বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২০

“তুমি বানা কন’ এক্কো বন্দা/ব্যক্তি নয় আ বানা এক্কান আদাম-চাগালার এওজি/প্রতিনিধি নয়, নয় তুমি গোদা হিলচাদিগাঙর এওজি/প্রতিনিধি, তুমি লক্ক, লক্ক/লাখো, লাখো পর্বোয়ার/শিক্ষার্থীর অঝা-সবনর এওজি”


এওজি দিঘীনালা: “চাঙমা সাহিত্য বাহ্ ফাউন্ডেশন শিবচরণ শিক্ষা বৃত্তি- ২০২১:  চাঙমা সাহিত্য বাহ্ এক্কো অরাজনৈতিক, অলাভজনক, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভালেদি স্বেচ্ছাসেবী জধা। যা ২০০০ সালত ১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসত থিদ অয়্যা। থিদ’ অনার সমারে সমারে তারা দেচ-জাত সাহিত্য আ সংস্কৃতি ভালেদি বহুত কাম গরি এচ্চোন আ গরদন।
১.    ১০০০ চাঙমা লেঘার কীবোর্ড বানানা অইয়ে।
২.    ৭৮৮৩ জন মানজোরে চাঙমা লেঘা শেঘানা অইয়ে (২০০৪-২০১৯)।
১.    চাঙমা সাহিত্য পত্রিকা ১৯ সংখ্যা সং, জুম- ২ সংখ্যা, হিল চাদিগাং- ২ সংখ্যা, মেদিনী, বিজক নাঙে সাহিত্য ম্যাগাজিন ছাবা অইয়ে আ ৩০০আন চাঙমা লেঘা চার্ট বানা অইয়ে।
২.    দাঘকধা ১৪০০, ছড়া ৭০ বো, বানা ৫০ আন, পালা ২ বে থুবানা অইয়ে।
৩.    আর কিজু মানজো ইদু----আমা সবনান পার গত্তে দেনা। ইক্কে কিজু মানুচ আমা সান চাঙমা লেঘার উজন্দি সবন দেঘন।
৪.    চাঙমা লেঘার নীতি নির্ধারন গত্তে আর সরকারর নানান কামত যেমন: ল্যাংগুয়েজ ব্রিজিং) অবদান রাঘানা।
৫.    পিএইচডি ক্যান্ডিডেটরে পিএইচডি গবেষণাত এজাল দেনা
এচ্যে সং ১০ আজার পর্বোয়ারে চাঙমা লেঘা শেঘানা সমারে এচ্যে ২০ বঝর সং তারা নানান জাগাত কাম গরিনেই বুঝি পাচ্ছোন বহুত গম গম, দোল দোল মেধাবি পুর্বোয়া তেঙা অভাবে লেঘা-পড়া গরি ন’ পারন বা উচ্চ শিক্ষা লোই ন’ পারন। এধক্যে চিদে-চেদনত্তুন গেল্লে  এপ্রিল ৬, ২০২০ ইং সালত চাঙমা সাহিত্য বাহ্ ফাউন্ডেশন ফগদাঙ গরা অয়। যার উদ্দেশ্য পত্তিক পর্বোয়ার (শিক্ষার্থী) নিরাপত্তা, সুরক্ষা আ শিক্কে নিশ্চিত গরি দোল এক্কান পিত্তিমী থিদ গরানা। ইরুক পর্বোয়াউনর পিত্তিমীআন ফুলে-ফলে সাজি তুলিবার শক্তি আঘে, আঘে আদর্শ আ মুজুঙ দিনর দোল  আঝা-সবন/সম্ভাবনা। এ শক্তি আ আদর্শআনরে কামত লাগে ন’ পারি, সালেন তারা লুদুংমরা, পিত্তোমরা আ দিক কাভুল ওই সহিংস অই উদিবাক। এধক্যে চিদেত্তুন “চাঙমা সাহিত্য বাহ্ ফাউন্ডেশন শিবচরণ শিক্ষা বৃত্তি- ২০২১” ফগদাঙ গরা অহ্’ল।

হিলচাদিগাঙত আ দেজ’ বিদেজর যারা গম-দোল চিদে গরন, শিক্ষানুরাগী বিদ্যোৎসাহী, মানবতাবাদী যারা গায় গায় অতালিয়ে ধারাজে আওজিমনে/স্বেচ্ছায় স্বতস্ফূর্তভাবে এ মানবিক কামত মুজুঙে উজে এবাক; তারার দিয়্যা তেঙা এজাল অভ’ “চাঙমা সাহিত্য বাহ্ ফাউন্ডেশন শিবচরণ শিক্ষা বৃত্তি- ২০২১” এর নিধুকতুক্যা/একমাত্র উৎস। এই শিক্ষা বৃত্তি চাঙমা সাহিত্য বাহ্ ফাউন্ডেশন কতৃর্ক বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২১-২০২২ এ অর্থ বঝরত্তুন ধরি “চাঙমা সাহিত্য বাহ্ ফাউন্ডেশন শিবচরণ শিক্ষা বৃত্তি- ২০২১” চালু গরা অভ’ ভিলে চাঙমা সাহিত্য বাহ্ গরা কমিতি জধানানু সুনানু ইনজেব চাঙমা জানেয়ে। 
তে আর’ বেক্কুনরে কুজোলী গচ্ছে, “তুমি বানা কন’ এক্কো বন্দা/ব্যক্তি নয় আ বানা এক্কান আদাম-চাগালার এওজি/প্রতিনিধি নয়, নয় তুমি গোদা হিলচাদিগাঙর এওজি/প্রতিনিধি, তুমি লক্ক/লাখো পর্বোয়ার/শিক্ষার্থীর অঝা-সবনর এওজি। এ কামান দোলে দোলে উভে পারানা  বেক্কনরে সরিত অভার  তুদি/আবেদন গচ্ছে।
খরব নিনেই জানি পাচ্ছেই “চাঙমা সাহিত্য বাহ্ ফাউন্ডেশন শিবচরণ শিক্ষা বৃত্তি- ২০২১” পল্লেদি ৫০০ + প্রাইমারি আ হাই ইক্কুল, কলেজ- ৫০, বিশ্ব বিদ্যালয়- ২৫ জন পর্বোয়ারে বৃত্তি দিবার আওচ গরের।

বুধবার, ২৬ আগস্ট, ২০২০

পানছড়িতে বিজিবি কর্তৃক অস্থায়ী বাজারের দোকানপাট ভাংচুর

 

২৬ আগস্ট ২০২০, খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ২নং চেঙ্গী ইউনিয়নের তারাবন গীর্জা এলাকায় একটি অস্থায়ী বাজারের দোকানপাট ভাংচুর করেছে বিজিবি সদস্যরা। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে এলাকাবাসী অস্থায়ীভাবে এ বাজারটি স্থাপন করেছে।

এ সময় বিজিবি সদস্যরা বাজারে আসা লোকজনকে তাড়িয়ে দেয় এবং সেখানে বাজার বসানো যাবে না হুমকি প্রদান করে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আজ ২৬ আগস্ট ২০২০ বুধবার সকাল ৮ টার সময় বিজিবি পানছড়ি জোনের লে. কর্নেল মোঃ রুবায়েস আলম-এর নেতৃত্বে একদল বিজিবি সদস্য উক্ত অস্থায়ী বাজারে হানা দেয় এবং ১৫-২০টি দোকান ভাংচুর করে।

পানছড়ি বাজার ও লোগাং বাজার ব্যতীত অন্য কোথাও কোন বাজার বসানো যাবে না বলে বিজিবি সদস্যরা হুমকি প্রদান করে। তারা লাঠিসোটা হাতে মারমুখি হয়ে বাজারে আসা লোকজনকে তাড়িয়ে দেয় এবং জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ফলে বাজারে আসা লোকজন যার যার বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন।

বিজিবি’র এমন অমানবিক আচারণে এলাকার জনগণ অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

লংগদুতে সেটেলার কর্তৃক প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জমির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা


হিল ভয়েস, ২৬ আগস্ট ২০২০, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি জেলার লংগদুর বগাচতর এলাকায় দুই ভূমিদস্যু মুসলিম সেটেলার উপজেলা ভূমি প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উল্টো জমির মালিক দুই জুম্মর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

তবে এর পরপরই উপজেলা প্রশাসন উক্ত দুই ভূমিদস্যু মোঃ আবদুল্লাহ ও মোঃ আল আমিনকে গ্রেফতার করে এবং নবীনচান চাকমার মালিকানাধী জায়গার উপর অবৈধভাবে তাদের নির্মিত বাড়িটি অপসারণ করে দেয়।

পরে উপজেলা প্রশাসন মোঃ আবদুল্লাহ ও মোঃ আল আমিনের কাছ থেকে লিখিত মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্তেও সম্প্রতি রাঙ্গীপাড়ার মুসলিম সেটেলার মজনু সরকারের দুই ছেলে মো: আবদুল্লাহ ও মো: আল আমিন নবীনচান চাকমার জায়গার উপর অবৈধভাবে বাড়ি নির্মাণ করে।

নবীনচান চাকমার পক্ষ থেকে বিষয়টি প্রশাসনকে অবগত করা হলে, প্রশাসন অবৈধভাবে নির্মিত বাড়িটি ২০ আগস্ট ২০২০ তারিখের মধ্যে অপসারণের নির্দেশ প্রদান করে। কিন্তু সেটেলার বাঙালিরা বাড়িটি অপসারণ না করে তারা উল্টো জায়গার মালিক নবীন চান চাকমা ও তার উত্তরাধিকারী দেবেন্দ্র চাকমার নামে রাঙ্গামাটি জেলা জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করে।

তবে গত ২৫ আগস্ট ২০২০ সকাল ১১.০০ টার দিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ক্যথোয়াইপ্রু মারমা, সার্ভেয়ার মোঃ খোরশেদ আলম পুলিশসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে অবৈধভাবে নির্মিত বাড়িটি অপসারণ করে দেয় এবং মো: আবদুল্লাহ ও মো: আল আমিনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

একই দিন পরে পুলিশ বিরোধীয় জায়গায় আর কোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণসহ সম্প্রীতি নষ্ট হয় এমন কোন কাজ করবে না এবং নবীনচান চাকমা ও দেবেন্দ্র চাকমার নামে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করে নিবে মর্মে অঙ্গীকার নিয়ে তাদেরকে জামিনে ছেড়ে দেয়।

উল্লেখ্য, বেশ কিছুদিন ধরে লংগদু উপজেলার বগাচতর ইউনিয়নের রাঙ্গীপাড়া মুসলিম সেটেলার বাঙালিরা পার্শ্ববর্তী নবীনচান চাকমার নামে রেকর্ডভুক্ত ৩.০ একর পরিমাণ জায়গাটি বেদখল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তারই অংশ হিসেবে গত ৪ জুন ২০২০ দিবাগত রাতে রাঙ্গীপাড়ার মো: আলী আহমেদ চৌধুরী ও আব্দুল আলিম সরকার নামের দুই সেটেলার বাঙালি নবীনচান চাকমার উক্ত জমির উপর রাতের আঁধারে একটি ঘর নির্মাণ করে।

পরে নবীনচান চাকমার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২২ জুন ২০২০ সহকারী কমিশনার (ভূমি) সঙ্গে পুলিশ ফোর্স, সার্ভেয়ার, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং বাদী-বিবাদী সকলকে নিয়ে জায়গাটি পরিদর্শ করেন এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উক্ত জায়াগাটিতে কোন প্রকার কার্যক্রম না করার নির্দেশ প্রদান করা হয়।

কিন্তু ২৪ জুন ২০২০ আবারও বাঙালি সেটেলাররা সদলবলে নবীনচান চাকমার মালিকানাধীন উক্ত বিরোধপূর্ণ জায়গায় জঙ্গল পরিষ্কার করে চারা রোপণের উদ্দেশ্যে গর্ত তৈরি করে।

এরপর সহকারী কমিশনার বাদী-বিবাদী সকলকে কাগজপত্র নিয়ে ২৫ জুন ২০২০ তার কার্যালয়ে দেখা করতে বলেন। উক্ত সভায় নবীনচান চাকমা রেকর্ডীয় সমস্ত কাগজপত্র দেখাতে সক্ষম হলেও সেটেলাররা জমি ক্রয়ের সাদা কাগজে একটি দলিল ছাড়া আর কিছুই দেখাতে পারেননি বলে জানা যায়।

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

চাকমাজাতির আদিনিবাস সন্ধানে-১ - By Pulak Khisa

আমরা চাকমারা বিশ্বাস করি আমাদের পূর্বপুরুষরা এসেছে চম্পক নগর থেকে। আমাদের এই ধারণাটা চলে আসছে বংশ পরম্পরায় – বাপ-দাদা, পূর্বপুরুষদের মুখ থেকে শুনে, আমাদের ‘গেংখুলি গীত’ নামক লোকগীতি বা পালাগানের মাধ্যমে। কিন্তু ঝামেলা হলো আমরা জানিনা কোথায় এই চম্পক নগর। চাকমা জাতির ইতিহাস লিখতে গিয়ে চাকমাদের এই আদি বাসস্থান চম্পক নগরের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে কিন্তু চম্পক নগরের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। এই লেখাতে আমারও ক্ষুদ্র প্রয়াস থাকবে চাকমাদের চম্পক নগরের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য। তবে চম্পক নগরের অবস্থান নির্ণয়ের আগে সম্ভবতঃ বিগত কয়েক শতাব্দীর প্রমাণযোগ্য ইতিহাস নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি, যা থেকে আমরা কিছুটা ইঙ্গিত পাবো যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসার আগে, বা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও চাকমারা কোথায় বসবাস করতো। এর অংশ হিসেবে আমরা এখানে রামু জনপদে চাকমাদের অবস্থানের উপর আলোকপাত করবো।

