বুধবার, ২৯ মে, ২০২৪

পার্বত্য চট্টগ্রামের মেলা, বিজু ও অন্যান্য উৎসব- শরদিন্দু শেখর চাঙমা


পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ কয়েকশত বছর ধরে ১৩টি উপজাতি বসবাস করছে। এই পার্বত্য ১৩টি উপজাতি হলো চাকমা তঞ্চঙ্গা, মারমা, ত্রিপুরা, উসাই, ম্রো (মুরুং), ব্যোম, পাংখো, লুসাই, বনযোগি, খুমী, চাক এবং খ্যাং। এদের মধ্যে চাকমাদের সংখ্যা সর্বাধিক। তাদের সংখ্যা বাকি উপজাতিদের মোট সংখ্যার চেয়েও বেশি। চাকমা এবং তঞ্চঙ্গরা একই ভাষায় কথা বলে। তাদের ধর্মও একই, তাদের আচার অনুষ্ঠান সামাজিক রীতিনীতিও একই। আসলে তারা একই জনগোষ্ঠীভূক্ত এবং তঞ্চঙ্গরা হলো চাকমাদের একটি শাখা। এই কারণে কক্সবাজার জেলার তঞ্চঙ্গরা নিজেদের চাকমা বলেই পরিচয় দেয়। ১৮৭১ সালের আদম শুমারিতে তঞ্চঙ্গাদের চাকমা হিসেবেই গণনা করা হয়েছিল। একইভাবে ত্রিপুরা উসাইরা একই ভাষায় কথা বলে, তাদের আচার অনুষ্ঠানও একই। সকল গবেষক এবং ইতিহাসবিদরা বলে গেছেন, ত্রিপুরা এবং উসাইরা একই জনগোষ্ঠীভূক্ত এবং উসাইরা ত্রিপুরাদের একটি শাখা। উল্লেখ্য, ভাষাগতভাবে ত্রিপুরারা বৃহত্তর বোরো জনগোষ্ঠীর একটি অংশ। ত্রিপুরারা হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী তবে তারা মূর্তি পূজা করে না। বাকি উপজাতিদেরও নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি রয়েছে। লুসাই, ব্যোম, পাংখো এবং বনযোগি উপজাতিদের ভাষা খুবই কাছাকাছি। বর্তমানে তারা সবাই খৃষ্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী এবং ভারতে তারা সবাই মিজো নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, ত্রিপুরা, উসাই, ব্যোম, পাংখো, লুসাই এবং বনযোগিরা বাদে বাকিরা সবাই বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী

এবং বৌদ্ধ উৎসবগুলো পালন করে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদেরও নিজস্ব উৎসব এবং অন্যান্য বিনোদন অনুষ্ঠান রয়েছে। তারাও আমোদ-প্রমোদ পছন্দ করে, উপভোগ করে এবং অন্যদেরও উপভোগ করতে দেয়। কালের প্রভাবে এবং যুগের পরিবর্তনে এবং অন্যান্য কারণে তাদের উৎসব বিনোদন অনুষ্ঠান অনেক হারিয়ে গেছে, অনেক নতুন বিনোদন অনুষ্ঠান যোগ হয়েছে। নিম্নে তাদের কিছু উৎসব বিনোদন অনুষ্ঠানের বর্ণনা দেয়া হলো।

বৌদ্ধ মেলা

ব্রিটিশ আমলে এবং পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা মারমা এবং অন্যান্য বৌদ্ধ উপজাতিদের অন্যতম প্রধান উৎসব ছিল বৌদ্ধ মেলা। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব স্থানে বড় বড় বৌদ্ধ বিহার অর্থাৎ বৌদ্ধ মন্দির ছিল সেসব স্থানে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমা অর্থাৎ মাঘ মাসের পূর্ণিমা, ফাল্গুনী পূর্ণিমা অর্থাৎ ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা এবং বৈশাখী পূর্ণিমা অর্থাৎ বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি এবং বাংলা নববর্ষের সময় মন্দিরের চত্বরে মেলার আয়োজন করা হতো। তখন বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার খাগড়াছড়ি, পানছড়ি, বোয়ালখালি এবং রামগড় মহামুনি বৌদ্ধ মন্দির চত্বরে প্রতিবছর বৌদ্ধ মেলার আয়োজন করা হতো। বর্তমান রাঙ্গামাটিতে প্রতি বছর রাজপুন্যাহর সময় এবং বর্তমান নানিয়াচড় থানার বড়াদম বৌদ্ধ মন্দির চত্বরে বৌদ্ধ মেলার আয়োজন করা হতো। কোন মেলা মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে, কোন মেলা ফাল্গুনী পূর্ণিমা অথবা বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বসতো। পূর্ণিমা তিথিতে প্রতি বছর একই তিথিতে একই স্থানে বসতো। এসব মেলা কমপক্ষে স্থান ভেদে / দিন হতে ১৫/১৬ দিন, এমনকি আরো দীর্ঘদিনের জন্য বসতো। রামগড় মহামুনি বৌদ্ধ মেলার আয়োজন করা হতো চৈত্র সংক্রান্তির সময় এবং মেলা বসতো প্রায় একমাসব্যাপী। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের সময় মানিকছড়ির মং রাজার মহামুনি মন্দির প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী মেলা বসতো। বিভিন্ন জায়গায় বৌদ্ধ মেলা উপলক্ষে চট্টগ্রাম জেলার অনেক ব্যবসায়ী এবং দোকানিরা তাদের মালামাল নিয়ে মেলায় আসতেন এবং পাহাড়িরাও তাদের কৃষিজাত দ্রব্যাদি এবং কুটির শিল্পের মালামাল মেলায় নিয়ে যেতো। মেলার আয়োজকরা চট্টগ্রাম জেলা হতে পূর্ব হতেই যোগাযোগ করে যাত্রাপার্টি নিয়ে আসতেন। তাই মেলা দেখতে, যাত্রা অনুষ্ঠান উপভোগ করতে, ধর্মকর্ম করতে এবং অনেকেই তাদের প্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয় করতে মেলায় যেতো।

ছেলেমেয়েরা কেহ মা-বাবার সঙ্গে, কেহ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে, যুবক- যুবতীরা দলবেঁধে অথবা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মেলায় যেতো। মেলার কাছাকাছি গ্রামগুলোর কয়েকজন বুড়াবুড়ি নামকাওয়াস্তে গ্রাম পাহারায় থাকতো। বাকিরা সবাই মেলায় যেতো। সন্ধ্যার সময় খাওয়া-দাওয়া সেড়ে মেলায় যেতো, মেলায় ঘুরে বেড়াতো। অনেকেই মন্দিরের চারদিকে নেচে বেড়াতো, পূজা অর্চনা করতো, রাতে যাত্রা অনুষ্ঠান দেখে সকালে বাড়িতে ফেরত হতো। অনেকেই প্রয়োজনীয়

