সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০

প্রসঙ্গ: আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুমির অধিকার : শক্তিপদ ত্রিপুরা

প্রসঙ্গ: আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুমির অধিকার :  শক্তিপদ ত্রিপুরা

 


১২ আগস্ট ২০২০

বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশে পাহাড় ও সমতল অঞ্চল মিলে ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বাস করে। স্মরণাতীত কাল থেকে তারা এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে।

এ অঞ্চলের ভুমিকে বাসযোগ্য ও চাষযোগ্য করার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের রয়েছে বিশেষ অবদান। বৃটিশ উপনিবেশবাদী শাসকগোষ্ঠী ও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে এদেশ থেকে বিতাড়ণে আদিবাসীদের রয়েছে ঐতিহাসিক অবদান।

  কিন্তু যে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী এ অঞ্চলের ভুমিকে বাস ও চাষযোগ্য করে তুললেছিলো, বৃটিশ ও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে বিতাড়ণ করে এদেশ স্বাধীন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলো, সেই আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃতি পেলো না- এর চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আদিবাসীদের আর কি হতে পারে।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনা করে। এই সংবিধানে বাঙালী ব্যতিত এদেশের অপর কোন জাতিগোষ্ঠীকে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা হয়নি।  আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির সংগ্রাম আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে শোষন বঞ্চণার শিকার হয়ে আসছে। বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষের অপরাপর অঞ্চল ও জাতিগোষ্ঠীকে যেভাবে ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে শাসন শোষণ নিশ্চিত করেছিলো, ঠিক তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল এলাকার আদিবাসীদের উপরও অনুরূপ শাসন শোষণ কায়েম করেছিলো। পাকিস্তান আমলে আদিবাসীদের উপর শোষণ নিপীড়ণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।


বৃটিশ আমলে আদিবাসীরা যেসব অধিকার ভোগ করতো সেসব অধিকার পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী খর্ব করে দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের কিছু কিছু এলাকায় যে ‘শাসন বহির্ভূত স্ট্যাটাস’ ছিল তা বাতিল করে দেয়। বৃটিশ প্রণীত ১৯০০ সালের পার্বত্য শাসনবিধির গুরুত্বপূর্ণ ধারাসমূহ বাতিল করা হয়। ১৯৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে লক্ষাধিক আদিবাসীকে উদ্বাস্তু করা হয়। এ বাঁধের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ উর্বর ফসলীয় জমি পানির নীচে তলিয়ে যায়। এতে আদিবাসীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অপূরনীয় ক্ষতির শিকার হয়।

পাকিস্তান সরকার ভারত থেকে চলে আসা অ-আদিবাসীদের আইন লংঘন করে শত শত পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ীদের জায়গায় পুনর্বাসন করে। সমতলেও পাকিস্তান আমলে আদিবাসীরা বহু জমি জমা হারায়। আদিবাসীদের জমি ভুমিদস্যু বাঙালীরা জোরপূর্বক কেড়ে নেয়।


পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আদিবাসী-বাঙালী নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর শোষন, বঞ্চণা ও নিপীড়ণ চালায়। এই শোষন নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণ সংগ্রাম গড়ে তুলে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেয় তখন সে ডাকে সাড়া দিয়ে আদিবাসীরাও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে বহু আদিবাসী শহীদ হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে পাহাড়ীরা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পাহাড়ীরা আশা করেছিল দেশ স্বাধীন হলে এ নতুন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। প্রতিষ্ঠা পাবে শোষণহীন এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ, যে সমাজে নিপীড়ন-নির্যাতন ও শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না, থাকবে না দ্বেষ-হিংসা-হানাহানি।

এ ধরনের সমাজে আদিবাসীরাও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, সং¯ৃ‹তি ও অধিকার নিয়ে মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবে- এ ছিল তাদের স্বপ্ন। কিন্তু ১৯৭২ সালে যখন নতুন দেশের সংবিধান রচনা করা হল তখন আদিবাসীদের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। যে নতুন সংবিধানের জন্য আদিবাসীরাও রক্ত দিল, জীবন দিল সেই নতুন সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি মিললো না- সত্যিই তা আদিবাসীদের জন্য হদয় বিদারক ঘটনা বৈ কি!
১৯৭২ সালে সংবিধান সংক্রান্ত বিষয়ে যখন আলোচনা চলে তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য আদিবাসী তথা মেহনতি মানুষের বন্ধু প্রয়াত এম এন লারমা জাতীয় সংসদে সংবিধানের উপর দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রেখেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন- বাংলাদেশে বাঙালী ছাড়াও আরো অনেক জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। তারাও এদেশের নাগরিক। এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদেরও অবদান ছিল। সুতরাং তাদের অধিকারও সংবিধানে স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মহান নেতা এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবী জানিয়েছিলেন এবং দেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সংবিধানে সুদৃঢ়ভাবে স্থাপনের দাবী জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এম এন লারমার দাবী ও বক্তব্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো আজ ৪৭ বছর হতে চলেছে, এই ৪৭ বছরেও এদেশের আদিবাসীদের, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের, সাধারণ কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুন্ঠিত। যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল- একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা তা এখনো সুদুর পরাহত।

