রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০২৪

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনের অবসান চাই: Binota M Dhamai

"একটা জায়গায় একজন লিখেছেন: "বমরা প্রায় অর্ধেক দেশ ছেড়েছে। ডিসেম্বর নাগাদ মনে হয় বম পার্বত্য চট্টগ্রামে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। থাকলে জেলা ও উপজেলা শহরে দু-এক পরিবার থাকবে। অধিকারের ললিপপ দেখিয়ে অপরাধীকরণ করে এখন অপরাধী ধরার অভিযান চলছে। বমরা পুরোটাই তথাকথিত কাউন্টার ইন্সারজেন্সি পলিটিক্সের শিকার।" বৈষম্যের বেড়াজাল কাকে বলে, আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে সংক্ষেপে এখানে একটু যোগ করি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যা এখনো চলমান - চুক্তির আগে এবং পরে - যে নামেই ডাকুক না কেন, অপারেশন দাবানল বা অপারেশন উত্তরণ, সেটা হলো তাত্ত্বিকভাবে কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি স্ট্রাটেজি। এই পলিসি ব্রিটিশরা এশিয়া অঞ্চলে মালয়েশিয়াতে সরাসরি প্রয়োগ করেছিল এবং সেই একই ব্যবহারিক দিক আমাদের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর প্রয়োগ করছে। এই তাত্ত্বিক দিকে কয়েকটি বিষয় বিদ্যমান, প্রথমতঃ loyal population তৈরী করা। সেটা দুইভাবে করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। একটি হলো transmigration - বাইরে থেকে এনে বাঙালিদের পূর্ণবাসন করে জনমিতি বদলে দেওয়া, এবং সেটা করে ফেলেছে। আরো একটি হলো ভাগ করো শাসন করো যেখানে আমাদের পাহাড়ের আদিবাসীদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল, যেটা আমরা দেখেছি ১৯৮৯ সালে স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচনে এবং ১৯৯৭ চুক্তি পরবর্তীতে। দ্বিতীয়তঃ হার্ট এন্ড মাইন্ড কর্মসূচি, সেটি মূলত অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়ন যা সেনা কতৃত্বে চলে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো কোটি কোটি টাকার ব্যয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কোনো প্রকার অডিট ছাড়াই ব্যয় হয়। বহিরাগত বাঙালিদের যে রেশন এবং পূর্ণবাসন করা হয় সেই টাকা ও এই কোটি টাকার লেনদেন। উনারা পলিটিকাল কাজও করে থাকেন এই যেমন হেডম্যান কারবারি সম্মেলন। আবার বহিরাগত বাঙালিদেরকে আমাদের পাহাড়ি আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হামলাসহ বিভিন্ন অপকর্মে লেলিয়ে দেওয়া হয়। তৃতীয়তঃ কম্যান্ড এন্ড কন্ট্রোল - প্রশাসনের সমস্ত কিছু প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সেনাদের নিয়ন্ত্রণে চলবে। পুলিশ এবং বেসামরিক প্রশাসনের ক্ষমতা সীমিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা সেটাই দেখি। একটা সাধারণ দেওয়াল লিখন বা সেখানে কি লিখবো না লিখবো, তার জন্যে সেনাবাহিনীর অনুমতি নিতে হয়। বাংলাদেশের আমার মানবাধিকার সেই কণ্ঠরোধের, নিপীড়ন নির্যাতনের বেড়াজালে, এই বৈষম্য পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ বহমান। আজকে এইখানে রাখলাম।"

শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০২৪

পাহাড়ের আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ: হিল ভয়েসের ন্যারেটিভে শেখ হাসিনা সরকারের সময়কাল (২০২০-২০২৪): ড. অনুরাগ চাকমা

