রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৯

জুম্ম জাতির দুগর মাচ: মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বক্তব্য -১

খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনা করতে গিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ১৯৭২, ২৫ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে বলেন:
মাননীয় স্পীকার সাহেব, আমাদের দেশেরে জন্য যে সংবিধান রচনা করতে যাচ্ছি, আপনার মাধ্যমে আজকে এই মহান গণপরিষদে দাঁড়িয়ে সেই সংবিধানের উপর আমি কিছু আলোচনা করবো। কিন্তু তার আগে আমি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই  বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে। আমি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই  সা¤্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসকের বিরুদ্ধে যারা কারকাগে তিল তিল করে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিল, যারা সা¤্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসককে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হাসি মুখে হাতকড়া পরেছিলেন, হাঁসিমুখে ফাঁসি কাষ্ঠকে বরণ করেছিলেন, তাদেরকে।
১৯৪৭ সালের পর সা¤্রাজ্যবাদী বৃটিশ এই দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্য যে কৃত্রিম স্বাধীনতা হয়েছিল, সেই কৃত্রিম স্বাধীনতার পর থেকে যে সব বীর, যে সব দেশপ্রেমিক নিজের জীবন তিলে তিলে চারদেওয়ালের অন্ধাকার প্রকোষ্ঠে উৎসর্গ করেছিলেন স্বাধীকার আদায়ের জন্য, যাঁরা নিজেদের জীবন উপেক্ষা করে স্বাধীকার আদায়ের পথে গিয়েছিলেন, তাঁদের কথা আজকে আমি স্মরণ করছি তাঁদের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আজকে এখানে যাঁরা সমবেত হায়েছেন, যে মাননী সংসদ সদস্য-সদস্যাবুন্দ রয়েছেন, তাঁদেরকে আমি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। তারপর আমি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করছি গত এপ্রিল মাসে যে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির সদস্য বন্ধুদের। সর্বশেষ আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করছি আমাদের শ্রদ্ধেয় জননেতা, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
আজকে আমার এই গণপরিষদ ভবনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছি। এই ইতিহাসের পেছনে রয়েচে কত করুণ কাহিনী, কত মানুষের অঝোর ধারায় কান্নার কাহিনী, বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে রয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের করুণ আর্তনাদ। তাই আজকে আমরা সে সব মানুষের কথা স্মরণ করে যদি বিবেকের প্রতি এতটুকু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগিয়ে যাই, তাহলে এই কথাই আমরা বলবো, আজকে এখানে দাঁড়িয়ে যে পবিত্র শপথ আমরা নিয়েছি সেই পবিত্র শপথ নিয়ে  বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য যে পবিত্র দলিল আমরা দিতে যাচ্ছি, সেই পবিত্র দলিলে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা ব্যক্ত হয়েছে কিনা, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা অর্থাৎ তারা যে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে চায়, সে কথা এই সংবিধানে ব্যক্ত হয়েছে কিনা।
তাই মাননীয় স্পীকার সাহেব, আমি আমার বক্তব্যের মধ্যে যে কথা তুলতে যাচ্চি, তাতে যদি কোন ভুলত্রæটি থাকে, তাহলে আমি তা শুধরে নিতে চাই কিন্তু আমি মনে করি, আমি আমার বিবেক থেকে ই এসব কথা বলছি। আমি কোন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বা কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে কিছুই বলতে যাচ্ছি না। যেহেতু আমি এই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষেরই একজন হয়ে আজকে গণপরিষদ ভবনে আমার মতামত প্রকাশ করতে যাচ্ছি, সাড়ে সাত কোটি মানুষের নিকট প্রকাশ করতে যাচ্ছি, তাই সংবিধানের উপর আমার কোন চুলচেরা ব্যাখ্যা নেই। আমার যে মত, আমার যে বক্তব্য, তার সবই দেশের প্রতি ভালোবাসার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। যেভাবে আমার দেশকে ভালবেসেছি, আমার জন্মভ’মিকে ভালোবেসেছি, যে দৃষ্টিকোণ থেকে আমি আমার দেশকে, আমার জন্মভ’মিকে, এদেশের কোটি কোটি মানুষকে দেখেছি, সেই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই আমি খসড়া সংবিধানকে দেখতে যাচ্ছি। .... ..... ..... ...
তাই আমি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য বন্দুদের বলছি যে, খসড়া সংবিধান তারা গত জুন মাসে দিতে পারেননি যদিও গত জুন মাসের ১০ তারিখে দেওয়ার কথা ছিল। আজকে এই অক্টোবর মাসে আমাদের এই খসড়া সংবিদান তারা দিয়েছেন। এই খসড়া সংবিধান আমরা জুন মাসে পাইনি, সেজন্য দুঃখিত নই। অক্টোবর আর জুন মাসের মধ্যে ব্যবধান মাত্র কয়েটি মাসের। সেজন্য আমার ব্যক্তিগত অভিমত, আমার কোন আপত্তি নাই, কিন্তু এখানে আমার আপত্তি হচ্ছে এই যে, যে কমিটি আমরা এ দেশেরে কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের ভার দিয়েছিলাম, সেই কমিটি-প্রদত্ত সংবিধান আজকে আমাদের হুবহু গ্রহণ করতে হচ্ছে।