এম, এন লারমা আমৃত্যু আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এখনো সে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে এ সংগঠনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এম এন লারমার ছোট ভাই শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। এ সংগ্রামের অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারের সনদ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ সম্পাদিত হয়। বর্তমানে চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। শ্রী লারমার নেতৃত্বে ২০০১ সালে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’ গঠিত হয়। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবী জানিয়ে আসছে।

সংবিধান ও রাষ্ট্রে আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃতি ও আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ও ভুমির অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সংবিধান বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের রায় আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাবার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছে। হাইকোর্টের রায়কে বিবেচনা রেখে মহাজোট সরকার সংবিধান সংশোধনের কথা ভাবছে।

এলক্ষ্যে সরকার সাজেদা চৌধুরীকে প্রধান করে এক বিশেষ কমিটিও গঠন করেছে। এদিকে মহাজোট সরকারের হাতে রয়েছে সংবিধান সংশোধন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সংসদ সদস্য। সুতরাং সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি এখন সরকারের আন্তরিকতার বিষয় মাত্র। সরকার চাইলে সংবিধান সংশোধন করে যে কোন সময় আদিবাসীদের জাতীয় পরিচয়, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে পারে। আদিবাসী-উপজাতি-ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী প্রসঙ্গ ‘উপজাতি’ শব্দের অর্থ ‘একটি জাতির শাখা’, ‘আদিম’, ‘অসভ্য’ ইত্যাদি বুঝায়। বাংলাদেশের আদিবাসীরা কোন জাতির শাখা নয়; তারা এক একটি ‘জাতি’। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে।

কোন কোন আদিবাসী জাতির হাজার বছরের স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস রয়েছে। তাছাড়া আধুনিক নৃবিজ্ঞানীরা ‘উপজাতি বা ট্রাইবাল’ শব্দ বর্তমানে আর ব্যবহার করে না। তাঁরা মনে করেন এ শব্দগুলি বহু পুরনো ও সংকীর্ণ প্রপঞ্চ। কোন জাতির পরিচয় দিতে গিয়ে এই শব্দগুলির ব্যবহার একটি জাতিকে অপমান করার সামিল বলে তাঁরা মনে করেন।

বর্তমান সরকার নুতন একটি শব্দ আমদানি করেছে- ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’। এই সরকার বাংলাদেশের আদিবাসীদেরকে বর্তমানে সর্বশেষ আইন দ্বারা এই নামে অভিহিত করছে। ২০১০ সালে একটি আইন (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন) প্রণয়নের মধ্য দিয়ে এই শব্দ স্থাপন করা হয়। এই আইনের বলে পূর্বতন ‘উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ বর্তমানে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ নামে রূপান্তরিত।
আদিবাসী কারা? এ নিয়ে অনেকের মাঝে বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। খোদ রাষ্ট্রের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও নাকি প্রশ্ন তোলেন- ‘আপনারা উপজাতিরা এদেশের আদিবাসী হলে আমরা কারা? আমরাও তো এদেশের আদিবাসী’।

কিন্তু ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী’ নির্ধারণে কে আদি বাসিন্দা বা কে আদি বাসিন্দা নয় তা মূখ্য বিষয় নয়। আদিবাসী হলো তারাই- ১. বর্তমানের রাষ্ট্র শাসন প্রক্রিয়ায় যাদের একেবারেই প্রান্তিক ভূমিকা, ২. আধুনিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার সাথে যাদের অসম্পৃক্ততা বা প্রান্তিক সম্পৃক্ততা, ৩. যারা রাষ্ট্রীয় আইনের চাইতে প্রথাগত আইনের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি করে থাকে, ৪. প্রথাগত আইন কার্যকর করার জন্য যাদের ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, ৫. যাদের একটি বিশেষ ভুমির সাথে আত্মিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে, ৬. যাদের ধর্মীয় বহুমাত্রিকতা রয়েছে- এসব বৈশিষ্ট্য যাদের রয়েছে তাদেরকেই ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাত্ত্বিক দিক থেকে এসব বৈশিষ্ট্যের আলোকে এদেশের আদিবাসীদের নির্ধিদ্বায় ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করা যায়- সরকার বা অন্য কারোর এক্ষেত্রে দ্বিধা থাকা সমীচিন নয়।

বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি না থাকলেও এদেশের আদিবাসীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন, প্রজ্ঞাপন, নির্দেশনা, পলিসি, স্মারক ও নথি ইত্যাদিতে এদেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া আছে। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯৯৫ সালের অর্থ আইন, আদালতের রায়, রাজস্ব বোর্ডের একাধিক স্মারক ও নথিতে ‘ইন্ডিজিনাস হিলম্যান’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সরকার প্রধান থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমেদ তাঁদের বাণীতে এদেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

মহাজোট সরকারের প্রধান শরীক দল আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করেছে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন সময়ের ‘দারিদ্র বিমোচন কৌশল পত্র’, জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০০৯- এ ‘আদিবাসী’ ও ‘ইন্ডিজিনাস পিপল’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৫০ সালের ‘পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাসত্ত্ব আইনে’ এদেশের আদিবাসীদেরকে ‘এবরোজিনাল কাস্ট এন্ড ট্রাইবস’ বলা হয়েছে। এই আইনটি সংবিধানে সন্নিবেশিত আছে। ২০০৯ সালের জাতীয় বাজেটে এদেশের আদিবাসীদের ‘ইন্ডিজিনাস পিপল’ সন্বোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১০ সালের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে’ও ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং কারা আদিবাসী তারও একটি তালিকা প্রদান করা হয়েছে।

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন, পলিসি, প্রজ্ঞাপন, আদালতের রায়, বিভিন্ন স্মারক ও নথিতে আদিবাসীদের স্বীকৃতি আছে। তথাপি সরকারের কোন কোন মহল বাংলাদেশের আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ বলার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং পার্বত্য চট্টগ্রামের আমলাদের এ ধরণের অপচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। বিদেশে কর্মরত সরকারের কোন কোন প্রতিনিধি এখনো ‘উপজাতি’ শব্দ প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। ২০১০ সালের ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলেছিলেন- “There are no indigenous people’ in Bangladesh but some tribal people or people of different ethnic minorities living in different part of Bangladesh’’ । ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন’ প্রণীত হবার পর এদেশের আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ বলার যৌক্তিকতা থাকতে পারে না বরং আইনত: অপরাধী। সর্বশেষ আইন অনুসারে এদেশের আদিবাসীদের হয় ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ অথবা ‘আদিবাসী’ বলা উচিত।

কারণ সর্বশেষ আইনে এই দু’টি শব্দ সন্নিবেশিত হয়েছে। এই আইন প্রণীত হবার পরও সরকারের বেশীরভাগ কর্মকর্তা এখনো ‘উপজাতি’ শব্দ ব্যবহার করে চলেছে। যারা সর্বশেষ আইন অনুসরণ করে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ বা ‘আদিবাসী’ বলছে না সরকার তাদের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।  সাংবিধানিক স্বীকৃতির অধিকার মানবাধিকার আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিকের সাংবিধানিক স্বীকৃতির অধিকার- মানবাধিকার। এটি নাগরিকের একটি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক অধিকার। আদিবাসীরা এদেশের নাগরিক। এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে আদিবাসীরা রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে এ অঞ্চলকে বাসযোগ্য ও কর্ষণযোগ্য করার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের হাজার বছরের সংগ্রাম ছিল। সুতরাং এই আদিবাসীদের নিজের দেশের সংবিধানে স্বীকৃতি থাকবে না কেন? কেন রাষ্ট্র, সরকার তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেবে না? কোন যুক্তিতে?
পৃথিবীর মানুষ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মানুষের চিন্তাচেতনা অনেক অগ্রসর হয়েছে। পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। যেসব জাতি আদিবাসীদের উপর শোষণ বঞ্চণা চালিয়েছিল সেসব জাতি আদিবাসী জাতির নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বক্তব্য প্রদানকালে প্রকাশ্যে আদিবাসীদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা চেয়েছেন। আমেরিকা, কানাডা, বলিভিয়া, মেক্্িরকো, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর প্রভৃতি দেশে আদিবাসীদের স্বীকৃতি আছে।

এসব দেশগুলিতে আদিবাসীদের প্রথাগত ভুমি অধিকার স্বীকৃত। নওেয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড- এ আদিবাসীদের নিজস্ব পার্লামেন্ট পর্যন্ত আছে। এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে আদিবাসীরা হয় সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত নয় তো রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। এশিয়ার এসব দেশে আদিবাসীদের ভুমির অধিকার স্বীকৃত। এসব দেশে আদিবাসীরা বহু পরিমানে অধিকার ভোগ করে থাকে। আদিবাসীদের ভুমির অধিকার আদিবাসীদের ভুমি ব্যবস্থাপনা দেশের মূল স্রোতধারা জনগোষ্ঠীর ভুমি ব্যবস্থাপনা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।

আদিবাসীদের প্রথাগত ভুমি অধিকার বৃটিশ আমলে কিছুটা স্বীকৃত ছিল। এ অধিকার ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে অন্তভর্’ক্ত ছিল। পাকিস্তান আমলে ভুমির উপর আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকারের বেশ কিছু অংশ বাতিল করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন আমলে আদিবাসীদের ভুমি অধিকার খর্ব করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বেশ কিছু ভ’মির অধিকার সন্নিবেশিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের হাতে ভুমির ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিত জেলার কোন জায়গা জমি বন্দোবস্ত, লীজ, হস্তান্তর বা অধিগ্রহণ করা যাবে না। ভুমি ও ভুমি ব্যবস্থপনা সম্পূর্ণরূপে পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট ন্যস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও এর আলোকে প্রণীত বিভিন্ন আইনে আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকার সন্নিবেশিত হয়েছে।

বিশেষত: জুম, জুমভুমি ও জুম চাষ পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট ন্যস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও প্রথাগত অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান সার্কেল চীফ বা রাজা, হেডম্যান ও কার্বারী পার্বত্য চট্টগ্রামের ভুমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে।  অপরদিকে ১৯৫০ সালের ‘জমিদারী উচ্ছেদ ও প্রজাসত্ত্ব আইনে’ সমতলের আদিবাসীদের ভুমি অধিকার কিছুটা স্বীকৃত হয়েছে। এই আইনে সমতল জেলাসমূহের বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের জমি বাংলাদেশের আদিবাসী ব্যতিত অন্য জাতিগোষ্ঠীর ব্যক্তির মালিকানায় হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এই আইনটি সংবিধানে সন্নিবেশিত আছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল অঞ্চলে ভুমির উপর আদিবাসীদের এসব অধিকার থাকা সত্ত্বেও আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত: ভুমি হারাচ্ছে। ভুমি বেদখলের জন্য আদিবাসীদের উপর প্রতিনিয়ত হামলা পরিচালনা করা হচ্ছে। আদিবাসীদের উপর মিথ্যা মামলা ঠুকিয়ে দিয়ে, হুমকী প্রদর্শন করে নানাভাবে হয়রানী করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার বসতিস্থাপনকারীরা এখনো আদিবাসীদের শত শত একর জমি বেদখল করে রেখেছে। এসব জমি বেদখলমুক্ত করে আদিবাসীদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ভুমি কমিশন গঠন করা হলেও ভুমি কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে। ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ শুরু না করে এ কমিশনের চেয়ারম্যান এককভাবে ভুমি জরীপের ঘোষণা দেয়, যা ভুমি কমিশনের কাজ নয়।

এদিকে বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন লংঘন করে হাজার হাজার একর আদিবাসীদের জায়গা-জমি বেদখল করে চলেছে। সমতল এলাকার আদিবাসীদের ভুমির পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও অনুরূপ দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আইন লংঘন করে প্রশাসন ও এলাকার ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আদিবাসীদের জমি বেদখল করে চলেছে।

আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য প্রস্তাবনা প্রথমত. বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের দেশ। এই বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সংবিধানে তিন ধরণের মালিকানা- ১. রাষ্ট্রীয় মালিকানা, ২. সমবায় মালিকানা ও ৩. ব্যক্তি মালিকানার কথা উল্লেখ আছে। আদিবাসীদের ‘সমষ্টিগত মালিকানা’ সংবিধানে স্বীকৃত নয়। তাই সংবিধানে ‘সমষ্টিগত মালিকানা’ সন্নিবেশ করার আবশ্যকতা রয়েছে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশে বাঙালী ছাড়াও বহু আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বাস করে। দেশের সমস্ত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে সংবিধানে স্বীকৃতি দিতে হবে।
চতুর্থত, সংবিধানে আদিবাসীদের প্রথাগত ভুমি অধিকার যথাযথভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। পঞ্চমত, আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি, প্রথা, ঐতিহ্য- এর সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। ষষ্ঠত, জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিষয়টি সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রযোজ্যক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আদিবাসীদের জন্য শিক্ষা, চাকরি, উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ অধিকার প্রদানের বিষয়টিও সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে আদিবাসী নারী ও অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ অধিকারের বিষয়টি সংবিধানে স্বীকৃতি থাকতে হবে।

সপ্তমত, পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। অষ্টমত, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও এ চুক্তির আলোকে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন- এর সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। নবমত, সংশোধনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ পূর্বক ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা।

দশমত, আদিবাসী বিষয়ক, সংবিধানের কোন ধারা পরিবর্তন করতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং সমগ্র অঞ্চলের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা পূর্বক সংশোধন করা- এই ধারা সংবিধানে সন্নিবেশ করা।

শক্তিপদ ত্রিপুরা, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...