রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৯

জুম্ম জাতির দুগর মাচ: মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জাতীয় সংসদের বক্তব্য -৩

 খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনা করতে গিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ১৯৭২, ২৫ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে বলেন:
মাননী স্পীকার সাহেব, ১৯৪৭ সালে কেউ কি চিন্তা করেছিলেন যে, পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে? জনাব মোঃ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, ÒPakistan has come to stay” নিয়তি অদৃষ্ট থেকে সেদিন নিশ্চয় উপহাস ভরে হেসেছিলেন। সেই পাকিস্তান অধিকার হারা বঞ্চিত মানুষের বুকের জ্বালায়, উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। আমি আমার অভিব্যাক্তি প্রকাশ করছি। আমি একজন নির্যাতিত অধিকার হারা মানুষ। পাকিস্তানের সময় দীর্ঘ ২৪ বছর পর্যন্ত একটি কথাও বলতে পারিনি। আমাদের অধিকারকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া হয়েছিল। সেই অধিকার আমরা পেতে চাই এই চাওয়া অন্যায় নয়। সেই অধিকার এই সংবিধানের মাধ্যমে দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মত যাতে সেই অধিকার আমরাও পেতে পারি, সেই কথাই আজকে আপনার মাদ্যমে পরিষদের নিকট নিবেদন করতে চাচ্ছি। সেই অধিকারের কথাই আমি বলতে চাচ্ছি। মানুষের মত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের হয়নি- যেমন দেওয়া হয়নি বায়লাদেশের লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত মানুষকে।
তাই আমি আমার কথা যদি আপনার মাদ্যমে মাননীয় সদস্য - সদস্যাদের ভাই-বোনদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে পারি, তাহলে আমি মনে করব, আমার অভিব্যাক্তি সার্থক হয়েছে। কারণ, আমার যে দাবী সেই দাবী আজকে নয়। এই দাবী করেছি স্বৈরাচারি আয়ূব ও স্বৈরাচারী ইয়াহিয়ার সময়ও। আমরা রাজনৈতিক দিক দিয়ে পেছনে পড়ে রয়েছি। অগ্রসর জাতির মত শক্তিশালী দল গঠণ করে দাবী আদায় করতে পারছি না। কারণ এতে যতটা রাজনৈতিক সচেনতার দরকার, ততটা রাজনৈতিক সচেনতার অভাব রয়েছে আদিবাসীদের মধ্যে, আমাদের মধ্যে।
মাননী স্পীকার সাহেব, আজকে তাই কথা প্রসঙ্গে এই কথা বলতে চাচ্ছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বদৌলতেই আজকে বৈদ্যুতিকবাতি জ¦লছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জল বিদ্যুতের বদৌলতে কলখানা চলছে। অথচ সেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে শোষণ করা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে, যারা দেশকে গড়েছে, পাকিস্তানের শাসকরা তাদের মানুষের মতো বাঁচার অধিকার দেয়নি। আমার বক্তব্য হল, আজকে আমরা এই সংবিধানে কিচুই পাইনি। আমি আমার বক্তব্য হয়তো সঠিকভাবে বলতে পারছি না, কিন্তু আমার বক্তব্যের মধ্যে কোন অপ্রাসাঙ্গিক কিছুই নাই।
আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিয়ে আমাদের জাতির পিতা শ্রদ্ধেয় বঙ্গবন্ধুর কাছে যুক্তি স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। এই স্মারকলিপিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনের কথা বলেছিলাম, আমাদের আদিবাসীদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্ব-শাসনের কথা বলেছিলাম।
এই সংবিধানে আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমরা বঞ্চিত মানব। আমাদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। এই সংবিধানের বাইরে কথা আমি বলতে চাচ্ছি না। আমার পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা সংবিধানে বলা হয়নি। এই জন্য এই কথা বলছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম একটা ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়েছে। আমি জানিনা, আমাদের কথা তারা কেমন করে ভুলে গেলেন? আমরাও যে বাংলাদেশের সংগে এক হয়ে গণবাংলার সংগে জড়িয়ে থাকতে চাই, সে কথা তারা কি ভুলে গেছেন?
