বুধবার, ১০ জুলাই, ২০১৯

চাকমাদের দুঃখিনী বর্ণমালা

প্রথম প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দৈনিক সমকাল  

রাজীব নূর
চাকমা ভাষা বলতে পারলেও লিখতে পারে না এন্তি চাকমা। রাঙামাটি সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী এন্তির সঙ্গে আলাপ হলো বরকল থেকে রাঙামাটি ফেরার পথে লঞ্চে। পড়াশোনায় ভালো বলে এন্তিকে বরকল থেকে রাঙামাটি পাঠিয়েছেন তার মা-বাবা। বরকলে সম্প্রতি একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। নিজের ভাষার বর্ণমালা জানা নেই বলে একটু লজ্জিত
হলো এন্তি। কিন্তু খানিক পর পাল্টা প্রশ্নে জানতে চাইল_ চাকমা ভাষা তার জীবনে কোন প্রয়োজনে লাগবে?
ভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সংখ্যাগতভাবে বাংলাদেশে বাংলার পরেই চাকমা ভাষার অবস্থান। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যেও চাকমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, চাকমা জনগোষ্ঠী ৪ লাখ ৪৪ হাজার। বাংলা ছাড়া বাংলাদেশের অন্য ভাষাভাষীদের মধ্যে যাদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে, তাদের একটি হলো চাকমা ভাষা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, চাকমা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের একটি ভাষা। চাকমা ভাষার লেখনরীতি 'মন খমে'র অনুরূপ। ড. জিএ গ্রিয়ারসন চাকমা ভাষাকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচ্য শাখার দক্ষিণ-পূর্বী উপশাখার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ভাষাটিকে গ্রিয়ারসন 'ব্রোকেন ডাইলেক্ট অব বেঙ্গলি' বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে সৌরভ সিকদার নিজে গ্রিয়ারসনের এ বক্তব্য মানতে রাজি নন বলে জানান। তিনি বলেন, আমি গবেষণা করে দেখেছি, চাকমা ভাষা বাংলা থেকে একেবারে স্বতন্ত্র একটি ভাষা।
চাকমাদের নিজস্ব বর্ণমালার সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে বলে জানালেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক পুলক বরণ চাকমা। তিনি বলেন, ১৯০০ সালের শুরুতে ড. জিএ গ্রিয়ারসন তার 'লিঙ্গুয়েস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া' গবেষণায় চাকমা ভাষায় ৩৩টি বর্ণমালার কথা উল্লেখ করেছিলেন। সতীশ চন্দ্র ঘোষ আবার ১৯০৯ সালে প্রকাশিত তার 'চাকমা জাতি' বইয়ে ৩৭টি বর্ণমালার কথা বলেছেন। অন্যদিকে, নোয়ারাম চাকমা ১৯৫৯ সালে তার 'চাকমা বর্ণমালার পত্তম শিক্ষা' নামক শিশুপাঠ্য বইয়ে ৩৯টি বর্ণমালার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে বর্তমানে চাকমা ভাষায় ৩৩টি বর্ণমালা ব্যবহৃত হচ্ছে বলে তিনি জানান।
সরেজমিন ১৪ থেকে ২৩ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত জনপদ ঘুরে এন্তি চাকমার মতো অনেক চাকমাভাষীর দেখা মিলল, যারা নিজের ভাষার বর্ণমালাটাও জানেন না। এমনকি চাকমা সমাজের সর্বজনমান্য অনন্তবিহারী খীসা, জনসংহতি সমিতির এমএন লারমা গ্রুপের প্রধান সুধাসিন্ধু খীসা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান, জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গলকুমার চাকমা, জুম ঈস্থেটিকস কাউন্সিলের সভাপতি মিহির বরণ চাকমা, সহ-সাধারণ সম্পাদক গঙ্গামানিক চাকমা, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক তুষারশুভ্র তালুকদার, মোনঘর শিশুসদনের শিক্ষক ও লেখক মৃত্তিকা চাকমা, সাংবাদিক-লেখক হরিকিশোর চাকমা, সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, আদিবাসী বিষয়ক গবেষক তন্দ্রা চাকমা, আদিবাসী নেতা দীপায়ন খীসা, শিল্পী কালায়ন চাকমা ও ইউপিডিএফের সংগঠক রিকু চাকমাসহ শতাধিক শিক্ষিত চাকমা নর-নারীর কাছে নিজের নামটি নিজের ভাষায় লিখে দিতে বললে মাত্র দু'জন সক্ষম হলেন। এই দু'জনের একজন শিক্ষক ও লেখক মৃত্তিকা চাকমা, অন্যজন ইউপিডিএফ নেতা রিকু চাকমা।
অনন্তবিহারী, সুধাসিন্ধু ও গৌতম দেওয়ান ছোটবেলায় বর্ণমালা শিখেছিলেন বলে জানালেন। দীর্ঘ দিনের অনভ্যাসে বিদ্যানাশ হয়েছে বলে তাদের দাবি। রিকু অবশ্য সরল স্বীকারোক্তি করে বলেন, নিতান্তই কৌতূহল থেকে বর্ণমালা শিখেছিলেন। এ ভাষায় লেখালেখি করার কোনো অভিজ্ঞতা তার নেই। তবে মৃত্তিকা নিজেদের ভাষায় যথেষ্ট জ্ঞানী বলে চাকমা সমাজে পরিচিত। ইতিমধ্যে তার ১৫টি বই প্রকাশ হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে বাংলায় প্রকাশিত একটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়া সবই চাকমা ভাষায় লেখা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে উচ্চতর শিক্ষা শেষ করে তিনি রাঙামাটিতে থিতু হয়েছেন। বর্তমানে আদিবাসী শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত আবাসিক বিদ্যালয় মোনঘরে শিক্ষকতা করেন।
মৃত্তিকা চাকমা বলেন, নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে ভাষাচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। সাহিত্য করার জন্যও নিজের ভাষা অবিকল্প। তবে নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষার উপযোগিতা তৈরি করা না গেলে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন। একই সঙ্গে ভাষার লিখিত চর্চা না থাকলে ভাষার বিকাশ ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে না। আদিবাসীদের সাহিত্যচর্চা বাংলা হরফে হলেও অনেক ক্ষেত্রে উচ্চারণগত সমস্যার সমাধান বাংলা হরফে সম্ভব নয়। তাই বাংলা হরফে চাকমা সাহিত্যচর্চা করতে গেলে ভাষার মূল উচ্চারণ পরিবর্তিত হয়ে অর্থও বদলে যাওয়ার যথেষ্ট ঝুঁকি রয়ে যায়।
মোনঘরের প্রধান শিক্ষক ঝিমিত ঝিমিত চাকমা বলেন, মোনঘরে এক সময় বেশ কয়েকটি আদিবাসী ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হলেও বর্তমানে কেবল চাকমা ভাষাটাই শেখানো হয়। তার মতে, আগের প্রজন্ম নিজের বর্ণমালা না জানলেও ভাষাটা জানেন। নতুন প্রজন্ম ভাষা ও বর্ণমালা দুটিই রপ্ত করছে। কারণ এরই মধ্যে অনেক উন্নয়ন সংস্থা রাঙামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করেছে।
আদিবাসী গবেষক তন্দ্রা চাকমা বলেন, আশার আরও অনেক দিক আছে। এরই মধ্যে কম্পিউটারে চাকমা বর্ণমালার সফটওয়্যার তৈরি হয়েছে। সুগত চাকমা সত্তরের দশকের শুরুর দিকেই চাকমা বাঙলা কধাতারা নামে একটি চাকমা-বাংলা অভিধান রচনা করেছেন। ওটিই চাকমা ভাষার প্রথম অভিধান। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে আদিবাসী শিশুরা মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের অধিকার লাভ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় চাকমাসহ আদিবাসীদের পাঁচটি ভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাদানের প্রস্তুতি চলছে। তার আশা, নতুন প্রজন্ম শিখবে নিজেদের বর্ণমালা, লিখবে নিজেদের ভাষায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...