মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০২০

দেশবিভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম

শুরুর কথা,১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে “ভারত স্বাধীনতা আইন- ১৯৪৭“ পাশ হয়। এই আইন পাশ ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের অবসান নিশ্চিত করে ।এক মাস পরে ভারত দুভাগ হয়ে যায় ।দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে ।ভারতের অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী  এবং গুরুত্বপূর্ণ দুটো  প্রদেশ – বাংলা ও পাঞ্জাবকে পূর্ব-পশ্চিম অংশে ভাগ করা হয় ।ব্রিটিশ সরকার স্বীকৃত স্বশাসিত রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে সম্পূর্ণ  অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।দেশবিভাগের ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায় এবং ১.২ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়। 

দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারণাঃ

এই তত্ত্বের প্রবর্তক মুহম্মদ আলী জিন্নাহ । এই তত্ত্ব অনুসারে পাকিস্তান রাষ্ট্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে গঠিত হয়।এবং ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে যায়।প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশ-বেলুচিস্তান(৯১.৮%),সিন্ধুর (৭২.৭%)  মুসলিম জনসংখ্যা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখে।

এছাড়া বাংলা প্রদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব অংশ এবং পাঞ্জাবের মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম অংশ পাকিস্তান গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিম অংশ এবং পাঞ্জাবের হিন্দু ও  শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব অংশ ভারতে থেকে যায়।মূলত ধর্মের ভিত্তিতে একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ও প্রস্তাব মুসলিম লীগের “লাহোর প্রস্তাব-১৯৪০” -এ উন্থাপন  করা হয়েছিল।এই ধারণা পরবর্তীতে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন করে।


ভাইসর‌য় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও স্যার শেরিল র‌্যাডক্লিফঃ


ধর্মের ভিত্তিতে ভূমি ভাগ করা খুবই জটিল এবং বির্তকিত ছিল।বিশেষ করে পাঞ্জাব প্রদেশ,সেখানে মুসলিম,হিন্দু ও শিখ জনগোষ্ঠীর একসঙ্গে বসবাস ছিল।

১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি হতে ১৯৪৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত এ সময়সীমার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের আদেশ নিয়ে ভারতের শেষ ভাইসরয় নিযুক্ত হন লর্ড মাউন্টব্যাটেন।তিনি ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।ইংল্যান্ডের বর্তমান রাণী ২য় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপের আপন মামা।২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক সংকটকালীন সন্ধিক্ষণে তিনি ভারতীয় প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।জানা যায়,মাউন্টব্যাটেন পূর্বের ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের দেশভাগের পরিকল্পনা অনুসারে চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন।

এদিকে দেশবিভাগের জটিলতা নিরসন ও ‍চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ করতে ব্রিটিশ সরকার স্যার শেরিল র‌্যাডক্লিফকে নিয়োগ দেয়।র‌্যাডক্লিফ ইংল্যান্ডের  একজন বিখ্যাত আইনজীবী এবং ব্রিটিশ সরকারের একজন বিশ্বস্ত ও অনুগত কর্মচারী ছিলেন।এর আগে তিনি কখনো ভারতবর্ষে আসেননি।১৯৪৭এর জুনের দিকে তাঁকে জানানো হয়,বাংলা ও পাঞ্জাবের ‍চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ কমিশনে তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছে।

ব্রিটিশ সরকার পাঁচ সদস্যর একটি করে বাংলা ও পাঞ্জাবের জন্য আলাদা আলাদা “সীমানা নির্ধারণ কমিশন” গঠন করে।প্রতি কমিশনে দুজন জাতীয় কংগ্রেসের ও দুজন মুসলিম লীগের সদস্য ছিল।পঞ্চম ব্যাক্তি হিসেবে স্বয়ং র‌্যাডক্লিফ কমিশনের সভাপতি পদে আসীন ছিলেন।সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়,দেশবিভাগের সময় অচলাবস্থা ও হিংসাপূর্ণ আচরণের সময় র‌্যাডক্লিফ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

স্য়ার রেডক্লিফ পক্ষপাতশুন্য সীমানা নির্ধারণে মাত্র ০৫ সপ্তাহ সময় পেয়েছিলেন।র‌্যাডক্লিফ এবং কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের সীমানা নির্ধারণে স্থানীয় জ্ঞান  ও বাস্তব অভিজ্ঞতা কোনটাই ছিল না।তাঁদের হাতে জরীপ চালানো ও স্থানীয় তথ্য় সংগ্রহ করার পর্যাপ্ত সময়ও ছিল না।কমিশনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের উপস্থিতি থাকলেও তাঁরা কেউই আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেননি।

স্যার র‌্যাডক্লিফ কমিশনের কাজের স্বচ্ছতাও নিরপেক্ষতার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেন।যদিও মাউন্টব্যাটেন তাঁর সহপাঠী ছিলেন।স্যার র‌্যাডক্লিফ এবং এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন উভয়েই জানতেন যে সীমানা নির্ধারণ কোনো দলের কাছে পুরোপুরি কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না।র‌্যাডক্লিফ যেসব সীমানা নির্ধারণ করছেন এর আগে তিনি কখনো দেখেননি।তিনি মাউন্টব্যাটেনকে সর্তক করেছিলেন যে যদি আজ তাড়াহুড়ো করে সীমানা নির্ধারণ করা হয় তাহলে পরে অনেক ভুল ও বিভ্রান্তি তৈরি হবে।র‌্যাডক্লিফ আলী জিন্নাহ ও নেহেরুর সাথে এ বিষয়ে আলাপ করেন।তাঁরা খুব কম বিষয়ে একমত হতেন কিন্তু তাঁরা সেদিন ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের আগে দেশবিভাগ চেয়েছিলেন এবং এই বিষয়ে সেদিন দুজনে সম্পূর্ণে একমত হয়েছিলেন।

র‌্যাডক্লিফ জানতেন তিনি যাই করেন না কেন ভারতের জনসাধারন এর ভুক্তভোগী হবে এবং এটা নিশ্চিত যে তাঁরা ব্যাথা পাবে।সীমানা নির্ধারণ সমস্যা নিরসনের জন্য র‌্যাডক্লিফকে ২০০০ পাউন্ড দেওয়া হয়েছিল কিন্ত তিনি তা প্রত্যাখান করেছিলেন।


কমিশনের সিদ্ধান্তের গোপনীয়তাঃ

মতবিরোধ এবং বিলম্ব এড়ানোর জন্য বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাজন গোপন করার সিদ্ধান্ত হয়।১৯৪৭ এর ৯-১২ আগস্টের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছিল।কিন্তু কমিশনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয় ১৭ আগস্ট ১৯৪৭ সালে।

