেয় না। যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন সৈনিকেরা বয়ে বেড়ায় শরীরে না হয় মনে। শরীরের ক্ষতি দেখা যায় কিন্তু মনের ক্ষত না যায়দেখা না যায় পরিমাপ করা। আর্মি এদের মানসিক ওয়ার্ডে ছুঁড়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। সৈনিকেরা তাদের মানসিক অসুবিধার কথা জানাতে চায় না কারণ মানসিক রোগ মানেই ও ভীতু, দুর্বল, সৈনিক হিসাবে আনফিট।

জামিল যুদ্ধের ভয়াবহতা ভুলতে চায় হিমশীতল বৃষ্টিধারায় তা যত স্বপ্নই

হোক না কেন? এই সাময়িক ভুলে থাকা অত্যন্ত জরুরি সামনের বড়ো বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য।

মন্তাজ মিয়া ছাতা হাতে আসে।

স্যার ছাতা নেন।

দেখছো না আমি ভিজে চুপসে গেছি; এখন ছাতা দিয়ে কি হবে? তাছাড়া আমি ভিজবো বলেই বের হয়েছি। মন্তাজ তুমি কখনও প্রয়োজন ছাড়া এভাবে বৃষ্টিতে ভিজেছো? জামিল প্রশ্ন করে।

মন্তাজ বুঝে না কি বলবে। স্যার বাচ্চাকালে ভিজেছি ওই সময় তো সবাই ভিজে কিন্তু বয়সকালে নিজের ইচ্ছায় ভিজি নি।

আজ ভিজে দেখো; ঠিক তোমার ছোটবেলার মতো ভালো লাগবে। তোমার

ছাতা বন্ধ করো। জামিল বলে।

মন্তাজ অনিচ্ছা সত্ত্বে ছাতা বন্ধ করে। বৃষ্টির জোর একটু বেড়েছে। ক্রমশ

মন্তাজের শরীর ভিজে আসে।

কেমন লাগছে? জামিল জানতে চায়।

ভালো স্যার।

আসো আমরা মাটিতে বসি। দাঁড়ায়, বসে, শুয়ে এক এক পজিশনে বৃষ্টি

খাওয়ার এক এক রকম মজা।

আপনি ঠিকই বলেছেন। জামিল আর মন্তাজ মুখোমুখি বসে।

মন্তাজ তুমি আর আমি কত কাছাকাছি থাকি। একসাথে পেট্রোল করি, ঘামে

ভিজি, রোদে শুকাই, পুড়ি, পাশাপাশি যুদ্ধ করি। একজন আর একজনকে বাঁচানোর জন্য ছুটে যেতে একটুও দেরি করবো না তবুও দেখ আমরা কতদূরে। জামিল বলে।

মন্তাজ উত্তর দেয় না। ওর আরামে ঘুম চলে আসে। বৃষ্টিতে ভেজায় এতো আরাম ও ভুলেই গেছিলো।

মন্তাজ মিয়া তুমি কি শুনছো?

শুনছি স্যার, খুব ভালো লাগছে।

আমার কথা না বৃষ্টি?

দুটোই। আয় বৃষ্টি কেঁপে ধান দিবো মেপে। মন্তাজ বিড় বিড় করে ছড়া আওড়ায়। বৃষ্টিতে ভেজার মধ্যেও কেমন যেন নেশা নেশা ভাব আছে।

যা বলছিলাম। তুমি আর আমি চব্বিশ ঘণ্টা আল্লার তিনশ পয়ষট্টি দিন পাশাপাশি থাকি কিন্তু কেউ কারও সম্বন্ধে কোনো কিছুই জানি না ব্যাপারটা অদ্ভুত না? জামিল পুরোন প্রসঙ্গ তোলে।

স্যার অদ্ভুত না। আপনি অফিসার আমি হাবিলদার। হাবিলদারের এতো জানন ঠিক না। আমাদের আর অফিসারদের হিসাব-কিতাব আলাদা। তেল আর জল কখনও মিশ খায় না। মন্তাজের গলা জড়িয়ে আসে, ওর চোখ বন্ধ। ওর কথা বলতে বিশেষ ইচ্ছা হয় না কিন্তু অফিসারের কথায় উত্তর না দিলে বিপদ হতে পারে ও কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না।

তুমি ঠিক বলনি। আমরা দুজনই প্রথমে সৈনিক তারপর অন্য কিছু। আমাদের লক্ষ্য এক। এই পার্থক্য ব্রিটিশদের তৈরি; স্বাধীন দেশের আর্মির এই পার্থক্য থাকা উচিত না।

মন্তাজ উত্তর দেয় না কারণ ওর উত্তর জানা নেই। ও সতের বছর বয়সে আর্মিতে ঢুকেছে, ওই বয়সে কেউ দুনিয়ার হালচাল বুঝে না রাজনীতি বুঝবে কিভাবে? রাজনীতির ভাষা বড়ই কঠিন। জীবন এখানে এমনি কঠিন আরও কঠিন করা বোকামী মাত্র। স্যারের বয়স অল্প এই বয়সে অনেককিছু ভাবতে মন চায় কিন্তু বয়স বাড়লে চাকরীর মায়া বাড়ে তখন ফালতু চিন্তা বন্ধ হয়। মন্তাজ এগুলো ভালো জানে তাই ও হু-হ্যাঁ করে ব্যাপারটা শেষ করতে চায়। বৃষ্টি শেষ হলেই সব ভাবনা খতম তখন যে যার গণ্ডিতে ফিরে যাবে।

এই যে তুমি প্রায় আমার বাবার বয়সী কিন্তু আমি তোমাকে অহরহ তুমি বলছি আর তুমিও প্রতি কথায় সায় দিয়ে যাচ্ছো এটা কি ঠিক? আমরা একসাথে যুদ্ধ করি কপালে মরণ থাকলে একসাথে মরতে হতেও পারে। মৃত্যুও আমাদের জীবনের

অমোঘ পার্থক্য দূর করতে পারে না। কি বল তুমি? জামিল জিজ্ঞেস করে। • স্যার এটাই নিয়ম। এইভাবেই আগে ছিল, এখনও এইভাবে থাকবে। আমার মতো ছাপোষা সৈনিকরা কিছুই পারে না, খামোখা পৈতৃক প্রাণটা হারাবো। মন্তাজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথাগুলো বলে।

তুমি ঠিকই বলেছো। যাদের এই বৈষম্যগুলো দূর করার দরকার তারা করে না কারণ আমরা কেউই এক ইঞ্চি সুবিধা ছাড়তে রাজী নই তাই কিছুই সহজে বদলায় না। থাক ওসব ভেবে লাভ নেই। শিকড় ধর টান দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ না। তারচে বরং গরম গরম চা খাই।

হা-রু-ন। জামিল ওর রানারকে ডাক দেয়।

সিপাই হারুন এসময় ডাক আসা করেনি ও একটু বিরক্তও হয়। ও তাস খেলা থেকে উঠে আসে। ওর জিত চলছিল। তিন ঘণ্টায় পনের টাকা লাভ হয়েছে। এই জিতের সময় উঠে যাওয়া শুভ লক্ষণ না কারণ পরে আবার বসলে ওকে হারতে হবে। এমন ম্যাড়ম্যাড়ে বাদলা দিনে তাস পেটানো ছাড়া করার কি

বা আছে? তাস খেলায় অনেক কুসংস্কার আছে ওগুলো না মানলে নির্ঘাৎ হার। স্যার ডাকছেন?

তুই সামাদকে দুই কাপ চা দিতে বল। ঘন দুধের সর তোলা কড়া লিকারের চা। অল্প এলাচ আর তেজপাতা দিতে বলবি। আর হ্যাঁ আজ কাপে না গ্লাসে চা খাব। মন্তাজ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কখনও চা খেয়েছো?

না স্যার। বৃষ্টিতে চা খায় কেমনে, চায়ে পানি পড়বো না। মন্তাজ অবাক

হয়।

আসলে চায়ে কিন্তু খুব সামান্যই পানি ঢোকে এতে চায়ের স্বাদ একটুও বদলায় না। আমরা ভাবি কাপ বুঝি পানিতে থৈ থৈ করবে। জামিল মন্তাজকে আশ্বস্ত করে।

মন্তাজ কোনো উত্তর দেয় না। স্যারকে বৃষ্টির ঘোরে পেয়েছে। ঘোরে পড়লে কেউ চুপ মেরে যায় আর কেউ খুব কথা বলে, স্যারের কথা বলা টাইপ। এই সময় মানুষ পেটের সব কথা বের করে দিতে চায়। মন্তাজ এসব কিছুই জানতে চায় না। ভালো মানুষের পেটের কথা বেশির ভাগই দুঃখের।

হারুন দুই প্লাস চা দিয়ে যায়। গ্লাস দিয়ে ধোঁয়ার চিকন রেখা উঠে। মস্তাজ চায়ে চুমুক দেয়। ওর মনে হয় জীবনে এত ভাল চা ও কোনোদিনই খায়নি। গরম তরল জানান দিয়ে গলা বুক হয়ে পেটে ঢোকে। ভিতরের গরম আর বাইরের ঠাণ্ডার সাথে জড়াজড়ি করে মিশে মনটা ফুরফুরে করে তোলে।

মস্তাজ কেমন লাগছে বললে না? জামিল জানতে চায়। স্যার এত ভালো লাগছে যেন জোঁকের গায়ে লবণ পড়ছে।

জামিল হা-হা করে হাসে। তুমি তো দেখি খুব মজার কথা বলেছ। আমিও জানতাম না বৃষ্টিতে চা খাওয়ায় এতো মজা যদি দিপুর সাথে চা না খেতাম তোমাকে তো দিলুর কথা বলা হয়নি। ও আমার বন্ধু, খুব অসাধারণ মেয়ে মাথা থেকেই এগুলো আজগুবি জিনিস বের হয়। ওর বাংলাদেশে জন্য না আমেরিকায় হলে নির্ঘাৎ বিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পেতো। কথা শেষে জামিল দীর্ঘ চুমুক দেয়।

মন্তাজ বুঝে দিলু-স্যারের দুঃখের জায়গা। একটু নাড়া দিলেই হড়হড় করে সব বলে দিবে। কিছু কিছু মুহূর্তে মানুষ বলার জন্য মুখিয়ে থাকে এখন স্যারের সেই মুহূর্ত। মন্তাজ দিলু নামটাকে সযত্নে এড়িয়ে যায়। কি লাভ ওসব জেনে?

বৃষ্টি এখন কমার দিকে। মন্তাজ চায়ে শেষ চুমুক দেয়, স্যারের চাও শেষ। এখন ওদের ওঠা উচিত। মন্তাজ অপেক্ষা করে আনমনা যুবকের দুঃখ ভারাক্রান্ত ঘোর কাটার অপেক্ষায়।

আগামীকাল পাহাড়িদের বিষ্ণু উৎসব, তিনদিন ধরে চলবে। এতো রক্ত আর ঘৃণার মাঝেও পাহাড়ি-বাঙ্গালি সবাই মিলে মেতে উঠবে আনন্দে। গত বছরও জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়েছে দিনগুলো। কিন্তু এক বছরে পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে। গোটা পার্বত্য এলাকা জুড়েই চলছে শান্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ। অনেক মানুষ মারা গেছে সৈনিক, পাহাড়ি, বাঙ্গালি। মানুষের মৃত্যু নিঃসন্দেহে যুদ্ধের সবচাইতে বড়ো ক্ষতি কিন্তু মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের মৃত্যু কোনো অংশেই কম নয়। যখন মানুষ বিশ্বাস আর ভালোবাসা হারায় তখন তার মনের শূন্য স্থান পূরণ করে অবিশ্বাস, ঘৃণা আর সন্দেহ। যে বিশ্বাস হারিয়ে যায় তার পুনঃস্থাপন চারটিখানি কথা নয়। এতো দুঃখ ও গ্লানির মাঝেও সব ঝেড়ে ফেলে নতুন করে বাঁচার অদম্য স্পৃহা মানুষকে এগিয়ে নেয়। এখানেই মানুষের মনুষ্যত্ব হার মানায় সব অন্ধকার অনুভূতিকে।

জামিলের মনের সংশয় কেটে যায় ও সিদ্ধান্ত নেয় ও যাবে মানুষের মহামিলনের আনন্দমেলায়। ও রিভলভারে গুলি লোড করে সাথে নেয় অতিরিক্ত রাউন্ড। এই রকম পরিস্থিতিতে অসতর্ক, অপ্রস্তুত থাকা বোকামীই শুধু নয় বরং জীবন মরণের প্রশ্ন জড়িত। শান্তিবাহিনী কোথায়, কখন আক্রমণ করবে বলাতো যায় না। পাহাড়ে মৃত্যু গাছের পাতা ঝরার মতোই স্বাভাবিক শব্দহীন কিন্তু তাই বলে অসহায়ের মতো মৃত্যু ওর কাম্য নয়। পাহাড়ে এটাই ওর প্রথম বিজু উৎসব। ক্যাম্পের ছোট পরিসীমার মধ্যে দিনের পর দিন থাকতে থাকতে ও হাঁফিয়ে উঠেছে। হি নিডস সাম চেঞ্চ। হারুন মন্তাজকে ডাকো তো।

মন্তাজ মিয়া বিজুতে কখনও গিয়েছো? জামিল প্রশ্ন করে।

বহুবার, এখন আর ভাল লাগে না। আপনে যান আপনার বয়স কম, ভালো লাগবে। মন্তাজের ঠোঁটের কোণায় হালকা একটা হাসি ঝুলে থাকে যা জামিলের চোখ এড়ায় না।

স্যার এই জীবনে তো কম দেখলাম না। আর চাকরী আছে দুই বছর। আল্লাহ যদি বাঁচায় রাখে চাকরী শেষে গ্রামে যাবো। অনেক বছর গ্রামে যাই না। নিজের ভিটায় ঘর তুলবো, বহুত কাজ-কাম জমে আছে। ওখানেই বাপ-দাদার কবর। পুরোনো বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনের অনেকেই আর বেঁচে নেই, যারা আছে তাদের দেখার জন্য মন টানে। মন্তাজ কথা শেষে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।

তুমি ঠিকই বলেছ। মানুষ তার অতীত হতে ছিটকে বের হতে চাইলেও পারে না। জামিল সায় দেয়।

সারাটা জীবন কচুরিপানার মতো কমতো ভেসে বেড়ালাম না। নিজেকে ছাড়া কোনোদিন কিছু ভাবিনি। স্যার শিকড় আলগা হলেও শিকড়ের টান থাকে।

শিকড়ের টান বড়ো টান। মানুষ লুকাতে চাইলেও পারে না। স্যার বেশি কথা বলে ফেললাম মনে কিছু নিবেন না। আরে না-না, কি যে বলো, এই বনবাঁদাড়ে যে জিনিস পর্যাপ্ত তাহলো সময়। তোমার সাথে কথা না বললে কি আর করতাম, বড়ো জোর রোদ পোহাতাম।

জামিল হাবিলদার মন্তাজকে এতদিনেও ঠিক যেন চিনতে পারেনি। কখনও লোকটাকে খুব কাছের মনে হয় কখনও মনে হয় শত যোজন দূরের। কখনও কত আপন আবার কখনও মনে হয় এই লোকের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা দেখাতে একমুহূর্তের জন্যও হাত কাঁপবে না। কিছু মানুষ আছে কোনোদিনই আপন হয় না বেশি কাছে আসলেই ছিটকে বেরিয়ে যায়। এদের সবচেয়ে বড়ো ভয় হলো কোনো কিছুর সাথে জড়িয়ে যাওয়ার ভয়।

আপনে যান স্যার। সাথে নায়েক সালামও যাক, ও দূরে দূরে থাকবে।

সাবধানের মার নেই। হিলের বৃষ্টির মতো পাহাড়ি মানুষের মনও বোঝা ভার। তবে কখনও বিজুতে কিছু হয়েছে বলে শুনিনি। মন্তাজ বলে। মৃত্যু থাকলে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকলেও বাঁচা যাবে না তা

আমাদের চেয়ে ভালো কে জানে। জামিল উত্তর দেয়।

হা-হা। আপনি ঠিকই বলেছেন। হিলে বাঁচন-মরণ তো কচুপাতার পানি। ঘুইর‍্যা আসেন স্যার, আল্লাহ ভরসা।

লোলাং বাজারের অনতিদূরে নদীর দুই পাড় ঘিরে অগুণতি মানুষের ভিড়। আজ ফুল বিজু আগামীকাল মূল বিজু, তিনদিন ধরে চলবে এই উৎসব। জাতি মানুষের ভিড়ে মিশে যায়। চাকমা, মারমা, টিপরা, পাংখো আরও অনেক জানি

মানুষের সাথে বাঙ্গালিরাও যোগ দিয়েছে। নানা বর্ণে, গন্ধে, শব্দে ভরে আ

গোটা নদী পাড়। কে বলবে এখানে যুদ্ধ চলছে? এই উৎসবরত মানুষগুনে

প্রাণশক্তি দেখলে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। ঘৃণা, হিংসা মানুষকে সামরিআচ্ছন্ন করে সত্য কিন্তু মানুষ আজীবন এর মাঝে বন্দি থাকতে পারে না বা চায় না।

কোমরঅব্দি চেঙ্গির জলে নেমে স্নানরত শত শত মানুষ। কেউ কেউ হাত জোড় করে প্রার্থনারত। জামিল ধীরপায়ে হাঁটে। বুকের বাম পাশে লোডেড রিভলভারের ইস্পাত উপস্থিতি ওকে সাহস জোগায়। ভয়কেও আমল দেয় না যদিও ভয়, প্রতিশোধ স্পৃহা ওর চেতনার সাথে মিশে গেছে। ক্ষমাহীন এই অরণ্যে একটি ভুল পদক্ষেপ মৃত্যুকে অনিবার্য করে তোলে সেখানে এই সতর্কতা, ভয় ক্রমশ সৈনিকের নিজের মনের অংশে পরিণত হয়। মনের এই পরিবর্তন কারো কাম্য হতে পারে না কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এটাই সৈনিকদের বাঁচিয়ে রাখে। গাছের ডালের সামান্য কাঁপন বা অনাকাঙ্খিত মৃদু শব্দ যা সাধারণের কান এড়িয়ে যায় তাই সৈনিকদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে তোলে।

সামনে টিপরা পাড়া টিপরা ছেলেমেয়েরা রঙ-বেরঙের বাহারী পোষাক পরে খেলাধুলায় ব্যস্ত। ছোট ছোট সারিবদ্ধ মুদি দোকানের পাশে খোলা জায়গায় কিছু উঠতি বয়সের ছেলেরা আড্ডা দেয়। কেউ কেউ ক্যারাম খেলে। পাড়া থেকে ক্যাসেটে হিন্দি সিমেনার চটুলগান ভেসে আসে। আধুনিকতার হাওয়া এই দূর পাহাড়ি অঞ্চলেও হানা দেয়।

জামিল ভগ্নপ্রায় টিপরা মন্দিরের পাশ দিয়ে ধীরপায়ে হাঁটে। বাঁশ, কাঠভর্তি নৌকার সারি ধীর গতিতে ভেসে চলে। প্রতিদিন কত মূল্যবান কাঠ, বাঁশ, দুর্লভ প্রাণীরা প্রতিদিনই পাচার হচ্ছে। কে রাখে কার খবর। বিধাতার অপার দান অরণ্যের বুকের মাঝে লুকানো সম্পদকে সবাই লুটতে চায় কিন্তু ভালোবাসতে চায় কয়জন। তা না হলে ফরেস্ট, বিডিআর আর পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে দিনদুপুরে এগুলো পাচার হয় কিভাবে? জামিলের দুঃখ হয় এই নির্ভেদী অরণ্যের অরণ্যচারী মানুষদের জন্য। বনের অস্তিত্বের সাথে ওদের অস্তিত্ব যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

দূর হতেই বটের ঝাঁকড়া চুলো মাথা দেখা যায়, কি বিশাল বৃক্ষ, কত সহস্র বছরের পুরোন কেউ জানে না। গাছ যদি কথা বলতে পারতো কত না ভালো হত, মানুষ হাজার বছরের সঞ্চিত ইতিহাস বৃক্ষের বঙ্কিম মূলে বসে শীতল ছায়ায় গা জুড়িয়ে জানতে পারতো। গাছের তুলনায় মানুষের জীবনকাল বড়ই নগন্য। এই স্বল্প সময়ে মানুষ কত কিছু করতে চায় আর করার যে মোক্ষম সময় যৌবন তা অতিদ্রুত ফুরিয়ে যায়। সেখানে বাকহীন বৃক্ষ শত সহস্র বছর বেঁচে থাকে। নিথর নীরব জীবনের এই দীর্ঘ আয়ু ওর কাছে মূল্যহীন মনে হয়। বটমূল বিশাল অজগরের মতো এঁকে বেঁকে চেঙ্গির জল ছুঁয়ে আছে। শ্যাওলাটে সিঁড়ি নেমে গেছে শীর্ণ নদীর শরীর ফুঁড়ে। শত শত মানুষ ঘাটে দাঁড়িয়ে নদীতে ভক্তিভরে ছুঁড়ে ফেলছে, ভালোবাসার ফুলেল অর্থ। নদীর জলে ভেসে যায় নানা বর্ণের ফুল-জবা, বেলি, নাম না জানা হরেক বুনো ফুল আর অজস্র ভাঁট ফুল। ভাঁট ফুলের এই জাতে উঠায় জামিল কিছুটা অবাক হয়। হয়তো এই অঞ্চলে ভাঁট ফুলের প্রাচুর্য থাকবে। ওর ইচ্ছা হয় ফুলের মতো দিক-বিদিক গন্তব্যহীনভাবে ভেসে বেড়াতে।

জামিল সিগারেটের তেষ্টা বোধ করে, ও বটের বিশাল ঝুঁরির গায়ে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরায়। ও অনুভব করে ও এতো ভিড়ের মাঝেও ও একা। মানুষের একাকীত্ব আসলে পরিপার্শ্বের সাথে যত না সম্পর্কিত বরং তার চেয়ে বেশি সম্পর্কিত তার মনের অবস্থার সাথে।

বাবু তুমি এখানে?

হঠাৎ এক মেয়েলি ডাকে ওর চিন্তার জাল ছিন্ন হয়। এই অচেনা অজস্র মানুষের ভিড়ে কেউ যে তার পরিচিত থাকতে পারে ও ভুলেও ভাবেনি। ও কিছুটা বিস্মিত হয়, দেখে তার সামনে একটা মেয়ে সিক্ত বসনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে চিনতে পারছো না? মেয়েটার ভ্রূদ্বয় ঈষৎ কুঞ্চিত হয়।

ও আসলেই চিনতে পারছে না। তবে এখন কিছুটা চেনা চেনা লাগে। মেয়েটা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মিটি-মিটি হাসে। মেয়েটার দুই গালে অসম্ভব সুন্দর দুটা টোল ভাঁট ফুলের মতো স্থির চেয়ে থাকে। ওর মস্তিষ্ক আঁতিপাঁতি করে খোঁজে স্মৃতির স্তূপ কিন্তু কিছুই উঠে আসে না। ওর ইচ্ছা হয় না এই সুন্দরী তরুণীর আগ্রহকে বিস্মৃতি দিয়ে নস্যাৎ করতে।

তোমাকে চিনেছি কিন্তু নামটা মুখে এসেও মনে করতে পারছি না। প্লিজ কিছু মনে করো না। জামিল উত্তর দেয়।

আমি মায়া, মায়া চাকমা। এখন কি পারছো?

ওহ! মায়া। হ্যাঁ পারছি, খুব পারছি। জামিলের বুক হতে বিরাট চাপ নেমে যায়। এখন সব কিছু হালকা মনে হয়। মায়া মাথা নিচু জামিলের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে।

আরে আরে কি করছো এসব? জামিল হতবুদ্ধি অবস্থায় মায়ার ডান বাহু ধরে ওকে তোলার ভঙ্গি করে।

মায়া খিলখিল করে হাসে। ফুল ছোঁড়া শেষে ঘাটমুখ হয়েছি দেখি তুমি।। তাও আবার আনমনে কি জানি ভাবছো। ভাবলাম আবার ঋষি-টিষি বনে যা কিনা? মায়া মৃদু হাসে।

সেদিন ওকে দেখেছিল কান্নারত অবস্থায়, ফুলো ফুলো চোখ। অবিন্যস্ত, যত্নহীন উসকো খুসকো কাঁধঅব্দি চুল ওর অনিদ্রা আর ক্লান্ত মুখায়বকে আরও মলিন করে তুলেছিল। আজ এক পরিপাটি তরুণী ওর দিকে নিষ্পাপ হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। ষড়ঋতুর মতো মেয়েদের রূপও স্থান, কাল আর অবস্থাভেদে পাল্টায়। অশ্রু ভারাক্রান্ত মেঘমেদুর শ্রী আর হাস্যরত চঞ্চলা, চটুলা রূপী কে কার চাইতে বেশি সুন্দর বলা মুশকিল।

ঋষি হতে পারলে তো বেঁচে যেতাম। ঋষি হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার সৈনিকের সেই ভাগ্য নেই। জামিল উত্তর দেয়।

তোমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম তুমি তো কিছু বললে না। মায়া কপট রাগ দেখায়।

হা-হা। জামিল হেসে উঠে।

কি হাসছো যে বড়ো? হাসির কিছু বলেছি নাকি?

