রবিবার, ২৮ জুন, ২০২০

"মায়ানমারের চাকমা জাতিগোষ্ঠী ও তাদের সমাজ" - Pannya Thiri ভান্তে

মায়ানমার বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যার আয়তন ৬.৭৭.০০০ বর্গ কিঃমিঃ।এটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বৃহত্তম দেশ, যাকে বলা হয় গোল্ডেন প্যাগোডার দেশ।

মায়ানমার বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক থেকে পাচভাগ বড় এবং সিংহভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
মায়ানমারে ১৩৫ টি স্বীকৃত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী
রয়েছে ।

মায়ানমারে স্বীকৃত সকল জনগোষ্ঠীই ইন্দো-আর্য বংশোদ্ভূত। মায়ানমারে সাতটি রাজ্য আছে, এই
সাতটি রাজ্যের মধ্যে চাকমারা বাস করে রাখাইন রাজ্যে। মায়ানমার সংবিধানে চাকমাদের ‘‘চাকমা’’
হিসাবে স্বীকৃতি নই, সেখানে ’’দৈনাক’’ নামে স্বীকৃত। সুভাগ্যের বিষয় হচ্ছে যে মায়ানমারে বসবাসরত সকল দৈনাক নিজেদেরকে চাকমা হিসেবে পরিচয়। বিশ্বের অনন্তকাল প্রবাহের স্রোতে মানুষ অনেক
ঘটনাকে ভূলে যায়, ভূলে যায় কালগর্ভে হারিয়ে যাওয়া অতীতের বহুস্মৃতি। ঠিক তেমনি আমরাও  হারাতে বসেছি আমাদের গৌরবজ্জলের সুদীর্ঘ ইতিহাস। যে ইতিহাস আজ আর আমাদের লোকগাথাগুলিতে পাওয়া যায় না। বলতে শুনা যায় না কোন এক বয়স্ক ব্যক্তির কাছে। কোন এক
সময় বলতে শুনা যেত উত্তরের চাকমা, দক্ষিনের চাকমা, পশ্চিমের চাকমা এবং পূর্বের চাকমা। তাহলে আমরা কি অনেক আগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছি ? চাকমাদের গেংহুলিগুলিতে আরাকান রাজ্য জয়ের ইতিহাস পাওয়া যায়। যেখানে বিজয়গিরি সাতচমু সৈন্য নিয়ে এবং সেনাপতি রাধামনকে সাথে নিয়ে আরাকানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।


এসমস্ত ইতিহাস আজ আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে লোকমূখে বলা নানা ধরনের রূপকথার গল্পগুলি। আজ আর শুনা যায় না অলিগীদগুলি, যেগুলি শুনিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়ানো হত। মায়ানমারের ইতিহাসের আলোকে চাকমা জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা আমরা দেখতে পাই, প্রাচীনকালে মায়ানমার তিন ভাগে বিভক্ত ছিল । তন্মধ্যে একভাগ ছিল চাকমা রাজার অধীনে, যেটি ছিল উচ্চ বার্মা। তাই চাকমাদেরকে বলা হল উচ্চ বার্মার অধিবাসী। Shwe Lu maung মায়ানমারের প্রাচীন ইতিহাস U kala’s Maharazawin (Great History by U kala) এতে উদ্ধৃতি দিয়ে লেখেন, ‘‘The Tibeto-Burman group is believed to have consisted of three tribes: The pyu, The kanyan and The thet
(Chakma)”. Tagaung Era and Dynasty সম্পর্কে তিনি আরও লেখেন, ‘‘Very Legendary and ancient. Bhama historian claim the origin of Bhama in this kingdom. A total fifty kings are listed to have ruled. The capital Tagaung is situated is northen Burma. There were two dynastied. The first one was founded by king Abi Raza and the second one by king Daza Raza, both of whom came from india and belonges to the Thet-kye-tha-gi i or tha-gii-win Royal Dynasty.” উলেস্নখিত তথ্য অনুসারে
এটা বোঝায় যে king Abi Raza এবং Daza Raza উভয়ে ভারতভূমি থেকে আগত শাক্য রাজবংশীয়। মায়ানমার ভাষায় Thet-kya অর্থে শাক্য বোঝায় এবং Thet শব্দটি Thet-kya শব্দের সংক্ষিপ্তরূপ। মায়ানমারের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে চোখ ভুলালে আমরা দেখতে পাই, যে চাকমারা মায়ানমারে প্রাচীন জনগোষ্ঠীদের মধ্যে একটি প্রধান প্রাচীন জনগোষ্ঠী। মায়ানমারে প্রাচীন জনগোষ্ঠীরা হলো- পিউ (Pyu), ক্যানর্যান (kanran), ও থেট বা সাক (Thet)।


