মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে রাখাইনদের নতুন প্রজন্ম
এম.এ আজিজ রাসেল:
পাকিস্তান আমলে শহরের বার্মিজ সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখাইন ভাষা শেখানো হতো। স্বাধীনতার পর তিন বছরের মাথায়
সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন ব্যক্তি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে
বিচ্ছিন্নভাবে রাখাইন ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল।
ধীরে ধীরে সেগুলোও গুটিয়ে যায়। এখন রাখাইন
ভাষা শেখানো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। এছাড়াও বাংলা-ইংরেজি শিক্ষার
প্রতিযোগিতার দৌড়ে মাতৃভাষা চর্চায় আগ্রহ নেই প্রায় ৯৬ শতাংশ রাখাইনদের
মধ্যে। ক্ষীণ সুযোগ-সুবিধা ও সচেতনতার অভাবে দিনদিন মাতৃভাষায় দক্ষতা
হারাচ্ছে রাখাইন সম্প্রদায়। এনিয়ে উদ্বীগ্ন রাখাইন সম্প্রদায়ের সচেতন
ব্যক্তিরা।
রাখাইন ভাষার গবেষক রামু উচ্চবালিকা
বিদ্যালয়ের শিক্ষক মংহ্লা প্রু পিন্টু বলেন, রাখাইন জনগোষ্ঠির ৯৬ শতাংশ
শিশু-কিশোরেরা মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও লিখতে পড়তে পারে না। অবশিষ্ট চার
শতাংশ শিশু বাবা মায়ের কাছে অথবা বৌদ্ধবিহারের পাঠাগারে গিয়ে রাখাইন ভাষা
শিখেছে। রাখাইন শিক্ষকের অভাব, পাঠ্যপুস্তক সংকট ও সরকারি উদ্যোগ না থাকায়
রাখাইন ভাষা চর্চা থেমে গেছে। এরফলে রাখাইনদের সংস্কৃতি, ঐহিত্য, সংগীত,
নৃত্য ও লোকগাথা হারিয়ে যাচ্ছে।
রাখাইনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ষাড়ের
দশকের দিকে শহরের বার্মিজ প্রাথমিক বিদ্যালেয় রাখাইন ভাষার সহশিক্ষা
কার্যক্রম চালু ছিল। তৎকালিন ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ইনজুমা রাখাইন
মাতৃভাষার উপর সকাল সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত পাঠদান করতেন। সেই সময়
মিয়ানমার থেকে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আসা হতো। পরে ১৯৭৪ সালে বিদ্যালয়টি সরকারি
করণ হওয়ার পর রাখাইন ভাষাশিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
ওই বিদ্যালয়ের তৎকালিন প্রধান শিক্ষিকা
(বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) মাসিন রাখাইন (৬৭) বলেন, সরকারি করণ হওয়ার পর নানা
কারণে রাখাইন ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম আর চালানো সম্ভব হয়নি। এছাড়া
অভিভাবকেরা মাতৃভাষা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না, যার কারণে শিক্ষার্থীদের
মধ্যেও আগ্রহ ছিল না। তিনি আরও বলেন, সত্তর দশকের পর থেকে কিছু কিছু রাখাইন
অভিভাবকেরা মনে করতেন, রাখাইন ভাষা শিখলে তাদের সন্তানেরা বাংলাতে দক্ষতা
অর্জন করতে পারবে না। প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যাবে। কিন্তু এটা ভুল ধারণা।
যাদের মাতৃভাষার প্রতি দক্ষতা থাকবে না, তারা অন্য যেকোন ভাষার উপর দক্ষতা
অর্জন করতে পারবে না। তবে অনেকে চাইলেও মাতৃভাষা শেখাতে পারে না, কারণ এখন
শহরে রাখাইন ভাষা শেখানোর মত তেমন কোন প্রতিষ্ঠান বা সুযোগ নেই বললেই চলে।
রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার
অ্যাসোসিয়েশনের সূত্রমতে, দেশের ৪৫ টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার একটি রাখাইন
সম্প্রদায়। দেশের বিভিন্নস্থানে এখন ৯০ হাজারের মত রাখাইন জাতির বসবাস
রয়েছে। এরমধ্যে ৫০ হাজারের বেশি রাখাইন বসবাস করে কক্সবাজার জেলায়। অবশিষ্ট
রাখাইনেরা থাকে পটুয়াখালী, বরগুনা, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও
চট্টগ্রাম মহানগরে। ষাটের দশক থেকে শহরের চাউল বাজার এলাকায় নিজের বাড়িতে
পাঠশালা খুলে রাখাইন ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন আম্মিসে রাখাইন নামে
এক ব্যক্তি। নিজে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশু সংগ্রহ করতেন। তাঁর কাছ থেকে
রাখাইন ভাষার শিক্ষা নিয়েছেন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা.
মায়েনু’র মত রাখাইন সমাজের আলোকিত মানুষেরা। তবে বয়সের কারণে ৯০’ সালের
দিকে সেটিও বন্ধ করে দেন তিনি। পরে ২০০৬ সালে পরলোক গমন করেন আম্মিসে
রাখাইন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে চাচার স্মৃতি রক্ষার্থে বাড়িতে পাঠশালাটি
চালু করেছেন আম্মিসে রাখাইনের বড় ভাইয়ের মেয়ে চ খিন রাখাইন (৪০)। তিনিও
রাখাইন ভাষার শিক্ষা নিয়েছেন চাচার কাছে। তাঁর কাছে এখন পর্যন্ত ১০ জন শিশু
রাখাইন ভাষা শিক্ষা নিতে আসে। সেখানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুতলা বাড়ির
নিচতলার একটি কক্ষে শিশুদের রাখাইন ভাষা শেখাচ্ছেন চ খিন। সেখানে পড়ছে
মাছেন হ্লা (১২), জিমা রাখাইন (১১), চুই লাইন, অ¤্রাসিন রাখাইন (৮)সহ ১০ জন
শিশু। শিক্ষার্থী মাছেন হ্লা (১২) রাখাইনের বাড়ি শহরের চাউল বাজার এলাকায়।
সে পড়ে শহরের কেজি অ্যান্ড মডেল হাইস্কুলের ৭ম শ্রেণিতে। সে জানায়, এক সময়
সে পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধমন্দিরে ‘ধর্ম স্কুলে’ পড়ত। সেখানে প্রতি শুক্রবার
সকালে পড়ানো হত। কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। একারণে
তাঁর বাবা তাকে চ খিনের কাছে দিয়েছেন। সেখানে সে শুক্রবার ও শনিবার বিকেলে
পড়তে যায়। সে আরও জানায়, বাংলা ভাষার মত রাখাইন ভাষা শিখতেও তার কাছে মজা
লাগে। তবে ভাষা শেখার জন্য বিশেষ কোন বিদ্যালয় থাকলে ভাষা শিখতে আরও সহজ
হতো তার। শিক্ষার্থী জিমা রাখাইনের (১১) বাড়ি টেকপাড়া এলাকায়। সে পড়ে রামু
ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুলের ৩য় শ্রেণিতে। শুক্রবার বন্ধের দিন আর শনিবার
স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে ভাষা শিক্ষা নিতে আসে সে। শিক্ষার্থী মাছেন হ্লা
রাখাইনের বাবা মংটিউমা রাখাইন (৪২) সোনালী ব্যাংক কক্সবাজার শাখার
কর্মকর্তা।
তাঁর দুই সন্তান। তিনি বলেন, পড়াশোনা করবে
ঠিক আছে, কিন্তু নিজের মাতৃভাষা জানাওতো দরকার। তাই পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে
শুক্রবার ও শনিবার সন্তানদের রাখাইন ভাষার পাঠদান করছেন তিনি। জিমা
রাখাইনের বাবা ব্যবসায়ী মংহ্লা সেন (৩৮) জানান, বিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজিসহ
সবকিছু শিখছে। কিন্তু নিজের মাতৃভাষা সম্পর্কে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই
সেখানে। মাতৃভাষা না শিখলে শেকড় ভুলে যাবে। তাই তিনি সন্তানদের মাতৃভাষা
শেখানোর উপর জোর দিয়েছেন।
রাখাইন ভাষা শিক্ষার শিক্ষক চ খিন রাখাইন
(৪০) জানান, কয়েক জন অভিভাবকের অনুরোধে তিনি রাখাইন ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম
চালু করেছেন। সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার বিকাল তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত
পড়ান। তবে চাচার সময়ের মত রাখাইন ভাষা শেখার আগ্রহ এখনকার অভিভাবকদের মধ্যে
নেই।
তিনি আরও বলেন, রাখাইন ভাষায় ব্যঞ্জন বর্ণ
৩৩ টি আর স্বরবর্ণ ১২টি। এছাড়া গাণিতিক সংখ্যা বাংলা ও ইংরেজির মতই।
শুরুতে শিশুদের ‘রাখাইন পেসা’ অর্থ্যাৎ রাখাইন বর্ণমালা বই পড়ান। এটি শেষ
হতে প্রায় বছরেরও বেশি সময় লাগে। এই বইটি শেষ হলে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য
ধর্মগ্রন্থ গুলো পড়ানো হয়।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের দিকে শহরের
মহাসেনদোগ্রি বৌদ্ধবিহার প্রাঙনে ‘ধর্মস্কুল’ নামে রাখাইন ভাষা শিক্ষা
কার্যক্রম শুরু করেন বাংলাদেশ রাখাইন স্টুডেন্ট কাউন্সিল (বিআরএসসি)
কক্সবাজার শাখা। প্রতি শুক্রবার সকালে তিনজন শিক্ষক সেখানে রাখাইন ভাষার
পাঠদান করতেন। প্রতি ক্লাসে ১৫০ থেকে ২০০ জন শিশু অংশগ্রহণ করতো। সম্পূর্ণ
বিনামূল্যে পড়ানো হতো শিশুদের। সংগঠনের সদস্যরা টাকা দিয়ে শিক্ষকদের বেতন
চালাতেন। কিন্তু পরে অভিভাবকদের অসহযোগিতা, জায়গা সংকট ও অর্থ সংকটের কারণে
আর চালানো সম্ভব হয়নি ধর্মস্কুল। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বাধ্য হয়ে
স্কুলটি বন্ধ করে দেয় তারা। ওই স্কুলের পাশে উকোসল্লা বৌদ্ধবিহারের রাখাইন
শিশু শিক্ষাকেন্দ্রেও একজন শিক্ষিকা রাখাইন মাতৃভাষা পড়াতেন। টানা ১০ বছর
পড়ান তিনি। কিন্তু ২০১৩ সালের দিকে তিনি মিয়ানমারে চলে যাওয়ায় সেটিও বন্ধ
হয়ে যায়।
বিআরএসসি কক্সবাজার শাখার সাবেক সভাপতি
ক্যনাইং রাখাইন বলেন, ধর্মস্কুলে বেশ আগ্রহ নিয়ে শিশুরা রাখাইন মাতৃভাষা
শিখতো। কিন্তু অর্থ এবং জায়গা সংকটের কারণে ধর্মস্কুল চালানো সম্ভব হয়নি
তাদের। জায়গা এবং অর্থ সহযোগিতা দিয়ে সরকার অথবা কোন বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে
আসলে স্কুলটি পূণরায় চালু করতে চায় তারা।
তিনি আরও বলেন, রাখাইন মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে
রাখা দরকার। তা না হলে এক সময় নিজস্ব সংস্কৃতি, সভ্যতা সবকিছু হারিয়ে
যাবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি দরকার অভিভাবকদের সচেতন হওয়া।
কক্সবাজার কেজি অ্যান্ড মডেল হাইস্কুলের
সহকারি শিক্ষিকা মাউন টিন বলেন, রাখাইনদের মধ্যে দিনদিন নিজের মাতৃভাষার
প্রতি বিমুখতা তৈরী হচ্ছে। প্রতিযোগিতার দৌড়ে বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষাকে
প্রাধান্য দিতে গিয়ে রাখাইন ভাষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না অভিভাবকেরা। কিন্তু
এটা উচিত নয়। এর ফলে মাতৃভাষার প্রতি আজীবন অজ্ঞ থেকে যাবে। যে মাতৃভাষার
প্রতি অজ্ঞ থেকে যাবে, সে কখনোই অন্যকোন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, রাখাইন ভাষা শেখার জন্য
শহরে তেমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই। অনেক রাখাইন শিক্ষিত ব্যক্তি কিন্তু নিজের
মাতৃভাষা (রাখাইন ভাষা) জানে না। উল্লেখযোগ্য কোন ব্যবস্থা না থাকাকেও
কিন্তু মাতৃভাষার প্রতির বিমুখতার অন্তরায় হিসেবে দেখেন তিনি। এই অবস্থা
চলতে থাকলে শিগগিরই রাখাইনদের মাতৃভাষা চর্চা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন