১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়ি থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সৈন্য প্রত্যাহার করে ।
খাগড়াছড়ির কুকিছড়া গ্রামে ঢুকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী অভিনন্দন জানাতে আসা নিরীহ লোকজনকে নির্বিচারে গুলি করে। এতে প্রায় ৩২ জন গ্রামবাসী নিহত হন এবং ২০০ এর অধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বরে আবারো কুকিছড়ায় ভয়ে লুকিয়ে থাকা ১৬ জন লোককে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হত্যা করে।
স্বাধীনতা লাভের পর শেখ মুজিবর রহমানের সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজাকার, আলবদর খোঁজার সামরিক কর্মসূচি নেয়। এতে বহু নিরীহ জুম্ম হত্যার শিকার হন, শত শত ঘরবাড়ি লুটপাট ও পুড়িয়ে দেয়া হয়, অনেক জুম্ম নারী ধর্ষিত হন এবং বহু মানুষকে বিনা কারণে ধরপাকড় ও নির্যাতন করা হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মেরুং, হাজাছড়া ও বোয়ালখালীতে গ্রামে গ্রামে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।
স্থানীয় সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি বলেন,
‘‘DO AWAY WITH YOUR ETHNIC IDENTITY, GO HOME AND BECOME BENGALIS’’
এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সেনা মোতায়েন ও সেটলার পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি রিপোর্টে এ সাক্ষাতের বিবরণ দিয়ে বলেছে,
‘‘জানা গেছে এই সাক্ষাতের পরে ব্যাপক সেনা তৎপরতা শুরু হয়। সেনাবাহিনী,পুলিশ এবং বিমানবাহিনী উপজাতীয় ( জুম্ম-লেখক ) এলাকার গ্রামগুলিতে আক্রমণ করে । উপজাতি ( জুম্ম-লেখক ) জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে এতে কয়েক হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছে ।’’
শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের পর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ১২,৫০০০ সামরিক ও প্যারা মিলিটারি সদস্য , বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এক ইউনিট এবং বিমানবাহিনী মোতায়েন করেন ।
সামরিক প্রশাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ জুম্ম জনগণের উপর হত্যা-গুম-খুন , মেয়েদের গণধর্ষণ ও ধর্মান্তরকরণ, ভূমি বেদখল এবং সমতলের সেটলার বাঙ্গালি পুনর্বাসন ব্যাপকতা লাভ করে। সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে পোড়ামাটি নীতি প্রয়োগ করে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ২৬ মে ১৯৭৯ সালে জনসম্মুখে ব্রিগেডিয়ার হান্নান ও লে. কর্ণেল সালামের ঘোষণায়। তারা বলেন,
‘‘ WE WANT THE LAND, BUT NOT THE PEOPLE OF THE CHITTAGONG HILL TRACTS ’’
সাধারণত দেখা যায় বাংলাদেশের মতো অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণহত্যার শিকার হচ্ছে অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রামরত পশ্চাদপদ জাতিসত্তাসমূহ। পার্বত্য চট্টগ্রামেও ভিন্ন ভাষাভাষী ১৩টি জাতিসত্তা- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরুং, বম, খিয়াং, পাংখোয়া, বনযোগী, ম্রো, চাক, লুসাই ও খুমী তথা জুম্ম জনগণ আজ প্রতিনিয়ত গণহত্যার শিকার হচ্ছে ।
উগ্র বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী, সম্প্রসারণবাদী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এ পর্যন্ত ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এতে সদ্য ভূমিষ্ট শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য গণহত্যাগুলো হচ্ছে : কলমপতি গণহত্যা, বানরাইবারী-বেলতলী ও বেলছড়ি গণহত্যা, তেলাফং-আসালং -গৌরাঙ্গপাড়া গণহত্যা, বরকল গণহত্যা, পানছড়ি গণহত্যা, মাটিরাঙ্গা গণহত্যা, কুমিল্লাটিলা-তাইন্দং গণহত্যা, গোলকপতিমাছড়া-মাইচ্যেছড়া-তারাবনছড়ি গণহত্যা, লংগদু গণহত্যা, মাল্যে গণহত্যা, লোগাং গণহত্যা ও নানিয়াচর গণহত্যা ।
এছাড়াও ১৯৯৫ সালের মার্চে বান্দরবান সদর, ২০০১ সালের আগস্টে রামগড়, ২০০৩ সালের আগস্টে মহালছড়ি, ২০০৬ এর এপ্রিলে মাইসছড়ি, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাঘাইহাটে এবং ২০১০ সালে বাঘাইহাট-খাগড়াছড়িতে হামলা-লুটপাট ও গণহত্যার একের পর এক ঘটনায় রক্তে রঞ্জিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপদ। এছাড়াও ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটির লংগদুতে সেনা-সেটলারের সাম্প্রদায়িক হামলায় ২০০ এর অধিক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়।
১. কাউখালি গণহত্যাঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে সিভিল ওয়ার চলাকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আর সেটেলার দ্বারা সর্ব প্রথম গণহত্যা হয়েছিলো রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার কলমপতিতে ২৫শে মার্চ ১৯৮০ সালে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্থানীয় কমান্ডার কলমপতির কাউখালী বাজারে বৌদ্ধ মন্দির পুননির্মাণ ও লোকালয়ের সমস্যার বিষয়ে আলোচনার জন্য মিটিং ডেকেছিলেন। বিরাট সংখ্যক জুম্ম লোকজন কাউখালী বাজার মাঠে জড়ো হয়েছিলেন ।