র‌্যাডক্লিফ ১৫ আগস্ট ইংল্যান্ডে রওনা দেন এবং যাবার আগে কমিশনের কাজে সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট,ফাইল-পত্র পুড়িয়ে ফেলেন।তিনি আর কখনো ভারতবর্ষে আসেননি।

 

পাঞ্জাবঃ

র‌্যাডক্লিফ পাঞ্জাবকে মুসলিম ও অমুসলিম জনসখ্যার ভিত্তিতে ভাগ করেন।পাঞ্জাব ভাগ করা একটি কঠিন কাজ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ শিখদের নিয়ে।শিখরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আধিপত্য মানতে এবং ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত হতে মোটেই ইচ্ছুক ছিল না।শিখনেতা ডা.বীর সিং ভাট্টি ‘খালিস্তান’ নামে পৃথক রাজ্য গঠনের প্রস্তাব দেন ।শিখনেতা মাস্টার তারা সিং,গিয়ানী কর্তার সিং এতে সমর্থন দেন।কিন্তু পরবর্তীতে শিখদের ভারতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। স্বাধীন ভারতবর্ষে শিখরা বর্তমান সময়ে এসেও পৃথক রাজ্যে গঠনের দাবি জানাচ্ছে।

লাহোরঃ

লাহোর জেলায় ৬৪.৫%  মুসলিম জনসংখ্যা ছিল।কিন্তু লাহোর শহরে ৮০% হিন্দু এবং শিখ জনগোষ্ঠী ছিল।কথা ছিল লাহোর ভারতে অর্ন্তভুক্ত হবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি পাকিস্তানে থেকে যায়।কারণ লাহোর ছাড়া ভারতে বড় কোনো শহর ছিল না।বাংলার বড় শহর কলকাতাকে ভারত অর্ন্তভুক্ত করা হলে আর বড়  কোনো শহর না থাকায় লাহোর ও ঢাকাকে পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।প্রশ্নের বিষয়,দেশ বিভাগ ধর্মীয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে হওয়ার কথা ছিল,সম্পত্তির ভিত্তিতে নয়।

গুরুদাসপুর জেলাঃ

এ জেলাটি পাঞ্জাব প্রদেশের সর্বউত্তরে এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জেলা।দেশবিভাগের পূর্বে এই জেলাটি চারটি তহশিলে বিভক্ত ছিল- শঙ্খরগড় তহশিল,পাঠানকোট তহশিল,গুরুদাসপুর তহশিল,বাতালা তহশিল ।শঙ্করগড় মুসলিম অধ্যুষিত তহশিল হওয়ায় এটি পাকিস্তানে দেওয়া হয়।গুরুদাসপুর জেলাকে ভারতে অর্ন্তভুক্ত করার কারণ ছিল-এর প্রাকৃতিক সম্পদ।এ জেলা ছিল শতদ্রু খালের মুখ,যা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উৎস।এছাড়া শিখদের পবিত্র ধর্মীয় স্থান এই জেলায় অবস্থিত।

পাকিস্তানিরা মনে করেন,লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই জেলা ভারতকে দিয়েছিলেন কারণ এই জেলা ছিল দিল্লী থেকে কাশ্মীরে যাবার সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ।যদিও এই দাবি বির্তকিত।কাশ্মীর তখন স্বাধীন রাজ্যে ছিল এবং ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়নি। এই জেলায় মুসলিম ৫০.২% ছিল।

ফিরোজপুরঃ

বর্তমানে ভারতীয় ইতিহাসবিদরা বলেন,লর্ড মাউন্টব্যাটেন ফিরোজপুর জেলাকে উপহার হিসেবে ভারতকেই দিয়েছিলেন।এই জেলার অধিকাংশ তহশিল ছিল মুসলিম প্রধান।

খুলনা,মূর্শিদাবাদ,করিমগঞ্জঃ


খুলনা জেলা ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ(৫২%) কিন্তু এটি পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।মূর্শিদাবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ জেলা।কলকাতা বন্দর হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত এই মূর্শিদাবাদ গঙ্গা থেকে পৃথক হয়েছে।যদি মূর্শিদাবাদ পাকিস্তানে অর্ন্তভু্তে হত তাহলে রাজধানী শহর কলকাতা ও কলকাতা বন্দর সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ত।আসামের করিমগঞ্জ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ভারতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে যোগাযোগের সুবিধার্থে এটি ভারতে রাখা হয়।



পার্বত্য চট্টগ্রামঃ

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একটি অতি অমুসলিম প্রবণ অঞ্চল যরি ৯৭% ছিল অমুসলিম এবং তাদের মধ্যে ৮০% ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।তা সত্ত্বেও এটিকে পাকিস্তানের-পূর্ব পাকিস্তান(বাংলাদেশ) অংশে সম্পূর্ণ অন্য়ায় এবং অযৌক্তিকভাবে জুড়ে দেওয়া হয়।

১৯৪১ সালের ভারতের আদমশুমারী অনুযায়ী,পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট জনসংখ্যা ছিল ২,৪৭,০৫৩ জন।তাঁর মধ্যে পাহাড়িদের সংখ্যা ছিল ২,৩৩,৩১২ জন এবং মুসলিম বাঙালি জনসংখ্যা ছিল ৭,২৭০ জন এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৪,৮৮১ জন।

১৯৪৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি” পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের রাজনৈতিক দাবী সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।জনসমিতি বাংলার সীমানা নির্ধারণ কমিশনের কাছে দাবী জানায়,যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি অতি অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল সেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতেই থাকতে চায়।বলা হয়,পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কমিশন এবং সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কেউ ছিল না।সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সরকারীভাবে সেরকম কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি।স্বাভাবিকভাবেই অমুসলিম প্রধান এ অঞ্চলের জনগণ এবং ভারতের অধিকাংশ জনগণ ভেবেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতে অর্ন্তভুক্ত হবে ।

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তারিখ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ জানতো না তাঁরা কোন দেশের অর্ন্তভুক্ত হতে যাচ্ছে।

১৭ আগস্ট বিকেলে পাকিস্তানে রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় এটি পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করার কারণ হিসেবে যেসব বিষয় দেখানো হয়-

১)পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ভারতের অনধিগম্য।পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ভারতে আসা যাওয়ার সহজ ও সুগম  পথ নেই;

২)এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অর্থনীতি,নিত্য প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ চট্টগ্রামের(সমতল) উপর নির্ভরশীল;

৩)চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান,বন্দরের ভূমির উপর নির্ভরশীলতা এবং গ্রামাঞ্চল কতৃক শহরাঞ্চলকে সাহায্যে প্রদান;

৪)পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদের (বনজ,খনিজ সম্পদ…) উপর চট্টগ্রামের (সমতল) নির্ভরশীলতা;

৫)কর্ণফুলী নদীর নিয়ন্ত্রণ ও এর উৎস; এই অঞ্চলের নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করা ব্রিটিশদের পরিকল্পনা ছিল।পাকিস্তান সরকার কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন করে।

৬)১৯৮০ সালে এইচ এন পন্ডিত অমৃতবাজার পত্রিকায় লিখেন, ”The  Ferozpur scandal was linked with a matter of life and death for the Buddhist Tribals of CHT in Bengal.” অর্থাৎ মুসলিম অধ্যুষিত ফিরোজপুর জেলা ভারতে অর্ন্তভুক্ত হওয়ার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।

৭)পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও শিখ ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর কারণে ভারতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।এর ফলস্বরুপ অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্ত করা হয় ।


দেশভাগের সময় পার্বত্য নেতাদের কার্যক্রম  এবং ঘটনাপ্রবাহঃ

এসময় এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন-স্নেহ কুমার চাকমা,কামিনী মোহন দেওয়ান,ঘনশ্যাম দেওয়ান,চাকমা রাজা নলীনাক্ষ রায়,প্রতুল চন্দ্র দেওয়ান প্রমুখ।

স্নেহ কুমার চাকমা ১৯৪৫ সালে সিমলায় অনুষ্ঠিত “ Wavell Conference”  এ যোগদান করেন।সেখানে তিনি সর্বভারতীয় নেতাদের কাছে অনুরোধ করেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অর্ন্তভুক্ত করার। তিনি পন্ডিত নেহেরু এবং মাওলানা আজাদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আলাদাভাবে আলাপ করেন,উভয়েই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়া হবে না।

এর পরবর্তী ১৯৪৬ সালে এ ভি ঠক্করকে সভাপতি করে একটি সর্বভারতীয় “ Excluded Areas Sub-committee of the Constituent Assembly of India” কমিটি গঠিত হয়।পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্নেহকুমার চাকমা কমিটির সদস্য নির্বিাচিত হন।তিনি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতির সাধারন সম্পাদক।

১৯৪৭ সালের ৩ এপ্রিল গঠিত কমিটির একটি টিম রাঙামাটি আসে।পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কি ধরনের শাসন চাই তা খতিয়ে দেখা এবং সে অনুযায়ী হাইকমান্ডের কাছে রিপোর্ট করা,সেই উদ্দেশ্য নিয়ে এই কমিটি রাঙামাটি আসে।

এর পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সাথে অর্ন্তভুক্ত করার জন্য স্নেহকুমার চাকমা,কামিনী মোহন দেওয়ান মহাত্না গান্ধী,সর্দার প্যাটেল,জওহরলাল নেহেরুসহ তৎকালীন কংগ্রেসের বাঘা বাঘা নেতাদের সাথে দেখা করেন।জানা যায়,কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে বল্লভভাই প্যাটেল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিদের সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

১৯৪৭ সালের মে মাসে প্রতুল চন্দ্র দেওয়ানকে সভাপতি এবং ঘনশ্যাম দেওয়ানকে ফিল্ড কমান্ডার করে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।এ কমিটি গঠনে মূল ভূমিকা রাখেন স্নেহ কুমার চাকমা।এই কমিটি আগস্ট পর্যন্ত পার্বত্য জনগণের ভাগ্য নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা্ রাখে।

অবশেষে পূর্ব নির্ধারিত ১৪ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আগের রাত্রে স্নেহকুমার চাকমার নেতৃত্বে হাজারো উৎসুক,উৎকন্ঠিত পাহাড়ি জনগণ রাঙামাটি ডেপুটি কমিশনারের অফিসের সামনে জড়ো হয়।তখন রাঙামাটির ডেপুটি কমিশনার ছিলেন কর্ণেল জি এল হাইড(Col. G.L. Hyde)।

 

স্নেহ কুমার চাকমা ১৪ও ১৫ আগস্ট এবং পরবর্তী দিন ও ঘটনাসমূহের যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলঃ

১৪ ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭। দুই দিনের সন্ধিক্ষণে যখন ০০.০০টা বাজে, তখন আমার নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটিসহ ১০০০ লোকের সমাবেশ নিয়ে ডেপুটি কমিশনারের বাংলোতে গেলাম। ডেপুটি কমিশনার কর্ণেল জি.এল হাইড (Col. G.L. Hyde) বের হয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।

স্যার, ভারত কী এখন স্বাধীন?”

হ্যাঁ, এখন থেকে আপনারা স্বাধীন

ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অংশ তো?”

হ্যাঁ, ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারত রাষ্ট্রের সীমারেখার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত

তাহলে আমাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা উচিত নয় কী?”

হ্যাঁ। কিন্তু আমরা ব্রিটিশরা সুর্যোদয়ের সময় পতাকা উত্তোলন করি। অনুগ্রহ করে ভোরে আসেন এবং ফুটবল মাঠে জনসমাবেশের সামনে ভারতীয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন। আমিও যাবো এবং সালাম জানাবো।

তারপর থেকে আমার অফিসে বাসায় ভারতীয় পতাকা সুশোভিত করে রাখবো। সেখানে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাবো।অনুগ্রহ করে আমার পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে আপনারা আসবেন

আমাদের প্রবীণ নেতা কামিনী মোহন দেওয়ান আমাদের সকল অনুরোধ উপেক্ষা করায় সংগ্রাম কমিটি আমাকে ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে পতাকা উত্তোলন করতে বলে। শোভাযাত্রায় আমরা ডিসিকে অনুসরণ করি এবং পতাকা উত্তোলনের সরকারী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। সব জায়গায় বার্তা পাঠানো হয়েছিলো।

আমি যখন রাঙামাটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করছিলাম তখন কিছুই জানতাম না পন্ডিত নেহরু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বি.এন -এর (B.N. Raw) একটি গুরুত্বপূর্ণ (কিন্তু বিলম্বিত) বার্তা সর্দার প্যাটেলের কাছে প্রেরণ করেছিলেন।

১৭ আগস্ট ১৯৪৭ তারিখে বিকেল বেলায় রেডক্লিফ ঘোষিত সিদ্ধান্ত (the Radcliffe Award)  রেডিওতে প্রচার করা হয়।

এর অগে ১২ আগস্ট ১৯৪৭ সেখানে আভাস দেওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বঙ্গীয় সীমানা কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে থাকবে।

পরদিন সকাল বেলায় সংগ্রাম কমিটি তাড়াতাড়ি বসে ১৯ আগস্ট ১৯৪৭ ডিসি বাসভবনে একটি জরুরী সভা আহবান করার সিদ্ধান্ত নেয়। চাকমা রাজা অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

সে সভায় চাকমা রাজা কামিনী মোহন দেওয়ানসহ আরো অনেকে অংশগ্রহণ করেন। প্রত্যেকে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তবলী সমর্থন করেন।

) পার্বত্য চট্টগ্রাম রেডক্লিফ ঘোষিত সিদ্ধান্ত মানবে না;

) প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে এবং স্থানীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ স্কোয়াড গড়ে তোলা হবে;

) অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ভারতের সমর্থন লাভের জন্যে স্নেহ কুমার চাকমা অবিলম্বে যাত্রা শুরু করবেন। তিনি তৎক্ষণাত গ্রেফতার এড়ানোর জন্যে সতর্ক থাকবেন।

সংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে বার্তা প্রেরণের পর ১৯ আগস্ট ১৯৪৭, বিকেল .০০ টায় রাঙামাটি ত্যাগ করি। পায়ে হেঁটে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত অতিক্রান্ত করার লক্ষ্যে রামগড়-সাব্রুম (পার্বত্য চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা)- চলে যাই।

আমার সঙ্গে ছিলেন ইন্দ্রমণি চাকমা (সহকর্মী) এবং গিরিশ দেওয়ানের সেনানায়কত্বের অধীনে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি সশস্ত্র দেহরক্ষী দল। ২০ আগস্ট ১৯৪৭ সাব্রুমে প্রবেশ করি এবং ২১ আগস্ট ১৯৪৭ আগরতলায় যাই।"



এদিকে পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমন্টে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।এবং ভারতের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে।রাঙামাটিতে জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনে ভারতীয় পতাকা তিন দিন পর্যন্ত উত্তোলিত ছিল।

এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে,দক্ষিণ পার্বত্য চট্টগ্রামে(বান্দরবানে) বোমাং রাজার নেতৃত্বে মায়ানমারের পতাকা উত্তোলন করা হয়।পরবর্তীতে এই পতাকাও বেলুচ রেজিমেন্ট নামিয়ে দেয়।এই বিষয়ে তথ্যর ঘাটতি রয়েছে এবং এটি আরও পর্যালোচনা ও তথ্য সংগ্রহের দাবি রাখে।

এর মধ্যে স্নেহ কুমার চাকমা কলকাতায় পৌঁছান এবং সর্দার প্যাটেল ও জওহরলাল নেহেরুর সাথে দেখা করেন।স্নেহ কুমার চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে  সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য তাঁদের সাহায্যে ও সমর্থনের অনুরোধ করেন।কিন্তু স্বাধীনতার পরে ভারতের নেতৃত্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে সেভাবে আর আগ্রহ দেখায়নি।স্নেহ কুমার চাকমাও আর পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসেননি।পরবর্তীতে ১৯৫১ সাল তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন।


স্নেহ কুমার চাকমা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন ।ছাত্রাবস্থা থেকে নেতাজীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল।তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যেই নিহিত আছে এদেশের মানুষ প্রকৃত মুক্তির পথ

তিনি লিখেছেন “ Only Subhas Chandra Bose had a comparatively clearer conception and inclination for us, and we, too, placed greater faith on Subhas Babu’s Method of independence than on other alternatives “( Sneha Kumar Chakma, The partition and the chakmas; Page-39 )


এখানে একটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে ।স্বাধীনতার আগে কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্দের মাত্রা চরমে পোঁছেছিল।নেতাজী কংগ্রেস সভাপতি থেকে পদত্যাগ করেন।স্নেহ কুমার চাকমা সুভাষের রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাস এবং ঘনিষ্ঠতার কারণেও মহাত্না গান্ধী,নেহেরুরা পার্বত্য চট্টগ্র্রাম বিষয়ে অনাগ্রহ দেখাতে পারেন।

দেশবিভাগ ও স্বাধীনতার মতন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষনে যেকোনো  অঞ্চল ও্র জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করতে হয়।কিন্তু এই চরম মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে নেতৃত্বের মধ্যে মতাদর্শগত অনৈক্য ছিল।

স্নেহ কুমার চাকমা এক সাধারন জুমিয়া কৃষক পরিবারের সন্তান।নি:সন্দেহে তিনি সাধারন জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব করতেন।ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং আন্দোলন করতে গিয়ে জেল ও খেটেছেন।তাঁর নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব পার্বত্য চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে।ধর্মঘট,নিয়মিত মিটিং,সভা-সমাবেশ,বিলেতী  পণ্য বর্জন সহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে দেন।


কামিনী মোহন  দেওয়ান তাঁর আত্নজীবনীতে স্নেহ কুমার চাকমা সম্পর্কে লিখেছেন,

“স্নেহ কুমার চাকমা আমার অনুগ্রহপৃষ্ঠ ব্যাক্তি মাত্র।আমার সাহায্যে  ব্যাতিরেখে তাহার পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না।বিশেষত:সে উচ্চ শিক্ষিত হইলে ও এক অপরিণত বয়সের যুবক মাত্র।তাহার কিংবা তাহার বংশীয় কাহারও বর্তমান পূর্ব জীবনের অর্জিত আর্থিক,সামাজিক কিংবা অন্য কোন প্রকার সম্মান,প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুই নাই।“

তৎকালীন চাকমা রাজা,কামিনী মোহন দেওয়ান  কিংবা দেওয়ানের মত যারা সামন্তীয় ব্যবস্থার সাথে আস্তে-পৃষ্ঠে  জড়িয়ে ছিলেন তারা কেউই স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বকে স্বাভাবিকভাবে মেনে  নিতে পারে না।স্নেহ কুমার চাকমা চেয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে জনগনের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হোক।অপরদিকে কামিনী মোহন দেওয়ান তৎকালীন সামন্তীয়দের প্রতিনিধি ছিলেন।তিনি সংসদীয় রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন।


কামিনী মোহন দেওয়ান সর্ম্পকে রাজা ত্রিদিব রায় তাঁর আত্নজীবনী `The Departed Melody´ তে লিখেছেন, “He believed in constitutional monarchy,that is the three chiefs should be heads of their territories but executive authority would vest in an elected council(Parliament).His dream eas an autonomous Hill Tracts too.“

আরেকদিকে চাকমা রাজা নলীনাক্ষ রায় রাজতন্ত্র ঠিকিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন।এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সমগ্র জাতিসত্তা ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তিশালী কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানও ছিল না। ভৌগলিক বাস্তবতার কারণেও জাতিসত্তাসমূহ বিচ্ছিন্ন ছিল।তাঁরা সংগঠিত হয়ে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারেনি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে,ব্রিটিশরা সুকৌশলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মূল ভারতের শিক্ষা,রাজনীতি,অর্থনীতি,সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখে।এই দূরভসন্ধি পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাসমূহকে অনেক বছর পিছিয়ে রেখেছে।


