বুধবার, ২৯ মে, ২০২৪

পার্বত্য চট্টগ্রামের মেলা, বিজু ও অন্যান্য উৎসব- শরদিন্দু শেখর চাঙমা


পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ কয়েকশত বছর ধরে ১৩টি উপজাতি বসবাস করছে। এই পার্বত্য ১৩টি উপজাতি হলো চাকমা তঞ্চঙ্গা, মারমা, ত্রিপুরা, উসাই, ম্রো (মুরুং), ব্যোম, পাংখো, লুসাই, বনযোগি, খুমী, চাক এবং খ্যাং। এদের মধ্যে চাকমাদের সংখ্যা সর্বাধিক। তাদের সংখ্যা বাকি উপজাতিদের মোট সংখ্যার চেয়েও বেশি। চাকমা এবং তঞ্চঙ্গরা একই ভাষায় কথা বলে। তাদের ধর্মও একই, তাদের আচার অনুষ্ঠান সামাজিক রীতিনীতিও একই। আসলে তারা একই জনগোষ্ঠীভূক্ত এবং তঞ্চঙ্গরা হলো চাকমাদের একটি শাখা। এই কারণে কক্সবাজার জেলার তঞ্চঙ্গরা নিজেদের চাকমা বলেই পরিচয় দেয়। ১৮৭১ সালের আদম শুমারিতে তঞ্চঙ্গাদের চাকমা হিসেবেই গণনা করা হয়েছিল। একইভাবে ত্রিপুরা উসাইরা একই ভাষায় কথা বলে, তাদের আচার অনুষ্ঠানও একই। সকল গবেষক এবং ইতিহাসবিদরা বলে গেছেন, ত্রিপুরা এবং উসাইরা একই জনগোষ্ঠীভূক্ত এবং উসাইরা ত্রিপুরাদের একটি শাখা। উল্লেখ্য, ভাষাগতভাবে ত্রিপুরারা বৃহত্তর বোরো জনগোষ্ঠীর একটি অংশ। ত্রিপুরারা হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী তবে তারা মূর্তি পূজা করে না। বাকি উপজাতিদেরও নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি রয়েছে। লুসাই, ব্যোম, পাংখো এবং বনযোগি উপজাতিদের ভাষা খুবই কাছাকাছি। বর্তমানে তারা সবাই খৃষ্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী এবং ভারতে তারা সবাই মিজো নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, ত্রিপুরা, উসাই, ব্যোম, পাংখো, লুসাই এবং বনযোগিরা বাদে বাকিরা সবাই বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী

এবং বৌদ্ধ উৎসবগুলো পালন করে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদেরও নিজস্ব উৎসব এবং অন্যান্য বিনোদন অনুষ্ঠান রয়েছে। তারাও আমোদ-প্রমোদ পছন্দ করে, উপভোগ করে এবং অন্যদেরও উপভোগ করতে দেয়। কালের প্রভাবে এবং যুগের পরিবর্তনে এবং অন্যান্য কারণে তাদের উৎসব বিনোদন অনুষ্ঠান অনেক হারিয়ে গেছে, অনেক নতুন বিনোদন অনুষ্ঠান যোগ হয়েছে। নিম্নে তাদের কিছু উৎসব বিনোদন অনুষ্ঠানের বর্ণনা দেয়া হলো।

