শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

চাকমাজাতির আদিনিবাস সন্ধানে-৩ -- By Pulak Khisa


এই পর্বে আমরা ভারতের ত্রিপুরায় চাকমাদের সম্ভাব্য চম্পকনগরের অবস্থান জানার চেষ্টা করবো যেখান থেকে চাকমাদের আদিরাজা বিজয়গিরি ও সেনাপতি রাধামন চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলের উদ্দেশ্যে বিজয় অভিযানে যাত্রা করেন।

চাকমারকূলে চাকমা নেই, চাকমাঘাটে চাকমা নেই
--------------------------------------------------------
আগের পর্বে আমরা দেখেছি সপ্তম শতাব্দী থেকে চট্টগ্রাম রামু এলাকায় হরিকেল রাজ্য ছিল যার রাজধানী ছিল চম্পক নগর। নবম শতাব্দীতে বিরচিত ‘কর্পূর-মঞ্জুরী’ নাটকে হরিকেলের রাজধানী হিসেবে এই নাম দেখা যায়। একমাত্র চাকমারা ছাড়া এতদঅঞ্চলের অন্য কোন জাতির এই নাম ব্যবহার করার কথা নয়। কাজেই সপ্তম শতাব্দী থেকে চাকমারা এই অঞ্চলে ছিল বলে ধারণা করা যায়। এখন আমরা দেখি চাকমাদের ইতিহাস মতে এতদঅঞ্চলে বিজয়গিরির অভিযান কখন পরিচালিত হয়েছিল। ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের দ্বিতীয় পরিচ্ছদের বর্ণনা মতে এই অভিযান পরিচালিত হয়েছিল আনুমানিক ৫৯০ খৃষ্টাব্দে (পর্ব -৩, সংযুক্তি–১)। ষষ্ঠ শতাব্দীর একদম শেষের দিকে বিজয়গিরির চট্টগ্রাম, রামু অঞ্চলে অভিযান ও বিজয় এবং ইতিহাসের বর্ণনামতে তাদের এতদঅঞ্চলে বসতি স্থাপনের সাথে সপ্তম শতাব্দীতে এই অঞ্চলে হরিকেল রাজ্যের উত্থান এবং ঐ রাজ্যের রাজধানীর নাম তাদের প্রাচীন রাজ্য বা রাজধানী চম্পকনগরের সাথে মিল থাকা ইত্যাদির মাধ্যমে চাকমাদের ইতিহাসের সামঞ্জস্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
এখন আমরা দেখি রাজা বিজয়গিরি কোন অঞ্চল থেকে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, অর্থাৎ চট্টগ্রাম, রামু জনপদে আসার আগে বিজয়গিরির দেশ কোথায় ছিল এবং চাকমাদের ইতিহাসে বর্ণিত তাঁর অভিযান পরিচালনার বর্ণনার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু।
বিপ্রদাস বড়ুয়া সম্পাদিত শ্রীমাধবচন্দ্র চাকমা কর্ম্মী বিরচিত ‘শ্রীশ্রীরাজনামা বা চাকমা জাতির ইতিহাস গ্রন্থ’ অনুসারে রাজা বিজয়গিরির পিতৃমহ রাজা ভীমঞ্জয়, তার পুত্র সাংবুদ্ধা, যার দুই পুত্র বিজয়গিরি ও উদয়গিরি। রাজা ভীমঞ্জয়ের কালাবাঘা নামে একজন সেনাপতি ছিল, যিনি রাজার আদেশে দিগ্বিজয় মানসে প্রভূত সৈন্য নিয়ে ‘লোহিত্য’ বা ‘কপিলা’ নদীর পরপারস্থ রাজ্যসমূহ জয় করার ইচ্ছায় ক্রমশঃ পূর্ব দক্ষিণ দিক জয় করতঃ তথায় কালাবাঘা নামে এক রাজ্য স্থাপন করেন এবং ঐ রাজ্যের প্রান্তভাগে নূতন চম্পানগর নামে এক নগর স্থাপন করে রাজধানী করেন। উক্ত গ্রন্থের টিকায় বর্ণিত হয়েছে যে ‘লোহিত্য’ বা ‘কপিলা’ নদী ব্রহ্মপুত্রের নামান্তর, যা ত্রিপুরার রাজমালার দ্বিতীয় লহর মধ্যমণির ৩১৫ নং পৃষ্ঠায়ও উল্লেখ করা হয়েছে আর অচ্যুতচরণ চৌধুরী তাঁর ‘শ্রীহট্টের ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্রীহট্ট জিলা পূর্বে কালাবাঘা রাজ্য নামে অভিহিত হতো বলে উল্লেখ করেছেন। ‘শ্রীশ্রীরাজনামা’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে ভীমঞ্জয়ের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র সাংবুদ্ধা রাজা হন। নূতন চম্পানগরের শাসনকর্তা সেনাপতি কালাবাঘার মৃত্যু হলে রাজা সাংবুদ্ধা তদস্থলে বিজয়গিরিকে শাসনকর্তারূপে প্রেরণ করেন। বিজয়গিরি কালাবাঘায় পৌঁছে স্বীয় আধিপত্য দৃঢ় করেন এবং দিগ্বিজয়ের জন্য এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করেন। স্বর্গীয় বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা তাঁর ‘চাকমা জাতি ও সমসাময়িক ইতিহাস’ গ্রন্থে পুরাতন আসাম প্রদেশের কিয়দংশ, শ্রীহট্ট জেলা, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণ বাড়িয়া জেলা, পার্বত্য ত্রিপুরার বৃহদংশ ও চট্টগ্রামের উত্তর অংশ নিয়ে কালাবাঘা রাজ্য গঠিত ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন। এখন আমরা দেখি উপরিবর্ণিত স্থানে যুবরাজ বিজয়গিরি পিতৃরাজ্য থেকে দূরে দ্বিতীয় চম্পকনগরে যে তার আধিপত্য দৃঢ় করেছিলেন তাঁর প্রমাণ কতটুকু। এতদুদ্দেশ্যে গুগুল ম্যাপ থেকে নেয়া উপরে বর্ণিত স্থানসমূহের একটি মানচিত্র ‘পর্ব-৩ এর সংযুক্তি-২’ এ দেখা যেতে পারে। সংযুক্ত এই মানচিত্রে প্রাচীন কালাবাঘা নামক বর্ণিত রাজ্যের জন্য চিহ্নিত জনপদে চাকমাদের ইতিকাহিনীর সহিত সংশ্লিষ্ট নিম্নবর্ণিত স্থানসমূহ দেখা যায়, যা সংযুক্ত গুগুলম্যাপে চিহ্নিত করা হয়েছেঃ
১) বিজয়নগর – বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি উপজেলা, স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা এ ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল বিধায় স্মারক হিসেবে ২০১০ সালে এই উপজেলার নামকরণ করা হয় বিজয়নগর। তবে আমরা পরবর্তীতে বিজয়গিরির নামের সাথে বিজয়নগরের কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা তা খুঁজে দেখতে পারি।
২) চম্পকনগর-১ – ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার একটি ইউনিয়ন।
৩) চম্পকনগর-২ – উপরে উল্লেখিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চম্পকনগর-১ থেকে বেশি দূরে নয়, কিন্তু ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরায়।
৪) চাকমাঘাট – ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরায় উপরের ৩ নং ক্রমিকে উল্লেখিত চম্পকনগরের সন্নিকটে।
৫) উদয়পুর – এর নাম ছিল রাঙ্গামাটি যা ত্রিপুরা রাজাদের বংশাবলী সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘শ্রীরাজমালা’-র বর্ণনামতে লিকা নামক মঘ সম্প্রদায় কর্তৃক শাসিত হত। তাদের থেকে ত্রিপুরার রাজা জুঝারু ফা এই স্থান দখল করেন এবং ঐ নামে প্রায় হাজার বছর ধরে ত্রিপুরার রাজধানী ছিল। পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীতে ত্রিপুরা মহারাজ উদয় মাণিক্য রাঙ্গামাটির নাম পরিবর্তন করে নিজের নামানুসারে উদয়পুর রাখেন।
৬) চম্পকনগর-৩ – উদয়পুরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে দক্ষিণ ত্রিপুরায় চম্পকনগর, বাংলাদেশের ফেনী জেলা সঙ্গলগ্ন।
৭) বিজয়নগর-২ - চম্পকনগর-৩ থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে দক্ষিণ ত্রিপুরায় চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্নিকটে।
৮) রাঙ্গামাটি – সিলেটের দক্ষিণ-পূর্বে আসামের করিমগঞ্জ জেলায়।
৯) চম্পকনগর-৪ – সিলেটের পূর্বদিকে, আসামের করিমগঞ্জ।

উপরের স্থানসমূহের অবস্থান পর্যালোচনা করে কালাবাঘা রাজ্যটি যে সিলেটের সন্নিকটস্থ আসাম, ত্রিপুরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইত্যাদি অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ হওয়াতে রাজ্যটি এখন আর নেই, কিন্তু বিভক্ত অঞ্চলগুলোর প্রত্যেকটিতে সেই রাজ্যের জনপ্রিয় নগর চম্পকনগর রয়ে গেছে, সেই সাথে আছে রাঙ্গামাটি, যেটি চম্পা বা চম্পকনগরের মত প্রাচীন বঙ্গ-ভারতবর্ষের একটি প্রাচীন নগর এবং চাকমাদের একটি প্রিয় নগর, যুগে যুগে চাকমারা যেখানে গেছে হয়তো এই নগরের নামটিও সাথে নিয়ে গেছে। উপরে উল্লেখিত জায়গাগুলো সম্বন্ধে পরে বলবো। তদুপরি আগে যেমন বলা হয়েছে, কালাবাঘার চম্পকনগর হলো দ্বিতীয় চম্পকনগর। সেক্ষত্রে আমাদের কালাবাঘার আগের চম্পকনগরও খুঁজতে হবে। ভারতে, আসামে আরো চম্পকনগর, বিজয়নগর, রাঙ্গামাটি রয়ে গেছে। তবে এই মুহূর্তে আমাদের কাজ হলো ত্রিপুরা বা কালাবাঘা অঞ্চলের চম্পকনগরকে তুলে ধরা যেখান থেকে বর্তমান চাকমাদের আদিরাজা বিজয়গিরি এবং তাঁর সেনাপতি রাধামন রোয়াং বা চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলে অভিযান চালিয়েছিলেন।
‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে দেখা যায় রাজা বিজয়গিরি সেনাপতি রাধামনসহ ৭ চিমু (২৬ হাজার) সৈন্য নিয়ে রোয়াংদেশ বা চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলে অভিযানের জন্য তার রাজ্য থেকে দক্ষিণ দিকে গমন করেন। তদকালীন ত্রিপুরা রাজা তাঁর সাহায্যার্থে কুঞ্জধন নামে এক সেনাপতিকে একদল সৈন্যসহ রাধামনের সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। তারা প্রথমে খৈ গাং (খৈয় নদী) পার হয়ে আসেন। গেংখুলীর গানে এ বিষয়ে এভাবে উল্লেখ আছে (পর্ব-৩, সংযুক্তি–৩)-
“নাজের উল্লাসে রাধামন,
খৈ গাঙত পল্লাক্কি সৈন্যগণ”।

