শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৯

র’ নেই


এত্থে এল এক বাম,
তেরোবো জাদর বজত্তি
সুগে-দুগে আলুল্লো দুলুল্লো দেঘি
তাগল ধারান্যা শিলয়্য যান গলি।

পত্তিক মোন-মুড়, পত্তিক ছড়া-গাঙ
সাজি আঘে এ্যাইল তারুম ঝার,
নানাঙ পেইক উবগীদ’ সুরে
চিগোন ছড়া দুধুুক গুজুরনিত
খুজিয়ে দি চোক ভিজি যায়।

পেইকর গীদর, দুধুুক গুজুরনি,
নাঙেল পিদিত গরুচরান্যা বাজি সুর,
বেল ধুবনি সাজন্যা অক্তত
পর্নিমা জুন’ পহ্’র সমার অই
চিঙে র’, খেংগরঙ র’ গুজুরি গুজুরি বেই যায়
এ মুড়ত্তুন অই মুড়ত।

সে র’ নেই ইক্যে! অলর,
গাঝ’ পাদায়্য ন’ লরে!
কি গরিবার আঘে? তারা দরে।
চোক পেলেহ্ পেলেহ্ চেই থানা বাদে।
বানা!
বানা, দুগে অগমানে
চোত মাজ্যা সনখোলা আঙানা সান
আঙি যায়, বানা আঙের
আঝা-সবন ভত্তি গোলা।






বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৯

ন’ কেমিবং



মুই এয’ সবন দেঘং অনসুর বুনঙ মাগরক’ সান
এক দিন আমি পরাধীনতাত্তুন সরান পেবং, পেবং এরান।
পেইক’ সান উড়ি ঘুড়ি বেড়েবং
চিদ’ সুগে মন’ সুগে-
ফুরোমোনত্তুন আলুটিলে, কেওক্রডঙত্তুন সিম্বুক মোন
চেঙে, মিঙিনি কাজালঙ, বরগাঙ আ ফেনি বাম।
দি আহ্’ধত যা বল আঘে
বুগত যা আঘে মনবল, সিআনলোই
কুত্তিঙ কাত্তিঙ গরিবং লুয়ো শিঙোল।
ছিনিবং পরধীনতা জাল।

এ লারেয়ত পিয়েরে ফুদ’ সান আহ্’দিবং
লাক লাক নুয়ো পিড়ি গাবুচ্যা আ গাভুরি ঝাক,
আনিবং জাদর এরান ছিনি
যেদক বেই যোক লো নালি।
ওক না পচা বাচ, হিল চাদিগাঙ
ওক না শবাশাল;
চিজি দাঘী খাদোক না মরা মাত্তুন দুত
ত্যুঅ ন’ কেমিবং
যেদক্কন ন’ পেবং সাধীনতা।

বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৯

জাদর কধা ভাবি

ছবিবো তুল্যা: চাঙমা নুয়ো জুম।
ও বাপ-ভেই মা-বোন লক!
কি বুঝর কিঝেনী তুমি?
কুত্তুরি নাত্তিরি, চুপে চুপে কধা,
মিলে কুত্তুরি ফেলেদি গম ভালেদি কধা ভাবি।
দেঘর দ’-
ছড়া-গাঙ কানের,
কানের মোন মুড়
রিঝেং জোরজুরি গীত ন’ শুনার
তারুম ঝার শীক ন’ কারের
বেঙগ’ মা বেঙগবি গেলাক কুধু।

মিলে কুত্তুরিলোই কোল বাজেলাক দেবানে দেবানে
ধুনি পেল্লোন বাইচ মুইজ’ চাঙমা,
পরর কু পাগত পুরি শান্তি বাহিনী ভাক অলাক
আহ্’রেলঙ জুম্ম জাদর পাত্থলি লারমা।
আমি দ’ এক্কো জাত, শাসক জাত
সিত্তেই লেখ্যা সতিশ চন্দ্র ঘোষ- “চাঙমা জাতি”
এ দরমর জাত এধক পিত্তোমরা অল’ কিত্তে?
খবর প’ ভেই লক?
বেক মিলে কুত্তুরি।
কুত্তুরি নাত্তিরি ফেলে দিই বেক মিলে কুত্তুরি
যে যেঙরি পারে কাম গরিবং কারর কুত্তুরি ন’ মাদি
অনসুর জাদর কধা ভাবি।

অবুচ মানেই


ও অবুচ মানেই, বুঝিবে কমলেে?
এধক দুক পর-
ত্যুঅ উচ ন’ বুঝে?
জাগা - জমি আহর’রেলে,
ভূই - সাগিন আহ্’রেলে,
রিদি সুদোম আহ্’রেলে,
আহ্’রেলে ভাচ-অঝাপাত আ
ঘর পাদা জাগা!
দানবর খেলাত
অনসুর তুই মিঝি থাচ
তরে সলং বদলে দিবার সে দানব
নানাঙ বেজে
নানাঙ ছলে
তরে খুজি রাঘেবার চার।
গীদে রেঙে রাঘেই ত’ সবনান
আহ্’রি নিবার চাই।
নানাঙ ভঙচমা কোই কোই
বিজয়গিরি, রাধামন, শেরমত্ত খা আ রুনু দেবান
খুচ মাজারা লগে দিবার চাই।
এম এন লারমা সবন ভাঙি দিবার
আমিজে তার কু-পেজা দেঘাই।
খুজি রাঘেই বার চার।
তুই কি খবর ন’ পাচ?
ত’ থেঙত তলে মাদি নেই?
খামা মাধাত কাজ্যে গাঝ’ সান
তরে রাঘেইয়্য।
এধক দুগর পর-
তুই কি তিনেঙ পালাঙ?
মরিবে না বাজিবে?
যুনি বাজিবার চাচ-
ত’ সবনান সুর অবার ন’ দিচ।
যুনি বাজিবার চাচ-
এম এন লারমা পদে আহ্’দিচ।
যুনি বাজি বার চাচ-
বিজয়গিরি আ রাধামন’ খুচ মাজারা তোগেচ।
যুনি বাজিবার চাচ-
শেরমত্ত খা আ রুনু দেবানর কুচ মাজারা তোগেচ।

বুধবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৯

দিন কাদাকাথ্যা

সাহিত্য তেম্মাঙ। লালন দা ঘরত।

পুগআগাজত রাঙা বেলান উদিব
পজিম মোনত বেল ছদক পরিহ্
সক্যে তেহ্,
বিঝু তরে-
মন খুলি, চিত খুলি
তল পেদত্তুন ছাগি তুলি কিজেক কারিম;
সাত নাল সুদোলোই বেরেহ্ রাঘেম,
সাত জাদি ফুল তুলি সাত ব্যান, সাত রেত
সং পুজি বিদেয় জানেম।


ইক্যে দদিন কাদাকাথ্যা
চেরো মেক্যে ঘুরঘুচ্যা কালা মেক
অনসুর আগাচ বোময়, পেরাক কারে
ঝালগা ঝলগা বোইয়ের
এক লেজাত্তুন এক লেজা দাঙর!
এ্যালুনি পেলুনি গরিদের হিল চাদিগাঙ।


অপজহ (অহংকারি) বর ব,
কনকিচ্ছু তান নমানের
মুজুঙত যিয়েন পায় সিনি নেযার
নেই আর মুই আগসান অলুঙ অনুসার (পশ্চাদপদ),
এধক্যে গরি কেনে লোম গজি তরে
বিঝু তুই এযরত ভিলে।


বিঝু!
তুই এযত মবুগত
কি আঘে মর ইক্যে!
বানা আঘঙ ছলঙান।
দেঘর দ’-
মরা থের থের গরি, দি এক্কান ধভুল কের বাদে
বার গরিবা কি আঘে?