সেনাকর্তা এসে জড়ো হওয়া লোকজনের দিকে ইঙ্গিত করে চলে যান। চলে যাওয়ার পর সেনা সদস্যরা হঠাৎ করে উপস্থিত লোকজনকে ঘিরে ধরে এবং ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। শতাধিক সেটলার বাঙ্গালি ছুরি, বর্শা নিয়ে সেনাদের সাথে নিরীহ-নিরস্ত্র জুম্ম জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই আক্রমণে ৩০০ এর অধিক খুন হয়েছিলো বলে জানা যায়। আহত হয় শতশত। সেদিন দুই ডজনের অধিক পাহাড়ি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয় , বহু নারীকে অপহরণ করা হয়, অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং ভিক্ষুদের হত্যা করা হয়।
হাজারের অধিক লোকজন বিভিন্ন এলাকায় এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করে। হাজার একরের অধিক জায়গা-জমি , বসতভিটা সেটলাররা জুম্ম জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেয়। এক সময়ের জুম্ম অধ্যুষিত জনপদ এখন সম্পূর্ণ সেটলারদের দখলে। চাপের মুখে জিয়াউর রহমানের সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলো। কিন্তু সেই তদন্ত রিপোর্ট কখনো আলোর মুখ দেখেনি। কলমপতির হত্যাযজ্ঞের পর উপেন্দ্রলাল চাকমা এবং অন্য দু’জন সংসদ সদস্য ব্যক্তিগত তদন্ত করতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।
তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর যে মন্তব্য করেন তা ‘‘জীবন আমাদের নয়’’ নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত ১৯৯১ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা যা বলেন তা হুবুহু তুলে ধরা হলো :
‘‘১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়া থানার অন্তর্গত কলমপতি ইউনিয়নের কাউখালী বাজারে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট যে গণহত্যা ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়েছে , ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। সদ্য আসা বসতিস্থাপনকারীরা ও উপজাতীয়দের (জুম্মদের-লেখক) উপর হত্যা ও লুন্ঠনকাজে যোগ দিয়েছিল। এমনকি ঘটনার একমাস পরেও সমগ্র এলাকাজুড়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। স্থানীয় প্রশাসন ও উপজাতীয় (জুম্ম-লেখক) নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্তেও উৎখাত হওয়া হতভাগ্য উপজাতীয়রা (জুম্মরা-লেখক) তাদের গ্রামের ধ্বংসস্তুপে ফিরে আসার সাহস করছে না। কারণ বসতিস্থাপনকারীরা ধরপাকড় , হেনস্থা , নরহত্যা , অগ্নি সংযোগ ও লুঠতরাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং হুমকি দিচ্ছে।’’ ( সূত্রঃপার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন কর্তৃক ২০০১ সালে ‘জীবন আমাদের নয়’ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ও মানবাধিকার -এই শিরোনামে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশিত চারটি আপডেটের অখন্ড সংকলন থেকে নেয়া। পৃষ্ঠা-২৮ )
২. বানরাইবারী -বেলতলী ও বেলছড়ি গণহত্যাঃ
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জুম্মদের গুচ্ছগ্রামে বন্দী অবস্থায় রাখা হতো। সরকার এ প্রক্রিয়াকে মডেল গ্রাম বা যৌথ খামার প্রকল্প বলে ভাওতাবাজি করে বেড়াতো বহির্বিশ্বে। জিয়া হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতায় আসেন আবদুস সাত্তার। তিনিও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মবিরোধী নীতিমালা চালিয়ে যান। যা পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের সময়ও চলে। ২৬শে জুন ১৯৮১ সালে ঘটে ২য় গণহত্যা ।
বানরাইবারী- বেলতলী ও বেলছড়িতে বাঙালি সেটলাররা প্রত্যক্ষ সেনা মদদে জুম্ম অধ্যুষিত গ্রামে আক্রমণ করে । ৫০০ এর অধিক জুম্ম নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা ও গুম করেছিলো। গ্রামগুলো এবং কৃষিজমি সেটলাররা দখল করে ফেলে। হাজারের মতো জুম্ম জনগণ ভয়ে আশেপাশের জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল এবং প্রায় ৫০০০ জনের মতো জুম্ম লোকজন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য শরনার্থী হয়েছিল। ফিরে এসে তারা আর নিজেদের জায়গা-জমি ফেরত পায়নি। ঐ অঞ্চলে আজ সেটেলার লোকালয় আর সেনা ক্যাম্প।
৩. তেলাফং-আসালং- গৌরাঙ্গপাড়া-তবলছড়ি-বরনালা গণহত্যাঃ
১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সেনা এবং সেটেলারের মিলিত বাহিনী তেলাফং-আসালং- গৌরাঙ্গপাড়া-তবলছড়ি-বরনালায় (ফেনী উপত্যকা) গণহত্যা সংঘটিত করে। মোট ৩৫ টি জুম্ম গ্রামে আক্রমণ করে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এবং নির্বিচারে নারী-পুরুষ-শিশুদের হত্যা করা হয়েছিল। হামলার শিকার গ্রামবাসীদের অনেকেই ত্রিপুরা রাজ্য এবং আশেপাশের জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল। এই হামলায় প্রায় ৯৫০০ জন নিহত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সরকার প্রথমে ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের অস্বীকার করেছিল যদিও অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সীমান্তে শরণার্থীদের সাথে দেখা করতে বাধ্য হয়। প্রত্যেককে মাত্র ১৮ ডলার করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদেরকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো। শরণার্থীদের নিজেদের গ্রামে ফিরে আসা আসলে সম্ভব ছিলো না। কেননা তাদের বাড়িঘর , জায়গাজমি সব সেটলার বাঙ্গালিদের দখলে চলে গিয়েছিল। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা কেউ জানে না।
৪. গোলকপতিমাছড়া-মাইচ্যেছড়া-তারাবনছড়ি গণহত্যাঃ