অর্থাৎ সৈন্যবাহিনী খৈয় নদীতে উপস্থিত হলে সেনাপতি রাধামন আনন্দ উল্লাস করেন। আমরা এখন গুগুল ম্যাপ থেকে দেখি বিজয়গিরি উপরে বর্ণিত খৈয় নদীতে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। এই উদ্দেশ্যে ইতোপূর্বে ক্রমিক নং - ৪ এ উল্লেখিত “চাকমাঘাট” স্থানটিকে গুগুল ম্যাপ থেকে সম্প্রসারিত আকারে সংযুক্তি-৪ ও ৫ এ দেখানো হল। স্পষ্টতই চাকমাঘাট এলাকাটি ‘খোয়াই নদী’র সাথে। বর্তমানে ঐ নদীতে বাধ দেয়া হয়েছে যা Chakmaghat Barrage নামে গুগুল ম্যাপ ও স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে। স্নেহভাজন অ্যাডভোকেট Nicolas Chakma নাকি ত্রিপুরার চাকমাঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তার কাছে শুনলাম সেখানে এখন কোন চাকমা নেই, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ধামাই গোষ্ঠীর লোকজন সেখানে বাস করে, তাদের নারীরা চাকমা নারীদের মত পিনোন-খাদি পরে, তবে তাদের পিনোনে নাকি চাবুঘী নেই। ত্রিপুরার শ্রীরাজমালা গ্রন্থে অবশ্য ধামাই জাতিকে মগজাতির শাখা বিশেষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজমালার প্রথম লহর (যুঝার খণ্ড) ৪৯ নং পৃষ্ঠায় লেখা আছে (পর্ব-৩, সংযুক্তি-৬)-
রাঙ্গামাটি দেশেতে যে লিকা রাজা ছিল ।
সহস্র দশেক সৈন্য তাহার আছিল ॥
ধামাই জাতি পুরোহিত আছিল তাহার।
অভক্ষ্য না খায়ে তারা সুভক্ষ্য ব্যভার ॥
আকাশেত ধৌত বস্ত্র তারাহ শুখায়।
শুখাইলে সেই বস্ত্র আপনে নামায় ॥
বৎসরে বৎসরে তারা নদী পূজা করে।
স্রোত যে স্তম্ভিয়া রাখে গোমতী নদীরে ॥

এখানে রাঙ্গামাটি হল লিকা সম্প্রদায় থেকে ত্রিপুরা রাজা কর্ত্তৃক অধিকৃত বর্তমান উদয়পুর যা উপরে ক্রমিক নং-৫ এ উল্লেখ করা হয়েছে। রাজমালার টিকায় লিকা এবং ধামাই দুই জাতিকে মঘ জাতির শাখা বিশেষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে রাঙ্গামাটি নামটি নিঃসন্দেহে মূল আরাকান/মিয়ানমার থেকে আগত মঘ বা আরাকানী জাতির দেয়া নাম হতে পারেনা। আর মঘ জাতির মধ্যে ধামাই নামে কোন সম্প্রদায় আছে বলে শোনা যায়না, বরং চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে ধামাই নামক গোঝা/গোষ্ঠী রয়েছে, আর চাকমারা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হলেও নদী বা গাঙপূজা এখনো করে, চৈত্র সংক্রান্তিতে ফুলবিঝুর দিনে নদীতে গিয়ে ফুল দিয়ে পূজা করে। অন্যদিকে চম্পকনগরের মত রাঙ্গামাটি নামটিও সম্ভবতঃ চাকমারা যেখানে গেছে সাথে নিয়ে গেছে। খুব সম্ভব সেই ষষ্ঠ শতাব্দীতে চাকমারা তখনো ‘চাকমা’ নামে এত পরিচিতি লাভ করেনি, তখনো বৌদ্ধ ধর্মের ধারক-বাহক মৌর্য সম্রাট অশোকের ‘মগধ’-এর নাম এত সুপরিচিত ছিল যে প্রাচীন বিহার, ভারত, আরাকানের যে কোন বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে সম্ভবতঃ মগ নামে অভিহিত করা হত। এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলাপ করা যাবে (কারণ এত দীর্ঘ আলোচনা এক পর্বে ফেসবুকে দিলে লেখাটি একঘেঁয়ে লাগতে পারে)।

এখন ‘খৈ গাঙ’ বা ‘খোয়াই নদী’র অবস্থান জানার পরে ‘ঠেওয়া’ নামে আরেক নদীর অবস্থান আমরা খুঁজি। ‘শ্রীশ্রীরাজনামা’ গ্রন্থের মতে রোয়াং রাজ্যে পৌঁছার আগে এই নদীর তীরে প্রথম শিবির স্থাপন পূর্বক রাজা বিজয়গিরি সেনাপতি রাধামনকে মগরাজ্য আক্রমণের অনুমতি প্রদান করেন। উক্ত গ্রন্থের ৪৭ নং পৃষ্ঠার টিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, “ঠেওয়া নদী কোথায় জানা যাইতেছে না”। আমরা চাকমারা অনেক ক্ষেত্রেই অন্তস্থঃ ‘গ’-কে অ-উচ্চারণ করি। যেমন খাগড়াছড়ি জায়গাটি মূলতঃ চাকমা ভাষায় বলা হয় “হাআরাসরি’, ‘নাগরি’-কে উচ্চারণ করা হয়, ‘নাঅরি’, ‘বাগান’-কে ‘বাআন’। তাই ‘ঠেওয়া’ নদীটি চাকমা ভাষায় ‘থেআ’ হবে যা বাংলায় ‘থেগা’, ইংরেজিতে “Thega” লেখা হয়। তার অর্থ হলো বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলা ও মিজোরাম সীমান্তে থেগা নদীর তীরে সম্ভবতঃ থেগামুখ অর্থাৎ থেগা নদী যেখানে এসে কর্ণফুলীতে মিশেছে সেই স্থানে এসে বিজয়গিরি শিবির স্থাপন করলেন। প্রশ্ন জাগে এই স্থানে এসে শিবির স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন কি কারণে? কারণ ছিল রোয়াং রাজ্য বা রামু ছিল সাগর তীরে, সেখানে যেতে হলে নৌপথে সাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হবে। গেংখুলী গীত এর ভাষায়ও গাওয়া হয়েছে -

অপার পানি সাগর বেই, কুল-কিনারা দেঘা নেই,
জাদিপুজাত তে ঘি দিল, রোয়্যাঙ্গা দেঝত তে কুলেল।
(স্বর্গীয় বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা, ‘চাকমা জাতি ও সমসাময়িক ইতিহাস’ – পৃঃ ৩২)

অর্থাৎ সাগর বেয়ে তারা রামু বা রোয়াং দেশে উপনীত হয়। এই লেখার প্রথম পর্বে যেমন উল্লেখ করেছি রামু ঠাঁই পেয়েছে ১৮৫৮ বছর আগের টলেমির ভুগোল গ্রন্থে। সেই হিসেবে আরব বণিকদের মত চাকমারাও হয়ত জানত সেখানে যেতে হবে জলপথে – থেগা, কর্ণফুলী হয়ে। কিন্তু ২৬ হাজার সৈন্য বহন করার মতো নৌকা সেই পাহাড়ি পথে সাথে বয়ে নিয়ে যাওয়া বিজয়গিরি-রাধামনদের নিশ্চয় সম্ভব ছিলোনা। তাই এই প্রস্তুতির জন্য থেগাতে তারা শিবির স্থাপন করলেন। এই শিবিরে বসে তাঁরা নৌকা তৈরি করেছিলেন কিনা জানা নেই, তবে সহজ সমাধান ছিল থেগার দুপাশের পাহাড় থেকে বাঁশ কেটে ঝটপট ভেলা তৈরি। চাকমারা সেই আদিকাল থেকে ‘কাত্তোন’ অর্থাৎ বাঁশ কাটা আর সেটা দিয়ে ভেলা তৈরিতে অভ্যস্ত, এখনো কাপ্তাই-এ বাধ দেয়ার পরে কয়েক কিলোমিটার প্রশস্ত কর্ণফুলী নদীর বুকে কিলোমিটার দীর্ঘ ভেলার সারি বানিয়ে চন্দ্রঘোনার পেপার মিলে তারা বাঁশ সরবরাহ করে। আর নৌকা ফুটো হলে ডুবে যায়, কিন্তু ভেলাতে সেই ভয় নেই। তাই ২৬ হাজার সৈন্য হয়তো ঝটপট কয়েক হাজার ভেলা বানিয়ে ফেলেছিল। ভাবতে সে এক মজার দৃশ্য হবে নিঃসন্দেহে। তবে তারপরেও রামু পর্যন্ত পৌঁছা হয়তো অত সহজ ছিলোনা। তার আগে কর্ণফুলীর মোহনায় দিয়াং (দিগাং<(চা)দিগাং?) নামক স্থানে প্রতিপক্ষ মগ রাজার সাথে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে জয়ী হলে চাকমারা আরো দক্ষিণে রোয়াং দেশ বা রামুতে অগ্রসর হয়।

খৈ গাঙ বা খোয়াই নদী অতিক্রম করার বর্ণনা থেকে আমরা বিজয়গিরি ও রাধামন কোন চম্পকনগর থেকে থেগা-কর্ণফুলী হয়ে রোয়াং রাজ্য গমণ করেছিলেন তার ধারণা করতে পারি। সিলেটের সন্নিকটে আসামের করিমগঞ্জ জেলার চম্পকনগর থেকে ‘থেগা’ গেলে আদৌ খোয়াই নদী অতিক্রমের দরকার পড়েনা। অন্যদিকে পশ্চিম ত্রিপুরার চম্পকনগর খোয়াই নদী থেকে বেশি দূরে নয়, তাই এখান থেকে যাত্রা করলে খোয়াই নদীর তীরে পৌঁছাটা গেংখুলী গীতিকাব্যে রাধামনের আনন্দ উল্লাস করার মতো এই অভিযানের একটি মাইলফলক হতে পারে বলে বিবেচিত হয়না। তাই বিজয়গিরির বাহিনী বর্তমান বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চম্পকনগর থেকে যাত্রা করে, ত্রিপুরার রাণীর বাজার, চম্পকনগর, বড়মুড়া হয়ে তেলিয়ামুড়ার সন্নিকটে খোয়াই নদী অতিক্রম করে বলে অনুমিত হয়। গুগুল ম্যাপ থেকে থেগা পর্যন্ত এই অভিযানের সম্ভাব্য গতিপথ পর্ব-৩, সংযুক্তি-৭ ও ৮ এ পদর্শিত হল।

এখানে উল্লেখ্য হাজার বছর ধরে চাকমাদের ইতিহাস নিয়ে বংশ পরম্পরায় গান করে আসছে যে গেংখুলীরা তাদের সিংহ ভাগ ছিলেন বাংলাভাষায় অশিক্ষিত। আজকে আমরা খুব সহজেই গুগুল ম্যাপে অনুসন্ধান করে তাদের বর্ণিত ‘খৈ গাং’ এর অবস্থান এবং ত্রিপুরার চাকমাঘাট জায়গা/তালুক এর অবস্থান ও তার উপর ভিত্তি করে ত্রিপুরায় চাকমাদের চম্পকনগর অন্বেষণের চেষ্টা করছি। কিন্তু এই গেংখুলীরা হয়তো জীবনে ত্রিপুরার চম্পকনগর, খোয়াই নদী, চাকমাঘাট ইত্যাদি এলাকা ভ্রমণ করেননি, বরং উত্তরসূরী হিসেবে পূর্বপুরুষদের গাওয়া লোকগীতি বংশ পরম্পরায় গেয়ে আসছেন। তাই এগুলো তাদের নেহাৎ বানানো কাহিনী হিসেবে উড়িয়ে দেয়া সমীচিন হবেনা, বরং এগুলো সংগ্রহ করে সেখান থেকে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে। আগামীপর্বে ত্রিপুরা-কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানের নামের ভিত্তিতে চাকমাদের এসব অঞ্চলে বসবাসের আরো সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপনের প্রচেষ্টা থাকবে।

উপরের এবং এর আগের পর্বের আলোচনা সমালোচনা থেকে দেখা যায় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষে ত্রিপুরা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-সিলেট অঞ্চলের চম্পকনগর থেকে চাকমারা চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে সম্ভবতঃ হরিকেল বা হরিখোলা নামের রাজ্য স্থাপন করে যার রাজধানীও চম্পকনগর নামে অভিহিত হয়। তাদের জাতির নামানুসারে জায়গা চাকমাঘাট, চাকমারকূল এখনো এসব অঞ্চলে এককালে তাদের শাসন, তাদের বসবাসের সাক্ষ্য বহন করে। কালের প্রবাহে চাকমাঘাট, চাকমারকুল এই দুই জায়গাতেই আর কোন চাকমা নেই। (চলবে)।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...