দেশে-দেশে আজ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপিত হবে। যাদেরকে ঘিরে আমাদের বাংলাদেশেও এই বিশেষ দিবসটি বহু বছর ধরে উদযাপিত হয়ে আসছিল, তাদের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কটা কেমন ছিল, আছে এবং থাকবে, দেশের এই কঠিন সময়ে সেটা অনেকের মত আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছে। তবে শুরুতে বলতে চাই, অতীত সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক পলিসি, পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ অনেক বিষয় নিয়ে অনেক লেখা লিখেছিলাম। আমার সেসব অনেক লেখা IPNEWS সহ অনেক জায়গায় ছাপানো হয়েছিল। কিন্তু, আজকের আলোচনাটা হিল ভয়েসের ন্যারেটিভসগুলোর মধ্যে রাখতে চাই এবং দেখাতে চাই, সদ্য বিদায়ী শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে (২০২০ থেকে ২০২৪ এপ্রিল পর্যন্ত) পাহাড়ের আদিবাসী জনগণের সাথে রাষ্ট্র কেমন আচরণ করেছে। তবে এটাও যুক্ত করতে চাই, শুধু শেখ হাসিনার আমলে নয়, অতীতের সব সরকারের সময়ে পাহাড়ের আদিবাসীরা নির্যাতিত হয়ে এসেছে। ১৯৭১ সাল থেকে আমরা সবসময় পরাধীন থেকে গেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বাদ আমরা কোনোদিন উপভোগ করতে পারিনি।
উল্লেখ্য যে, ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারিতে হিল ভয়েসের ফেসবুক পেইজটি যাত্রা শুরু করে। তখন থেকে এযাবৎ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘন, আদিবাসী নারীদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন এবং বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত প্রায় ২,৮৫৪টি পোস্ট করা হয়। এসব পোস্টগুলোর থিম্যাটিক ক্লাস্টারগুলো বের করার জন্য আমি GloVe (Global Vectors for Word Representation) অ্যালগরিদম ব্যবহার করেছি, যা শব্দগুলির ভেক্টর প্রতিনিধিত্ব তৈরি করে এবং Uniform Manifold Approximation and Projection (UMAP) এর মাধ্যমে সেগুলিকে 2D স্পেসে প্রদর্শন করেছে। সংযুক্ত প্লটটিতে দেখুন ২০২০ থেকে ২০২৪ এপ্রিল পর্যন্ত পাহাড়ে আদিবাসীদের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্কটা কেমন ছিল? নিচে শুধুমাত্র আমি কিছু থিম্যাটিক ক্লাস্টার নিয়ে আলোচনাটা সীমিত রেখে দিলাম।
• মন এবং সহিংসতা ( (UMAP1: 3.9-4.0, UMAP2: -0.4 থেকে -1.2 পর্যন্ত): এই ক্লাস্টারটিতে “arrested,” “murdered,” “raided,” এবং “tortured” এর মতো শব্দগুলি পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান রাষ্ট্রয় নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকে প্রতিফলিত করেছে। প্রত্যাশা থাকবে, এই সরকার সেটা বন্ধ করবে।
* বাস্তুচ্যুতি এবং পুনর্বাসন ( UMAP1: 4.0-4.4, UMAP2: -1.2 থেকে 0.4 পর্যন্ত): এই অংশে “evicted,” “displaced,” “relocated,” এবং “resettlement” এর মতো শব্দগুলি রয়েছে, যা আদিবাসী জনগণের ভূমি এবং ঘরবাড়ি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং পুনর্বাসনের ঘটনার উপর ফোকাস করেছে। এই সরকারকে এই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে।
* শান্তি আলোচনা এবং সমঝোতা ( UMAP1: 4.3-4.5, UMAP2: 0.8 থেকে1.2 পর্যন্ত): এই ক্লাস্টারটিতে “peace,” “agreement,” “negotiation,” এবং “implementation” এর মতো শব্দগুলি নির্দেশ করে, আদিবাসী জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং সংঘাত নিরসনে সম্পূর্ণভাবে পার্বত্য চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
* প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ (UMAP1: 3.9-4.2, UMAP2: -0.4 থেকে 0.6 পর্যন্ত): এই অংশে “protest,” “resistance,” “struggle,” এবং “movement” এর মতো শব্দগুলি আদিবাসী জনগণের বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রতিরোধ, প্রতিবাদ এবং আন্দোলনকে প্রতিফলিত করেছে।
* যৌন সহিংসতা ( UMAP1: 3.8-4.0, UMAP2: -1.0 থেকে -1.5 পর্যন্ত): এই ক্লাস্টারটিতে “raped,” “sexually,” “violated,” এবং “assaulted” এর মতো শব্দগুলি আদিবাসী নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা এবং তার যে প্রভাব সেটাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই সরকারের যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
* কেন্দ্রীয় থিম ( UMAP1: 4.0-4.3, UMAP2: -0.2 থেকে 0.8 পর্যন্ত): এই ক্লাস্টারটিতে “authority,” “rights,” “law,” এবং “recommendations” এর মতো শব্দগুলি প্রধানত আদিবাসীদের জন্য আইনি এবং প্রশাসনিক সুরক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে।
জানি না, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজ, প্রফেসর ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, এবং ভবিষ্যতে দেশে যেসব দল ক্ষমতায় আসবে তাদের সাথে আদিবাসীদের সম্পর্কটা কেমন হবে? যদি তারা সত্যিকার অর্থে একটি “সবার জন্য বৈষম্যমুক্ত কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা” গড়তে চায়, তাহলে তারা এসব থিম্যাটিক ক্লাস্টারগুলোকে বিবেচনায় নিতে পারে। দেশে সব সরকারের সময়ে পাহাড়ে নিপীড়িত-নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য হিসেবে বলব, “অধিকার দিয়ে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কেউ ছোট হয়ে যায়নি”।
সবাইকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা।
ড. অনুরাগ চাকমা, রিসার্চ ফেলো, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৪

পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা-বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭) : সুপ্রকাশ রায়

 

চাকমা জাতির জীবনধারা

 

