বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট, ২০২০

স্মৃতির অন্তরালে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান এবং তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি - Dhiman Khisa

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি সম্প্রদায় হতে নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনে যারা অগ্রগামী ছিলেন ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। পার্বত্যচুক্তি সম্পাদনের পূর্বে দীর্ঘ অনেক বছর যাবত তিনি পার্বত্য চট্টগাম জনসংহতি সমিতির অান্তর্জাতিক মূখপাত্র ছিলেন। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডে গেলে তিনি অার দেশে ফিরেননি। দীর্ঘ অনেক বছর যাবত বিদেশে অবস্থানের কারনে এখানকার সাধারন জনগণ তাঁর সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিফহাল নন। পাহাড়িদের স্বায়ত্বশাসন অান্দোলনে তাঁর অসামান্য অবদান থাকলেও সে সম্পর্কে খুব কম জনেই অবগত অাছেন। তরুন প্রজন্মের কাছে তিনি অজানাই রয়ে গেছেন। তাই কালের পরিক্রমায় তিনি মেঘে ঢাকা তারার ন্যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে অন্তরীণ হয়েছেন। এ মহান ব্যক্তির বীরত্বগাঁথা তুলে ধরার প্রয়াসে অামার এ ক্ষুদ্র লেখার অবতারনা।

তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জিঃ
ড. অার এস দেওয়ান ১৯৩২ সালে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার সদর উপজেলাধীন খবংপড়িয়া(খবংপুজ্যা) গ্রামে লার্মা গোজা পীড়েভাঙা গুত্তি(চাকমাদের গোত্র)র এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রমেশ চন্দ্র দেওয়ান ও মাতার নাম চন্দ্রমূখী দেওয়ান। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ সন্তান। তাঁর ডাকনাম ছিলো কুলকুসুম। তাঁর পিতামহ উগ্রমুনি ও অামার প্রপিতামহ বিরাজমুনি ছিলেন সহোদর ভাই। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে তিনি একদিন বংশের নাম উজ্জ্বল করবেন। তাইতো তাঁরা তাঁকে অাদর করে ডাকতেন কুলকুসুম। বড় হয়ে তিনি তাই হয়েছেন। শত প্রতিকুলতাকে ডিঙিয়ে শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি পিএইচডি অর্জনের মাধ্যমে তিনি শুধু বংশকে নয় গোটা জাতিকেই গৌরবান্বিত করেছেন।

শিক্ষাজীবনঃ
ড. অার এস দেওয়ানের শৈশব কেটেছে খবংপড়িয়া(খবংপুজ্যা)র নির্মল প্রকৃতি ও অালো-বাতাসের সান্নিধ্যে। অদম্য মেধাবী এ ব্যক্তির লেখা-পড়ায় হাতেখড়ি হয় Khabongporia Lower Primary School( বর্তমানে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলাধীন খবংপড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়)এ। উক্ত স্কুলে ২য় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তিনি চলে যান বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলাধীন নানিয়ারচর উপজেলার মহাপুরম(মাওরুম)এ। সেখানে অাপন ভগ্নিপতির অাশ্রয়ে মহাপুরম মিডল ইংলিশ স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান সংগঠক প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার পিতা চিত্ত কিশোর লারমা ছিলেন তাঁর অাপন ভগ্নিপতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার অালো বিস্তার সাধনের ক্ষেত্রে অগ্রণী পথিকৃৎ এবং অসংখ্য স্কুল প্রতিষ্ঠার পিছনে যার অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করতে হয় স্কুল ইন্সপেক্টর কৃষ্ণ কিশোর লারমা ছিলেন তাঁর ভগ্নিপতির বড়ভাই। কৃষ্ণ কিশোর লারমা ও চিত্ত কিশোর লারমা ভাইযুগল পার্বত্যাঞ্চলের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার অালোয় অালোকিত করার মহান ব্রত নিয়ে জ্ঞানের মশাল জ্বালানোর শুভসূচনা করেন এ মহাপুরম থেকে। তাই মহাপুরমকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার অালো বিস্তারের সুতিকাগার বললে অত্যুক্তি হবেনা। চিত্ত কিশোর লারমা তৎসময়ে মহাপুরম মিডল ইংলিশ স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।

ড. অার এস দেওয়ান মহাপুরম মিডল ইংলিশ স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর রাঙ্গামাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং উক্ত স্কুল থেকে বিজ্ঞান শাখায় সেন্টার ফার্স্ট হয়ে ১৯৫২ সালে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। সে সময় বিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠী ছিলেন খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের একসময়ের স্বনামধন্য প্রথিতযশা শিক্ষক নবীন কুমার ত্রিপুরা, বিশিষ্ট সমাজসেবক কংলাচাই চৌধুরী(খাগড়াছড়ি), মৃনাল কান্তি চাকমা(খবংপড়িয়া, খাগড়াছড়ি) ও ডা. সুব্রত চাকমা(রাঙ্গামাটি) প্রমুখ। ম্যাট্রিক পাশ করার পর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ সনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা প্রদানের সময় তাঁর মা মারা গেছে মর্মে একটি উড়ো চিঠি অাসলে তিনি পরীক্ষা বাতিল করে বাড়িতে চলে অাসেন। ফলে লেখাপড়ায় সহপাঠীদের কাছ থেকে একবছর পিছিয়ে পড়েন। সন্দেহ করা হয়, তাঁর মেধা ও যোগ্যতার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে এবং শ্রেষ্ঠত্বকে ঠেকানোর জন্য সহপাঠীদের মধ্যে কোন একজন গোপনে উড়ো চিঠি প্রদানের হীনকাজটি করেন। একবছর ক্ষতি হলেও তিনি ক্ষান্ত হননি। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৫৫ সনে পুনরায় একই কলেজ থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১ম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। অতঃপর তিনি ঢাকাস্থ অাহসান উল্লাহ ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। তৎকালীন সময়ে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার জন্য খুবই প্রসিদ্ধ ছিলো। উক্ত প্রতিষ্ঠানে দুই বছর পর্যন্ত পড়ার পর পাঠ্য বিষয়টির প্রতি মনোযোগী হতে না পারায় কোর্স সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে ১৯৫৭ সালে তিনি ইঞ্জিনীয়ারিং পড়া ছেড়ে দেন এবং ঐ বছরই কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান UTAH Companyতে চাকুরি গ্রহণ করলে কাপ্তাইয়ে তাঁর পোস্টিং হয়। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল অাগ্রহের কারনে উক্ত চাকুরিতেও তিনি মন বসাতে পারেননি। তাই বছরখানেক পরে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৫৮সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং উক্ত ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৬১ সালে বিএ অনার্স(রসায়ন) ও ১৯৬৩ সালে এমএসসি(রসায়ন) সম্পন্ন করেন। উক্ত ডিগ্রীসমূহ অর্জনের পরেও তিনি ক্ষান্ত হননি। শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রী পিএইচডি অর্জনের অদম্য অাগ্রহকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য তিনি উপায় খুঁজতে থাকেন। তৎসময়ে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর এক অজ পাড়াগাঁর মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে বিদেশে গিয়ে ডিগ্রী অর্জনের বিষয়টি ছিলো অাকাশকুসুম কল্পনার মতো। কারন তাঁর পরিবারের পক্ষে এতো ব্যয়বহুল খরচ যোগান দেয়ার মতো অার্থিক সক্ষমতা ছিলোনা। তারপরেও তিনি দমবার পাত্র নন। অার্থিক অানুকুল্যতা সৃষ্টির জন্য তিনি অবশেষে ঢাকার সাইন্স ল্যাবরেটরিতে চাকুরি নেন। চাকুরির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থ যোগাড় করা সম্পন্ন হলে পিএইচডি ডিগ্র্রী অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৬৭ সালে বিলেত(ইংল্যান্ড) গমন করেন লন্ডনের বিশ্বখ্যাত Salford University থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।

কর্মজীবন ও অবদানঃ
লন্ডনের Salford University থেকে পিএইচডি ডিগ্র্রী অর্জনের পর ড. অার এস দেওয়ান উক্ত ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা শুরু করেন। তৎসময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির স্বায়ত্বশাসন অান্দোলন শুরু হয়। উল্লেখ্য, এম এন লারমা ছিলেন তাঁর অাপন ভাগিনা। অান্দোলন ক্রমশঃ গতিশীল হতে থাকলে ড. দেওয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপনা ত্যাগ করে অান্দোলনে সম্পৃক্ত হন। পার্বত্যচুক্তি সম্পাদনের পূর্বে তিনি দীর্ঘ অনেক বছর যাবত জনসংহতি সমিতির অান্তর্জাতিক মূখপাত্র ছিলেন। জাতিসংঘসহ অান্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইস্যুটিকে সমাধানের জন্য স্মারকলিপি প্রদান করেন এবং অান্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন অাদায়ে গুরুুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পার্বত্য চট্টগাম বিষয়ক অান্তর্জাতিক কমিশন গঠনের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া অান্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সুদৃষ্টি ও সহযোগিতা অর্জনেও তাঁর অসামান্য অবদান ছিলো।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের রাজনৈতিক অধিকার অাদায়ের স্বার্থে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুখ, স্বপ্ন ও সম্ভাবনা সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছেন। এসব কিছু করতে গিয়ে তিনি বিয়ে করার বিষয়টি পর্যন্ত মাথায় অানেননি। তাই তিনি চিরকুমার রয়ে গেছেন এবং বর্তমানে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে নিজস্ব এ্যপার্টমেন্টে বৃদ্ধ বয়সে একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন।

অতীব দুঃখের বিষয় যে, সমাজ ও জাতির কল্যাণে এতো কিছু করার পরেও জাতির কাছে তাঁর সে অসামান্য অবদান কতটুকু মূল্যায়িত হয়েছে সে প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। তাঁকে সম্মাননা জ্ঞাপনের ন্যুনতম সৌজন্যতাবোধটুকুও যে অামরা হারিয়েছি তা অত্যন্ত দুঃখজনক। অশীতিপর বৃদ্ধ বয়সে তিনি যে নিসঙ্গ ও একাকীত্ব জীবন কাটাচ্ছেন সে খবর অামরা কজনেইবা রাখি? তারপরেও খবংপড়িয়ার মাটির সন্তান হিসেবে খবংপড়িয়াবাসী অামরা তাঁকে নিয়ে এখনো গর্ব বোধ করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...