রামু জনপদে চাকমারা

চাকমারা বর্তমানে মূলত চট্টগ্রামের উত্তর-পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে বসবাস করছে। তবে তারা চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিশেষতঃ রামু জনপদে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী বসবাস ও রাজত্ব করেছিল। রামু উপজেলার পটভূমিতে লেখা হয়েছে “বিশ্বখ্যাত পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থান রামু। রামুতে আছে গৌরবোজ্জ্বল অতীত অধ্যায়ের স্মৃতিচিহ্ন। কালের পরিক্রমায় রাজা, রাজবংশ সবই গেছে। তবু ও এখানে টিকে আছে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন” (http://ramu.coxsbazar.gov.bd/…/%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%…)। এখানে কিন্তু বলা হচ্ছেনা রামুর রাজা, রাজবংশ কারা ছিল। রামুতে বর্তমানে চাকমারা বলতে গেলে নেই, অন্ততঃপক্ষে সদর বা শহর এলাকায়, যেখানে এককালে তাদের রাজারা বসবাস ও রাজত্ব করত। উখিয়া, টেকনাফে কিছুসংখ্যক চাকমা এখনো রয়েছে হয়তো। (যেমন ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসনের সময় অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উখিয়ার চেনছড়িতে ফেলোরাম চাকমার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন কয়েকটা দিন (https://www.prothomalo.com/…/%E0%A6%89%E0%A6%96%E0%A6%BF%E0… )। কিন্তু এই চাকমাদের দীন-দরিদ্র, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া অবস্থা দেখলে কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারবেনা এককালে তাদের পূর্বপুরুষরা রামুতে রাজক্ষমতায় ছিল। তবে সেখানে জায়গার নাম, সেখানকার জনশ্রুতি এখনো চাকমাদের ইতিহাসের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে তাদের সেখানে বসবাস ও রাজত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রামু জনপদের উপর সংযুক্ত ডকুমেন্টারীটি দেখা যেতে পারে (https://www.youtube.com/watch?v=9PiapWvtnGQ) । গাঁয়ের বধূ মীনা বড়ুয়ার মতে (ডকুমেন্টারীর ৯:১৫ – ৯:৪০ পর্যন্ত) বাঁকখালী নদীর দক্ষিণ পাড়ে রাজারকূল, উত্তর পাড়ে চাকমার কূল – এই দুই জনপদের সাথে জড়িয়ে রয়েছে চাকমাদের প্রথম রাজা বিজয়গিরির স্মৃতি । শুধু রাজার কূল আর চাকমার কূল ইউনিয়ন নয়, রামুতে এখনো আছে রাজার কূল ও চাকমার কূলের অনতিদূরে চাকমা রাজা ফতে খাঁর নাম অনুসারে ‘ফতে খাঁর কূল’ ইউনিয়ন (সংযুক্ত গুগুল ম্যাপে এটা দেখা যেতে পারে)।

রাঙ্গামাটিতে চাকমা রাজবাড়ির আঙিনায় এখনো রয়ে গেছে রাজার কামান ‘ফতে খাঁ’ (ছবি সংযুক্ত) https://www.jagonews24.com/feature/news/59928 । চাকমা রাজা ‘ফতে খাঁ’-র নাম অনুসারে নাকি কামানটা। না, চাকমারা সম্ভবতঃ অতো উন্নত জাতি ছিলোনা যে কামান বানাতে পারে। তবে সেই কামানটা নাকি যুদ্ধে মোগলদের থেকে হস্তগত করা হয়। অর্থাৎ চাকমারা বিনা প্রতিবাদে, বিনা প্রতিরোধে মোগলদের বৈশ্যতা স্বীকার করার মতো অতো দুর্বলও ছিলোনা, অন্ততঃ যুদ্ধে মোগলদের থেকে কামান ছিনিয়ে নেয়ার সক্ষমতাও তাদের ছিল। সেই সময়েও চাকমারা দক্ষিণ চট্টগ্রামে - রামু, কক্সবাজার, টেকনাফে বসবাস ও রাজত্ব করত। এমনকি ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে চট্টগ্রামের যুদ্ধে মোগল, ডাচ, পর্তুগীজদের সমন্বিত বাহিনীর কাছে আরাকান রাজা চন্দ্র সুধর্ম (সন্দা থুধম্ম) পরাজিত হলে (https://bn.wikipedia.org/…/%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A… ) এবং চাদিগাং বা চট্টগ্রাম মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হলেও চাকমা রাজা ধরম্যা স্বাধীনভাবেই ছিলেন এবং পরবর্তীতে মোগলদের সাথে চাকমাদের বরং সখ্যতা হয়। ১৭১৫ খ্রীস্টাব্দে রাজা ফতে খাঁর সাথে মোগলদের বাণিজ্য চুক্তিই তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন (স্বর্গীয় বিরাজ মোহন দেওয়ান প্রণীত “চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” পৃঃ ১০৪-১০৫)। এই সখ্যতার কারণে সম্ভবতঃ রাজা ধরম্যা এক মোগল রমণীর পাণি গ্রহণ করেন এবং তাঁর গর্ভে যে রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করেন তাকে চাকমারা ‘মোগল্যা’ নামে অভিহিত করে। মোগল রমণীর বংশজাত হওয়ার কারণেই হয়তো পরবর্তী চাকমা রাজারা খাঁ উপাধি গ্রহণ করেন। যেমন মোগল্যার দুই পুত্রের নাম ছিল যথাক্রমে সুভল খাঁ ও ফতে খাঁ। তাঁদের সেনাপতির নাম কালু খাঁ। রাজা সুভল খাঁ (১৭১২) থেকে রাজা ধরমবক্স খাঁ (১৮৮২) পর্যন্ত চাকমা রাজারা খাঁ উপাধি ধারণ করেন। শুধু রাজারা নয়, চাকমাদের মধ্যে অনেক গোত্র-প্রধানও খাঁ উপাধি ব্যবহার করতেন (যেমন আমার নিজের পূর্বপুরুষদের যে বংশ তালিকা আমার হস্তগত হয়েছে তাতে ‘মাখ খাঁ’ নামে এক পূর্বপুরুষের নাম উল্লেখ আছে)।

রাজা সুভল খাঁ মাত্র তিন বছর শাসন করে মারা গেলে তার ছোট ভাই ফতে খাঁ রাজা হন। মোগলদের সাথে বাণিজ্যচুক্তি, মোগলদের থেকে হস্তগত করা কামান, তাঁর নামে অদ্যাবধি ‘ফতে খাঁর কূল’ নামে সম্পূর্ণ এক ইউনিয়নের নামকরণ ইত্যাদি থেকে মনে হয় যে রাজা ফতে খাঁ বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। এখানে চাকমাদের জায়গার নামকরণে ‘কূল’ এবং বিশেষতঃ রাজার কূল শব্দটি বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। চাকমাভাষায় কোন এক বৃহৎ এলাকা, উপত্যকা বুঝাতে এখনো ‘কূল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন – চেঙ্গী (চেঙে) নদীর অববাহিকা বুঝাতে ‘চেঙে কূল বা চেঙ্গী কূল’ ব্যবহৃত হয়, মাইনী (মেগিনি) নদীর অববাহিকা বুঝাতে ‘মেগিনি কূল’ বলা হয়। অনুরূপ ভাবে কাজলং কূল, লোগাং কূল, পুজগাং কূল ইত্যাদি। রাঙ্গামাটির অধিবাসী বুঝাতে রাঙামাত্যা কুল্যা, খাগড়াছড়ির অধিবাসী বুঝাতে খাগড়াছড়ি কুল্যা বলা হয়। অনুরূপভাবে ব্যবহৃত হয় – ঢাকা কুল্যা, কুমিল্লা কুল্যা ইত্যাদি। ‘রাজার কূল’ বলতে রাজার বসবাস করা এলাকাকে বুঝায়। যেমন ভারতের মিজোরাম বা লুসাই হিলে বসবাসকারী চাকমারা বর্তমানে রাঙ্গামাটির চাকমাদের ‘রাজ-কূল্যা’ বা রাজার কূলের চাকমা হিসেবে অভিহিত করেন, নিজেদের বলেন লুসাই হিল্যা।

রাজা ফতে খাঁ ১৭১৫ থেকে ১৭৩৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। রামুতে রাজারকূল, চাকমারকূল, ফতেখাঁরকুল জায়গার নামকরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে এসব এলাকা ঐ সময়ে তাদের শাসনাধীনে ছিল। রামুতে চাকমারা বলতে গেলে এখন আর নেই এবং থাকলেও নগণ্যসংখ্যক, কিন্তু তদসত্বেও সেখানে, কক্সবাজারে ও তার আশে পাশে এলাকায় অনেক জায়গা রয়েছে যেগুলোর নামের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের গ্রাম, এলাকার মিল রয়েছে। যেমন ধলিরছড়া, কালিছড়া, পানিরছড়া, বরইছড়া, বনিয়া ছড়া, ধওয়াপালং ছড়া, হাদরা ছড়া, ধালির ছড়া, বাহার ছড়া, হাদুর ছড়া, দোচারি ছড়া, মনিয়া ছড়া, হারবাং ছড়া, জুমছড়ি, দোছড়ি, জাংছড়ি, ফুলছড়ি, নাক্ষ্যংছড়ি, সোনাইছড়ি, হিমছড়ি, চেংছড়ি, নুনছড়ি, জয়ছড়ি, মিঠাছড়ি, করল্যাছড়ি, থিমছড়ি, নোনাছড়ি, পানছড়ি, কোয়াংছড়ি, ঘিলাতলী, কলাতলী, তুলাতলী, সিবাতলী, পাহাড়তলী, বেলতলী, জারইলতলী (জারুলতলী?), বাথতলী, শ্রীমুরা, ফকিরামুরা, চৌচুলা মুরা, করলিয়া (করল্যা?) মুরা, বালুখালী, বাঁকখালী, রাজাখালী, মনাখালী, উলটাখালী, ভারুয়াখালী, নাপিতখালী, ফাস্যাখালী, মহেশখালী, উমখালী, খনাখালী, নন্দাখালী, উখিয়ার ঘোনা, খেংচরঘোনা, কালুয়ারঘোনা, আসমারঘোনা, হাউরিঘোনা, থোলিয়াঘোনা, খেনচুর ঘোনা, লাফার ঘোনা, পানিস্যা ঘোনা, জিরানিখোলা, কাচিরখোলা, হরিতলা, মুরাপাড়া, আলিখখ্যং, হোয়াইখ্যং, জওয়ারিয়া নালা, মরিচ্যা (মারিশ্যা?), বেতবুনিয়া, কাটাবনিয়া, কচুবনিয়া, আছারবনিয়া, মেরং(মেরুং?)লোয়া, চাকমারকাটা ইত্যাদি। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো টেকনাফের দক্ষিণে সাগরপাড়ে ‘সাবরাং’ নামে একটা ইউনিয়ন রয়েছে যা একান্তই চাকমাদের ব্যবহৃত একটি মশলা গাছের নাম অনুসারে। এটা টেকনাফ তথা বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ ইউনিয়ন (https://bn.wikipedia.org/…/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A…) । সাবরাং (Lemon Basil) চাকমাদের রান্নায় নিত্য ব্যবহৃত একটি মশলা পাতা যা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ঘরে ঘরে চাষ হয়। অথচ সমতলে এর ব্যবহার খুব একটা দেখিনি (অতি সম্প্রতি ঢাকায় সবজি বাজারে বেশ চড়া দামে একটু-আধটু বিক্রি হচ্ছে বলে আমি লক্ষ্য করেছি)।

বৃটিশরা অষ্টাদশ শতকে যখন ভারতবর্ষে রাজত্বের সূচনা করে তখন কোলকাতা ছিল একটা গ্রাম। ঢাকার ইতিহাসও খুব বেশি প্রাচীন নয়। কিন্তু ঐতিহাসিক রামু জনপদের উপর নির্মিত সংযুক্ত ডকুমেন্টারীর মতে রামু ঠাঁই পেয়েছে ১৮৫৮ বছর আগে গ্রীক ভুগোলবিদ টলেমীর ভুগোল গ্রন্থে। চীনা পরিব্রাজক ফাহিয়েন এর ভ্রমণ-বৃত্তান্ত যদি সঠিক হয়ে থাকে তবে মহামানব গৌতমবুদ্ধ হয়তো তাঁর জীবদ্দশায় স্বশরীরে এসেছিলেন এই রামু জনপদে অথবা তিনি না এলেও তাঁর মহাপরিনির্বাণের পরে এখানে আনা হয়েছিল তাঁর বক্ষাস্থির অংশবিশেষ। গৌতমবুদ্ধের এই স্মৃতিকে ধারণ করার জন্য পরবর্তীতে মহান সম্রাট অশোক তাঁর ৮৪ হাজার ধাতুচৈত্যের একটি নির্মাণ করেছিলেন এখানে, যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। মহামানব বুদ্ধ ও সম্রাট অশোকের স্মৃতিবিজড়িত এমন স্বনামধন্য এক জনপদে চাকমারা রাজত্ব ও বসবাস করত ভাবতে নিজেকে নিঃসন্দেহে অনেক গৌরবান্বিত বোধ হয়। চাকমারা নিজেদের শাক্যবংশীয় হিসেবে দাবি করে। প্রশ্ন জাগে শাক্যবংশীয় হিসেবে চাকমারাই কি তাহলে রামু জনপদে নিয়ে এসেছিল নিজেদের পরমাত্মীয় শাক্যমুনি গৌতমবুদ্ধের বক্ষাস্থির অংশবিশেষ?

রামু জনপদে বসবাসকে ভিত্তি করে চাকমাদের ইতিহাস, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির উপর বেশ কিছু জটিল প্রশ্নের উত্তর দেয়া যেতে পারে, যা আমরা পরবর্তীতে আলাপ করবো। (চলবে)।

চাকমাজাতির আদিনিবাস সন্ধানে-৩ -- By Pulak Khisa


এই পর্বে আমরা ভারতের ত্রিপুরায় চাকমাদের সম্ভাব্য চম্পকনগরের অবস্থান জানার চেষ্টা করবো যেখান থেকে চাকমাদের আদিরাজা বিজয়গিরি ও সেনাপতি রাধামন চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলের উদ্দেশ্যে বিজয় অভিযানে যাত্রা করেন।

চাকমারকূলে চাকমা নেই, চাকমাঘাটে চাকমা নেই
--------------------------------------------------------
আগের পর্বে আমরা দেখেছি সপ্তম শতাব্দী থেকে চট্টগ্রাম রামু এলাকায় হরিকেল রাজ্য ছিল যার রাজধানী ছিল চম্পক নগর। নবম শতাব্দীতে বিরচিত ‘কর্পূর-মঞ্জুরী’ নাটকে হরিকেলের রাজধানী হিসেবে এই নাম দেখা যায়। একমাত্র চাকমারা ছাড়া এতদঅঞ্চলের অন্য কোন জাতির এই নাম ব্যবহার করার কথা নয়। কাজেই সপ্তম শতাব্দী থেকে চাকমারা এই অঞ্চলে ছিল বলে ধারণা করা যায়। এখন আমরা দেখি চাকমাদের ইতিহাস মতে এতদঅঞ্চলে বিজয়গিরির অভিযান কখন পরিচালিত হয়েছিল। ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের দ্বিতীয় পরিচ্ছদের বর্ণনা মতে এই অভিযান পরিচালিত হয়েছিল আনুমানিক ৫৯০ খৃষ্টাব্দে (পর্ব -৩, সংযুক্তি–১)। ষষ্ঠ শতাব্দীর একদম শেষের দিকে বিজয়গিরির চট্টগ্রাম, রামু অঞ্চলে অভিযান ও বিজয় এবং ইতিহাসের বর্ণনামতে তাদের এতদঅঞ্চলে বসতি স্থাপনের সাথে সপ্তম শতাব্দীতে এই অঞ্চলে হরিকেল রাজ্যের উত্থান এবং ঐ রাজ্যের রাজধানীর নাম তাদের প্রাচীন রাজ্য বা রাজধানী চম্পকনগরের সাথে মিল থাকা ইত্যাদির মাধ্যমে চাকমাদের ইতিহাসের সামঞ্জস্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
এখন আমরা দেখি রাজা বিজয়গিরি কোন অঞ্চল থেকে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, অর্থাৎ চট্টগ্রাম, রামু জনপদে আসার আগে বিজয়গিরির দেশ কোথায় ছিল এবং চাকমাদের ইতিহাসে বর্ণিত তাঁর অভিযান পরিচালনার বর্ণনার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু।
বিপ্রদাস বড়ুয়া সম্পাদিত শ্রীমাধবচন্দ্র চাকমা কর্ম্মী বিরচিত ‘শ্রীশ্রীরাজনামা বা চাকমা জাতির ইতিহাস গ্রন্থ’ অনুসারে রাজা বিজয়গিরির পিতৃমহ রাজা ভীমঞ্জয়, তার পুত্র সাংবুদ্ধা, যার দুই পুত্র বিজয়গিরি ও উদয়গিরি। রাজা ভীমঞ্জয়ের কালাবাঘা নামে একজন সেনাপতি ছিল, যিনি রাজার আদেশে দিগ্বিজয় মানসে প্রভূত সৈন্য নিয়ে ‘লোহিত্য’ বা ‘কপিলা’ নদীর পরপারস্থ রাজ্যসমূহ জয় করার ইচ্ছায় ক্রমশঃ পূর্ব দক্ষিণ দিক জয় করতঃ তথায় কালাবাঘা নামে এক রাজ্য স্থাপন করেন এবং ঐ রাজ্যের প্রান্তভাগে নূতন চম্পানগর নামে এক নগর স্থাপন করে রাজধানী করেন। উক্ত গ্রন্থের টিকায় বর্ণিত হয়েছে যে ‘লোহিত্য’ বা ‘কপিলা’ নদী ব্রহ্মপুত্রের নামান্তর, যা ত্রিপুরার রাজমালার দ্বিতীয় লহর মধ্যমণির ৩১৫ নং পৃষ্ঠায়ও উল্লেখ করা হয়েছে আর অচ্যুতচরণ চৌধুরী তাঁর ‘শ্রীহট্টের ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্রীহট্ট জিলা পূর্বে কালাবাঘা রাজ্য নামে অভিহিত হতো বলে উল্লেখ করেছেন। ‘শ্রীশ্রীরাজনামা’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে ভীমঞ্জয়ের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র সাংবুদ্ধা রাজা হন। নূতন চম্পানগরের শাসনকর্তা সেনাপতি কালাবাঘার মৃত্যু হলে রাজা সাংবুদ্ধা তদস্থলে বিজয়গিরিকে শাসনকর্তারূপে প্রেরণ করেন। বিজয়গিরি কালাবাঘায় পৌঁছে স্বীয় আধিপত্য দৃঢ় করেন এবং দিগ্বিজয়ের জন্য এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করেন। স্বর্গীয় বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা তাঁর ‘চাকমা জাতি ও সমসাময়িক ইতিহাস’ গ্রন্থে পুরাতন আসাম প্রদেশের কিয়দংশ, শ্রীহট্ট জেলা, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণ বাড়িয়া জেলা, পার্বত্য ত্রিপুরার বৃহদংশ ও চট্টগ্রামের উত্তর অংশ নিয়ে কালাবাঘা রাজ্য গঠিত ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন। এখন আমরা দেখি উপরিবর্ণিত স্থানে যুবরাজ বিজয়গিরি পিতৃরাজ্য থেকে দূরে দ্বিতীয় চম্পকনগরে যে তার আধিপত্য দৃঢ় করেছিলেন তাঁর প্রমাণ কতটুকু। এতদুদ্দেশ্যে গুগুল ম্যাপ থেকে নেয়া উপরে বর্ণিত স্থানসমূহের একটি মানচিত্র ‘পর্ব-৩ এর সংযুক্তি-২’ এ দেখা যেতে পারে। সংযুক্ত এই মানচিত্রে প্রাচীন কালাবাঘা নামক বর্ণিত রাজ্যের জন্য চিহ্নিত জনপদে চাকমাদের ইতিকাহিনীর সহিত সংশ্লিষ্ট নিম্নবর্ণিত স্থানসমূহ দেখা যায়, যা সংযুক্ত গুগুলম্যাপে চিহ্নিত করা হয়েছেঃ
১) বিজয়নগর – বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি উপজেলা, স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা এ ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল বিধায় স্মারক হিসেবে ২০১০ সালে এই উপজেলার নামকরণ করা হয় বিজয়নগর। তবে আমরা পরবর্তীতে বিজয়গিরির নামের সাথে বিজয়নগরের কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা তা খুঁজে দেখতে পারি।
২) চম্পকনগর-১ – ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার একটি ইউনিয়ন।
৩) চম্পকনগর-২ – উপরে উল্লেখিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চম্পকনগর-১ থেকে বেশি দূরে নয়, কিন্তু ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরায়।
৪) চাকমাঘাট – ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরায় উপরের ৩ নং ক্রমিকে উল্লেখিত চম্পকনগরের সন্নিকটে।
৫) উদয়পুর – এর নাম ছিল রাঙ্গামাটি যা ত্রিপুরা রাজাদের বংশাবলী সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘শ্রীরাজমালা’-র বর্ণনামতে লিকা নামক মঘ সম্প্রদায় কর্তৃক শাসিত হত। তাদের থেকে ত্রিপুরার রাজা জুঝারু ফা এই স্থান দখল করেন এবং ঐ নামে প্রায় হাজার বছর ধরে ত্রিপুরার রাজধানী ছিল। পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীতে ত্রিপুরা মহারাজ উদয় মাণিক্য রাঙ্গামাটির নাম পরিবর্তন করে নিজের নামানুসারে উদয়পুর রাখেন।
৬) চম্পকনগর-৩ – উদয়পুরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে দক্ষিণ ত্রিপুরায় চম্পকনগর, বাংলাদেশের ফেনী জেলা সঙ্গলগ্ন।
৭) বিজয়নগর-২ - চম্পকনগর-৩ থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে দক্ষিণ ত্রিপুরায় চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্নিকটে।
৮) রাঙ্গামাটি – সিলেটের দক্ষিণ-পূর্বে আসামের করিমগঞ্জ জেলায়।
৯) চম্পকনগর-৪ – সিলেটের পূর্বদিকে, আসামের করিমগঞ্জ।

উপরের স্থানসমূহের অবস্থান পর্যালোচনা করে কালাবাঘা রাজ্যটি যে সিলেটের সন্নিকটস্থ আসাম, ত্রিপুরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইত্যাদি অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ হওয়াতে রাজ্যটি এখন আর নেই, কিন্তু বিভক্ত অঞ্চলগুলোর প্রত্যেকটিতে সেই রাজ্যের জনপ্রিয় নগর চম্পকনগর রয়ে গেছে, সেই সাথে আছে রাঙ্গামাটি, যেটি চম্পা বা চম্পকনগরের মত প্রাচীন বঙ্গ-ভারতবর্ষের একটি প্রাচীন নগর এবং চাকমাদের একটি প্রিয় নগর, যুগে যুগে চাকমারা যেখানে গেছে হয়তো এই নগরের নামটিও সাথে নিয়ে গেছে। উপরে উল্লেখিত জায়গাগুলো সম্বন্ধে পরে বলবো। তদুপরি আগে যেমন বলা হয়েছে, কালাবাঘার চম্পকনগর হলো দ্বিতীয় চম্পকনগর। সেক্ষত্রে আমাদের কালাবাঘার আগের চম্পকনগরও খুঁজতে হবে। ভারতে, আসামে আরো চম্পকনগর, বিজয়নগর, রাঙ্গামাটি রয়ে গেছে। তবে এই মুহূর্তে আমাদের কাজ হলো ত্রিপুরা বা কালাবাঘা অঞ্চলের চম্পকনগরকে তুলে ধরা যেখান থেকে বর্তমান চাকমাদের আদিরাজা বিজয়গিরি এবং তাঁর সেনাপতি রাধামন রোয়াং বা চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলে অভিযান চালিয়েছিলেন।
‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে দেখা যায় রাজা বিজয়গিরি সেনাপতি রাধামনসহ ৭ চিমু (২৬ হাজার) সৈন্য নিয়ে রোয়াংদেশ বা চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলে অভিযানের জন্য তার রাজ্য থেকে দক্ষিণ দিকে গমন করেন। তদকালীন ত্রিপুরা রাজা তাঁর সাহায্যার্থে কুঞ্জধন নামে এক সেনাপতিকে একদল সৈন্যসহ রাধামনের সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। তারা প্রথমে খৈ গাং (খৈয় নদী) পার হয়ে আসেন। গেংখুলীর গানে এ বিষয়ে এভাবে উল্লেখ আছে (পর্ব-৩, সংযুক্তি–৩)-
“নাজের উল্লাসে রাধামন,
খৈ গাঙত পল্লাক্কি সৈন্যগণ”।

অর্থাৎ সৈন্যবাহিনী খৈয় নদীতে উপস্থিত হলে সেনাপতি রাধামন আনন্দ উল্লাস করেন। আমরা এখন গুগুল ম্যাপ থেকে দেখি বিজয়গিরি উপরে বর্ণিত খৈয় নদীতে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। এই উদ্দেশ্যে ইতোপূর্বে ক্রমিক নং - ৪ এ উল্লেখিত “চাকমাঘাট” স্থানটিকে গুগুল ম্যাপ থেকে সম্প্রসারিত আকারে সংযুক্তি-৪ ও ৫ এ দেখানো হল। স্পষ্টতই চাকমাঘাট এলাকাটি ‘খোয়াই নদী’র সাথে। বর্তমানে ঐ নদীতে বাধ দেয়া হয়েছে যা Chakmaghat Barrage নামে গুগুল ম্যাপ ও স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে। স্নেহভাজন অ্যাডভোকেট Nicolas Chakma নাকি ত্রিপুরার চাকমাঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তার কাছে শুনলাম সেখানে এখন কোন চাকমা নেই, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ধামাই গোষ্ঠীর লোকজন সেখানে বাস করে, তাদের নারীরা চাকমা নারীদের মত পিনোন-খাদি পরে, তবে তাদের পিনোনে নাকি চাবুঘী নেই। ত্রিপুরার শ্রীরাজমালা গ্রন্থে অবশ্য ধামাই জাতিকে মগজাতির শাখা বিশেষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজমালার প্রথম লহর (যুঝার খণ্ড) ৪৯ নং পৃষ্ঠায় লেখা আছে (পর্ব-৩, সংযুক্তি-৬)-
রাঙ্গামাটি দেশেতে যে লিকা রাজা ছিল ।
সহস্র দশেক সৈন্য তাহার আছিল ॥
ধামাই জাতি পুরোহিত আছিল তাহার।
অভক্ষ্য না খায়ে তারা সুভক্ষ্য ব্যভার ॥
আকাশেত ধৌত বস্ত্র তারাহ শুখায়।
শুখাইলে সেই বস্ত্র আপনে নামায় ॥
বৎসরে বৎসরে তারা নদী পূজা করে।
স্রোত যে স্তম্ভিয়া রাখে গোমতী নদীরে ॥

এখানে রাঙ্গামাটি হল লিকা সম্প্রদায় থেকে ত্রিপুরা রাজা কর্ত্তৃক অধিকৃত বর্তমান উদয়পুর যা উপরে ক্রমিক নং-৫ এ উল্লেখ করা হয়েছে। রাজমালার টিকায় লিকা এবং ধামাই দুই জাতিকে মঘ জাতির শাখা বিশেষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে রাঙ্গামাটি নামটি নিঃসন্দেহে মূল আরাকান/মিয়ানমার থেকে আগত মঘ বা আরাকানী জাতির দেয়া নাম হতে পারেনা। আর মঘ জাতির মধ্যে ধামাই নামে কোন সম্প্রদায় আছে বলে শোনা যায়না, বরং চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে ধামাই নামক গোঝা/গোষ্ঠী রয়েছে, আর চাকমারা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হলেও নদী বা গাঙপূজা এখনো করে, চৈত্র সংক্রান্তিতে ফুলবিঝুর দিনে নদীতে গিয়ে ফুল দিয়ে পূজা করে। অন্যদিকে চম্পকনগরের মত রাঙ্গামাটি নামটিও সম্ভবতঃ চাকমারা যেখানে গেছে সাথে নিয়ে গেছে। খুব সম্ভব সেই ষষ্ঠ শতাব্দীতে চাকমারা তখনো ‘চাকমা’ নামে এত পরিচিতি লাভ করেনি, তখনো বৌদ্ধ ধর্মের ধারক-বাহক মৌর্য সম্রাট অশোকের ‘মগধ’-এর নাম এত সুপরিচিত ছিল যে প্রাচীন বিহার, ভারত, আরাকানের যে কোন বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে সম্ভবতঃ মগ নামে অভিহিত করা হত। এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলাপ করা যাবে (কারণ এত দীর্ঘ আলোচনা এক পর্বে ফেসবুকে দিলে লেখাটি একঘেঁয়ে লাগতে পারে)।

এখন ‘খৈ গাঙ’ বা ‘খোয়াই নদী’র অবস্থান জানার পরে ‘ঠেওয়া’ নামে আরেক নদীর অবস্থান আমরা খুঁজি। ‘শ্রীশ্রীরাজনামা’ গ্রন্থের মতে রোয়াং রাজ্যে পৌঁছার আগে এই নদীর তীরে প্রথম শিবির স্থাপন পূর্বক রাজা বিজয়গিরি সেনাপতি রাধামনকে মগরাজ্য আক্রমণের অনুমতি প্রদান করেন। উক্ত গ্রন্থের ৪৭ নং পৃষ্ঠার টিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, “ঠেওয়া নদী কোথায় জানা যাইতেছে না”। আমরা চাকমারা অনেক ক্ষেত্রেই অন্তস্থঃ ‘গ’-কে অ-উচ্চারণ করি। যেমন খাগড়াছড়ি জায়গাটি মূলতঃ চাকমা ভাষায় বলা হয় “হাআরাসরি’, ‘নাগরি’-কে উচ্চারণ করা হয়, ‘নাঅরি’, ‘বাগান’-কে ‘বাআন’। তাই ‘ঠেওয়া’ নদীটি চাকমা ভাষায় ‘থেআ’ হবে যা বাংলায় ‘থেগা’, ইংরেজিতে “Thega” লেখা হয়। তার অর্থ হলো বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলা ও মিজোরাম সীমান্তে থেগা নদীর তীরে সম্ভবতঃ থেগামুখ অর্থাৎ থেগা নদী যেখানে এসে কর্ণফুলীতে মিশেছে সেই স্থানে এসে বিজয়গিরি শিবির স্থাপন করলেন। প্রশ্ন জাগে এই স্থানে এসে শিবির স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন কি কারণে? কারণ ছিল রোয়াং রাজ্য বা রামু ছিল সাগর তীরে, সেখানে যেতে হলে নৌপথে সাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হবে। গেংখুলী গীত এর ভাষায়ও গাওয়া হয়েছে -

অপার পানি সাগর বেই, কুল-কিনারা দেঘা নেই,
জাদিপুজাত তে ঘি দিল, রোয়্যাঙ্গা দেঝত তে কুলেল।
(স্বর্গীয় বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা, ‘চাকমা জাতি ও সমসাময়িক ইতিহাস’ – পৃঃ ৩২)

অর্থাৎ সাগর বেয়ে তারা রামু বা রোয়াং দেশে উপনীত হয়। এই লেখার প্রথম পর্বে যেমন উল্লেখ করেছি রামু ঠাঁই পেয়েছে ১৮৫৮ বছর আগের টলেমির ভুগোল গ্রন্থে। সেই হিসেবে আরব বণিকদের মত চাকমারাও হয়ত জানত সেখানে যেতে হবে জলপথে – থেগা, কর্ণফুলী হয়ে। কিন্তু ২৬ হাজার সৈন্য বহন করার মতো নৌকা সেই পাহাড়ি পথে সাথে বয়ে নিয়ে যাওয়া বিজয়গিরি-রাধামনদের নিশ্চয় সম্ভব ছিলোনা। তাই এই প্রস্তুতির জন্য থেগাতে তারা শিবির স্থাপন করলেন। এই শিবিরে বসে তাঁরা নৌকা তৈরি করেছিলেন কিনা জানা নেই, তবে সহজ সমাধান ছিল থেগার দুপাশের পাহাড় থেকে বাঁশ কেটে ঝটপট ভেলা তৈরি। চাকমারা সেই আদিকাল থেকে ‘কাত্তোন’ অর্থাৎ বাঁশ কাটা আর সেটা দিয়ে ভেলা তৈরিতে অভ্যস্ত, এখনো কাপ্তাই-এ বাধ দেয়ার পরে কয়েক কিলোমিটার প্রশস্ত কর্ণফুলী নদীর বুকে কিলোমিটার দীর্ঘ ভেলার সারি বানিয়ে চন্দ্রঘোনার পেপার মিলে তারা বাঁশ সরবরাহ করে। আর নৌকা ফুটো হলে ডুবে যায়, কিন্তু ভেলাতে সেই ভয় নেই। তাই ২৬ হাজার সৈন্য হয়তো ঝটপট কয়েক হাজার ভেলা বানিয়ে ফেলেছিল। ভাবতে সে এক মজার দৃশ্য হবে নিঃসন্দেহে। তবে তারপরেও রামু পর্যন্ত পৌঁছা হয়তো অত সহজ ছিলোনা। তার আগে কর্ণফুলীর মোহনায় দিয়াং (দিগাং<(চা)দিগাং?) নামক স্থানে প্রতিপক্ষ মগ রাজার সাথে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে জয়ী হলে চাকমারা আরো দক্ষিণে রোয়াং দেশ বা রামুতে অগ্রসর হয়।

খৈ গাঙ বা খোয়াই নদী অতিক্রম করার বর্ণনা থেকে আমরা বিজয়গিরি ও রাধামন কোন চম্পকনগর থেকে থেগা-কর্ণফুলী হয়ে রোয়াং রাজ্য গমণ করেছিলেন তার ধারণা করতে পারি। সিলেটের সন্নিকটে আসামের করিমগঞ্জ জেলার চম্পকনগর থেকে ‘থেগা’ গেলে আদৌ খোয়াই নদী অতিক্রমের দরকার পড়েনা। অন্যদিকে পশ্চিম ত্রিপুরার চম্পকনগর খোয়াই নদী থেকে বেশি দূরে নয়, তাই এখান থেকে যাত্রা করলে খোয়াই নদীর তীরে পৌঁছাটা গেংখুলী গীতিকাব্যে রাধামনের আনন্দ উল্লাস করার মতো এই অভিযানের একটি মাইলফলক হতে পারে বলে বিবেচিত হয়না। তাই বিজয়গিরির বাহিনী বর্তমান বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চম্পকনগর থেকে যাত্রা করে, ত্রিপুরার রাণীর বাজার, চম্পকনগর, বড়মুড়া হয়ে তেলিয়ামুড়ার সন্নিকটে খোয়াই নদী অতিক্রম করে বলে অনুমিত হয়। গুগুল ম্যাপ থেকে থেগা পর্যন্ত এই অভিযানের সম্ভাব্য গতিপথ পর্ব-৩, সংযুক্তি-৭ ও ৮ এ পদর্শিত হল।

এখানে উল্লেখ্য হাজার বছর ধরে চাকমাদের ইতিহাস নিয়ে বংশ পরম্পরায় গান করে আসছে যে গেংখুলীরা তাদের সিংহ ভাগ ছিলেন বাংলাভাষায় অশিক্ষিত। আজকে আমরা খুব সহজেই গুগুল ম্যাপে অনুসন্ধান করে তাদের বর্ণিত ‘খৈ গাং’ এর অবস্থান এবং ত্রিপুরার চাকমাঘাট জায়গা/তালুক এর অবস্থান ও তার উপর ভিত্তি করে ত্রিপুরায় চাকমাদের চম্পকনগর অন্বেষণের চেষ্টা করছি। কিন্তু এই গেংখুলীরা হয়তো জীবনে ত্রিপুরার চম্পকনগর, খোয়াই নদী, চাকমাঘাট ইত্যাদি এলাকা ভ্রমণ করেননি, বরং উত্তরসূরী হিসেবে পূর্বপুরুষদের গাওয়া লোকগীতি বংশ পরম্পরায় গেয়ে আসছেন। তাই এগুলো তাদের নেহাৎ বানানো কাহিনী হিসেবে উড়িয়ে দেয়া সমীচিন হবেনা, বরং এগুলো সংগ্রহ করে সেখান থেকে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে। আগামীপর্বে ত্রিপুরা-কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানের নামের ভিত্তিতে চাকমাদের এসব অঞ্চলে বসবাসের আরো সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপনের প্রচেষ্টা থাকবে।

উপরের এবং এর আগের পর্বের আলোচনা সমালোচনা থেকে দেখা যায় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষে ত্রিপুরা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-সিলেট অঞ্চলের চম্পকনগর থেকে চাকমারা চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে সম্ভবতঃ হরিকেল বা হরিখোলা নামের রাজ্য স্থাপন করে যার রাজধানীও চম্পকনগর নামে অভিহিত হয়। তাদের জাতির নামানুসারে জায়গা চাকমাঘাট, চাকমারকূল এখনো এসব অঞ্চলে এককালে তাদের শাসন, তাদের বসবাসের সাক্ষ্য বহন করে। কালের প্রবাহে চাকমাঘাট, চাকমারকুল এই দুই জায়গাতেই আর কোন চাকমা নেই। (চলবে)।

চাকমাজাতির আদিনিবাস সন্ধানে-২ -- By Pulak Khisa

আদিবাসী বন্ধুদের সবাইকে আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা।

এবারের পোস্ট থেকে আমরা যা জানবোঃ
১) প্রাচীন ভারত বা বর্তমান বাংলাদেশের পূর্বাংশে আরাকান সংলগ্ন বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলে হরিকেল নামে এক প্রখ্যাত ও সম্মৃদ্ধশালী রাজ্য বা জনপদ ছিল।
২) এই হরিকেলের রাজধানী ছিল চম্পানগরী বা চম্পকনগর যা সম্ভবত চাকমাদের আদিবাসস্থানের একটি।
৩) হরিকেলের রাজারা সম্ভবতঃ একসময় চাকমাদের আদিরাজা বিজয়গিরির অনুরূপ ‘গিরি’ উপাধি ধারণ করতেন এবং এই উপাধিতে রৌপ্য মুদ্রাও প্রবর্তন করেছিলেন।

আগের পর্বে আমরা জেনেছি একসময় চাকমাদের বসবাস ছিল প্রায় ২০০০ বছর প্রাচীন ঐতিহাসিকভাবে সম্মৃদ্ধ রামু জনপদে। তবে চাকমারা এই রামু জনপদে কখন থেকে বসবাস করে এসেছে সে সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়না। আমাদের সিংহভাগ ইতিহাসবিদ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যে চাকমারা এসেছে আরাকান-রামু হয়ে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে। কিন্তু এই ইতিহাসবিদরা এটা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেননি যে এককালে রামু-চট্টগ্রাম এসব অঞ্চল আরাকানেরই শাসনাধীন ছিল এবং চাকমারা বর্তমান আরাকানে বসবাস না করলেও তারা এককালে আরাকান অধীনস্ত রামু-চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে বিধায় আরাকান থেকেই এখানে এসেছে হিসেবে অভিহিত করা যায়। যেমন চাকমাদের ইতিহাসমতে রাজা ফতে খাঁ ১৭১৫ থেকে ১৭৩৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন এবং বিগত প্রায় তিন শত বছর ধরে রামু জনপদে তাঁর নামে জায়গার নাম রয়েছে, কাজেই ধরা যায় যে সেই অষ্টাদশ শতকেও চাকমারা সেই অঞ্চলে শাসন ও বসবাস করতো। চাকমারা কি এর আগেও চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করতো, নাকি পরে রামু থেকে এই পাহাড়ী অঞ্চলে আসে? যেমন পর্তুগীজ ইতিহাসবিদ Joao de Barros (১৪৯৬-১৫৭০) ষোড়শ শতকে এতদ অঞ্চলের যে মানচিত্র (https://mappingbengal.com/the-de-barros-map) প্রণয়ন করেন তাতে Chacoma নামে যে স্থান প্রদর্শিত হয়েছে তা আরাকান ও ত্রিপুরার মাঝামাঝি অঞ্চলে চাকমারা বর্তমানে যে জায়গায় বসবাস করছে মোটামুটি তার সন্নিকটেই (সংযুক্তি-১)। অন্যদিকে ষোড়শ শতাব্দীতে বিরচিত রাজমালার দ্বিতীয় লহরে যে মানচিত্র সন্নিবেশিত হয়েছে তাতে চাকমাদের অবস্থান ‘চাখমা’ হিসাবে চট্টগামের সাথেই (সামান্য দক্ষিণে) প্রদর্শিত হয়েছে (সংযুক্তি-২)। কাজেই উপরে বর্ণিত দুই মানচিত্রের তথ্য যদি সত্য হয় তাহলে ষোড়শ শতাব্দীতেও চাকমারা চট্টগ্রাম ও তার আশেপাশের এলাকায় বসবাস করত। তারও আগে কি চাকমারা এতদঅঞ্চলে ছিল? পরবর্তী আলোচনাগুলো হয়তো তার কিছুটা তথ্য দেবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বাধিক নিকটে যে চম্পকনগর
-----------------------------------------------------------------

