পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রাম সম্পর্কে পশ্চিম বাংলায় চেতনা জাগ্রত করতে হবে: কলকাতা সেমিনারে তথাগত রায়
হিল ভয়েস, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: “আপনারা আপনাদের সংগ্রাম করুন। এই সংগ্রামে কিন্তু ভারতকে সামিল হতে হলে পশ্চিম বাংলায় এ সম্বন্ধে চেতনা জাগ্রত করতে হবে।” কলকাতা সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে এই কথা বলেন ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায়।
‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামীকরণ বন্ধ কর’- শ্লোগানকে সামনে রেখে ক্যাম্পেইন অ্যাগেনস্ট অ্যাট্রোসিটিস অন মাইনরিটি ইন বাংলাদেশ (ক্যাম্ব) ও অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্টের যৌথ উদ্যোগে আজ শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) অপরাহ্ন ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত “মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন” বিষয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার ফাইন আর্টস একাডেমিতে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন ক্যাম্ব-এর ড: মোহিত রায় এবং সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্টের জয়েন্ট কনভেনার সুজিত শিকদার।
সম্মেলনে বক্তব্য রাখনে ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায়, বার্ক-এর প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. যিষ্ণু বসু, সিএইচটি পিস ক্যাম্পেইন গ্রুপের করুণালংকার ভিক্ষু প্রমুখ। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল কমিটির সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম কুমার চক্রবর্তী সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।
সাবেক রাজ্যপাল তথাগত রায় বলেন, বাঙালিরা পৃথিবীর সমস্ত জিনিস নিয়ে ভাবে। ভিয়েতনাম, কিউবা, নিকারাগুয়া, গাজা- কত রকম জিনিস নিয়ে আমরা ভাবি! শুধু আমাদের নিকটতম যারা আত্মীয়, অর্থাৎ বাংলাদেশের যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ হিন্দু বাঙালি এবং অন্য যারা আছেন, যাদের জন্য আজকের এই সেমিনার আয়োজিত হয়েছে, অর্থাৎ চাকমা এবং অন্যান্য জনজাতি রয়েছেন, এদের সম্পর্কে আমরা কম জানি। কিউবা থেকে আরম্ভ করে এত দেশের লোকেদের সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চিন্তায় ঘুম নেই, চুলচেরা বিশ্লেষণ, অথচ তাদের নিকটতম আত্মীয়- এদের সম্পর্কে কোনো চিন্তাই নেই।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই। আমি সাধারণভাবে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ এবং অবিভক্ত বাংলা, এর আগে ব্রিটিশ বিদায় নেবার আগে অবিভক্ত বাংলার যে লাইন মার্কস আছে, সেই লাইন মার্কসের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, অর্থাৎ হিন্দু এবং তার সঙ্গে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- এদের সম্বন্ধে একটু পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি। মূল বিষয় হচ্ছে এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চেতনা জাগ্রত করতে হবে। তিনি বলেন, আপনারা অতীত ভুলবেন না, আপনারা যদি অতীত ভুলে যান তাহলে আপনারা আবার সেই যন্ত্রণা ভোগ করবেন।
সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের পরিবর্তে সরকার অতি সুক্ষ্ম কৌশলে রোহিঙ্গাসহ সমতল জেলাগুলো থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী বসতি প্রদান করে চলেছে। মুসলিম সেটেলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসনের পরিবর্তে সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ করে জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখলে মদদ দেয়া হচ্ছে। আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে এখনো সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো হস্তান্তর করা হয়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিগত ২৬ বছরেও এসব পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের স্বশাসন ব্যবস্থা এখনো যথাযথভাবে গড়ে উঠেনি।
শ্রী তালুকদার আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ তথা অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে সুরক্ষা দিতে হলে জুম্ম জনগণকে পার্বত্য চট্টগ্রামে টিকে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ দেয়া; পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুটিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে তুলে ধরার মাধ্যমে জনমত গঠন করা ও সারাবিশ্বে প্রচার ও জনমত গঠনের কাজ জোরদার করা এবং জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করার প্রস্তাব রাখেন।