দ্রব্যাদি ক্রয় করে নিয়ে আসতো। দূরবর্তী অঞ্চলের লোকেরা আগেভাগে মন্দিরের  নিকটবর্তী গ্রামগুলোর আত্নীয়-স্বজন, পরিচিতজন, অনেক সময় অপরিচিত জনের অনুষ্ঠান দেখে, ধর্মকর্ম করে এবং পরিশেষে প্রয়োজনীয় মালামালাদি ক্রয় করে নিজ নিজ বাড়িতে চলে যেতো। এভাবে মেলায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ, যুবক- যুবতীর সমাগম হতো। অনেকেই তাদের বাচ্চা-কাচ্চাদেরও সঙ্গে নিতো। এভাবে মেলাটি কেবল উৎসবমুখর হতো না, এলাকাটিও উৎসবমুখর হতো। মেলার আয়োজকরা মেলায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নিজেরা ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করতেন। তাছাড়া এলাকার থানা-পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মেলায় যেতেন এবং সাময়িক সময়ের জন্য মেলায় ক্যাম্প স্থাপন করতেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মেলার ওপর প্রথম আঘাত আসে পাকিস্তান হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে ফাল্গুনী পূর্ণিমার সময় খাগড়াছড়ি বৌদ্ধ মেলায়। তখন খাগড়াছড়ি ছিল কেবল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। গ্রামের পাশে চেঙ্গী উপনদী, যেটি পুরাতন রাঙ্গামাটি শহরের কাছে কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে। এই চেঙ্গী উপনদীর পাড়ে খাগড়াছড়ি বাজার। বাজারের সন্নিকটে খাগড়াছড়ি বৌদ্ধ মন্দির। ব্রিটিশ আমল হতেই এই বৌদ্ধ মন্দিরের চত্বরে প্রতিবছর ফাল্গুনী পূর্ণিমার সময় বৌদ্ধ মেলার আয়োজন করা হতো। মেলা চলতো ১৫/১৬ দিনব্যাপী। উল্লেখ্য, তখন খাগড়াছড়িতে থানা এমনকি পুলিশ বিটও ছিল না। থানা ছিল মহালছড়িতে। ১৯৪৮ সালের বৌদ্ধ মেলার সময় মহালছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরুল হুদার নেতৃত্বে একদল পুলিশ মেলায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মেলায় একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। মেলার প্রথম অথবা দ্বিতীয় দিনের রাতে যাত্রা অনুষ্ঠানের সময় হঠাৎ করে বন্দুকের গুলির আওয়াজ। গুলিতে কেহ মারা যায় নি, তবে ২/৩ জন আহত হয়। কে বা কারা গুলি করেছে কেহ বলতে পারে না। তবে সবার সন্দেহ দারোগা নূরুল হুদার দিকে। কারণ ঘটনার পরদিন খাগড়াছড়ি বাজার হতে ৩ মাইল দূরে কমলছড়ি গ্রামের দুই সচ্ছল পরিবারের শুক্রমণি চাকমা এবং ভুয়াছড়ি মৌজার হেডম্যানের ছেলে চিকন চান্দ কারবারীকে আটক করা হয়। গ্রামের সবাই জানে ওইদিন রাতে শুক্রমণি এবং চিকন চান্দ কারবারী মেলায় যায়নি। উভয়েই গৃহী মানুষ, সচ্ছল এবং এলাকার খুবই সম্মানিত ব্যক্তি। তাদের নিকট হতে অর্থ আদায় এবং লোকজনকে ভয় দেখানোর জন্য পুলিশ ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে লোকের সন্দেহ।

যাত্রা অনুষ্ঠানে গুলি বর্ষণ হওয়াতে ওই রাতেই যাত্রা অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তার পরদিন মেলাও ভেঙে যায়। তবুও পরবর্তী বছর আয়োজকরা আবার মেলার আয়োজন করেন। তবে আগের তুলনায়, মেলায় লোক সমাগম কম হয়। অনেকেই ওয়ে মেলায় যায়নি, অনেকেই ছেলেমেয়েদের মেলায় যেতে দেয়নি। তবে জেলার I যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মেলাগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত আসে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হলে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হলে রাঙ্গামাটি শহরের চাকমা রাজার গৌতম মুনির বৌদ্ধ মন্দির ও বর্তমান নানিয়াচড় থানার অধীন বড়াদম বৌদ্ধ মন্দির কাপ্তাই হৃদের পানিতে ডুবে যায়। উল্লেখ্য, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের তখনকার মোট জনসংখ্যার প্রায় উদ্বাস্তু হয়ে

যায়। সেটার কারণে অন্যান্য স্থানের বৌদ্ধ মেলাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময়ে প্রায় ৪০ হাজার চাকমা ভারতে চলে যায়। আইন- শৃঙ্খলার পরিস্থিতিও ক্রমশ অবনতি হতে থাকে এবং মেলায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে কোনটা ১৯৬৯, কোনটা ১৯৭০ বা ১৯৭১ সালে বৌদ্ধমেলাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তবে ২০০৫ সালের জুলাই মাসে আমি যখন খাগড়াছড়িতে যাই তখন খাগড়াছড়ি বাজারের বৌদ্ধ মন্দিরে যাই। তখন কয়েকজন দায়ক আমাকে বলেন, বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৭২ সালে খাগড়াছড়িতে শেষ বৌদ্ধ মেলাটি হয়েছিল। সে বছর মেলায় আইন-শৃঙ্খলা

সোমবার, ২৭ মে, ২০২৪

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক ইতিহাস হত্যার একটি কাহিনী - শরদিন্দু শেখর চাকমা

