রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৯

জুম্ম জাতির দুগর মাচ: মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বক্তব্য -২

খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনা করতে গিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ১৯৭২, ২৫ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে বলেন:
মাননীয় স্পীকার সাহেব, আজকে যে পবিত্র দলিল আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছি, সেটা যেন ১৯৫৬ সালের এবং ১৯৬২ সালের দলিলের মত না হয় এবং সেদিনের মতো করুণ অবস্থা যেন আমাদের জীবদ্দশায় দেখে যেতে না হয়।
মাননীয় স্পীকার সাহেব, আজকে মানুষের মনে যে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে, আমরা যদি সেই সন্দেহের অবসারন না করি, পরিষদে আমরা যদি তার নিরসন না করি, তাহলে আর কে করবে? আমাদের পর যাঁরা আসবেন , তাদের সেই একই করুণ অবস্থা হবে- যেমন হয়েছে পূর্ববর্তীদের। সেই করুণ কাহিনীর পুনরাবৃতিত্ত ঘটুক, আমরা তা চাই না। ......
সংবিধানে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মনের কথা যদি সত্যিকারভাবে  লিপিবদ্ধ হত, তাহলে আজকে নিদর্লীয় সদস্য হিসাবে এই সংবিধানকে অভিননন্দন জ্ঞাপন করতে করতে পারতাম। আভিনন্দন জ্ঞাপন করতে না পারার অনেক কারণের মধ্যে এক কারণ হল, এখানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি।
মাননীয় স্পীকার, এই দলিলের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ থেকে প্রমাণ পাওয়া যাবে যে, এক হাতে অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং অন্য হাতে সেটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মাননীয় স্পীকার সাহেব, সংবিধানের ১০ নং অনুচ্ছেদ এবং ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:
১০। মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়নুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেম্যে সমাজতান্ত্রিক অর্তনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।
এবং
২০। কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয় এবং প্রত্যেক নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।
মাননীয় স্পীকার, আজকে এখানে বলতে বাদ্য হচ্ছি, একদিকে হিংসাদ্বেষ বিহীন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতি¤্রুতি দেওয়া হয়েছে আর অন্যদিকে উৎপাদন যন্ত্র ও উৎপাদন ব্যবস্থাসমূহের মালিকানা, রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ূ মালিকানা ও ব্যক্তিগত মালিকানা অইনের দ্বারা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যের আবব্দ করে শোষণেরপথ প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছে। আমরা এমন একটা ক্ষমতা দেখতে পাচ্ছি, যে ক্ষমতা বলে সরকার একটা লোককে এক পয়সার অধিকারী হতে দেবেন এবং অন্য একটা লোকের জন্য এক কোটি টাকার মালিকানার অধিকার রেখে দেবেন।
মাননী স্পীকার সাহেব, তাই এই  দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা, প্রাণের কথা এখানে প্রতিফলন হয়নি বলে আমি মনে করি। কৃষকের কথা প্রতিফলিত হয়নি, রিক্সাওয়ালার কথা প্রতিফলিত হয়নি,  মেথরের কথা প্রতিফলিত হয়নি। আজ এদর সবার জীবন, মেথরের জীবন, খেটে খাওয়া মানুষের জীবন অভিশপ্ত। তাদের কথা, তাদের দাবী এখানে স্থান পায়নি। এই যে অভিশপ্ত জীবন তাদের কথা সংবিধানে নাই।
তারা যদি আজ জিজ্ঞেসা করে, “তোমরা দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছ- তোমরা তাতে আমাদের কথা কি কিচু লিখেছ?” এই প্রশ্নের আমরা কি উত্তর দেব? যে মেথররা দেশকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে, আজ আমরা শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে তাদেরকে কি আশ্বাসের বাণী শোনাচ্ছি? তাদের অভিশপ্ত জীবনকে সুখী করে তোলার মতো কতটুকু আমরা দিয়েছি, এই সংবিধানে কি প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছি? কিছুই না।
আমাকে আজ বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের যারা সত্যিকারের শোষিত, নিপীড়িত, তাদের কথা এই সংবিধানে নাই। হ্যাঁ, তাঁদের কথা এই সংবিধানে আছে, যারা শোষিত নয়, নির্যাতিত নয়, নিপীড়িত নয়। মাননীয় স্পীকার, তাই আজকে এখানে দাঁিড়য়ে বলতে হচ্ছে, প্রশ্ন করতে হচ্ছে যে, এটা কাদের সংবিধান? যদি জনগণের সংবিধান না হয়, তাহলে আমরা দেশকে কেমন করে গড়ে তুলব, দেশের মানুষকে কেমন করে ভবিষ্যৎ সুখী জীবনের নির্ভরতা দান করব?
এরপর, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্ত¡ার কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতি সত্ত¡ার অস্তিত্বে কথা আমি খুলে বলছি। বিভিন্ন জাতিসত্ত¡ার কথা যে এখানে স্বীকৃত হয়নি, সে কথা আমি না বলে পারছি না। আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী। আমি  সেখানকার আদিবাসীর এলাকার লোক। সেখানকার কোন কথাই এই সংবিধানে নাই। যুগে যুগে বৃটিশ শাসন থেকে আরম্ভ করে সবসময় এই এলাকা স্বীকৃত হয়েছিল, অথচ আজকে এই সংবিধানে সেই কথা নাই। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি কিভাবে ভুলে গেলেন আমার দেশের কথা-পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা। এটা আমার কাছে বিস্ময়। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি আদিবাসীর এলাকা। এই এলাকার সেই সব ইতিহাসের কথা, আইনে কথা এই সংবিধানে কোথাও কিছু নাই।
মাননীয় স্পীকার সাহেব, এই মহান পরিষদে দাঁড়িয়ে আজকে আমি আপনার মাধ্যমে একজন সরল মানুষের অভিব্যাক্তি প্রকাশ করছি। আমাদের এলাকাটা একটা আদিবাসী এলাকা। এখানে বিভিন্ন জাতি বাম করে। এখানে চাঙমা, মগ, ত্রিপুরা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমি, মুরুং এবং চাক এইরূপ ছোট ছোট এগারটি আদিবাসী বাস করে। এই মানুষের কথা আমি বলতে চাই।
এই আদিবাসী মানুষের কথা বৃটিশ পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েছিল। পাকিস্তানের মত স্বৈরাচারী গভর্ণমেন্ট আমাদের অধিকার ১৯৫৬ সালের এবং ১৯৬২ সালের সংবিধানে স্বীকার করে নিয়েছিল। জানি না আজকে যেখানে গণতন্ত্র হতে যাচ্ছে, সমাজতন্ত্র হতে যাচ্ছে, সেখানে কেন আপনারা আমাদের কথা ভুলে যাচ্ছেন?
পৃথিবীর অনেক দেশেই সমাজতন্ত্র হয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নেও আদিবাসীদের আধিকার আছে। পৃথিবীর আর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত- আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র - আমরা সেখানে দেখি, তাদের সংবিধানে বিভিন্ন জাতিকে অধিকার দেওয়া হয়েছে জানি না, আমরা কি অপরাধ করেছি?
আমি যতদূর বুঝতে পারি, আপনার মাধ্যমে আমি মাননীয় সদস্যদের জানাচ্ছি, আমি একজন মানুষ। এমন একজন মানুষ, যারা যুগ যুগ ধরে অধিকার থেকে বঞ্চিত। সেই জাতির প্রতিনিধি আমি। আমার বুকের ভিতর কি জ¦ালা, তা আমি বুঝাতে পারবো না। সেই জ্বালা আর কারোর ভিতর নাই। সেই জ¦ালার কথা কেউই চিন্তা করেননি। অস্বীকার করা উচিৎ নয়। কিন্তু সেই সব জাতির কথা গণপ্রজাতন্ত্র¿ী বাংলাদেশের এই খসড়া সংবিধানে নাই।

 চলবে-
*জুম্ম সংবাদ বুলেটিন (১০ই নভেম্বর ৮৩ স্মরণে বিশেষ সংখ্যা) বুলেটিন নং- ২৩, ৫ম বর্ষ, ১০ই নভেম্বর ৯৫, শুক্রবার 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...