চট্টগ্রাম জেলার সমতলভূমির উপরিভাগে অবস্থিত পাহাড়-পর্বতময় অঞ্চলটির নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি "যাযাবর চাষীদের বাসস্থান। প্রকৃতির কঠোরতা এবং ততোধিক দুর্ধর্ষ বন্য প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্নভাবে কঠোর সংগ্রাম করিয়া ইহাদের জীবন ধারণ করিতে হয়।"[1]

ভারতবর্ষের অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলের আদিম অধিবাসীদের মতই এই অঞ্চলের চাকমা, কুকি প্রভৃতি পার্বত্য অধিবাসীরা প্রকৃতির সহিত নিরবচ্ছিন্নভাবে কঠোর সংগ্রাম করিয়া জীবন ধারণ করে। সেই কঠোর সংগ্রামই তাহাদিগকে দুর্ধর্ষ করিয়া তুলিয়াছে।

চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলটি প্রথমে ছিল কুকি জাতির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাসস্থান। পরে চাকমাগণ কুকিদের আরও উত্তর-পূর্ব দিকে তাড়াইয়া দিয়া আরাকান অধিকার করে। কিন্তু ব্রহ্মযুদ্ধের সময় (১৮২৪-৫২) মগেরা আসিয়া চাকমাদের বিতাড়িত করিয়া চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ অংশ অধিকার করিলে চাকমাগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করিয়া সেই স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করিতে থাকে। [2]

এই অঞ্চলের পার্বত্য আদিম অধিবাসীরা এমনকি মোগল যুগেও নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখিতে পারিয়াছিল। সেই যুগেও তাহারা তাহাদের নিজস্ব স্বাধীন জীবিকার ব্যবস্থা অক্ষত অব্যাহত রাখিতে সক্ষম হইয়াছিল। তখন তাহারা কঠোর কায়িক পরিশ্রমে প্রস্তরময় অনুর্বর জমিতে যে শস্য উৎপাদন করিত তাহার সামান্য একটা অংশ রাজস্ব হিসাবে মোগল সম্রাটদের দিয়া তাহারা স্বাধীনভাবেই বাস করিত। কিন্তু এই অঞ্চলটি ইংরেজ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হইবার সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের 'স্বাধীন ভাবে জীবিকা নির্বাহের পুরাতন ব্যবস্থা ধ্বংস হইয়া যায় এবং অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকদের মত এই পর্বত-অরণ্যচারী আদিম মানুষগুলিও ক্রমশ ইংরেজরাজের শোষণ ব্যবস্থার নাগপাশে আবদ্ধ হইয়া পড়ে। ক্রমশ এই অঞ্চলের[3] উপরেও ইংরেজরাজের শোষণযন্ত্রগুলি একে একে চাপিয়া বসিতে থাকে।

১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে এক সন্ধি দ্বারা ইংরেজদের 'ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' মীরকাসেমের হস্তে বাংলা-বিহার উড়িষ্যার নবাবী দান করিয়া প্রতিদান স্বরূপ বর্ধমান, চট্টগ্রাম মেদিনীপুর অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে। সুতরাং সেই সঙ্গে এই ক্ষুদ্র চাকমা রাজ্যটি পার্শ্ববর্তী স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্য ইংরেজ বণিকদের কুক্ষিগত হয়।[4] সেই সময় হইতেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠি উহার শোষণের অনুচরগণ এই আদিবাসীদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করিতে আরম্ভ করে। এই আদিবাসীদের জীবনধারা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আলেকজান্দার ম্যাকেঞ্জি সাহেব লিখিয়াছেন।

"চট্টগ্রাম বৃটিশদের অধিকারে আসিবার সঙ্গে সঙ্গেই এই পার্বত্য অঞ্চলের কোনো অংশে বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। সেই সময় বৃটিশ কর্তৃপক্ষ পার্বত্য অঞ্চলে দুইজন মাত্র পাহাড়িয়া দলপতির সন্ধান পাইয়াছিল। তাহাদের একজন 'ফ্র' (Phruu) নামক আদিম জাতির নায়ক, অপরজন চাকমা জাতির নায়ক। এই দলপতিগণ মুসলমান শাসকদের নিকা রাজস্ব হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্পাস পাঠাইত। তাহারা প্রথমে বৃটিশ শাসকদিগকেও কার্পাসের দ্বারা রাজস্ব দিত। কিন্তু রাজস্বের কার্পাসের পরিমাণ সম্ভবত এক এক বৎসর এক এক রূপ হইত। এই জন্যই প্রতি বৎসর এই 'কার্পাস মহল' একজন ফড়িয়ার (speculator) নিকট ইজারা দেওয়া হইত। এই ইজারাদার ফড়িয়া বৃটিশ কর্তৃপক্ষের সহিত কাপাস-রাজস্ব আদায়ের চুক্তি করিত এবং এইভাবে এই অঞ্চলের সমস্ত কার্পাস একচেটিয়া করিয়া ফেলিত।"[5]

 

ম্যাকেঞ্জি সাহেবের মতে, মোগল যুগেই 'কার্পাস মহল' বা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ফড়িয়া বা 'স্পেকুলেটর' নামক শোষকদের আবির্ভাব ঘটে। ইংরেজ শাসকগণ এই পার্বত্য আদিম জাতিগুলির উপর তাহাদের শোষণ-যন্ত্রের অপরিহার্য অংশ রূপে এই ফড়িয়াদের লেলাইয়া দেয়। ফড়িয়ারা ইংরেজ শাসকদের সহিত রাজস্ব আদায়ের চুক্তি করিয়া নানাবিধ উৎপীড়ন দ্বারা 'কার্পাস মহলের' প্রস্তরময় অনুর্বর জমিতে পাহাড়িয়াদের অমানুষিক পরিশ্রমে উৎপন্ন একমাত্র শস্যের উপর একচেটিয়া প্রভুত্ব স্থাপন করে।

 

এই অঞ্চলের আদিম প্রথায় চাষবাস ভূ-সম্পত্তি-প্রথার নিম্নোক্ত বিবরণটি ম্যাকেঞ্জি সাহেবের গ্রন্থে পাওয়া যায়:

 

"যে প্রথায় সকল পাহাড়িয়া জাতি জমি চাষ করিত, তাহার নাম 'ঝুম' প্রথা। প্রতি বৎসর এপ্রিল মাসে গ্রামের সমস্ত লোক কোন একটা সুবিধাজনক স্থানে যাইয়া বসতি স্থাপন করে তাহার পর প্রত্যেক পরিবারের সকল লোক জঙ্গল কাটিয়া চাষের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ জান আবাদ করিয়া লয়। ফসল পাকিবার সময় বন্য পশুপক্ষীর হাত হইতে শস্য রক্ষা করিবার জন তাহারা 'ঝুম' বা দল ব্যাধিয়া সারা রাত্রি জমি পাহারা দেয়। দুই বৎসর চাষের পর জমিয় উর্বরা-শক্তি নিঃশেষ হইয়া যায়। এইভাবে যখন গ্রামের চারিপাশের সমস্ত উর্বর জমি চাষ হইয় যায়, তখন সকল লোক স্থান ত্যাগ করিয়া অন্য স্থানে গিয়া বসতি স্থাপন করে। সহজেই বুঝিতে পারা যায় যে, এই প্রথায় চাষের ফলে কোন জমির উপরই 'ভূমিয়াদের' (যাহারা চাষে অংশ গ্রহণ করে) স্থায়ী স্বত্ত্ব জন্মিতে পারে না, এবং এই সকল জমির উপর রাখা নির্ধারণ করিবারও কোন উপায় থাকে না। এই জন্যই এমনকি দলপতিরাও জমি বা বলে উপর কোন ব্যক্তিগত অধিকার দাবি করে না।[6]

 

পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা প্রভৃতি আদিবাসীরা এইভাবে অনুর্বর পার্বত্য জমিতে তুলার ফলা ফলাইয়া এবং সেই তুলা চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে লইয়া আসিয়া উহার বিনিময়ে চাউল, লবণ প্রভৃতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করিত।

শোষণ-পদ্ধতি

ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বিবরণ হইতে বুঝিতে পারা যায় যে, এই অঞ্চলের পার্বত্য আদিম অধিবাসীরা ছিল যাযাবর চরিত্রের মানুষ। ইংরেজ শাসনের পূর্বে এবং অব্যবহিত পরেও ইহাদের মধ্যে জমির উপর ব্যক্তিগত স্বত্ত্বের উদ্ভব হয় নাই। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব না হইবার ফলে ইংরেজ শাসকগণ প্রথমে এই অঞ্চলের উপর তাহাদের প্রত্যক্ষ শোষণের জাল বিস্তার করিতে না পারিয়া পরোক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছিল। পরোক্ষ ব্যবস্থাটি ছিল নিম্নরূপ:

 

ইংরেজ শাসকগণ বাহিরের কোন ব্যক্তির সহিত কার্পাস-র আদায়ের চুক্তি করিয়া তাহাকে পার্বত্য অঞ্চল ইজারা দিত। ইজারাদার বিভিন্ন কৌশলে এই সরল প্রকৃতির পার্বত্য অধিবাসীদের নিকট হইতে রাজস্বের নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা হইতে কয়েক গুন অধিক তুলা আদায় করিয়া আনিত এবং চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলা শাসকদের নিকট জমা দিয়া বাকি তুলা আত্মসাৎ করিত। ইহার পর ঐ তুলা বাজারে বিক্রয় করিয়া প্রচুর মুনাফা লাভ করিত। অবশ্য ইজারাদার ইংরেজ প্রভুদের সম্মতি লইয়াই ইহা করিত। শাসকগণ রাজস্ব হিসাবে যে তুলা পাইত তাহা বিক্রয় করিয়া মুদ্রায় পরিণত করিবার জন্য অন্য কোন ব্যক্তির সহিত চুক্তি করিত। এই চুক্তিতে মুদ্রার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা থাকিত। এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি শাসকগণের হস্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিয়া বাকি তুলা হইতে ফটকাবাজি দ্বারা (স্পেকুলেশন) প্রচুর মুনাফা লুণ্ঠন করিত।[7]

 

এই ব্যবস্থার ফলে পার্বত্য অধিবাসীদের জীবিকা নির্বাহ অসম্ভব হইয়া উঠে। প্রথমত, প্রথম ইজারাদারটি তাহাদের নিকট হইতে রাজস্বের নামে প্রায় সমস্ত তুলাই লুটিয়া লইত। দ্বিতীয়ত, তাহার লুণ্ঠনের পর যে সামান্য পরিমাণ তুলা থাকিত তাহা চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে লইয়া গিয়া উহার বিনিময়ে বা উহার বিক্রয়লব্ধ অর্থে আদিবাসীদের পক্ষে খাদ্য প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করা দ্বিতীয় ব্যক্তিটির জন্য অসম্ভব হইয়া উঠিত। কারণ, সেই ব্যক্তি বিভিন্ন উপায়ে ঐ অবশিষ্ট তুলা নামমাত্র মূল্যে তাহার নিকট বিক্রয় করিতে আদিবাসীদের বাধ্য করিত। এই অঞ্চলের আদিবাসীরা সমান ওজনের দ্রব্যের বিনিময়ে সমান ওজনের দ্রব্য লইতে অভ্যস্ত ছিল। সুতরাং তুলার ব্যাপারী দুই টাকা মূল্যের এক মণ লবণের বিনিময়ে আট টাকা মূল্যের এক মণ তুলা আত্মসাৎ করিত।[8] এইভাবে কোন একটি বা দুইটি দ্রব্য ক্রয় করিতেই আদিবাসীদের সমস্ত তুলা নিঃশেষ হইয়া যাইত। এই উভয়বিধ শোষণের ফলে এই আদিবাসীরা অনিবার্য মৃত্যুর মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। অবশেষে তাহারা আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসাবে বিদ্রোহের পন্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য হইল।

প্রথম বিদ্রোহ (১৭৭৬-৭৭)

প্রথম চাকমা-বিদ্রোহ সম্পর্কে সরকারী রেকর্ডে কেবলমাত্র একখানি পত্রের উল্লেখ দেখা যায়। এই পত্র দ্বারা চট্টগ্রামের তৎকালীন কালেক্টর গভর্ণর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে এই বিদ্রোহের সংবাদ দিয়াছিলেন। এই পত্রে কালেক্টর সাহেব নিম্নোক্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন:

"রামু খাঁ নামক এক পাহাড়িয়া তুলার চাষের জন্য কোম্পানিকে সামান্য রাজস্ব দেয়। আমার এই স্থানে আসিবার পর হইতে, ইজারাদারগণের দুর্ব্যবহারের জন্যই হউক, অথবা তাহার বিদ্রোহী চরিত্রের জন্যই হউক, রামু খাঁ কয়েক মাস যাবৎ কোম্পানির ইজারাদারগণের সহিত ভীষণ দাঙ্গাহাঙ্গামা চালাইতেছে। ..... রামু খাঁকে বন্দী করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা চলিতেছে।[9]

 

"কিন্তু কালেক্টরের এই চেষ্টা সফল হয় নাই, কারণ রামু খাঁ তাঁহার বাসস্থান হইতে পলায়ন করিয়াছে। "[10]

পরবর্তী কালে এই অঞ্চলের শাসনকর্তা রূপে আসিয়া আলেকজান্দার ম্যাকেঞ্জি, ক্যাপ্টেন টি এইচ. লুইন, আর. এইচ. এস. হাচিন্সন প্রভৃতি উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীগণ চাকমা জাতির এই বিদ্রোহ অন্যান্য বিদ্রোহ সম্পর্কে বহু তথ্য খুঁজিয়া বাহির করেন। ইহাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন লুইন-এর বিবরণটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যভাগে চাকমাগণ প্রথমবার বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন চাকমা-দলপতি 'রাজা' শের দৌলত তাঁহার সেনাপতি রামু খাঁ। ইহারা উভয়ে ছিলেন পরস্পরের আত্মীয়। রামু খাঁ সাধারণের নিকট 'সেনাপতি' বলিয়া পরিচিত ছিলেন। চাকমাদের উপর সেনাপতি রামু খাঁর অসাধারণ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। ইংরেজ শাসকদের দ্বারা নিযুক্ত ইজারাদারগণের শোষণ-উৎপীড়ন সহ্যের সীমা অতিক্রম করিলে রামু শের দৌলত চাকমা জাতির সকল লোককে একত্র করিয়া ইজারাদারি ইংরেজ শাসনের মূলোচ্ছেদ করিবার জন প্রস্তুত হন। প্রথমে কার্পাস-কর দেওয়া বন্ধ হয় এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে ইজারাদারগণের ভূলম গোলা লুণ্ঠিত হয়। রামু খাঁর নেতৃত্বে চাকমাগণ ইজারাদারদের বড় বড় ঘাঁটি ধ্বংস করিয় ফেলে। রাঙ্গুনীয়া প্রভৃতি স্থানের বড় বড় গোলা লুণ্ঠন করিয়া সমস্ত তুলা বিদ্রোহীরা লইয়া যায় ইজারাদার তাহার কর্মচারীগণ চাকমা অঞ্চল হইতে পলায়ন করে এবং বহু কর্মচার চাকমাদের হস্তে নিহত হয়।