এই পরিষদের সামনে আমার বক্তব্য হল, আজকে খসড়া সংবিধান যদি এই এই গণপরিষদ-এ এই ভাবে গৃহীত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে আমার যে আপত্তি আছে সে আপত্তি হল, আমার বিবেক , আমার মনের অভিব্যক্তি বলছে, বাংলাদেশেরসাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা এই সংবিধানে নাই। যদি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা পুরোপুরি এই খসড়া সংবিধানে থাকত, তাহলে আমার আপত্তির কোন কারণ থাকত না। কিন্তু আজ আমি দেকতে পাচ্ছি, পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ^রী, বুড়িগঙ্গা, মাথাভাঙ্গাঁ, শঙ্খ, মাতামহুরী, কর্ণফুলী, যমুনা, কুশিয়ারা প্রভৃতি নদীতে রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে যাঁরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসের পর বৎসর ধরে নিজের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে নৌকা বেয়ে, দাঁড় টেনে চলেছেন, রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে, মাথায় ঘাম পায়ে ফেলে যাঁরা শক্ত মাটি চষে সোনার ফসল ফলিয়ে চলেছেন, তাঁদেরই মনের কথা এ সংবিধানে লেখা হয়নি। আমি বলছি আজকে যাঁরা রাস্তায় রাস্তায় রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নিবৃঅহ করে চলেছেন, তাদের মনের কথা এই সংবিধানে লেখা হয়নি।
আজকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে আপনারা বাংলাদেশের মেহনতী মানুষের কথা সমাজতন্ত্রের নামে, গণতন্ত্রের নামে বলেচলেছেন। আমি ক্ষুদ্র মানুষ সংসদীয় অভিজ্ঞতা আমার সেরকম নাই। তবু আমার বিবেক বলছে এই সংবিধানের কোথায় যেন গলদ রয়েছে।
মাননীয় স্পীকার সাহেব সাহেব, আজকে যারা কল-খানায় চাকা, রেলের চাকা ঘুরাচ্ছেন, যাঁদের রক্ত চুইয়ে আজকে আমাদের কাপড়, কাগজ প্রতিটি জিনিষ তৈরী হচ্ছে, সে লক্ষ লক্ষ মেহনতী মানুষের মনের কথা এখানে নাই।
তারপর আমি বলব, সবচেয়ে দুঃখজনক কথা হচ্ছে এই যে, আমাদের মা-বোনদের কথা এখানে নাই। নারীর যে অধীকার সেটা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত। নারীকে যদি অধিকার দিতে হয়, তাহলে পুরুষ যে অধিকার ভোগ করে, সে অধিকার নারীকেও দিতে হবে। কারণ, তারাও সমাজের অর্ধেক অংশ।.... ... আজ পল্লীর আনাচে কানাচে আমাদের যে সমস্ত মা-বোনকে তাদের দেহ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে, তাদের কথা এই সংবিধানে লেখা হয়নি। এই সংবিধানে সেই মা-বেনদের জীবনে কোন গ্যারান্টি দেওয়া হয়নি। যদি এটা আদর্শ সংবিধান হতো, যদি এাঁ গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক সংবিধান হতো, তাহলে আজকে যারা নিষিদ্ধ পল্লীতে নিজেদের দেহ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে, তাদের কথা লেখা হত, তাদেরকে এই নরক যন্ত্রনা থেকে মুক্ত করে আনার কথা থাকত, কিন্তু তাদের মনের অভিব্যাক্তি প্রকাশের কথা, খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার কথা এই সংবিধানে নাই।
এই সংবিধানের মানুষের অধিকার যদি খর্ব হয়ে থাকে, তাহলে আজকে ৩০ লক্ষ শহীদের কথা স্মরণ করে অতীতের ইতিহাস স্মরন আমি বলব যে, ইহিাস কাউকে কোনদিন ক্ষমা করেনি, করবেও না-ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। আমরা দেখেছি, ১৯৫৬ সালের সংবিধান যে সংবিধানকে আয়ুব খানের মত একজন সৈনিক লাতি মেরে, গণতন্ত্রকে হত্যা করে পাকিস্তানের বুকে স্বৈরাচারী সরকার গঠণ করেছিল। তারপর ১৯৬২ সালে তার মনের মত একটি সংবিধান রচনা করে সেটাকে দেশের বুকে চাপিয়ে দিয়ে ভেবেছিল যে, তার এই সংবিধান এদেশের মানুষ গ্রহণ করবে। কিন্তু এ দেশের মানুষ সেটা গ্রহণ করেনি।
এই সংবিধানও যদি সে ধরণে হয়ে যায়, তাহলে ইতিহাস কি আমাদের ক্ষমা করবে? তাই ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মত. ১৯৬২ সালের সংবিধানের মত এই সংবিধানকেও কি আমরা হতে দিব, আমার বিবেক বলছে, আমরা এমন সংবিধান চাই না। আমরা এমন সংবিধান চাই, যে সংবিধানে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য একটা পবিত্র দলিল হয়ে থাকবে। সেরকম সংবিধানই আমরা চাই। আমার যা মনের কথা তা আমি ব্যক্ত করলাম।
                                                                                     
                                                                                                                                    চলবে-
*জুম্ম সংবাদ বুলেটিন (১০ই নভেম্বর ৮৩ স্মরণে বিশেষ সংখ্যা) বুলেটিন নং- ২৩, ৫ম বর্ষ, ১০ই নভেম্বর ৯৫, শুক্রবার




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...