রামু, চট্টগ্রাম ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে চাকমাদের অবস্থান বিষয়ে আমরা আলাপ করছিলাম। তারমধ্যে চাকমাদের আদি বাসস্থান চম্পকনগর সম্পর্কে এখনো কোন আলাপ করা হয়নি। আগে যেমন উল্লেখ করেছি আমাদের ইতিহাস লেখকগণ ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন চম্পা নগরীর উল্লেখ করেছেন যার বিস্তৃতি ভারতের হিমাচলের চাম্বা থেকে সুদূর ভিয়েতনামের চম্পা পর্যন্ত বিস্তৃত। আমার মনে হয়েছে এতদুদ্দেশ্যে উপমহাদেশে এবং সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত যে কয়টি চম্পা-নগরী বা চম্পক নগর পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে পারস্পরিক একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে আমি এখানে এমন এক চম্পা বা চম্পকনগরীর কথা বলবো যা ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিভিন্ন চম্পা বা চম্পকনগরীর মধ্যে চাকমাদের বর্তমান বাসস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে নিকটে, কিন্তু আমার জানামতে এত নিকটে থাকা সত্বেও ইতোপূর্বে কোন গবেষক বা ইতিহাসবিদ চাকমাদের সাথে সম্পর্ক টানতে এই চম্পকনগরীর কথা উল্লেখ করেননি। অবশ্য আমি নিজে অন্য আরেক গ্রুপে এ সম্বন্ধে আগেও লিখেছি। কিন্তু তবুও এখানে লিখছি ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে যে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছি অনেক দূরের চম্পকনগর থেকে নয়, সম্ভবতঃ খুব কাছের সেই চম্পকনগর থেকে। হাঁ, আমি আলোচনা করতে চাচ্ছি চট্টগ্রাম বা তদসংলগ্ন এলাকায় হরিকেল (সযুক্তি-৩) নামক প্রাচীন রাজ্য বা জনপদের রাজধানী চম্পা-নগরী বা চম্পক-নগরকে নিয়ে, যেখানে সম্ভবতঃ চাকমাদের গিরি উপাধিধারী রাজারা শাসন ও বসবাস করতেন।

হরিকেল সম্পর্কে বাংলাপিডিয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে (http://bn.banglapedia.org/index.php…) –
“হরিকেল প্রাচীন পূর্ববঙ্গের একটি জনপদ। এর শনাক্তীকরণ নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। খ্রিস্টীয় সাত শতকের প্রাচীন ভারতীয় লেখকগণ পূর্বভারতীয় একটি অঞ্চলকে হরিকেল বলে উলে¬খ করেন। এটি পূর্ববঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। সাত শতকের চৈনিক পরিব্রাজক ই-ৎসিঙ্ হরিকেলের অবস্থানকে ‘পূর্বভারতের পূর্বসীমা’য় নির্দেশ করেন। নয় শতকের সাহিত্য কর্ম কর্পূরমঞ্জরীতে এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। এতে হরিকেলের রমণীগণকে পূর্ব বঙ্গীয় নারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
…………………. চন্দ্র বংশের লেখসমূহের উপর পর্যালোচনা ও গবেষণা এবং বঙ্গে তাদের বিজয় সম্পর্কে যথার্থ বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, আরাকান সীমান্তবর্তী চট্টগ্রাম এলাকায় এ রাজ্য অবস্থিত ছিল। এ ধারণার আরও জোরালো সমর্থন পাওয়া যায় চট্টগ্রামে কান্তিদেবের তাম্রশাসনের আবিষ্কারে।”
বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে হরিকেল বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলে খুব সম্ভবত রামু, দিয়াঙ্গ অথবা চট্টগ্রামের নগরাঞ্চলে অবস্থিত ছিল।
দৈনিক প্রথম আলোর ৩১ শে আগষ্ট ২০১৩ সংখ্যায় “হরিকেল থেকে চট্টগ্রাম” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় (http://archive.prothom-alo.com/…/date/2012-04-06/news/238162)। ‘অদম্য চট্টগ্রাম উৎসব’ শিরোনামে ডেইলি স্টার আয়োজিত প্রদর্শনীর আলোকে এই প্রবন্ধে বিশ্বজিৎ চৌধুরী লেখেনঃ
“অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু ইতিহাস বলছে, চৌদ্দ শ বছরের এক প্রাচীন শহরের নাম চট্টগ্রাম। আমরা জানি, ৯০০ বছরের প্রবীণ নগর লন্ডন, আমাদের রাজধানী ঢাকার রয়েছে ৪০০ বছরের ইতিহাস; আর বছর কয়েক আগে ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বর্ণময় উৎসবের আয়োজন হয়েছিল কলকাতা নগরে। চট্টগ্রামের ইতিহাস এই প্রসিদ্ধ নগরগুলোর চেয়েও দীর্ঘ।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ইৎসিঙ নামের একজন চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রথম উল্লেখ করেন ভারতের পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে হরিকেল নামে একটি রাজ্য আছে। এই ‘হরিকেল’ই যে চট্টগ্রাম, এই তথ্য উঠে আসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বিএন মুখার্জির গবেষণায়। এই খ্যাতিমান মুদ্রাবিশারদ হরিকেল রাজ্যে প্রচলিত মুদ্রা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন, সমৃদ্ধ এই রাজ্য ছিল কর্ণফুলী নদীর তীরে, যা কালক্রমে চট্টগ্রাম নামে পরিচিতি পায়। বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের জার্নালে এ তথ্য প্রকাশ করেন তিনি।
আরাকান, ত্রিপুরা ও মোগল—এই তিন রাজশক্তির লড়াইয়ের ক্ষেত্র ছিল চট্টগ্রাম। বহুকাল চলেছে এই দখল প্রতিষ্ঠার লড়াই। মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মুনিম খান ১৫৭৫ সালের ৩ মার্চ আফগান শাসক দাউদ খার কররানীকে পরাজিত করলে মোগল সাম্রাজ্যের অধিকারে আসে বাংলা। কিন্তু এরপর আরও প্রায় ৮০ বছর পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে যায় অধরা। অবশেষে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি ‘কর্ণফুলীর যুদ্ধে’ মোগল নৌবাহিনী জয়লাভ করে। আসলে এই লড়াই ও জয়ের মধ্য দিয়েই বঙ্গ বা বাংলার সঙ্গে যুক্ত হয় চট্টগ্রাম” ।

ইতিহাসবিদরা হরিকেলের অবস্থান সনাক্তকরণ বিষয়ে মনোনিবেশ করলেও এর রাজধানী চম্পানগরী বা চম্পকনগর সম্পর্কে খুব বেশি আলোকপাত করেননি। সম্ভবতঃ এই বিষয়টি তাঁদের গবেষণায় কোন উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে এত সন্নিকটে থাকা চম্পক নগরী আমাদের অগোচরে রয়ে গেছে।

ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর History of Bengal, Vol-1 গ্রন্থে ভারতের পূর্বাংশে হরিকেল রাজ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন –
Writers of the seventh century mention a country called Harikela. According to I-tsing it was the eastern limit of East India. The evidence of the Chinese writer is confirmed by that of the Karpura-Manjuri (9th Century A.D.) which includes Harikela girls among women of the east –
“Thou gallant of women of the east, though Champak-bloom ear-ornament of the town Champa, thou whose lustre transcends the loveliness of Radha, who hast conquered Kamrupa by thy prowess who providest merri mekings (Keli) for Harikeli”.

ডঃ মজুমদার উল্লেখিত নবম শতাব্দীতে বিরচিত কর্পূর-মঞ্জরী নাটকে আমরা দেখি হরিকেলের রাজাকে ‘পূর্বদিকপতি’ হিসেবে বিশেষিত করা হয়েছে, চম্পানগরের “চম্পক” কর্ণভূষণ, চম্পক-কোদণ্ড (চম্পক-ধনুর্ধর) নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে (সংযুক্তি-৪, ৫)। এও উল্লেখ করা হয়েছে যে অবলীলাক্রমে তিনি রাঢ়দেশ জয় করেছেন, ভূজবিক্রমে কামরূপ জয় করেছেন। এই বিবেচনায় দেখা যায় হরিকেল একসময় বঙ্গ বা রাঢ় এবং সিলেটসহ কামরূপ বা আসাম পর্যন্ত জয় করেছিল। তার রাজধানী ছিল চম্পানগরী বা চম্পকনগর।

Numismatic Society of India প্রকাশিত Coinage and Economy of North Eastern States of India গ্রন্থে ইতিহাস ও মুদ্রাতত্ববিদ ডঃ বি, এন মুখার্জী তাঁর ‘A survey of the Coinage of Harikela’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন – “Harikela or Hariketa was the name of a territory which in 7th century A.D. included inter alia the Chittagong district area (now in Bangladesh).”

হরিকেল যে অনেক সমৃদ্ধ জনপদ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই রাজ্যের রাজাদের ধাতব মুদ্রা প্রবর্তনের মাধ্যমে। ডঃ বি, এন মুখার্জী তাঁর উপরিবর্ণিত প্রবন্ধে হরিকেলের মুদ্রা সম্বন্ধে লিখেছেন –
“The Original Structures of the series of thin silver coins mentioned above were apparently inspired by the Arakan coinage. This is not impossible, since the Chittagong district region of the Harikela was contiguous to Arakan.”
ডঃ মুখার্জীর বর্ণনা থেকে দেখা যায় হরিকেলের অনেক মুদ্রায় ‘গিরি’ নামাঙ্কিত রয়েছে –
“Thus a silver coin, bearing a bull and tripartite symbol, is inscribed with a legend (La)lagiri ……….., Among such legends we can refer ……… Sivagiri, Jayagiri etc.”
হরিকেল মুদ্রার বড় ভাণ্ডার পাওয়া গেছে ময়নামতি ও ত্রিপুরার বিলোনিয়ায়। হরিকেল মুদ্রা মূলত সপ্তম ও অষ্টম শতকের দিকে এখনকার সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লার ময়নামতি ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় ব্যবহৃত হতো। সিলেট থেকে ৩০-৪০টি হরিকেল মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জোবরা গ্রামে পাওয়া গেছে ৩৫টি (https://www.kalerkantho.com/print-editi…/…/2017/04/29/491940)। এর থেকে বুঝা যায় হরিকেলের প্রভাব চট্টগ্রাম থেকে সিলেট বা আসাম পর্যন্ত ছিল। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংগৃহীত দুটি পরবর্তী সময়ের পাণ্ডুলিপিতে হরিকোলকে সিলেটের সমার্থক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, আর কর্পূরমঞ্জুরী নাটকে হরিকেলের রাজাকে কামরূপ বা আসাম বিজয়ী রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। এর সাথে উপরে উল্লেখিত হরিকেলের মুদ্রার ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনা করলে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পর্যন্ত হরিকেলের প্রভাব ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় –
১) প্রাচীন ভারত বা বর্তমান বাংলাদেশের পূর্বাংশে আরাকান সংলগ্ন বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলে হরিকেল নামে এক সম্মৃদ্ধশালী রাজ্য বা জনপদ ছিল।
২) এই হরিকেলের রাজধানী ছিল চম্পানগরী বা চম্পকনগর
৩) হরিকেলের রাজারা সম্ভবতঃ একসময় গিরি উপাধি ধারণ করতেন এবং এই উপাধিতে রৌপ্য মুদ্রাও প্রবর্তন করেছিলেন।
চাকমারা নিজেদের চম্পকনগর থেকে আগত এবং সেই নগরের রাজা বিজয়গিরির বংশধর বলে দাবী করে। এই বিবেচনায় আমরা কি বলতে পারি চম্পকনগরের গিরি উপাধিধারী চাকমা রাজারা আরাকান রাজাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রৌপ্য মুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন?
বাংলাপিডিয়ার ইতোপূর্বের বর্ণনা অনুসারে আমরা দেখেছি হরিকেলের জনগণ মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। উল্লেখ্য বিগত শতকেও চাকমারা মহাযানী আচার-আচরণ অনুসরণ করত এবং বেশি দেরী হয়নি তারা থেরবাদীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এটাও চাকমাদের হরিকেলের চম্পক নগরীর মহাযানী বৌদ্ধ জনগন হওয়ার দিকে ইঙ্গিত দেয়।
পরিশেষে বলতে হয়, উপরে যেমন বর্ণিত হয়েছে, চট্টগ্রাম বাংলার সাথে যুক্ত হয় ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে। কিন্তু তারও প্রায় হাজার বছর আগে সপ্তম শতাব্দীতে এই জনপদ হরিকেল নামে পরিচিত ছিল, যার রাজধানী চম্পক নগর বা চম্পা নগরীতে সম্ভবতঃ গিরি উপাধিধারী চাকমা রাজারা রাজত্ব করতেন এবং তাঁরা নিজেদের নামে রৌপ্যমুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন।
তুলনামূলকভাবে হরিকেল একটি ভিন্ন ধরণের নাম। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে হরিকেলকে কোন কোন ক্ষত্রে হরিকোলও বলা হয়েছে। চাকমারা নারিকেলকে বলে নারিকুল। সেক্ষেত্রে হরিকেলকে হরিকোল বা হরিকূল বলা অস্বভাবিক নয়। কারণ চাকমাদের জায়গার নামে রাজারকূল, চাকমারকূল, ফতেখাঁরকূল ইত্যাদি কূলযুক্ত স্থানের নাম আমরা আগেও দেখেছি।

শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০

এচ্যে চাঙমা রাজার চিগোন রানির সুনানু ইয়েন ইয়েন সিঝি জনমপুর: চাঙমা সাহিত্য বাহ্ তপ্পেত্তুন কোচপানা

 

এচ্যে ২১ আগস্ট ২০২০ ইংরেজি, ভাদমাজ ৫, ১৪২৭ বাংলা শুক্করবার চাঙমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়র চিগোন রানির (মক্কো) সিজি জনমপুর।

এক্কো পুঅ কুমর ত্রিভূন আর্য্য দেব রায় আ এক্কো ঝি রাজ কুমরী আয়েত্রী আরাধনা রায় ফেলে যেই চাঙমা রাজার পল্লে রাণী তাতু রায় ১৯৯৮ সালত মরি যায়।

দাঙর রাণি মরি যানার পর গেল্লে ৫ জুলাই ২০১৪ ইং দাঙর রাখাইন মিলে ইয়েন ইয়েন লগে চাঙমা সার্কেল কর্তা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়’ সমারে জধন অহ্’য়। 

অস্ট্রেলিয়ার এডিলেইড বিশ্ববিদ্যালয়ত পর্বোয়া বান্দরবানর ঝি ইয়েন ইয়েনর লগে চিনপচ্যে অহ্’লে ১২ ডিসেম্বর ২০১৪ ইং দ্বি’জনে আহ্নদিক পিনে দি-দি গরন।

এচ্যে চাঙমা রাজার, চাঙমাউন চিগোন রাণী ইয়েন ইয়েন জনমপুরত চাঙমা সাহিত্য বাহ্ তপ্পেত্তুন চাঙমা সাহিত্য বাহ্ গরা কমিতি জধানানু আ দাঙর কাবিদ্যাঙ সাইন গচ্ছে পেডত অতালিয়ে কোচপানা জানানার সমারে তার নিরোক আ ঈয়োত লাম্বা বর মাগি দিলাক। ইয়ান চাঙমা সাহিত্য বাহ্’ কামর পত্তম কাররে ফেসবুক টাইম লাইত অফিসিয়ালি পেডত কোচপানা জানানা। যনি মিঙিনি চাগালাত চাঙমা সাহিত্যিক সুনানু মুকুন্দ জনমপুর আ আনন্দমোহন চাঙমা জনমপুর পালে এত্তন। 

 

 




বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট, ২০২০

স্মৃতির অন্তরালে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান এবং তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি - Dhiman Khisa

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি সম্প্রদায় হতে নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনে যারা অগ্রগামী ছিলেন ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। পার্বত্যচুক্তি সম্পাদনের পূর্বে দীর্ঘ অনেক বছর যাবত তিনি পার্বত্য চট্টগাম জনসংহতি সমিতির অান্তর্জাতিক মূখপাত্র ছিলেন। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডে গেলে তিনি অার দেশে ফিরেননি। দীর্ঘ অনেক বছর যাবত বিদেশে অবস্থানের কারনে এখানকার সাধারন জনগণ তাঁর সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিফহাল নন। পাহাড়িদের স্বায়ত্বশাসন অান্দোলনে তাঁর অসামান্য অবদান থাকলেও সে সম্পর্কে খুব কম জনেই অবগত অাছেন। তরুন প্রজন্মের কাছে তিনি অজানাই রয়ে গেছেন। তাই কালের পরিক্রমায় তিনি মেঘে ঢাকা তারার ন্যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে অন্তরীণ হয়েছেন। এ মহান ব্যক্তির বীরত্বগাঁথা তুলে ধরার প্রয়াসে অামার এ ক্ষুদ্র লেখার অবতারনা।

তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জিঃ
ড. অার এস দেওয়ান ১৯৩২ সালে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার সদর উপজেলাধীন খবংপড়িয়া(খবংপুজ্যা) গ্রামে লার্মা গোজা পীড়েভাঙা গুত্তি(চাকমাদের গোত্র)র এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রমেশ চন্দ্র দেওয়ান ও মাতার নাম চন্দ্রমূখী দেওয়ান। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ সন্তান। তাঁর ডাকনাম ছিলো কুলকুসুম। তাঁর পিতামহ উগ্রমুনি ও অামার প্রপিতামহ বিরাজমুনি ছিলেন সহোদর ভাই। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে তিনি একদিন বংশের নাম উজ্জ্বল করবেন। তাইতো তাঁরা তাঁকে অাদর করে ডাকতেন কুলকুসুম। বড় হয়ে তিনি তাই হয়েছেন। শত প্রতিকুলতাকে ডিঙিয়ে শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি পিএইচডি অর্জনের মাধ্যমে তিনি শুধু বংশকে নয় গোটা জাতিকেই গৌরবান্বিত করেছেন।

শিক্ষাজীবনঃ
ড. অার এস দেওয়ানের শৈশব কেটেছে খবংপড়িয়া(খবংপুজ্যা)র নির্মল প্রকৃতি ও অালো-বাতাসের সান্নিধ্যে। অদম্য মেধাবী এ ব্যক্তির লেখা-পড়ায় হাতেখড়ি হয় Khabongporia Lower Primary School( বর্তমানে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলাধীন খবংপড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়)এ। উক্ত স্কুলে ২য় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তিনি চলে যান বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলাধীন নানিয়ারচর উপজেলার মহাপুরম(মাওরুম)এ। সেখানে অাপন ভগ্নিপতির অাশ্রয়ে মহাপুরম মিডল ইংলিশ স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান সংগঠক প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার পিতা চিত্ত কিশোর লারমা ছিলেন তাঁর অাপন ভগ্নিপতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার অালো বিস্তার সাধনের ক্ষেত্রে অগ্রণী পথিকৃৎ এবং অসংখ্য স্কুল প্রতিষ্ঠার পিছনে যার অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করতে হয় স্কুল ইন্সপেক্টর কৃষ্ণ কিশোর লারমা ছিলেন তাঁর ভগ্নিপতির বড়ভাই। কৃষ্ণ কিশোর লারমা ও চিত্ত কিশোর লারমা ভাইযুগল পার্বত্যাঞ্চলের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার অালোয় অালোকিত করার মহান ব্রত নিয়ে জ্ঞানের মশাল জ্বালানোর শুভসূচনা করেন এ মহাপুরম থেকে। তাই মহাপুরমকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার অালো বিস্তারের সুতিকাগার বললে অত্যুক্তি হবেনা। চিত্ত কিশোর লারমা তৎসময়ে মহাপুরম মিডল ইংলিশ স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।

ড. অার এস দেওয়ান মহাপুরম মিডল ইংলিশ স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর রাঙ্গামাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং উক্ত স্কুল থেকে বিজ্ঞান শাখায় সেন্টার ফার্স্ট হয়ে ১৯৫২ সালে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। সে সময় বিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠী ছিলেন খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের একসময়ের স্বনামধন্য প্রথিতযশা শিক্ষক নবীন কুমার ত্রিপুরা, বিশিষ্ট সমাজসেবক কংলাচাই চৌধুরী(খাগড়াছড়ি), মৃনাল কান্তি চাকমা(খবংপড়িয়া, খাগড়াছড়ি) ও ডা. সুব্রত চাকমা(রাঙ্গামাটি) প্রমুখ। ম্যাট্রিক পাশ করার পর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ সনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা প্রদানের সময় তাঁর মা মারা গেছে মর্মে একটি উড়ো চিঠি অাসলে তিনি পরীক্ষা বাতিল করে বাড়িতে চলে অাসেন। ফলে লেখাপড়ায় সহপাঠীদের কাছ থেকে একবছর পিছিয়ে পড়েন। সন্দেহ করা হয়, তাঁর মেধা ও যোগ্যতার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে এবং শ্রেষ্ঠত্বকে ঠেকানোর জন্য সহপাঠীদের মধ্যে কোন একজন গোপনে উড়ো চিঠি প্রদানের হীনকাজটি করেন। একবছর ক্ষতি হলেও তিনি ক্ষান্ত হননি। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৫৫ সনে পুনরায় একই কলেজ থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১ম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। অতঃপর তিনি ঢাকাস্থ অাহসান উল্লাহ ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। তৎকালীন সময়ে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার জন্য খুবই প্রসিদ্ধ ছিলো। উক্ত প্রতিষ্ঠানে দুই বছর পর্যন্ত পড়ার পর পাঠ্য বিষয়টির প্রতি মনোযোগী হতে না পারায় কোর্স সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে ১৯৫৭ সালে তিনি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়া ছেড়ে দেন এবং ঐ বছরই কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান UTAH Companyতে চাকুরি গ্রহণ করলে কাপ্তাইয়ে তাঁর পোস্টিং হয়। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল অাগ্রহের কারনে উক্ত চাকুরিতেও তিনি মন বসাতে পারেননি। তাই বছরখানেক পরে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৫৮সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং উক্ত ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৬১ সালে বিএ অনার্স(রসায়ন) ও ১৯৬৩ সালে এমএসসি(রসায়ন) সম্পন্ন করেন। উক্ত ডিগ্রীসমূহ অর্জনের পরেও তিনি ক্ষান্ত হননি। শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রী পিএইচডি অর্জনের অদম্য অাগ্রহকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য তিনি উপায় খুঁজতে থাকেন। তৎসময়ে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর এক অজ পাড়াগাঁর মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে বিদেশে গিয়ে ডিগ্রী অর্জনের বিষয়টি ছিলো অাকাশকুসুম কল্পনার মতো। কারন তাঁর পরিবারের পক্ষে এতো ব্যয়বহুল খরচ যোগান দেয়ার মতো অার্থিক সক্ষমতা ছিলোনা। তারপরেও তিনি দমবার পাত্র নন। অার্থিক অানুকুল্যতা সৃষ্টির জন্য তিনি অবশেষে ঢাকার সাইন্স ল্যাবরেটরিতে চাকুরি নেন। চাকুরির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ যোগাড় করা সম্পন্ন হলে পিএইচডি ডিগ্র্রী অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৬৭ সালে বিলেত(ইংল্যান্ড) গমন করেন লন্ডনের বিশ্বখ্যাত Salford University থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।

কর্মজীবন ও অবদানঃ
লন্ডনের Salford University থেকে পিএইচডি ডিগ্র্রী অর্জনের পর ড. অার এস দেওয়ান উক্ত ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা শুরু করেন। তৎসময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির স্বায়ত্বশাসন অান্দোলন শুরু হয়। উল্লেখ্য, এম এন লারমা ছিলেন তাঁর অাপন ভাগিনা। অান্দোলন ক্রমশঃ গতিশীল হতে থাকলে ড. দেওয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপনা ত্যাগ করে অান্দোলনে সম্পৃক্ত হন। পার্বত্যচুক্তি সম্পাদনের পূর্বে তিনি দীর্ঘ অনেক বছর যাবত জনসংহতি সমিতির অান্তর্জাতিক মূখপাত্র ছিলেন। জাতিসংঘসহ অান্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইস্যুটিকে সমাধানের জন্য স্মারকলিপি প্রদান করেন এবং অান্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন অাদায়ে গুরুুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পার্বত্য চট্টগাম বিষয়ক অান্তর্জাতিক কমিশন গঠনের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া অান্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সুদৃষ্টি ও সহযোগিতা অর্জনেও তাঁর অসামান্য অবদান ছিলো।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের রাজনৈতিক অধিকার অাদায়ের স্বার্থে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুখ, স্বপ্ন ও সম্ভাবনা সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছেন। এসব কিছু করতে গিয়ে তিনি বিয়ে করার বিষয়টি পর্যন্ত মাথায় অানেননি। তাই তিনি চিরকুমার রয়ে গেছেন এবং বর্তমানে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে নিজস্ব এ্যপার্টমেন্টে বৃদ্ধ বয়সে একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন।

অতীব দুঃখের বিষয় যে, সমাজ ও জাতির কল্যাণে এতো কিছু করার পরেও জাতির কাছে তাঁর সে অসামান্য অবদান কতটুকু মূল্যায়িত হয়েছে সে প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। তাঁকে সম্মাননা জ্ঞাপনের ন্যুনতম সৌজন্যতাবোধটুকুও যে অামরা হারিয়েছি তা অত্যন্ত দুঃখজনক। অশীতিপর বৃদ্ধ বয়সে তিনি যে নিসঙ্গ ও একাকীত্ব জীবন কাটাচ্ছেন সে খবর অামরা কজনেইবা রাখি? তারপরেও খবংপড়িয়ার মাটির সন্তান হিসেবে খবংপড়িয়াবাসী অামরা তাঁকে নিয়ে এখনো গর্ব বোধ করি।

মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০২০

দেশবিভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম

শুরুর কথা,১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে “ভারত স্বাধীনতা আইন- ১৯৪৭“ পাশ হয়। এই আইন পাশ ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের অবসান নিশ্চিত করে ।এক মাস পরে ভারত দুভাগ হয়ে যায় ।দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে ।ভারতের অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী  এবং গুরুত্বপূর্ণ দুটো  প্রদেশ – বাংলা ও পাঞ্জাবকে পূর্ব-পশ্চিম অংশে ভাগ করা হয় ।ব্রিটিশ সরকার স্বীকৃত স্বশাসিত রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে সম্পূর্ণ  অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।দেশবিভাগের ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায় এবং ১.২ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়। 

দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারণাঃ

এই তত্ত্বের প্রবর্তক মুহম্মদ আলী জিন্নাহ । এই তত্ত্ব অনুসারে পাকিস্তান রাষ্ট্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গঠিত হয়।এবং ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে যায়।প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশ-বেলুচিস্তান(৯১.৮%),সিন্ধুর (৭২.৭%)  মুসলিম জনসংখ্যা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখে।