আমাদের এই সংবিধানের খসড়া তৈরী করার সময় তারা অন্যান্য দেশের সংবিধান দেখেছে। তাঁরা দেখেছেন বাংলাদেশের ইতিহাস। তাঁরা দেখেছেন বাংলাদেশের এক কোণায় রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু কিসের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসকে এখানে স্থান দেওয়া হয়নি?
আমরা জানি, ইতিহাসকে বিকৃত করা যায় না। কিন্তু আমরা কি দোষ করেছি? কেন আমরা অভিশপ্ত জীবন যাপন করবো? পাকিস্তানের সময়ে ছিল আমাদের অভিশপ্ত জীবন। আজকে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র হতে চলেছে। আমাদের অধিকার তুলে ধরতে হবে এই সংবিধানে। কিন্তু তুলে ধরা হয়নি। যদি আমাদের কথা ভুলে যেতে চান, যদি ইতিহাসের কথা ভুলে যেতে চান, তাহলে তা আপনারা পারেন। কিন্তু আমি পারি না। আদিবাসীরা কি চায়? তারা চায় স্বাধীন অধিবেশনে তাদের সত্যিকারের নিশ্চয়তা।
মাননীয় ডেপুটি স্পীকার সাহেব, তাই আজকে বঞ্চিত মানুষের মনের কথা আমি আপনার মাধ্যমে তুলে ধরতে চাই। সেই বঞ্চিত মানুষের একজন হয়ে আমি বলতে চাচ্ছি, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের যারা নির্যাতিত সেই বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে, সেই পাকিস্তান আমলের যে নির্যাতিন ভোগ করেছি সেই নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে চাই। আমরা চাই মানুষের মত মানুষ হয়ে বেঁেচ থাকতে।
এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি আমাদেরকে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। এই খসড়া সংবিধানে আমাদের অবহেলিত অঞ্চলের কোন কথা নাই। তাই আজকে আমি বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কাছে কি অপরাধ করেছে, তা আমি জানি না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম হল বিভিন্ন জাতিস্বত্ত¡ার ইতিহাস। কেমন করে সেই ইতিহাস আমাদের সংবিধানের পাতায় স্থান পেলনা, তা আমি ভাবতে পারি না। সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে, পিছিয়ে পড়া নির্যাতিত জাতিকে, অগ্রসর জাতির সংগে সমান তালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথ নির্দেশ  করবে। কিন্তু বস্তুতঃ পক্ষে এই পেশকৃত সংবিধানে আমরা সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না। ...... .......
পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা ইতিহাস আছে এবং সেই ইতিহাসকে কেন এই সংবিধানে সংযোজিত করা হল না? যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার স্বীকৃত না হয়, তাহলে এই সংবিধান তাদের কি কাজে লাগবে। আমি একজন মানুষ যেখানে জন্মগ্রহণ করেছি, যে জন্মভূমিতে আজন্ম লালিত পালিত হয়েছি, সেই জন্মভূমির জন্য আমার যে কথা বলার রয়েছে, সে কথা যদি প্রকাশ করতে না পারি, যদি এই সংবিধানে তার কোন ব্যবস্থাই দেখতে পাই না, তাহলে আমাকে বলতে হবে যে, বঞ্চিত মানুষের জন্য সংবিধানে কিছুই রাখা হয়নি। বঞ্চিত মানুষের সংবিধান এাঁ কিছুতেই হবে না এবং মানুষ এটাকে গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করবে।
তাই আমার কথা শেষ করার আগে আমার কথাগুলি সংক্ষিপ্ত আকারে বলতে চাই, এই সংবিধানে মানুষের মনের কথা লেখা হয়নি। কৃষক, শ্রমিক, মেথর, কামার, কুমার, মাঝিমাল্লার জন্য কোন অধিকার রাখা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণের অধিকারের কথাও সংবিধানে লেখা হয়নি।

*জুম্ম সংবাদ বুলেটিন (১০ই নভেম্বর ৮৩ স্মরণে বিশেষ সংখ্যা) বুলেটিন নং- ২৩, ৫ম বর্ষ, ১০ই নভেম্বর ৯৫, শুক্রবার  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...