সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০

পাহাড়ে তাঁবেদার গ্রুপদের সময় বেশি দিন নেই: মিন্ট অং

সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পরিবর্তিত হয়। পাহাড়ের রাজনীতিতেও বহু পরিবর্তন এসেছে। মানুষ বুঝে নিয়েছে কোন রাজনৈতিক দলটি অতীব জরুরী। সময় এবং সুযোগ বুঝে বহু গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। যাদের আমরা তাঁবেদার গ্রুপ বলে চিনে থাকি। ‘তাঁবেদার’ শব্দটির সাথে অনেকেই পরিচিত নয়। আজ্ঞাধীন বা গোলাম হয়ে যে গ্রুপ পরিচালিত হয় তাই ‘তাঁবেদার গ্রুপ’। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস বহু পুরনো। ভৌগলিক সীমানা নিয়েও আলোচনায় ছিল ভূ-খন্ডটি। অমুসলিম অধ্যুষিত এই অঞ্চলে শুরুর দিকে অমুসলিমদের শাসন বিরাজমান ছিল। পরবর্তিতে এই ভূখন্ডটিতে ভূ-রাক্ষুসেদের দৃষ্টি পড়ে। শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। প্রথমে পাকিস্তান জমানায় ‘শাসন বহির্ভূত’ অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাথে মুক্তি বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। বাঙালীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পাহাড় এবং পাহাড়ের বাইরে আদিবাসীরাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সদ্য গঠিত বঙ্গবন্ধু সরকার পাহাড়ে প্রথম ধাক্কা দেন। বাঙালী তকমা দিতে থাকেন পাহাড়ীদের। হৃদয়ে আঘাত লাগে পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসীদের। প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সেসময় বঙ্গবন্ধুর মন জয় করতে ‘বাকশাল’ এ যোগ দেন। কাজ না হওয়ায় শেষমেষ পাহাড়ে বসবাসরত জুম্ম আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আত্মগোপনে চলে যান। জুম্মদের অধিকার খর্ব করে দেখার পরিণতি ‘শান্তি বাহিনী’ গঠন এবং তার কার্যক্রম।

আন্দোলনের মধ্যে আশির দশকে ষড়যন্ত্রের সূচনা করেন প্রীতিকুমার। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে এই নাম। নেতা হওয়ার প্রবল ইচ্ছা থেকে ক্ষমতায় যাবার উন্মাদ হয়ে উঠেন এই ব্যক্তি। পাহাড়ে তাঁবেদার গ্রুপের সূচনা প্রীতিকুমার ওরফে প্রকাশের হাত ধরে। সারথি ছিলেন ভবতোষ দেওয়ান ওরফে গিরি, ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান ওরফে পলাশ এবং দেবজ্যোতি ওরফে দেবেন। এদের মধ্যে দেবজ্যোতি বহু আগে আততায়ী হাতে খুন হন। তাঁবেদার গ্রুপ (‘বাদী’ নামে সর্বাধিক পরিচিত) পরীক্ষিত এক নেতাকে হত্যা করতে পারলেও আদর্শ এবং আন্দোলনকে হত্যা করতে পারেন নি। পরীক্ষিত সেই নেতস ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। সময়ের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে তাদের অস্তিত্ব ধূলোয় মিশে যায়। জুম্ম বিধ্বংসী অংশের কারোর দ্বারা প্ররোচিত হয়েই এ কাজ করেছিলেন তারা প্রীতি গ্রুপ।

এরপর ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর। আরও একটি কালো অধ্যায়। পাহাড়ের সকল জুম্ম এ ঘটনার জন্য ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। শুরু হয় ভয়াবহতা। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর জনসংহতি সমিতির অনেক সদস্য ভারত প্রত্যাগত। ‘৯৭ এর ২ ডিসেম্বর মাত্র অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ভারত প্রত্যাগতরা। এরই মধ্যে ভারত প্রত্যাগত জনসংহতি সদস্যদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠে সদ্য ১৯৯৮ সালে সৃষ্টি হওয়া ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) সদস্যরা। সদ্য ইউপিডিএফ এর রাজনীতি থেকে সরে আসা কর্মীদের প্রচারিত ‘কোন চোরাবালিতে ডুবছে ইউপিডিএফ’ পুস্তিকায় স্পষ্ট লেখা রয়েছে কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছিলেন ইউপিডিএফ নেতা প্রসীত বিকাশ খীসা। সর্বপ্রথম পানছড়ি এরপর দীঘিলানাসহ আর অনেক জায়গায় ভারত প্রত্যাগতদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায় ইউপিডিএফ কর্মীরা। পর্যায়ক্রমে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে আধিপত্য বিস্তার চালায় তাঁবেদার গ্রুপটি। পার্বত্য চুক্তিকে বিরোধীতা করে এ গ্রুপটি সৃষ্টি করেছিলেন সেনাবাহিনী। শতাধিক জেএসএস কর্মীকে হত্যা করে গ্রুপটি। এখন তাদের অবস্থান প্রায় প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত।

২০০৭ সালের দিকে জন্ম নেয় আরও একটি তাঁবেদার গ্রুপ। প্রথম দিকে জেএসএস(সংস্কার) নাম দিলেও পরে তা জেএসএস(এমএন লারমা) নামে প্রচার করে এই গ্রুপটি (সূত্রঃ সত্যদর্শী মূলিম্যা, আইপিনিউজ)। কিন্তু ততক্ষনে গ্রুপটি সংস্কার নামে পরিচিতি পায়। দেশে তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকার কথা ছিল ৯০ দিন। কিন্তু ২ (দুই) বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে তত্বাবধায়ক সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ চাইলে আরও ক্ষমতায় আসীন হতে পারতেন। আওয়ামী লীগে সংস্কার আনয়নে মাইনাস ফর্মুলা গ্রহণ করা হয়। ড. আবদুল জলীল যিনি তৎকালীন (২০০৭) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে দলে সংস্কার আনতে ষড়যন্ত্র পেতে বসেন। অপরদিকে বিএনপিতেও মাইনাস ফর্মুলা চলতে থাকে। খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে সংস্কার আনয়নে উঠেপড়ে লাগেন তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। পাহাড়েও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পাহাড়ের নেতৃত্ব বললে যার নাম জানা হয় তিনি হলেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এর চেয়ারম্যান। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতিও। এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি। তাঁকে বাদ দিয়ে পাহাড়ের নয়া উপদলীয় নেতৃত্ব তৈরি করতে চেয়েছিল সুধাসিন্ধু খীসার গ্রুপ।

তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জনসংহতি সমিতিতে মাইনাস ফর্মুলা ষড়যন্ত্রের জাল বুনে নয়া সংস্কারবাদীরা। গুটি কয়েক নেতা জনসংহতি সমিতি থেকে প্রস্থান করে সংগঠনের বিরোধীতা করে ক্ষুদে দলবাদ সৃষ্টি করে সংস্কারপন্থিদের এই গ্রুপটি। দাবার গুটি হয়ে চালিত হতে থাকেন প্রয়াত সুধাসিন্ধু খীসা। তিনি ঢাকায় ছুটে যান নিজের অবস্থান তৈরি করতে। জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিকদের সাথে দেখা করেন সুধাসিন্ধু খীসা। কোনরকম সাড়া না পেয়ে ফিরে আসেন পাহাড়ে। সদ্য সংস্কার হওয়া গ্রুপটি আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সন্তু লারমাকে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক পরিষদ দখল করতে মরিয়া সংস্কারপন্থি এ গ্রুপটি। পিসিজেএসএসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত চন্দ্রশেখর চাকমা রীতিমত ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে উঠাবসা করতে লাগলেন। কিন্তু বয়সের শেষ ভারে স্ট্রোক করে মারা যান এই সংস্কারপন্থি নেতা। সংস্কার গ্রুপের সহসাধারণ সম্পাদক সুদর্শন চাকমা। শুরু দিকে স্থানীয়ভাবে টাকার জোরে বহু মানুষকে ভুলিয়ে ভোট ব্যাংক হিসেবে তৈরি করেন। সর্বশেষ, বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান ভোট ডাকাতি করে। শোনা যায় স্ত্রীর সাথে বোঝাপড়া হচ্ছে না তার কোনভাবে। এভাবে নিষ্ক্রীয় হতে পারেন সুদর্শন চাকমা।