বিঝু!
কি কোই বোঝেম তরে!
ভারদহনুমান্যা অদুঙ দেঘেদুঙ বুক সিরি,
আভাকবাক গরি, এ অট্টীযনা (জালাতন) বুক ভরন
দিঘিলেন সক্যে।
দুলু বাজর সীম সীম্যা দুলুগত ঘা
থেপ থেপ লো জুরি পরের
ইক্যে মুই-
আঘঙ!
আঘঙ!
আঘঙ মুই
কুল নেই সাগরক ভাজি ভাজি।
তুই এলে খুজি মনে
সিদু, পারঙ তরে লোবিয়ত গরি
সিত্যাই তুই যেলে পরসিদু?
তুই দসালেন দুলধচ্যা (দালাল), তুগুন বাচ?
না, না, না-
ত ধক সেধক্যে নয়!


সালেন কিত্তেই-
পৈনাল গরি আহ্দিলে রাজ পদে পদে
ধুলে দগরে বেড়র?
বুঝিলুঙ, বুঝিলুং-
ধক সেধক্যে নয়।
বেড়া যেলে বানা তুই,
সিত্তেই তরে দিঘি খুজি অই
ভিন জাদর সুদোমলোই ভিন জাদে গজি লদন।


যেক্কে উদিবপুগ আগাজ বেলান
সেক্যে তুই মবুগত ফিরি এইচ
ইক্যে মুই আঘঙ ভারি দিন কাদাকাথ্যাত।


ছবি: লুসি চাঙমা।


বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৯

আমনর আন্দাচ পাগলেয়্য বুজে



বিঝু,
চাঙমা জাদর এক্কো দিন বঝর শেজত এযত ফিরি 
কু কু কোগিল গীদ’ সুরে, 
কাত্তোল পাফোকর আ বিঝুর পেইকর দাগনিত
ভরি তুলি গাবুচ্যা-গাভুরির উব’ গীদে;
রাধামন, ধনপুদির সেই খেংগরঙর সুরে সুরে।
বিঝু,
তুই এযর খুজ’ র’ শুনিলে
আদামে আদামে গুরো-বুরোহ্, গাবুচ্যা-গাভুরি কন উলমত্ত
আদামর সেই বট গাজ’ ত’ বেইয়ে ধেলাত
ঘিলে লুদিলোই থাঙান দোলন
নাধেং, ঘিলে খারা অই তরে বিদেয় দ্যুন।
জগরা মাত্তলে
ঘরে ঘরে গীদে রেঙে
গুজুরি গুজুরি উদে খুয়োঙ।
সে দিন নেই ২০১৯ বিঝু,
কোগিল - কাত্তোল পাফোক আ বিঝুর পেইক
বুঝি যিয়োন, 
চাঙমা উন আঘঙ অগুর আন্দারত।
সিত্তেই কোগিল সুর নেই, 
নেই কাত্তোল পাফোকর আ বিঝুর পেইকর দাগনি!
ভাবি চ’ মানেই লক,
কি দিন চেলং
আ কি দিন পেলং
যিআন কন’ জন আঝা ন’ গরি।

শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৯

অস্ত্র কোনো নির্ধারক শক্তি নয়; নির্ধারক শক্তি হচ্ছে মানুষ। সংগঠিত জনগণ অ্যাটম বোমার চেয়েও শক্তিশালী। -- মাওসেতুং।


পার্বত্য শান্তিচুক্তি (২ ডিসেম্বর, ১৯৯৭) স্বাক্ষরের বছর তিনেক আগের কথা। পার্বত্য চট্টগ্রাম তখন দারুন যুদ্ধ-বিক্ষুব্ধ। সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাহাড়ি বিদ্রোহী গ্রুপ শান্তিবাহিনীর রক্তক্ষয়ী বন্দুকযুদ্ধ লেগেই আছে। সেনাবাহিনী তখন অপরেশন চালাচ্ছে দিনের বেলা, আর রাতের বেলা হানা দিচ্ছে গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনী। তাদের যুদ্ধ কৌশল: হিট অ্যান্ড রান!
পেশাদার সাংবাদিকতার শুরুতে আমি শান্তিবাহিনী প্রধান, গেরিলা নেতা সন্তু লারমার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়া সংকল্প প্রকাশ করি সে সময়ের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) নেতা প্রধীর তালুকদারসহ কয়েকজনের কাছে। শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতি গোপনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালালেও তাদেরই প্রকাশ্য সহযোগি সংগঠন হিসেবে পিসিপি তখন পাহাড়ে বেশ প্রভাবশালী। প্রধীর দা আমাকে জানান, দেশের 'নাম্বার ওয়ান ওয়ান্টেড পার্সনের' এমন সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা কঠিন হবে। তাছাড়া এতে জীবন ঝুঁকিও আছে বৈকি। তবে তিনি এর আয়োজন করার চেষ্টা করবেন।
একদিন ঢাকায় প্রধীর দা এসে দেখা করেন আমার তখনকার কর্মস্থল, বার্তা সংস্থা নিউজ অ্যান্ড ফিচার সার্ভিসের ধানমণ্ডির অফিসে। তিনি গোপনে আমাকে বলেন, লিডার (সন্তু লারমা) সাক্ষাৎকার দিতে রাজী হয়েছেন। ঢাকা থেকেই একজন গাইডের মাধ্যমে আমাকে সন্তু লারমার গেরিলা বাহিনীর হাইড আউটে পৌঁছে দেওয়া হবে। আমি যেনো যে কোনো সময় দুর্গম পাহাড় যাত্রার জন্য তৈরি থাকি। সেটি ১৯৯৪ সালের মে মাসের কথা।
এরপর যথা সময়ে ঢাকা থেকে পিসিপির কর্মী বিভাষ চাকমার গাইড নিয়ে কলাবাগান থেকে ‘ডলফিন’ পরিবহনের বাসে চেপে খাগড়াছড়ির পাহাড়ি গ্রাম প্যারাছাড়ায় আত্নগোপন করে থাকি। চারদিন পর শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে ‘ক্লিয়ারেন্স’ পাওয়া যায়। ৪ মে খুব ভোরে লক্কর-ঝক্কর ভাড়ার জিপ চাঁদের গাড়িতে করে রওনা দেই পানছড়িতে। সেখান থেকে বিভাষ বিদায় নেন। আমাকে পথ দেখান পানছড়ি কলেজের
পিসিপির কয়েকজন কর্মী। তারা পায়ে হাঁটা পথ ধরে কিছুদূর এগিয়ে দেওয়ার পর ছাতা বগলে, আধ-ময়লা শার্ট ও লুঙ্গী পরা একজন ত্রিপুরা ভাষী যুবক আমার গাইড হলেন।
তারপর ওই নতুন গাইডের নির্দেশ মতো ছাতা মাথায় মাইলের পর মাইল পাহাড়ি রাস্তা ধরে দ্রুত বেগে অবিরাম পথ চলা। কষ্টকর যাত্রার পুরোটা সময়টা ছাতা দিয়ে মাথা ঢেকে ক্যামোফ্লাজ করতে হয়; যেনো পাহাড়ের ওপর বসানো সেনাবাহিনী আর বিডিআর-এর ওয়াচ টাওয়ার থেকে দূরবীনে আমার অস্তিত্ব ধরা না পড়ে। এই কৌশলটিও আমাকে শেখান ওই ত্রিপুরা গাইড।
পথে একজন পাহাড়ির মাচাং ঘরে সামান্য সময়ের জন্য বিশ্রাম। সেখানে ঠাণ্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে পানি খেয়ে আমরা মিনিট দশেক জিরিয়ে নেই। কথা বলি গাইড যুবকটির সঙ্গে। মন পরীক্ষা জন্য তাকে প্রশ্ন করি, আচ্ছা, আপনারা জুম্মল্যান্ড (সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ পাহাড় আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা; তখন এটি ছিল শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতির প্রধানতম দাবি) প্রতিষ্ঠা করবেন কবে? জবাবে তিনি মুচকি হেসে বলেন, মাওসেতুং তো গেরিলা যুদ্ধের মহানায়ক, তাই না? তিনি কিন্তু কখনোই বলেননি, অমুক বছর চীনে রাষ্ট্র বিপ্লব হবে। রাজনীতিতে এ রকম আগাম দিনক্ষণ বলা যায় না।... গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত সাধারণ একজন গেরিলা যোদ্ধার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখে মনে মনে আমি চমকিত হই।
এরপর আবারো ক্লান্তি ঝেড়ে দ্রুত পায়ে হেটে চলা। একের পর এক পাহাড়, গ্রাম, ছড়া পার হতে থাকি আমরা । পাড়ি দেই লোগাং, পুচগাঙসহ নাম না জানা অসংখ্য পাহাড়ি জনপদ। মাঝে মাঝে পথের ধারে অপেক্ষমান সাদা পোষাকের শান্তিবাহিনীর সদস্যরা গাইডকে ‘ক্লিয়ারেন্স’ দেন।
হাঁটতে হাঁটতে পথে পড়ে এক গহিন খাদ। খাদটি পার হওয়ার জন্য এ পার-ওপার একটি মোটা গাছ ফেলা রয়েছে। সেটিই রেলিং-বিহীন সেতুর কাজ করছে। গাছের ওই সেতুটি আবার পিচ্ছিল কাদায় মাখামাখি হয়ে পথ ঝুঁকি আরো বেড়েছে। খাদের ভেতর উঁকি মেরে দেখি, অনেক নীচে একটি পাথুরে ছড়া বয়ে যাচ্ছে। পা পিছলে একবার সেখানে পড়লে আর রক্ষে নেই। সাত-পাঁচ ভাবতে আধ মিনিট সময় নিয়েছি কি নেইনি. গাইড আমাকে তাড়া দেন, দাদা, একটু জলদি করুন! সন্ধ্যার আগেই আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে! তবু আমার ইতস্ততা দেখে তিনি আর দেরি করেন না। কিছু বোঝার আগেই এক ঝটকায় তিনি আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে অবলীলায় খাদটি পার হয়ে যান।
তিনি বলেন, আমাদের সব ধরণের ট্রেনিং আছে। এছাড়া সন্ধ্যার আগেই আমাদের এসবি’র (শান্তিবাহিনী) ক্যাম্পে পৌঁছাতে হবে। সন্ধ্যা হলে আর পথ দেখা যাবে না। তখন টর্চ জ্বালানোও ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বিডিআর’রা জানে শান্তিবাহিনীর গতিপথ কোনগুলো। তখন হয়তো টর্চের আলো দেখেই কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই ওরা গুলি করতে শুরু করবে।
আরো কিছুটা এগিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে আমরা পৌঁছে যাই ভারত সীমান্তে শান্তিবাহিনীর সদর দফতর দুদুকছড়ায়। বনের ভেতর পাহাড়ি টিলায় অসংখ্য জলপাই রঙের তাঁবু ফেলে তৈরি হয়েছে গেরিলা ছাউনি। সেখানে দেখতে পাই, একে-৪৭, জি-থ্রি আর নানান রকম স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত জলপাই-সবুজ পোষাকের শান্তিবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন গাছের আড়ালে সতর্ক প্রহরায় রয়েছেন।
সাদা পোষাকে শান্তিবাহিনীর শীর্ষ স্থানীয় নেতা সুধাসিন্ধু খীসা এগিয়ে এসে আমাকে স্বাগত জানান। হেরিকেনের আলোয় হাতমুখ ধুয়ে একটি ছোট্ট তাঁবুর ভেতর আমরা বসি। সুধাসিন্ধু বাবু ফ্লাক্স খুলে কফি খেতে দেন। সঙ্গে পাহাড়ি কলা ও বিস্কুট। আপ্যায়নের জন্য আরো দেওয়া হয় এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট।
সুধাসিন্ধু খীসা বলেন, শুনেছি, আপনার চা-কফির খুব নেশা। আর আপনি গোল্ডলিফ সিগারেট খান। তাই জঙ্গলের ভেতর অনেক কষ্ট করে এসব যোগাড় করতে হয়েছে!
একটু পরে একজন শান্তিবাহিনীর সৈনিক এসে সেল্যুট করে তাকে চাকমা ভাষায় বলেন, ‘স্যার’ আসছেন।
বলা ভাল, এই ‘স্যার’ হচ্ছেন শান্তিবাহিনী প্রধান (ফিল্ড কমান্ডার) জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা। শান্তিবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত নেতা এমএন লারমা, সন্তু লারমা, সুধাসিন্ধু খীসাসহ শীর্ষ নেতারা সকলেই ছিলেন বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষক। শিক্ষকতা করার সময়েই তারা
শান্তিবাহিনী গঠন করে আত্নগোপনে চলে যান। শুরু করেন নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রাম। মাওসেতুং চিন্তাধারার অনুসারী শান্তিবাহিনীর লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য ছিল পাহাড়ে জুম্ম (পাহাড়ি) জাতির আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা। এ কারণেই শান্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধকে বলা হয়
‘মাস্টার্স রেভ্যুলিউশন’। আর সেই থেকে শীর্ষ নেতাদের ‘স্যার’ বলে অনুসারীরা সম্বোধন করেন। তবে সাধারণ অর্থে ‘স্যার’ বলতে সন্তু লারমাকেই বোঝায়।
খুবই সাদাসিদা পোষাকে বয়স্ক মতোন শুকনো গোছের একজন মানুষ আট-দশজন গেরিলা যোদ্ধা পরিবেষ্টিত হয়ে কাছে এগিয়ে আসেন। আমরা উঠে দাঁড়ালে তিনি হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে বলেন, আমিই সন্তু লারমা!...
সেদিন রাতে দূর্গম দুদুকছড়ার হাইড আউটে শান্তিবাহিনী প্রধান সন্তু লারমার সঙ্গে কুশল বিনিময় ছাড়া তেমন কথা হয়নি। লিডার বললেন, আপনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতো কষ্ট করে আমাদের ক্যাম্পে এসেছেন, আমি খুব খুশী হয়েছি। আপনার সঙ্গে কথা হবে কাল সকালে।
ওই রাতে সামান্য ভাত-মুরগির মাংসের তরকারি খেয়ে শুয়ে পড়ি। রাত্রিবাসের তাঁবুটিকে পাহারা দিচ্ছিলেন শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র যোদ্ধারা। শিশিরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে জলপাই রঙের মশারীর ছাদ ঘন সবুজ কাপড়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। নানান রকম রাত জাগা পাখি ও তক্ষকের বিচিত্র ডাক শুনতে শুনতে পথক্লান্তিতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে দ্রুত।...
একজন গেরিলা কমান্ডার এসে ফিসফিস করে বলেন, সেনাবাহিনী বা বিডিআর যদি আমাদের ক্যাম্প আক্রমণ করে, তাহলে আপনি ভয় পাবেন না। গোলাগুলি শুরু হলে আপনি শুধু মাটিতে শুয়ে থাকবেন। আমরা আপনাকে জীবন দিয়ে রক্ষা করবো।...
পরদিন (৫ মে) খুব ভোরে হাত-মুখ ধুয়ে চা-নাস্তা খেতে খেতে কথোপকথন হয় সন্তু লারমার সঙ্গে। দীর্ঘ সাক্ষৎকারটি লিখে নেওয়া হচ্ছিলো। লিডার টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করার অনুমতি দিলেন না। তাকে সহায়তা করছিলেন শান্তিবাহিনীর আরেক শীর্ষ নেতা রূপায়ন দেওয়ান।
কথোপকথনে সন্তু লারমা যা বললেন, তা অনেকটা এরকম:
কথায় কথায় আমাদের বলা হয়, আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিভেদপন্থী, রাষ্ট্রদ্রোহী-- ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু আমরা আসলে তা নই। আমরা এদেশের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী। আমাদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজগুলোতে নিয়মিত জাতীয় পতাকা উড়ানো হয়। গাওয়া হয় জাতীয় সংগীত। আমাদের স্কুল-কলেজেও একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালিত হয়। আর আমরা কোনোভাবেই ভারতের মদদপুষ্টও নই। আমার যুদ্ধ পরিচালনা করছি, এ দেশের সাধারণ পাহাড়ি মানুষের জনসমর্থন নিয়েই। তারাই আমাদের যুদ্ধের মূল শক্তি।
সন্তু লারমা জোর দিয়ে বলেন, আপনি গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখবেন, এ রকম কোনো যুদ্ধই কোনো একটি দেশের ওপর নির্ভর করে বা জনসমর্থন ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম করছি প্রায় দুই দশক! এটি খুব সাধারণ ব্যাপার নয়। আর দেখুন, জঙ্গলের জীবন অনেক কঠিন। আমরা তো কেউ শখ করে অস্ত্র হাতে তুলে নেইনি। এখানে রোমান্টিকতার কোনো প্রশ্নই আসে না!... এই যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্ত পথই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা বাধ্য হয়ে অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সশস্ত্র
গেরিলা যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছি। আমরা শান্তিকামী বলেই সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথও খোলা রেখেছি।
তিনি আরো বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। কিন্তু এখন এদেশেরই সেনাবাহিনী এদেশেরই পাহাড়ি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। এটি হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠিগুলোকে বুলেটে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য সেনা অপারেশন। সেখানে আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি না। আত্নরক্ষার অধিকার তো সকলেরই আছে, তাই না? আমরা আরো লড়ছি, পাহাড়ে আঞ্চলিক সায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে সাধারণ বাঙালিদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই।
বলা ভালো, এটিই ছিলো কোনো গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রথম সন্তু লারমার সাক্ষাৎকার।...
সাক্ষাৎকারটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে লিডারের সঙ্গে গেরিলা পরিবেষ্টিত হয়ে আমি কয়েকটি আলোকচিত্র তুলি। আমার পক্ষে ছবি তুলে দেন রূপায়ন দেওয়ান।
দুপুরে ভাত খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে আবারো পানছড়ি হয়ে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে যাত্রা। সন্তু লারমা কিছুটা পথ এগিয়ে দেন। বিদায় বেলায় বলেন, পারলে আমাদের কথা লিখবেন। কেউ আমাদের কথা বলে না!...
পরে ঢাকায় ফিরে আমি সন্তু লারমার সচিত্র সাক্ষাৎকারটি লিখি। সে সময় দৈনিক আজকের কাগজে ছবিসহ সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশিত হয়। ভারতীয় ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘ইন্ডিয়া টুডে’ একই সাক্ষাৎকারটি ছবিসহ ফলাও করে প্রকাশ করে। সাপ্তাহিক খবরের কাগজে দুই পর্বে ছাপা হয় গণমাধ্যমে দেওয়া গেরিলা নেতা সন্তু লারমার প্রথম সাক্ষাৎকারটির ইতিবৃত্ত। ফরাসী বার্তা সংস্থা এএফপি’র তৎকালীন বিশেষ সংবাদদাতা নাদিম কাদির সংস্থার পক্ষে সন্তু লারমার দুটি আলোকচিত্র চড়া দামে কিনে নেন।
[পুনর্লিখিত। ছবি: দুদুকছড়ায় গেরিলা নেতা সন্তু লারমার হাইড আউটে, ৫ মে ১৯৯৪, লেখক, বিপ্লব রহমান] (সেই ৮০-৯০ দশকের শান্তিবাহিনী পাহাড় আর একটি বার দেখতে চাই)
জুম্ম

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...