১৯৮৩ সালের ২৬ জুন, ১১, ২৬ ও ২৭ জুলাই এবং আগষ্ট মাসের ৯, ১০,১১ তারিখে সশস্ত্রবাহিনী ও সেটেলার বাঙ্গালীরা যৌথভাবে পানছড়ি পুলিশ স্টেশনের আশেপাশের গ্রাম এবং গোলকপতিমাছড়া , মাইচ্যেছড়া , তারাবনছড়ি, লোগাং, তারাবন্যে, মরামাইচ্যেছড়া, জেদামাইচ্যেছড়া গ্রামে হামলা চালায়।
শতাধিক বাড়িঘর লুট ও পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং ৮০০ জন মানুষ মারা যায়। ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই বৃদ্ধ , নারী ও শিশু। গণহত্যার পর সরকার সেখানে বাঙ্গালী বসতি স্থাপন করেছিল ।
৫. বরকল গণহত্যাঃ
৩১ মে ১৯৮৪ সালে রাঙ্গামাটির বরকলে গণহত্যা সংঘটিত হয় যা ভূষণছড়া গণহত্যা নামে সমধিক পরিচিত। শান্তি বাহিনীর গেরিলারা এদিন সকালে সেটলার বসতি এবং বিডিআর ক্যাম্প আক্রমণ করে। এতে ১০০ জন সেটলার নিহত হয় বলে অভিযোগ করা হয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে সেদিন এবং তারপরের দিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩০৫ ব্রিগেডের ২৬তম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও বিডিআরের ১৭নং ব্যাটালিয়ন সেটলার বাঙ্গালিদের সাথে নিয়ে জুম্ম গ্রামগুলোতে হামলা করে।
বিশেষ করে হেটবাড়িয়া , সুগুরি পাড়া , টারেঙ্গাঘাট , ভূষণছড়া, গোরস্থান ও ভূষণবাগ এলাকাগুলো বেশী আক্রান্ত হয়। নারী ও শিশুসহ প্রায় ৪০০ জন লোক মারা যায়। অনেক নারীকে গণধর্ষণের পর গুলি করে হত্যা করা হয়। আর ৭০০০ জন জুম্ম জনগণকে ভারতের মিজোরামে শরণার্থী হতে হয়েছিল এবং ১০০০০ এর মতো মানুষ এলাকা ছাড়া হয়েছিল।
আবারো ৩০ জুন ১৯৮৪ তে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সেটলাররা ছোট হরিণা, বড় হরিণা, চেদোয়া, গর্জনতলী, সোগুরিপিাড়া, মাওদং এ হামলা চালায়। ৩০০ জনের অধিক চাকমাকে জবাই করে হত্যা করা হয়। বন্দী হওয়া লোকজনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়- বয়স্ক পুরুষ এবং যুবক, বয়স্ক নারী ও যুবতী নারী। পুরুষ এবং বয়স্ক মহিলাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। তরুণীদের ইচ্ছামতো ধর্ষণ করা হয়, তাদের অনেককে হত্যা ও ধর্মান্তর করা হয়। ১৩০০০ চাকমা মিজোরামে শরণার্থী হন। হেটবাড়িয়ার একজন গ্রামবাসী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন,
‘‘আমার গ্রামটি বরকল পুনর্বাসন জোনে পড়েছে যেখানে বছরের পর বছর ধরে বিপুল সংখ্যক মুসলিম বসতি স্থাপন করেছে। এরফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। ১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মের দিকে ঘন ঘন সংঘর্ষ হতে লাগলো এবং মুসলিমরা সেনাবাহিনী আসবে ও তোমাদের শিক্ষা দিবে বলে প্রায় হুমকি দিতো। মুসলিমদের বড় একটি গ্রুপ নিয়ে ৩১ মে সেনাবাহিনী আসে যাদের অনেকে অস্ত্রধারী। তারা আমাদের গ্রাম ধ্বংস করলো, মেয়েদের ধর্ষণ করলো এবং লোকজনকে হত্যা করলো। আমি দুইজন মহিলাকে ধর্ষিত হতে দেখেছি এবং তারপর তাদের বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়। আরতি নামের আমার এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়কে কয়েকজন সৈনিক মিলে ধর্ষণ করে এবং বেয়নেট দিয়ে তার শরীর বিকৃত করা হয়। শিশুসহ বহু লোককে জলন্তু বাড়িতে নিক্ষেপ করা হয়। আমি টর্চারের শিকার জনসাধারনের মধ্যে একজন ছিলাম। আমাদের ৫ বা ৬ জনকে গাছে উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানো হয়। সম্ভবত মৃত ভেবে ফেলে রেখেছিল এবং বেচেঁ যায়। সেই দিনের স্মৃতি এখনো দুঃস্বপ্ন মনে হয় আমার। এখনো মাঝে মাঝে ঘর্মাক্ত হয়ে জেগে উঠি সৈন্যদের মহিলাদের গোপনাংশে বেয়নেট বিদ্ধ করার দৃশ্যগুলো মনে করে। তারা চিৎকার করে বলেছিল , কোন চাকমা বাংলাদেশে জম্মাবে না।’’
৬. পানছড়ি গণহত্যাঃ
২৯ এপ্রিল ১৯৮৬ শান্তিবাহিনী খাগড়াছড়ির আসালং , ছোট আসালং ও তাইন্দং এ বিডিআরের বর্ডার আউটপোস্ট আক্রমণ করে। তার ফলশ্রুতিতে ১ মে ও ২ মে সেনাবাহিনী , বিডিআর , আনসার ও সেটলার বাঙ্গালিরা একত্রিত হয়ে পানছড়ি-খাগড়াছড়ি এরিয়ার বিভিন্ন গ্রামে প্রবেশ করে হামলা এবং হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।
আক্রান্ত হওয়া উল্লেখযোগ্য গ্রামগুলো হচ্ছে গোলকপতিমাছড়া, কালানাল, সূতকর্মপাড়া , শান্তিপুর , মির্জিবিল, খেদারাছড়া, পূজগাং , লোগাং , হাতিমুক্তিপাড়া , সর্বেশ্বর পাড়া, নাপিদাপাড়া এবং দেওয়ানপাড়া। গ্রামবাসীদের খোলা মাঠে জড়ো করে গুলি করা হয় এবং ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।শতাধিক জুম্ম নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হন।
এ ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে আন্দাজ করা যায় পানছড়ি থেকে মাইলখানেক দূরের মির্জিবিলের এক নারীর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে দেয়া বর্ণনা থেকে। যিনি ৭০ বছরের এক বৃদ্ধার খুনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
‘‘ আমার গ্রামে হানা দেয়ার সাথে সাথে অন্য গ্রামের লোকজন চিৎকার করে প্রত্যেককে গ্রাম ত্যাগ করার জন্য বলছিল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কোনকিছু বুঝে উঠার আগেই সেনা এবং আনসার সদস্যরা পৌঁছে যায়। তাদের পিছু পিছু অসে শতাধিক মুসলিম সেটলার। তারা পুরো গ্রামকে তছনছ করা শুরু করে। সেনারা পুরুষ এবং নারীদের আলাদাভাবে দাঁড়াতে বলে। একজন বয়স্ক মহিলা, পয়দেবী, উঠে লাইনে দাঁড়াতে পারছিলেন না। একজন সৈনিক খুব কাছ থেকে গুলি করে তাকে হত্যা করেন।’’
৭. মাটিরাঙা গণহত্যাঃ
সেনা-সেটলারদের হামলার ভয়ে লোকজন বাড়িতে থাকতে পারতো না। তারা ভয়ে জঙ্গলে রাত্রী যাপন করতো। ১৯৮৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মাটিরাঙ্গার বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় শতাধিক লোকজন সর্বেশ্বর পাড়া ও মনুদাসপাড়ায় জড়ো হয়।
তাদের উদ্দেশ্য ছিলো সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করা। কিন্তু বিধি বাম! একদিন রাতে ,সম্ভবত মে মাসের ১ বা ২ তারিখে ভারতীয় সীমান্তে যাওয়ার প্রাক্কালে সেনাবাহিনীর অ্যামবুশে পড়েন। কোন প্রকার সতর্কবার্তা না দিয়ে এলোপাতারি ব্রাশ ফায়ার করা হয়। এতে ৭০ জন নিহত হন।
৮. কুমিল্লাটিলা-তাইন্দং গণহত্যাঃ
মাটিরাঙ্গা গণহত্যার পর ২০০ এর অধিক জুম্ম জনগণ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যান , যাদের অধিকাংশ ত্রিপুরা জাতিসত্তার। প্রাণে বাঁচার তাগিদে তারা ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার শিলছড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। ১৮-১৯ মে ১৯৮৬ সালে তারা বিডিআরের ৩১ ব্যাটালিয়নের জোয়ানদের হাতে ধৃত হন। তাদেরকে কুমিল্লাটিলা ও তাইন্দং গ্রামের সরু উপত্যকা দিয়ে হেঁটে যেতে বাধ্য করে।
সীমিত পরিসরের এ পথ অতিক্রম করার সময় হঠাৎ করে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়। যারা আহত হয়েছিলেন তাদেরকে সেটলাররা বেয়নেট খুচিয়ে ও দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এ হামলায় বেঁচে যাওয়া ও ভারতে শরণার্থী হওয়া একজন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে বর্ণনা দিয়ে বলেন,
‘‘আমি ত্রিপুরা অধ্যুষিত বড় একটি এলাকার প্রধান যা মাটিরাঙ্গার একটু দূরে। এপ্রিলের শেষ এবং মে মাসের কাছাকাছি সময়ে যখন শান্তিবাহিনী বিডিআর , সেনাবাহিনী ও মুসলিম সেটলারদের আক্রমণ করা শুরু করলো তখন থেকে সেনারা গ্রামে এসে আমাদের হয়রানি করা শুরু করলো। আমরা তাদের বললাম , আমরা চাকমা নই এবং শান্তিবাহিনীর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারপরও তারা হয়রানি করতে লাগলো। এরপর ৮ মে তারা শক্তি নিয়ে এসে আমাদের গ্রাম পোড়াতে লাগলো। অফিসার ইন চার্জ বললো, তোমাদের হিন্দুদের বাংলাদেশে কোন জায়গা নেই, চলে যাও। আমরা প্রতিবেশী কিছু চাকমা পরিবারসহ পালানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু সেনারা আমাদের তাও শান্তিতে যেতে দিলো না। তারা আমাদের পিছু তাড়া করলো এবং আমরা জঙ্গলে লুকিয়ে পড়লাম। ১৮ মে রবিবার যখন বর্ডারের দিকে যাচ্ছিলাম বড় একটি সেনাদলের হাতে ধরা পড়লাম। অফিসারটি বললো, আমাদের সাথে ভালো আচরণ করা হবে এবং সেটেলড করে দেয়া হবে।আমাদের ফিরে যেতে বললো। সৈন্যরা আমাদের ঘিরে ছিল। তারা আমাদের তাইন্দং ও কুমিল্লাটিলার মাঝামাঝি সরু পথ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করে আমরা বুলেটের আওয়াজ শুনতে পায় এবং একই সাথে আমাদের লোকজনের তীব্র চিৎকার ও গোঙ্গানির শব্দ শুনি। প্রায় ২০০ জনের মতো মারা গিয়েছিলো যার বেশির ভাগ ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর। আমার পরিবারের কোন চিহ্নই খুঁজে পায়নি। জানিনা তারা কোথাও লুকিয়ে আছে নাকি মারা গেছে। যখন চারদিক থেকে গুলি করা হচ্ছিলো তখন সেটলাররা চলে আছে এবং মেয়েদের ধর্ষণ করতে লাগলো। অনেককে তরবারি, বর্শা ও ছুড়ি দিয়ে হত্যা করে।আমরা প্রাণ বাচাঁতে ভারতের দিকে দৌড় দিই ।’’
৯. বাঘাইছড়ি গণহত্যাঃ
১৯৮৮ সালের ১ আগস্ট শান্তিবাহিনী বাঘাইছড়ির দুরছড়িতে সেনাবাহিনীর একটি পেট্রোলিং টিমের উপর হামলা করে। এতে ৭ সেনা সদস্য নিহত হন। এর পাল্টা হিসেবে ৩ থেকে ১০ আগস্টের মধ্যে সেনাবাহিনী মুসলিম সেটলারদের সাথে নিয়ে বাঘাইছড়ির দুরছড়ি, খেদারমারা, বটতলী, সার্ভোয়াতলী, পাবলাখালী, শিজক, তুলাবানসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা করে। বাড়িঘর লুটপাট ও পুড়িয়ে দেয়া হয়।
নারী ও শিশুসহ প্রায় ৫০০ জনের মতো জুম্ম গ্রামবাসী নিহত হন এবং শত শত লোক আহত হয়। অনেক নারীকে সেনা-সেটলাররা ধর্ষণ করে এবং ২৫ জন তরুণীকে অপহরণ করে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের ভাগ্য কি ঘটেছে তা কেউ জানে না।
বহু মানষ নিখোঁজ হন, অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সামাজিক-ধর্মীয় রীতিনীতিকে তোয়াক্কা না করে নিহতদের গণকবর দেয়া হয়েছিল।
১০. লংগদু গণহত্যাঃ
১৯৮৯ সালের ৪ মে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলায় স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের শাসনামলে বর্বর ও নারকীয় হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। রক্তাক্ত লংগদু গণহত্যার ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এদিন সেনাবাহিনী ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) সহায়তায় সেটলার বাঙ্গালিরা দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে পাহাড়ি অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করে এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করে।
এ হামলায় বহু পাহাড়ি হতাহত হয়। তৎসময়ে এ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়, প্রাক্তন সংসদ সদস্য চাইথোয়াই রোয়াজা, প্রাক্তন সংসদ সদস্যা সুদীপ্তা দেওয়ান, প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা সুবিমল দেওয়ান, তৎকালীন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান এবং রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মায়াধন চাকমাসহ ২২ জন বিশিষ্ট পাহাড়ি নেতা বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপিতে তারা এ হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে বলেন,
‘‘ উপজেলা সদরের সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্তেও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য , লংগদু ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও ৩ নং লংগদু মৌজার হেডম্যান অনিল বিহারী চাকমা তার বাসভবনে হামলার শিকার হন।ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তার স্ত্রী ও প্রতিবেশীদের অনেকেই যারা হেডম্যানের বাসভবনে আশ্রয় নিয়েছিল এই নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। হত্যাকারীরা দা, বল্লম ইত্যাদিসহ আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা গুলি করে এইসব নিরীহ নারী, পুরুষ শিশু নির্বিশেষে হত্যা করেও ক্ষান্ত হয়নি। মৃতদেহগুলি বাড়িতে ফেলে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। অনিল বিহারী চাকমা তার স্ত্রীর মৃতদেহ বাড়ি থেকে বের করে বাড়ির পাশ্ববর্তী জঙ্গলে সারা রাত পাহারা দিয়ে রাখেন। ভোরের দিকে থানায় খবর দিতে এসে উদ্ধার করতে গেলে পরবর্তীতে মৃতদেহের কোন হদিস পাননি। পরিস্থিতির এমন ভয়াবহতায় মৃতদেহগুলি ধর্মীয় বিধিতে পর্যন্ত সৎকার করা সম্ভব হয়নি ।’’ ( তথ্যসূত্রঃ রাডার, লোগাং গণহত্যা সংখ্যা)
অন্যদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টান্যাশনাল এ বিষয়ে রিপোর্ট করেছিল। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালের ৪ মে বিকাল ৪-৫ টা নাগাদ লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদ সরকার তার অফিসের কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবার আড়াই ঘন্টা পর লংগদুতে পাহাড়ি গ্রামের উপর প্রতিহিংসা মূলক সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু করে।
হিংসাত্বক ও নির্মম এ হামলায় ৩৬ জন নারী পুরুষ ও শিশু মারা যায়। তবে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলে রিপোর্টে বলা হয়। আব্দুর রশীদ সরকারের মৃত্যুর জন্য শান্তিবাহিনীকে দায়ী করা হলেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর কোন সত্যটা খুঁজে পায়নি। অ্যামনেস্টির রিপোর্টে আরো বলা হয়,
‘‘সেদিন কম করে হলেও ৬ টি গ্রাম আক্রান্ত হয়।পাহাড়িদের শতশত ঘরবাড়ি, অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির এবং খ্রিস্টানদের দুটি গির্জা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। হামলায় যারা বেঁচে যান তারা আশ্রয়ের জন্য পাহাড়ে ও জঙ্গলে পালিয়ে যান এবং তাদের একটা সংখ্যাগুরু অংশ বিপদ মাথায় নিয়ে বর্ডার ক্রস করে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী হন।”
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এ বর্বর গণহত্যার সংবাদ সেসময় বাংলাদেশের কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।
এই গণহত্যার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অভ্যুদয় ঘটে। দেশের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রাজনৈতিক সচেতন পাহাড়ি ছাত্ররা একত্রিত হয়ে ২০ মে ১৯৮৯ সালে পিসিপি গঠন করেন। এবং লোমহর্ষক এ গণহত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানোর জন্য ঢাকার রাজপথে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ২১ শে মে মৌন মিছিল সহকারে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ এ বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতিপূরণ দাবি করে।
১১. মাল্যে গণহত্যাঃ
২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার মাল্যা নামক স্থানে এ গণহত্যা সংঘটিত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন কতৃক প্রকাশিত ‘ জীবন আমাদের নয় ’ রিপোর্টে এ গণহত্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে , “২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ মাল্যা নামক স্থানে (লংগদু উপজেলা) একটি যাত্রীবাহী লঞ্চে দু’টি বোমা বিস্ফোরিত হয়। লঞ্চটি মারিশ্যা (বাঘাইছড়ি উপজেলা) থেকে রাঙামাটি যাচ্ছিল। মাল্যা এখন সমতল থেকে আগত বাঙালী অভিবাসী অধ্যুষিত এলাকা। বিস্ফোরণের ফলে একজন যাত্রী নিহত এবং লঞ্চের চালক মারাত্মক আহত হয়। বেঁচে যাওয়া লোকগুলো সাঁতরিয়ে কূলে ওঠেন। কিন্তু সশস্ত্র বাঙালী বসতিস্থাপনকারীরা তাদের অপেক্ষায় ছিল এবং তারা নারী পুরুষ শিশু নির্বিশেষে জুম্ম যাত্রীদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ৩০ জন মারা যায়। ১৪টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বাকীগুলো পানিতে ডুবে যায়। আহতদের কয়েকজনকে সামরিক হাসপাতালে নিতে হয়।”
আরো জানা যায় সেদিন বাঘাইছড়ি এলাকার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক অসদাচরণের প্রতিবাদ করার জন্য ঐ লঞ্চের একটি জুম্ম প্রতিনিধি দলের রাঙ্গামাটি ও ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। জনৈক মশিউর রহমান নামের এক ক্যাপ্টেন বিশ্বমিত্র চাকমা নামে একজন কলেজ ছাত্র ও বোধিমিত্র ভিক্ষু নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল। এবং কয়েকজন ছাত্রীর সাথেও অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনানুযায়ী, ঘটনার দিন সেনাবাহিনীর দু’জন সদস্য দুরছড়ি বাজার থেকে দু’টি কেরোসিন টিনসহ ঐ লঞ্চে উঠে। কিছুদূর আসার পর কেরোসিনের টিন দু’টো রেখে উভয়ে লঞ্চ থেকে নেমে পড়ে। একই দিনে সেনাবাহিনী সহযোগীতায় পরিকল্পিতভাবে সেটলার বাঙালীদেরকে দা , বল্লম ও বিভিন্ন ধারালো অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করে মাইনি এবং দুরছড়ি বাজারের মধ্যবর্তী লংগদু উপজেলাধীন মাল্যা নামক স্থানে জড়ো করে রাখে।