এছাড়া বাংলা প্রদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব অংশ এবং পাঞ্জাবের মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম অংশ পাকিস্তান গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিম অংশ এবং পাঞ্জাবের হিন্দু ও  শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব অংশ ভারতে থেকে যায়।মূলত ধর্মের ভিত্তিতে একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ও প্রস্তাব মুসলিম লীগের “লাহোর প্রস্তাব-১৯৪০” -এ উন্থাপন  করা হয়েছিল।এই ধারণা পরবর্তীতে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন করে।


ভাইসর‌য় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও স্যার শেরিল র‌্যাডক্লিফঃ


ধর্মের ভিত্তিতে ভূমি ভাগ করা খুবই জটিল এবং বির্তকিত ছিল।বিশেষ করে পাঞ্জাব প্রদেশ,সেখানে মুসলিম,হিন্দু ও শিখ জনগোষ্ঠীর একসঙ্গে বসবাস ছিল।

১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি হতে ১৯৪৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত এ সময়সীমার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের আদেশ নিয়ে ভারতের শেষ ভাইসরয় নিযুক্ত হন লর্ড মাউন্টব্যাটেন।তিনি ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।ইংল্যান্ডের বর্তমান রাণী ২য় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপের আপন মামা।২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক সংকটকালীন সন্ধিক্ষণে তিনি ভারতীয় প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।জানা যায়,মাউন্টব্যাটেন পূর্বের ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের দেশভাগের পরিকল্পনা অনুসারে চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন।

এদিকে দেশবিভাগের জটিলতা নিরসন ও ‍চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ করতে ব্রিটিশ সরকার স্যার শেরিল র‌্যাডক্লিফকে নিয়োগ দেয়।র‌্যাডক্লিফ ইংল্যান্ডের  একজন বিখ্যাত আইনজীবী এবং ব্রিটিশ সরকারের একজন বিশ্বস্ত ও অনুগত কর্মচারী ছিলেন।এর আগে তিনি কখনো ভারতবর্ষে আসেননি।১৯৪৭এর জুনের দিকে তাঁকে জানানো হয়,বাংলা ও পাঞ্জাবের ‍চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ কমিশনে তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছে।

ব্রিটিশ সরকার পাঁচ সদস্যর একটি করে বাংলা ও পাঞ্জাবের জন্য আলাদা আলাদা “সীমানা নির্ধারণ কমিশন” গঠন করে।প্রতি কমিশনে দুজন জাতীয় কংগ্রেসের ও দুজন মুসলিম লীগের সদস্য ছিল।পঞ্চম ব্যাক্তি হিসেবে স্বয়ং র‌্যাডক্লিফ কমিশনের সভাপতি পদে আসীন ছিলেন।সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়,দেশবিভাগের সময় অচলাবস্থা ও হিংসাপূর্ণ আচরণের সময় র‌্যাডক্লিফ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

স্য়ার রেডক্লিফ পক্ষপাতশুন্য সীমানা নির্ধারণে মাত্র ০৫ সপ্তাহ সময় পেয়েছিলেন।র‌্যাডক্লিফ এবং কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের সীমানা নির্ধারণে স্থানীয় জ্ঞান  ও বাস্তব অভিজ্ঞতা কোনটাই ছিল না।তাঁদের হাতে জরীপ চালানো ও স্থানীয় তথ্য় সংগ্রহ করার পর্যাপ্ত সময়ও ছিল না।কমিশনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের উপস্থিতি থাকলেও তাঁরা কেউই আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেননি।

স্যার র‌্যাডক্লিফ কমিশনের কাজের স্বচ্ছতাও নিরপেক্ষতার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেন।যদিও মাউন্টব্যাটেন তাঁর সহপাঠী ছিলেন।স্যার র‌্যাডক্লিফ এবং এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন উভয়েই জানতেন যে সীমানা নির্ধারণ কোনো দলের কাছে পুরোপুরি কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না।র‌্যাডক্লিফ যেসব সীমানা নির্ধারণ করছেন এর আগে তিনি কখনো দেখেননি।তিনি মাউন্টব্যাটেনকে সর্তক করেছিলেন যে যদি আজ তাড়াহুড়ো করে সীমানা নির্ধারণ করা হয় তাহলে পরে অনেক ভুল ও বিভ্রান্তি তৈরি হবে।র‌্যাডক্লিফ আলী জিন্নাহ ও নেহেরুর সাথে এ বিষয়ে আলাপ করেন।তাঁরা খুব কম বিষয়ে একমত হতেন কিন্তু তাঁরা সেদিন ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের আগে দেশবিভাগ চেয়েছিলেন এবং এই বিষয়ে সেদিন দুজনে সম্পূর্ণে একমত হয়েছিলেন।

র‌্যাডক্লিফ জানতেন তিনি যাই করেন না কেন ভারতের জনসাধারন এর ভুক্তভোগী হবে এবং এটা নিশ্চিত যে তাঁরা ব্যাথা পাবে।সীমানা নির্ধারণ সমস্যা নিরসনের জন্য র‌্যাডক্লিফকে ২০০০ পাউন্ড দেওয়া হয়েছিল কিন্ত তিনি তা প্রত্যাখান করেছিলেন।


কমিশনের সিদ্ধান্তের গোপনীয়তাঃ

মতবিরোধ এবং বিলম্ব এড়ানোর জন্য বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাজন গোপন করার সিদ্ধান্ত হয়।১৯৪৭ এর ৯-১২ আগস্টের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছিল।কিন্তু কমিশনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয় ১৭ আগস্ট ১৯৪৭ সালে।

র‌্যাডক্লিফ ১৫ আগস্ট ইংল্যান্ডে রওনা দেন এবং যাবার আগে কমিশনের কাজে সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট,ফাইল-পত্র পুড়িয়ে ফেলেন।তিনি আর কখনো ভারতবর্ষে আসেননি।

 

পাঞ্জাবঃ

র‌্যাডক্লিফ পাঞ্জাবকে মুসলিম ও অমুসলিম জনসখ্যার ভিত্তিতে ভাগ করেন।পাঞ্জাব ভাগ করা একটি কঠিন কাজ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ শিখদের নিয়ে।শিখরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আধিপত্য মানতে এবং ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত হতে মোটেই ইচ্ছুক ছিল না।শিখনেতা ডা.বীর সিং ভাট্টি ‘খালিস্তান’ নামে পৃথক রাজ্য গঠনের প্রস্তাব দেন ।শিখনেতা মাস্টার তারা সিং,গিয়ানী কর্তার সিং এতে সমর্থন দেন।কিন্তু পরবর্তীতে শিখদের ভারতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। স্বাধীন ভারতবর্ষে শিখরা বর্তমান সময়ে এসেও পৃথক রাজ্যে গঠনের দাবি জানাচ্ছে।

লাহোরঃ

লাহোর জেলায় ৬৪.৫%  মুসলিম জনসংখ্যা ছিল।কিন্তু লাহোর শহরে ৮০% হিন্দু এবং শিখ জনগোষ্ঠী ছিল।কথা ছিল লাহোর ভারতে অর্ন্তভুক্ত হবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি পাকিস্তানে থেকে যায়।কারণ লাহোর ছাড়া ভারতে বড় কোনো শহর ছিল না।বাংলার বড় শহর কলকাতাকে ভারত অর্ন্তভুক্ত করা হলে আর বড়  কোনো শহর না থাকায় লাহোর ও ঢাকাকে পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।প্রশ্নের বিষয়,দেশ বিভাগ ধর্মীয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে হওয়ার কথা ছিল,সম্পত্তির ভিত্তিতে নয়।

গুরুদাসপুর জেলাঃ

এ জেলাটি পাঞ্জাব প্রদেশের সর্বউত্তরে এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জেলা।দেশবিভাগের পূর্বে এই জেলাটি চারটি তহশিলে বিভক্ত ছিল- শঙ্খরগড় তহশিল,পাঠানকোট তহশিল,গুরুদাসপুর তহশিল,বাতালা তহশিল ।শঙ্করগড় মুসলিম অধ্যুষিত তহশিল হওয়ায় এটি পাকিস্তানে দেওয়া হয়।গুরুদাসপুর জেলাকে ভারতে অর্ন্তভুক্ত করার কারণ ছিল-এর প্রাকৃতিক সম্পদ।এ জেলা ছিল শতদ্রু খালের মুখ,যা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উৎস।এছাড়া শিখদের পবিত্র ধর্মীয় স্থান এই জেলায় অবস্থিত।

পাকিস্তানিরা মনে করেন,লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই জেলা ভারতকে দিয়েছিলেন কারণ এই জেলা ছিল দিল্লী থেকে কাশ্মীরে যাবার সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ।যদিও এই দাবি বির্তকিত।কাশ্মীর তখন স্বাধীন রাজ্যে ছিল এবং ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়নি। এই জেলায় মুসলিম ৫০.২% ছিল।

ফিরোজপুরঃ

বর্তমানে ভারতীয় ইতিহাসবিদরা বলেন,লর্ড মাউন্টব্যাটেন ফিরোজপুর জেলাকে উপহার হিসেবে ভারতকেই দিয়েছিলেন।এই জেলার অধিকাংশ তহশিল ছিল মুসলিম প্রধান।

খুলনা,মূর্শিদাবাদ,করিমগঞ্জঃ


খুলনা জেলা ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ(৫২%) কিন্তু এটি পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।মূর্শিদাবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ জেলা।কলকাতা বন্দর হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত এই মূর্শিদাবাদ গঙ্গা থেকে পৃথক হয়েছে।যদি মূর্শিদাবাদ পাকিস্তানে অর্ন্তভু্তে হত তাহলে রাজধানী শহর কলকাতা ও কলকাতা বন্দর সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ত।আসামের করিমগঞ্জ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ভারতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে যোগাযোগের সুবিধার্থে এটি ভারতে রাখা হয়।



পার্বত্য চট্টগ্রামঃ

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একটি অতি অমুসলিম প্রবণ অঞ্চল যরি ৯৭% ছিল অমুসলিম এবং তাদের মধ্যে ৮০% ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।তা সত্ত্বেও এটিকে পাকিস্তানের-পূর্ব পাকিস্তান(বাংলাদেশ) অংশে সম্পূর্ণ অন্য়ায় এবং অযৌক্তিকভাবে জুড়ে দেওয়া হয়।

১৯৪১ সালের ভারতের আদমশুমারী অনুযায়ী,পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট জনসংখ্যা ছিল ২,৪৭,০৫৩ জন।তাঁর মধ্যে পাহাড়িদের সংখ্যা ছিল ২,৩৩,৩১২ জন এবং মুসলিম বাঙালি জনসংখ্যা ছিল ৭,২৭০ জন এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৪,৮৮১ জন।

১৯৪৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি” পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের রাজনৈতিক দাবী সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।জনসমিতি বাংলার সীমানা নির্ধারণ কমিশনের কাছে দাবী জানায়,যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি অতি অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল সেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতেই থাকতে চায়।বলা হয়,পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কমিশন এবং সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কেউ ছিল না।সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সরকারীভাবে সেরকম কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি।স্বাভাবিকভাবেই অমুসলিম প্রধান এ অঞ্চলের জনগণ এবং ভারতের অধিকাংশ জনগণ ভেবেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতে অর্ন্তভুক্ত হবে ।

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তারিখ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ জানতো না তাঁরা কোন দেশের অর্ন্তভুক্ত হতে যাচ্ছে।

১৭ আগস্ট বিকেলে পাকিস্তানে রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় এটি পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করার কারণ হিসেবে যেসব বিষয় দেখানো হয়-

১)পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ভারতের অনধিগম্য।পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ভারতে আসা যাওয়ার সহজ ও সুগম  পথ নেই;

২)এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থনীতি,নিত্য প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ চট্টগ্রামের(সমতল) উপর নির্ভরশীল;

৩)চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান,বন্দরের ভূমির উপর নির্ভরশীলতা এবং গ্রামাঞ্চল কতৃক শহরাঞ্চলকে সাহায্যে প্রদান;

৪)পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদের (বনজ,খনিজ সম্পদ…) উপর চট্টগ্রামের (সমতল) নির্ভরশীলতা;

৫)কর্ণফুলী নদীর নিয়ন্ত্রণ ও এর উৎস; এই অঞ্চলের নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করা ব্রিটিশদের পরিকল্পনা ছিল।পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করে।

৬)১৯৮০ সালে এইচ এন পন্ডিত অমৃতবাজার পত্রিকায় লিখেন, ”The  Ferozpur scandal was linked with a matter of life and death for the Buddhist Tribals of CHT in Bengal.” অর্থাৎ মুসলিম অধ্যুষিত ফিরোজপুর জেলা ভারতে অর্ন্তভুক্ত হওয়ার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।

৭)পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও শিখ ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর কারণে ভারতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।এর ফলস্বরুপ অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করা হয় ।


দেশভাগের সময় পার্বত্য নেতাদের কার্যক্রম  এবং ঘটনাপ্রবাহঃ

এসময় এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন-স্নেহ কুমার চাকমা,কামিনী মোহন দেওয়ান,ঘনশ্যাম দেওয়ান,চাকমা রাজা নলীনাক্ষ রায়,প্রতুল চন্দ্র দেওয়ান প্রমুখ।

স্নেহ কুমার চাকমা ১৯৪৫ সালে সিমলায় অনুষ্ঠিত “ Wavell Conference”  এ যোগদান করেন।সেখানে তিনি সর্বভারতীয় নেতাদের কাছে অনুরোধ করেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অর্ন্তভুক্ত করার। তিনি পন্ডিত নেহেরু এবং মাওলানা আজাদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আলাদাভাবে আলাপ করেন,উভয়েই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়া হবে না।