বৌদ্ধ মেলা

ব্রিটিশ আমলে এবং পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা মারমা এবং অন্যান্য বৌদ্ধ উপজাতিদের অন্যতম প্রধান উৎসব ছিল বৌদ্ধ মেলা। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব স্থানে বড় বড় বৌদ্ধ বিহার অর্থাৎ বৌদ্ধ মন্দির ছিল সেসব স্থানে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমা অর্থাৎ মাঘ মাসের পূর্ণিমা, ফাল্গুনী পূর্ণিমা অর্থাৎ ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা এবং বৈশাখী পূর্ণিমা অর্থাৎ বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি এবং বাংলা নববর্ষের সময় মন্দিরের চত্বরে মেলার আয়োজন করা হতো। তখন বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার খাগড়াছড়ি, পানছড়ি, বোয়ালখালি এবং রামগড় মহামুনি বৌদ্ধ মন্দির চত্বরে প্রতিবছর বৌদ্ধ মেলার আয়োজন করা হতো। বর্তমান রাঙ্গামাটিতে প্রতি বছর রাজপুন্যাহর সময় এবং বর্তমান নানিয়াচড় থানার বড়াদম বৌদ্ধ মন্দির চত্বরে বৌদ্ধ মেলার আয়োজন করা হতো। কোন মেলা মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে, কোন মেলা ফাল্গুনী পূর্ণিমা অথবা বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বসতো। পূর্ণিমা তিথিতে প্রতি বছর একই তিথিতে একই স্থানে বসতো। এসব মেলা কমপক্ষে স্থান ভেদে / দিন হতে ১৫/১৬ দিন, এমনকি আরো দীর্ঘদিনের জন্য বসতো। রামগড় মহামুনি বৌদ্ধ মেলার আয়োজন করা হতো চৈত্র সংক্রান্তির সময় এবং মেলা বসতো প্রায় একমাসব্যাপী। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের সময় মানিকছড়ির মং রাজার মহামুনি মন্দির প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী মেলা বসতো। বিভিন্ন জায়গায় বৌদ্ধ মেলা উপলক্ষে চট্টগ্রাম জেলার অনেক ব্যবসায়ী এবং দোকানিরা তাদের মালামাল নিয়ে মেলায় আসতেন এবং পাহাড়িরাও তাদের কৃষিজাত দ্রব্যাদি এবং কুটির শিল্পের মালামাল মেলায় নিয়ে যেতো। মেলার আয়োজকরা চট্টগ্রাম জেলা হতে পূর্ব হতেই যোগাযোগ করে যাত্রাপার্টি নিয়ে আসতেন। তাই মেলা দেখতে, যাত্রা অনুষ্ঠান উপভোগ করতে, ধর্মকর্ম করতে এবং অনেকেই তাদের প্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয় করতে মেলায় যেতো।

ছেলেমেয়েরা কেহ মা-বাবার সঙ্গে, কেহ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে, যুবক- যুবতীরা দলবেঁধে অথবা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মেলায় যেতো। মেলার কাছাকাছি গ্রামগুলোর কয়েকজন বুড়াবুড়ি নামকাওয়াস্তে গ্রাম পাহারায় থাকতো। বাকিরা সবাই মেলায় যেতো। সন্ধ্যার সময় খাওয়া-দাওয়া সেড়ে মেলায় যেতো, মেলায় ঘুরে বেড়াতো। অনেকেই মন্দিরের চারদিকে নেচে বেড়াতো, পূজা অর্চনা করতো, রাতে যাত্রা অনুষ্ঠান দেখে সকালে বাড়িতে ফেরত হতো। অনেকেই প্রয়োজনীয়