গত জুলাই (২০২০) মাসের আগে সংস্কার নামে এই তাঁবেদার গ্রুপটির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা মধ্য রাতে সেনাবাহিনীর এসকর্ট দিয়ে করোনাকালীন মধ্যে বান্দরবানে প্রবেশ করে। গ্রুপটির সহসভাপতি বিমল কান্তি চাকমা ওরফে প্রজিত এতে নেতৃত্ব দেন। তাকে মূলত বান্দরবানে সাংগঠনিক কাজে দায়িত্ব দেয়া হয়। চট্টগ্রামে একটি হোটেলে করোনার মহামারীর মধ্যে বান্দরবান সংস্কার গ্রুপ গঠন করে দেন এই বিমল কান্তি। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি থেকে শতাধিক মানুষকে সুযোগ সুবিধা দিয়ে চট্টগ্রাম হোটেলে নিয়ে গিয়ে মিটিং করে গ্রুপটি। কমিটিও গঠন করে দেয়া হয়। কয়েক মাসের মধ্যে আততায়ীর হাতে খুন হন বিমল কান্তিসহ কয়েকজন। এতে করে দূর্বল হয়ে পড়ে সংস্কারপন্থি তাঁবেদার গ্রুপটি। সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এই গ্রুপটি পাহাড়ে অবস্থান করতে পারেনি। অর্থ ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে আভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে গ্রুপটি। অবশেষে বিনাশ হতে যাচ্ছে গ্রুপটি।

এএলপি নামক আরও একটি তাঁবেদার গ্রুপ জন্ম নেয় এই পাহাড়ে। বান্দরবানের স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চাহিদা মেটাতে গ্রুপটি সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনসহ সকল স্তরের নির্বাচনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয় এএলপি। স্থানীয় জনমানুষের সহানুভূতি পেতে মগ লিবারেশন পার্টি নাম দিয়েছে গ্রুপটি। মারমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নাম করে চাঁদাবাজী, অপহরণ এবং হত্যার মত লোমহর্ষক ঘটনার জন্য দায়ী এএলপি নামক তাঁবেদার গ্রুপটি। গরীব-দুঃখী বালকদের আবেগকে ব্যবহার করে শত প্রাণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ মদদপুষ্ট এই এএলপি। জেএসএসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এ গ্রুপটি। প্রকাশ্যে সেনা সদস্যকে হত্যা করার পরও কোন পদক্ষেপ নেয়নি সেনা প্রশাসন।
সংস্কারপন্থিদের মতন এদের অবস্থানও এখন খুব শোচনীয় স্তরে।

সংস্কারপন্থিদের সহযোগী পরম বন্ধু গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ। প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি তপনজ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার মৃত্যুর পর এ দলটিও করুণ পরিণতিতে ভুগছে। সেনা মদদপুষ্ট এই তাঁবেদার গ্রুপটিকে চাঙ্গা করতে গুরুত্ব দিচ্ছে গুপ্তচরেরা। এ গ্রুপটি ইতোমধ্যে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি ও রাঙামাটির জীবতলীসহ খাগড়াছড়িতে ঘরোয়া আলোচনা সেড়ে নিয়েছে বলে জানা যায়। বলা বাহুল্য, এদের মধ্যে গুটি কয়েক নেতা রয়েছেন যারা সংস্কারদের মধ্য থেকে এসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এতে করে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ এর নেতাকর্মীরা বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন। দেখা যাচ্ছে এদের অবস্থানও অচীরেই অস্পষ্ট এবং অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

পরিশেষে, তাঁবেদার গ্রুপের অবস্থান শুরুতে চাঙ্গা থাকলেও পরবর্তিতে ধোঁয়াশা হতে থাকে। বিরক্ত হতে তাকে সাধারণ মানুষ। সুতরাং, তাঁবেদারি অচীরেই শেষ হতে চলেছে পাহাড়ে।

মিন্ট অং, রাজনৈতিক কর্মী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...