লঞ্চটি ঠিক সে স্থানে পৌঁছলে সেনা সদস্যদের রেখে যাওয়া কেরোসিন টিনগুলো বিস্ফোরিত হয়। সাথে সাথে লঞ্চের যাত্রীরা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পানিতে ঝাঁপ দেয় । পাহাড়ি যাত্রীরা সাঁতরিয়ে কূলে উঠার চেষ্টা করলে অসহায় পাহাড়িদের উপর সেটলার বাঙালীরা আক্রমণ চালায় ।বোমা বিস্ফোরণে যারা হতাহত হয়েছিল তারা ছিল সবাই পাহাড়ি।
আর যারা সেটলারদের হামলার শিকার হয়েছিল তারাও সবাই পাহাড়ি। কোন সেটলার বাঙালী উক্ত ঘটনায় হতাহত হননি । সেদিন সেনাবহিনী গণহত্যার অজুহাত সৃষ্টির অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটায়।কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়া নির্লজ্জভাবে প্রচার চালায় যে , শান্তিবাহিনী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
১২. লোগাং গণহত্যাঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে একদিনে কোন নির্দিষ্ট এলাকায় বড় ধরনের গণহত্যার ঘটনা ঘটে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার লোগাং গুচ্ছ গ্রামে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় ১৫০০ এর অধিক জুম্ম পরিবারকে জোড়পূর্বক লোগাং গুচ্ছ গ্রামে নিয়ে আসে। এবং তাদের ফেলে আসা জায়গা জমিতে সেটলারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে।
১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল, জুম্মদের জাতীয় উৎসব বিজুর মাত্র দুইদিন আগে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক গণহত্যা চালানো হয়। গণহত্যার কারণ নিয়ে কিছুটা মত পার্থক্য দেখা যায় সরকার এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের মহাসচিব ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি ও সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক মো . সাইফুল ইসলাম দিলদর বলেন, ‘‘গরু চড়ানোর সময় শান্তিবাহিনী নামধারী ব্যক্তিরা একজন বাঙ্গালি রাখালকে হত্যা,অপর দুজনকে কুপিয়ে আহত করার পরই এই ঘটনার সূত্রপাত হয়।’’ মূলত তিনি সেনাবাহিনীর অপকর্মকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করতে চেয়েছিলেন।
জুম্ম সংবাদ বুলেটিনের ১৯৯২ সালের ৩১ মের ৭নং সংখ্যায় ঘটনার প্রত্যক্ষ শিকার গীতা চাকমা বলেন ,
‘‘সেদিন আমরা ৩ জন মহিলা পাশ্ববর্তী মাঠে গরু চড়াচ্ছিলাম। সেই সময় দুই জন অনুপ্রবেশকারী এসে আমাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হলে আমার চিৎকার শুনে আমার স্বামী মঙ্গল চাকমা (পাশ্ববর্তী জঙ্গলে কাজ করছিল) অনুপ্রবেশকারীদের বাধা দেয়। ফলে তাদের সঙ্গে আমার স্বামীর কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে অনুপ্রবেশকারীরা আমার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করে ও তারাও রক্তাক্ত অবস্থায় বিডিআর ক্যাম্পে ছুটে যায়। তারপরে উত্তেজিত অনুপ্রবেশকারীরা সশস্ত্র ভিডিপি ও বিডিআরসহ গুচ্ছগ্রাম আক্রমণ করে ও হত্যাকান্ড চালায়।’’
কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই সশস্ত্র ভিডিপিসহ শত শত সেটলার অনুপ্রবেশকারী উত্তোলিত দা, বর্শা কুড়াল দিয়ে হিংস্রতা নিয়ে নিরীহ নিরস্ত্র জুম্মদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। বর্শাবিদ্ধ হয়ে, দা ও কুড়ালের কোপে প্রাণ হারায় অনেক জুম্ম। আর যারা পালানোর চেষ্টা করে তাদের গুলি করে হত্যা করে বিডিআর ও ভিডিপি সদস্যরা। সেটলারদের জিঘাংসার হুংকার আর জুম্মদের গগনবিধারী আর্তনাদে চারপাশ প্রকম্পিত হয়েছিল ।
বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ করে দেয়া হয়। পুড়ে ছাই হয়ে যায় জুম্মদের প্রায় পাঁচ শতাধিক আশ্রয়স্থল ও সহায়-সম্পদ।পুড়ে মরতে হয় পালাতে অক্ষম অসংখ্য শিশু , বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও আহত নর-নারীকে । প্রায় তিন ঘন্টা ধরে এই তান্ডবলীলা চালানো হয়। শত শত আধাপোড়া মরদেহ পড়ে থাকে পোড়া বাস্তুভিটায়। সরকারি হিসাবে শুধুমাত্র ১২ জন নিহতের কথা স্বীকার করা হয়।
কিন্তু প্রাণে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন জুম্ম বলেন, সেদিন ১৩৫ টি লাশ সূর্য উদয় সংঘ ক্লাবঘরে স্তুপ করে রাখা হয়। আধাপোড়া লাশ বহন করতে বাধ্য হওয়া সুখমনি চাকমা পিং লক্ষী বিলাস চাকমা বলেন, তিনি অন্য একজনের সহায়তায় ৪টা লাশ ক্লাব ঘরে নিয়ে যান। একসময় ক্লাবঘরটি লাশে ভরে যায় এবং ১৮/১৯ টি লাশ বাইরে স্তুপ করে রাখা হয়। তারা ধারণামতে কম করে হলেও ১৫০/১৬০ টির মতো লাশ জড়ো করা হয়েছিল।
হত্যাযজ্ঞের পর বিডিআর ও ভিডিপি সদস্যরা কাউকে লাশ হস্তান্তর করেনি। রাতের আধারে অনেক লাশ গুম করে ফেলা হয়। ফলে প্রকৃতপক্ষে মোট কতজন নিহত হয়েছেন তা অজানায় থেকে গেল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়
‘‘ ……আধা সামরিক সদস্যদের দ্বারা নিহত লোকের সংখ্যা অবশ্যই ১২ থেকে অনেক ছাড়িয়ে যাবে। তবে আমরা জোড় দিয়ে বলতে চাই যে , যদি আধা সামরিক সদস্যদের দ্বারা নিহতদের সংখ্যা ‘‘১২’’ জন হয়েও থাকে , তাহলে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনী ও বসতিস্থাপনকারীরা গ্রামটিকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে।’’