বাংলা পিডিয়ায় 'শরণার্থী' শিরোনামে নবম খণ্ডের ২৫৯ পৃষ্ঠা হতে ২৬২ পৃষ্ঠায় বাংলা একটি বিরাট প্রবন্ধ ছাপানো হয়। প্রবন্ধটিতে প্রথমে শরণার্থীর অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়, নির্যাতনের শিকার হয়ে বা বিপজ্জনক রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সামরিক সংঘাতজনিত পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে স্বীয় ভূমি বা দেশত্যাগ করে অন্য কোন জায়গায় বা দেশে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় প্রার্থী বা প্রার্থীরাই হলো শরণার্থী। এরপর বলা হয়, ২০০০ সালের শেষার্ধে এশিয়ায় শরণার্থীর প্রাক্কলিত মোট সংখ্যা ছিল ৭৩,০৮, ৮৬০ জন। তন্মধ্যে বাংলাদেশে আসে ২১,৬২৭ জন, তাদের মধ্যে ২১,৫৫৬ জন হলো মায়ানমারের রোহিঙ্গা। আরো বলা হয়, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ থেকে .২৫ মিলিয়ন হিন্দু ভারতে অভিবাসিত হয়, পরিবর্তে পশ্চিম বঙ্গ এবং বিহার হতে পূর্ব বাংলায় আসে .৭০ মিলিয়ন মুসলমান। উল্লেখ্য, পঞ্চাশের দশকের দাঙ্গায় হিন্দুদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল পর্যন্ত ভারতে হিজরত করেন। এরপর নিবন্ধটিতে বলা হয়, বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের নৃশংসতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ১০ মিলিয়ন শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নেয়। এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের প্রায় সবাই দেশে ফেরত আসে। এরপর বলা হয়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় হতে যেসব উর্দুভাষী মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে ছিল তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জনরোষের শিকার হয়। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান সরকার উর্দুভাষীদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি মেনে নিলেও তাদের মধ্যে প্রথম দফায় ,৭০,০০০ এর কিছু বেশি পাকিস্তানে যেতে সক্ষম হয়। পাকিস্তান সরকার বাকিদের  সেদেশে নিতে অস্বীকার করে যদিও পরবর্তীকালে ১৯৭৭ থেকে১৯৭৯ সময়ের মধ্যে আরো ৪৮০০ জন এবং সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে আরো ৫৩টি পরিবার পাকিস্তানে যেতে সক্ষম হয়।

নিবন্ধটিতে ১৯৫৮ সালে জেনারেল আয়ুব খান পাকিস্তানে ক্ষমতা দখলের পর হিন্দুরা এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুরা যে ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয় সে বিষয়ে একটি বাক্যও বলা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চৌধুরী আর আবরার কর্তৃক সম্পাদিত গবেষণামূলক গ্রন্থ 'On the margin, Refugees Migrants and Minorities' তে বলা হয়েছে, কেবল ১৯৬৪-১৯৯১ সালের মধ্যে অনুমান করা হয় যে, ৫.৩ মিলিয়ন হিন্দু দেশত্যাগী হয়েছে। উল্লেখ্য, আইউবখান ক্ষমতা গ্রহণের পর পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র হিন্দু সি.এস.পি অজিত কুমার দত্ত চৌধুরী এবং পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের একমাত্র হিন্দু বিচারপতি নির্মল চন্দ্র নন্দী পর্যন্ত ভারতে হিজরত করেন। আর কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, কাপ্তাই বাঁধে উদ্বাস্তু হয়ে ক্ষতিপূরণ অথবা পুনর্বাসিত হতে না পেরে ৪০ হাজারের অধিক উপজাতি ভারতে চলে যায়। ভারতের লোকসভার এক সময়ের স্পিকার পি.এ সাংমাও ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার ফলে জন্মস্থান বর্তমান বৃহত্তর ময়মনসিংহ হতে ভারতে চলে যান। নিবন্ধটিতে এসব কিছু বলা হয়নি; কিন্তু বলা হয়, বার্মা অর্থাৎ বর্তমান মায়ানমার সরকারের অত্যাচারের কারণে ১৯৭৮ সালে ২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান শরণার্থী বাংলাদেশে চলে আসে। তবে ১৯৭৯ সালের শেষ পর্যন্ত ১,৮০,০০০ এর বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান দেশে ফেরত যায়। এরপর নিবন্ধটিতে আরো বলা হয়, ১৯৯১- ৯২ সালে মায়ানমার থেকে ২,৫০,০০০ রোহিঙ্গা মুসলমান শরণার্থী বাংলাদেশে চলে আসে। তাদের মধ্যে ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী দেশে ফেরত যায়। বাংলাদেশে এখনও ২২ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে রয়েছে বলে নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে। কিন্তু বলা হয় নাই বাংলাদেশ হতে রাখাইনদের মায়ানমারে বিতাড়নের বিষয়টি। উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে বর্তমান বৃহত্তর চট্টগ্রামে রাখাইনদের সংখ্যা ছিল ৭০ হাজারের অধিক। এখন সেখানে তাদের সংখ্যা ১০ হাজারের মতো আর ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় বর্তমান পটুয়াখালী এবং বরগুনা জেলায় রাখাইনদের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারেরও অধিক। এখন এই দুই জেলায় রাখাইনদের সংখ্যা মাত্র ৩৫০০। নানাভাবে অত্যাচারিত হয়ে রাখাইনরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। এবং তাদের প্রায় সবাই চলে গেছে বার্মায়।

কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছিল এবং যার কারণে হাজার হাজার উপজাতি শরণার্থী বারবার ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিল এবং যার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হওয়ার পূর্বে অনেক বছর ধরে আই.এল.ও'সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছিল, সেই বিষয়টি এশিয়াটিক সোসাইটি একেবারে চেপে গেছে। সেই বিষয়ে একটি বাক্য কেন, একটি শব্দও উচ্চারণ করা হয়নি। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু বাঙালি দুষ্কৃতকারী প্রয়াত বোমাং রাজার পুত্র এবং বান্দরবান ইউনিয়ন কাউন্সিলের তৎকালীন চেয়ারম্যান এম. এস প্রুর মাথা ন্যাড়া করে দেয় এবং তার গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিয়ে সারা বান্দরবান শহরে ঘুরানো হয়। এরপর ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি বান্দরবান শহরে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় পার্শ্ববর্তী সাতকানিয়া কলেজের এক ছাত্র নেতা বোমাং রাজা এবং মারমা সম্প্রদায়কে গালাগালি করে বলতে থাকে, 'বাঁচতে যদি চাও, বাঙালি হও, নইলে বার্মায় চলে যাও।' এছাড়া মারমা সম্প্রদায়ের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে অপমান করা হয়। ফলে সারা বান্দরবান মহাকুমায় পাহাড়িদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় ২০ হাজার মার্মা সম্প্রদায়ের লোক বার্মায় পালিয়ে যায়। পরবর্তী পরিস্থিতি শান্ত হলে তাদের কিছু অংশ দেশে ফেরত আসে, বাকিরা সেখানে থেকে যায়।