ইংরেজ শাসকগণ ইজারাদারের সাহায্যে অগ্রসর হয় এবং এই অঞ্চলের সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে একটি সৈন্যদল প্রেরণ করে। চাকমাগণ তাহাদের তীর-ধনুক বর্শা দ্বারা আগ্নেয়াত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অসম্ভব বুঝিয়া গভীর পার্বত্য অঞ্চলে সরিয়া পড়ে। ইংরেজ বাহিন বিদ্রোহীদের কোন সন্ধান না পাইয়া ফিরিয়া আসে। চাকমাগণ সুযোগ বুঝিয়া আবার অগ্রসর হয় এবং চট্টগ্রামের সমতল ভূমিতে নামিয়া আসিয়া ইজারাদারের ঘাঁটি ও ব্যাপারীদের দোকান প্রভৃতির উপর আক্রমণ চালাইতে থাকে। ইংরেজ বাহিনী আবার পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশ করিয়া বিদ্রোহীদের পশ্চাদ্ধাবন করে। কিন্তু এবারেও বিদ্রোহীরা গভীর পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য হইয়া যায়।

এইভাবে বিদ্রোহী চাকমাদের দমন করা অসম্ভব বুঝিয়া শাসকগণ এক নতুন কৌশল অবলম্বন করে। চাকমাগণ সমতল ভূমির বিভিন্ন বাজারে আসিয়া তাহাদের উদ্বৃত্ত তুলার বিনিময়ে বাজার হইতে খাদ্য, লবণ প্রভৃতি সংগ্রহ করিত। শাসকগণ জানিত যে, চাকমাগণ তুলা বাজারে লইয়া আসিতে না পারিলে খাদ্য সংগ্রহ করিতে পারিবে না এবং খাদ্যাভাবে শেষ পর্যন্ত বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য হইবে। সুতরাং তাহারা সমতল ভূমির বিভিন্ন বাজারের পথে বহু স্থানে সৈন্যের পাহারা বসাইয়া চাকমাদের বাজারে আসা বন্ধ করিবার ব্যবস্থা করে। অবশেষে তাহাদের এই কৌশল সাফল্য লাভ করে, চাকমাগণ বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য হয়। রামু খাঁ ইংরেজ শাসকগণকে ৫০১ মণ তুলা বার্ষিক রাজস্ব, স্বরূপ দিতে সম্মত হইয়াছিলেন। [11]

এই প্রথম চাকমা-বিদ্রোহ ও উহার প্রধান নায়ক রামু খাঁর নাম এখনও চাকমা জাতির স্মৃতি হইতে মুছিয়া যায় নাই, এখনও চাকমাগণ এই বিদ্রোহ ও রামু খাঁর কাহিনী গর্বের সহিত স্মরণ করে।[12]

দ্বিতীয় বিদ্রোহ (১৭৮২)

প্রথম বিদ্রোহের পর হইতে রামু খাঁর আর কোন উল্লেখ দেখা যায় না। ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে চাকমা-দলপতি শের দৌলত খাঁর মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র জানবক্স খাঁ 'রাজা' (দলপতি) নির্বাচিত হন। "জানবক্স খাঁ জমিদার বলিয়া নিজের পরিচয় দিলেও তিনি বহুকাল পর্যন্ত স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া চলিয়াছিলেন। "[13] জানবক্স খাঁ দলপতি হইয়া চাকমা অঞ্চলে ইজারাদারগণের প্রবেশ বন্ধ করিয়া দেন। ১৭৮৩ হইতে ১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত কোঁন ইজারাদারই এই অঞ্চলে প্রবেশ করিতে বা রাজস্ব আদায় করিতে পারে নাই। সেই হেতু ইংরেজ প্রভুরা ইজারাদারগণের উপর সদয় হইয়া ১৭৮৩, ১৭৮৪ এবং ১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে তাহাদের খাজনা মকুব করিয়াছিলেন। [14]

জানবক্স খাঁর সময় ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দে চাকমাগণ আবার বিদ্রোহী হইয়াছিল। এই বিদ্রোহের কারণ স্বরূপ ক্যাপ্টেন লুইন লিখিয়াছেন:

"ইজারাদারগণ এই উপজাতির উপর ভীষণ অত্যাচার করিত। তাহার ফলে বহু চাকমা নিকটবর্তী আরাকান অঞ্চলেও পলায়ন করিয়াছিল। চাকমাগণ জানবক্স-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ  করে। কিন্তু স্থানীয় শাসকগণ পূর্বের মত অর্থনৈতিক অবরোধের দ্বারা আবার তাহাদের বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য করে। "[15]

এই বিদ্রোহের সময়েও ইংরেজ বাহিনী চাকমাদের দমন করিতে পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশ করিয়াছিল। কিন্তু জানবক্স ও সকল চাকমা গভীর পার্বত্য অঞ্চলে পলায়ন করিয়া এই অভিযান ব্যর্থ করিয়া দেয়।[16]

তৃতীয় ও চতুর্থ বিদ্রোহ (১৭৮৪-৮৭)

জানবক্স খাঁর নেতৃত্বে চাকমাগণ আবার বিদ্রোহ করে ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে। এই বিদ্রোহ দীর্ঘকাল ধরিয়া চলিয়াছিল। জানবকস অবশেষে ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দে বশ্যতা স্বীকার করেন হাচিন্সনের বিবরণে দেখা যায়, ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দেই আর একজন শের দৌলত খাঁর নেতৃত্বে চাকমাদের আর একটি বিদ্রোহ ঘটিয়াছিল। ইহাকে হাচিন্সন দ্বিতীয় শের দৌলত খাঁ নামে অভিহিত করিয়াছেন। ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয় শের দৌলত খাঁ বশ্যতা স্বীকার করেন। [17]

***

ইংরেজ শাসক, ইজারাদার ও স্থানীয় ভূম্যধিকারিগণের সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে চাকমাগণ কোন কোন সময় আপস করিলেও যতদিন পর্যন্ত এই অঞ্চলে রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারা-প্রথা বলবৎ ছিল, ততদিন, অর্থাৎ ১৭৭৬ হইতে ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত চাকমা-বিদ্রোহ চলিয়াছিল। বিদ্রোহ-কালে চাকমাগণ যে পদ্ধতিতে উন্নত অস্ত্র-সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর সহিত যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছিল, তাহা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সেই যুদ্ধ ছিল একালের গেরিলা যুদ্ধেরই অনুরূপ; ইংরেজ বাহিনী চাকমা অঞ্চলে প্রবেশ করিবামাত্র তাহারা সম্মুখ যুদ্ধে বাধা দিবার চেষ্টা না করিয়া স্ত্রীপুত্র ও অস্থাবর সম্পত্তিসহ গভীর পার্বত্য অঞ্চলে পলায়ন করিত এবং এইভাবে ইংরেজ বাহিনীকে গভীর পার্বত্য অঞ্চলে টানিয়া লইয়া যাইত। ইংরেজ সৈন্যগণ চাকমাদের গ্রাম, বাড়ীঘর, ক্ষেতের শস্য সমস্ত কিছু জ্বালাইয়া দিতে দিতে অগ্রসর হইত এইরূপে বহু দূর অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়াও যখন ইংরেজ বাহিনী বিদ্রোহীদের সন্ধান পাইত না তখন তাহারা ফিরিতে আরম্ভ করিবামাত্র বিদ্রোহীদের আক্রমণ আরম্ভ হইত। চাকমাগণ বড় বড় গাছ কাটিয়া পার্বত্য পথগুলি বন্ধ করিয়া, পর্বত-গহ্বরের মুখে ফাঁদ পাতিয়া ও পানীয় জল নই করিয়া দিয়া ইংরেজ বাহিনীকে অবরুদ্ধ করিয়া ফেলিত। তাহার পর তাহারা গোপন স্থান হইতে বিষাক্ত তীর বৃষ্টি করিয়া দলে দলে ইংরেজ সৈন্য সংহার করিত। ১৭৭৬ হইতে ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই চৌদ্দ বৎসরে কত ইংরেজ সৈন্য ও ভারতীয় সিপাহী যে বিদ্রোহী চাকমাদের বিষাক্ত তীরে প্রাণ দিয়াছে, কত সৈন্য ফাঁদ-পাতা পর্বত-গহ্বরে পড়িয়া এবং পানীয় জলের অভাবে পিপাসায় ছটফট করিয়া মরিয়াছে তাহার হিসাব নাই। ইংরেজ শাসকগণ অস্ত্রের জোরে বিদ্রোহ চাকমাদের পরাজিত করিতে সক্ষম হয় নাই। পার্বত্য অঞ্চলে খাদ্যের অভাবে এবং অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে, অর্থাৎ সমতল ভূমির হাট-বাজারে আসিয়া তুলার বদলে খাদ্য সংগ্রহ করিজে বশ্যতা স্বীকার করিতে বাধ্য  হইয়াছিল। কিন্তু এই অঞ্চল হইতে ইজারাদারের মারফত রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা যতদিন বর্তমান ছিল ততদিন স্থায়ী শাস্তি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয় নাই। ইজারা প্রথার অবসান করিয়াই ইংরেজগণ এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হইয়াছিল।

চাকমাগণ বার বার বিদ্রোহ করিবার ফলে ইংরেজ শাসকদের টনক নড়িয়া উঠে। তাহারা বুঝিতে পারে যে, তাহাদের এবং ইজারাদারদের অবাধ শোষণ ও বর্বরসুলভ উৎপীড়নই চাকমা-বিদ্রোহের কারণ, এবং যতদিন এই ইজারা প্রথার অবসান না হয় ততদিন চাকমাগণ শান্ত হইবে না। ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গীয় সরকারের প্রধান বাণিজ্যকর্তা হ্যারিস সাহেব সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান করিয়া 'রেভিনিউ বোর্ড'-এর নিকট সুপারিশ করেন যে, ইজারাদারের হস্তে নাস্ত পার্বত্য অঞ্চলের কার্পাসের একচেটিয়া বাণিজ্য-প্রথা রহিত করিয়া সরাসরি ঝুমিয়াদের বা চাকমা দলপতির সহিত বন্দোবস্ত করা উচিত। এই প্রস্তাব অনুসারে ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে ইংরেজ শাসকগণ স্থির করেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইজারা-প্রথা রহিত করা হইবে এবং কার্পাস-কর তুলিয়া দিয়া ঝুমিয়াদের বা চাকমা সর্দারগণের সহিত পরিমিত জমা (টাকা) ধার্য করা হইবে। ইহা ব্যতীত আশ্বাস দেওয়া হইল যে, এই কর নিয়মিতভাবে কালেক্টরের নিকট জমা দিলে উহা আর বৃদ্ধি করা হইবে না।”[18] কিন্তু শাসকগণ এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নাই। এই সময় আরও স্থির করা হইয়াছিল যে, চাকমাদের নিকট হইতে কর স্বরূপ তুলা আদায় করিবার নিমিত্ত সরকারের পক্ষ হইতে একজন কর্মচারী নিযুক্ত করা হইবে। এই কর্মচারীই কর বাবদ দেয় সমস্ত তুলা আদায় করিয়া পরে তাহা নিলামে বিক্রয় করিবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা করা হইত না, সমুদয় তুলা ঢাকাস্থিত কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে চালান দেওয়া হইত।[19] রামু খাঁর সময় হইতে রাজস্ব হিসাবে ৫০১ মণ তুলা ধার্য হইয়াছিল। রামু খাঁর মৃত্যুর পর ৫০১ মণ তুলার পরিবর্তে ১৮১৫ টাকা ধার্য হয়। ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে ৫০১ মণ তুলার মূল্য আরও বর্ধিত করিয়া টা. ২২২৪1৪ পাই নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হয়। পরে আপসের শর্তানুসারে চাকমা সর্দারগণই এই রাজস্ব সংগ্রহ করিয়া কালেক্টরের অফিসে জমা দিত।

 



[1] Alexander Mackenzie: History of the North-East Frontier of Bengal.c 332

[2] Chittagong Hills Tracts (District Gazetteer), p. 8

[3] পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, কুকি প্রভৃতি আদিম অধিবাসীদের বাসভূমিতে কেবল মাত্র কার্পা তুলা জন্মিত এবং তাহারা তুলা দ্বারা রাজস্ব দিত বলিয়া এই অঞ্চলটিকে বলা হইত "কার্পাস মহল"।

[4]  সতীশচন্দ্র ঘোষ: চাকমা জাতি, পৃঃ ১৩

[5] Alexander Mackenzie: History of the North-East Frontier of Bengal.p 332

[6] Ibid, p. 331.

[7] Halhed Commission of Chittagong (1829), p. 59.

[8] সতীশচন্দ্র ঘোষ: চাকমা জাতি, পৃঃ ১০।

[9] Letter from the Collector of Chittagong to the Governor-General, Dated 10th, April, 1777 (Quoted from T.H. Lewines's "The Hill Tracts of Chittagong, p. 64).

[10] Capt. T. H. Lweine: The Hill Tracts of Chittagong, p.64.

[11] Sir Henry Cotton: Revenue History of Chittagong, p. 73.

[12] Capt. T. H. Lewine: The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers therein, p. 21

[13] Sir Henry Cotton: Revenue History of Chittagong, p. 74.

[14] সতীশচন্দ্র ঘোষ: চাকমা জাতি, পৃঃ ৭৫।

[15] Sir Henry Cotton: Ibid, p. 64

[16] সতীশচন্দ্র ঘোষ: চাকমা জাতি, পৃঃ ৭৫।

[17] R.H.S. Hutchinson: An Account of the Chittagong Hill Tracts, p. 122.

[18] Sir Henry Cotton: Ibid, p. 81.

[19] A letter of the Board quoted in সতীশচন্দ্র ঘোষ প্রণীত 'চাকমা জাতি', পৃঃ ৮১

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...