সোমবার, ২৭ মে, ২০২৪

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক ইতিহাস হত্যার একটি কাহিনী - শরদিন্দু শেখর চাকমা

বাংলা পিডিয়ায় 'শরণার্থী' শিরোনামে নবম খণ্ডের ২৫৯ পৃষ্ঠা হতে ২৬২ পৃষ্ঠায় বাংলা একটি বিরাট প্রবন্ধ ছাপানো হয়। প্রবন্ধটিতে প্রথমে শরণার্থীর অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়, নির্যাতনের শিকার হয়ে বা বিপজ্জনক রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সামরিক সংঘাতজনিত পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে স্বীয় ভূমি বা দেশত্যাগ করে অন্য কোন জায়গায় বা দেশে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় প্রার্থী বা প্রার্থীরাই হলো শরণার্থী। এরপর বলা হয়, ২০০০ সালের শেষার্ধে এশিয়ায় শরণার্থীর প্রাক্কলিত মোট সংখ্যা ছিল ৭৩,০৮, ৮৬০ জন। তন্মধ্যে বাংলাদেশে আসে ২১,৬২৭ জন, তাদের মধ্যে ২১,৫৫৬ জন হলো মায়ানমারের রোহিঙ্গা। আরো বলা হয়, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ থেকে .২৫ মিলিয়ন হিন্দু ভারতে অভিবাসিত হয়, পরিবর্তে পশ্চিম বঙ্গ এবং বিহার হতে পূর্ব বাংলায় আসে .৭০ মিলিয়ন মুসলমান। উল্লেখ্য, পঞ্চাশের দশকের দাঙ্গায় হিন্দুদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল পর্যন্ত ভারতে হিজরত করেন। এরপর নিবন্ধটিতে বলা হয়, বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের নৃশংসতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ১০ মিলিয়ন শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নেয়। এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের প্রায় সবাই দেশে ফেরত আসে। এরপর বলা হয়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় হতে যেসব উর্দুভাষী মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে ছিল তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জনরোষের শিকার হয়। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান সরকার উর্দুভাষীদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি মেনে নিলেও তাদের মধ্যে প্রথম দফায় ,৭০,০০০ এর কিছু বেশি পাকিস্তানে যেতে সক্ষম হয়। পাকিস্তান সরকার বাকিদের  সেদেশে নিতে অস্বীকার করে যদিও পরবর্তীকালে ১৯৭৭ থেকে১৯৭৯ সময়ের মধ্যে আরো ৪৮০০ জন এবং সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে আরো ৫৩টি পরিবার পাকিস্তানে যেতে সক্ষম হয়।

নিবন্ধটিতে ১৯৫৮ সালে জেনারেল আয়ুব খান পাকিস্তানে ক্ষমতা দখলের পর হিন্দুরা এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুরা যে ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয় সে বিষয়ে একটি বাক্যও বলা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চৌধুরী আর আবরার কর্তৃক সম্পাদিত গবেষণামূলক গ্রন্থ 'On the margin, Refugees Migrants and Minorities' তে বলা হয়েছে, কেবল ১৯৬৪-১৯৯১ সালের মধ্যে অনুমান করা হয় যে, ৫.৩ মিলিয়ন হিন্দু দেশত্যাগী হয়েছে। উল্লেখ্য, আইউবখান ক্ষমতা গ্রহণের পর পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র হিন্দু সি.এস.পি অজিত কুমার দত্ত চৌধুরী এবং পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের একমাত্র হিন্দু বিচারপতি নির্মল চন্দ্র নন্দী পর্যন্ত ভারতে হিজরত করেন। আর কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, কাপ্তাই বাঁধে উদ্বাস্তু হয়ে ক্ষতিপূরণ অথবা পুনর্বাসিত হতে না পেরে ৪০ হাজারের অধিক উপজাতি ভারতে চলে যায়। ভারতের লোকসভার এক সময়ের স্পিকার পি.এ সাংমাও ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার ফলে জন্মস্থান বর্তমান বৃহত্তর ময়মনসিংহ হতে ভারতে চলে যান। নিবন্ধটিতে এসব কিছু বলা হয়নি; কিন্তু বলা হয়, বার্মা অর্থাৎ বর্তমান মায়ানমার সরকারের অত্যাচারের কারণে ১৯৭৮ সালে ২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান শরণার্থী বাংলাদেশে চলে আসে। তবে ১৯৭৯ সালের শেষ পর্যন্ত ১,৮০,০০০ এর বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান দেশে ফেরত যায়। এরপর নিবন্ধটিতে আরো বলা হয়, ১৯৯১- ৯২ সালে মায়ানমার থেকে ২,৫০,০০০ রোহিঙ্গা মুসলমান শরণার্থী বাংলাদেশে চলে আসে। তাদের মধ্যে ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী দেশে ফেরত যায়। বাংলাদেশে এখনও ২২ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে রয়েছে বলে নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে। কিন্তু বলা হয় নাই বাংলাদেশ হতে রাখাইনদের মায়ানমারে বিতাড়নের বিষয়টি। উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে বর্তমান বৃহত্তর চট্টগ্রামে রাখাইনদের সংখ্যা ছিল ৭০ হাজারের অধিক। এখন সেখানে তাদের সংখ্যা ১০ হাজারের মতো আর ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় বর্তমান পটুয়াখালী এবং বরগুনা জেলায় রাখাইনদের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারেরও অধিক। এখন এই দুই জেলায় রাখাইনদের সংখ্যা মাত্র ৩৫০০। নানাভাবে অত্যাচারিত হয়ে রাখাইনরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। এবং তাদের প্রায় সবাই চলে গেছে বার্মায়।

কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছিল এবং যার কারণে হাজার হাজার উপজাতি শরণার্থী বারবার ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিল এবং যার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হওয়ার পূর্বে অনেক বছর ধরে আই.এল.ও'সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছিল, সেই বিষয়টি এশিয়াটিক সোসাইটি একেবারে চেপে গেছে। সেই বিষয়ে একটি বাক্য কেন, একটি শব্দও উচ্চারণ করা হয়নি। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু বাঙালি দুষ্কৃতকারী প্রয়াত বোমাং রাজার পুত্র এবং বান্দরবান ইউনিয়ন কাউন্সিলের তৎকালীন চেয়ারম্যান এম. এস প্রুর মাথা ন্যাড়া করে দেয় এবং তার গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিয়ে সারা বান্দরবান শহরে ঘুরানো হয়। এরপর ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি বান্দরবান শহরে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় পার্শ্ববর্তী সাতকানিয়া কলেজের এক ছাত্র নেতা বোমাং রাজা এবং মারমা সম্প্রদায়কে গালাগালি করে বলতে থাকে, 'বাঁচতে যদি চাও, বাঙালি হও, নইলে বার্মায় চলে যাও।' এছাড়া মারমা সম্প্রদায়ের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে অপমান করা হয়। ফলে সারা বান্দরবান মহাকুমায় পাহাড়িদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় ২০ হাজার মার্মা সম্প্রদায়ের লোক বার্মায় পালিয়ে যায়। পরবর্তী পরিস্থিতি শান্ত হলে তাদের কিছু অংশ দেশে ফেরত আসে, বাকিরা সেখানে থেকে যায়।

এরপর জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করার জন্য ৪ লাখ বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের জন্য নিয়ে আসেন। এরপর শুরু হয় ব্যাপকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যা, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, পাহাড়ি গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়া, লুটপাট ইত্যাদি অন্যান্য লোমহর্ষক কাণ্ড কারখানা। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম গণহত্যা ঘটে ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ এবং এর পরবর্তী ক'দিন রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার কাউখালী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে। ওই ঘটনায় ৩শ' জন উপজাতি নিহত হয়। ২০টি উপজাতি গ্রাম লুট এবং জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হয়, ৯টি বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং ৩০ জন মেয়েকে অপহরণ করে ধর্ষণ করা হয়। এভাবে পাহাড়িরা নিজ ভিটা হতে উৎখাত হয়ে গেলে বাঙালিরা তাদের বাড়িঘর-জায়গাজমি দখল করে নেয়। আর উপজাতিরা হয় শরণার্থী। এরপর ১৯৮১ সালের ২৬, ২৭ এবং ২৮ জুন তারিখে বর্তমান মাটিরাঙ্গা এবং রামগড় থানার ১১ মাইলব্যাপী কাতুন কারবারী পাড়া, যোগেন্দ্র হেডম্যানপাড়া, ধনুছড়া গ্রাম, ব্রজেন কুমার পাড়া, গোমতি, বাদলছড়া,

চংরাকাবা, বোলছড়ি, অযোধ্যা, গোমতি, বাদলছড়া, খেদাছড়া এবং আশপাশের আরো গ্রামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীএবং শরণার্থী বাঙালিরা আক্রমণ চালায়, অগ্নিসংযোগ করে এবং সামনে যাকে পায় তাকে হত্যা করে। এতে আনুমানিক ৩০০ জন পাহাড়ি নিহত হয়, ২০৯ জন আহত এবং ৫০০৭টি বাড়িঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। প্রায় ২০ হাজার উপজাতি পাশের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয়গ্রহণ করে। পরে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর শরণার্থীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু অনেক শরণার্থী পাহাড়ি তাদের বাড়িঘর জায়গাজমি ফেরত পায়নি। তারা এখন মাতৃভূমিতে শরণার্থী। এরপর গণহত্যা ঘটে ১৯৮৪ সালের ৩১ মে হতে ৭ জুন পর্যন্ত রাঙ্গামাটি জেলার ভূষণছড়া ইউনিয়ন এবং ছোট হরিনা ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে। ওই ঘটনায় ৬২ জন উপজাতি নিহত, ১৩ জন আহত এবং ৭ জন মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়। হাজার হাজার উপজাতি বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায়। তাছাড়া ৪৫৩০ জন উপজাতি পার্শ্ববর্তী ভারতে মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু কয়েকমাস পরে মিজোরাম সরকার তাদের জোর করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এরকম গণহত্যা আরো ঘটে ১৯৮৬ সালের ১ মে তারিখে পানছড়ি এবং মাটিরাঙ্গা এলাকায় ১৮ মে তারিখে রামবাবুডেবা গ্রামে, ১৬ ডিসেম্বর চংড়াছড়ি এবং মেরুং মৌজায়। এরপর ১৯৮৮ সালের ৮-১০ আগস্ট তারিখে হিরাচর, সারবোতুলি, খাগড়াছড়ি ও পাবলাখালি মৌজায়। এরপর গণহত্যা ঘটে ১৯৮৯ সালের ৪ মে তারিখে লংগদুতে এবং ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে লোগাং গুচ্ছ গ্রামে এবং ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর তারিখে নানিয়াড় বাজারে। এসব গণহত্যায় শত শত উপজাতি নিহত, আহত হয়, হাজার হাজার উপজাতি বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায় এবং হাজার হাজার উপজাতি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নেয়। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক হত্যা, গণহত্যা এবং মানবাধিকার লংঘনের ফলে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে এবং জেনারেল এরশাদ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শেষ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের তথাকথিত একশ্রেণীর নেতার সঙ্গে চুক্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জেলায় ৩টি জেলা কাউন্সিল গঠন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা হয়েছে বলে বহির্বিশ্বে প্রচার চালাতে থাকেন। এরপর জেনারেল এরশাদ তার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা বিনয় কুমার দেওয়ানকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থিত ৭০ হাজারের অধিক উপজাতি শরণার্থীকে ভারত হতে দেশে ফেরত আনার জন্য তাকে ভারতে যেতে চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু বিনয় দেওয়ান ভারতে যেতে অস্বীকার করেন এবং দাবি করতে থাকেন যে, প্রথমে পার্বত্য চট্টগ্রামেরঅভ্যন্তরে যে ৫০ হাজারের অধিক শরণার্থী রয়েছে তাদের নিজ নিজ ভূমিতে পুনর্বাসন করা হোক। এরপর মন্ত্রী বিনয় দেওয়ানকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলা হয় এবং বিনয় দেওয়ান পদত্যাগ করে রাঙ্গামাটিতে চলে যান। এরপর বাংলাদেশ সরকার ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ফারুক চৌধুরীর নেতৃত্বে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান এবং রাজা দেবাশীষ রায়সহ আরো কয়েকজন উপজাতি নেতাকে পাহাড়ি শরণার্থীদের দেশে ফেরত আনার জন্য ভারতে পাঠায়। কিন্তু শরণার্থীরা দেশে ফেরত আসতে অস্বীকার করে।