এর পরবর্তী ১৯৪৬ সালে এ ভি ঠক্করকে সভাপতি করে একটি সর্বভারতীয় “ Excluded Areas Sub-committee of the Constituent Assembly of India” কমিটি গঠিত হয়।পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্নেহকুমার চাকমা কমিটির সদস্য নির্বিাচিত হন।তিনি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতির সাধারন সম্পাদক।

১৯৪৭ সালের ৩ এপ্রিল গঠিত কমিটির একটি টিম রাঙামাটি আসে।পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কি ধরনের শাসন চাই তা খতিয়ে দেখা এবং সে অনুযায়ী হাইকমান্ডের কাছে রিপোর্ট করা,সেই উদ্দেশ্য নিয়ে এই কমিটি রাঙামাটি আসে।

এর পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সাথে অর্ন্তভুক্ত করার জন্য স্নেহকুমার চাকমা,কামিনী মোহন দেওয়ান মহাত্না গান্ধী,সর্দার প্যাটেল,জওহরলাল নেহেরুসহ তৎকালীন কংগ্রেসের বাঘা বাঘা নেতাদের সাথে দেখা করেন।জানা যায়,কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে বল্লভভাই প্যাটেল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিদের সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

১৯৪৭ সালের মে মাসে প্রতুল চন্দ্র দেওয়ানকে সভাপতি এবং ঘনশ্যাম দেওয়ানকে ফিল্ড কমান্ডার করে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।এ কমিটি গঠনে মূল ভূমিকা রাখেন স্নেহ কুমার চাকমা।এই কমিটি আগস্ট পর্যন্ত পার্বত্য জনগণের ভাগ্য নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা্ রাখে।

অবশেষে পূর্ব নির্ধারিত ১৪ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আগের রাত্রে স্নেহকুমার চাকমার নেতৃত্বে হাজারো উৎসুক,উৎকন্ঠিত পাহাড়ি জনগণ রাঙামাটি ডেপুটি কমিশনারের অফিসের সামনে জড়ো হয়।তখন রাঙামাটির ডেপুটি কমিশনার ছিলেন কর্ণেল জি এল হাইড(Col. G.L. Hyde)।

 

স্নেহ কুমার চাকমা ১৪ও ১৫ আগস্ট এবং পরবর্তী দিন ও ঘটনাসমূহের যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলঃ

১৪ ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭। দুই দিনের সন্ধিক্ষণে যখন ০০.০০টা বাজে, তখন আমার নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটিসহ ১০০০ লোকের সমাবেশ নিয়ে ডেপুটি কমিশনারের বাংলোতে গেলাম। ডেপুটি কমিশনার কর্ণেল জি.এল হাইড (Col. G.L. Hyde) বের হয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।

স্যার, ভারত কী এখন স্বাধীন?”

হ্যাঁ, এখন থেকে আপনারা স্বাধীন

ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অংশ তো?”

হ্যাঁ, ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারত রাষ্ট্রের সীমারেখার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত

তাহলে আমাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা উচিত নয় কী?”

হ্যাঁ। কিন্তু আমরা ব্রিটিশরা সুর্যোদয়ের সময় পতাকা উত্তোলন করি। অনুগ্রহ করে ভোরে আসেন এবং ফুটবল মাঠে জনসমাবেশের সামনে ভারতীয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন। আমিও যাবো এবং সালাম জানাবো।

তারপর থেকে আমার অফিসে বাসায় ভারতীয় পতাকা সুশোভিত করে রাখবো। সেখানে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাবো।অনুগ্রহ করে আমার পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে আপনারা আসবেন

আমাদের প্রবীণ নেতা কামিনী মোহন দেওয়ান আমাদের সকল অনুরোধ উপেক্ষা করায় সংগ্রাম কমিটি আমাকে ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে পতাকা উত্তোলন করতে বলে। শোভাযাত্রায় আমরা ডিসিকে অনুসরণ করি এবং পতাকা উত্তোলনের সরকারী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। সব জায়গায় বার্তা পাঠানো হয়েছিলো।

আমি যখন রাঙামাটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করছিলাম তখন কিছুই জানতাম না পন্ডিত নেহরু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বি.এন -এর (B.N. Raw) একটি গুরুত্বপূর্ণ (কিন্তু বিলম্বিত) বার্তা সর্দার প্যাটেলের কাছে প্রেরণ করেছিলেন।

১৭ আগস্ট ১৯৪৭ তারিখে বিকেল বেলায় রেডক্লিফ ঘোষিত সিদ্ধান্ত (the Radcliffe Award)  রেডিওতে প্রচার করা হয়।

এর অগে ১২ আগস্ট ১৯৪৭ সেখানে আভাস দেওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বঙ্গীয় সীমানা কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে থাকবে।

পরদিন সকাল বেলায় সংগ্রাম কমিটি তাড়াতাড়ি বসে ১৯ আগস্ট ১৯৪৭ ডিসি বাসভবনে একটি জরুরী সভা আহবান করার সিদ্ধান্ত নেয়। চাকমা রাজা অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

সে সভায় চাকমা রাজা কামিনী মোহন দেওয়ানসহ আরো অনেকে অংশগ্রহণ করেন। প্রত্যেকে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তবলী সমর্থন করেন।

) পার্বত্য চট্টগ্রাম রেডক্লিফ ঘোষিত সিদ্ধান্ত মানবে না;

) প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে এবং স্থানীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ স্কোয়াড গড়ে তোলা হবে;

) অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ভারতের সমর্থন লাভের জন্যে স্নেহ কুমার চাকমা অবিলম্বে যাত্রা শুরু করবেন। তিনি তৎক্ষণাত গ্রেফতার এড়ানোর জন্যে সতর্ক থাকবেন।

সংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে বার্তা প্রেরণের পর ১৯ আগস্ট ১৯৪৭, বিকেল .০০ টায় রাঙামাটি ত্যাগ করি। পায়ে হেঁটে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত অতিক্রান্ত করার লক্ষ্যে রামগড়-সাব্রুম (পার্বত্য চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা)- চলে যাই।

আমার সঙ্গে ছিলেন ইন্দ্রমণি চাকমা (সহকর্মী) এবং গিরিশ দেওয়ানের সেনানায়কত্বের অধীনে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি সশস্ত্র দেহরক্ষী দল। ২০ আগস্ট ১৯৪৭ সাব্রুমে প্রবেশ করি এবং ২১ আগস্ট ১৯৪৭ আগরতলায় যাই।"



এদিকে পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমন্টে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।এবং ভারতের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে।রাঙামাটিতে জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনে ভারতীয় পতাকা তিন দিন পর্যন্ত উত্তোলিত ছিল।

এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে,দক্ষিণ পার্বত্য চট্টগ্রামে(বান্দরবানে) বোমাং রাজার নেতৃত্বে মায়ানমারের পতাকা উত্তোলন করা হয়।পরবর্তীতে এই পতাকাও বেলুচ রেজিমেন্ট নামিয়ে দেয়।এই বিষয়ে তথ্যর ঘাটতি রয়েছে এবং এটি আরও পর্যালোচনা ও তথ্য সংগ্রহের দাবি রাখে।

এর মধ্যে স্নেহ কুমার চাকমা কলকাতায় পৌঁছান এবং সর্দার প্যাটেল ও জওহরলাল নেহেরুর সাথে দেখা করেন।স্নেহ কুমার চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে  সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য তাঁদের সাহায্যে ও সমর্থনের অনুরোধ করেন।কিন্তু স্বাধীনতার পরে ভারতের নেতৃত্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সেভাবে আর আগ্রহ দেখায়নি।স্নেহ কুমার চাকমাও আর পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসেননি।পরবর্তীতে ১৯৫১ সাল তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন।


স্নেহ কুমার চাকমা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন ।ছাত্রাবস্থা থেকে নেতাজীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল।তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যেই নিহিত আছে এদেশের মানুষ প্রকৃত মুক্তির পথ

তিনি লিখেছেন “ Only Subhas Chandra Bose had a comparatively clearer conception and inclination for us, and we, too, placed greater faith on Subhas Babu’s Method of independence than on other alternatives “( Sneha Kumar Chakma, The partition and the chakmas; Page-39 )


এখানে একটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে ।স্বাধীনতার আগে কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্দের মাত্রা চরমে পোঁছেছিল।নেতাজী কংগ্রেস সভাপতি থেকে পদত্যাগ করেন।স্নেহ কুমার চাকমা সুভাষের রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাস এবং ঘনিষ্ঠতার কারণেও মহাত্না গান্ধী,নেহেরুরা পার্বত্য চট্টগ্র্রাম বিষয়ে অনাগ্রহ দেখাতে পারেন।

দেশবিভাগ ও স্বাধীনতার মতন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষনে যেকোনো  অঞ্চল ও্র জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করতে হয়।কিন্তু এই চরম মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে নেতৃত্বের মধ্যে মতাদর্শগত অনৈক্য ছিল।

স্নেহ কুমার চাকমা এক সাধারন জুমিয়া কৃষক পরিবারের সন্তান।নি:সন্দেহে তিনি সাধারন জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব করতেন।ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং আন্দোলন করতে গিয়ে জেল ও খেটেছেন।তাঁর নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব পার্বত্য চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে।ধর্মঘট,নিয়মিত মিটিং,সভা-সমাবেশ,বিলেতী  পণ্য বর্জন সহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে দেন।


কামিনী মোহন  দেওয়ান তাঁর আত্নজীবনীতে স্নেহ কুমার চাকমা সম্পর্কে লিখেছেন,

“স্নেহ কুমার চাকমা আমার অনুগ্রহপৃষ্ঠ ব্যাক্তি মাত্র।আমার সাহায্যে  ব্যাতিরেখে তাহার পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না।বিশেষত:সে উচ্চ শিক্ষিত হইলে ও এক অপরিণত বয়সের যুবক মাত্র।তাহার কিংবা তাহার বংশীয় কাহারও বর্তমান পূর্ব জীবনের অর্জিত আর্থিক,সামাজিক কিংবা অন্য কোন প্রকার সম্মান,প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুই নাই।“

তৎকালীন চাকমা রাজা,কামিনী মোহন দেওয়ান  কিংবা দেওয়ানের মত যারা সামন্তীয় ব্যবস্থার সাথে আস্তে-পৃষ্ঠে  জড়িয়ে ছিলেন তারা কেউই স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বকে স্বাভাবিকভাবে মেনে  নিতে পারে না।স্নেহ কুমার চাকমা চেয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগনের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হোক।অপরদিকে কামিনী মোহন দেওয়ান তৎকালীন সামন্তীয়দের প্রতিনিধি ছিলেন।তিনি সংসদীয় রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন।


কামিনী মোহন দেওয়ান সর্ম্পকে রাজা ত্রিদিব রায় তাঁর আত্নজীবনী `The Departed Melody´ তে লিখেছেন, “He believed in constitutional monarchy,that is the three chiefs should be heads of their territories but executive authority would vest in an elected council(Parliament).His dream eas an autonomous Hill Tracts too.“

আরেকদিকে চাকমা রাজা নলীনাক্ষ রায় রাজতন্ত্র ঠিকিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন।এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সমগ্র জাতিসত্তা ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তিশালী কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানও ছিল না। ভৌগলিক বাস্তবতার কারণেও জাতিসত্তাসমূহ বিচ্ছিন্ন ছিল।তাঁরা সংগঠিত হয়ে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারেনি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে,ব্রিটিশরা সুকৌশলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মূল ভারতের শিক্ষা,রাজনীতি,অর্থনীতি,সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখে।এই দূরভসন্ধি পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাসমূহকে অনেক বছর পিছিয়ে রেখেছে।


শেষ কথা,যদি স্বশাসিত পার্বত্য  রাজ্যে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত না হয়ে ভারতে যুক্ত হত তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তা জনগণের ইতিহাসটা অন্যরকম হত।হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগনের স্বায়ত্বশাসন,রাজনৈতিক অধিকার বজায় থাকত।পাহাড়ি জনগণের উপর ডজনের অধিক গণহত্যা সংগঠিত হত না,জনমিতির বিশাল পরিবর্তন দেখা যেত না,সেটলার বাঙালি দ্বারা পাহাড়িদের ভূমি বেদখল হত না,পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন থাকত না।অথবা,পার্শবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে,কাশ্মীর,সিকিম কিংবা সেভেন সিস্টারের রাজ্যেগুলোর ন্যায় অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হত।

যাই হোক যা হয়নি তা হয়তো হবে না,তবে ইতিহাসে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যে ঘটে।

 

তথ্যসূত্র:

1.OPINDIA.COM

2.THIS BLOODY LINE-a short film directed by Ram Madhvani

3.WIKIWAND.COM-RADCLIFFE LINE

4.THE DEPARTED MELODY-AN AUTOBIOGRAPHY BY RAJA TRIDIV ROY

5.THE POLITICS OF NATIONALISM(The case of the Chittagong Hill Tracts Bangladesh) written by AMENA MOHSIN

6.Angelfire.com-এ প্রকাশিত দেশবিভাগ এবং এর পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম সর্ম্পকিত ঘটনাসমূহের ডকুমেন্ট;

7.chakmasudarshi.wordpress.com- এ সুদর্শী চাকমার লেখা “এক অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা স্নেহ কুমার চাকমা“

8.mithunchakma.blogspot.com- এ মিঠুন চাকমার লেখা “ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষা:পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসংগ-১৯৪৭ সাল“

9.jumjournal.com -এ প্রকাশিত স্নেহকুমার চাকমার লেখা ”পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানকে মেনে নেয়নি“ অডং চাকমার বাংলা অনুবাদ।

*

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...