অবশ্যই বলেছো, শুধু বলনি বরং করেছো। আমাকে আজ অব্দি কেউ পা ছুঁয়ে প্রণাম করেনি। এরকম হ্যাংলাটে ছোকড়া টাইপের মানুষের পা কেউ কি ছোয়? প্রণাম শেষে যে কিছু বলতে হয় তাই বা জানবো কিভাবে? আজকের পরে শিখে নিবো। আজ জানলাম আমিও প্রণামতুল্য।

থাক আর ঢঙ করতে হবে না। আজকের দিনে প্রণাম করলে আশীর্বাদ করতে

হয়। মায়া জামিলের ডান হাত নিয়ে ওর মাথায় রাখে।

এখন জানলে যখন কি বলবে বলো?

জামিল ঘটনার আকস্মিতায় একটু চমকে উঠে। সিক্ত, শীতল, সিঁথিকাটা মোলায়েম চুলের স্পর্শ ওকে কিছুটা হলেও বিচলিত করে। তালুর নিচে উর্ধ্বমুখী কুমারীর কৌতুকময় আঁথি যুগল ওর দৃষ্টিকেই শুধু বিদ্ধ করে না বরং ওর হৃদয়কেও চঞ্চল করে। জামিল খুঁজে পায় না ও কি বলবে বা ওর কি বলা উচিত।

কি কিছু বলছো না যে? মায়া তাড়া দেয়।

দাঁড়াও, বলছি। জামিল সময় নেয়।

হ্যাঁ বলেছি।

কই শুনলাম নাতো। সত্যি বলেছো তো?

মনে মনে বলেছি। জামিল উত্তর দেয়।

কি বললে গো।

আজ বলবো না। আর একদিন না হয় বলবো। বলেছো যখন তাতেই চলবে। খারাপ কিছু বলবে না তা জানি।

তোমার হাতে সময় আছে? মায়া জানতে চায়।

অফুরন্ত, সারাদিনের জন্য বেরিয়েছি। তা তোমার ভাইকে দেখছি না, ও কই? ওই বাঁদরের কথা আর বলো না। দিদির পিছু পিছু ঘুরে সময় নষ্ট করার ছেলে ও নয়। সকালেই বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বেরিয়েছে দেওয়ান বাজারে মেলা দেখতে। আমি পিসীর ওখানে এসেছি। ওর বাসা টিপরাপাড়ার আধামাইল উত্তরে বিশ্বরাম পাড়ায়। চলো ওখানেই বরং যাই। মায়া বলে।

জামিল কিছুটা ইতস্তত করে। আজ থাক। একদিনে এত কিছু ঘটে গেল শেষে বদহজম না হয়ে যায়। জামিল কথা শেষে হাসে।

আজ যেতে যখন চাইছো না তখন জোর করবো না। কাল আসো, কাল বিজুর আসল দিন, আসবে? মায়ার চেহারায় বিষণ্ণতার ছোঁয়া লাগে।

হ্যাঁ আসবো কিন্তু এই ভিড়ে তোমাকে খুঁজে পাবো কিভাবে? আজ যেভাবে পেলে সেভাবে। মায়ার চোখে মুখে তরুণীর উজ্জ্বলতা ফিরে

আসে।

সকাল এগারটায় ঠিক এখানে, এই ঘাটে। পারবে তো?

জামিল জানতে চায়।

খুব পারবো। তুমি যতক্ষণ না আসছো ততক্ষণ আমি একটুও নড়ছি না, পায়ে শিকড় গজালেও না।

 ১৩

বাংলাদেশের সীমানা হতে মাইলদেড়েক ভিতরে ত্রিপুরা রাজ্যের শাবরুমে শান্তিবাহিনীর ক্যাম্প। ঘন বনের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা ক্যাম্পের চারিধার। কি নেই এখানে? বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি সৈনিকদের ব্যারাক, খেলার মাঠ, জিমনেশিয়াম, ট্রেনিং সেন্টার, মাঝারি সাইজের ফায়ারিং রেঞ্জ। যেন ছোটখাট ক্যান্টমমেন্ট। কর্ণেল প্রভাস চাকমা গা এলিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এই মানুষটির ভিতরে বিরাট উত্তেজনার ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। প্রভাস চাকমা সিগারেট ধরায়, চোখ বন্ধ রেখে ছাদমুখো একরাশ ধোয়া ছাড়ে। জেনারেটরের একঘেয়েমি যান্ত্রিক শব্দ রাতের নীরবতাকে যেন আরও ঘন করে তোলে। রাত তখন প্রায় একটার কাছাকাছি। প্রভাস রিভলভিং চেয়ার ঘুরিয়ে দেয়ালে টাঙ্গানো পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল ম্যাপের দিকে তাকায়। এই সুযোগ ও মিস করতে চায় না। অনেক অপেক্ষার পর এরকম সুযোগ আসে। লাস্ট টাইম দ্যে সাফারড এ হিউজ লস। নট দিস টাইম। নেভার এগেইন। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। এখনও চোখে লাদুমণি চাকমা, বিকাশ চাকমা, কল্পনা মারমার চেহারা ভাসে। বিকাশ তখন সবে ষোলতে পা দিয়েছিল। গৌরবর্ণ, মাথায় ঘন কালো একরাশ পরিচর্যাহীন চুল, মুখে দাড়ি-গোঁফের হালকা ছোপ কেবল দেখা দিতে শুরু করেছিল, ঘোলাটে চোখ আর কি সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। প্রভাসকে কোনো রকম ভঙ্গি ছাড়াই সরাসরি বলেছিল, আমি যোগ দিতে চাই।

তোমার বাড়িতে কে কে আছেন? ও জিজ্ঞেস করেছিল। মা-বাবা আর ছোট দুই বোন। বিকাশের সংক্ষিপ্ত উত্তর। ওহ্, তুমি তাহলে একমাত্র ছেলে। বাবা-মা জানেন যে তুমি এখানে এসেছো।

বিকাশ এই প্রশ্নটা পছন্দ করেনি। ওর চেহারায় রাগ ও বিরক্তি ফুটে উঠেছিল কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়েছিল।

কর্ণেল তুমি তো বলেছিলে নিজের দেশ মা, বাবা, পরিবার এমনকি নিজের চেয়েও বড়ো। তাহলে এই প্রশ্ন আসে কেন?

প্রভাস ছেলেটার বুকের ভিতরের কষ্ট আর ঘৃণার আগুনের উত্তাপ আঁচ

করেছিল। বিকাশ তুমি ঠিকই বলেছো, আমি কিছু ভেবে বলিনি, তোমার বয়স অনেক

কম সেইজন্য বলা। আমরা এখানে আছি, অনেকদিন থাকবো তুমি না হয় আরও কিছুদিন ভেবে দেখো। উই নিড মেনি ডেডিকেটেড ইয়াং পিওপলস লাইক ইউ। সময় তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না। এটা দীর্ঘপথ। বিকাশ তোমাকে আমি নিরুৎসাহিত করছি না তবে তোমার ফিরে যাওয়া ঠিক হবে। দুই বছর পরে না হয় আসো। কর্ণেল প্রভাস এই তরুণের জন্য এক ধরনের মায়া অনুভব করে।

আমি তো ফিরে যাওয়ার জন্য আসিনি। তাছাড়া তুমি ভাবছো কিভাবে আমি না ভেবেই এতদূর এসেছি। বিকাশের গলায় রাগের আঁচ কর্ণেল প্রভাসের কান এড়ায় না।

প্রভাস বিকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সেদিন। সে বুঝেছিল হি ওয়াজ মোর দ্যান রেডি। কিছু বলে ওকে ফেরানো যাবে না। প্রভাস কিছুক্ষণ খোলা দরজার দিকে চেয়েছিল তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলেছিল, বিকাশ তুমি যোগ দিচ্ছো। ইয়ংম্যান ইউ আর ওয়ান অফ আস নাও। তারপর দাঁড়িয়ে ওর সাথে হ্যান্ডশেক করেছিল। বিকাশ মিলিটারি কায়দায় ওকে স্যালুট দিয়েছিল। ওর প্রথম এ্যাসাইনমেন্ট ছিল ভূষণছড়া আর ছোট হরিণা বিডিআর ক্যাম্পে আক্রমণ। পনের জনের দলের নেতৃত্ব দিয়েছিল ক্যাপ্টেন সুব্রত চাকমা। দলের অনেকেরই এটা ছিল প্রথম অপারেশন। সেই অপারেশনে সাতজন বিডিআরের সৈনিক মারা গিয়েছিল আর তাদের দলের সবাই ফিরে এসেছিল শুধু তিনজন ছাড়া। বিকাশ ছিল তাদের একজন। পরে প্রভাস সুব্রতের কাছে জেনেছিল বিকাশ সেদিন খুবই সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছিল, ওর গুলিতেই অন্ততপক্ষে তিনজন বিডিআর মারা গিয়েছিল। বিকাশ অপারেশনের সারাটা সময় যেন রাগে ফুঁসছিল, ওর মারমুখী সাহস দেখে সুব্রত শুধু অবাকই হয়নি বরং একটু রাগও হয়েছিল। সুব্রতরা আরও আগে অপারেশন শেষ করে ফিরে আসতে চেয়েছিল কিন্তু ও যেন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েই নেমেছিল। ওকে থামানোর শক্তি সেদিন সুব্রতের ছিল না।

কমান্ড সেন্টারের দেয়ালে বিকাশ, ত্রিদিব, প্রণব আরও শত শত সহযোদ্ধার ছবি টাঙ্গানো আছে। এতো ছবির মাঝেও বিকাশকে আলাদাভাবে চেনা যায়, যেন ছিল ওর চোখ জোড়ায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের যা থাকার কথাও সবই তো বিকাশের ছিল কিন্তু কিছুই ওকে ধরে রাখতে পারেনি। বিকাশের মা

আরও একটা জিনিস ছিল তা হলো অতলস্পর্শী যন্ত্রণা। প্রভাস আর কথা কোনোদিন জানবে না ওর যন্ত্রণার উৎস। এই সমস্ত তরুণ তরুণীরা আজও ওকে জাগিয়ে রাখে এতো রাত অবধি। ওরা ওদের বর্তমান, ভবিষ্যত অবলীলায় ত্যাগ করেছিল অন্যদের নিগ্রহ আর পরাধীনতার ঘৃণা হতে বাঁচানোর জন্য। ও কোনোদিনই বেঈমানী করবে না, করতে পারে না ওদের সাথে। নট ইন হিজ লাইফ টাইম। বাপু, তুমি এখনও ঘুমাওনি। সুরমা দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে। সুরমা মারমার বয়স যখন তিনবছর তখন হতেই ও প্রভাসের সাথে আছে। আচলঙের এক গ্রামে ছিল ওদের ঘর। মৃত বাবা-মা, ভাই-বোনের মাঝে বেঁচে ছিল সুরমা। মার মৃত শরীর আঁকড়ে ছিল ও, মারই রক্তে মাখা ছিল ওর ছোট্ট শরীর। সেদিন ছোট্ট সুরমাকে ও বুকে টেনে নিয়েছিল। চিরকুমার প্রভাসই ওর বাবা। একজন বিপ্লবী তার শত ব্যস্ততার মাঝেও তার মেয়ের জন্য যা করা যায় তার কোনো ঘাটতি ও কখনও করেনি। তবুও কি মায়ের অভাব বাবা কখনও পূরণ করতে পারে?

আর কিছুক্ষণ তারপরই শুয়ে পড়বো দেখিস। প্রভাস উত্তর দেয়।

জান এখন কটা বাজে?

কয়টা?

রাত দুটো দশ। এতো রাত জেগে থাকলে শরীর কারও কি বেশিদিন ভালো থাকে? সুরমা অভিযোগের সুরে বলে। মা আর বেশি না, মাত্র তিনটা পর্যন্ত। শরীরের কথা ভাবি না রে। এতো মৃত্যুর পর নিজেকে নিয়ে কি ভাবা যায় বল?

তোমার তো বুঝতে হবে তোমার বয়স বেড়েছে। আগে যেভাবে পেরেছো এখন কি সেইভাবে পারা যায়। তাছাড়া তোমার কিছু হলে...। সুরমা কথা শেষ করতে পারে না ওর গলা ঠেলে কান্না উঠে আসতে চায়।

সুরমা, আমি যেমন তোর বাবা তেমনি অন্যরাও আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। তাদের দাবি তো কোনো অংশে কম নয়। একটা মৃত্যুও অনেক রে মা। এরা শুধু সংখ্যা নয়, সবাই একদিন রক্তমাংসের মানুষ ছিল যাদের নিজস্ব জগৎ ছিল, পরিবার ছিল, ঠিকানা ছিল। বড়ো ভয় হয় পাছে আমার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কেউ চিরতরে হারিয়ে যায়। এ যে পাহাড় সমান দায়িত্ব। তুই আর আমার জন্য জাগিস নে। তপনকে বল জেনারেটরটা বন্ধ করতে, বাকী সময় আমি মোমবাতির আলোয় কাটিয়ে দিতে পারবো।

 

গত পরশু পঁচিশ জন গেরিলা দেরাদুনের চক্রতায় ট্রেনিং শেষে ক্যাম্পে এসেছে। প্রতি মাসেই বেশ কিছু ছেলেকে ক্যাম্পের বেসিক ট্রেনিং শেষে প্রভাস দেরাদুনে পাঠায় স্পেশালাইজড ট্রেনিং এর জন্য। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র'এর সাহায্য পাওয়া না গেলে এত সহজ হতো না সব কিছু। তাছাড়া আগরতলায় র'এর অফিসের কড়া নজরদারিতো আছেই। ওদের সাহায্য তো স্বার্থহীন নয় বিনিময়ে প্রভাসরা খবর দেয় মিজো গেরিলাদের সম্বন্ধে। এটা এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা কিন্তু ওদের এছাড়া উপায় নেই। গিভ অ্যান্ড টেক আছে বলেই ওরা পাচ্ছে আশ্রয়, ট্রেনিং, অস্ত্র। দেয়ার ইজ নো ফ্রি লাঞ্চ। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে। ইন লাভ এ্যান্ড ওয়ার দেয়ার ইজ নো রুলস।

প্রভাস চায়ে চুমুক দেয় আর ত্রিপুরা টাইমসে চোখ বুলায়। খবরের কাগজ মানেই সিপিএম আর কংগ্রেসের ল্যাং মারামারির খবর। রাজনীতি যেন ক্রমশ নোংরা হয়ে উঠেছে, যেন ব্যক্তি আর দলই সব দেশ আর জনগণ মূল্যহীন। ইদানিং দেশ আর মানুষের কল্যাণে রাজনীতি হয় না, বরং রাজনীতিতে ব্যবহৃত হয় দেশ আর মানুষ। রাজনীতি আজ উপরে উঠার সিঁড়ি, বিত্ত-বৈভব বানানোর উপায় মাত্র। বাংলাদেশের অবস্থা তো আরও খারাপ। রাজনীতির দুষ্ট চক্রে বছরের পর বছর ঘুরপাক খাচ্ছে এগারকোটি মানুষ। বাংলাদেশের কথা মনে হতেই প্রভাস আনমনা হয়ে যায়। রাঙ্গামাটির লংগেদুতে কাঠের দোতলা বাড়ি, টানা ঝুল বারান্দা, বারান্দার পাশে লোহার পেঁচানো সরু সিঁড়ি। বাড়ির পেছনে মাঝারি ডেক। ডেকে বসে দৃষ্টি মেললে আটকে যায় সারিবদ্ধ নীলাভ ধোঁয়াশা টিলায়। টিলার মাথা ছাড়িয়ে আরও দূরে তাকালে আগুনছটা পাহাড়ের চূড়া ভোরের কমলা আলোয় সত্যিই আগুন ঝরায়। সম্বর হরিণ, মেঠো খরগোস, বনমোরগ, লাল শিয়াল, ধলামুখো বান্দরের দল আরও কতো প্রাণী-পাখ-পাখালি বাড়ির আশপাশ ঘোরাঘুরি করে। বানরের দল তো এক কাঠি বাড়া, ওরা তো নির্ভাবনায় সকাল সন্ধ্যা ডেকের উপর লাফ-ঝাঁপ হুটোপটি, কুস্তাকুস্তি কিনা করে। আরতি চাকমা কলা, ভাত দিয়ে রাখতো ওদের জন্য। ওরাও চিনতো ওকে। দীপক চাকমা বলতো এমনি বানরের জ্বালায় বাঁচি না। তারপর কলা, ভাত দিয়ে আরও মাথায় তোলা হচ্ছে।

আহা ওরকমভাবে বলো না তো। দেখছো না বনে শীত নামছে, এখন এমনি ফলমূলের ঘাটতি। বেচারারা উপায় না দেখেই এসেছে। আরতি জবাব দেয় আমি তো শীত-গ্রীষ্ম কোনো সময়ই ওদের আনাগোনা বন্ধ হতে দেখলাম দিচ্ছো দাও, বানর মাথায় তুললে নামানো যায় না। কথাটা মনে রেখ। দীপক বা তা আর মনে নেই ভেবেছো। একটা বানর তো তিরিশ বছর ধরে ঘাড়ে চেপে বসে আছে। তাকে যখন নামাতে পারিনি এদেরকে নিয়ে চিন্তা করি না।

দীপক স্ত্রীর উত্তরে হা-হা করে হাসতো। কি প্রাণ খোলা ছিল সেই হাসি। প্রভাসের কানে এখনও সেই হাসির শব্দ ভাসে। আরতি প্রতিটি বানরকে নাম ধরে চিনতো। ওই পেট মোটাটা দেখছো না ওটা পল্টু, লেজের কাছে সাদা ছোপ ওটা পল্টুর বোন অপু, আর ওই যে বেশি লাফাচ্ছে দুষ্টু কালো লেজা আবু রশিদ। দীপক অবাক হয় অন্যরকম নাম শুনে।

আরে তুমি কালোপানা বাঙ্গালি ছেলেটাকে ভুলে গেলে যে তোমার সুভাসের

হাত ভেঙ্গে দিয়েছিল। তাই বলে ভেবো না আমি আবু রশিদকে কম খেতে দেই। এই রকম দেবতুল্য দুই বয়োবৃদ্ধ মানুষদেরকে মারতেও ওদের হাত একটুও

কাঁপেনি।

মা-বাবার কথা মনে হতে কর্ণেল প্রভাসের চোখ এখনও অশ্রু সজল হয়ে

উঠে। এতো কিছু হারানোর পরও ও ভালোবাসে ওর দেশকে। তারা তো একদিনে হাতে অস্ত্র তোলেনি। বছরের পর বছর বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার পর এই একটি পথই তো ওদের খোলা ছিল।

মেজর তরুণ চাকমা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে। কর্ণেল তুমি ডেকেছো? হ্যাঁ, অত্যন্ত জরুরি খবর তুমি সব অফিসারদের খবর দাও। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। এখন পৌনে এগারটা বাজে, বারটার মধ্যে সবাইকে এখানে

আসতে বলো।

ওকে বস। মনে হচ্ছে তুমি বড়ো কিছু একটা পেয়েছো। মেজর তরুণ জানতে চায়।

বড়ো ছোট বুঝি না। ইট ইজ এ গুড পিস অব ইনটেলিজেন্স। আমাদের পুরোশক্তি দিয়ে নামতে হবে। অপারেশন স্যুড বি সুইফট, সার্জিক্যাল উইথ মিনিমাম ক্যাজুয়ালটি। উই মাস্ট সারপ্রাইজ আওয়ার এনিমি।

তরুণ, তুমি আর প্রদীপ এই অপারেশনে নেতৃত্ব দিবে। তোমার উপর আমার ফুল কনফিডেন্স আছে এ্যান্ড ইউ হ্যান্ড মাই ব্রেসিং।

তরুণ স্থির দৃষ্টিতে প্রভাসের পিছনে ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে তাকায়। ওখানে শত শত মানুষের ছবি বেশ যত্ন করে লাগানো। অধিকাংশই সিঙ্গেল ছবি তবে কয়েকটা গ্রুপ ছবিও আছে। ওদের অনেকের সাথেই তরুণ অপারেশনে গিয়েছিল কিন্তু আজ ওরা শুধু নির্বাক ছবি, স্মৃতি মাত্র। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান এতো সামান্য যে অপারেশনে না গেলে তা বোঝা যায় না। এই অপারেশনের পর কারও কারও ছবি বোর্ডে উঠবে হয়তো সেটা হতে তরুণ নিজেও।

কিছু ভাবছো মনে হয়। প্রভাসের ডাকে তরুণের আনমনা ভাঙ্গে। না নির্দিষ্ট কিছু ভাবছি না। আমি রেডি বস। তরুণ বলে।

কিছুক্ষণের মধ্যে প্রভাসের ঘর ভরে উঠে। মেজর প্রদীপ মারমা, মেজর সুব্রত চাকমা, ক্যাপ্টেন আনন্দ দেওয়ান, ক্যাপ্টেন দেবপ্রিয় ত্রিপুরা আরও বেশকিছু অফিসার ঘরে ঢোকে। ক্যাপ্টেন নলিনী চাকমা গ্রুপের মধ্যে একমাত্র মেয়ে। হাতে গোনা এলিট ব্ল‍্যাক স্করপিয়ন ক্লাবের একমাত্র মেয়ে সদস্য নলিনী। জংগল ওয়ার ফেয়ার এ্যান্ড সারভাইভাল টেকটিসের উপর ওর ট্রেনিং আছে।

প্রভাস ওকে আদর করে ডাকে ক্যাপ্টেন নাগিনী। এখনও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা যখন নলিনী ওর সাথে প্রথম দেখা করতে এল। সাদামাটা চেহারার বিশেষত্বহীন এক চাকমা মেয়ে যাকে আর দশটা মেয়ে হতে আলাদা করা যায় না। মেয়েটা বুকে একটা কাপড়ের পুটলি আঁকড়ে ধরে রীতিমতো ভয়ে কাঁপছিল। টানা একরাত পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে অনেকের সাথে নলিনী ত্রিপুরা এসেছিল। আর্মি মিটিং ডেকেছিল কাওখালী বাজারে বৌদ্ধমন্দির মেরামতের জন্য। নলিনীর বাবা-মা, ভাই আর নলিনী নিজে উপস্থিত ছিল সেই মিটিং-এ। অধিকাংশ মানুষ সাধারণ কৌতূহলী দর্শক, খেটে খাওয়া মানুষ। আর্মি আর বাঙ্গালি চারিদিক ঘিরে এলোপাথারি গুলি চালিয়েছিল। রক্ত, বিকৃত লাশ, আকাশবিদারী আর্তচিৎকার, বাঁচার জন্য আকুতি, কি ভয়ংকর বীভৎসতা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

নলিনী চোখের সামনে ওর মা-বাবা, ভাইকে মরে যেতে দেখেছিল। পৃথিবীর সবচাইতে কুৎসিততম দৃশ্য নিজের চোখের সামনে আপনজনের নির্মম মৃত্যু। সেদিন নলিনী ছিল বড়ো অসহায়। আজ সেই মেয়ের বুকে জ্বলে প্রতিহিংসার জ্বলন্ত চিতা। কর্ণেল প্রভাস ভাবতেও পারেনি এই মেয়েই একদিন বারুদের মতো জ্বলে উঠবে।

ঘরে থমথমে নীরবতা বিরাজ করে। নীরবতাকে ভয় পায় প্রদীপ মারমা তা যত সংক্ষিপ্তই হোক না কেন। ও চুরুট ধরায়, দিয়াশলাই জ্বালানোর শব্দও কানে খটকা লাগে। নলিনী, দেবপ্রিয়, চিন্ময় দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। সবার দৃষ্টি একজন মানুষের দিকে। কর্ণেল প্রভাস ওদের লিডারই শুধু না ওদের অভিভাবকও বটে। এই পিতৃতুল্য মানুষটার উপর ওদের অগাধ বিশ্বাস। কর্ণেল প্রভাসের। ডিসপ্লে বোর্ডে খাগড়াছড়ির অপারেশন ম্যাপ।

প্রভাস সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে ক্যাম্পের দিকে পয়েন্টার হাতে ও যায়, কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই শুরু করে। মাটিরাঙ্গা হতে মেজর খালেনেটাইপ পেট্রোল বোয়ালখালি বাজারে ক্যাপ্টেন জামিলের পেট্রোলের সাথে আগামী পরশু সকাল পাঁচটা পঁয়ত্রিশে মিলিত হবে।

সবার দৃষ্টি এখন বোর্ডে।

নলিনী এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। অনেকদিন ধরে ও বসে আছে, ওর আর দেরি সয় না। পরশুদিনও অনেক দেরি মনে হয়। বাবার প্রাণভিক্ষার কথাগুলো এখনো কানে বাজে, সেদিন নিরীহ স্কুল টিচারকে ওরা বাঁচতে দেয়নি। বোয়ালখালি বাজার হতে আর্মির কমবাইন্ড পেট্রোল কম্বিং অপারেশন চালাবে পাবলাখালিতে। মেজর তরুণের নেতৃত্বে দেওয়ান বাড়ি হতে একটা দল আগে থেকেই পজিশন নিয়ে থাকবে কালিচাঁদ বাড়ি এলাকায় এবং মেজর প্রদীপের নেতৃত্বে একটি পেট্রোল আগেই পজিশন নিয়ে থাকবে গদাধর পাড়ায়। শত্রুর পেট্রোল যখন বোয়ালখালি বাজার হতে পাবলাখালির দিকে অগ্রসর হবে তখনই আমরা দুই দিক হতে সাড়াশি আক্রমণ চালাবো। ওদের পায়ের তলায় মাটি আমরা কাঁপিয়ে দিবো। কর্ণেল প্রভাসের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।

কি পারবে না?

আমরা পারবো। সবার সম্মিলিত চিৎকারে ঘর গমগম করে।

অপারেশন ডিটেইলস নিয়ে আমি তরুণ আর প্রদীপের সাথে বসবো, পরে অন্যরা সবাই সবকিছু জানতে পারবে। প্রভাস কথা শেষে দম নেয়, রুমাল দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মোছে।

শত্রুকে আমরা শক্ত জবাব দিবো। বুঝিয়ে দিবো এই পাহাড়, ছড়া, অরণ্য আমাদের; এখানে থাকতে হলে আমাদের সাথে শান্তি করেই থাকতে হবে। এই বনে যতদিন ঘাস গজাবে, পাহাড় থাকবে, ছড়ায় জল বইবে ততোদিন এই ভূমি আমাদের এবং আমাদের সংগ্রাম ততদিন চলতেই থাকবে।

 ১৪

মায়া।

কি? মায়ার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

হাঁটুর উপর বা হাতে মাথা হেলান দিয়ে দূরের অশ্বত্থ গাছটার দিকে মায়া স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

তুমি কি কাঁদছো? নাহ্! কাঁদবো কেন? মায়া মুখ তুলে হাসি হাসি মুখে বলে।

মায়ার চোখে অশ্রু টলটল করে। চোখ মোছার কারণে কাজল হালকা ত্রিভুজাকৃতিতে বা চোখের বা কোনায় লেপ্টে আছে। এই কাজল লেপ্টানো অশ্রুভেজা মায়াকে আরও সুন্দর লাগে। বৃষ্টি আর রোদ মিলে যখন আকাশ জুড়ে রঙধনু সাতরঙের মেলা ছড়ায়, তেমনি হাসি-কান্নার এই মাখামাখিময় রূপে প্রতিটি মেয়েই সর্বোচ্চ সৌন্দর্যে আবির্ভূত হয়। মায়াকে এখন ডানাকাটা অপসরী মনে হয়। জামিলের ভয় হয় মায়া তার লুকানো পাখা লাগিয়ে উড়ে যাবে অজানা রাজ্যে, আর কোনো দিন দেখা হবে না।

তুমি যদি নাই কাঁদো তাহলে তোমার চোখে জল কেন? জামিল কিছুটা নাছোড়বান্দা।

আমি নিজেও জানি না আমি কেন কেঁদেছি। মেয়েরা কারণে অকারণে কাঁদে। ছেলেরা কেঁদে শক্তি হারায় আর কান্না মেয়েদের শক্তি জোগায়।

আমার দিকে তাকাও। জামিল মায়ার ডান হাত আলতোভাবে ছুঁয়ে বলে। মায়া জামিলের দিকে মুখ ফেরায়। কি অপূর্ব মায়াভরা মুখ। হ্রদের পানির মতো শান্ত দুটো চোখ।

কঠিন কিছু বলবে মনে হচ্ছে। দেখ বাপু যাই বলো দুঃখের কিছু বলো না। আর দুঃখ সইবার শক্তি আমার নেই।

তুমি কেন আমাকে ভালোবাসলে? জামিল মায়ার চোখে চোখ রেখে করে।

যাও, আমি জানি না। বেশি পণ্ডিতি করছো মনে হয়। মায়া হেসে হেসে বল প্রশ্ন করেছি এইজন্য যে কেউ আমাকে ভালোবাসলে আমার ভয় হয় পাছে আমি তার ভালোবাসার মর্যাদা না রাখতে পারি। জামিল কথা বলার সময় অজান্তে মায়ার হাত জোরে চেপে ধরে।

উফ্ ছাড়তো, লাগছে। হাত তো নয় যেন লোহার সাঁড়াশি। সরি, জামিল ওর হাত ছেড়ে দেয়।

দেখ রাইফেল, ধরে ধরে কেমন কড়া পড়ে গেছে। এক, দুই, তিন...। ডান হাতে পাঁচটা, বা হাতে চারটা। জামিল ওর ডানহাত মায়ার সামনে মেলে ধরে। মায়া কোনও উৎসাহ দেখায় না।

জামিল সিগারেটের তেষ্টা অনুভব করে। যখন কোনো কিছু স্বাভাবিকভাবে চলে না তখন তেষ্টাটা প্রবল হয়। এখন এক ধরনের অসহায়ত্ব ওকে ভর করে। দিলুর কথা ওর মনে হয়। মানুষ নাকি জীবনে একবারই প্রেমে পড়ে, কথাটা ওর মিথ্যা মনে হয়। মানুষ বহুবার বহুজনকে একসাথে অথবা আলাদাভাবে ভালোবাসতে পারে। দিলুর জন্য কষ্ট আর মায়ার জন্য কষ্টের স্বরূপ আলাদা কিন্তু তীব্রতা একই। হয়তো সে কাউকেই ভালোবাসেনি। জানেই না ভালোবাসা কি? জামিল সিগারেট ধরায়। দীর্ঘ টানের পর এক ধরনের শান্তি অনুভব করে।

এই মায়া কি এতো ভাবছো? সেই কখন থেকে চুপচাপ বসে আছো যে বড়ো। জামিল মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, মাঝে মাঝে

কারণ ছাড়া চুপচাপ থাকতে ভালো লাগে। জানি না কেন? এস আমরা একটা খেলা খেলি। মজার খেলা। জামিল মায়ার মেদহীন

হলুদাভ পিঠের দিকে তাকায়।

কি খেলা?

এই যে দেখাচ্ছি। জামিল মায়ার পিঠে আঙুল দিয়ে লেখে।

বলতো কি লিখেছি?

এ্যাই আমি রেডি না। তুমি আবার লেখ।

জামিল আবার লেখে।

বুঝেছি, আমি বুঝেছি। তুমি লিখেছো-"আমি মায়া"।

এবার আমার পালা, ঘুরে বসো।

জামিল মায়ার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে উবু হয় বসে। ও মায়ার সরু আঙুলের মৃদু চাপ অনুভব করে। প্রথম শব্দটা ধরতে পারছি না তবে দ্বিতীয়টা "পাহাড়"। প্লিজ আবার লেখ।

মায়া আবার লেখে। আমি জানি তুমি পারবে না। মায়া হেসে হেসে বলে।

তুমি য ফলা ব্যবহার করেছো। নাহ্ আমি পারলাম না। হার মানছি। এখন বলো কি লিখেছো?

তুমি দ্বিতীয় শব্দটা ঠিকই বলেছো। আমি লিখেছি "মৃত্যু পাহাড়"।

ওহ্ বাবা, প্রথমবারই এত কঠিন শব্দ। ওকে এবার আমার পালা। জামিল লেখে।

তুমি লিখেছো, উম-দাঁড়াও, লিখেছো "পাহাড়ি ফুল।" খুব সুন্দর দুটো

শব্দ-পাহাড়ি ফুল, মায়া বারকয়েক উচ্চারণ করে।

আচ্ছা এবার আমার পালা।

ইউরেকা, এবার পেরেছি। তুমি লিখেছো "ফুল ছিঁড়ো না"। জামিল মায়ার গাল টেনে বলে ছিঁড়বো না গো ছিঁড়বো না।

তোমার দশ আর আমার পাঁচ পয়েন্ট। নাও মাই টার্ন, আর ইউ রেডি।

মায়া ঈষৎ মাথা ঝুঁকায়। জামিল লেখে।

আমি জানতাম তুমি একসময় এটা লিখবে। মায়া হাসে। তুমি লিখেছো-

আমি তোমাকে ভালবাসি"। সত্যি তো? "

জামিল গভীর চোখে মায়ার দিকে তাকায়। তারপর বলে সত্যি, সত্যি, তিন সত্যি। আর এই খেলা খেলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। ইউ আর উইনার বরং তুমি একটা গান গাও।

কি গাইবো? বাংলা না চাকমা গান।

চাকমা গান। বন আর পাহাড়ের মাঝে অন্য কোনো ভাষার গান মানাবে না।

মায়া শুরু করে।

কুচপানাকারে কয়

যে কুচ পাইতে বুঝে...।

মায়ার কিন্নরী কণ্ঠ পাহাড়, উপত্যকায় হালকা স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

জামিলের মনে হয় এরকম কণ্ঠ ও কোনোদিনই শোনেনি। পাহাড়ি পরিবেশে পাহাড়ি কন্যার হৃদয় নিংড়ানো আকুতি ভরা স্বর্গীয় সুর বনের নির্জনতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সব গ্রহ, নক্ষত্র আজ যেন এক লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে প্রকৃতির সামান্যতম বেশকম এই গান সইতে পারবে না। তানসেনের মেঘমল্লার রাগে মেঘ হতে বৃষ্টি নামতো। হয়তো নামতো হয়তো না, কে জানে? জামিল আকায়ে দিকে তাকায়। ওদের ঠিক মাথা বরাবর কালো মেঘ জমে আছে। জামিল নিশি এই মেঘ গানের টানে এসেছে, শুধু ঝরার অপেক্ষায়। জামিলের চোখ দিয়ে অ ঝরে, ও মোছার চেষ্টা করে না।

আজ করার দিন।

 ১৫

সাদা-মাটা আর দশটা দিনের মতোই শুরু হয় দিনটা। বৈচিত্র্যহীন। আকাশ ফকফকা পরিষ্কার, অনুজ্জ্বল ধূসর চাঁদ দিনটাকে যেন আরও সাধারণ করে তোলে। অজগরের শরীরের মতো পেট্রোল আঁকাবাঁকাভাবে এগিয়ে চলে। বুটের তলায় পাতার মস্যস্ শব্দ বনের নিঃস্তব্ধতা ভাঙ্গে না বরং বাড়ায়। সামনে দুজন স্কাউট পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে যদিও সৈনিকেরা এই পথে বহুবার হেঁটেছে। বোয়ালখালি এখনও প্রায় ঘন্টা দেড়েকের হাঁটাপথ। রাতের অন্ধকার কাটতে এখনও দেরি আছে কিন্তু সৈনিকেরা অভ্যস্ত পায়ে ছড়ার বাঁক, টিলা, কাঁটাবন, মাথাঅব্দি বিশাল শনের মাঠ পেরিয়ে যায়। এত পরিচিত এই পথ তবুও অরণ্য কখনই আপন হয় না, প্রতিবারই কোনো না কোনো বিস্ময় অপেক্ষা করে।

ওটা কি রে? সিপাই ফারুক ফিসফিস করে বলে।

পথ হতে বিশ-পঁচিশ ফুট দূরে কতকগুলো শিয়াল মৃত প্রাণীর দেহ নিয়ে টানাহেঁচড়া করে। সৈনিকদের হঠাৎ আগমনে ওদের টানাহেঁচড়া কিছুটা কমে যায়। মোট তিনটা শিয়াল, দুইজন খাওয়া বাদ দিয়ে স্থির চোখে পেট্রোলের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছুটা বিরক্ত অহেতুক ব্যাঘাতে, অপেক্ষা করে সৈনিকদের চলে যাওয়ার অপেক্ষায়। এ্যাই ওটা মানুষ নাকি? সিপাই জালাল বলে।

সবার নজর এখন শিয়ালগুলোর দিকে। ক্যাপ্টেন জামিল পেট্রোলকে থামতে

বলে।

সিপাই শ্যামল, গোলজার মুখ দিয়ে হুস্-হুস্ শব্দ করতেই শিয়ালগুলো কয়েক পা পিছু হটে। ওরা কোনো ঝামেলা চায় না কিন্তু পুরোপুরি চলেও যায় না।

অনেকেই ছুটে যায় দেখতে। আধা খাওয়া মৃত দেহ, শরীরের নিচের অংশ নেই বললেই চলে। মুখের এক অংশে বিরাট গর্ত হা করে আছে। চাঁদের ফ্যাকাশে আলোয় এই গহ্বর আরও ভয়ংকর হয়ে উঠে। লাশ দেখে বোঝার উপায় নেই পুরুষ বা মহিলার লাশ। বনে হরহামেশা কেউ না কেউ বন্যপ্রাণীর হাতে প্রাণ হারায়। এটা নতুন কিছু না কিন্তু সৈনিকদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি নেমে আসে। মানুষের মৃতদেহের এই করুণ অবস্থা অবচেতন মনে যেন নিজেদের জীবনের অনিশ্চয়তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। ক্যাপ্টেন জামিল সৈনিকদের

গর্ত খুঁড়ে মৃতদেহটাকে মাটি চাপা দিতে বলে। সৈনিকেরা বেলচা দিয়ে দ্রুত গর্ত

খুঁড়ে মৃতদেহের সৎকার করে। শিয়ালগুলো তাদের খাদ্যের এই অবাঞ্ছিত

সাদা-মাটা আর দশটা দিনের মতোই শুরু হয় দিনটা। বৈচিত্র্যহীন। আকাশ ফকফকা পরিষ্কার, অনুজ্জ্বল ধূসর চাঁদ দিনটাকে যেন আরও সাধারণ করে তোলে। অজগরের শরীরের মতো পেট্রোল আঁকাবাঁকাভাবে এগিয়ে চলে। বুটের তলায় পাতার মস্যস্ শব্দ বনের নিঃস্তব্ধতা ভাঙ্গে না বরং বাড়ায়। সামনে দুজন স্কাউট পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে যদিও সৈনিকেরা এই পথে বহুবার হেঁটেছে। বোয়ালখালি এখনও প্রায় ঘন্টা দেড়েকের হাঁটাপথ। রাতের অন্ধকার কাটতে এখনও দেরি আছে কিন্তু সৈনিকেরা অভ্যস্ত পায়ে ছড়ার বাঁক, টিলা, কাঁটাবন, মাথাঅব্দি বিশাল শনের মাঠ পেরিয়ে যায়। এত পরিচিত এই পথ তবুও অরণ্য কখনই আপন হয় না, প্রতিবারই কোনো না কোনো বিস্ময় অপেক্ষা করে।

ওটা কি রে? সিপাই ফারুক ফিসফিস করে বলে।

পথ হতে বিশ-পঁচিশ ফুট দূরে কতকগুলো শিয়াল মৃত প্রাণীর দেহ নিয়ে টানাহেঁচড়া করে। সৈনিকদের হঠাৎ আগমনে ওদের টানাহেঁচড়া কিছুটা কমে যায়। মোট তিনটা শিয়াল, দুইজন খাওয়া বাদ দিয়ে স্থির চোখে পেট্রোলের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছুটা বিরক্ত অহেতুক ব্যাঘাতে, অপেক্ষা করে সৈনিকদের চলে যাওয়ার অপেক্ষায়। এ্যাই ওটা মানুষ নাকি? সিপাই জালাল বলে।

সবার নজর এখন শিয়ালগুলোর দিকে। ক্যাপ্টেন জামিল পেট্রোলকে থামতে

বলে।

সিপাই শ্যামল, গোলজার মুখ দিয়ে হুস্-হুস্ শব্দ করতেই শিয়ালগুলো কয়েক পা পিছু হটে। ওরা কোনো ঝামেলা চায় না কিন্তু পুরোপুরি চলেও যায় না।

অনেকেই ছুটে যায় দেখতে। আধা খাওয়া মৃত দেহ, শরীরের নিচের অংশ নেই বললেই চলে। মুখের এক অংশে বিরাট গর্ত হা করে আছে। চাঁদের ফ্যাকাশে আলোয় এই গহ্বর আরও ভয়ংকর হয়ে উঠে। লাশ দেখে বোঝার উপায় নেই পুরুষ বা মহিলার লাশ। বনে হরহামেশা কেউ না কেউ বন্যপ্রাণীর হাতে প্রাণ হারায়। এটা নতুন কিছু না কিন্তু সৈনিকদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি নেমে আসে। মানুষের মৃতদেহের এই করুণ অবস্থা অবচেতন মনে যেন নিজেদের  পরিণতিতে ক্ষুব্ধ হলেও সৈনিকদের সাথে যুদ্ধ করতে সাহস পায় না। শক্তি যার এই বন তার-এই ভয়ংকর অমোঘ নির্দেশ নিয়ে অহর্নিশি প্রকৃতির খেলা চলে। প্রতিটি জীবই এই অরণ্যে হয় খাদ্য না হলে খাদক। শিকার আর শিকারির এই শাশ্বত চক্র বনের প্রতিটি প্রাণী বৃক্ষ-লতা সবার মাঝে নিবিড় স্পর্শকাতর ভারসাম্য বজায় রাখে যদিও সাধারণ চোখে অনেকসময় এটা অমানবিক ঠেকে। সৈনিকেরা আবার হাঁটা শুরু করে। মৃতদেহের দৃশ্যস্থল ছাড়িয়ে এলেও মৃত্যুর অস্বস্তিকর অস্তিত্ব সামান্য হলেও মনের সাথে মিশে থাকে। এতই সামান্য সেই উপলব্ধি যা মনকে ভারাক্রান্ত করে না আবার পুরোপুরি এড়ানোও যায় না। সৈনিকেরা ছড়া পাশের ঢালু জমিতে বিশ্রামে, জন্য থামে। স্কাউট ছাড়াও হাবিলদার মন্তাজ পাহারায় থাকে। সৈনিকদের বুক কামারের হাঁপরের মতো হাঁপায়, সারা শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে। মশা ছেঁকে ধরে সৈনিকদের কিন্তু ওরা মশাদেরকে আমল দেয় না অথবা হাঁটার ক্লান্তি নগণ্য মশার অস্তিত্বকে আরও নগণ্যতর করে তোলে। সৈনিকেরা সিগারেট ধরায়। সিপাই মুজতবা সিগারেটে লম্বা লম্বা টান দেয়। ওকে দেখে কে বলবে যখন ও হিলে এল তখন ও সিগারেট খেতো না। এই পরিশ্রম, জীবনের অনিশ্চয়তার সাথে সিগারেটের নিশ্চয় কোনো সম্পর্ক আছে। সিগারেটের ধোঁয়ার মতো জীবনও শুধু ফুরিয়ে যাবার জন্য, দীর্ঘ সময় এই আতংকময় পরিবেশে থাকার জন্য জীবনের প্রতি এক ধরনের বেপরোয়া অনাসক্তি চলে আসে ফলে অনেক সৈনিকরাই ছেঁড়া বুটের

মতো জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। কি রে গোলজার কথা কস্ না কেন? সব রস কি আজ ফুরায় গেল নাকি? ল্যান্স নায়েক মঞ্জুর কটাক্ষ করে বলে।

না ওস্তাদ ফুরায়নি, তবে মনটা কেমন জানি করে। বুঝি না যন্ত্রপাতি সব ঠিক আছে কিনা?

অন্যরা গোলজারের উত্তরে হাসে।

এই না হলে গোলজার। গোলজারের কথা না ছুটলে আমাদের বাঁচন নাই। সিপাই শ্যামল বলে।

গোলজারের শরীর মন কোনোটাই আজ ভালো নাই। জোকার হবার সু যেমন আছে তেমনি অসুবিধাও কম নয়। ও যা বলে মানুষ তাতেই হাসে।

ধারণা গুলি খেয়ে ব্যথায় কোঁকালেও সবাই হাসবে।

তোরা দেখ গোলজার গুলি খাইছে-হা-হা

 ও মা গোলজার ব্যথায় কোঁ কোঁ করে রে-হা-হা।

সিপাই আকতার ইতিমধ্যে হেলমেটে মাথা দিয়ে সটান শুয়ে পড়ে; ওর নাক ডাকার শব্দে রমজান বলে শালা আছে ভাল। মঞ্জুরের ধারণা বাসর রাতে বিছানায় বসা মাত্র ঘুমিয়ে পড়বে। বেচারী বৌ একা একা জেগেই পার করবে জীবনের অন্যতম রাত। সৈনিকেরা পনের মিনিটের বিশ্রাম শেষে আবার হাঁটার জন্য রেডি হয়। আকতার ঝটপট উঠে দাঁড়ায়, প্যান্ট ঝাড়ে, মস্ত একটা হাই তুলে একদম প্রস্তুত হাঁটার যান্য। কে বলবে একটু আগেও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল জালালের হাঁটতে খারাপ লাগে না। মুদী দোকানদারের মতো সারাদিন কোলাব্যাঙের মতো তেল-নুন বেচার চাইতে হাঁটা ভালো কিন্তু তাই বলে আজীবন হাঁটতে হবে এটা ভাবতেও ভালো লাগে না ওর। সৈনিকের ঘিলু কম থাকলেও সই কিন্তু পা হতে হয় ইস্পাতের। সৈনিকেরা ঢিমে তালে হাঁটে, আর বিশ মিনিটের মতো পথ বাকী। সামনে তনচংখা পাহাড়, পাহাড় পেরোলেই বোয়ালখালি বাজারের সীমানা শুরু। কি নিরুপদ্রব রাত। হাবিলদার মন্তাজ পেট্রোলের পিছু পিছু হাটে, ওর সামনে ক্যাপ্টেন জামিল। মন্তাজ আকাশের দিকে তাকায়, এমন চাঁদ কোনো দিন দেখেনি, চাঁদের ধূসর রঙের ভিতর দিয়ে অদ্ভুত ফ্যাকাশে কমলাটে আলো বের হয়। ওর ধারণা কেয়ামতের রাতে আকাশে এমন কুৎসিত চাঁদ উঠবে। ওর ভয় হয় কিন্তু হাবিলদার মন্তাজ এই ভয়কে আমল দেয় না। জীবনে আরও অনেকবার ভয় পেয়েছে কিন্তু অনেক ভয়ই কারণ ছাড়া। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভয়ও বাড়ে, জীবনের প্রতি আসক্তি জন্মে। যার বয়স কম জীবনের প্রতি মায়াও কম। বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার।

ক্যাপ্টেন জামিলের পেট্রোল বোয়ালখালি বাজারে ঢোকে। মেজর খালেদের পেট্রোল পাবলাখালিতে লেফট ফ্ল্যাংকস কাভার করে ঢুকবে আর জামিলের পেট্রোল কাভার করবে রাইট ফ্লাংকস। রাতের অন্ধকার কাটিয়ে সবে ভোরের আলো ফুটতে লেগেছে। বন একটু একটু করে জেগে উঠার জন্য তৈরি হয়। সৈনিকেরা সতর্কতার সাথে এগিয়ে চলে। পাবলাখালি পাড়া এখন দৃষ্টি সীমার মাঝে। ছোট ছোট বাঁশ-কাঠের ঘরগুলো দূর হতে ছবির মতো লাগে।

-মারে বলে সিপাই রমজান মাটিতে শুয়ে পড়ে। চারিদিক হতে বৃষ্টির মতো

গুলি শুরু হয়। ক্যাপ্টেন জামিল চেঁচিয়ে বলে সবাই পজিশন নাও, উই আর আন্ডার এ্যাটাক। সৈনিকেরা বুঝতে পারে না কোথা থেকে গুলি আসে। গাছের পিছনে, পাহাড়ের খাদে, গর্তে যে যেখানে পারে মাথা নিচু করে পজিশন নেয়। গোলজার ক্রলিং করে রমজানের কাছে যায়। রমজানের পেটে গুলি লেগেছে। গোলজার নিজের ইউনিফর্ম ছিঁড়ে ব্যান্ডেজ করে। উষ্ণ, আঁঠালো রক্তে গোলজারের দু'হাত ভিজে উঠে। গোলজার আমি বাঁচবো না। রমজান মৃদু স্বরে বলে।