জেনারেল এরশাদের পতনের পর যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে জিতে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন। তার সময়ে সরকার ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের কিছু দাবি পূরণ করতে রাজি হওয়ায় দুই কিস্তিতে ৫১৮৬ শরণার্থী ভারত হতে দেশে ফেরত আসে। কিন্তু সরকার শরণার্থীদের নিকট দেয়া সকল দাবি বাস্তবায়ন না করায় বাকি শরণার্থীরা দেশে ফেরত আসতে অস্বীকার করে। ১৯৯৪ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখে প্রত্যাগত উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কমিটি ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করে যে খালেদা জিয়া সরকার যেসব দাবি পূরণ করবে বলে ওয়াদা করেছিল সেসব দাবির অনেকগুলো বাস্তবায়ন করেনি।

১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার জয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। এরপর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং উপজাতিদের রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা হয়। ফলে দশ বছরের অধিককাল ধরে ভারতে শরণার্থী হিসেবে থাকার পর প্রায় ৭০ হাজার উপজাতি শরণার্থী দেশে ফেরত আসে। কিন্তু দেশে ফেরত আসার পর তাদের মধ্যে ৩০৩৫টি পরিবার এখনও তাদের পূর্ব পুরুষের ভিটে মাটিতে ফেরত যেতে পারেনি। কারণ তারা তাদের জায়গাজমি, ভিটে মাটি ফেরত পায়নি। কারণ সেগুলো বাঙালিরা জোর করে দখল করে রেখেছে। তাছাড়া ৫০ হাজারের অধিক অভ্যন্তরীণ উপজাতি শরণার্থী ও তাদের ভিটেমাটি ফেরত পায়নি। তারা এখনও শরণার্থী।

এভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার উপজাতি ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি শরণার্থী বিষয়টি এখনও দেশে বিদেশে মাঝে মাধ্যে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে আলোচনার বিষয় হয়ে থাকে। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি শরণার্থীরা বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি ঢাকায় সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামের শরণার্থী বিষয়টি আমাদের দেশে পাগল, নির্বোধ এবং শিশু ছাড়া অন্য সকলের কাছে অবহিত আছে। কিন্তু বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি তাদের 'শরণার্থী শীর্ষক নিবন্ধে বিষয়টি সম্পর্কে একটি বাক্য লেখেনি, সম্পূর্ণভাবে উহ্য রেখেছে এবং সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। এটাতো কেবল ইচ্ছাকৃত ইতিহাস বিকৃতি নয়, এটা ইচ্ছাকৃত ইতিহাস হত্যা এবং এরকম ইতিহাস বিকৃতি কেবল বাংলাদেশ এশিয়াটিক দ্বারা সম্ভব বলে মনে হয়। ইচ্ছাকৃত ইতিহাস বিকৃতির জন্য আমি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির কাছে, দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থী হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

দৈনিক ভোরের কাগজ - ২ এপ্রিল ২০০৫

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...