মায়ানমারে চাকমাদের থেক বা সাক বলে ডাকে। বর্তমানে মায়ানমারে চাকমাদের জনসংখ্যা ৪০.০০০ (চলিস্নশ হাজার) এরও অধিক বলে জানা গেছে। শিক্ষাগত দিক দিয়ে মায়ানমারের চাকমারা অনেক পিছিয়ে। শিক্ষার হার 5% ভাগের ও কম। বর্তমানে শিক্ষাগত সচেতনার জন্য অনেক চাকমা দায়ক ভিক্ষুগণ কঠোরভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

চাকমাদের বসবাস অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও অউন্নত। মায়ানমারে বসবাসকৃত চাকমা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির তালিকা নিম্নে তুলে ধরা হল।
1. বুসিডং টাউনশীপ 2. মাম্রা টাউনশীপ 3. ক্যোয়ক-ত টাউনশীপ 4. মংডু’ টাউনশীপ 5. পুঞ্ঞা জুআইন টাউনশীপ 6. পালা ওয়া টাউনশীপ 7. ম্রক-উ টাউনশীপ 
মায়ানমারে চাকমাদের গ্রামের সংখ্যা মোট ৮০ টি। নিম্নে গ্রামগুলির নামের তালিকা দেওয়া হল (এছাড়া 5পরিবার ভিত্তিক গ্রামগুলো তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করা
হয়নি)।
 
* বুসিডং এলাকায় (উত্তর)
১. তাইমাই সং ২. সাং-সি রোয়া ৩. নাসকিন ডং ৪. লং সং’ (ন’ছড়া) ৫. প্রিন সং’৬. আঙ সং’ ৭. মিনসং গংসোয়ে ৮. বাদানা ৯. ইয়াং বং ১০. রোয়াচায়া
 
* বুসিডং এলাকা (উত্তর-২) 
১. পেংগুমা ২. আঙসং’ ৩. দু-দাইন ৪. পক্কাইস ৫. চাঙমা উগাইন ৬. পিরাকা পিয়া ৭. সাং সং ৮. সা-ইন প্রা ৯. মেইনঝারি ১০. বাহো প্রাঙ ১১.পক্কেওয়া ১২. ও-প্রু ১৩. রে-কোয়ে ১৪. মঙ-নি রোয়া ১৫. কালাবী ম্রঙ ১৬. কাঠিলা ১৭. লাঙ-নু কং ১৮. বাবুং ১৯. বাদাগা ২০. রোয়া হং ২১. রোয়া সেক ২২. ঙা-ম্রাঙ ব্ 
 
* বুচিতঙ এলাকায় (দক্ষিন)
১. বুসিতঙ টাউনশীপ ২. তঙ-ম’ রোয়া (লাম্বাঘোনা) ৩. তিন-তঙ প্রাং ৪. আ-তঙ প্রাং ৫. সাবাইক ডং
৬. কাংসং ৭. ঞং সং 
 
* বুচিতঙ এলাকায় (পূর্ব )
১. কাইন তিং 
 
*মামপিয়া এলাকা
১. সোয়ে ডং ২. উ-পিন ডং ৩. জিগুং ৪. মিজি পাঙচু ৫. লাপাইনগুং ৬. য়ানবাম্নন ওয়াইন ৭. পাইন ম্রঙ
 
 * ক্যোয়ক-ত’ টাউনশীপ
১. লিসাইন দঙ ২. কেয়ক ত’ টাউনশীপ ৩. রোয়া-মা প্রাঙ ৪. আলি জুআইন ৫. পাইন ম্রং ৬. পাঙদাইন ৭. দুকাই সং’ ৮. কেয়ক দাইন ৯. সাপেগুং 
 
* ম্রক-উ টাউনশীপ
১. নাইন জা’ ২. রক’ পুং জাইন ৩. কেরক পাংগুং ৪. মিজিলি গুং ৫. আং-রি 
 
* পুঞ্ঞা জুআইন টাউনশীপ
১. রাঙ-ড্ 
 
* মংডু’ এলাকা
১. মিধিখ ২. সাংবালা(১) ২. সাংবালা(২) ৩. তঙমুড়ু ৪. রে-সং প্রাং ৬. তামাইন সা ৭. মাঙ্গালা নোআইন
৮. অং তাব্রে ৯. ওইলা ডং ১০. রে নঙ ঞাচা ১১. ম্রাওয়াদি ১২. রাঙাজিজি ১৩.সুইলাব্রে ১৪. সুই-হ্লা এ
 
* পালেওয়া টাউনশীপ
১. সাঠি গুং ২. তারাগা সং ৩. রে-এ সং
 
শিক্ষাগত দিক দিয়ে মায়ানমারের চাকমারা অনেক পিছিয়ে। শিক্ষার হার 5% ভাগের ও কম। বর্তমানে
শিক্ষাগত সচেতনার জন্য অনেক চাকমা দায়ক ভিক্ষুগণ কঠোরভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। চাকমাদের বসবাস অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও অউন্নত। বর্তমানে মায়ানমারের চাকমারা শিক্ষাই  অনগ্রসর এবং এখনো এমন কিছু এলাকা আছে যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছাইনি।


মায়ানমার আর বাংলাদেশ, ভারতের চাকমাদের মধ্যে উচ্চারগত পার্থক্য বিদ্যমান যা নিজ দেশের বৃহৎজনগোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত। তবে আজ মায়ানমারে বসবাসকৃত দৈনাক নামধারী চাকমারা অনেক সচেতন হয়েছে।বর্তামানে মায়ানমারে বসবাসরত এলাকায় এখনো অনেক এলাকা আছে যেখানে স্কুল কলেজ হয়নি যা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তবে তারা বার্মা বর্ণমালাতে শিক্ষা লাভ করে। তাদের বাড়িগুলি এখনো মাচা ঘর, আমাদের উচিত তাদেরকে সাহায্য করা, তাদের পাশে দাড়ানো। তাদেরকে "দৈনাক" বললে যতটুকু সন্তুস্তিরতা তার চেয়ে অধিক সন্তুস্ত হয় "চাকমা" ডাকলে তখন যেন স্বস্তি পায়। তাদের সাথে আমাদের (বাংলাদেশ, ভারত সহ চাকমা) কথা বলার ভঙ্গি ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে কারণ
তারা সেখানকার বৃহৎ জাতিকে অনুসরণ করা হয়ে থাকে। আরো অতীতেও অনেক চাকমা বার্মা ও রাখাইন জাতির সাথে মিশে গেছে, তাদেরকে আর চেনার উপাই নেই। কারণ সবাই ইন্দো-আর্য বংশদূত। আজ যেসব চাকমা সেখানে বাস করে তাদের মধ্য অনেকে বার্মার সাথে মিশে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু সেখানকার বর্তমান চাকমা প্রজন্ম যথেষ্ট সচেতন হয়েছে। মায়ানমারের চাকমারা বহু অতীত হতে প্রতি বছর ‘জানুয়ারী মাসের ৭ তারিখে চাকমা দিন’’ হিসেবে পালন করে। এই ন্যাশন্যাল ডে 2011 সাল থেকে পালন করে আসছে। বর্তমানে মায়ানমার চাকমাদের ফেসবুকে বেশ কয়েকটা ফেইজ আছে তন্মধ্যে ‘‘Chakma Community/Socity of Mayanmar অন্যতম।
 
মায়ানমারের চাকমারা কেন চাকমা দিন পালন করে?
মায়ানমার চাকমাদের কাছে ৭ জানুয়ারী জাতীয় দিন হওয়ার কারন পরিলক্ষিত। মায়ানমারের  ইতিহাসের মতে খ্রীষ্ট জন্মের ৮৫০ (৯২৩ ও বলা হয়) বছর আগে অভিরাজা/অভিরথ প্রথম শাক্য রাজা ভারত থেকে টগাউঙ রেজ্য বার্মায় স্থাপন করেন। এই শাক্য জাতির কিছু লোক ১৩৩৩-৩৪ মইচ্যাগিরিতে বাস করত। সে সময় মইচ্যাগিরির রাজার ছিল ইয়াংজ (বার্মা রাজা)। বার্মা রাজা ইয়াংজ এর সাথে মেঙ্গাদি নামক স্থানে মগ রাজা মিত্থির সাথে যুদ্ধ বাধে, আর এ যুদ্ধে মগ রাজা মিত্থি চাকমাদের চিরতরে বিলুপ্ত করতে 6 জানুয়ারি পর্যন্ত গনহত্যা করে। অনেকেই পালিয়ে গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয় এবং যুদ্ধ শেষে মগ রাজা চলে গেলে ৭ জানুয়ারি জীবিত চাকমারা চিৎকার করে উঠে যে, "আমি এজ বেক্কুন ন্ মুরি" আমাদেরকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিতে পারে নাই। আর এই দিনটিকে স্মরণ রাখার জন্য মায়ানমারের চাকমারা ৭ জানুয়ারীকে চাকমা জাতীয় দিন হিসেবে পালন করে ।

লেখকঃ Pannya Thiri ভান্তে।

Comments

1 টি মন্তব্য:

  1. জুু জু জানাঙ,লেগার সৃষ্টি ও মেধাআনরে সম্মান জানেনেই এই লেগাআন জাত্তুন পা ওয়ি তারে দ অনন্ত কৃতজ্ঞতা স্বীকার গরানা উচিত বলি মনে গরঙ,,,অনন্ত কার্টেসি দিয়া যেদ।

    উত্তরমুছুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...