তুই বাঁচবি, কোনো চিন্তা করিস না। গোলজার আর কোনো কথা বলতে

পারে না। বৃষ্টির মতো গুলি চারিদিক হতে আসে। ব্যান্ডেজ রক্তে ভিজে উঠে। ও বুঝে রমজান বাঁচবে না।

লা ইলাহা ইল্লাললাহু, রমজান মৃদু স্বরে বলে তারপর ওর শরীর নিথর হয়ে যায়।

দূর পাহাড় হতে জলপাই রঙের ইউনিফর্ম পরা শান্তিবাহিনী ওদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে চালাতে আসে। জালাল আর আকতার একই গর্তে পজিশন নিয়ে ওদের দিকে গুলি চালায়। গোলাগুলির শব্দে বন কেঁপে কেঁপে উঠে। একটা গ্রেনেড ওদের থেকে প্রায় ফুট দশেক দূরে ধুলার ঝড় উড়িয়ে বিশাল শব্দে ফেটে পড়ে। ওদের শরীর ধুলায় মাখামাখি খায়। ওরা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে ব্যাপারটাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করে। জালাল দ্রুত নতুন ম্যাগাজিন লোড করে। কানের পাশ দিয়ে সাঁ-সাঁ করে গুলি ছোটে। জালালের নজরে আসে আকতার রাইফেলের উপর উবু হয়ে শুয়ে আছে। শালা কি ঘুমিয়ে পড়লো? আকতারকে ও কনুই দিয়ে ঠেলা দেয় কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। জালাল এক হেঁচকা টানে ওকে উল্টে দেয়। আকতারের বাম কপালের একাংশ গুলির আঘাতে উড়ে গেছে। ও আল্লাহ, ও মাবুদরে দয়া করো। জালালের গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে। ও থামে না ও গুলি চালিয়ে যায়। বেঁচে থাকার দুর্নিবার ইচ্ছা ছাড়া আর কোনো চিন্তা ওর আসে না।

জামিল অনেক আগেই ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে রিএনফোর্সমেন্টের জন্য মেসেজ পাঠিয়েছে এখন শুধু হেলিকপ্টার আসার অপেক্ষায়। প্রতিটি মিনিট যেন মনে হয় অনন্তকাল যা শেষ হবে না।

সিপাই শ্যামল, ল্যান্সনায়েক মঞ্জুরের গুলি লেগেছে। হাবিলদার মন্ডাজ শ্যামলের কাছে যায়। শ্যামলের প্রাণহীন ফ্যাকাশে মুখ, আধবোজা চোখ, ঝুলেপড়া চোয়াল ভয়ংকর কুৎসিত মনে হয়। এখানে সময় নষ্ট করা বৃথা ও মঞ্জুরের কাছে যায়। মঞ্জুর বেঁচে আছে, ওর বাম উরুতে আর ডান কাঁধের নিচে গুলি লেগেছে।

কে ওস্তাদ? মঞ্জুর অস্ফুট গলায় বলে।

ওস্তাদ আর বাঁচুম না, মাফ করে দিয়েন। ওর গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ হ

মন্তাজ জানে এটা মৃত্যুর শব্দ। ও চেষ্টা চালায় রক্ত বন্ধের, হাত ভিজে যায় রতে এরকম তরতাজা ছেলে চলে যাবে ভাবতেও কষ্ট হয়। পানি-পানি। মঞ্জুরের গ ক্ষীণ হয়ে আসে। মন্তাজ ওর ওয়াটার বোতল হতে পানি মঞ্জুরের মুখে দেয়।

ঢোক পানিও পুরোপুরি গিলতে পারে না, মুখের কোনা দিয়ে ঝরে পড়ে। মন্তাজের দিকে তাকানো অবস্থায় শান্ত হয়ে যায় মঞ্জুরের শরীর।

ক্যাপ্টেন জামিল ক্রলিং করে সামনের দিকে যাওয়ার সময় টের পায় ওর বা পা কাপড়ের পুতুলের মতো নেতিয়ে আছে। বাম হাঁটু পুরোপুরি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। কি আশ্চর্য একটুও ব্যথা অনুভব করে না। প্যাকস্যাক হতে ব্যান্ডেজ বের করে দ্রুত রক্ত বন্ধের চেষ্টা করে। ওর কোনো বেদনা, কষ্ট, দুঃখ, হতাশা কোনো কিছুরই অনুভূতি হয় না। মাথাটা ক্রমশ হালকা হয়ে আসে, বুঝতে পারে জ্ঞান হারাচ্ছে। এই যদি মৃত্যু হয় তাহলে তা মন্দ না। মানুষ কেন মৃত্যুকে এতো ভয় পায়?

আগুন, আগুন। তোরা বাইর , কে কোথায় আছস? বৃদ্ধা বসুমতি চাকমা চিৎকার দিতে দিতে ঘর হতে বের হয়। এখনও পুরোপুরি ভোর হয়নি, কেবল পূব আকাশে হালকা আলোর ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। আধা ঘুমস্ত মানুষগুলো একে একে বেরিয়ে আসে। পাড়ার উত্তর দিকের ঘরগুলো হতে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুনের লেলিহান শিখা, ছড়িয়ে পড়ছে একঘর হতে অন্য ঘরে। কাঠ আর বাঁশ ফাঁটার পটাপট শব্দের সাথে আছে আগুনের নিজস্ব হিসহিসানি। নিমাই, বটু, ঈরেশ বালতি নিয়ে ছুটে যায় ছড়ার দিকে, তখনই শুরু হয় প্রচণ্ড গুলি। নিমাই আর ঈরেশের দেহ কাটা কলা গাছের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে ছড়ার জলে। ততক্ষণে খবর ছড়িয়ে পড়ে আর্মি আর বাঙ্গালিরা গোটা পাড়া ঘিরে রেখেছে। আগুনের শব্দ ছাপিয়ে নারী, পুরুষ, শিশুর কান্না শোনা যায়।

মেজর নিজাম দাঁতে দাঁত পেঁষে, হারামজাদাদের আজ উচিৎ শিক্ষা দিবো। আজ বুঝবি আর্মিদের মারার ফল কি? অনিল কারবারীর বাড়ি কোনটা? মেজর

নিজাম হাবিলদার মস্তাজকে জিজ্ঞেস করে।

স্যার ছড়ার দক্ষিণের ওই কাঠের বাড়িটা।

মেজর নিজামের পেট্রোল বাড়ির সামনে আসতেই অনিল বেরিয়ে আসে। খালি গা, ধুতি পড়া প্রায় তিরিশের কাছাকাছি হালকা গড়নের লোকটা এগিয়ে আসে।

সেলাম বাবু। অনিল কপাল নুইয়ে বলে।

স্যার ইনিই অনিল কারবারী। মন্তাজ জানায়।

এই শূয়োরের বাচ্চা, তোর পাড়ায় শান্তিবাহিনী কে কে আছে বল? নিজামের

চোখ দিয়ে আগুন ঝরে।

অনিল বুঝে আজকের দিন আলাদা, ভয়ে ওর শরীর কাঁপতে থাকে।

বাবু তুমি বিশ্বাস করো পাড়ায় কোনো শান্তিবাহিনী নেই। আমরা খেটে খাওয়া জুমিয়া। আমরা ওর সাথে পাছে নেই গো বাবু।

ওটা কি রে? মেজর নিজাম জানতে চায়। ওটা বাবু চালের ঝাঁপি। সাংবছরের চাল আছে ওতে।

শালার ওটা চেক করতো রে? নিজাম সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলে। সৈনিকেরা লাথি দিয়ে ভাঙ্গে ঝাঁপির বেত আর বাঁশের দেয়াল। সারা উঠানময় চাল ছড়িয়ে পড়ে আর সেই সাথে বেরিয়ে আসে দুইটা একে ফরটি সেভেন রাইফেল আর গুলির পেটি।

এটাও তোর চাল নাকি? মেজর নিজাম মুখ খেঁচিয়ে বলে।

অনিল ভয়ে কাঁপতে থাকে। ধুতি ভিজিয়ে ফেলে, চিকন তরল রেখা গোড়ালি উঠানে দাগ ফেলে। ছুঁয়ে

মেজর নিজামের হাতে বেশি সময় নাই। এই বেজন্মার সাথে আর সময় কাটানোর মানে হয় না। হোলস্টার হতে রিভলবার বের করে অনিলের মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে। এই শালাদের বাঁচিয়ে রাখা মানে নিজেদের বিপদ ডেকে আনা। নিজাম অনিলের লাশের উপর দিয়ে হেঁটে ঘরে ঢোকে। ঘরের ভিতর ওর বৃদ্ধ মা-বাবা আর এক যুবতী দুইটা অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েকে বুক দিয়ে আগলে বসে আছে। সম্ভবত অনিলের বৌ। অনিলের মা মেজর নিজামের বা পা জড়িয়ে ধরে। বাবা আমাদের মেরো না গো, তোমার দোহাই লাগে। মেজর নিজাম ডান পা দিয়ে বৃদ্ধার মুখে কষে লাথি মারে। বৃদ্ধার ক্ষীণ শরীর তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ে নিথর হয়ে যায়। বোঁটা -মা, মাগো বলে ডুকরে কেঁদে উঠে। বাচ্চা দুটোও ভয়ে চেঁচিয়ে কাঁদে। এখন মায়া দেখানোর সময় না এখন কাজের সময়। নিজাম হাবিলদার মস্তাজকে ইশারা দেয়। হাবিলদার মন্তাজের এই নোংরা কাজ করতে মন চায় না বরং নতুনরাই হাত পাকাক। সিপাই মাসুদকে সামনে ডাকে। মাসুদ কালবিলম্ব করে না। চাইনিজ রাইফেল হতে এক ঝাঁক গুলি আরও অনেক শব্দের সাথে মিশে যায়। তারপর সৈনিকেরা আগুন লাগিয়ে দেয় কারবারীর ঘরে। সিপাই নারায়ণ অনিলের পা ধরে টেনে এনে জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে দেয়। উঠোনে রক্তের খয়েরী সরল রেখা সাক্ষী হয়ে থাকে সেই দিনের।

অনিলের বৌটা মোটা তাজা ছিল রে। এতো আগে শেষ করে ঠিক নি। নারায়ণ মাসুদকে বলে।

আহা! মালুর যেন তর সইছে না। তোকে আরও ডবকা জিনিস পাইয়ে বি কেবল

তো শুরু। মাসুদ উত্তর দেয়। অন্যরা ওদের কথায় হা-হা করে হাসে।

মাইরি বলেছিস তুই, শালা সব চাকমা মাগীদের পেটে বাঙ্গালি বীজ গেঁথে দিবো। সিপাই রশীদ হাসান বলে।

আজ গোলজারকে বড়ো মিস করছি। যে এমন করবে শাল। কক্ষনো ভাবিনি। জালাল আফসোস করে।

সিপাই গোলজার পাবলাখালি অপারেশনের দুই দিন পর পাকুড় গাছে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। সিপাই জালালই প্রথম দেখেছিল। ফজরের নামাজের জন্য উঠেছে তখনই দেখে কি জানি ঝুলছে গাছের সাথে। ওর ডাকে মন্তাজসহ আরও অনেকে বেরিয়ে এসেছিল। গোলজার যে ভিতরে ভিতরে এতো পুড়ছিল ওরা কেউ বোঝেনি।

মেজর নিজাম সৈনিকদের নির্দেশ দেয় শিশু আর মহিলা বাদে সব.... হাত দিয়ে ভয়ংকর ইঙ্গিত করে। সামনে ঝোঁপের আড়ালে তিনজন যুবকের ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে আছে। বাঙ্গালিরা ওদের দা দিয়ে কুপিয়ে মেরেছে। এই সমস্ত হিংস্র মানুষরা যে কোথা থেকে এসেছে আল্লাহই মালুম। মেজর নিজামের এখনও বুক কাঁপে গুলি ছুঁড়তে কিন্তু শালাদের নৃশংসভাবে একটা পাহাড়ি মারতে কলিজা সামান্যও কাঁপে না। ওরা মানুষ না পাথর? কঠিন চিজ না হলে সব ছেড়ে ছুড়ে জংগলে বাসা বাঁধবে কোন দুঃখে।

