সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০

প্রসঙ্গ: আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুমির অধিকার : শক্তিপদ ত্রিপুরা

প্রসঙ্গ: আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুমির অধিকার :  শক্তিপদ ত্রিপুরা

 


১২ আগস্ট ২০২০

বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশে পাহাড় ও সমতল অঞ্চল মিলে ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বাস করে। স্মরণাতীত কাল থেকে তারা এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে।

এ অঞ্চলের ভুমিকে বাসযোগ্য ও চাষযোগ্য করার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের রয়েছে বিশেষ অবদান। বৃটিশ উপনিবেশবাদী শাসকগোষ্ঠী ও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে এদেশ থেকে বিতাড়ণে আদিবাসীদের রয়েছে ঐতিহাসিক অবদান।

  কিন্তু যে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী এ অঞ্চলের ভুমিকে বাস ও চাষযোগ্য করে তুললেছিলো, বৃটিশ ও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে বিতাড়ণ করে এদেশ স্বাধীন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলো, সেই আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃতি পেলো না- এর চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আদিবাসীদের আর কি হতে পারে।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনা করে। এই সংবিধানে বাঙালী ব্যতিত এদেশের অপর কোন জাতিগোষ্ঠীকে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা হয়নি।  আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির সংগ্রাম আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে শোষন বঞ্চণার শিকার হয়ে আসছে। বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষের অপরাপর অঞ্চল ও জাতিগোষ্ঠীকে যেভাবে ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে শাসন শোষণ নিশ্চিত করেছিলো, ঠিক তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল এলাকার আদিবাসীদের উপরও অনুরূপ শাসন শোষণ কায়েম করেছিলো। পাকিস্তান আমলে আদিবাসীদের উপর শোষণ নিপীড়ণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।


বৃটিশ আমলে আদিবাসীরা যেসব অধিকার ভোগ করতো সেসব অধিকার পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী খর্ব করে দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের কিছু কিছু এলাকায় যে ‘শাসন বহির্ভূত স্ট্যাটাস’ ছিল তা বাতিল করে দেয়। বৃটিশ প্রণীত ১৯০০ সালের পার্বত্য শাসনবিধির গুরুত্বপূর্ণ ধারাসমূহ বাতিল করা হয়। ১৯৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে লক্ষাধিক আদিবাসীকে উদ্বাস্তু করা হয়। এ বাঁধের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ উর্বর ফসলীয় জমি পানির নীচে তলিয়ে যায়। এতে আদিবাসীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অপূরনীয় ক্ষতির শিকার হয়।

পাকিস্তান সরকার ভারত থেকে চলে আসা অ-আদিবাসীদের আইন লংঘন করে শত শত পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ীদের জায়গায় পুনর্বাসন করে। সমতলেও পাকিস্তান আমলে আদিবাসীরা বহু জমি জমা হারায়। আদিবাসীদের জমি ভুমিদস্যু বাঙালীরা জোরপূর্বক কেড়ে নেয়।


পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আদিবাসী-বাঙালী নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর শোষন, বঞ্চণা ও নিপীড়ণ চালায়। এই শোষন নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণ সংগ্রাম গড়ে তুলে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেয় তখন সে ডাকে সাড়া দিয়ে আদিবাসীরাও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে বহু আদিবাসী শহীদ হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে পাহাড়ীরা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পাহাড়ীরা আশা করেছিল দেশ স্বাধীন হলে এ নতুন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। প্রতিষ্ঠা পাবে শোষণহীন এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ, যে সমাজে নিপীড়ন-নির্যাতন ও শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না, থাকবে না দ্বেষ-হিংসা-হানাহানি।

এ ধরনের সমাজে আদিবাসীরাও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, সং¯ৃ‹তি ও অধিকার নিয়ে মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবে- এ ছিল তাদের স্বপ্ন। কিন্তু ১৯৭২ সালে যখন নতুন দেশের সংবিধান রচনা করা হল তখন আদিবাসীদের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। যে নতুন সংবিধানের জন্য আদিবাসীরাও রক্ত দিল, জীবন দিল সেই নতুন সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি মিললো না- সত্যিই তা আদিবাসীদের জন্য হদয় বিদারক ঘটনা বৈ কি!
১৯৭২ সালে সংবিধান সংক্রান্ত বিষয়ে যখন আলোচনা চলে তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য আদিবাসী তথা মেহনতি মানুষের বন্ধু প্রয়াত এম এন লারমা জাতীয় সংসদে সংবিধানের উপর দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রেখেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন- বাংলাদেশে বাঙালী ছাড়াও আরো অনেক জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। তারাও এদেশের নাগরিক। এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদেরও অবদান ছিল। সুতরাং তাদের অধিকারও সংবিধানে স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। মহান নেতা এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবী জানিয়েছিলেন এবং দেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সংবিধানে সুদৃঢ়ভাবে স্থাপনের দাবী জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এম এন লারমার দাবী ও বক্তব্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো আজ ৪৭ বছর হতে চলেছে, এই ৪৭ বছরেও এদেশের আদিবাসীদের, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের, সাধারণ কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুন্ঠিত। যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল- একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা তা এখনো সুদুর পরাহত।

এম, এন লারমা আমৃত্যু আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এখনো সে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে এ সংগঠনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এম এন লারমার ছোট ভাই শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। এ সংগ্রামের অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারের সনদ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ সম্পাদিত হয়। বর্তমানে চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। শ্রী লারমার নেতৃত্বে ২০০১ সালে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’ গঠিত হয়। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবী জানিয়ে আসছে।

সংবিধান ও রাষ্ট্রে আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃতি ও আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ও ভুমির অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সংবিধান বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের রায় আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাবার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছে। হাইকোর্টের রায়কে বিবেচনা রেখে মহাজোট সরকার সংবিধান সংশোধনের কথা ভাবছে।

এলক্ষ্যে সরকার সাজেদা চৌধুরীকে প্রধান করে এক বিশেষ কমিটিও গঠন করেছে। এদিকে মহাজোট সরকারের হাতে রয়েছে সংবিধান সংশোধন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সংসদ সদস্য। সুতরাং সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি এখন সরকারের আন্তরিকতার বিষয় মাত্র। সরকার চাইলে সংবিধান সংশোধন করে যে কোন সময় আদিবাসীদের জাতীয় পরিচয়, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে পারে। আদিবাসী-উপজাতি-ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী প্রসঙ্গ ‘উপজাতি’ শব্দের অর্থ ‘একটি জাতির শাখা’, ‘আদিম’, ‘অসভ্য’ ইত্যাদি বুঝায়। বাংলাদেশের আদিবাসীরা কোন জাতির শাখা নয়; তারা এক একটি ‘জাতি’। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে।

কোন কোন আদিবাসী জাতির হাজার বছরের স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস রয়েছে। তাছাড়া আধুনিক নৃবিজ্ঞানীরা ‘উপজাতি বা ট্রাইবাল’ শব্দ বর্তমানে আর ব্যবহার করে না। তাঁরা মনে করেন এ শব্দগুলি বহু পুরনো ও সংকীর্ণ প্রপঞ্চ। কোন জাতির পরিচয় দিতে গিয়ে এই শব্দগুলির ব্যবহার একটি জাতিকে অপমান করার সামিল বলে তাঁরা মনে করেন।

বর্তমান সরকার নুতন একটি শব্দ আমদানি করেছে- ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’। এই সরকার বাংলাদেশের আদিবাসীদেরকে বর্তমানে সর্বশেষ আইন দ্বারা এই নামে অভিহিত করছে। ২০১০ সালে একটি আইন (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন) প্রণয়নের মধ্য দিয়ে এই শব্দ স্থাপন করা হয়। এই আইনের বলে পূর্বতন ‘উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ বর্তমানে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ নামে রূপান্তরিত।
আদিবাসী কারা? এ নিয়ে অনেকের মাঝে বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়। খোদ রাষ্ট্রের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও নাকি প্রশ্ন তোলেন- ‘আপনারা উপজাতিরা এদেশের আদিবাসী হলে আমরা কারা? আমরাও তো এদেশের আদিবাসী’।

কিন্তু ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী’ নির্ধারণে কে আদি বাসিন্দা বা কে আদি বাসিন্দা নয় তা মূখ্য বিষয় নয়। আদিবাসী হলো তারাই- ১. বর্তমানের রাষ্ট্র শাসন প্রক্রিয়ায় যাদের একেবারেই প্রান্তিক ভূমিকা, ২. আধুনিক রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার সাথে যাদের অসম্পৃক্ততা বা প্রান্তিক সম্পৃক্ততা, ৩. যারা রাষ্ট্রীয় আইনের চাইতে প্রথাগত আইনের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তি করে থাকে, ৪. প্রথাগত আইন কার্যকর করার জন্য যাদের ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, ৫. যাদের একটি বিশেষ ভুমির সাথে আত্মিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে, ৬. যাদের ধর্মীয় বহুমাত্রিকতা রয়েছে- এসব বৈশিষ্ট্য যাদের রয়েছে তাদেরকেই ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাত্ত্বিক দিক থেকে এসব বৈশিষ্ট্যের আলোকে এদেশের আদিবাসীদের নির্ধিদ্বায় ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করা যায়- সরকার বা অন্য কারোর এক্ষেত্রে দ্বিধা থাকা সমীচিন নয়।

বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি না থাকলেও এদেশের আদিবাসীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন, প্রজ্ঞাপন, নির্দেশনা, পলিসি, স্মারক ও নথি ইত্যাদিতে এদেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া আছে। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯৯৫ সালের অর্থ আইন, আদালতের রায়, রাজস্ব বোর্ডের একাধিক স্মারক ও নথিতে ‘ইন্ডিজিনাস হিলম্যান’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সরকার প্রধান থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমেদ তাঁদের বাণীতে এদেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

মহাজোট সরকারের প্রধান শরীক দল আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করেছে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন সময়ের ‘দারিদ্র বিমোচন কৌশল পত্র’, জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০০৯- এ ‘আদিবাসী’ ও ‘ইন্ডিজিনাস পিপল’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৫০ সালের ‘পূর্ববঙ্গ জমিদারী দখল ও প্রজাসত্ত্ব আইনে’ এদেশের আদিবাসীদেরকে ‘এবরোজিনাল কাস্ট এন্ড ট্রাইবস’ বলা হয়েছে। এই আইনটি সংবিধানে সন্নিবেশিত আছে। ২০০৯ সালের জাতীয় বাজেটে এদেশের আদিবাসীদের ‘ইন্ডিজিনাস পিপল’ সন্বোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১০ সালের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে’ও ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং কারা আদিবাসী তারও একটি তালিকা প্রদান করা হয়েছে।

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন, পলিসি, প্রজ্ঞাপন, আদালতের রায়, বিভিন্ন স্মারক ও নথিতে আদিবাসীদের স্বীকৃতি আছে। তথাপি সরকারের কোন কোন মহল বাংলাদেশের আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ বলার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং পার্বত্য চট্টগ্রামের আমলাদের এ ধরণের অপচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। বিদেশে কর্মরত সরকারের কোন কোন প্রতিনিধি এখনো ‘উপজাতি’ শব্দ প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। ২০১০ সালের ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলেছিলেন- “There are no indigenous people’ in Bangladesh but some tribal people or people of different ethnic minorities living in different part of Bangladesh’’ । ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন’ প্রণীত হবার পর এদেশের আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ বলার যৌক্তিকতা থাকতে পারে না বরং আইনত: অপরাধী। সর্বশেষ আইন অনুসারে এদেশের আদিবাসীদের হয় ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ অথবা ‘আদিবাসী’ বলা উচিত।

কারণ সর্বশেষ আইনে এই দু’টি শব্দ সন্নিবেশিত হয়েছে। এই আইন প্রণীত হবার পরও সরকারের বেশীরভাগ কর্মকর্তা এখনো ‘উপজাতি’ শব্দ ব্যবহার করে চলেছে। যারা সর্বশেষ আইন অনুসরণ করে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ বা ‘আদিবাসী’ বলছে না সরকার তাদের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।  সাংবিধানিক স্বীকৃতির অধিকার মানবাধিকার আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিকের সাংবিধানিক স্বীকৃতির অধিকার- মানবাধিকার। এটি নাগরিকের একটি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক অধিকার। আদিবাসীরা এদেশের নাগরিক। এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে আদিবাসীরা রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে এ অঞ্চলকে বাসযোগ্য ও কর্ষণযোগ্য করার ক্ষেত্রে আদিবাসীদের হাজার বছরের সংগ্রাম ছিল। সুতরাং এই আদিবাসীদের নিজের দেশের সংবিধানে স্বীকৃতি থাকবে না কেন? কেন রাষ্ট্র, সরকার তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেবে না? কোন যুক্তিতে?
পৃথিবীর মানুষ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মানুষের চিন্তাচেতনা অনেক অগ্রসর হয়েছে। পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। যেসব জাতি আদিবাসীদের উপর শোষণ বঞ্চণা চালিয়েছিল সেসব জাতি আদিবাসী জাতির নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বক্তব্য প্রদানকালে প্রকাশ্যে আদিবাসীদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা চেয়েছেন। আমেরিকা, কানাডা, বলিভিয়া, মেক্্িরকো, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর প্রভৃতি দেশে আদিবাসীদের স্বীকৃতি আছে।

এসব দেশগুলিতে আদিবাসীদের প্রথাগত ভুমি অধিকার স্বীকৃত। নওেয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড- এ আদিবাসীদের নিজস্ব পার্লামেন্ট পর্যন্ত আছে। এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে আদিবাসীরা হয় সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত নয় তো রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। এশিয়ার এসব দেশে আদিবাসীদের ভুমির অধিকার স্বীকৃত। এসব দেশে আদিবাসীরা বহু পরিমানে অধিকার ভোগ করে থাকে। আদিবাসীদের ভুমির অধিকার আদিবাসীদের ভুমি ব্যবস্থাপনা দেশের মূল স্রোতধারা জনগোষ্ঠীর ভুমি ব্যবস্থাপনা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।

আদিবাসীদের প্রথাগত ভুমি অধিকার বৃটিশ আমলে কিছুটা স্বীকৃত ছিল। এ অধিকার ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে অন্তভর্’ক্ত ছিল। পাকিস্তান আমলে ভুমির উপর আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকারের বেশ কিছু অংশ বাতিল করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন আমলে আদিবাসীদের ভুমি অধিকার খর্ব করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বেশ কিছু ভ’মির অধিকার সন্নিবেশিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের হাতে ভুমির ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিত জেলার কোন জায়গা জমি বন্দোবস্ত, লীজ, হস্তান্তর বা অধিগ্রহণ করা যাবে না। ভুমি ও ভুমি ব্যবস্থপনা সম্পূর্ণরূপে পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট ন্যস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও এর আলোকে প্রণীত বিভিন্ন আইনে আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকার সন্নিবেশিত হয়েছে।

বিশেষত: জুম, জুমভুমি ও জুম চাষ পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট ন্যস্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও প্রথাগত অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান সার্কেল চীফ বা রাজা, হেডম্যান ও কার্বারী পার্বত্য চট্টগ্রামের ভুমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে।  অপরদিকে ১৯৫০ সালের ‘জমিদারী উচ্ছেদ ও প্রজাসত্ত্ব আইনে’ সমতলের আদিবাসীদের ভুমি অধিকার কিছুটা স্বীকৃত হয়েছে। এই আইনে সমতল জেলাসমূহের বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের জমি বাংলাদেশের আদিবাসী ব্যতিত অন্য জাতিগোষ্ঠীর ব্যক্তির মালিকানায় হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এই আইনটি সংবিধানে সন্নিবেশিত আছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল অঞ্চলে ভুমির উপর আদিবাসীদের এসব অধিকার থাকা সত্ত্বেও আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত: ভুমি হারাচ্ছে। ভুমি বেদখলের জন্য আদিবাসীদের উপর প্রতিনিয়ত হামলা পরিচালনা করা হচ্ছে। আদিবাসীদের উপর মিথ্যা মামলা ঠুকিয়ে দিয়ে, হুমকী প্রদর্শন করে নানাভাবে হয়রানী করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার বসতিস্থাপনকারীরা এখনো আদিবাসীদের শত শত একর জমি বেদখল করে রেখেছে। এসব জমি বেদখলমুক্ত করে আদিবাসীদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ভুমি কমিশন গঠন করা হলেও ভুমি কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গড়িমসি করছে। ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ শুরু না করে এ কমিশনের চেয়ারম্যান এককভাবে ভুমি জরীপের ঘোষণা দেয়, যা ভুমি কমিশনের কাজ নয়।

এদিকে বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন লংঘন করে হাজার হাজার একর আদিবাসীদের জায়গা-জমি বেদখল করে চলেছে। সমতল এলাকার আদিবাসীদের ভুমির পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও অনুরূপ দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আইন লংঘন করে প্রশাসন ও এলাকার ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আদিবাসীদের জমি বেদখল করে চলেছে।

আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য প্রস্তাবনা প্রথমত. বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের দেশ। এই বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সংবিধানে তিন ধরণের মালিকানা- ১. রাষ্ট্রীয় মালিকানা, ২. সমবায় মালিকানা ও ৩. ব্যক্তি মালিকানার কথা উল্লেখ আছে। আদিবাসীদের ‘সমষ্টিগত মালিকানা’ সংবিধানে স্বীকৃত নয়। তাই সংবিধানে ‘সমষ্টিগত মালিকানা’ সন্নিবেশ করার আবশ্যকতা রয়েছে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশে বাঙালী ছাড়াও বহু আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বাস করে। দেশের সমস্ত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে সংবিধানে স্বীকৃতি দিতে হবে।
চতুর্থত, সংবিধানে আদিবাসীদের প্রথাগত ভুমি অধিকার যথাযথভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। পঞ্চমত, আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি, প্রথা, ঐতিহ্য- এর সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। ষষ্ঠত, জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিষয়টি সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। প্রযোজ্যক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আদিবাসীদের জন্য শিক্ষা, চাকরি, উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ অধিকার প্রদানের বিষয়টিও সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে আদিবাসী নারী ও অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ অধিকারের বিষয়টি সংবিধানে স্বীকৃতি থাকতে হবে।

সপ্তমত, পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। অষ্টমত, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও এ চুক্তির আলোকে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন- এর সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা। নবমত, সংশোধনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ পূর্বক ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা।

দশমত, আদিবাসী বিষয়ক, সংবিধানের কোন ধারা পরিবর্তন করতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং সমগ্র অঞ্চলের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা পূর্বক সংশোধন করা- এই ধারা সংবিধানে সন্নিবেশ করা।

শক্তিপদ ত্রিপুরা, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

মতামত ও বিশ্লেষণ তাতিন্দ্রলাল বিহীন জেএসএস সংস্কারপন্থীদের সম্ভাব্য গতিপথ- সত্যদর্শী মুলিম্যা

আগস্ট ১৫, ২০২০

গত ১৩আগস্ট ৬৮ বছর বয়সে মারা গেলেন জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা) সভাপতি শ্রী তাতিন্দ্রলাল। যিনি পাহাড়ের রাজনীতিতে পেলে বাবু নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি যে দলের সভাপতি ছিলেন সে দলটিও সংস্কারপন্থী জেএসএস নামেই পাহাড়ের সাধারণ জনগণ চিনে আসছে। যারা দেশের রাজনীতির খবরাখবর রাখেন। তারা নিশ্চয় সংস্কারপন্থী রাজনীতির হিসাব নিকাশ জানেন। ২০০৭ সালের সেই এক এগার সরকার। মঈন উদ্দিন ও ফকরুদ্দিন সাহেবদের শাসনকাল। সেনা সমর্থিত একটি বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। জরুরি অবস্থা, মাইনাস ফর্মুলা। রাজনীতির কথিত শুদ্ধকরণের লক্ষ্যে সংস্কার কার্যক্রম চালানো। জরুরি অবস্থাকালীন বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার একটি বহুল আলোচিত শব্দ ছিল রাজনীতির সংস্কার করা। প্রভাবশালী রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই রাজনীতি সংস্কার প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকার একটি অভিযোগও প্রায়ই শোনা যেতো। দেশের বহু শীর্ষ রাজনীতিবিদ রাতারাতি সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতি ও খ্যাতি পেতে শুরু করেন। তারই অংশ হিসেবে বহু তারকা রাজনীতিবিদদের গায়ে সংস্কারপন্থী তকমা লেগে যায়। সেই সময়ের এক যুগ অতিক্রান্ত হতে চললো। কিন্তু সংস্কারপন্থী তকমা সেই রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দকে এখনও বহন করতে হচ্ছে। অনেক রাজনীতিবিদ সংস্কারের বেড়াজাল থেকে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনও করেছেন। তারপরেও নিজ নিজ দলে তাদের আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট এখনো কাটেনি।

চলতি রচনার বিষয়বস্তু পাহাড়ের রাজনীতি। সদ্য প্রয়াত হওয়া শ্রী তাতিন্দ্রলাল যে দলটির সভাপতি ছিলেন। সেই দলটির জন্ম, উত্থান কিংবা উদ্ভব ঐ এক এগার রাজনীতির সংস্কার তত্বের সূত্রানুসারে। মঈন উদ্দিন ও ফকরুদ্দিন সময়কালীন মাইনাস ২ ফর্মুলার কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। তা সফল করতে জরুরি অবস্থার সেনা সমর্থিত সরকার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে কারান্তরীণ করেন। বহু নেতাকর্মীকে জেলে পুরা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামেও মাইনাস ফর্মুলার কথা জোরেশোরে বাতাসে ভাসতে থাকে। কি ছিলো সেই মাইনাস ফর্মুলা? পাহাড়ের রাজনীতিতে এক এগার কুশীলবদের মাইনাস ফর্মুলার মূল লক্ষ্য ছিলেন একজন। তিনি হলেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা। সেই সাথে দল হিসেবে জনসংহতি সমিতির মধ্যে সংস্কার কাজ চালানো। এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এক এগারর মুল কুশীলব বলে পরিচিতি পাওয়া সেনা কর্তৃপক্ষ পাহাড়ে তাদের মিশন শুরু করে। মিশনের মূল এজেন্ডা ছিলো সন্তু লারমাকে গ্রেফতার এবং আঞ্চলিক পরিষদের নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ। আর জনসংহতি সমিতিকে এক এগার কুশীলবদের কব্জায় নেওয়া। এটাকে জুম পাহাড়ের সংগ্রামকে অধিগ্রহণ করার এক ধরণের উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক চক্রান্তও বলা যেতে পারে।

সেনা সমর্থিত ফকরুদ্দিন সরকারের সক্রিয় নানান সংস্থা পাহাড়ী রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে টোপ ফেলা শুরু করে। পাহাড়ের লড়াই সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দল জনসংহতি সমিতির মধ্যে বড়শী ফেলা হয়। অন্যদিকে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়। জেএসএস নেতা-কর্মীদের হয়রানি, গ্রেফতার ও বহুবিধ উপায়ে নিপীড়ন চালিয়ে পাহাড়ে আতংকের বিবিধ উপাদান সৃজন করা হয়। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়া, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান হওয়া। জেএসএস-এর কিছু উচ্চাভিলাষী নেতা-কর্মী এই রকম বাহারী লোভনীয় টোপ গিলতে শুরু করে। এই উচ্চাভিলাষী নেতা-কর্মীরা জেএসএস-এর মধ্যে ক্ষুদে উপদল সৃষ্টি করে। দলটির নেতৃস্থানীয় সংগঠক রূপায়ন দেওয়ান, সুধাসিন্ধু খীসা, তাতিন্দ্র লাল, মৃণাল কান্তি ত্রিপুরা, শক্তিমান চাকমা, সুদীর্ঘসহ অন্যান্যদের একটি উপদল প্রকাশ্য হয়ে উঠে। সন্তু লারমা গ্রেফতার হচ্ছেন। রূপায়ন দেওয়ান আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হতে চলেছেন। অন্যরাও বেশ লোভনীয় পদে আসীন হচ্ছেন। রূপায়ন দেওয়ান আর শক্তিমানরা নিজেরাই উৎসাহের সাথে এই ধরণের প্রচার প্রচারণা শুরু করে দেন। অনেকে রীতিমত ক্ষমতার ট্রায়াল কসরৎ আরম্ভ করেন। এরই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় জনসংহতি সমিতি (সংস্কার) নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জনসংহতি সমিতির মূল নের্তৃত্ব দখল,কব্জা কিংবা অধিগ্রহণে ব্যর্থ হয়ে ফকরুদ্দিন সরকারের ক্রিয়াশীল সংস্থাগুলো দলটির উচ্চাভিলাষী অংশকে হাতিয়ে নেয়। তখন থেকেই তৈরি হয় জেএসএস (সংস্কার) নামক গ্রুপটি। রাজনীতির এই সংস্কারের ঘূর্ণ চক্রে রূপায়ন দেওয়ান, সুধাসিন্ধু খীসা ও তাতিন্দ্র লালদের মতো পাহাড়ের পোড় খাওয়া সংগ্রামীরা নিজেরাই গুটি হয়ে যায়। মজার বিষয় সংস্কারপন্থী খাতায় নাম লেখালেও বিশেষ সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুতি মোতাবেক রূপায়ন দেওয়ান ও শক্তিমানদের কোন পদেই বসাননি। তবে মুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়। ঝুলানো মুলোটির স্বাদ নেওয়ার উদগ্র বাসনায় সংস্কারপন্থী নামধারী জেএসএস-এর লোকজন বিশেষ সংস্থাসমূহের প্রদর্শিত পথে হাঁটতে থাকে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে মঈন উদ্দিন ও ফকরুদ্দিন সরকারের বিদায় ঘটে। কথিত মাইনাস ২ ফর্মুলা উধাও হয়ে যায়। এক এগার কুশীলবরা দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেন। সংস্কারপন্থী রাজনীতিবিদরা নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। বহুল কথিত সংস্কারপন্থী রাজনীতিবিদরা হারিয়ে যেতে থাকে। অনেকে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। কিন্তু পাহাড়ের রাজনৈতিক সমীকরণ সব সময়ই ভিন্ন। এক এগারর কুশীলবরা পাহাড়ে সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক। সরকার বদল হলেও পাহাড়ে এক এগাররা থেকেই যায়। তাই জনসংহতি সংস্কারপন্থীদের কাজ সচল থাকে। ২০১০ সালে দলটি একটি কংগ্রেস অধিবেশন আহ্বানও করে। সেখানে জনসংহতি সমিতি (সংস্কার) নামটি বদলে ফেলা হয়। নতুন নামকরণ করা হয় জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)। অবশ্য পাহাড়ের জনগণ তাদের এই নামটি গ্রহণ করেনি। পাহাড়ী মানুষের কাছে তাদের পরিচয় সংস্কারপন্থী হিসেবে থেকে যায়। শুরু থেকে রূপায়ন দেওয়ান ও সুধাসিন্ধু খীসা এই সংস্কারপন্থীদের নের্তৃত্বে ছিলেন দৃশ্যমান। তাঁরা দুজন এই দলটির যৌথ কার্যকরী সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। বাহ্যিকভাবে রূপায়ন দেওয়ান ও সুধাসিন্ধু খীসা দলটির পরিচিত মুখ। কিন্তু সংস্কারপন্থী জেএসএস-এর মূল সাংগঠনিক কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তাতিন্দ্রলাল। তিনি শুরু থেকেই দলটির সাংগঠনিক কাঠামোর প্রাণ ছিলেন।


সংস্কারপন্থী জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতা সুধাসিন্ধু খীসা এক পর্যায়ে শারীরিক অসুস্থতার কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। রূপায়ন দেওয়ানও নিজেকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে নেন। তরুণ সংগঠক সুদীর্ঘ চাকমা প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন। আরেকজন প্রভাবশালী পরিচিত মুখ নানিয়াচর উপজেলা চেয়ারম্যন শক্তিমান চাকমা নিজ কর্মস্থলের পাশে আততায়ী কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এমতাবস্থায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংস্কারপন্থী জনসংহতি সমিতির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসে তাতিন্দ্রলাল পেলে সভাপতি ও বিমল চাকমা মূর্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। সুধাসিন্ধু খীসার অসুস্থতা ও রূপায়ন দেওয়ানের নিষ্ক্রিয়তা, সেই সাথে শক্তিমান চাকমার মৃত্যু। সব মিলিয়ে ২০২০ এর কংগ্রেস আগ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক তাতিন্দ্রলাল সংস্কারপন্থী রাজনীতি ধারার প্রধান কর্ণধার হয়ে উঠেন। এখানে উল্লেখ থাকে যে, এক এগারর যে বিশেষ সংস্থাগুলোর পৃষ্টপোষকতায় সংস্কার জেএসএস তৈরী হয়। সেই বিশেষ গোষ্ঠীর আশীর্বাদ ও সক্রিয় সমর্থন প্রতিনিয়ত সংস্কারপন্থী জনসংহতি সমিতির সাথে ছিল। বলতে গেলে এই বিশেষ শক্তিই দলটির প্রাণ ভোমরা। ২০২০ সালের কংগ্রেসের মাধ্যমে সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে শ্রী তাতিন্দ্রলাল আনুষ্ঠানিকভাবে দলটির শীর্ষ জন হযে উঠেন। দীর্ঘদিন শারীরিক অসুস্থতার পর আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য ও দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম সুধাসিন্ধু খীসার প্রয়াণ ঘটে। এটাও দলটির বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। অন্যদিকে আরেক পরিচিত মুখ মৃণাল ত্রিপুরা এনজিও কার্যক্রমে অধিক মনোযোগী হয়ে যান। ফলস্বরুপ যোগযোগ থাকলেও পার্টিজান রাজনীতি থেকে মৃণাল ত্রিপুরাও দূরে চলে যান। এমতাবস্থায় সংস্কারপন্থী জনসংহতি সমিতির সভাপতি শ্রী তাতিন্দ্রলালের ১৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার ৬৮ বছর বয়সে আকষ্মিক মৃত্যু ঘটে। যদিও তিনি বেশ কছিুদিন যাবৎ সুস্থ ছিলেন না। তারপরেও শারীরিক সক্ষমতা অটুটই ছিলো।

চলতি সময়ে সংস্কারপন্থী জনসংহতি সমিতির সভাপতি তাতিন্দ্রলাল পেলের মৃত্যু দলটির জন্য কাঙ্খিত ছিলোনা। এই মৃত্যু দলটির সাংগঠনিক কাঠামোর জন্য বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। শুধু বিপর্যয় বললেও কম হতে পারে। প্রকৃত অর্থে সংস্কারপন্থী জেএসএস-এর জন্য এই মৃত্যু মহাবিপর্যয়ও বয়ে আনতে পারে। যদিওবা পেলে বাবুর মৃত্যুর পর মৃত্যু সংবাদ এবং ভারপ্রাপ্ত সভাপতির নাম দলটি একসাথে সংবাদ মাধ্যমে পাঠায়। সুভাষ কান্তি চাকমা (পরচিয়)-কে দলটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে আমরা জানতে পারি। তবে বিষয়টি একটু খটকা তৈরী করে। সভাপতির মৃত্যুর দিনই তড়িঘড়ি করে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির নাম ঘোষণা কেন? আর পেলে বাবুর মৃত্যু সংবাদ নিয়েও দলটি ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে। বাঘাইছড়ির এক সাংবাদিক তার ভেরিফাইড ফেসবুক একাউন্ট থেকে ১৩ আগস্ট সকালের দিকে পেলে বাবুর মৃত্যু নিশ্চিত করেন। তারপর পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পেলে বাবুর মৃত্যুর খবরটি চলে আসে। কিন্তু সংস্কারপন্থী জেএসএস অনেক দেরীতে তাদের সভাপতির মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করে।

এখন প্রশ্ন উদয় হতেই পারে। তাতিন্দ্রলাল পরবর্তী সংস্কারপন্থী জনসংহতি সমিতির গন্তব্য কি হতে পারে? দলটি কি এই ক্ষতি কিংবা বিপর্যয় অথবা মহাবিপর্যয় সামলে উঠতে পারবে? যে কোনো রাজনৈতিক দলে নেতা-নের্তৃত্ব অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এখন সংস্কারপন্থী জেএসএস-এর ক্ষেত্রে যদি পর্যালোচনা করা হয। তাহলে পরিলক্ষিত হবে সুধাসিন্ধু খীসা ও শক্তিমান চাকমা দুজনেই বেঁচে নেই। অন্যতম শীর্ষ নেতা আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য রূপায়ন দেওয়ান রাজনীতি থেকে অবসর জীবন যাপন করছেন। রাজনীতিতে আবার ফিরবেন সেই সম্ভাবনাও শূন্য। পরিচিত মুখ মৃণাল কান্তি ত্রিপুরা এনজিও নিয়ে ব্যস্ত। তিনিও আর সক্রিয় রাজনীতিতে জড়াবেন বলে মনে হয় না। বাঘাইছড়ির উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা। তিনি এলাকা ভিত্তিক রাজনীতি করেন। মহালছড়ির প্রজ্ঞান খীসা। সংস্কারপন্থী রাজনীতির বেশ পরচিতি মুখ। হাল নাগাদ দলটির প্রক্রিয়ায় তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি নগণ্য। দলের সাধারণ সম্পাদক বিমল কান্তি চাকমা (মূর্ত)। তিনিও বলতে গেলে স্থানীয় রাজনীতির মধ্যেই থাকেন। দলের আরেকজন সিনিয়র কর্মী অংশুমান। তিনি সংস্কারপন্থী জেএসএস-এর একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী। কিন্তু তাতিন্দ্রলাল হয়ে উঠার মতো গুণাবলী অর্জন করা অংশুমানের জন্য দুরূহ কাজ। যিনি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হয়েছেন। সেই সুভাষ কান্তি চাকমার পক্ষে এই ভার বহন করা আসলেই দুঃসাধ্য। সুধাকর ত্রিপুরা নামের আরেকজন নেতার নাম মাঝে মাঝে সংস্কারপন্থীদের পাঠানো প্রেস রিলিজে দেখা মিলে। কিন্তু সুধাকর বাবুর কর্ম পরিধিও সেখানেই সীমিত।

অতএব চুড়ান্ত বিশ্লেষণে সংস্কারপন্থী জনসংহতি সমিতির সামনে তাতিন্দ্রলালের মতো চৌকষ নের্তৃত্ব আর একজনও নেই। শুধু তাই নয়। দল কিংবা সংগঠন চালানোর মতো কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠার ব্যক্তিও দুর্লভ বলে প্রতীয়মান। তাই চলমান সময়ে তাতিন্দ্রলালের মৃুত্যু সংস্কারপন্থী জনসংহতি সমিতির জন্য শুধু ক্ষতির কারণ নয়। তাতিন্দ্রলালের মৃত্যু দলটির জন্য মহাবিপর্যয় অপেক্ষা করছে। সংস্কারপন্থী জনসংহতি সমিতির সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে জনমনে শংকা থেকেই যাবে। পর্যালোচনায় উঠে আসে, দলটি মোটাদাগে অঞ্চল ভেদে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদল সৃষ্টি হতে পারে। প্রতিটি উপদলের ছোট ছোট পকেট তৈরী হতে পারে। এই উপদল আর পকেটগুলো বিশেষ বাহিনীর খুবই আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারে। অনেক নেতা কর্মী হতাশ হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারেন। আবার নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ লড়াই সংগ্রামের মূল স্রোতধারায় মিশে যেতেও পরেন। সদ্য প্রয়াত সংস্কারপন্থী জনসংহতি সভাপতি শ্রী তাতিন্দ্রলাল পেলের অবর্তমানে দলটির ছিন্নভিন্ন ভগ্ন ভবিষ্যতই দৃশ্যমান।

সত্যদর্শী মুলিম্যা, পাহাড়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

১৭ আগস্ট: চাকমা জনগোষ্ঠীর কালো দিবস-৩ - নিরঞ্জন চাকমা

 

দেশ বিভাগ: চাকমাদের জীবনে প্রদোষকালের সূত্রপাত

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের রাত্রির মধ্যযামে দিল্লীর লালকেল্লা থেকে পন্ডিত জওরলাল নেহেরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আবেগ-মথিত কন্ঠে ভারতের পরম আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা ঘোষণা করে ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনি বা নিয়তির সঙ্গে অভিসার নামের ভাষণ প্রদান করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে প্রশংসামূলক বহুল আলোচনা হয়েছে। এই সুদীর্ঘ ভাষণের প্রসঙ্গে কোন এক কবি বলেছেন-

স্বাধীনতার প্রভাব এসেছে সিংহবাহনে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের বেলায় বলতে হয় স্বাধীনতা প্রভাব এসেছে দুর্গতিবাহনে। কারণ স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে দেশভাগের সময় ভারতের জাতীয় নেতাদের চরম অবহেলার দরুন এই আদিবাসী ও অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য জেলাটি সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তারা হারিয়েছে স্বশাসনের অধিকার, বিপন্ন হয়েছে অস্তিত্ব, হাতছাড়া হয়েছে জমিন-জিরত, ‘এথনিক ক্লিনসিং’ প্রক্রিয়ায় স্ব-ভূমি থেকে বিপুল সংখ্যায় উৎখাত হয়েছে, বার বার আক্রান্ত হয়ে চলেছে জাতিদাঙ্গায়, ভারতের শরণার্থী হতে হয়েছে একাধিকবার। বর্তমানে নিজ বাসভূমিতে পরবাসী হয়ে বিশ^ময় পরিচিতি লাভ করেছে ইহুদিদের মতো ‘ডায়াসপোরা’ নামে। স্বাধীনতা তাদের জীবনে এনে দিয়েছে ঘোর প্রদোষকাল।

দেশ বিভাগের বীজ অজান্তে বপন করা হয়েছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়কাল থেকেই।বঙ্গভঙ্গের আদেশ কার্যকরী হওয়ায় সাড়ে চৌদ্দমাস পরেই ১৯০৬ এর ৩০ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকার নবাব মহম্মদ সলিউল্লাহ এর অগ্রণী ভূমিকায় মুসলিম এলিট শ্রেণীর লোকদের উপস্থিতিতে প্রথম মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম দিকে অবশ্য এই নবগঠিত সংগঠনের তেমন জনপ্রিয়তা ছিল না। মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে জাতীয় কংগ্রেস দলেরই অধিক জনপ্রিয়তা ছিল। কিন্তু কালক্রমে এই সংগঠনের সঙ্গে মহম্মদ ইকবাল সহ বহু মুসলিম বিদ্বজ্জনের অংশ গ্রহণের ফলে, এবং সর্বোপরি মহম্মদ আলী জিন্নার এই সংগঠনের নেতৃত্বে গ্রহণের পর থেকেই এর বাড়-বাড়ন্ত হতে থাকে।

অপরদিকে মুসলিম লীগের শ্রীবৃদ্ধির ক্ষেত্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের পরোক্ষ ভূমিকা কার্যকর হয়েছিল। আসলে সমগ্র ঊনিশ শতক জুড়ে শিক্ষা দীক্ষা, পেশা, সরকারী চাকুরী-বাকুরি, অন্যান্য সুযোগ সুবিধালাভ ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে উচ্চবর্গের হিন্দুরা একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করছিলেন। তখন এসব ক্ষেত্রে মুসলমানেরা ছিলেন পিছিয়ে। বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে এই চিত্রটি গেল পাল্টে। আর এদিকে সেই ১৯০৬ সালে রোপিত সাম্প্রদায়িকতা নামের বিষবৃক্ষের বীজটি অঙ্কুরোদগমের পরে চারাগাছ থেকে বড় হতে হতে তা বিশাল আকার ধারণ করেছে। চল্লিশের দশকের শেষদিকে দেখা গেল এই মহীরুহটি কোন মতোই উৎপাটিত করা যায় না। তখন উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতারা খেয়াল করলেন বিপদ সমুৎপন্ন অর্ধেক ভাগ করাই স্বার্থরক্ষার একমাত্র উপায়। তাই তাঁরা ১৯৪৭ এর প্রথম দিকের প্রস্তাব বঙ্গ ও পাঞ্জাব বিভাজনের মাধ্যমে দেশভাগের কথা স্বীকার করে নিলেন।

গান্ধীজী কিন্তু দেশবিভাজনের কথা মানলেন না। তিনি বললেন আমার মৃত্যুর পর আমার মৃতদেহের উপর দেশভাগ হবে। তখন বুড়োর কথা শুনে কে। নেহেরু, প্যাটেল ও আজাদ দেশ খন্ডিত হলেও স্বাধীন ভারতের ক্ষমতাভোগের জন্য পরম লালায়িত ছিলেন। জিন্নাহ দেশভাগ ব্যতীত কোন কথা শুনতে রাজী নন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল হিন্দু মহাসভা প্রথম দিকে দেশভাগের প্রস্তাবে অরাজি হলেও শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন। আর অন্যদিকে তখনকার সময়ের গণ সংগঠনের দিক থেকে তৃতীয় শক্তি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দেশভাগের ঘোর বিরোধী। তবু তড়িঘড়ি দেশভাগ হলো। স্বাধীন ভারত ও স্বাধীন পাকিস্তানের জন্ম হলো। জিন্নাহ কিন্তু প্রাপ্ত অংশ নিয়ে অসন্তুষ্ট। বললেন- কীটদস্ত পাকিস্তান (মথ ইটন পাকিস্তান)। তিনি চেয়েছিলেন লাহোর থেকে দিল্লি। তবু সান্ত¡না অন্তত লাহোর তো পাওয়া গেছে।

এদিকে পাঞ্জাবীরা লাহোরের জন্য বিষাদগ্রস্ত হলেন চিরতরে। কারণ লাহোর ছিল পাঞ্জাব কেশরী রণজীৎ সিং এর রাজধানী পাঞ্জাবীদের শোর্য বীর্যের প্রতীক। তবু দেশভাগ হলো আপামর ভারতবাসীর দেশভাগের চূড়ান্ত সীমারেখা না জানা অবস্থায়। তাই দেখা গেল দেশময় তিক্ততম পরিণতি। দেশভাগকালীন ভয়ঙ্কর জাতিদাঙ্গার, ফলে অন্তত দশ লক্ষ নিরপরাধ মানুষ হলেন আহত। দিকে দিকে বহু লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ, অপহরণ ও বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণের দূর্ঘটনা ঘটল। বহু মানুষ হলেন গৃহহারা, দিশাহারা। অন্তত এক কোটি আশি লক্ষ মানুষ প্রাণ রক্ষার্থে নিজ পরিচিত পরিবেশ ও পরিজন ছেড়ে হলেন দেশান্তরিত। দেশান্তরের সেই প্রবাহ ক্ষীণতর হলেও এখনো চলছে, থেমে যায়নি। দেশান্তরিত জনের সুস্থিতি, সুরক্ষা ও অভয়দানের জন্য নবগঠিত দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীদের একটি চুক্তি (নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তি) সম্পাদিত হলো। কিন্তু চুক্তি হলেও তা দু’দিকেই যতাযথভাবে মান্য করা হলো না। ফলে দেশভাগজনিত প্রদাহ প্রশমিত হতে লেগে গেল আরও কয়েক বছর।

দেশভাগকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ:

১৯৪৭ সালের তেসরা জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক বেতারযোগে ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে ঘোষিত হলো ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের তথা এই উভয় দেশের স্বাধীনতা লাভের নির্ঘন্ট বা নির্দিষ্ট সময়সূচি। তাতে বলা হলো আগস্ট মাসের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্রিটিশরা চলে যাবে নিজ দেশে। তখনই পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা নেতাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম দু’দেশের মধ্যে কোনটির সঙ্গে যোগ দেবে এই বিষয়টির উপর। আপামর চাকমা জনসাধারণের অভিমত হলো তারা ভারতের সঙ্গেই যোগ দেবেন। কারণ সংস্কৃতিগত দিক থেকে হিন্দুদের সঙ্গেই চাকমাদের মিল অধিক। চাকমা রাজা, রাজপরিবার ও দেওয়ান পদাধিকারদের তাই অভিমত। কিন্তু তাদের আশংকা হলো ব্রিটিশ আমলে যেভাবে রাজন্যবৃন্দের মর্যাদা ও ক্ষমতা সুরক্ষিত ছিল, গণপ্রজাতন্ত্রী ভারতে তা সুরক্ষিত থাকবে কিনা?

এই দোদুল্যমানতা নিয়েই ঠিক হলো যে, শীঘ্রই একটি প্রতিনিধিদল দিল্লী যাবেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনার জন্য। এই দলের নেতৃত্ব দেবেন পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের একমাত্র গণসংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতির সভাপতি কামিনী মোহন দেওয়ান ও চাকমা ছাত্র সংগঠনের নেতা ¯েœহ কুমার চাকমা। এছাড়া চাকমা রাজপরিবারের পক্ষ থেকেও পৃথক একটি প্রতিনিধিদল দিল্লি যাবেন যাঁর নেতৃত্বে থাকবেন স্বয়ং চাকমা রাজা ভূবন মোহন রায় এবং তার সহযোগী থাকবেন জন সমিতির সদস্য অবনী দেওয়ান। উভয় দল পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেন কংগ্রেস সভাপতি আচার্য জে বি কৃপালনি, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এই প্রতিনিধিদলকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য এই জুন মাসের শেষদিকে একটি প্রতিনিধিদল পার্বত্য চট্টগ্রামে যাবেন। এই কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে থাকবেন জাস্টিস এ ডি ঠক্কর। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে থাকবেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, প্রফুল্ল ঘোষ, জয়পাল সিং, রাজকৃষ্ণ বোস ও ফুলবন সাহা। স্নেহ কুমার চাকমা থাকবেন কমিটির কো-ওপ্টেট সদস্য।

কথামতো নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ জুন মাসের শেষদিকে উল্লিখিত কংগ্রেসের বিশেষ প্রতিনিধিদলটি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে পৌঁছলে চাকমা রাজা সহ জনসাধারণের তরফ থেকে তাঁদের যথোচিত সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। আলোচনা সভায় চাকমাদের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে প্রতিনিধিদলটি তা তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখান করেন। অবশেষে বিনাশর্তে ভারতে যোগদানের বিষয়টি চাকমাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদলকে জ্ঞাপন করা হয়। এদিকে বেঙ্গল বাউন্ডারী কমিশন, বিভিন্ন আবেদনকারী দল, অঞ্চলবাসী ও উৎসাহী ব্যক্তি বিশেষের উপস্থিতিতে হেয়ারিং-এর জন্য দিন তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করেন।

সেই অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে ১৬ থেকে ২৪ জুলাই তারিখে কলকাতার বেলভেদরে প্যালেস-এ হেয়ারিং সভা আয়োজিত হয়। প্রথম দিনেই ছিল কংগ্রেসের দাবি উত্থাপনের দিন, যাতে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের একটি অঞ্চলকে (আয়তন ৪০,১৩৭ বর্গমাইল) ভারত ভুক্তির জন্য দাবি জানানো হয়। কিন্তু ঐদিনে বা পরবর্তী দিনগুলিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম দাবির বিষয়টি কংগ্রেসের তরফ থেকে কদাপি উত্থাপিত হয়নি। অথচ মুসলীম লীগের তরফ থেকে ১৯ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি করার দাবি জানানো হয়। তাতে বলা হয়, যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে মানচিত্রের মধ্যে অ-মুসলমান অঞ্চল রূপে দেখানো হলেও, তা কিন্তু সংযুক্ত মুসলমান এলাকার একটি পকেট মাত্র। তাছাড়া এই অ-মুসলমান অঞ্চলটির সঙ্গে বাংলার কোন অ-মুসলমান অঞ্চলের সংযুক্তি নেই। তদুপরি পূর্ববঙ্গ এলাকার মধ্যে একমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফূলি নদীতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা সম্ভব। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি পূর্ববঙ্গের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করাই যুক্তিযুক্ত।

কংগ্রেসের দ্বারা এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতভুক্তির বিষয়টি চরম অবহেলায় পড়ে থাকার পর, ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট তারিখে বেঙ্গল ও পাঞ্জাব বাউন্ডারী কমিশনের রিপোর্ট দুটি সংক্ষিপ্ত রূপ যখন কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের শীর্ষ নেতাদের দেখানো হয়, তখন নাকি সর্দার বল্লভবাই প্যাটেল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে দেখে দারুণভাবে নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভ জানিয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে চিঠি লেখেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় পরের দিনই পাকিস্তানের স্বাধীনতা উদযাপনের সময়। এই অসময়ে ক্ষোভ জানিয়ে কী বা হবে?

ঐ ১৩ আগস্টের দিনে বাউন্ডারী কমিশনের চেয়ারম্যান স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিপ বেঙ্গল ও পাঞ্জাব বাউন্ডারী কমিশনের রিপোর্ট দুটি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের নিকট স্বয়ং উপস্থিত হয়ে সহস্তে প্রদান করেন। মাউন্টব্যাটেন তা গ্রহণ করে সৌজন্যমূলক ধন্যবাদ জানান এবং খামে ভরা রিপোর্ট দুটি সবুজ রঙের একটি চামড়ার বাক্সে ঢুকিয়ে রাখেন। আগস্টের ১৪-১৫ তারিখে পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা উৎসব দুটি নিজের উপস্থিতিতে সুসম্পন্ন করে ১৬ আগস্টের অপরাহ্নে ঐ দুটি বাউন্ডারি রিপোর্টের কপি কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের অফিসে পাঠিয়ে দেন। পরের দিন ১৭ আগস্ট র‌্যাডক্লিপের দ্বারা প্রস্তুতকৃত বহু আকাক্সিক্ষত বাউন্ডারি কমিশনের রিপোর্ট দুটি পত্রপত্রিকা, রেডিও ইত্যাদি গণমাধ্যমের মারফত ভারত ও পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণ জানতে পারলেন। কিন্তু এদিকে গত তিন-চারদিন যাবৎ ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ, জেলায়, মহল্লায় ও গ্রামে গ্রামান্তরে দারুণ রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও অপহরণ ইত্যাদি নারকীয় ঘটনা অবিরাম ঘটে চলেছে। অপরদিকে মানবিক-বিবেকরহিত, ‘ভারতঅজ্ঞ’ ও কসাই সুলভ কর্মপদ্ধতিতে বাউন্ডারী রিপোর্ট-প্রণেতা সিরিল র‌্যাডক্লিপ ১৪ আগস্টের দিনেই ইংল্যান্ড চলে যান।

এখন প্রশ্ন হলো, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের শীর্ষনেতারা সত্যিই কি সীমান্ত নির্ধারণের ব্যাপারে ১৩ আগস্টের পূর্বে কিছুই জানতেন না? মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট ফিরোজপুর, গুরুদাসপুর ও মালদহ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতে তা কি মুসলিম লীগ জানতো না? আর অমুসলমান অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের দিকে রাখা হয়েছিল তা কংগ্রেস জানেই না? সব দায়িত্ব লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং র‍্যাডক্লিপের উপর চাপিয়ে উভয় দল নিশ্চিত ছিলেন? তা কী বিশ^াসযোগ্য? এক্ষেত্রে হিন্দু সংখ্যাঘরিষ্ট জেলা শ্রীহট্টের কথা উল্লেখ না-ই করলাম। তা গণভোটের নামে ভোট জালিয়াতি করে পাকিস্তানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায়, সময় থাকতে কংগ্রেস কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করলো না কেন? ভারতভূমির সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন সংযুক্তি নেই এই মিথ্যা যুক্তি দেখিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তান লুফে নিল? এই পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা তো কখনো চট্টগ্রাম জেলার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। এটা ছিল শাসন-বহির্ভূত এলাকা অর্থাৎ এক্সক্লুডেড এরিয়া। সে কারণে বঙ্গীয় পরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন প্রতিনিধি ছিল না।

তাই দুর্মুখেরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইচ্ছাকৃতভাবে বলি দেওয়া হয়েছে। একথাটি আপাতত সত্য বলেই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে একটি কথা এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের দিক থেকে দেশ বিভাগের সময় উত্তরপূর্ব ভারতের সীমান্ত ও সামরিক সুরক্ষা এবং সামদ্রিক বাণিজ্যের বিষয়টি মোটেই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি। যদি ভাবা হতো, তাহলে আজকের দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বারা সেই সুবিধাটি সহজেই অর্জন করা যেতো। কারণ তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে টেকনাফ ও কক্সবাজার স্থান দুটি অবস্থিত ছিল, সেখানে সহজেই ভারতের সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যেতো। তাতে বর্তমান ভারত সরকার দ্বারা খরচ-বহুল বার্মার পরিত্যক্ত মান্দালয় বন্দরটি এখন লীজ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় চালাতে হতো না। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতকে বাংলাদেশ সরকারের নিকট হাত পাততে হতো না।

এটা সত্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাটিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিদলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাই দেশভাগের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা নেতারা নিশ্চিত ছিলেন এই ভেবে যে, দিল্লির কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের তদারকিতে এই অঞ্চলটি অবশ্যই ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে। তাছাড়া দেশভাগের ঘোষিত বিধি অনুযায়ী অমুসলমান প্রধান অঞ্চল রূপে এটি ভারতের ভাগে পড়ারই কথা। তাই ১৫ আগস্টের দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসদর রাঙ্গামাটিতে চাকমারা ভারতের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা সগর্বে উড়িয়েছিলেন স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসক তথা ডেপুটি কমিশনারের অনুমতি সাপেক্ষে। কিন্তু ১৭ আগস্ট জানা গেল সেই চরম দুর্ভাগ্যের কথা, এই অঞ্চলটি নাকি পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে। তখন থেকেই শুরু হলো চাকমা নেতাদের দৌড়ঝাঁপ- পাকিস্তানের বালুচ রেজিমেন্টের দ্বারা ২১ আগস্ট ভারতের জাতীয় পতাকাটি টেনে হিঁচড়ে নামানো- পাকিস্তান সরকার কর্তৃক চাকমা নেতাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি- চাকমা নেতাদের দিল্লি গমন- সর্দার প্যাটেলের দ্বারা প্রতিরোধ সৃষ্টির ব্যাপারে আশ্বাস প্রদান- পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা শুনে নেহেরুজীর হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনাবলী, যা অন্যত্র বহুবার আলোচিত হয়েছে। এখানে সবিস্তারে উল্লেখের প্রয়োজন নেই।

এখানে যা উল্লেখ্য তা হলো দেশ বিভাগে ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অভিমত বা প্রতিক্রিয়া। যেমন পাঞ্জাব বাউন্ডারী কমিশনের একজন মুসলমান সদস্য জাস্টিস মুহম্মদ মুনীর বলেছেন “আমি নিশ্চিতই ভেবেছিলাম যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত করা হবে”। ভারতের অন্যতম আদিবাসী নেতা তথা ভারতের গণপরিষদের সদস্য জয়পাল সিং বলেছিলেন “পার্বত্য চট্টগ্রামকে অবশ্যই ভারতে ফিরিয়ে আনতে হবে”। খোদ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু কলকাতার একজন সভায় বলেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হবে। কিন্তু সে আলোচনা কখনো হয়নি। আর এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা আদিবাসীরা বিগত ৭০ বছর যাবৎ “প্রো-ইন্ডিয়ান” অপবাদ বহন করে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দুঃখময় জীবন যাপন করছে। তার শেষ সীমা কেউ জানে না।

তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপন্ন অবরুদ্ধ আদিবাসীদের পক্ষে কথা বলার জন্য বহির্বিশে^ ছড়িয়ে থাকা চাকমা ও অন্যান্য সহমর্মী আদিবাসীদের পক্ষে অহিংসনীতি মেনে কালোদিবস পালন ব্যতীত বিকল্প কিছু নেই। আমরা বিশ^াস করি, এই কর্মসূচির মাধ্যমে যদি বিশ্ববিবেকের দ্বারা সহানুভূতিমূলক আলোচনার ক্ষেত্র প্রসারিত হয় এবং বিশে^র তাবৎ মানবাধিকার কর্মীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, তবেই অবরুদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন।

নিরঞ্জন চাকমা: হিল ভয়েস (নিউজ পোর্টাল)-এর সম্পাদক এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

বুধবার, ১২ আগস্ট, ২০২০

চাকমা হরফ নিয়ে কিছু অপ্রিয় বচন - শুভ্র জ্যোতি চাকমা



চাকমা হরফের ব্যবহার নিয়ে আমি খুবই আশাবাদী এবং হঠাশ- দু’টোই। ঘাবড়ে গেলেন ? আচমকা কথা শুনলে ঘাবড়ে যাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রত্যাশা করছি এ প্রবন্ধটি পাঠের মধ্য দিয়ে ঘাবড়ে যাওয়ার উত্তর বা জবাব যা-ই বলি না কেন পাওয়া যাবে। আমার উত্তর বা জবাব বা যুক্তি কারোর অপছন্দের পাশাপাশি খারাপও লাগতে পারে। কেউ কেউ হতে পারেন বিব্রত। দু’টো বিষয় একেবারে পরস্পর বিরোধী। এর কারণ কী সেটি খুলেই বলি। পূর্বের চেয়ে হরফগুলোর ব্যবহার-চর্চা বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়াসহ সরকারিভাবে পাঠ্যবই মুদ্রণ ও পঠনের ব্যবস্থাকরণ আশাবাদী হওয়ার প্রধান এবং অন্যতম কারণ। অপরদিকে হরফগুলোর নিয়ম-শৃঙ্খলাহীন ব্যবহার-প্রয়োগ, নব নব নিয়ম চালুকরণের ব্যক্তিক উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা, নিত্য নৈমিত্তিক চিহ্নের উদ্ভাবন-প্রয়োগ হচ্ছে হঠাশার কারণ। হরফগুলোর ব্যবহারে ব্যক্তিগত অভিমতের প্রতিফলন ইতিমধ্যে নানাভাবে প্রতিভাত হয়েছে। আগামীতেও এ ধরনের প্রতিফলন হামেশাই দেখা যাবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারি। আমার অনেক লেখায় এ বিষয়ে কোনো কোনো অসঙ্গতি ও অযৌক্তিক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যার কারণে অনেকের অপছন্দের তালিকায় আমার স্থান হয়েছে সেটি অনুমান বা অনুভব করতে পারি। বছর তিনেক আগের ঘটনা। এক ফেসবুক বন্ধু যিনি নিজেকে চাকমা হরফ ও ভাষাবিশেষজ্ঞ এবং প্রখ্যাত লেখক মনে করেন আমাকে আনফ্রেণ্ড করার পাশাপাশি ব্লগও করে দিয়েছেন। কী অবাক কাণ্ড দেখুন তো ? ভুলভাল লিখবেন কিন্তু সেগুলিকে ভুল বলাও যাবে না। মুখবুঝে মেনে নিতে হবে-এটাই তো তারা চায়, পছন্দ করে। মানুষ নামক জীবেরা বড়ই অদ্ভুদ ! শুধুমাত্র প্রসংশাই খোঁজে-পেতে চায়। সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং মতকে প্রাধান্য দিয়ে যারা নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করতে চায় অধিকন্তু যারা নিজেদের গোজা ও গোষ্ঠীতে প্রচলিত শব্দ ও উচ্চারণকে(আমি ঐ সকল শব্দ ও উচ্চারণকে চাকমা আঞ্চলিক শব্দ হিসেবে গণ্য করি) প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের পছন্দের তালিকায় আমার অনুপস্থিতি আমি নিজেই পছন্দ করি। কারণ উভয়ের জন্য এটি বিব্রতকর। আরও উদ্বেগের কারণ হচ্ছে এ শ্রেণিদের প্রচেষ্টা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বৈ কমছে না। সামগ্রিকভাবে আমাদেরকে গভীর চিন্তায় ফেলে দেয়। ক্ষণিকের জন্য দিশাহীন হয়ে পড়ি। আমাদের ভাষা ও হরফের অগ্রগতির পথে এগুলো নি:সন্দেহে অন্তরায়। আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি গোজাভিত্তিক শব্দ ও উচ্চারণ প্রয়োগ অব্যাহত থাকলে আমাদের ভাষাকে স্ট্যাণ্ডার্ড পয্যায়ে উপনীত করা দুরূহ হবে ? ভেবে না থাকলে এখনিই ভাবা শুরু করতে হবে। একটি সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলে আগামী প্রজন্মের কাছে এগুলো দুর্বোধ্যতার দৃষ্টান্ত হিসেবে থেকে যাবে। এর কারণ উচ্চারণের নিরিখে বর্ণের ব্যবহার ও প্রয়োগ এবং বানান নির্ভর করে থাকে। একটু খেয়াল করে দেখবেন পূর্বে ব্যবহৃত অনেক বানান ও চিহ্নকে সমসাময়িক সময়ে এসেও অনেকে সেগুলিকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলেছেন। তথাগত বুদ্ধের অমীয় বাণীর ন্যায় সত্য মনে করেন। বুচ্চি উ-কে কেউ কেউ বলছেন উচ্চি উয়া। কারণ বচ্চি উ-এর নিচে কোনো কোনো বৈদ্যালি পুঁথিতে একটান চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে প্রতিফলন করার সময় অযৌক্তিক বা চাকমা হরফগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের নিয়ম বহির্ভুত কোনো চিহ্ন ব্যবহার করা হচ্ছে কি না সেদিকে সতর্ক থাকা উচিত। যদি করা হয় সেগুলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয় হবে এটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। চাকমা ভাষা ও হরফ নিয়ে আমরা এমন কোনো বিতর্কিত বিষয় বা সিদ্ধান্ত রেখে যেতে চায় না যাতে আমাদের ভাবী প্রজন্মরা সেটিকে নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পতিত হয় বা সমাধানহীন সমস্যায় মুখোমুখি হয়।

 পছন্দসই এবং স্বজাতীয় যে কোনো জিনিসের প্রতি ভালবাসা, ভাললাগা থাকা মানুষের স্বভাবজাত অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে ভাললাগা কোনো জিনিসের ওপর কোনো সমালোচনা, কুটবাক্য বা যে কোনো ধরনের আঘাত মানুষ সহ্য করে না, করতে পারে না। এক্ষেত্রে চাকমারা আরও একধাপ এগিয়ে রয়েছেন বলে মনে করা হয়। তারা সমালোচনা সহজে গ্রহণ বা হজম করতে চান না, গ্রহণ করেন না। অনেক ভিনজাতীয় মানুষের নিকট থেকেও এ জাতীয় মন্তব্য প্রায়শ শোনা যায়। এটি নি:সন্দেহে নেগেটিভ দিক এবং গ্রহণ অযোগ্য অপবাদ। সুতরাং এ জাতীয় বিষয়কে হেলায় না নিয়ে সেটির বিষয়ে গভীরভাবে ভাবা উচিত যাতে অপবাদ ঘুচানো যায়। আমাদেরকে গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ বা হজম করবার সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে এগুতে হবে নচেৎ কোনো বিষয়ে উৎকৃষ্ট ফলাফল আশা করা বৃথা হবে। আমি মনে করি চাকমা হরফগুলোর উন্নয়ন ও প্রসারে যারা কাজ করে যাচ্ছেন তাদের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করা জরুরিভাবে প্রয়োজন। তা না হলে একপেশে ফলাফলই আসবে যা এযাবৎ আমরা পেয়েই চলেছি। যার কারণে চাকমা হরফের ব্যবহার নিয়ে সুনির্দিষ্ট পন্থা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। খেয়াল করুন-অদ্যাবধি আমরা আমাদের হরফের সঠিক সংখ্যা কয়টি হওয়া উচিত সেটিও ঠিক করতে পারিনি। যে যার মত হরফ শিক্ষার বই প্রকাশ করছি মাত্র। অনেকে যার যার ধারা মোতাবেক শিখনের কাজও সম্পাদন করছেন। শিখনের কাজটিকে আমি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করতে চাই। তবে ব্যক্তি বিশেষে শিখনের কাজে রয়েছে নানা পার্থক্য। হরফের আকৃতিতে মৌলিক কোনো পার্থক্য না থাকলেও চিহ্ন প্রয়োগ ও ব্যবহারে রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা। ফলশ্রুতিতে বানানের প্রসঙ্গতি আরও দুর্বোধ্য হয়ে যায়। একটি ঘটনা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
 আমাদের ইনস্টিটিউটের কোনো একটি ব্যাচের চাকমা শিক্ষার্থীদের পঠন সুবিধার্থে আমি বন্ধুবর শুভাশীষ-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘করোদি’ নামক পত্রিকার কিছু কপি শিক্ষার্থীদের কাছে দিই। পরে ফলোআপ করে জানলাম যে, শিক্ষার্থীরা কিছু কিছু শব্দ পড়তে সক্ষম হচ্ছে না। কারণ সেই সব শব্দে কিছু চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলো তারা চিনে না। তাদের শেখানো হয়নি। চিহ্নগুলোর অন্যতম হচ্ছে ‘ডেইলদ্যা’। এ চিহ্নটি রাঙ্গামাটির কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি চাকমা হরফ শিখনের কাজে প্রয়োগ করেন না। আমরা লক্ষ করছি এভাবে অঞ্চলভেদে পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে। দৃশ্যমান পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং বাংলাদেশে আমরা যারা চাকমা হরফ চর্চা করছি তাদের মধ্যে। আশা করি এতক্ষণ নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন আলোচ্য প্রবন্ধটির লিখন উদ্দেশ্য। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে যে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে তা প্রত্যাশা করাও কল্পনাতীত। আমাদের মনে রাখা দরকার, হরফগুলোর ব্যবহারে নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব না হলে বানানরীতিও প্রণয়ন করা সম্ভব হবে না। তবে সমালোচনা হওয়া উচিত গঠনমূলক ও যৌক্তিক সহকারে এবং তা হওয়া উচিত অবশ্যই লিখিতভাবে। অনেকে শুধুমাত্র কথার মধ্য দিয়ে সমালোচনার ফুলঝুড়ি ঝেরে থাকেন। এতে কথাবার্তাগুলোর বিকৃতি ঘটে মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়ে থাকে। যে কোনো বিষয়ে মতদ্বৈততা লিখিতভাবে তুলে ধরা হলে পরবর্তীতে যারা কাজ করবেন তাদেরও অনেকখানি সহজ হয়ে থাকে। চাকমা হরফগুলোর অগ্রগতি চান তো এগুলোর অযৌক্তিক ব্যবহার, প্রয়োগ নিয়ে লিখিতভাবে সমালোচনা করুন। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা বলে, চাকমা হরফ ব্যবহারকারীদের মধ্যে নানা মত-দ্বিমত থাকলেও তা অনেকে লিখিতভাবে প্রকাশ করেন না। শুধুমাত্র কথার বুলিতেই তাদের যৌক্তিকতা খুঁজে পান। এ যৌক্তিকথা প্রকাশের ক্ষেত্র হচ্ছে কোনো সভা। ফলে শুধুমাত্র মত-অভিমত প্রকাশ করতে করতেই সভাটির কায©ক্রম শেষ হয়ে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। আমি মনে করি চাকমা হরফগুলোর আদি বৈশিষ্ট্য অধিকন্তু আধুনিক ভাষা প্রকাশে(যে কোনো ভাষা হতে পারে) হরফগুলোর বৈশিষ্ট্য বা ব্যবহারবিধি কী হওয়া উচিত সে নিয়ে সুচিন্তিত বিশ্লেষণধর্মী মতামত লিখিতভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন ।
 নিজস্ব হরফ নিয়ে গৌরবান্বিত ও আশাবাদী হওয়া একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেকের ন্যায় আমিও বেশ আশাবাদী। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি আমাদের হরফগুলো আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবের প্রতীক। আমাদের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি হরফগুলো আমাদের সুদূর অতীতের গৌরবময় ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। চাকমাদের অতীত ইতিহাস যে অত্যন্ত প্রজ্জ্বল ছিল হরফগুলো তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এজন্য হরফগুলো ব্যবহারে একটি সুষ্ঠু ও সর্বজন গ্রহণীয় ধারা প্রণয়ন করা যুগের দাবি হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে তাহলে হরফগুলো নিয়ে হঠাশার সুর কেন ? উত্তর খুবই স্বাভাবিক-চাকমা হরফগুলো নিয়ে উচ্চাকাঙ্খা আছে বলে নেগেটিভ ও পজেটিভ দিকসমুহ আমলে নিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করি যাতে হরফগুলোর ব্যবহারিক গাঁথুনি মজবুত এবং যৌক্তিক হয়। হঠাশ হওয়া নিয়ে অনেকের মনে প্রতিক্রিয়াসহ নানা প্রশ্ন-উদ্বেগও অনেকের মনে সৃষ্টি হতে পারে যা খুবই স্বাভাবিক। যদি বলি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করানোর জন্যই এ লিখনি ! আসলেই তা-ই। আমি চাই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে আরও অনেকে লিখবেন, গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরবেন। সৃষ্টি হবে অনেক লিখনির। চাকমা হরফগুলো নিয়ে অজস্র মতামত প্রতিফলিত হবে। সকল মতামতকে বিচার-বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা নতুন দিশা জাতিকে দেবেন। প্রসঙ্গ যে, হরফগুলো নিয়ে আমি ইতিপূর্বে দীর্ঘ-নাতিদীর্ঘ বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সে সব প্রবন্ধে আমি হরফগুলোর আদি উৎস, বৈশিষ্ট্য, প্রাচীন ব্রাহ্মী হরফগুলোর সাথে কোনো কোনো হরফের বিদ্যমান সাদৃশ্য এবং বিভিন্ন লেখকের মত-অভিমত তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। (পড়ুন-চাকমা বর্ণমালার ব্যবহার : অতীত ও বর্তমান, চাকমা হরফের সংখ্যা কত ?, চাকমা বর্ণমালা : ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে ইত্যাদি প্রবন্ধ) সাম্প্রতিক সময়ে চাকমা হরফের ব্যবহার, সংস্কার নিয়ে অনেকের নানা মত-অভিমত আমার নজর এড়ায়নি। নিরলস পরিশ্রম করে অনেকে আমাদের হরফগুলোকে উন্নয়নের দিকে ধাবিত করার শত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজস্ব চিন্তা ও মেধায় তারা কিছু কিছু সংস্কার ও নানা ধরনের চিহ্ন ব্যবহারে আগ্রহ দেখিয়েছেন। সন্দেহ নেই তারা চাকমা হরফগুলোর অগ্রগতির স্বার্থেই সংস্কার আয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যুগের চাহিদা মেটানোর জন্য সংস্কার আনয়ন অপরিহায্য। এ বিষয়ে আবারও লিখতে বসতে হলো এ কারণে যে, অনেক মত-অভিমতের সাথে আমি পুরোপরি একমত হতে পারি না। যেমনটি গ্রহণ করতে পারিনি সরকারিভাবে প্রকাশিত পাঠ্য উপকরণাদিতে যে সকল সংস্কার সংশ্লিষ্টরা সংযুক্ত করেছেন। যেমন-বইগুলোর প্রচ্ছদে তারা ম শব্দটি লিখতে গিয়ে বুগতপদলা মা হরফটির ওপরে একটান চিহ্ন দেয়ার পরও পাশে একটি কমা ব্যবহার করা করেছেন। শুধুমাত্র একটিতে নয় পুরো ৪টি শ্রেণির জন্য মুদ্রিত বইয়ে একই চিহ্ন প্রয়োগ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো যুক্তি আছে কী ?
 প্রসঙ্গত যে, বাংলা হরফে চাকমা ভাষা লিখার সময় বিগত শতকের সত্তর দশকে চাকমা সাহিত্যিকদের কেউ কেউ এ ধরনের চিহ্ন ব্যবহার শুরু করেছিলেন। আলোচ্য পাঠ্য বইগুলোতে মাজ্যাপাতের নিয়ম চুরমার করা হয়েছে। তাদের লিখন বৈশিষ্ট্য পয্যালোচনায় বুঝা যায় যে তারা সকল হরফে মাজ্যা চিহ্ন ব্যবহারে পক্ষপাতি। আমরা অনেকেই জানি, চাকমা ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ ও বানানরীতিকে সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে চাকমাদের মাজ্যাপাত। মাজ্যা চিহ্নটি হরফের ডানপাশের ওপরে বসে। এটি অনেকটা বাংলা রেফ্-এর ন্যায়। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ চিহ্নটিকে মানার কোনো ধার ধারেননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অপরদিকে ভারত থেকে চাকমা হরফে যে সকল প্রকাশনা প্রকাশ করা হচ্ছে সেগুলোতে মাজ্যাপাত এতই কঠোরভাবে মান্য করা হচ্ছে যে স্বয়ং বুদ্ধ শব্দটিই বিকৃত করা হচ্ছে। চাকমা হরফে তাদের বানানটি ‘বুত্ধ’। ‘বুদ্ধ’ উচ্চারণ করতে করতে অভ্যস্ত হওয়া আমাদের জিহ্বায় এটিকে উচ্চারণও সম্ভব হয়ে ওঠে না। সারা পৃথিবীজুড়ে সকল ভাষায় বুদ্ধ শব্দটি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করা হয়। অথচ মাজ্যাপাত মেনে চলার কারণে শব্দটিকে বিকৃতি করা হচ্ছে। এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মাজ্যাপাত এখানে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। শুধু তাই নয় নামবাচক ও জাতিবাচক বিশেষ্যর ক্ষেত্রেও মাজ্যাপাত উন্মুক্ত করে দিতে হবে। তা না হলে চিরাচরিত নামগুলো বিকৃত হবে। যেমন-কারোর নাম যদি শুভাশীষ হয় তাহলে মাজ্যাপাতের নিয়ম মেনে চলার জন্য কি শেষ বর্ণটির জায়গায় ‘চ’ বর্ণটি গ্রহণ করা যুক্তিসম্মত হবে ? না, কোনো অবস্থাতে সেটি গ্রহণ অযোগ্য। এজন্য ভিনজাতীয় ভাষার শব্দ, নামবাচক ও জাতিবাচক বিশেষ্যর ক্ষেত্রে মাজ্যাপাত উন্মুক্ত করতেই হবে। এছাড়া লক্ষ করা গেছে সরকারি পাঠ্যবইগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে বাংলাশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে চলমান ‘অঝাপাত’কে বিভক্ত করে ‘আবযুগি পাত’ ও ‘অঝাপাত’ নামে দু’টি ভাগে বিভক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। শুধু তাই নয় কেউ কেউ মৌলিক অঝাপাতকে ‘গাইমাত্যা পাত’ এবং ‘বলেমাত্যেপাত’ নামেও অভিহিত করছেন। এ ধরনের তথাকথিত প্রয়াস বাংলার স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ পাঠকে অনুসরণ করার ফলশ্রুতি বৈ কিছু নয়। তথাকথিত পাণ্ডিত্যের প্রতিফলন হিসেবে মাজারাগুলোকে অনেকে বলছেন ‘লেবাং’। ফলাগুলোকে বলা হচ্ছে পরশাল্য। সাম্প্র্র্রতিক সময়ে জামাহরফ(যুগ্মবর্ণ) এবং যদাহরফ(যুক্তবর্ণ) সৃষ্টিসহকারে ব্যবহার করার প্রয়াস চলছে। এ সকল বর্ণপ্রণেতাগণের যুক্তি হচ্ছে বিদেশি ভাষাকে চাকমা হরফে লিখনের জন্য জামাহরফ এবং যদাহরফ অবশ্যই দরকার। জানিনা জামাহরফ এবং যদাহরফগুলোকে কীভাবে উচ্চারণ করা হবে। কারণ চাকমা হরফগুলো আ-কারান্ত। জামা বা যদা হরফগুলোকে সরলভাবে লিখনের জন্য চাকমা হরফে মাজ্যা নামে একটি স্বতন্ত্র চিহ্ন রয়েছে। এ মাজ্যা চিহ্ন দিয়ে জামা বা যদা হরফগুলো আলাদা করা যায়। যে কোনো ধরনের যুক্তি দাঁড় করানো হোক না কেন এ ধরনের উদ্যোগের সাথে আমি কোনোভাবে একমত হতে পারি না। চাকমা হরফগুলোর যে বৈশিষ্ট্য তাতে জামা বা যদাহরফ সমর্থনযোগ্য নয়। এ ধরনের উদ্যোগ চাকমা হরফগুলোর চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থি। আর যদিই জামা বা যদাহরফ ব্যবহারকে সমর্থন করি তাহলে চিরাচরিত মাজ্যা চিহ্নটিকে তো বিলুপ্তি করে দিতে হবে। বলুন, এটি কি সম্ভব ? এজন্য বলি, চাকমা হরফগুলোর বৈশিষ্ট্যকে বাদ দিয়ে বা বিলুপ্তি ঘটিয়ে যে মত-অভিমত দাঁড় করানো হোক না কেন তা কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। গণতন্ত্রের মত এখানে বিকল। মেধা এখানে অর্থহীন। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, ভিনজাতীয় ভাষার কিছু শব্দকে লিখনের জন্য রাঙ্গামাটিস্থ সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট-এর চাঙমা পত্থম পাঠ(Chakma Primer) নামক বইটিতে রা-ফলা, য়্যা-ফলা ছাড়াও তিনটি ফলা গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-না-ফলা, হা্-ফলা এবং লা-ফলা। আলোচ্য এ তিনটি ফলা ভিনজাতীয় ভাষা শুদ্ধভাবে লিখনের জন্য যথেষ্ট সহায়ক বলে মনে হয়। আরও একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে এ প্রসঙ্গতি থেকে বিদায় নেব। চাকমা হরফে শুদ্ধ বানান লিখনের জন্য আমাদের কোনো একজন একটি নিয়ম চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমার অতি ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে যে, তার উদঘাটিত নিয়মটি অনুসরণ করতে হলে আমাদেরকে সর্বপ্রথমে বাংলাভাষা ও বানান বিষয়ে সুদক্ষ হতে হবে। অর্থাৎ আগে বাংলাভাষা ভালভাবে আয়ত্ব করেই চাকমা ভাষার বানান শিখতে হবে।
 অনেক মতের সাথে একমত হতে না পারা আমার জ্ঞানের স্বল্পতা যে হবে না তা হলফ করে বলতে পারি না। অধিকন্তু সে সকল মতকে তাত্ত্বিকতার তত্ত্ব দিয়ে মোকাবেলা করার মত জ্ঞান আমার নেই। ব্যবহারিক প্রয়োগতত্ত্বই হচ্ছে আমার যৌক্তিকতা। বাস্তবতার নিরিখে তথ্য-তত্ত্ব উপস্থাপন করাই হচ্ছে আমার লিখনির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রবন্ধের পরবর্তী অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে আরও কিছু যোগ করবো। যা হোক আমি মনে করি মত-অভিমত থাকতেই পারে এবং তা দোষণীয় কিছু নয়। মত-অভিমত প্রকাশ করার নামই হচ্ছে গণতন্ত্র। মত-অভিমত প্রকাশের স্বাধীনতা সবার রয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত। এজন্য কারোর মত-অভিমতকে গলা টিপে ধ্বংস করা বা বাঁধাগ্রস্ত করা যায় না। আবার মত প্রকাশের স্বাধীনতাও যেন কারোর মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব না করে, বাঁধাগ্রস্ত না করে, সত্যকে আড়াল না করে, সরল বিষয়কে জটিল না করে তোলে, চলমান একটি সচলে ঐতিহ্যবাহী ধারাকে বাঁধাগ্রস্ত ও অসম্মান না করে সেদিকে সুক্ষ্মদৃষ্টি রাখা দরকার। আমার মনে হয় চাকমা হরফগুলোর ব্যবহার নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ এক্ষেত্রে কায্যকর ভূমিকা রাখতে বেশি সহায়ক হবে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ চাকমা হরফগুলো নিয়ে এযাবৎকালে যে ধরনের ব্যবহারবিধি, নিয়মনীতি, মত-অভিমত ব্যক্তি বিশেষে সৃষ্টি করা হয়েছে বা প্রকাশ করা হয়েছে অন্যান্য হরফগুলোর ক্ষেত্রে তার সিঁকিভাগও নজরে আসেনি। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, কোনোকিছুতে একমত হতে হলে আমাদের প্রচুর সময়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অনেকক্ষেত্রে একমত হতে পারি না। অযৌক্তিক হলেও নিজের অবস্থান থেকে কেউ সরে আসতে চায় না। এ ধরনের দৃষ্টান্ত বা পরিস্থিতি কি প্রমাণ করে না যে চাকমা হরফ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা খুবই বেশি ? এজন্য বলি যৌক্তিকতার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। যৌক্তিকতা না মানলে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যাবে না।
এবার নিজের অক্ষমতার কিছু কথা কই। স্বীকার করে নিই, ইতিহাস সে যে বিষয়েরই হোক না কেন তা আমার অতটা জানা নেই। আমার অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে প্রচণ্ড রকমের দুর্বলতার বিষয় এটি। শিক্ষাজীবনে আধাআধি বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আ্যাকাডেমিক পড়াশুনার অভ্যন্তরে ইতিহাস বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা দুষ্কর ছিল। অতি আগ্রহ ও যৎসামান্য লিখনকাজ সম্পাদনের নিমিত্তে যৎকিঞ্চিত যা পড়ি তাও ক’দিনের মধ্যে ভুলে যায়। পঠিত বিষয়গুলোকে পুনরায় খুঁটেখুঁটে দেখতে হয়। এবার বলুন-আলোচ্য বিষয়ে আমার দ্বারা উল্লেখযোগ্য কিছু সম্পাদন করা কি সম্ভব ? আদৌ নয়। নিজেকে যাচাই করে আমার যেটুকু আশাবাদ জন্মে তা দিয়ে নিজেই আশাবাদি হতে পারি না অধিকন্তু অন্যকে আশান্বিত করার মতো যোগ্যতা অর্জন করা এ জন্মে হবে না, প্রত্যাশা করাও অর্থহীন-বৃথাও বটে। যারা আমার লেখা পড়েন তারা বিষয়টিকে অনুধাবন করে থাকবেন নিশ্চয়। মূল কথা হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের অভাববোধ থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। এজন্য আমার কোনো কোনো লিখনিতে শুধুমাত্র বিষয়কে তুলে ধরার চেষ্টা করি। তুলে ধরার সক্ষমতাই হলো আমার যোগ্যতা। সেটির গভীরে গিয়ে আলোচনা করা সম্ভব হয় না। একটি উদারহণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করি। একবার ‘চাকমা হরফের সংখ্যা কত ?‘ শিরোনামে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলাম। প্রবন্ধটি চট্টগ্রামের প্রচারবহুল একটি দৈনিকে দু’কিস্তিতে ছাপা হয়েছিল। পরে স্থানীয় সংকলনে ছাপানোর জন্যও দিয়েছিলাম। অনুজপ্রতীম একজন আমাকে প্রশ্ন করেছিল- ‘দাদা, এ বিষয়ে আপনার মত কী ? উত্তরে বলেছিলাম-আমার কাজটিই হলো তুলে ধরা। যারা বিবেচক বা নীতিনির্ধারক তারাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। মাঝে মাঝে লিখতে লিখতে আটকে যায়। শুরু করতে হয় ঘাটাঘাটি। তখন অনুভব করি, আসলে ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করা বড্ড প্রয়োজন ছিল। ইতিহাস পাঠে যে আনন্দ সর্বোপরি ইতিহাস জানা অত্যাবশ্যক এটি এখন হারে হারে অনুভব করি। আমাদের ন্যায় অতিশয় সংখ্যালগিষ্টদের নিজেদের ইতিহাস জানা খুবই জরুরি। তাই বলে অ্যাকাডেমিক্যালি শুধুমাত্র ইতিহাস অধ্যয়ন করতে হবে সেটি বলছি না। অন্যান্য বিষয়ের সাথে ইতিহাস পাঠ বা অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম নানা দিক অবশ্যই জানা দরকার। মূল বিষয়ে দৃষ্টি ফেরা যাক।
অবস্থা দৃষ্টিতে মনে হয় যা অনেকে স্বীকারও করবেন যে, চাকমাদের হরফগুলোর ব্যবহার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। তার অর্থ এই-চাকমা হরফ জানা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিহাস বলে, চাকমাদের একশত বিশ বৎসর পূর্বেও নিজস্ব হরফ জানা লোকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে ছিল। কালে কালে তা তলানিতে এসে থামে। যাক বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে-আধুনিক প্রযুক্তিতে চাকমা হরফ ব্যবহার করা যায়। নিজস্ব হরফে অনেকে গল্প, কবিতা, ছড়া এবং ছোট-খাটো পত্রিকাও প্রকাশ করছেন। উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পরবর্তী ধারে ২০১৭ খ্রি. থেকে সরকারিভাবে চাকমা হরফে পাঠ্যবই প্রকাশ করা হচ্ছে। ফলাফল যা-ই আসুক না কেন আমরা নি:সন্দেহে বলতে পারি, চাকমা হরফগুলোর বিস্তৃতি ঘটছে। আমার বিশ্বাস, আলোচ্য কর্মকাণ্ডগুলোকে সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হলে ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে। কিন্তু হঠাশার বিষয় হচ্ছে-হরফগুলোর যত্রতত্র নিয়মবিহীন অযৌক্তিক ব্যবহার, নানাবিধ নিয়ম চালু করার প্রবণতা, হরফগুলোর আকৃতিগত বৈসাদৃশ্য, প্রচলিত নিয়মের পরিপন্থি মাজ্যাপাঠ-এর অপপ্রয়োগ, বানানে ভিন্নতা ইত্যাদি অপ্রত্যাশিত বিষয় চাকমা হরফগুলোর সহজ ব্যবহারকে জটিল করে তুলেছে। ফলশ্রুতিতে আশারবাণীর পাশাপাশি হঠাশারবাণীও আমাদের আঁকড়ে ধরে। বিকাশমান একটি বিষয়ে পজেটিভ বা নেগেটিভ থাকা অযৌক্তিক কিছু নয়। তবে চাকমাদের হরফগুলো নিয়ে যে ধরনের খাদ্য-অখাদ্য প্রায়শ নজরে আসে সেগুলিতে নেহায়েৎ নিজেকে তুলে ধরার বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পায়। অর্থাৎ মত-অভিমতের আড়ালে থাকে ব্যক্তির পাণ্ডিত্যকে উপস্থাপন করার সুপ্ত মনোবাসনা। মত এবং অভিমতের ভীড়ে আমাদের চাকমা হরফগুলোর প্রকৃত বৈশিষ্ট্যগুলো চাপা পড়ছে। খেয়াল করবেন, চাকমা ইতিহাসের কথা বলবো না অন্ততপক্ষে হরফগুলো নিয়ে যাচ্ছেটাই ঘটছে।
পৃথিবীতে হরফ বা বর্ণের সংখ্যা খুবই কম। সকল জাতির মধ্যে নিজস্ব হরফ নেই। এজন্য যাদের নিজস্ব হরফ আছে যেগুলো স্মরণাতীত সময় থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে তারা নি:সন্দেহে ভাগ্যবান। আবার এটিও পরীক্ষিত যে, বিদ্যমান হরফগুলোর মাধ্যমে একটি ভাষার সব ধ্বনি বা শব্দকে উচ্চারণ করা যায় না। বাকযন্ত্রের সাহায্যে যে অজস্র ধ্বনি সৃষ্টি করা যায় সেগুলিকে প্রকাশ করার জন্য অক্ষরের সংখ্যা একবারে অপ্রতুল। যার কারণে অনেক গবেষণা করে আইপিএ(IPA) সৃষ্টি করতে হয়েছে। নিজস্ব হরফ থাকায় চাকমারা নি:সন্দেহে ভাগ্যবান। ইতিপূর্বের প্রবন্ধে আমি হরফগুলোর প্রাচীনত্ব, ব্যবহারিক নানা দিক তুলে ধরেছি। আমরা জানি, অন্যান্য হরফের ন্যায় চাকমা হরফগুলোরও নিজস্ব কিছু স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো স্মরণাতীত সময় থেকে অনুসরণ করা হচ্ছে। অনেক স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো অন্য কোনো হরফে দেখা যায় না। যেমন-উবরতুল্যা, মাজ্যা, ডেইলভাঙ্যা ইত্যাদি। বলা হয় চাকমা হরফে বারমাত্রা ব্যবহার জানলে পুরোপুরি শিখন সম্পন্ন হয়ে যায়। অর্থাৎ যিনি জানেন তিনি বিশেষজ্ঞ লেভেলে উন্নিত হতে পারেন। কিন্তু বারমাত্রার প্রয়োগ আদৌ যুক্তিসম্পন্ন কি না তা বিচায্য বিষয়। কারণ পূর্বে যারা চাকমা হরফে লিখনকাজ করতেন তাদের মধ্যে ধ্বনি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। যে যার সুবিধামত হরফগুলো ব্যবহার করতেন। ব্যক্তি বিশেষে বানানের ভিন্নতা ছিল। এমন দেখা গেছে যে, কোনো একজন রচয়িতার লিখনি অন্য একজনের কাছে পাঠ করতে কষ্টকর হয়ে থাকে। এ অবস্থায় পূর্বের কোনো বানান বা চিহ্নকে অন্ধভাবে অনুসরণ করা কতটুকু যুক্তিসংগত হবে তা ভেবে দেখা উচিত। অধিকন্তু অতিরিক্ত চিহ্ন ব্যবহার থেকেও বিরত থাকা প্রয়োজন। শব্দের অর্থভেদে যদি বানানের ভিন্নতা খোঁজা হয় তাহলে অজস্র চিহ্ন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। যতসম্ভব সরল নিয়ম প্রচলন করা দরকার। পাশাপাশি চাকমা ধ্বনিগুলোকে সুনির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় আনতে না পারলে সমস্যা থেকেই যাবে। বিজ্ঞ অনেকের মতামত প্রত্যাশায় এখানে শেষ করছি।
-০-
লেখক-শুভ্র জ্যোতি চাকমা, রিসার্চ অফিসার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি।
shuvrachakma71@gmail.com


রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০

চাঙমা সাহিত্য বাহ্ শিল্পী গোষ্ঠী উদ্যোগে ১১ জন সংগীত শিল্পীরে সার্টিফিকেট দিয়্যা অইয়ে

দিঘীনালা এওজি: এচ্যে বিশ্ব আদিবাসী দিবস। চাঙমা সাহিত্য বাহ্ শিল্পী গোষ্ঠী উদ্যোগে চাঙমা সাহিত্য বাহ্ কাম ঘরত  সংগীত শিল্পীউনরে সার্টিফিকেট দেনা পোইদ্যানে এক্কো খলা জুগল গরা অয়্যা। এ খলাবোত নকবাচ্যা গরবা ইজেবে আহ্’জিল এল’ বোয়ালখালী ইউনিয়ন পরিষদর মানবলা চেয়ারম্যান সুনানু চয়ণ বিকাশ চাঙমাদাঘি। খলা নানু সুনানু ত্রিদিব কান্তি চাঙমা(জধানানু/সভাপতি, চাঙমা সাহিত্য বাহ্ শিল্পী গোষ্ঠী )  আ মুলক গরবা ইজেবে এলাক চাঙমা চাঙমা সাহিত্য বাহ্ শিল্পী গোষ্ঠী মানবলা সাবাঙ্গী, শিল্পী সুনানু  নোবেল চাঙমা আ চাঙমা সাহিত্য বাহ্ গরা কমিতি জধানানু ইনজেব চাঙমাদাঘি।

চাঙমা সাহিত্য বাহ্ শিল্পী গোষ্ঠীর সংগীত ইক্কুলত পল্যে(১ম) বঝর পাশ গচ্ছে ১১ জন সংগীত শিল্পীউনর আহ্’দত সার্টিফিকেট তুলি দিয়্যা বোয়ালখালী ইউনিয়ন পরিষদর মানবলা চেয়ারম্যান সুনানু চয়ণ বিকাশ চাঙমাদাঘি।

ইয়োত আর আহ্’জিল এলাক চাঙমা সাহিত্য বাহ্  কণ্ঠ শিল্পী সুনানু প্রত্যাশা চাঙমা, সুনানু লিটিনা চাঙমা আ নাজ’শিল্পী মেকি ত্রিপুরাদাঘি।


শনিবার, ৮ আগস্ট, ২০২০

চাঙমা সাহিত্য বাহ্ নুঅ গরা কমিতি আরা অয়্যা

 চাঙমা সাহিত্য বাহ্ ২০৫১ ভিশন পত্থমে গরিবাত্যা গেল্লে ০৮আগস্ট ২০২০ ইং রেত ০৮:০০ টায় চাঙমা সাহিত্য বাহ্ নীতিনির্ধারণী কমিতি চাঙমা সাহিত্য বাহ্ গরা কমিতি, সল্লাদার কমিতি, পাবলিসার্শ কমিতি ফগদাং গচ্ছে।তারার মেয়াদ ০৮-০৮-২০২০ -০৮-০৮-২০২২ ইং সং।

কোই যায়- গেল্লে ১৩ জুলাই ২০২০ইং কবি, লেঘিয়্যা জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন আলমগীররে সল্লাদার কমিতি বানা পোইদ্যানে সোসাল জগদত নানান কধা উদি এযে। সে পোইদ্যানে ১৭ জুলাই ২০২০ ইং বেল্যা মাধান তিনতা বাজি নীতিনির্ধাণী কমিতি চাঙমা সাহিত্য বাহ্ কামানি বন্ধ গরি দেয়। থিক ২১ দিন পর গেল্লে কেল্যা নুঅ কমিতি ফগদাঙ গরানা সমারে সমারে চাঙমা সাহিত্য বাহ্ বেক কাম গরিবার কোই অইয়ে।

সুনানু ইনজেব চাঙমারে জধানানু, সুনানু প্রজ্ঞা আলো তালুকদাররে দাঙর কাবিদ্যাঙ আ সুনানু রিমি চাঙমারে ভান্ডালি কাবিদ্যাং বানেনেই ১১ জনর সাবাঙ্গীদাঘিরে নিনেই নীতিনিধার্ণীয় কমিতি জধানানু সুনানু দেবপ্রিয় চাঙমা দস্তগে চাঙমা সাহিত্য বাহ্ ২০৫১ ভিশন পত্থমে গরিবাত্যা এ কমিতিবো বানা অইয়ে কধা কো কোইয়ে।

বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০২০

মানুষের জীবন মান উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো “পরিশ্রম ও সদাচারন”- চঞ্চল কান্তি চাঙমা

চঞ্চল কান্তি চাকমা
গ্রাম: কামুক্কো ছড়া, ইউনিয়ন: বোয়ালখালী, উপজেলা: দিঘীনালা, জেলা: খাগড়াছড়ি, পার্বত্য জেলা।
পিতা: মৃত নিরতা রঞ্জন চাঙমা, মা: সুনীতি বালা চাঙমা। ১৯৭৫ সালে এসএসসি পাশ করে দরিদ্র পরিবার পক্ষে পড়া-লেখা চালানো সম্ভব না হওয়াতে  ১৯৭৬ সালে ০১ জানুয়ারি কেপিএম চাকুরিতে যোগদান করেন। এর পর ১৯৭৯, ২০ ডিসেম্বর মহিলা অধিদপ্ত (রাঙ্গামটি) যোগদান করে সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৮ ইংরেজিতে অবসর গ্রহণ করেন।
প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ অবস্থান থেকে অন্যের মঙ্গলের জন্য চাইলেই কিছু করতে পারেন, এক্ষেত্রে ব্যক্তির সদিচ্ছাই যথেষ্ট। এই  কথাটি আরেকবার প্রমাণ করেছেন খাগঢ়াছড়ি পার্বত্য জেলার দিঘীনালা উপজেলার উত্তর কামুক্কোছড়া গ্রামের ৬১ বছর বয়সী চঞ্চল কান্তি চাকমা। সম্প্রতি হিসাবরক্ষক হিসেবে রাঙ্গামাটি জেলার মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে অবসর নিয়েছেন।
 চাকুরীজীবন থেকেই একটা ইচ্ছা ছিল অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার। চাকুরীর ব্যস্ততায় সবসময় সুযোগ করে ইঠতে পারেন নাই কিন্ত স্বপ্নকে লালন করেছেন সযত্নে। অবসর জীবনে প্রথমে শুরু
করলেন বাবা-মাকে সেবা দিয়ে। তাদের জন্য গড়ে তুললেন ‘অবসর ভবন’। কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি করলেন বয়স্ক ব্যক্তিদের শারীরিক এবং আর্থিক দুর্দশার কথা। তিনি দেখলেন, এই অসহায় মানুষদের চিকিৎসা করানোর সঙ্গতি নেই বা কোনো একটা প্রয়োজনীয় জিনিসও কেনার সামর্থ্য নেই।বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য কিছু করার ভাবনা থেকেই তিনি গড়ে তুললেন ‘পেনশন’ নামে একটি সংগঠন এবং নিজের অবসর ভাতা থেকে চালু করেন বয়স্ক ভাতা। ১ অক্টোবর ২০১৯ সালে দিঘীনালা উপজেলা ভবনে বিশ^ প্রবীণ দিবসে অংশগ্রহণ করে জনসক্ষে তার এই বয়স্ক ভাতা দেয়ার ঘোষণা দেন। চঞ্চল কান্তি চাকমা অন্যরাও যাতে উদ্ধুদ্ধ হন এবং প্রবীণদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। বর্তমানে প্রতিমাসে নিজের অবসর ভাতা বাবদ পাওয়া অর্থ থেকে ৫ জন প্রবীবণকে প্রতিমাসে ৫০০ টাকা করে (মোট ২৫০০ টাকা) তিনি প্রদান করছেন।
চঞ্চল কান্তি চাঙমা মনে করেন মানুষের জীবন মান উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো “পরিশ্রম ও সদাচারন”। চঞ্চল কান্তি চাঙমার এই মহতী প্রচেষ্টা ইতোমধ্যেই   দশব্যাপী বহুল প্রশংসিত হয়েছে। বিভিন্ন দৈনিক প্রত্রিকা তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান “ইত্যাদি” তাদের অনুষ্ঠানে চাঞ্চল কান্তি চাঙমাকে বিশেষ সম্মাননা ও ১ লাখ টাকা পুরস্কার প্রদান করেছেন এবং গত জানুয়ারি ১৪, ২০২০ ইংরেজি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট- ঢাকা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন “মানবাধিকার পদক” প্রদান করেন।
 
সরকারী চাকুরী জীবন শেষে পেনশনের টাকার শুধুমাত্র নিজের সুখের কথা চিন্তা না করে পেনশনের টাকা নিয়ে প্রবীণ অসহায় মানুয়ের পাশে দাঁড়ানোর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি মহৎ প্রচেষ্টা। 

সোমবার, ৩ আগস্ট, ২০২০

চাঙমা সাহিত্য বাহ্ পাবলিসার্শ উদ্যোগে চের দিনর ফটোগ্রাফি কামর কোর্স থুম

এক্কো দোল সামচ থিদব্বরিত্যাই চাঙমা সাহিত্য বাহ্ কুরি বঝর সং নানাঙ অনটনর সেরে সেরে নিআলচি গরি কাম গরি জার। চাঙমা সাহিত্য বাহ্ বিশ্চেচ গরে- আহ্’দে কলমে শিঘানা। সেনে এগানাগারে ১৬ বঝর সং অঝাপাত- ভাচ শিঘানা সমারে নানাঙ কাম আহ্’দত লোয়ে। সে নানাঙ কামর মধ্যে ফটোগ্রাফি এক্কান কাম। জনি দি’ দিন অয়। তবে পরেদি দোল সময়ত এক্কো দাঙর কোর্স গরা অভ’ ভিনেল নীতিনিধারণী কমিতি জধানানু দেব প্রিয় চাঙমা চাঙমা সাহিত্য পত্রিকারে কল’। সমারে চাঙমা সাহিত্য বাহ্’ত্তুন কোণা-ঘোণা ভিদিরে পুঅ/ছাউনরে তুলি আনিবার শিক্ষাবৃত্তি ২০২১ সালত্তুন চালু গরিবার আঝা আঘে ভিলে কল’।

গেল্লে ৩১ জুলাই আ ০১ আগস্ট ২০২০ খ্রিঃ দিঘীনালাত, ০২-০৩ আগস্ট পানছড়ি উপজেলাত দি’ দিন ফটোগ্রাফি কাম শিঘানা এচ্যে থুম অইয়ে।  

তবে চাঙমা সাহিত্য বাহ্ মনে গরে এ কামানি সম্ভর অহ্’র বেগর এজালে। চাঙমা সাহিত্য বাহ্ আঝা গরে মুজুঙে জে কন’ দিন বেক্কুনরে কায় পেব।  

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...