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সরকার গণহত্যা তদন্তের জন্য বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে নিয়ে এক সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন নিয়োগ করে। কিন্তু গণহত্যার ছয় মাস পরে ৭ অক্টোবর ১৯৯২ বাংলাদেশ সরকার গণহত্যার তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যসহ এক সদস্য বিশিষ্ট ‘ লোগাং বিশৃঙ্খলা তদন্ত কমিশন ’ এর যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তা প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। লোগাং গণহত্যার পর চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে বৈ-সা-বির অন্যতম অনুষঙ্গ পাজন চেঙ্গী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বৈসাবি উৎযাপন কমিটির আমন্ত্রণে রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক, আইনজীবী, ছাত্রনেতা ও মানবাধিকার কর্মীসহ ২৯ জনের একটি প্রতিনিধি দল খাগড়াছড়িতে এসেছিল। হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনের জন্য ১২ এপ্রিল লোগাং সফরে যান। কিন্তু সেনা সদস্যরা তাদের লোগাং সফর করতে দেয়নি। তাদেরকে খাগড়াছড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল। তারা খাগড়াছড়ি ফিরে এসে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এ প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় ফিরে এসে ১৮ এপ্রিল এক যৌথ বিবৃতি দেয় যেখানে হত্যাকান্ডের এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত অবস্থার বর্ণনা দেন। ২৮ এপ্রিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে লোগাং অভিমুখে ঐতিহাসিক পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হয়।
১৩. নানিয়াচর গণহত্যাঃ
১৭ নভেম্বর ১৯৯৩ সালে রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়াচর বাজারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সেটলার বাঙ্গালিরা জুম্ম জনগণের একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা চালালে কমপক্ষে ৬৬ জন নিহত ও ৫০০ এর অধিক আহত হন। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অগ্রিম অনুমতি নিয়ে সমাবেশটির আয়োজন করেছিল। এবং এটি ছিল লঞ্চযাত্রীদের একমাত্র বিশ্রামাগারকে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রচারণার একটি অংশ। নানিয়াচর তিন দিকে কাপ্তাই হ্রদ দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ায় লোকজন প্রধানত নৌকায় চলাচল করে। নানিয়াচর বাজারে আসা লোকজনকে চেক পোস্টের সেনা সদস্যরা নিয়মিত জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানি করতো। ফলে এই সেনা চেক পোস্টের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল।
২ নভেম্বর ১৯৯৩ নানিয়াচরের এক ছাত্র সমাবেশ থেকে ১৬ নভেম্বরের আগে চেকপোস্ট থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়। অন্যথায় তারা স্কুল , বাজার ইত্যাদি বয়কট করে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করবে বলে জানিয়ে দেয়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নানিয়াচর ইউপি চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করলেও এর সুরাহা করেনি।
ছাত্ররা তাদের স্মারকলিপির কোন জবাব না পেয়ে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার জন্য ১৭ নভেম্বর সমাবেশ ও মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। দিনটি ছিল বুধবার, সাপ্তাহিক বাজার দিন । তাই স্বাভাবিকভাবে দূর-দূরান্ত থেকে শত শত জুম্ম নর-নারী বাজারে এসেছিল। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মিছিল ও সমাবেশ শেষ হওয়ার সাথে সাথে বাঙ্গালি অনুপ্রবেশকারী ইউপি সদস্য আহমেদ মিঞার নেতৃত্বে একটি পাল্টা সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এর জন্য তারা ঐদিনই প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি লাভ করেছিল। তাদের সাথে পাশ্ববর্তী গ্রাম থেকে পার্বত্য গণপরিষদের সভাপতি মোঃ আয়ুব হোসেন ও বুড়িঘাট ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে শ’খানেক সেটলার যোগ দেয়। তারা লোহার রড , লাঠি ও দা নিয়ে আসে।
কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, চেকপোস্টে সেনা সদস্যরা সেটলারদের কাছ থেকে তাদের অস্ত্র কেড়ে নেয়নি। ফলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং এক পর্যায়ে সেটলাররা জুম্ম জনগণের উপর আনা অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে। এমনকি যে জুম্মরা পালাবার জন্য পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল তাদেরকের গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল। জানা যায়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আক্রমণ বন্ধ করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেয়নি বরং নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে ছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করে , ‘‘….বসতিস্থাপনকারীরা যখন পশ্চাদপসরণ করছিল তখন আর্মি ক্যাম্প থেকে হুইসেল বেজে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে আর্মিরা ছাত্রদের উপর গুলি চালায়।’’ কমপক্ষে তিন ব্যক্তি গুলিতে আহত হনঃ কুশল্যা চাকমা , জ্যোতিময় চাকমা ও রুপন চাকমা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় আর্মিরা সুস্পষ্টভাবে লোকজনকে তাক করে গুলি চালায়। গণহত্যার বহুদিন পরও কাপ্তাই হ্রদ থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আরো অনেক গণহত্যার মতো সেনাবাহিনী এই গণহত্যার সাথে নিজেদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন তাদের রিপোর্টে বলেন , ‘‘ …. আর্মিরা স্বীকার করেছে যে , দুইজন সেনা সদস্য ফাঁকা গুলি ছুড়েঁছিল, তবে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। অধিকন্তু যদি এটা সত্য হয়ে থাকে যে , কেবল মাত্র ফাঁকা গুলি ছোঁড়া হয়েছে , তাহলে তিন জন যে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে তার ব্যাখ্যা কি হবে ? কোন মৃত দেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি এবং গণহত্যার পরপরই সেনাবাহিনী আত্মীয় স্বজনদের তাদের মৃত্যু সংবাদ দেয়ার আগে অনেক মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে। এর ফলে সন্দেহ ঘনীভূত হয় যে, লোকজন যে আর্মিদের গুলিতে মারা যায় তার সাক্ষ্য প্রমাণ আর্মিরা নষ্ট করতে চেয়েছিল ।’’
এ গণহত্যার পর বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে তদন্তের ভার দেয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
উল্লেখ্য, বাঙালি জাতিবাদী রাষ্ট্র বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক বাঙালির উপর সংঘটিত গণহত্যা ও রোহিঙ্গা গণহত্যার কথা স্বীকার করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগোষ্ঠীর উপর সংগঠিত গণহত্যার কথা স্বীকার করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা বিষয়ক রিসার্চ সেন্টার “সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ” এর অবস্থাও একই। UNPFII এর রিপোর্টের পরে বাংলাদেশ সরকার এর জবাব দিয়েছিল, “বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই” এবং এজন্য এই রিপোর্ট UNPFII এর ম্যান্ডেটের বাইরে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ তম সংশোধনীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে অস্বীকার করে এবং “উপজাতি”, “ক্ষুদ্র জাতিসত্তা”, “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী” ইত্যাদি হিসেবে আখ্যায়িত করে।
Source:
1. Life is not ours (THE REPORT OF THE CHITTAGONG HILL TRACTS COMMISSION),
2. ht*tps://www. cwis. org/document/the-genocide-in-the-chittagong-hill-tracts/
3. Unlawful Killings and Torture in the CHT : Amnesty International,1986
4. The Crisis of the Chittagong Hill Tracts: A report to the Annual Meeting of the Asian Conference of Religion and Peace, Seol ,South Korea 1985
5. ht*tps://www. angel* fire. com/ab/jumma/massacre.html
6. জুম্ম সংবাদ বুলেটিন , নং ৭, ২য় বর্ষ,৩১ মে ১৯৯২
7. Winning Hearts and Minds: Foreign Aid and Militarisation in the Chittagong Hill Tracts, Economic and Political Weekly, Vol. 32, No. 29 (Jul. 19-25, 1997), pp. 1811-1819
8. Wolfgang Mey (ed.) (1984): 'They Are Now Burning Village after Village: Genocide in the Chittagong HilI Tracts', IWGIA Document 51, Copenhagen
(২০২৩ সালে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা র ফেসবুক পেইজের পোস্ট থেকে)
মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
কল্পনা চাকমা কেবল অপহৃতই হননি, সেইসঙ্গে অপহৃত হয়েছে পাহাড়ের মানুষগুলোর সবুজ স্বপ্ন, তাঁদের রক্তিম ভবিষ্যৎ: মো. জাবির আহমেদ জুবেল
১৯৯৬ সালের ১২ই জুন অপহৃত হন কল্পনা চাকমা। তিনি কেবল অপহৃতই হননি, সেইসঙ্গে অপহৃত হয়েছে পাহাড়ের মানুষগুলোর সবুজ স্বপ্ন, তাঁদের রক্তিম ভবিষ্যৎ। দীর্ঘ ২৭ বছর পার হলেও বিচারের দেখা মেলেনি, ঠিক যেমন দেখা মেলেনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত কোন গণহত্যার বিচারের। আমরা কল্পনা চাকমার গুম দিবসে কল্পনা চাকমার গুমের বিচার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল গণহত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানাই। একইসাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সাথে সংহতি প্রকাশ করছি।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কল্পনা চাকমা কেবল অপহৃতই হননি, সেইসঙ্গে অপহৃত হয়েছে পাহাড়ের মানুষগুলোর সবুজ স্বপ্ন, তাঁদের রক্তিম ভবিষ্যৎ: মো. জাবির আহমেদ জুবেল
১৯৯৬ সালের ১২ই জুন অপহৃত হন কল্পনা চাকমা। তিনি কেবল অপহৃতই হননি, সেইসঙ্গে অপহৃত হয়েছে পাহাড়ের মানুষগুলোর সবুজ স্বপ্ন, তাঁদের রক্তিম ভবিষ্যৎ।...
-
যে লাম্বা ১৮ বঝর ধুরি চাঙমা লেঘা শেঘানা কামান এগাচিত্তে এগামনে নিআলচি গরি যার তে অহ্’ল সুনানু ইনজেব চাঙমা। তার জনম ১৯ ডিসেম্বর ১৯৮১ খ্রি. বা...
-
Chakma Alphabet ( Ajhapat) by Lakshmi Bhusan Chakma, Arts and Culture Officer, Chakma Autonomus District Council at Mizoram in India on ...
-
খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনা করতে গিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ১৯৭২, ২৫ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে বলেন: মাননী স্পীকার সাহেব, ১৯৪৭ সালে ক...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন