বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০

নির্বাচনী ইশতেহার ও আদিবাসী: মঙ্গল কুমার চাকমা

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮



নির্বাচনী ইশতেহার ও আদিবাসী
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো একে একে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনী ইশতেহার অনেকাংশে একটা কাগুজে দলিল হলেও জাতীয় নির্বাচনকালে এর গুরুত্বকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। বলাবাহুল্য, নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন দল বা বিরোধী দল অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি প্রতিপালনে আশানুরূপ আগ্রহ দেখায় না। তবুও জাতীয় নির্বাচন এলে আপামর দেশবাসীর সঙ্গে আদিবাসীরাও রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করে থাকে।
ক্ষমতাসীন দলের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়, 'লক্ষ্য ও পরিকল্পনা'র মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ নেই। পার্বত্য চুক্তির ২১ বছরের মাথায় চুক্তি স্বাক্ষরকারী একটি দলের ইশতেহারে চুক্তি বাস্তবায়নের ইস্যুটি না থাকার বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবতা হচ্ছে তাই। এর মধ্য দিয়ে 'এ সরকার আর চুক্তি বাস্তবায়ন করবে না' বলে সন্তু লারমার যে আশঙ্কা- তা অনেকটা প্রমাণিত হতে বসেছে; বলা যেতে পারে। অপরদিকে 'সাফল্য ও অর্জন' অংশে 'পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে চুক্তির বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদের নিকট ন্যস্ত করা হয়েছে' এবং 'ক্ষমতায়নের এই ধারা চুক্তির শর্তানুযায়ী অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে' বলে উল্লেখ রয়েছে। অথচ এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, এসব পরিষদে এখনও সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ স্বশাসনের অনেক বিষয় ও কার্যক্রম এখনও ন্যস্ত করা হয়নি। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, চুক্তির পর ২১ বছর ধরে এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন কাজ আগের মতো বিগত ১০ বছরেও সরকার সম্পূর্ণভাবে ঝুলিয়ে রাখে।
বিগত এক দশক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে সরকার তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে কতিপয় বিষয় ও কর্ম হস্তান্তর, ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার, ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণ, ২০১৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন ইত্যাদি বিষয় বাস্তবায়ন করলেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিপূর্বক আদিবাসীদের বেহাত হওয়া ভূমি ফেরতদান, ভূমি ইজারা বাতিল, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণপূর্বক পুনর্বাসন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ, চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য জাতীয় ও বিশেষ আইন সংশোধন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলার বাঙালিদের যথাযথ পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয় বাস্তবায়নের কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি।
বিগত এক যুগ ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকা অন্যতম দল বিএনপির ইশতেহারে 'ক্ষুুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়' শিরোনামে দুটি লক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলো হলো- 'পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন, সম্পদ, সল্ফ্ভ্রম ও মর্যাদা সুরক্ষা করা হবে। অনগ্রসর পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে সব সুবিধা এবং পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করা হবে।' এবং 'দল, মত, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল জাতি গোষ্ঠীর সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মকর্মের অধিকার এবং জীবন, সল্ফ্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে। এই লক্ষ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।'
আগের মতো এবারের ইশতেহারেও বিএনপি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, সমতলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকারের মূল বিষয়গুলো সযত্নে এড়িয়ে গেছে। এ থেকে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আদিবাসী জাতিগুলোর সমস্যার প্রধান দিকগুলো, যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও সমতলের আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান, সর্বোপরি আদিবাসী ভূমি সমস্যা সমাধানে বিএনপি একেবারেই অনাগ্রহী। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করেছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে পার্বত্য চুক্তি বাতিল করবে মর্মে ১৯৯৭ সালে চুক্তি স্বাক্ষরকালে বিএনপি ঘোষণা করলেও ২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে বিএনপি অবশ্য পার্বত্য চুক্তি বাতিল করেনি। 'জেলা ও উপজেলা যুব উন্নয়ন কার্যালয়' রাঙামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং চারদলীয় জোট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে নানাভাবে ক্ষুণ্ণ করে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে '২৭. ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' শিরোনামে উল্লেখ করা হয়, 'সংখ্যালঘুদের মানবিক মর্যাদা, অধিকার, নিরাপত্তা এবং সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় নূ্যনতম ঘাটতি খুব গুরুত্বের সাথে নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোনো রকম হামলার বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। পাহাড় এবং সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের সংস্কৃতি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা হবে।'
সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোনো রকম হামলার বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের লক্ষ্য নিঃসন্দেহে ইতিবাচক বলে বিবেচনা করা যায়। তবে নির্বাচনী ইশতেহারের বয়ান থেকে এটা বলা যেতে পারে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও দেশের আদিবাসীদের সমস্যাকে কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতে আগ্রহী।
জাতীয় পার্টির (এরশাদ) ১৮ দফা নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসী বা ক্ষুুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নামে পৃথক কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। তবে 'ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা' শিরোনামে ১৮তম দফায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ৩০টি আসন সংরক্ষণ, চাকরি ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ, সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় ও কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টির ইশতেহারেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও আদিবাসীদের অন্যতম প্রধান সমস্যা ভূমি সমস্যার বিষয়টি উল্লেখ নেই। বরাবরের মতো জাতীয় পার্টির ইশতেহারের অন্যতম স্বাতন্ত্র্য বিষয় হচ্ছে, দেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং ফেডারেল সরকার। প্রাদেশিক ব্যবস্থায় এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে নিয়ে পৃথক একটি প্রদেশের প্রস্তাব থাকলেও পরে তা তুলে দেওয়া হয়। এবারের ইশতেহারেও সেই প্রস্তাব পুনর্বহাল করা হয়নি।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের ইশতেহারে '১৮. বিভিন্ন জাতিসত্তা, আদিবাসী সমাজ ও দলিতদের যথাযথ স্বীকৃতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা' শিরোনামে আদিবাসী হিসেবে বিভিন্ন জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের অনুস্বাক্ষর; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে আদিবাসীদের জমি ফেরত দেওয়া, পর্যায়ক্রমে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারসহ পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন; সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠন ও খাস জমি বণ্টনে তাদেরকে অগ্রাধিকার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের এই ইশতেহারে মোটামুটি আদিবাসীদের সমস্যার মৌলিক ইস্যুগুলো সমাধানের প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে; বলা যেতে পারে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পাহাড়ে প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের শোষণ নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা ইত্যাদি বিষয় অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর বলে প্রতীয়মান।
এ ছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির 'ভিশন-মুক্তিযুদ্ধ ৭১' নামে ইশতেহারে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, মাতৃভাষায় শিক্ষা, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, অন্যায়-অবিচার বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। একই ধারায় ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিও ইশতেহার ঘোষণা করেছে।
এবারের নির্বাচনী ইশতেহারগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন, সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ইত্যাদি নতুন প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছে। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং আদিবাসী ও সংখ্যালঘু অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রগতি বলা যায়। তবে আদিবাসীসহ সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার পরিষদগুলোয় আসন সংরক্ষণের বিষয়টি জাতীয় পার্টি ব্যতীত অন্য কোনো দলের ইশতেহারে ঠাঁই পায়নি।
তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন?

বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর- আবেদন পত্র গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী ...