রবিবার, ২৮ জুন, ২০২০

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ঐতিহাসিক ৫-দফা দাবীনামা

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৫-দফা দাবীনামাঃ 


১.
ক) পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রাদেশিক মর্যাদা প্রদান করা।
খ) নিজস্ব আইন পরিষদ সংবলিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা।
গ) প্রাদেশিক আইন পরিষদ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে এবং প্রদেশ
তালিকাভুক্ত বিষয়ে এই প্রাদেশিক আইন পরিষদ প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের অধিকারী হবে।
ঘ)দেশরক্ষা,বৈদেশিক মুদ্রা ও ভারি শিল্প ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ
প্রশাসন,পুলিশ,শিক্ষা,স্বাস্থ্য,কৃষি,বনজ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ,মৎস্য,অর্থ,পশুপালন,ব্যবসা-
বাণিজ্য,ক্ষুদ্র শিল্প,বেতার ও টেলিভিশন,রাস্তাঘাট,যোগাযোগ ও পরিবহন,ডাক,কর ও
খাজনা,জমি ক্রয়-বিক্রয় ও বন্দোবস্তি,আইন-শৃঙ্খলা,বিচার,খনিজ তেল ও     
গ্যাস,সংস্কৃতি,পর্যটন,স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন,সমবায়,সংবাদপত্র,পুস্তক ও প্রেস,জল ও বিদ্যুৎ
সরবরাহ,সীমান্তরক্ষা,সামাজিক প্রথা ও অভ্যাস,উন্নয়নমূলক কার্যক্রমসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের
অন্য সকল বিষয়ে প্রাদেশিক সরকারকে প্রত্যক্ষ প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ও ক্ষমতা
প্রদান করা।
ঙ) আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও প্রদেশ যাতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করতে
পারে,সে জন্য কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতা স্বতন্ত্রভাবে তালিকাভুক্ত করা।
চ) পার্বত্য চট্টগ্রামের নাম পরিবর্তন করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে 'জুম্মল্যান্ড'(Jummland) নামে
পরিচিত করা।
ছ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিবর্তন(Amendent)
করা।

২.
ক) গণভোটের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামত যাচাই ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের
বিষয় নিয়ে কোন শাসনতান্ত্রিক সংশোধন বা পরিবর্তন যাতে না হয়, সেরকম শাসনতান্ত্রিক
বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন করা।
খ) বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে কেউ যেন পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন,ভূমি ক্রয়
বা বন্দোবস্তি নিতে না পারে সেরকম শাসনতান্ত্রিক বিধি প্রণয়ন করা।
গ) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী নয় এরকম কোন ব্যক্তি যাতে বিনা অনুমতিতে পার্বত্য
চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য শাসনতান্ত্রিক বিধি প্রণয়ন করা।
ঘ) অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত বাংলাদেশের অপরাপর অংশের
নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপদগ্রস্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন জরুরি আইন অথবা
সামরিক আইন জারি করা না হয়,সেরকম শাসনতান্ত্রিক বিধি প্রণয়ন করা।
ঙ) প্রাদেশিক সরকারের সকল সরকারি,আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ
 পদে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী নন, এমন কোন ব্যক্তিকে যেন নিয়োগ করা না হয় এবং
 গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তাকে প্রাদেশিক সরকারের সুপারিশ ব্যতীত অন্যত্র যেন
 বদলি করা না হয়, সেইরকম শাসনতান্ত্রিক বিধি প্রণয়ন করা।

৩.
 ক) ১. ১৭ আগস্ট,১৯৪৭ সালের পর থেকে যারা বেআইনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ
করে পাহাড় বা সমতল ভূমি ক্রয়,বন্দোবস্তি বা 'বেদখল' করেছে অথবা বসতি স্থাপন
করেছে সে সকল 'বেআইনি বহিরাগতদের' পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
২. এ দাবীনামা উথথাপনের পর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির মধ্যে
চুক্তিপুত্র সম্পাদিত না হওয়া পর্যন্ত যেসব 'বেআইনি অনুপ্রবেশকারী' পার্বত্য চট্টগ্রামে
জমি ক্রয়,বন্দোবস্তি বা বেদখল করে বসতি স্থাপন করবে তাদেরকেও সরিয়ে দিতে হবে.
খ) পাকিস্তান শাসনামলের শুরু থেকে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি
সমিতির মধ্যে চুক্তিপত্র সম্পাদিত না হওয়া পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যেসব অধিবাসী
ভারত ও বার্মায় চলে যেতে 'বাধ্য হয়েছে' তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করা।
গ) কাপ্তাই বাঁধের জলসীমা সর্বোচ্চ ষাট ফুট নির্ধারিত করা এবং এ বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত
উদ্বাস্তুদের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
ঘ) ১. পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কোন সদস্যের বিরুদ্ধে যদি কোন প্রকারের
মামলা,অভিযোগ,ওয়ারেন্ট ও হুলিয়া থাকে অথবা কারও অনুপস্থিতে কোন বিচার নিষ্পন্ন
হয়ে থাকে, তাহলে বিনাশর্তে সেসব মামলা,অভিযোগ, ওয়ারেন্ট,হুলিয়া প্রত্যাহার ও
বিচারের রায় বাতিল করা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।
২. পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সকল সদস্যের যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা
অবলম্বন করা।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কার্যকলাপে জড়িত করে বা মিথ্যা অজুহাতে জুম্ম
জনগণের মধ্যে যদি কারও বিরুদ্ধে কোন প্রকার মামলা,অভিযোগ,ওয়ারেন্ট ও হুলিয়া
থাকে অথবা কারো অনুপস্থিতিতে কোন বিচার অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে বিনাশর্তে সেসব
মামলা,অভিযোগ,ওয়ারেন্ট,হুলিয়া প্রত্যাহার ও বিচারের রায় বাতিল করা এবং কারো
বিরুদ্ধে কোন প্রকারের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।

৪.
ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের উন্নতিকল্পে কৃষি,শিল্প,শিক্ষা,সমবায়,সংস্কৃতি,স্বাস্থ্য,ধর্ম,ভাষা,
ব্যবসা-বাণিজ্য,পশুপালন,রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ,মৎস্য,বন,জল ও বিদ্যুৎ সরবারাহ খাতে 
বিশেষ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও সেজন্য কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ
বরাদ্দ করা।
খ) পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি নিজস্ব ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা।
গ) বিশ্ববিদ্যালয়,মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জুম্ম ছাত্র-ছাত্রীদের
 জন্য আসন সংরক্ষণ করা এবং বিদেশে গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষালাভের সুযোগ প্রদান করা।
ঘ) ১. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে জুম্ম জনগণের জন্য নির্দির্ষ্ট কোটা
সংরক্ষণ করা।

৫.পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য-
ক) সাজাপ্রাপ্ত অথবা বিচারাধীন অথবা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর হাতে আটককৃত সকল জুম্ম
নর-নারীকে বিনাশর্তে মুক্তি প্রদান করা।
খ) পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ওপর সকল প্রকারের নির্যাতন,নিপীড়ন বন্ধ করা।
গ) পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে যুক্তগ্রাম ও আদর্শগ্রামের নামে গ্রুপিং করার কার্যক্রম
 বন্ধ করা এবং যুক্তগ্রাম ও আদর্শগ্রামসমূহ ভেঙে দেয়া।
ঘ) ১.বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চল হতে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে 'বেআইনি' অনুপ্রবেশ, পাহাড়
ও সমতল ভূমি ক্রয়,বন্দোবস্তি ও বেদখল এবং বসতি স্থাপন বন্ধ রাখা।
 ২. লামা, রাজস্থলী,মাটিরাঙ্গা,রামগড়,মেরুং, পানছড়ি ও লংগদু থানা সমূহের বিভিন্ন অঞ্চলে
বসবাসরত বেআইনি বহিরাগতদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া।
ঙ) দীঘিনালা,রুমা ও আলিকদম সেনানিবাসসহ বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সকল ক্যাম্প
পর্যায়ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তুলে নেওয়া।

[১৯৮৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে দ্বিতীয় আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে এই পাঁচ দফা সংবলিত দাবিনামা বাংলাদেশ সরকার সমীপে আনুষ্ঠানিভাবে পেশ করা হয় ।]


গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রস্তাবিত ৯-দফাঃ

১৯৮৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ বৈঠকে সরকার পক্ষ তাঁদের ৯-দফা রুপরেখা জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদলের কাছে পেশ করেন। সেই ৯-দফা রুপরেখা ছিল নিম্নরুপঃ-

১) সংবিধানের ২৮ ধারার আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলাকে বিশেষ এলাকা হিসেবে
চিহ্নিতকরণ।
২) সংবিধানের ৯ ও ২৮ ধারার আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় প্রত্যক্ষ নির্বাচনের
মাধ্যমে সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন পৃথক পৃথক জেলা পরিষদ গঠন।
৩) বিষয় বিভক্তি ( Divison of Subjects) স্থিরকরণ।
৪) সংবিধানের ৬৫ ধারার আলোকে জেলা পরিষদসমূহকে মূল আইনের অধীন নির্দিষ্ট বিষয়ে
উপ-আইন,আদেশ,বিধি,প্রবিধান ইত্যাদি প্রণয়ন,জারি এবং কার্যকরী করার ক্ষমতা অর্পণ।
৫) জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোন আইন,জেলা পরিষদ কর্তৃক নিজস্ব এলাকার জন্য
আপত্তিকর বিবেচিত হলে সংসদে পুনর্বিবেচনার দাবি সরকারকে অবগতির জন্য
 আইনগত ক্ষমতা অর্পন।
৬) জেলা ও উপজাতীয় সার্কেলের এলাকা একত্রীকরণার্থে সীমানা পুননির্ধারণ।
৭) জেলা প্রধান এবং উপজাতীয় প্রধানের (Circle Chief) সংবলিত অবস্থান নির্ণয়ন।
৮) প্রতি সার্কেলে পুলিশ বাহিনী গঠন।
৯) পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েলের যথাযথ সংশোধন,বাস্তবায়ন অথবা বাতিলকরণ।
[বিদ্রঃ উপরোক্ত রুপরেখা নীতিগতভাবে গ্রহণ করা হলে যে আইনের অধীন স্থানীয় শাসন
প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই আইনকে সংরক্ষণ (Protection) করার জন্য সম্ভাব্য ব্যবস্থা করা যেতে পারে।]


জুম্ম জনগণের পক্ষ হতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সংশোধিত পাঁচ দফা দাবীনামাঃ  

চাকমা,মারমা,ত্রিপুরা,মুরং,বোম,লুসাই,পাংখো,খুমী,খিয়াং ও চাক- ভিন্ন ভাষাভাষী এই দশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির আবাসভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম।যুগ যুগ ধরিয়া এই দশটি ভিন্ন ভাষাভাষী জাতি নিজস্ব সমাজ,সংস্কৃতি,রীতি-নীতি,ধর্ম ও ভাষা লইয়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করিয়া আসিতেছে।বিশ্বের প্রতিটি জাতি বড় হউক আর ক্ষুদ্র হউক সব সময়ই নিজস্ব ধ্যান-ধারণার মাধ্যমে স্বীয় জাতীয় সংহতি ও জাতীয় পরিচিতি অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্ঠা চালাইয়া আসিতেছে।পার্বত্য চট্টগ্রামের দশটি ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম পাহাড়ি জনগণও ইহার ব্যতিক্রম নয়।
      ভারতের ব্রিটিশ সরকার এই মর্মকথা অনুধাবন করিতে সক্ষম হওয়ায় ১৯০০সালের ৬ই জানুয়ারি ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি প্রণয়ন করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখে।ইহার পরেও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে উক্ত শাসনবিধিকে পুনরায় স্বীকৃতি প্রদান করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক শাসিত অঞ্চলরুপে ঘোষণা করে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ক্ষমতা পাকিস্তান সরকারের হস্তে অর্পন করিয়া চলিয়া যায়।পাকিস্তান সরকার সংশোধিত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনকে অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসনের স্বীকৃতিও প্রদান করে। পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি গৃহীত হয় এবং এই শাসনতন্ত্রেও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি পৃথক শাসিত অঞ্চলরুপে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এই দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রে ভারত শাসন ও ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান শাসনতন্ত্রে ব্যবহৃত 'পৃথক শাসিত অঞ্চল' শব্দের পরিবর্তে "উপজাতীয় অঞ্চল" শব্দ ব্যবহার করিয়া ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন পরিচালনার আইন ঘোষণা করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতীয় অঞ্চলের মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বস্তুতঃ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত এই শাসনবিধি উপনিবেশিক, সামন্ততান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক ও ত্রুটিপূর্ণ। এই শাসনবিধিতে জুম্ম জনগণের প্রতিনিধিত্বের কোন বিধি ব্যবস্থা গৃহীত হয় নাই। এই কারণে ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে তদানিন্তন সরকারের নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবী উথথাপন করা হয়।
         ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে এই স্বাধীনতা যেন সকলের নিকট অর্থপূর্ণ হইতে পারে তজ্জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণও দেশ ও জাতির পুনর্গঠনের মহান কর্মকান্ডে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করিয়া বাংলাদেশের উপযুক্ত নাগরিক হইয়া বাঁচিয়া থাকিতে চাহিয়াছিল। তদুদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখিয়া নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত স্বায়ত্তশাসনের আবেদন করা হইয়াছিল। কিন্তু তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকার জুম্ম জনগণের সকল প্রকারের আবেদন ও বাসনা সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় ও ভূমির অধিকার সংরক্ষণের একমাত্র রক্ষাকবচ পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের সত্তা চিরতরে লুপ্ত করিয়া দিয়া ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম শাসনতন্ত্র ঘোষণা করে। ফলতঃ জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভূমির স্বত্ব সংরক্ষণের যতটুকু আইনগত অধিকার ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে ছিল তাও ক্ষুণ্ণ হইয়া যায়।
          ব্রিটিশ শাসনামল হইতে আজ অবধি জুম্ম জনগণ সকল ক্ষেত্রে বঞ্চিত,লাঞ্চিত,নিপীড়িত ও নির্যাতিত হইয়া আসিতেছে। ফলশ্রুতিতে ভিন্ন ভাষাভাষী দশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির জাতীয় অস্তিত্ব আজ চির বিলুপ্তির পথে। ইহা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি,সামাজিক রীতি-নীতি,ভৌগলিক পরিবেশ,আচার-অনুষ্ঠান,দৈহিক ও মানসিক গঠন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা প্রভৃতির ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ ও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় জুম্ম জনগণও বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চলের জনগণের ন্যায় দেশমাতৃকার সেবা করিতে দৃঢ়-সংকল্প কিন্তু বিশেষ এক শ্রেণির লোকের ষড়যন্ত্রের ফলে ঐতিহাসিকভাবে আজ তাহারা সেই মহান দায়িত্ব হইতে বঞ্চিত হইয়া রহিয়াছে। অথচ এই দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় করিবার ক্ষেত্রে জুম্ম জনগণ নীরবে সকল বঞ্চনা ও নিপীড়ন সহ্য করিয়াও অপরিসীম ত্যাগ স্বীকারে দ্বিধাবোধ করে নাই।
           ব্রিটিশ প্রদত্ত ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি জুম্ম জনগণের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করিতে পারে নাই। অনুরুপ 'পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ' দ্বারাও জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব,ভূমি স্বত্ব ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হইতে পারে নাই। কারণ এই পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ অগণতান্ত্রিক,সামন্ততান্ত্রিক,কম ক্ষমতাসম্পন্ন ও ত্রুটিপূর্ণ। বস্তুতঃ গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসন ব্যতিরেকে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ,ভূমিস্বত্ব ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভবপর নহে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগণের জাতীত অস্তিত্ব অর্থাৎ দশ ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণের সংহতি ,সংস্কৃতি,সামাজিক গঠন,অভ্যাস,প্রথা,ভাষা প্রভৃতি এবং ভূমিস্বত্ব অর্থাৎ পাহাড় ,বন ও ভূমির স্বত্ব সংরক্ষণের জন্য সর্বোপরি মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এবং সকল প্রকারের পশ্চাদপদতা অতি দ্রুতগতিতে অবসান করিবার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বার্থে জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক ১৯৮৭ সালের ১৭ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নিকট পেশকৃত আইন পরিষদসহ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত ৫(পাঁচ) দফা দাবি সংশোধিত আকারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট উপস্থাপন করা গেল-
১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান(Amendment) করিয়া-
ক) পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি পৃথক শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা প্রদান করা।
খ) আঞ্চলিক পরিষদ(Regional Council) সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন পার্বত্য চট্টগ্রামকে
প্রদান করা।
গ) এই আঞ্চলিক পরিষদ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের লইয়া গঠিত হইবে এবং ইহার
একটি কার্যনির্বাহী কাউন্সিল থাকিবে।
ঘ) আঞ্চলিক পরিষদে অর্পিত বিষয়াদির ওপর এই পরিষদ সংশ্লিষ্ট আইনের অধীনে                              বিধি,প্রবিধান,উপবিধি,উপআইন,আদেশ,নোটিশ প্রণয়ন,জারী ও কার্যকর করিবার
ক্ষমতার অধিকারী হইবে।
ঙ) পরিষদের তহবিল ও সম্ভাব্য আয়ের সাথে সংগতি রাখিয়া স্বাধীনভাবে বাৎসরিক বাজেট
 প্রণয়ন ও অনুমোদন করিবার ক্ষমতা এই পরিষদের হাতে থাকিবে।
চ) আঞ্চলিক পরিষদ নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের দ্বায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী
হইবে-
১.পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা; ২.জেলা পরিষদ,পৌরসভা,
ইউনিয়ন পরিষদ,ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ও অন্যান্য স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ;
 ৩.পুলিশ; ৪.ভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন; ৫.কৃষি,কৃষি ও উদ্যান উন্নয়ন; ৬.কলেজ,মাধ্যমিক
 ও প্রাথমিক শিক্ষা; ৭.বন,বনসম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন; ৮. গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা; ৯.আইন ও বিচার;
 ১০.পশু পালন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ; ১১.ভূমি ক্রয়,বিক্রয় ও বন্দোবস্ত; ১২.ব্যবসা-বাণিজ্য; ১৩.
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প; ১৪.রাস্তাঘাট ও যাতায়াত ব্যবস্থা; ১৫.পর্যটন; ১৬.মৎস্য,মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন
 ও রক্ষণাবেক্ষণ; ১৭.যোগাযোগ ও পরিবহন; ১৮.ভূমি রাজস্ব,আবগারী শুল্ক ও অন্যান্য কর
ধার্যকরণ; ১৯.পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ;২০.হাটবাজার ও মেলা; ২১.সমবায়; ২২.সমাজ কল্যাণ;
২৩.অর্থ; ২৪.সংস্কৃতি,তথ্য ও পরিসংখ্যান;২৫.যুব কল্যাণ ও ক্রীড়া; ২৬.জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও
পরিবার পরিকল্পনা; ২৭.মহাজনী কারবার ও ব্যবসা; ২৮.সরাইখানা,ডাকবাংলা,বিশ্রামাগার,
খেলার মাঠ ইত্যাদি; ২৯.মদ চোলাই,উৎপাদন,ক্রয়-বিক্রয় ও সরবরাহ; ৩০.গোরস্থান ও শ্মশান;
 ৩১.দাতব্য প্রতিষ্ঠান,আশ্রম,ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও উপাসনাগার; ৩২.জল সম্পদ ও সেচ ব্যবস্থা;
৩৩.জুমচাষ ও জুম চাষীদের(জুমিয়া) পুনর্বাসন;৩৪.পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন; ৩৫.কারাগার;
 ৩৬.পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

২.
ক) চাকমা,মারমা,ত্রিপুরা,মুরং,বোম,লুসাই,পাংখো,খুমী খিয়াং ও চাক- এই ভিন্ন ভাষাভাষী
দশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা;
খ) পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি 'বিশেষ শাসনবিধি' অনুযায়ী শাসিত হইবে সংবিধানে এই রকম
শাসনতান্ত্রিক সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা;
গ) বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল হইতে আসিয়া যেন কেহ বসতি স্থাপন,জমি ক্রয় ও
বন্দোবস্ত করিতে না পারে সংবিধানে সেই রকম সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা;
ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী নন এই রকম কোন ব্যক্তি পরিষদের অনুমতি ব্যতিরেকে
যাহাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করিতে না পারে সেই রকম আইনবিধি(Inner Line
Regulation)প্রণয়ন করা।তবে শর্ত থাকে যে কর্তব্যরত সরকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে ইহা
প্রযোজ্য হইবেনা।
ঙ) ১. গণভোটের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামত যাচাইয়ের ব্যতিরেকে পার্বত্য
চট্টগ্রামের বিষয় লইয়া কোন শাসনতান্ত্রিক সংশোধন(Amendment) যেন না করা হয়
সংবিধানে সেইরকম সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা;
২. আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পরামর্শ ও
সম্মতি ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় লইয়া যাহাতে কোন আইন অথবা বিধি
প্রণীত না করা হয় সংবিধানে সেই রকম শাসনতান্ত্রিক সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা;
চ) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের লইয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য স্বতন্ত্র পুলিশ বাহিনী
গঠন করা।তদুদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন করা;
ছ) যুদ্ধ বা বহিঃআক্রমণ ব্যতীত আভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে
বা উহার যে কোন অংশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন হইলেও
আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রান হইতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পরামর্শ ও
সম্মতি ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা না হয় সংবিধানে
সেই রকম শাসনতান্ত্রিক সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা;
জ) পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সরকারী,আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের
কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারী পদে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী নন এমন কোন
ব্যক্তিকে যেন নিয়োগ করা না হয় সেই রকম আইন বিধি প্রণয়ন করা।তবে কোন পদে
পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের মধ্যে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি না থাকিলে সরকার
হইতে প্রেষণে উক্ত পদে নিয়োগ করা।