হরিণটিলার পাশে বেশ কিছু বাঙ্গালিরা জটলা করে আছে। ওদের কারও হাতে রাম্দা, বল্লম, ছুরি আর লাঠি। মেজর নিজামকে দেখে ওরা সরে দাঁড়ায়। স্যার এরা শান্তি, পালিয়ে যাচ্ছিল। চারজন পাহাড়ি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, বয়স বড় জোর ষোল হতে বাইশের মধ্যে, ওদের হাত দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা। একজনের বাম হাতের কব্জির ইঞ্চি দুয়েক উপরে গভীর ধারালো ক্ষত, দেখে বোঝা যায় যা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হয়েছে আর একজনের ডান কানের উপরে ক্ষত দিয়ে অজস্র রক্ত ঝরছে। বুকের একপাশ রক্তে ভিজে গেছে, ঘাসের উপর চাপ ধরে আছে রক্তের ছোপ। ওদের চেহারায় নির্বিকার ভাব। ওরা ওদের ভাগ্যের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছে। নিশ্চিত মৃত্যুর আগে এই নির্বিকার শূন্যতা মেজর নিজাম আগেও দেখেছে। ওদের আজ নিশ্চিত মরতে হবে। হিংস্র নেকড়ের আঘাতে জর্জরিত হয়ে মরবে না গুলি খেয়ে মরবে এটাই প্রশ্ন এখন।

থ্যাংক ইউ। আপনারা না থাকলে কাজটা এতো সহজ হতো না। আপনারা যান আমরা এদের দেখছি। মেজর নিজাম বাঙ্গালিদের বলে।

বাঙ্গালিরাও খুশি হয়ে চলে যায়।

সিপাই কালাম ওদের ছড়ার পাড়ে নিয়ে দাঁড় করায়। কালাম একজিকিউশন স্টাইলে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। এটা ওর প্রথম কোনও মানুষ মারা। মানুষমারা যে এত সহজ ও কিছুটা অবাক হয় আর বিস্মিত হয় যে ওর একটুও খারাপ লাগছে না ভেবে।

অপারেশন ক্লিন শ্লেট প্রায় শেষের দিকে। মেজর নিজাম আত্মতৃপ্তি বোধ করে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পেরেছে বলে। নিজাম হাবিলদার মন্ডাজকে শেষবারের মতো এলাকাটা একবার ঘুরে আসতে বলে।

পাড়ার পশ্চিম প্রান্তের টিলায় আনারসের বাগান আর বাগানের পাশে পাহারার গুমটি ঘর। ওখানে কয়েকজন সৈনিকদের মন্তাজ দেখতে পায়। মন্তাজ একটু অবাক হয়। এগিয়ে যায় ওদের দিকে। সিপাই নারায়ণ, মাসুদ, রশীদ হাসান আর সম্পূর্ণ বিবস্ত্র দুইজন চাকমা মেয়ে ওখানে। একটি মেয়ে দুই হাত দিয়ে বুক ঢেকে উবু হয়ে বসে আছে আর অন্য জন গুমটি ঘরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ওদের চোখে ভয়ের ছায়া। সৈনিকেরা ওকে আসতে দেখে একটু বিরক্ত হয়, নারায়ণ আর রশীদ তাড়াতাড়ি নামানো প্যান্ট দ্রুত টেনে তোলে।

ওস্তাদ আপনি আর এক ঘন্টা পরে আসেন। সিপাই মাসুদ বলে। হাবিলদার মন্তাজ আবার মেয়েগুলোর দিকে তাকায়। কি ভয়ার্ত সেই দৃষ্টি।

বসে থাকা মেয়েটার চোখে বাঁচার নির্বাক আকুতি মন্তাজ সহ্য করতে পারে না। ওর জরির কথা মনে হয়।

ওদের তোরা ছেড়ে দে। মন্তাজ বলে।

ওস্তাদ আপনি চলে যান। নারায়ণ ধীরভাবে বলে। ওদের ছেড়ে দে কইলাম। মন্তাজ এগিয়ে আসে।

চলে যান ওস্তাদ। রশীদ চিৎকার দিয়ে বলে।

হাবিলদার মন্তাজ এগিয়ে যায়, রিভলভারে হাত দেওয়ার আগেই সিপাই

মাসুদ তার অটোমেটিক রাইফেল মন্তাজের দিকে তাক করে।

ওস্তাদ আর এক পা এগুবেন না। আপনার কথা বহুত শুনছি। আজ আপনি আমাদের কথা শুনবেন। মাসুদ বলে।

তুই অস্ত্র নামা, ওদের যেতে দে। মন্তাজ উত্তর দেয়। আপনারে শেষবারের মতো যাইতে কইলাম। মাসুদ ধীরভাবে বলে।

কি তুই আমাকে মারতে চাস? তোর এতো বড়ো সাহস। ওদের ছাড় বলছি

নইলে...। হাবিলদার মন্তাজ কথা শেষ করতে পারে না। এক ঝাঁক গুলি ওর বুক ঝাঝরা করে দেয়।

 ১৬

চট্টগ্রাম সিএসএইচের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ক্যাপ্টেন জামিল শুয়ে আছে। সাতদিন অজ্ঞান থাকার পর গতকাল ওর জ্ঞান ফিরেছে। তো ভেবেছিল মরে গেছে অবশ্য ওর তাতে কোনো আফসোস ছিল না। আশেপাশে প্রতিদিন কেউ না কেউ মারা যায় সেই হিসাবে মৃত্যু এতো পরিচিত আবার একই সাথে মৃত্যু অপরিচিত। অপরিচিত অজানা জগৎকে মানুষ ভয় পায় বলেই মৃত্যু এত গ্ল্যামারহীন অবাঞ্ছিত। জামিলকে কড়া পেনকিলার দেওয়া হয়েছে। ভীষণ ক্লান্তি বোধ করে। কোনো কিছুই গোছানোভাবে ভাবতে পারে না কেমন যেন

খাপছাড়া, এলোমেলো চিন্তা মাথার মধ্যে ভেসে বেড়ায়। কর্ণেল ইকবাল গতকাল ওকে দেখে গেছে। জামিল এখন কেমন বোধ

করছো?

ভালো স্যার।

তুমি খুব ভাগ্যবান। তোমার পায়ের আর পেটের জখমটা খুব খারাপ ছিল। অনেক রক্ত গেছে। উই থট ইউ মাইট নট মেক ইট। সরি তোমার পাটাকে সেভ করতে পারলাম না যদিও অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ডোন্ট ওরি এখন অনেক ভালো প্রসথেসিস পাওয়া যায়। ইউ উইল বি অল রাইট। কর্ণেল ইকবাল যাওয়ার আগে ওর মাথায় আলতোভাবে হাত রেখেছিল।

ওর ডান পাশের বিছানায় লেফটেন্যান্ট মাহবুব শুয়ে আছে, দুটা পা- হারিয়েছে। সাদা চাদর গলাঅব্দি টেনে অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

জামিল ভাবে হাসপাতালের বিছানা চাদর, বালিশ কভার সব সাদা হয় কেন? মনে হয় সারি সারি কাফন পরা লাশ শুয়ে আছে। রঙিন চাদর হলে কি এমন ক্ষতি? উল্টাপাল্টা ভাবছে এটা নির্ঘাৎ ওষুধের কাজ।

ছোটখাট গড়নের সিস্টার ট্রলি নিয়ে ওর কাছে এসে দাঁড়ায়। ক্যাপ্টেন জামিল

কেমন আছেন?গতকালকের চেয়ে ভাল।

ভেরি গুড। এই আপনার ওষুধ। সিস্টার ওর হাতে পানির গ্লাস উঠিয়ে দেয়।

সিস্টার আমার সাথে কেউ কি দেখা করতে এসেছিল? জামিল জানতে চায়। ও হ্যাঁ একটা মেয়ে এসেছিল গত পরশু। তখনও আপনার জ্ঞান ফেরেনি।

কি জানি নাম মেয়েটির? হ্যাঁ মনে পড়েছে মায়া চাকমা।

কিছু কি বলেছে?

না তেমন কিছু না। বলেছে আবার আসবে।

মায়া তুমি কেমন আছ?

ভাল। মায়ার মুখ খুব মলিন দেখায়।

তুমি?

ভালো ছিলাম না একটুও কিন্তু তুমি আসাতে ভালো বোধ করছি।

তুমি আমার হাতটা ধরবে মায়া।

মায়া জামিলের হাত ধরে।

রতনকে দেখছি না, কেমন আছে?

মারা গেছে। মায়া স্থির গলায় জবাব দেয়।

আমাকে মাফ করো এই অহেতুক যুদ্ধের জন্য। এই যুদ্ধে তুমি, আমি,

পাহাড়ি-বাঙ্গালি আমরা সবাই ভিকটিম। যুদ্ধ খুব জঘন্য, কুৎসিত।

মায়া জামিলের গালে আলতোভাবে হাত বুলায়।

কাল আমি চলে যাচ্ছি।

কোথায়?

আগরতলায়, আমার মামার ওখানে।

তুমি কোথাও যাচ্ছো না। জামিল মায়ার হাত দু'হাতে আঁকড়ে ধরে।

আমার সব শেষ হয়ে গেছে। ঘর পুড়ে থাক। এখানে কেউ আর নেই। আমি

বড়ো অসহায় জামিল। মায়া কাঁদে।

আমি আছি। দেখো একদিন এই যুদ্ধ বন্ধ হবে তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।

ততদিন আমরা শেষ হয়ে যাবো। একটা দিনও এখানে কাটানো আমার

ভীষণ কষ্টের। মায়ার চোখ দিয়ে জল ঝরে।

জামিলের বড্ডো ঘুম পায়। সিস্টার কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়েছে।

মায়ার মুখটা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। তলিয়ে যায় ঘুমের অতল গহন

---------------

 

চৌধুরী আহসান পেশায় চিকিৎসক। জন্ম জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে। শৈশব কেটেছে খুলনায়। ক্যাডেট কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হতে ডাক্তারি পাশ করে যোগদান করেন আর্মি মেডিক্যাল কোরে। আর্মিতে থাকা অবস্থায় বদলি হন খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে। খুব কাছ থেকে দেখেন পাহাড় আর পাহাড়ি মানুষদের। প্রত্যক্ষ করেছেন নিরীহ পাহাড়িদের উপর অন্যায়, অবিচার যা লেখকের মন মানতে পারে নি কোনোদিনই। চাকরি ছেড়ে চলে যান প্রবাসে। বর্তমানে উচ্চ শিক্ষা শেষে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ইতিমধ্যে অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও কোনোদিনই ভুলতে পারেন নি পৃথিবীর বুকে অপার নিখাদ সৌন্দর্যপূর্ণ এই বিরল ভূখণ্ড আর এই ভূখণ্ডের সহজ-সরল মানুষদের।

পাহাড় আর পাহাড়ি মানুষদের প্রতি লেখকের অকৃত্রিম ভালবাসার ক্ষুদ্র প্রয়াস, 'পাহাড়ি ফুল এক অজেনা যুদ্ধের কাহিনী'

 স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রায় এক যুগের বেশি চলে আরো একটি যুদ্ধ যা অনেক বাংলাদেশির কাছেই প্রায় অজানা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সেই অচেনা, অস্পষ্ট অজানা যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত এই উপন্যাস 'পাহাড়ি ফুল এক অচেনা যুদ্ধের কাহিনী'

ক্যাপ্টেন জামিল ভালোবাসে ঢাকা ভার্সিটির ছাত্রী দিলুকে, যাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলী ওর সেই স্বপ্নে বাঁধ সাধে কিন্তু উন্মুক্ত করে এক অচেনা জগৎ। অবাক হয় সিজনড সৈনিক হাবিলদার মন্তাজকে প্রতি রাতে কাঁদতে দেখে। জোকার টাইপের সৈনিক গোলজারের অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ আরও অনেক মৃত্যু ওকে একটু একটু করে অজান্তে পাল্টে দেয়। যুদ্ধের ভ্যাঙ্কর ভয়াবহতার মাধোও পাহাড়ের অপার সৌন্দর্য ওকে বিমোহিত করে। এত কিছুর মাঝে একদিন দেখা পাহাড়ি কন্যা মায়া চাকমার সাথে। তারপর ঘটতে থাকে নানা ঘটনা বা দুর্ঘটনা।

প্রচ্ছদ:: মশিউর রহমান

 

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...