দ্রব্যাদি ক্রয় করে নিয়ে আসতো। দূরবর্তী অঞ্চলের লোকেরা আগেভাগে মন্দিরের  নিকটবর্তী গ্রামগুলোর আত্নীয়-স্বজন, পরিচিতজন, অনেক সময় অপরিচিত জনের অনুষ্ঠান দেখে, ধর্মকর্ম করে এবং পরিশেষে প্রয়োজনীয় মালামালাদি ক্রয় করে নিজ নিজ বাড়িতে চলে যেতো। এভাবে মেলায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ, যুবক- যুবতীর সমাগম হতো। অনেকেই তাদের বাচ্চা-কাচ্চাদেরও সঙ্গে নিতো। এভাবে মেলাটি কেবল উৎসবমুখর হতো না, এলাকাটিও উৎসবমুখর হতো। মেলার আয়োজকরা মেলায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নিজেরা ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করতেন। তাছাড়া এলাকার থানা-পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মেলায় যেতেন এবং সাময়িক সময়ের জন্য মেলায় ক্যাম্প স্থাপন করতেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মেলার ওপর প্রথম আঘাত আসে পাকিস্তান হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে ফাল্গুনী পূর্ণিমার সময় খাগড়াছড়ি বৌদ্ধ মেলায়। তখন খাগড়াছড়ি ছিল কেবল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। গ্রামের পাশে চেঙ্গী উপনদী, যেটি পুরাতন রাঙ্গামাটি শহরের কাছে কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে। এই চেঙ্গী উপনদীর পাড়ে খাগড়াছড়ি বাজার। বাজারের সন্নিকটে খাগড়াছড়ি বৌদ্ধ মন্দির। ব্রিটিশ আমল হতেই এই বৌদ্ধ মন্দিরের চত্বরে প্রতিবছর ফাল্গুনী পূর্ণিমার সময় বৌদ্ধ মেলার আয়োজন করা হতো। মেলা চলতো ১৫/১৬ দিনব্যাপী। উল্লেখ্য, তখন খাগড়াছড়িতে থানা এমনকি পুলিশ বিটও ছিল না। থানা ছিল মহালছড়িতে। ১৯৪৮ সালের বৌদ্ধ মেলার সময় মহালছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরুল হুদার নেতৃত্বে একদল পুলিশ মেলায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মেলায় একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। মেলার প্রথম অথবা দ্বিতীয় দিনের রাতে যাত্রা অনুষ্ঠানের সময় হঠাৎ করে বন্দুকের গুলির আওয়াজ। গুলিতে কেহ মারা যায় নি, তবে ২/৩ জন আহত হয়। কে বা কারা গুলি করেছে কেহ বলতে পারে না। তবে সবার সন্দেহ দারোগা নূরুল হুদার দিকে। কারণ ঘটনার পরদিন খাগড়াছড়ি বাজার হতে ৩ মাইল দূরে কমলছড়ি গ্রামের দুই সচ্ছল পরিবারের শুক্রমণি চাকমা এবং ভুয়াছড়ি মৌজার হেডম্যানের ছেলে চিকন চান্দ কারবারীকে আটক করা হয়। গ্রামের সবাই জানে ওইদিন রাতে শুক্রমণি এবং চিকন চান্দ কারবারী মেলায় যায়নি। উভয়েই গৃহী মানুষ, সচ্ছল এবং এলাকার খুবই সম্মানিত ব্যক্তি। তাদের নিকট হতে অর্থ আদায় এবং লোকজনকে ভয় দেখানোর জন্য পুলিশ ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে লোকের সন্দেহ।

যাত্রা অনুষ্ঠানে গুলি বর্ষণ হওয়াতে ওই রাতেই যাত্রা অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তার পরদিন মেলাও ভেঙে যায়। তবুও পরবর্তী বছর আয়োজকরা আবার মেলার আয়োজন করেন। তবে আগের তুলনায়, মেলায় লোক সমাগম কম হয়। অনেকেই ওয়ে মেলায় যায়নি, অনেকেই ছেলেমেয়েদের মেলায় যেতে দেয়নি। তবে জেলার I যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মেলাগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত আসে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হলে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হলে রাঙ্গামাটি শহরের চাকমা রাজার গৌতম মুনির বৌদ্ধ মন্দির ও বর্তমান নানিয়াচড় থানার অধীন বড়াদম বৌদ্ধ মন্দির কাপ্তাই হৃদের পানিতে ডুবে যায়। উল্লেখ্য, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের তখনকার মোট জনসংখ্যার প্রায় উদ্বাস্তু হয়ে

যায়। সেটার কারণে অন্যান্য স্থানের বৌদ্ধ মেলাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময়ে প্রায় ৪০ হাজার চাকমা ভারতে চলে যায়। আইন- শৃঙ্খলার পরিস্থিতিও ক্রমশ অবনতি হতে থাকে এবং মেলায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে কোনটা ১৯৬৯, কোনটা ১৯৭০ বা ১৯৭১ সালে বৌদ্ধমেলাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তবে ২০০৫ সালের জুলাই মাসে আমি যখন খাগড়াছড়িতে যাই তখন খাগড়াছড়ি বাজারের বৌদ্ধ মন্দিরে যাই। তখন কয়েকজন দায়ক আমাকে বলেন, বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৭২ সালে খাগড়াছড়িতে শেষ বৌদ্ধ মেলাটি হয়েছিল। সে বছর মেলায় আইন-শৃঙ্খলা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...