এরপর জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করার জন্য ৪ লাখ বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের জন্য নিয়ে আসেন। এরপর শুরু হয় ব্যাপকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যা, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, পাহাড়ি গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়া, লুটপাট ইত্যাদি অন্যান্য লোমহর্ষক কাণ্ড কারখানা। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম গণহত্যা ঘটে ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ এবং এর পরবর্তী ক'দিন রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার কাউখালী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে। ওই ঘটনায় ৩শ' জন উপজাতি নিহত হয়। ২০টি উপজাতি গ্রাম লুট এবং জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হয়, ৯টি বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং ৩০ জন মেয়েকে অপহরণ করে ধর্ষণ করা হয়। এভাবে পাহাড়িরা নিজ ভিটা হতে উৎখাত হয়ে গেলে বাঙালিরা তাদের বাড়িঘর-জায়গাজমি দখল করে নেয়। আর উপজাতিরা হয় শরণার্থী। এরপর ১৯৮১ সালের ২৬, ২৭ এবং ২৮ জুন তারিখে বর্তমান মাটিরাঙ্গা এবং রামগড় থানার ১১ মাইলব্যাপী কাতুন কারবারী পাড়া, যোগেন্দ্র হেডম্যানপাড়া, ধনুছড়া গ্রাম, ব্রজেন কুমার পাড়া, গোমতি, বাদলছড়া,

চংরাকাবা, বোলছড়ি, অযোধ্যা, গোমতি, বাদলছড়া, খেদাছড়া এবং আশপাশের আরো গ্রামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীএবং শরণার্থী বাঙালিরা আক্রমণ চালায়, অগ্নিসংযোগ করে এবং সামনে যাকে পায় তাকে হত্যা করে। এতে আনুমানিক ৩০০ জন পাহাড়ি নিহত হয়, ২০৯ জন আহত এবং ৫০০৭টি বাড়িঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। প্রায় ২০ হাজার উপজাতি পাশের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয়গ্রহণ করে। পরে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর শরণার্থীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু অনেক শরণার্থী পাহাড়ি তাদের বাড়িঘর জায়গাজমি ফেরত পায়নি। তারা এখন মাতৃভূমিতে শরণার্থী। এরপর গণহত্যা ঘটে ১৯৮৪ সালের ৩১ মে হতে ৭ জুন পর্যন্ত রাঙ্গামাটি জেলার ভূষণছড়া ইউনিয়ন এবং ছোট হরিনা ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে। ওই ঘটনায় ৬২ জন উপজাতি নিহত, ১৩ জন আহত এবং ৭ জন মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়। হাজার হাজার উপজাতি বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায়। তাছাড়া ৪৫৩০ জন উপজাতি পার্শ্ববর্তী ভারতে মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু কয়েকমাস পরে মিজোরাম সরকার তাদের জোর করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এরকম গণহত্যা আরো ঘটে ১৯৮৬ সালের ১ মে তারিখে পানছড়ি এবং মাটিরাঙ্গা এলাকায় ১৮ মে তারিখে রামবাবুডেবা গ্রামে, ১৬ ডিসেম্বর চংড়াছড়ি এবং মেরুং মৌজায়। এরপর ১৯৮৮ সালের ৮-১০ আগস্ট তারিখে হিরাচর, সারবোতুলি, খাগড়াছড়ি ও পাবলাখালি মৌজায়। এরপর গণহত্যা ঘটে ১৯৮৯ সালের ৪ মে তারিখে লংগদুতে এবং ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে লোগাং গুচ্ছ গ্রামে এবং ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর তারিখে নানিয়াড় বাজারে। এসব গণহত্যায় শত শত উপজাতি নিহত, আহত হয়, হাজার হাজার উপজাতি বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায় এবং হাজার হাজার উপজাতি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নেয়। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক হত্যা, গণহত্যা এবং মানবাধিকার লংঘনের ফলে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে এবং জেনারেল এরশাদ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শেষ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের তথাকথিত একশ্রেণীর নেতার সঙ্গে চুক্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জেলায় ৩টি জেলা কাউন্সিল গঠন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা হয়েছে বলে বহির্বিশ্বে প্রচার চালাতে থাকেন। এরপর জেনারেল এরশাদ তার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা বিনয় কুমার দেওয়ানকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থিত ৭০ হাজারের অধিক উপজাতি শরণার্থীকে ভারত হতে দেশে ফেরত আনার জন্য তাকে ভারতে যেতে চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু বিনয় দেওয়ান ভারতে যেতে অস্বীকার করেন এবং দাবি করতে থাকেন যে, প্রথমে পার্বত্য চট্টগ্রামেরঅভ্যন্তরে যে ৫০ হাজারের অধিক শরণার্থী রয়েছে তাদের নিজ নিজ ভূমিতে পুনর্বাসন করা হোক। এরপর মন্ত্রী বিনয় দেওয়ানকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলা হয় এবং বিনয় দেওয়ান পদত্যাগ করে রাঙ্গামাটিতে চলে যান। এরপর বাংলাদেশ সরকার ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ফারুক চৌধুরীর নেতৃত্বে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান এবং রাজা দেবাশীষ রায়সহ আরো কয়েকজন উপজাতি নেতাকে পাহাড়ি শরণার্থীদের দেশে ফেরত আনার জন্য ভারতে পাঠায়। কিন্তু শরণার্থীরা দেশে ফেরত আসতে অস্বীকার করে।

জেনারেল এরশাদের পতনের পর যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে জিতে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন। তার সময়ে সরকার ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের কিছু দাবি পূরণ করতে রাজি হওয়ায় দুই কিস্তিতে ৫১৮৬ শরণার্থী ভারত হতে দেশে ফেরত আসে। কিন্তু সরকার শরণার্থীদের নিকট দেয়া সকল দাবি বাস্তবায়ন না করায় বাকি শরণার্থীরা দেশে ফেরত আসতে অস্বীকার করে। ১৯৯৪ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখে প্রত্যাগত উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কমিটি ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করে যে খালেদা জিয়া সরকার যেসব দাবি পূরণ করবে বলে ওয়াদা করেছিল সেসব দাবির অনেকগুলো বাস্তবায়ন করেনি।

১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার জয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। এরপর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং উপজাতিদের রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা হয়। ফলে দশ বছরের অধিককাল ধরে ভারতে শরণার্থী হিসেবে থাকার পর প্রায় ৭০ হাজার উপজাতি শরণার্থী দেশে ফেরত আসে। কিন্তু দেশে ফেরত আসার পর তাদের মধ্যে ৩০৩৫টি পরিবার এখনও তাদের পূর্ব পুরুষের ভিটে মাটিতে ফেরত যেতে পারেনি। কারণ তারা তাদের জায়গাজমি, ভিটে মাটি ফেরত পায়নি। কারণ সেগুলো বাঙালিরা জোর করে দখল করে রেখেছে। তাছাড়া ৫০ হাজারের অধিক অভ্যন্তরীণ উপজাতি শরণার্থী ও তাদের ভিটেমাটি ফেরত পায়নি। তারা এখনও শরণার্থী।

এভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজার হাজার উপজাতি ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি শরণার্থী বিষয়টি এখনও দেশে বিদেশে মাঝে মাধ্যে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে আলোচনার বিষয় হয়ে থাকে। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি শরণার্থীরা বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি ঢাকায় সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামের শরণার্থী বিষয়টি আমাদের দেশে পাগল, নির্বোধ এবং শিশু ছাড়া অন্য সকলের কাছে অবহিত আছে। কিন্তু বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি তাদের 'শরণার্থী শীর্ষক নিবন্ধে বিষয়টি সম্পর্কে একটি বাক্য লেখেনি, সম্পূর্ণভাবে উহ্য রেখেছে এবং সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। এটাতো কেবল ইচ্ছাকৃত ইতিহাস বিকৃতি নয়, এটা ইচ্ছাকৃত ইতিহাস হত্যা এবং এরকম ইতিহাস বিকৃতি কেবল বাংলাদেশ এশিয়াটিক দ্বারা সম্ভব বলে মনে হয়। ইচ্ছাকৃত ইতিহাস বিকৃতির জন্য আমি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির কাছে, দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থী হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

দৈনিক ভোরের কাগজ - ২ এপ্রিল ২০০৫

বুধবার, ১৫ মে, ২০২৪

"পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন-১৯০০": নিকোলাস চাকমা

 


"পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন-১৯০০"

চিটাগং হিল ট্র্যাক্ট (পার্বত্য চট্টগ্রাম) রেগুলেশন ১৯০০ এখনো কার্যকর একটি আইন। এ রেগুলেশনটির কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে ২০১৪ সালে ও ২০১৬ সালে পৃথক দুই মামলার রায় দেয় সুপ্রীম কোর্টের পুর্ণ বেঞ্চ। কিন্তু এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে সুপ্রীম কোর্টে রিভিউ করেছেন মোহাম্মদ আব্দুর মালেক ও আব্দুল আব্দিল আজিজ আখন্দ নামে খাগড়াছড়ির দুই বাসিন্দা।
আইনজ্ঞরা বলছেন, এ রিভিউ সরকারের পক্ষের রায়ের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। সে হিসেবে সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা এটর্নী জেনারেল রিভিউকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান থাকার কথা। কিন্তু এটর্নী জেনারেল তা না করে বরং রিভিউকে সমর্থন করে রায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে হলফনামা আকারে সুপ্রীম কোর্টে দাখিল করেছেন। যা এক প্রকার রাষ্ট্রের রায়ের বিরোধীতার সামিল।
এটর্নী জেনারেলের এমন ভূমিকায় উদ্বিগ্ন পাহাড়ের জনগণ। এ রিভিউ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী ও স্থায়ী বাসীন্দাদের নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন তারা। এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখার জন্য তিন পার্বত্য (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) জেলার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিশিষ্টজনেরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গত ১৬ জুলাই স্মারকলিপিও দিয়েছেন।
জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত স্থায়ী ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের সুরক্ষার জন্য বৃটিশ সরকার ১৯০০ সালে একটি আইন প্রনয়ন করে। যে আইনটি চিটাগং হিল ট্র্যাক্ট রেগুলেশন বা পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ নামে পরিচিত। এ রেগুলেশনটি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সকল অধিকারের সুরক্ষা দিয়ে আসছে। এ রেগুলেশনের সাথে সঙ্গতি রেখে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়।
চুক্তির আলোকে তিন পার্বত্য (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় সৃষ্টি হয়।
রেগুলেশন মতে, তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে সিভিল জজ হিসেবে দেওয়ানী বিচারিক কার্যক্রম এবং বিভাগীয় কমিশনার পদাধিকার বলে জেলা ও দায়রা জজ এবং দেওয়ানী মামলার আপীল কর্তৃপক্ষ ও ফৌজদারী বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
২০০৩ সালে এ রেগুলেশনে শুধুমাত্র এ দুটি সংশোধনী এনে দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিচার কার্যক্রম বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজের আদালতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ সংশোধনীতে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি পাহাড়ের মানুষ বরং ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছিল।
সূত্র জানায়, ২০০৩ সালে রাঙামাটি ফুডস প্রোডাক্ট লি. এক মামলায় হাইকোর্ট বেঞ্চ সিএইচটি রেগুলেশনকে ডেট ল বা অকার্যকর আইন বলে রায় দেয়। এ রায়ের ফলে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি, পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদসহ এবং সিএইচটি রেগুলেশনের সৃষ্ট প্রথাগত প্রতিষ্ঠানসমূহ সংকটের মুখে পড়ে।
এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হলে সুপ্রীমকোর্ট ২০১৬ সালে ২২ নভেম্বর সিএইচটি রেগুলেশনকে একটি কার্যকর ও বৈধ আইন বলে রায় দেয়।
অন্যদিকে সুপ্রীম কোর্ট বিচারধীন ওয়াগ্গা ছড়া টি স্টেট অপর এক মামলার ২০১৪ সালে ২ ডিসেম্বর রায় দেয়।
দুটি রায়ই সিএইচটি রেগুলেশনকে কার্যকর বলে রায় দেয়।
উক্ত দুটি রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে সুপ্রীম কোর্টে রিভিউ আবেদন করেন খাগড়াছড়ির বাসিন্দা আব্দুর মালেক ও আব্দুল আজিজ আখন্দ।
এটর্নী জেনারেল উল্লেখিত দুজনের রিভিউ আবেদন গ্রহণ করে রিভিউর পক্ষে অবস্থান নিয়ে সুপ্রীম কোর্টের দুটি রায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে হলফনামা আকারে সুপ্রীম কোর্টে দাখিল করেন। এ রিভিউ বেঞ্চ গ্রহণ করবে কিনা তার উপর শুনানী হবে আগামী ১৯ অক্টোবর।
চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, সিএইচটি রেগুলেশনকে যখন মৃত আইন বলে রায় দেয়া হয় এ রায়ের বিরুদ্ধে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার আপীল করেছিল। এ আপীলে রেগুলেশনটি কার্যকরী আইন হিসেবে রায় পায়।
যেহেতু এটর্নী জেনারেল সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা সেহেতু এ রায়ের বিরুদ্ধে যারা রিভিউ চাচ্ছেন তাদের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান থাকার কথা। কিন্তু তিনি তা না করে বরং রিভিউকে সমর্থন করে রায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে হলফনামা আকারে সুপ্রীম কোর্টে দাখিল করেছেন। এটা এক প্রকার সরকারের পক্ষের রায়ের বিরোধীতা করার মত।
তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ তো সরকারী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান যেহেতু সিএইচটি রেগুলেশন অনুসরণ করে সেহেতু এটর্নী জেনারেলের উচিত এদের সাথে আলোচনা করা। কিন্তু তিনি কোন আলোচনা না করে রেগুলেশনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ বাদ দিতে সুপ্রীম কোর্টে প্রার্থনা করেছেন।
লেখা এ্যাডঃ নিকোলাস চাকমা

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

কল্পনা চাকমা অপহরণ: ২৮ বছর পর মামলা খারিজ

প্রতিনিধি, রাঙামাটি, দৈনিক প্রথম আলো
দীর্ঘ ২৮ বছর পর বহুল আলোচিত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি শেষ হয়েছে। আদালত পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাদীর নারাজি কল্পনা চাকমা আবেদন নামঞ্জুর করে মামলাটি অবসানের আদেশ দেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাঙামাটির জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তা এ আদেশ দেন।
আদালতের আদেশের মাধ্যমে কল্পনা চাকমা অপহৃত হলেও কে বা কারা অপহরণ করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনই বহাল থাকছে। প্রতিবেদনে কারও দায় পাওয়া না যাওয়ায় ২৮ বছর আগের মামলাটির অবসান হচ্ছে। তবে মামলার বাদী কল্পনার চাকমার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতের এ আদেশে ক্ষুব্ধ। তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন।
মামলার আইনজীবী জুয়েল দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল মামলার শুনানিতে বাদীর বক্তব্যও শোনেন আদালত। পরে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বাদীর নারাজি আবেদন প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবেদন নথিভুক্ত করেন। এর মাধ্যমে ২৮ বছর চলার পর মামলাটি সমাপ্তি ঘটেছে। তিনি বলেন, 'পুলিশ সুপারের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকৃত আসামিদের নাম উল্লেখ না করে সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্ত করা হয়েছে। আমরা উচ্চ আদালতে যাব।'
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১১ জুন মধ্যরাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার লাইল্যাঘোনায় নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন কল্পনা চাকমা। পরদিন কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা বাদী হয়ে বাঘাইছড়ি থানায় অপহরণের মামলা করেন। প্রথমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেন আদালত। পরে আদালত অধিকতর তদন্তের জন্য রাঙামাটির পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব দেন। ২০১৬ সালে মামলার ৩৯তম তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন রাঙামাটির পুলিশ সুপার।
পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কল্পনা চাকমা অপহৃত হলেও কে বা কারা করেছে, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন জানিয়ে মামলার অধিকতর তদন্তের দাবি জানান বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা। নারাজি আবেদনের ওপর দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে শুনানি চলে আদালতে। অবশেষে গতকাল পূর্বনির্ধারিত শুনানির দিনে আদালত পুলিশ সুপারের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেন।
মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতের আদেশের প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এই বিচারে অসন্তুষ্ট। তিনি উচ্চ আদালতে গিয়ে আবার আবেদন করবেন।

‘চীনে বিক্রি পাহাড়ি তরুণীরা’ বিবিসি বাংলা

 

‘চীনে বিক্রি পাহাড়ি তরুণীরা’

পত্রিকা

নারী পাচার নিয়ে আজকের পত্রিকার প্রধান শিরোনাম, ‘চীনে বিক্রি পাহাড়ি তরুণীরা

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, চীনে এক সন্তান নীতির মারপ্যাঁচে পড়ে দেশটিতে এখন নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। অনেক পুরুষ বিয়ের জন্য নারী পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশের পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে চীনাদের চেহারার মিল থাকায়, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাচারকারী চক্র উন্নত জীবনযাপনের লোভ দেখিয়ে পাহাড়ি পরিবারগুলোকে রাজি করাচ্ছে।

এরপর তরুণী-কিশোরীদের পাচার করা হচ্ছে চীনে। এ কাজে সুবিধার জন্য অনেক সময় এ দেশেই চীনাদের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বা বিয়ের জাল কাগজ তৈরি করা হচ্ছে।

পত্রিকাটি সূত্রের বরাতে বলছে, এভাবে চক্রের সদস্যরা গত সাত বছরে আট হাজারের বেশি কিশোরী-তরুণীকে চীনে পাচার করেছে।

তাদের কাউকে কাউকে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেককে বাসায় আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়।

জীবন বাঁচাতে কেউ কেউ পালিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে।

এ বিষয়ে চীনা দূতাবাসের পক্ষ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, চীনে নারী পাচারের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।

কেননা ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে কখনো কোনো অভিযোগ আসে না।

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

পার্বত্য চট্টগ্রাম: বাংলাদেশ নেশন-বিল্ডিং এর সমস্যা নয় কি? - Anurug Chakma

 

রাষ্ট্র কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর ব্যাংক ডাকাতি বুঝে। কিন্ত সন্ত্রাস দমনের নামে গণগ্রেপ্তার, Illegitimate use of force, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, এসব কিছুই বুঝতে চায় না।

রাষ্ট্রযন্ত্র রাষ্ট্রদ্রোহ বুঝে কিন্ত গায়ের জোরে সংখ্যাগুরুর জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়া এবং পাহাড়িদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসকে বুঝতে চায় না।
রাষ্ট্র অসাম্প্রদায়িক দাবি করতে চায়। কিন্ত পাহাড় থেকে সমতল কোথাও আদিবাসী আছে বলে স্বীকার করতে চায় না।
রাষ্ট্র মিলিটারাইজেশন এবং এথনিক ক্লিনজিং (জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ) বুঝতে চায় না। বরং রাষ্ট্রের প্রবল আগ্রাসনের মুখে পাহাড়িদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়ায়কে রাষ্ট্র দেশদ্রোহ বলতে চায়।
রাষ্ট্র পাহাড়ে ইন্সারজেন্সি দেখতে পায়। কিন্ত পাহাড়িদেরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বুঝতে চায় না।
সীমান্ত সড়ক, পর্যটন ব্যবসা করাটাকে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন মনে করে। কিন্ত উন্নয়নের নামে আগ্রাসন, পাহাড়িদেরকে উচ্ছেদ করা যে বৈধ নয় সেটা বুঝতে চায় না।
জনগণ যেমন, রাষ্ট্রও তেমন। এজন্য এদেশের সংখ্যাগুরুদের মধ্যে অনেকে নিজেদের বেলায় স্বাধীনতা চাইতে পারে, কিন্ত অন্যের পরাধীনতা টিকিয়ে রাখতে চায়। এদেশের সংখ্যাগুরুদের মধ্যে অনেকে নিজেদের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার চাই, কিন্ত অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকারকে অস্বীকার করে।
এখানেই কি শেষ? ঢাকা শহরে পাহাড়িদের দেখলে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে অনেকে লাফিয়ে উঠে বলে, “দেখ দেখ চাকমা চাকমা”। আমি নিজেও কয়েকবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। রাষ্ট্র এই রেসিজমকে যেমন বুঝতে চায় না। তেমনি স্বীকারও করতে চায় না। এটাই তো বিশাল সমস্যা!
এভাবেই তো গেল বছরের পর বছর। দশকের পর দশক। এভাবেই সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর বৈরি সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে। এভাবেই চলছে বাংলাদেশের নেশন-বিল্ডিং! রাষ্ট্রের এই Assimilationist এবং Exclusive Nation-building পাহাড়িদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছে। কখনো তাদেরকে করেছে “উপ-জাতি”। কখনোবা তাদেরকে “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী” বানিয়েছে। কিন্ত কখনো তাদেরকে জাতির কাতারে আসতে দেওয়া যাবে না। কি ভয়ংকর রাষ্ট্রের দর্শন!
যাক, আমাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি থাকতে পারে। দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ থাকতে পারে। কিন্ত এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের সামনে একটা রাস্তা ছিল। সেটা হচ্ছে পার্বত্য চুক্তির শতভাগ বাস্তবায়ন করা। কিন্ত সেটাও কি হয়েছে? সেটা নিয়ে রাষ্ট্রের কত মিথ্যাচার! কত ছলচাতুরি! কত প্রতারণা! রাষ্ট্র নিজেই এই চুক্তির প্রধান Spoiler। একদিকে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত, অন্যদিকে পাহাড়িদের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে রাষ্ট্র উসকে দিতে চায়। রাষ্ট্র শুধু পাহাড়িদের নিয়ে একের পর এক গেম খেলতে চায়। মনে আছে, চুক্তির পরে পাহাড়ে তিন বিদেশী অপহরণের গল্প। এবার কুকি-চিন নিয়ে নাটক শুরু করলেন। এই নাটক দেখে দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী নামক “বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীরা” রাষ্ট্রদ্রোহের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশের উস্কানি দেখতে পাচ্ছে। হায় হায় দেশটা গেল গেল! কিন্ত কেউ জোর দিয়ে বলছে না পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। কেউ বলছে না, স্বাধীনতার পর থেকে আমরা পাহাড়ের মানুষদের উপর একটা অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছি। সেখানে লোগাং গণহত্যা, লংগদু গণহত্যা এবং নানিয়াচর গণহত্যা থেকে শুরু করে অনেক ম্যাসাকার হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। শরণার্থী হয়েছে। প্রতি পাঁচজন পাহাড়িদের জন্য একজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত আছে। এই মিলিটারজাইসেশন করতে গিয়ে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুক্ত কারাগারে (Open Prison) বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সেখানে Freedom of Movement কোথায়? সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কল্পনা চাকমারা অপহরণ হচ্ছে কেন? পাহাড়ি মেয়েরা ধর্ষণ হচ্ছে কেন? নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে রমেল চাকমারা নির্মমভাবে হত্যার শিকার হচ্ছে কেন? অথচ, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের এই ডিসকোর্সটিকে পাশ কাটিয়ে পাহাড়ে সন্ত্রাসী ধরার, পাহাড়ে আন্তর্জাতিক গেম হচ্ছে এসব আজগুবি থিউরি দিয়ে কি প্রমাণ করতে চান? পাহাড়ে সন্ত্রাসী আছে, তাই মিলিটারাইজেশন বাড়াতে হবে, তাই না? পাহাড়ে অস্ত্রবাজি আছে, তাই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা যাবে না। এই তো!
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Christian Davenport বলেছেন, “State repression creates a ‘backlash’ that intensifies mobilisation”। ২০২২ সালে Journal of Policing, Intelligence and Counter Terrorism থেকে “Does State Repression Stimulate Terrorism? A Panel Data Analysis” শিরোনামে একটি পেপার পাবলিশ করেছিলাম। Grievance Theory উপর ভিত্তি করে মূলত আমি এই পেপারের Hypothesisটি ভেভেলপ করেছিলাম। এই Hypothesisটি আমি দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের প্যানেল ডেটাসেট দিয়ে টেস্ট করে দেখেছি। আমার প্রাপ্ত গবেষণার ফলাফলও প্রমাণ করে, রাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন ‘backlash’ হতে পারে। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন-নির্যাতন বাড়লে, জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়বে, এবং ফলশ্রুতিতে এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে উগ্রপন্থা এবং সন্ত্রাস বাড়বে।
তাই, পার্বত্য চুক্তির শতভাগ বাস্তবায়নই একমাত্র Accommodative Nation-building হতে পারে এবং পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৪

বিজু নিয়ে আলাপ করলেই লোগাংয়ের কথা মনে পড়ে

 

বিজু (বা বিঝু) উদযাপনে আমাদের সময় আড়ম্বর এতো হতো না। আমরা বাড়ী বাড়ী যেতাম, পাজন খেতাম। চৈত্র সংক্রান্তিতে সবজি একটা আমাদের ঘরেও হতো, অনুমান করি অনেক বাঙালীর ঘরেই হয়, কিন্তু রাঙামাটিতে চাকমা পাজন যেটা আমাদের ঘরের সবজিটা ঠিক সেটার মতো নয়। একশ রকমের উদ্ভিতজাত ফল, মুল, ফুল, লতা পাতা মিশিয়ে পাজন হয়। সবার ঘরে একরকম স্বাদ হয় না। উপাদান ভেদে বা রান্নার স্টাইলের কারণে একেক রকম স্বাদ হয় একেক ঘরে, কিন্তু সুস্বাদু হয় সবার ঘরেই। বছরের এই তারিখটা, এই দিনের আবহাওয়া এই সবকিছু মিলিয়ে পাজন আর আমাদের শরীরের মধ্যে যে সমীকরণ হয়, সেইটাই বৈশিষ্ট্য।