শেষ কথা,যদি স্বশাসিত পার্বত্য  রাজ্যে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত না হয়ে ভারতে যুক্ত হত তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তা জনগণের ইতিহাসটা অন্যরকম হত।হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগনের স্বায়ত্বশাসন,রাজনৈতিক অধিকার বজায় থাকত।পাহাড়ি জনগণের উপর ডজনের অধিক গণহত্যা সংগঠিত হত না,জনমিতির বিশাল পরিবর্তন দেখা যেত না,সেটলার বাঙালি দ্বারা পাহাড়িদের ভূমি বেদখল হত না,পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন থাকত না।অথবা,পার্শবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে,কাশ্মীর,সিকিম কিংবা সেভেন সিস্টারের রাজ্যেগুলোর ন্যায় অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হত।

যাই হোক যা হয়নি তা হয়তো হবে না,তবে ইতিহাসে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যে ঘটে।

 

তথ্যসূত্র:

1.OPINDIA.COM

2.THIS BLOODY LINE-a short film directed by Ram Madhvani

3.WIKIWAND.COM-RADCLIFFE LINE

4.THE DEPARTED MELODY-AN AUTOBIOGRAPHY BY RAJA TRIDIV ROY

5.THE POLITICS OF NATIONALISM(The case of the Chittagong Hill Tracts Bangladesh) written by AMENA MOHSIN

6.Angelfire.com-এ প্রকাশিত দেশবিভাগ এবং এর পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম সর্ম্পকিত ঘটনাসমূহের ডকুমেন্ট;

7.chakmasudarshi.wordpress.com- এ সুদর্শী চাকমার লেখা “এক অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা স্নেহ কুমার চাকমা“

8.mithunchakma.blogspot.com- এ মিঠুন চাকমার লেখা “ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষা:পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসংগ-১৯৪৭ সাল“

9.jumjournal.com -এ প্রকাশিত স্নেহকুমার চাকমার লেখা ”পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানকে মেনে নেয়নি“ অডং চাকমার বাংলা অনুবাদ।

*

সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০

চাঙমা সাহিত্য আগাজত এক্কো লাজর দিন জনম নিল' ৭ আগষ্ট - অপুর চাঙমা

 

Wednesday, August 12, 2020


ভদ্র সেন চাকমা
লাজর কধা,ভাবিবার কধা। কধেও লাজ গরে পারা। ত্যুঅ কোই পরের।  গেল্লে ০৭ আগস্ট ২০২০ ইং পরম স্বর্গীয় সুনানু বিভূতি চাঙমার(শিক্ষক) সাপ্তাক্রীয়া কেজ্জো পোইদ্যানে দাঙর এক্কো ধর্ম সভা অই গেল’। এ ধর্ম সভাত সুনানু ভদ্র সেন চাঙমায়্য অন্যজনর সান গরি সরিত অয়্যা। দিবুজ্যে মাধান কাচালং সরকারি কলেজর প্রভাষক সুনানু লালন কান্তি চাঙমারে কাচালং বালিকা হাই ইক্কুলর প্রধান শিক্ষক স্বপ্রচারিত কবি সাহিত্যিক পুন্ডিক ভদ্র সেন চাঙমা (সহ সভাপতি,আদিবাসী লেখক ফোরাম ও উপদেষ্টা চাকমা কালচার কাউন্সিল বাংলাদেশ) এ ধর্ম সভাত কাচালং সরকারী কলেজর প্রিন্সিপাল আ সসাগজ্যে মানি গরবা গরবি মুজুঙে কাচালং কলেজর প্রভাষক সুনানু লালন কান্তি চাকমার উগুরে আহ্’ত তুল্যে। যা ভাবদে বঃনিঝেচ এযে,অগলা এযে। যে নিজরে মহাপুন্ডিক মনে গোরিনেই ফেইচ বুগত সমানে পোষ্ট দেদে দেগা যায়। পিত্তিমীত কন’ দেঝত,কন’ জাদর সাহিত্য জগদত এধক্যে ঘদনা দেঘা ন’ যায়,শুনা ন' যায়। মাত্তর! ইনিক্কেন লাংদা কাম চাঙমা জাদত দেঘা গেল’ গেল্লে ০৭ আগষ্টত। ইক্কো হাই ইস্কুলর হেড মাস্টরর ইনিক্কেন বজং কাম কন' সভ্য সমাজত অবার ওই ন' পারে।
 

২০১৪ সালত রাঙামত্যা জেলা বাঘাই ছড়ি উপজেলাত ৬২ জন সাবাঙ্গী নিনেই “আরাং” নাঙে এক্কো সাহিত্য জধা থিদ অহ্’য়। সুনানু লালন কান্তি চাঙমারে সভাপতি আ সুনানু ভদ্রসেন চাঙমারে সাধারণ সম্পাদক ইজেবে আরাঙর জধাত নকবাচ গরা অয়্যা। লাম্বা চের বঝর সং আড়াঙর কাম বন্ধ থানার পর গেল্লে ০২ আগস্ট ২০২০ ইং সুনানু ভদ্রসেন চাঙমা ফেইসবুক টাইম লাইনত দেঘা যিয়ে- “আরাঙর জনম পোইদ্যানে এগত্তরি। নুঅ জনম, নুঅ সবন, নুঅ মানুচ, মন ভরন” ক্যাপশন দিনেই ১২/১৩ জনর দ্বি’বে আরুক/ছবি। কধা কোনেই খবর পা যেল’- আরাঙর যে ৬২ জন সাবাঙ্গী/সদস্য আঘন তারালোই কন’ কধা নেই, তেম্মাঙ নেই গরি যে নুঅ আড়াং জনম দেনা তারা কন’ সাবাঙ্গী/সদস্য মানি নেযে ন’ পারানার পোইদ্যানে সুনানু লালন কান্তি চাঙমা সংগঠনত সভাপতি ইজেবে সুয়োল গরিলে সুনানু ভদ্র সেন চাঙমা তার উগুরে আহ্’ত তুল্যে সে ধর্ম খলাবোত।
 

সুনানু ভদ্র সেন চাঙমা চাঙমা সাহিত্য বাহ্ সল্লাদার (উপদেষ্টা) থানা সময়ত “চাঙমা সাহিত্য বাহ্’রে আরাং নাঙ দিবার এক্কান প্রস্তাব আনে। চাঙমা সাহিত্য বাহ্ কন’ সাবাঙ্গী মানি ন’ নেযানার সে প্রস্তাবয়ান গজি লোনা ন’ অহ্’য়। আ কিঝু দিন আগেও চাঙমা সাহিত্য বাহত তে ভেজাল বাজেই দিবার চেইয়্যে। তা সমারে তাল মিলেনেই সংগঠনর কয়েক জন কাবিল কাম্মো নিগিলি গেলাক। যিয়েন ভারী দুক লাগিবার কাম ভিলি চাঙমা সাহিত্য বাহ মনে গরে।
 

খবর পা যিয়ে, সুনানু ভদ্র সেন চাঙমা চাকমা কালচার কাউন্সিল অফ বাংলাদেশ (সিসিসিবি-র) এ সল্লাদার পদত্তুন সরে এবার এক্কান কাগোজ পাদেয়্যা সংগঠনর কমিতির গ্রুপত। তার পরে পরে সিসিসিবিত নানান ভেজাল থুম ন' অহ্’র।
 

 

এর আগেও আদিবাসী লেখক ফোরামতও সুজালো জোস রে লোইনেই এক্কান দাঙর বেজাল ওইয়্যে। তে আদিবাসী লেখক ফোরামর সহসভাপতি অনা সত্বেও সুজালোর ইন্দি বেরত বাজে পারা বাজিনেই সিয়োতও তাল মাতাল কারবার গচ্ছে। কদ' জনে তার ইনিক্কেন চাল বাজির কারনে আদিবাসী লেখক ফোরামত্তুন নিগিলি যিয়োনদোই।
 ইআনিত্তুন বুঝা যায় সুনানু ভদ্র সেন চাঙমা যিয়ত সিয়োত শিয়েলর পাক চক্কর নিগিলানার কাবিদ্যাঙ। তার এ গভীর ষড়যন্ত্র নিঘিলেনেই আরাঙর যে ৬২ জন সাবাঙ্গীরে কিঝু ন’ কোই নুঅ “আরাং” থিদ’ গরিবার অ-কাম (ব্যর্থ প্রচেষ্টা) গরিল’। তা ফল চাঙমা জাত্তো পেল লাজর/কলঙ্গ এক্কো দিন, ০৭ আগস্ট। ইক্কো আনকরা মানজ্যেও ইনিক্কেন লাজর কাম ন' গরন। তার ইনিক্কেন বজং কামানি কি আদিবাসী লেখক ফোরাম আ সিসিসিবি কেনে মানি লোই পারের? ইয়েন পুজার থেল'। এ লাজসান কেনে ঢাগিব' চাঙমা সায়িত্য পুজার থেল' আদিবাসী লেখক ফোরামর ইধু। আমি ইত্তুন নিগিলি এবার চেই, চেই দোল সাহিত্য সংস্কৃতি মানুচ।

‘দেশভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা ছিল মহাভুল’- কালো দিবসে আলোচকবৃন্দ- By Hill Voice - আগস্ট 17, 2020

 হিল ভয়েস, ১৭ আগস্ট ২০২০, আগরতলা: ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা ছিল মহাভুল,আজ আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই বলে ১৭ আগস্ট কালো দিবস প্রতিপালনে ভারতের চাকমা জনগোষ্ঠী কর্তৃক আয়োজিত ভাচু‍র্য়াল আলোচনা সভায় আলোচকবৃন্দ অভিমত ব্যক্ত করেন।

আজ সিএনসিআই-এর ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির সাধারণ সম্পাদক উদয় জ্যোতি চাকমা কর্তৃক প্রেরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী চাকমা জাতির লোকজনের উদ্যোগে ১৭ই আগস্টকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী চলমান প্রাণঘাতি কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এ বছর আনুষ্ঠানিকভাবে মিছিল ও সমাবেশ করা সম্ভব না হওয়ায় তার পরিবর্তে একটি ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আজ ১৭ অগাস্ট ২০২০, সোমবার ভারতীয় সময় সকাল ৯:০০ টায় ভারতীয় চাকমা জনগোষ্ঠী কর্তৃক আয়োজিত ‘দেশভাগ এবং আদিবাসী চাকমা সম্প্রদায়ের উপর এর প্রভাব’ শীর্ষক এই অনলাইন মতবিনিময় সভায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। উক্ত ভার্চুয়াল আলোচনা ত্রিপুরা রাজ্য ভিত্তিক এনজিও ‘ধুদুক আগরতলা’ ফেসবুক পেইজ থেকে সরাসরি প্রচার করা হয়।

ত্রিপুরা রেজ্যো চাকমা সামাজিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শান্তি বিকাশ চাকমার সঞ্চালনায় আলোচনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বিশিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং হিল ভয়েসের সম্পাদক নিরঞ্জন চাকমা ও প্রধীর তালুকদার, মিজোরাম রাজ্য থেকে চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’র মিজোরাম রাজ্য কমিটির সভাপতি ও চাকমা স্বশাসিত জেলা পরিষদের চীফ এক্সকিউটিভ মেম্বার রসিক মোহন চাকমা ও কমলানগর কলেজের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় চাকমা, অরুণাচল থেকে (বর্তমানে বেঙ্গালোর) মহেন্দ্র চাকমা, আসাম থেকে আলেজান্দার চাকমা এবং কানাডা থেকে ড. আদিত্য কুমার দেওয়ান ও প্রীতিবিন্দু চাকমা, অস্ট্রেলিয়া থেকে কবিতা চাকমা ও কূলোত্তম চাকমা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

আলোচনায় আলোচকবৃন্দ, ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় যা করা হয়েছে তা এক ‘মহাভুল’ বলে অভিহিত করেন। দেশভাগের যে নীতি সেই দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে তথা ভারত স্বাধীনতা আইন লঙ্ঘন করে ৯৮% অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করায় পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাসহ জুম্মরা আজ এক ‘পড়াকবাল্যা’ (পোড়াকপাল), প্রান্তিক ও পরিবেশ উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছেন।

আলোচকবৃন্দ বলেন, দেশ বিভাগের সময় পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা না হলে বিশেষ করে চাকমারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ও বার্মায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে বাধ্য হতো না। এর ফলে তারা রাজনৈতিকভাবে যেমনি, তেমনি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবেও খুব খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আলোচকবৃন্দ বলেন, দেশ বিভাগের সঠিক নীতির ভিত্তিতে আমরা যদি ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতাম, তাহলে অন্যান্যদের মত আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষরাও একটা রাজ্য পেতাম।

আলোচকবৃন্দ আরও বলেন, দেশভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি অন্যায়ের কারণেই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাসহ জুম্মরা আজ খুব দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের এখন নিরাপত্তাও নেই। আর সেখানে এখন ভূমি বেদখলসহ অবাধে চলছে ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণ; যা উদ্বেজনক ও ভয়াবহ।

আলোচকবৃন্দ বলেন, রাজনৈতিক অধিকার ছাড়া অন্যান্য অধিকারগুলো নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা দরকার।

আলোচকবৃন্দ বলেন, আমাদের অবশ্যই কন্ঠস্বর অব্যাহত রাখতে হবে এবং সৃজনশীলভাবে এগিয়ে যেতে হবে। অবশ্যই আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এই স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। টিকে থাকতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া এবং ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ছাড়াউপায় নেই।

উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ৯৮.৫০ শতাংশ অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে অন্যায়ভাবে ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে প্রতি বছর উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম, অরুনাচল প্রদেশ, মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বসবাসকারী চাকমা জনগোষ্ঠী লোকদের দ্বারা ১৭ই আগস্টকে কালো দিবস হিসাবে পালন করা হয়। এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয় ২০১৬ সালের ২৪-২৫ মার্চ আসামের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (সিএনসিআই)-এর প্রথম বাৎসরিক জাতীয় অধিবেশনে।

https://hillvoice.net/bn/দেশভাগের-সময়-পার্বত্য/

পাহাড়ে তাঁবেদার গ্রুপদের সময় বেশি দিন নেই: মিন্ট অং

সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পরিবর্তিত হয়। পাহাড়ের রাজনীতিতেও বহু পরিবর্তন এসেছে। মানুষ বুঝে নিয়েছে কোন রাজনৈতিক দলটি অতীব জরুরী। সময় এবং সুযোগ বুঝে বহু গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। যাদের আমরা তাঁবেদার গ্রুপ বলে চিনে থাকি। ‘তাঁবেদার’ শব্দটির সাথে অনেকেই পরিচিত নয়। আজ্ঞাধীন বা গোলাম হয়ে যে গ্রুপ পরিচালিত হয় তাই ‘তাঁবেদার গ্রুপ’। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস বহু পুরনো। ভৌগলিক সীমানা নিয়েও আলোচনায় ছিল ভূ-খন্ডটি। অমুসলিম অধ্যুষিত এই অঞ্চলে শুরুর দিকে অমুসলিমদের শাসন বিরাজমান ছিল। পরবর্তিতে এই ভূখন্ডটিতে ভূ-রাক্ষুসেদের দৃষ্টি পড়ে। শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। প্রথমে পাকিস্তান জমানায় ‘শাসন বহির্ভূত’ অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাথে মুক্তি বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। বাঙালীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পাহাড় এবং পাহাড়ের বাইরে আদিবাসীরাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সদ্য গঠিত বঙ্গবন্ধু সরকার পাহাড়ে প্রথম ধাক্কা দেন। বাঙালী তকমা দিতে থাকেন পাহাড়ীদের। হৃদয়ে আঘাত লাগে পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসীদের। প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সেসময় বঙ্গবন্ধুর মন জয় করতে ‘বাকশাল’ এ যোগ দেন। কাজ না হওয়ায় শেষমেষ পাহাড়ে বসবাসরত জুম্ম আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আত্মগোপনে চলে যান। জুম্মদের অধিকার খর্ব করে দেখার পরিণতি ‘শান্তি বাহিনী’ গঠন এবং তার কার্যক্রম।

আন্দোলনের মধ্যে আশির দশকে ষড়যন্ত্রের সূচনা করেন প্রীতিকুমার। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে এই নাম। নেতা হওয়ার প্রবল ইচ্ছা থেকে ক্ষমতায় যাবার উন্মাদ হয়ে উঠেন এই ব্যক্তি। পাহাড়ে তাঁবেদার গ্রুপের সূচনা প্রীতিকুমার ওরফে প্রকাশের হাত ধরে। সারথি ছিলেন ভবতোষ দেওয়ান ওরফে গিরি, ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান ওরফে পলাশ এবং দেবজ্যোতি ওরফে দেবেন। এদের মধ্যে দেবজ্যোতি বহু আগে আততায়ী হাতে খুন হন। তাঁবেদার গ্রুপ (‘বাদী’ নামে সর্বাধিক পরিচিত) পরীক্ষিত এক নেতাকে হত্যা করতে পারলেও আদর্শ এবং আন্দোলনকে হত্যা করতে পারেন নি। পরীক্ষিত সেই নেতস ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। সময়ের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে তাদের অস্তিত্ব ধূলোয় মিশে যায়। জুম্ম বিধ্বংসী অংশের কারোর দ্বারা প্ররোচিত হয়েই এ কাজ করেছিলেন তারা প্রীতি গ্রুপ।

এরপর ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর। আরও একটি কালো অধ্যায়। পাহাড়ের সকল জুম্ম এ ঘটনার জন্য ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। শুরু হয় ভয়াবহতা। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর জনসংহতি সমিতির অনেক সদস্য ভারত প্রত্যাগত। ‘৯৭ এর ২ ডিসেম্বর মাত্র অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ভারত প্রত্যাগতরা। এরই মধ্যে ভারত প্রত্যাগত জনসংহতি সদস্যদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠে সদ্য ১৯৯৮ সালে সৃষ্টি হওয়া ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) সদস্যরা। সদ্য ইউপিডিএফ এর রাজনীতি থেকে সরে আসা কর্মীদের প্রচারিত ‘কোন চোরাবালিতে ডুবছে ইউপিডিএফ’ পুস্তিকায় স্পষ্ট লেখা রয়েছে কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছিলেন ইউপিডিএফ নেতা প্রসীত বিকাশ খীসা। সর্বপ্রথম পানছড়ি এরপর দীঘিলানাসহ আর অনেক জায়গায় ভারত প্রত্যাগতদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায় ইউপিডিএফ কর্মীরা। পর্যায়ক্রমে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে আধিপত্য বিস্তার চালায় তাঁবেদার গ্রুপটি। পার্বত্য চুক্তিকে বিরোধীতা করে এ গ্রুপটি সৃষ্টি করেছিলেন সেনাবাহিনী। শতাধিক জেএসএস কর্মীকে হত্যা করে গ্রুপটি। এখন তাদের অবস্থান প্রায় প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত।

২০০৭ সালের দিকে জন্ম নেয় আরও একটি তাঁবেদার গ্রুপ। প্রথম দিকে জেএসএস(সংস্কার) নাম দিলেও পরে তা জেএসএস(এমএন লারমা) নামে প্রচার করে এই গ্রুপটি (সূত্রঃ সত্যদর্শী মূলিম্যা, আইপিনিউজ)। কিন্তু ততক্ষনে গ্রুপটি সংস্কার নামে পরিচিতি পায়। দেশে তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকার কথা ছিল ৯০ দিন। কিন্তু ২ (দুই) বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে তত্বাবধায়ক সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ চাইলে আরও ক্ষমতায় আসীন হতে পারতেন। আওয়ামী লীগে সংস্কার আনয়নে মাইনাস ফর্মুলা গ্রহণ করা হয়। ড. আবদুল জলীল যিনি তৎকালীন (২০০৭) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে দলে সংস্কার আনতে ষড়যন্ত্র পেতে বসেন। অপরদিকে বিএনপিতেও মাইনাস ফর্মুলা চলতে থাকে। খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে সংস্কার আনয়নে উঠেপড়ে লাগেন তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। পাহাড়েও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পাহাড়ের নেতৃত্ব বললে যার নাম জানা হয় তিনি হলেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এর চেয়ারম্যান। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতিও। এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি। তাঁকে বাদ দিয়ে পাহাড়ের নয়া উপদলীয় নেতৃত্ব তৈরি করতে চেয়েছিল সুধাসিন্ধু খীসার গ্রুপ।

তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জনসংহতি সমিতিতে মাইনাস ফর্মুলা ষড়যন্ত্রের জাল বুনে নয়া সংস্কারবাদীরা। গুটি কয়েক নেতা জনসংহতি সমিতি থেকে প্রস্থান করে সংগঠনের বিরোধীতা করে ক্ষুদে দলবাদ সৃষ্টি করে সংস্কারপন্থিদের এই গ্রুপটি। দাবার গুটি হয়ে চালিত হতে থাকেন প্রয়াত সুধাসিন্ধু খীসা। তিনি ঢাকায় ছুটে যান নিজের অবস্থান তৈরি করতে। জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিকদের সাথে দেখা করেন সুধাসিন্ধু খীসা। কোনরকম সাড়া না পেয়ে ফিরে আসেন পাহাড়ে। সদ্য সংস্কার হওয়া গ্রুপটি আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সন্তু লারমাকে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক পরিষদ দখল করতে মরিয়া সংস্কারপন্থি এ গ্রুপটি। পিসিজেএসএসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত চন্দ্রশেখর চাকমা রীতিমত ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে উঠাবসা করতে লাগলেন। কিন্তু বয়সের শেষ ভারে স্ট্রোক করে মারা যান এই সংস্কারপন্থি নেতা। সংস্কার গ্রুপের সহসাধারণ সম্পাদক সুদর্শন চাকমা। শুরু দিকে স্থানীয়ভাবে টাকার জোরে বহু মানুষকে ভুলিয়ে ভোট ব্যাংক হিসেবে তৈরি করেন। সর্বশেষ, বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান ভোট ডাকাতি করে। শোনা যায় স্ত্রীর সাথে বোঝাপড়া হচ্ছে না তার কোনভাবে। এভাবে নিষ্ক্রীয় হতে পারেন সুদর্শন চাকমা।

গত জুলাই (২০২০) মাসের আগে সংস্কার নামে এই তাঁবেদার গ্রুপটির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা মধ্য রাতে সেনাবাহিনীর এসকর্ট দিয়ে করোনাকালীন মধ্যে বান্দরবানে প্রবেশ করে। গ্রুপটির সহসভাপতি বিমল কান্তি চাকমা ওরফে প্রজিত এতে নেতৃত্ব দেন। তাকে মূলত বান্দরবানে সাংগঠনিক কাজে দায়িত্ব দেয়া হয়। চট্টগ্রামে একটি হোটেলে করোনার মহামারীর মধ্যে বান্দরবান সংস্কার গ্রুপ গঠন করে দেন এই বিমল কান্তি। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি থেকে শতাধিক মানুষকে সুযোগ সুবিধা দিয়ে চট্টগ্রাম হোটেলে নিয়ে গিয়ে মিটিং করে গ্রুপটি। কমিটিও গঠন করে দেয়া হয়। কয়েক মাসের মধ্যে আততায়ীর হাতে খুন হন বিমল কান্তিসহ কয়েকজন। এতে করে দূর্বল হয়ে পড়ে সংস্কারপন্থি তাঁবেদার গ্রুপটি। সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এই গ্রুপটি পাহাড়ে অবস্থান করতে পারেনি। অর্থ ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে আভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে গ্রুপটি। অবশেষে বিনাশ হতে যাচ্ছে গ্রুপটি।

এএলপি নামক আরও একটি তাঁবেদার গ্রুপ জন্ম নেয় এই পাহাড়ে। বান্দরবানের স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চাহিদা মেটাতে গ্রুপটি সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনসহ সকল স্তরের নির্বাচনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয় এএলপি। স্থানীয় জনমানুষের সহানুভূতি পেতে মগ লিবারেশন পার্টি নাম দিয়েছে গ্রুপটি। মারমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নাম করে চাঁদাবাজী, অপহরণ এবং হত্যার মত লোমহর্ষক ঘটনার জন্য দায়ী এএলপি নামক তাঁবেদার গ্রুপটি। গরীব-দুঃখী বালকদের আবেগকে ব্যবহার করে শত প্রাণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ মদদপুষ্ট এই এএলপি। জেএসএসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এ গ্রুপটি। প্রকাশ্যে সেনা সদস্যকে হত্যা করার পরও কোন পদক্ষেপ নেয়নি সেনা প্রশাসন।
সংস্কারপন্থিদের মতন এদের অবস্থানও এখন খুব শোচনীয় স্তরে।

সংস্কারপন্থিদের সহযোগী পরম বন্ধু গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ। প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি তপনজ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মার মৃত্যুর পর এ দলটিও করুণ পরিণতিতে ভুগছে। সেনা মদদপুষ্ট এই তাঁবেদার গ্রুপটিকে চাঙ্গা করতে গুরুত্ব দিচ্ছে গুপ্তচরেরা। এ গ্রুপটি ইতোমধ্যে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি ও রাঙামাটির জীবতলীসহ খাগড়াছড়িতে ঘরোয়া আলোচনা সেড়ে নিয়েছে বলে জানা যায়। বলা বাহুল্য, এদের মধ্যে গুটি কয়েক নেতা রয়েছেন যারা সংস্কারদের মধ্য থেকে এসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এতে করে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ এর নেতাকর্মীরা বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন। দেখা যাচ্ছে এদের অবস্থানও অচীরেই অস্পষ্ট এবং অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

পরিশেষে, তাঁবেদার গ্রুপের অবস্থান শুরুতে চাঙ্গা থাকলেও পরবর্তিতে ধোঁয়াশা হতে থাকে। বিরক্ত হতে তাকে সাধারণ মানুষ। সুতরাং, তাঁবেদারি অচীরেই শেষ হতে চলেছে পাহাড়ে।

মিন্ট অং, রাজনৈতিক কর্মী।

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...