২.
১. ক) রাঙ্গামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিন জেলা বলবৎ রাখিয়া একত্রে পার্বত্য
চট্টগ্রামকে একটি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ইউনিতে পরিণত করা।
 খ) পার্বত্য চট্টগ্রামের নাম পরিবর্তন করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামকে 'জুম্মল্যান্ড' (Jummaland)
 নামে পরিচিত করা।
২. পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি পৃথক মন্ত্রণালয় স্থাপন করা।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণের জন্য একটি বিশেষ বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন
করা।
৪.  পার্বত্য চট্টগ্রামস্থ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ আসনসমূহ জুম্ম জনগণের জন্য সংরক্ষিত
রাখিবার বিধান করা।
৫. ক) কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প কেন্দ্র এলাকা ( Power Project Centre Area),বেতবুনিয়া
ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র এলাকা,রাষ্ট্রীয় শিল্প কারখানা এলাকা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থে অধিগ্রহণকৃত
জমি ব্যতীত অন্যান্য সকল শ্রেণীর জমি,পাহাড় ও কাপ্তাই হৃদ এলাকা এবং
সংরক্ষিত (Reserved) বনাঞ্চলসহ অন্যান্য সকল বনাঞ্চল পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও
আওতাধীন করা।
খ) কাপ্তাই জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প কেন্দ্র এলাকা ( Power Project Centre Area),বেতবুনিয়া
ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র এলাকা,রাষ্ট্রীয় শিল্প কারখানা এলাকা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থে অধিগ্রহণকৃত
জমির সীমানা সুনির্দিষ্ট করা।
গ) পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোন প্রকারের জমি পাহাড় পরিষদের সম্মতি
ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর না করিবার প্রয়োজনীয় আইনগত
ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নন এমন ব্যক্তির দ্বারা বেদখলকৃত ও অন্য উপায়ে
বন্দোবস্তকৃত বা ক্রীত বা হস্তান্তরকৃত সমস্ত জমি ও পাহাড়ের প্রকৃত মালিকের
নিকট অথবা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা।
ঙ) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নন এমন ব্যক্তির নিকট বা কোন সংস্থাকে যে সমস্ত
জমি বা পাহাড় রাবার চাষ,বনায়ন অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে 'লীজ'(Lease) বা
বন্দোবস্ত দেওয়া হইয়াছে,সেই সমস্ত জমির লীজ ও বন্দোবস্ত বাতিল করা এবং
ঐ সমস্ত জমি ও পাহাড় পরিষদেরর নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন করা।
চ) সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প ও সেনানিবাস কর্তৃক পরিত্যক্ত সকল
এলাকা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন করা।

৩.
১. ১৭ই আগস্ট,১৯৪৭ সাল হইতে যাহারা বেআইনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ করিয়া
পাহাড় কিংবা ভূমি ক্রয়,বন্দোবস্ত ও বেদখল করিয়া অথবা কোন প্রকারের জমি বা পাহাড়
ক্রয়,বন্দোবস্ত ও বেদখল ছাড়াই বিভিন্ন স্থানে ও গুচ্ছগ্রামে বসবাস করিতেছে সেই সকল
বহিরাগতদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে অন্যত্র সরাইয়া লওয়া।
২. ১৯৬০ সালের পর হইতে যে সকল জুম্ম নর-নারী ভারতে চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছে
তাহাদের সকলের সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন ও সুষ্ঠু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩. কাপ্তাই বাঁধের সর্বোচ্চ জলসীমা নির্ধারণ করা এবং কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারসমূহের
সুষ্ঠু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
৪. ক) সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ক্যাম্প ব্যতীত সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সকল
ক্যাম্প ও সেনানিবাস পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে তুলিয়া লওয়া।
খ) বহিঃশত্রুর আক্রমণ,যুদ্ধাবস্থায় জরুরী অবস্থা ঘোষণা ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন
সেনাবাহিনীর সমাবেশ না করা ও সেনানিবাস স্থাপন না করা।

৪.
১. ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সকল সদস্যদের যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা
অবলম্বন করা।
খ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসং হতি সমিতির কোন সদস্যের বিরুদ্ধে যদি কোন প্রকারের
মামলা,অভিযোগ, ওয়ারেন্ট,হুলিয়া থাকে অথবা কাহারও অনুপস্থিতিতে যদি কোন
বিচার নিষ্পন্ন হইয়া থাকে তাহা হইলে বিনা শর্তে সেইসব মামলা,অভিযোগ,ওয়ারেন্ট ও
 হুলিয়া প্রত্যাহার ও উক্ত বিচারের রায় বাতিল করা এবং কাহারও বিরুদ্ধে কোন
প্রকারের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।
গ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কার্যকলাপে জড়িত করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী
বাসিন্দাদের মধ্যে যদি কাহারও বিরুদ্ধে কোন প্রকারের মামলা,অভিযোগ, ওয়ারেন্ট,
হুলিয়া থাকে অথবা কাহারও অনুপস্থিতিতে যদি কোন বিচার নিষ্পন্ন হইয়া থাকে তাহা
হইলে বিনা শর্তে সেইসব মামলা,অভিযোগ,ওয়ারেন্ট ও হুলিয়া প্রত্যাহার ও উক্ত বিচারের
রায় বাতিল করা এবং কাহারও বিরুদ্ধে কোন প্রকারের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।
২. ক) বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে জুম্ম জনগণের জন্য নির্দির্ষ্ট কোটা
সংরক্ষণ করা।
খ) বিশ্ববিদ্যালয়,মেডিকেল কলেজ,ক্যাডেট কলেজ,কারিগরী ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
 জুম্ম ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা
 লাভের সুযোগ প্রদান করা।
গ) সরকারী চাকুরীতে জুম্ম জনগণের জন্য বয়ঃসীমা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা।
৩. ক) সরকারী অনুদানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা।
 খ) ভূমিহীন ও জুম চাষীদের (জুমিয়া) পুনর্বাসনসহ কৃষি,শিল্প,শিক্ষা,স্বাস্থ্য,সংস্কৃতি,রাস্তা-ঘাট
 প্রভৃতি খাতে বিশেষ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও তজ্জন্য সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় অর্থ
 বরাদ্দ করা।
 ৪. পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা।
৫. পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বহাল রাখা এবং উহা পরিষদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা।

৫. পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে অনুকূল পরিবেশ
গড়িয়া তোলা একান্ত অপরিহার্য।তৎপ্রেক্ষিতে-
১. সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন বা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর হেফাজতে আটককৃত সকল জুম্ম
নর-নারীকে বিনাশর্তে অনতিবিলম্বে মুক্তি প্রদান করা।
২. পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনকে অনিতিবিলম্বে বেসামরিকীকরণ করা।
৩. জুম্ম জনগণকে গুচ্ছগ্রাম,বড়গ্রাম,শান্তিগ্রাম,যুক্তগ্রাম ও আদর্শগ্রামের নামে গ্রুপিং
করিবার কার্যক্রম বন্ধ করা এবং এই গ্রামসমূহ অনতিবিলম্বে ভাঙ্গিয়া দেওয়া।
৪. বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চল হইতে আসিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ,বসতি স্থাপন,
পাহাড় ও ভূমি ক্রয়, বন্দোবস্ত,হস্তান্তর ও বেদখল বন্ধ করা।
৫.পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ও গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত বহিরাগতদেরকে পর্যায়ক্রমে
পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে অনতিবিলম্বে অন্যত্র সরাইয়া লওয়া।
৬. সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (BDR) ক্যাম্প ব্যতীত অন্যান্য সামরিক ও আধা-সামরিক
বাহিনীর সেনানিবাস ও ক্যাম্পসমূহ পর্যায়ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে তুলিয়া লওয়া।
                                                                                                                                                                   
[বিঃদ্রঃ-৪ ডিসেম্বর,শুক্রবার,১৯৯২ পার্বত্য চট্টগ্রাম যোগাযোগ কমিটির মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক সংশোধিত আকারে পাঁচ দফা দাবীনামা পেশ করা হয়।]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...