এখনকার মতো মেলা, কনসার্ট বা এইরকম অন্য কোন বিশেষ গণ-আয়োজন এগুলি হতো না। কারো কারো বাসায় পার্টির মতো হতো। আমাদের উদযাপন ছিল ঐ যে, সকলের ঘরে ঘরে গিয়ে খাওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, কিঞ্চিৎ পান করা এইসব। শুধু যে পাজন খেতে দিতো লোকে সেটা নয়, সাথে নানাপ্রকার সুস্বাদু খাবারও থাকতো। ভারি কোন খাবার সাধারণত পরিবেশন করা হতো না।কোন কোন বাড়ীতে ভাত হয়তো দিত সাথে, পোলাও কোরমা এইসব খাবার বিজুর সাথে যুক্ত ছিল না। পাজনের মধ্যে অনিবার্যভাবে কাঁঠাল তো থাকবেই, তীব্র স্বাদের মধ্যে কাঁচা আম থাকতো, আর করলা বা উচ্ছে এইসব। সব মিলিয়ে অমৃত।

আমি যখন রাঙামাটি কলেজ থেকে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখনো পর্যন্ত আমার মনে একটা সিদ্ধান্ত ছিল যে যেখানেই থাকি বিজুতে অন্তত একদিন আমি যে কোন অবস্থাতেই রাঙামাটি থাকবো। পড়ে যখন বাপু বদলই হয়ে গেলেন রাঙামাটি থেকে কক্সবাজারে, পরিবাররে সবাই চলে গেলে কক্সবাজার তখন থেকে ধীরে ধীরে বিজুর সময় রাঙামাটি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বিজু হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে আর আমদের পরিবারে আড়ম্বরের সাথে উদযাপিত হয় পহেলা বৈশাখ। নিতান্ত অনিবার্য কোন কারণ না থাকলে পহেলা বৈশাখ পুরো পরিবারের সাথে উদযাপন করতে হয়। আমার মা থাকতেও এটা ছিল, এখনো এই নিয়ম বিদ্যমান আছে।

২.

এখন তো আমার নিজেরই একটা পরিবার হয়েছে প্রিয়তমা স্ত্রী আর দুই কন্যার সাথে এই অধমকে মিলিয়ে। আমরা উৎসব হিসাবে দুই ঈদ, পহেলা বৈশাখ, ক্রিসমাস, ইংরেজি নববর্ষ, দুর্গা পূজা এই সবই উদযাপন করি। এই সবকিছুর মধ্যে পহেলা বৈশাখটা হচ্ছে প্রধান। দুই ঈদের বা অন্য কোন পালা পার্বণের চেয়ে পহেলা বৈশাখটা আমাদের কাছে উদযাপনের হিসাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পহেলা বৈশাখের সুবিধা হচ্ছে যে এর সাথে কোন ধর্মীয় আচার আচরণ জড়িত নাই, আপনি আপনার ইচ্ছামতো যেভাবে চান সেভাবেই উৎসব বা উদযাপন সাজাতে পারেন। আমরা চেষ্টা করি সব ভাইবোন ওদের বাচ্চা কাচ্চা সবাই অন্তত এক বেলা একসাথে হতে।

পহেলা বৈশাখ যদি আপনি ঢাকায় উদযাপন করতে চান তাইলে তো বিজুর সময় আর রাঙামাটি যেতে পারবেন না। এই কারণে আমার আর বিজুতে রাঙামাটি যাওয়া হয়না। জেনেছি যে এখন নাকি রাঙামাটিতে বিজু উপলক্ষে অনেক আয়োজন হয়। অনেক মেলা হয়, দোকানপাট বেসে, কনসার্ট হয়, গান বাজনা নাচের অনুষ্ঠান হয়। আমি যদি রাঙামাটি থাকতাম তাইলে সম্ভবত বিজু উপলক্ষে ছোট একটা সাহিত্য সংকলন করতে চেষ্টা করতাম। কেউ কেউ নিশ্চয় সেটা করেন, আমারই হয়তো জানা নেই। বেশী অনুষ্ঠান হতে থাকলে অনেক সময় উৎসবের মুল সুরটা ম্লান হয়ে যায়- বিজু উপলক্ষে রাঙায় এরকম হয় কিনা জানিনা।

সমানে বিজু, রাঙামাটিতে এখন নিশ্চয়ই ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ী সবাই বিজুর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। উদযাপনের ধরন পাল্টেছে, উৎসবের ব্যাপ্তিও বেড়েছে নিশ্চয়ই। তথাপি মুল সুরটা কখনো পাল্টায় না। চৈত্রের দাবদাহ, বছরের শেষ দিন, পাহাড়ে প্রকৃতির রূপ রঙ পরিবর্তনের সূচনা এই সব মিলিয়ে চাকমা সমাজের এই উৎসবের দিনে চাকমা তরুণ তরুণীরা নিজেদের উৎসের দিকে ফিরে তাকাবেন, আত্ম পরিচয়, জাতিগত অধিকার, বৈষম্য বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই এই সবকিছুই নিশ্চয়ই তরুণদের উৎসব উদযাপনের অনুষঙ্গ হয়ে আছে এখনো। নিজের দিকে ফিরেও তাকাবো এবং নিজের পরিচয়েই আনন্দ করবো।

৩.  

আনন্দ তো করবই, আনন্দই মুল, কিন্তু যে আনন্দ আমার সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে ধারণ করে না সেটা বড়ই নিম্নমানের স্থূল আনন্দ। রাঙাতে তরুণ বন্ধুরা যারা আছেন, আমি জানি এই বিজুতে আপনাদের উদযাপনের সুরেও বিশ্বব্যাপী আদিবাসী মানুষের যে চলমান সংগ্রাম বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সেই সূরও এসে মিশে যাবে। গেংখুলির সুরে দেখবেন একটা প্রলম্বিত উদাসীন সুর অন্তর্ভুক্ত থাকে- সেই সুরটা হচ্ছে পাহাড়ের মানুষের জীবনের আনন্দের সাথে উচ্ছ্বাসের সাথে কান্নার সংযোগ। সেই কন্নাটা, সেটা মনে রাখবেন। 

বিজু নিয়ে আলাপ করলেই লোগাংএর কথা মনে পড়ে। কেননা আমার দেখা মতে সেই একবারই বিজু উৎসব বর্জনের কথা হয়েছিল- সেবারের বিজু ছিল কান্নার বিজু, ক্রোধ ও বেদনার বিজু। আপনি যখন এইবার বিজুতে আনন্দ করবেন, আনন্দ নিশ্চয়ই করবেন- সেটা জীবনেরই অংশ, সারা দিনের আনন্দের এক ফাঁকে অন্তত একটা মিনিটের জন্যে হলেও লোগাং এর কথা স্মরণ করবেন। ভুলবেন না।

সকলেই ভাল থাকুন। আনন্দ হোক।  


লেখক: ইমতিয়াজ মাহমুদ, প্রগতিশীল লেখক ও আইনজীবী। *লেখাটি ফেইসবুক থেকে নেওয়া।

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...