ঢাবি শিক্ষক ড: মেসবাহ কামাল বলেন, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বর্তমান সরকার। আজ তারা ক্ষমতায়, কিন্তু ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি। চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় ৯২,৫০০ পরিবার মানুষ তাদের নিজেদের জায়গায় ফিরে যেতে পারেনি। আমি মনে করি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীদের সংগ্রামও অত্যন্ত ন্যায্য সংগ্রাম। কারণ বাঙালিদের সংগ্রাম যদি ন্যায্য হয়ে থাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রামও ন্যায্য। বাঙালি তার ন্যায্য অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছিল যুদ্ধ করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণেরও তার আত্মপরিচয়ের অধিকার ন্যায্য অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে বলেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী, এটা একেবারে ডাহা মিথ্যা কথা।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতি কখনো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়নি। তারা চেয়েছিল সংবিধানের মধ্যে তাদেরকে একটু জায়াগা দেওয়া। বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যে তাদেরকে জায়গা দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে দেশের জনগণ সবাই বাঙালি। এমনকি বাংলাদেশের মধ্যে বসবাসরত ৫০টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে নাম দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। বাংলাদেশ সরকার সমতল থেকে ৫ লক্ষ বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়ে সেখানে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করাতে লাগল। সেই বাঙালিদের দিয়ে স্থানীয় পাহাড়িদের উপর হামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং জমি দখল করতে লাগল। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ কী করবে, জীবন বাঁচানোর জন্য তখন সেদিন প্রতিরোধে নেমেছে এবং জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিরোধ, নিজের আত্মপরিচয়কে রক্ষার জন্য প্রতিরোধ ন্যায়সঙ্গত। যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত হয় তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের যুদ্ধও ন্যায়সঙ্গত।
ড. যিষ্ণু বসু বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম যদি সত্যিই তার স্বকীয়তা হারায়, তার মানে এটা ইসলামী মৌলবাদের আখড়ায় পরিণত হবে। তাহলে এই উপমহাদেশের সুরক্ষার ক্ষেত্রে বিপদ ডেকে আনবে। ভারতবর্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অরুণাচলে এবং অন্যান্য জায়গাতে যারা এসেছেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। একটা মানুষ তার জাতির প্রতি অন্যায় ও অন্যায্য আচরণ কখনোই মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে পারে না বলেই তারা প্রতিবাদ করে, আন্দোলন করে।
তিনি আরো বলেন, আজকে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তখন মনের ভেতরে ভয় কাজ করে। এতক্ষণ পর্যন্ত ঊষাতন বাবু তার বক্তব্যে তাদের মা-বোনদের উপর নিদারুন অত্যাচারের কথা বলেছেন তা ভাষায় বলার নয়। আমার জানা মতে ইংরেজ শাসনামল থেকে তাদের খ্রীস্টান ধর্মে ধর্মান্তর করার চেষ্টা করা হলেও তাদের খুব কম সংখ্যক লোককে ধর্মান্তর করা সম্ভব হয়েছে। কতটা নিজের জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, সংস্কৃতি মনের গভীরে গ্রোথিত রয়েছে, ভালবাসা রয়েছে সেটা তা বোঝা যায়। বাংলা বাংলাভাষি মানুষ যদি মনে করে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই চুক্তিকে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, তাহলে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সেই বিষয়ে সমর্থন প্রকাশ করা প্রয়োজন। রাস্তায় নেমে আমাদের সংগঠিতভাবে এই কথা বলতে হবে, সেই দিন আজকে এসেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির গৌতম দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ভূমি কমিশন কাজ করার জন্য যে বিধিমালাটা দরকার, এখনো পর্যন্ত সেই বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ আটকে আছে। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য টাস্ক ফোর্স করা হয়েছে। ১২ হাজার পরিবার ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী এবং ৯০ হাজার পরিবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু রয়েছেন। ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার পরিবারের মধ্যে ৯ হাজার পরিবারকে তাদের ভূমি ফেরত দেয়া হয়নি। ৯০ হাজার পরিবারের কাউকে এখনো পুনর্বাসন করা হয়নি, কোন রেশনও দেয়া হচ্ছে না। অথচ সামরিক শাসনামলে আমাদেরকে ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সংখ্যালঘু করার জন্য বাইরে থেকে যে বাঙালি মুসলমানদের পার্বত্য চট্টগ্রামে আনা হয়েছে তাদেরকে এখনো পর্যন্ত রেশন দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন তো হচ্ছেই না, বরং সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে। পর্যটনের নামে জুম্মদের ভূমি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। সীমান্ত সড়ক দিয়ে জুম্মদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
নির্ধারিত আলোচকদের আলোচনা শেষে সাংবাদিক ও অংশগ্রহণকারী অনেকে মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এসময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে গৌতম দেওয়ান ও মেসবাহ কামাল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। সম্মেলনে প্রায় ১৫০ জনের মতো লোক অংশগ্রহণ করেছেন বলে আয়োজক সূত্রে জানা গেছে।
১৯৪৭ সালের আগে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক আইডেন্টিটি একই ছিল। আমাদের এই তিনটি দেশের কালচারও একই। ইতিহাস একই। জিওগ্রাফি এবং ক্লাইমেট একই। এসব অনেক কিছুতে মিল থাকার পরও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত অনেক কিছুতে (যেমন, সম্প্রতি চন্দ্রযান উৎক্ষেপণ) সফল হচ্ছে। কিন্ত, আমরা পারছি না কেন? Multivariate Perspective থেকে এই একটি প্রশ্নের অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে। অনেক Variable নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা যেতে পারে, যদিও আমি Institutionalist Perspective থেকে আলোচনাটা সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।
এক
পড়ে নিতে পারেন Why Nations Fail: The Origin of Power, Prosperity and Poverty বইটি। এই বইয়ের মূল আর্গুমেন্ট হল একটি দেশের উন্নতি নির্ভর করে শক্তিশালী Political Institutions এবং Economic Institutions গড়ে তোলার উপর। এজন্য একটি দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন “Institution, Institution, Institution”। Daron Acemoglu এবং James A. Robinson-দের এই আর্গুমেন্টের উপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে, ভারত উপমহাদেশের এই তিনটি দেশ সমানভাবে Institution Building করতে পারেনি। যার ফলে এই তিন দেশের বিভিন্ন সেক্টরে অগ্রগতির ক্ষেত্রে তারতম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ, ভারত অনেক ক্ষেত্রে Institution Building করতে পেরেছে। যেটা বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে সম্ভব হয়নি। যেমন ধরুন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে বারবার সেনাশাসন ফিরে এসেছে। আর ভারতে কি জেনারেলরা ক্ষমতা দখল করেছে? এই একটি উদাহরণ কি প্রমাণ করে না আমাদের Political Institution Building কেন ব্যর্থ হয়েছে?
দুই
একটি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে ভারতে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ পি জে আব্দুল কালাম হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। একজন আদিবাসী নারী দ্রুপুদী মুরমু শক্তিশালী ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি। ভাদনগর রেল স্টেশনের একজন চা দোকানের মালিকের ছেলে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এটা কি প্রমাণ করে না সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে যে কেউ মেধা থাকলে সরকার প্রধান হয়ে ভারতকে নেতৃত্বে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে? আর বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণ করে কে? Political Dynasty, তাই না? একজন চা দোকানের মালিকের সন্তান, একজন রিকশাওয়ালার সন্তান, একজন সাধারণ কৃষকের সন্তান এবং একজন আদিবাসী পরিবারের সন্তান কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে? কিন্ত এটা ভারতে সম্ভব হয়। অস্ট্রেলিয়াতে সম্ভব হয়। বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রে সম্ভব হয়। কেন হয়? এসব দেশে পলিটিক্যাল লিডারশীপ নির্ধারণ হয় কোয়ালিটি দেখে। আর আমরা ফোকাস করি Political Dynasty উপর। বুঝতে পারছেন, বাংলাদেশে Political Institution Building হচ্ছে না কেন? তাই, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত অনেক কিছুতে সফল হলেও আমরা কেন পারছি না তার মূলে আছে আমাদের Institution Building-এর ব্যর্থতা।
তিন
আরেকটু পিছনে ফিরে যায়। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা গ্রহণের আগে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন শিখ পরিবারের সন্তান ডঃ মনমোহন সিং। বাংলাদেশে কি এটা সম্ভব হতে পারে? ডঃ মনমোহন সিং পড়ালেখা করেছেন পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি এবং ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে। ভারতের অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পিএইচডি শেষ করে তার কর্মস্থল পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসিবে যোগদান করেন। কাজ করেছেন জাতিসংঘেও। অধ্যাপক হিসিবে পড়িয়েছেন দিল্লি ইউনিভার্সিটির দিল্লি স্কুল অব ইকোনোমিকস-এ। এরকম একজন প্রথিতযশা এবং প্রজ্ঞাবান একাডেমিশিয়ান ভারত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন। যেমন, সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর, পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান, Ministry of Finance-এর সচিব এবং ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান। আর বাংলাদেশে কি এটা ২০২৩ সালে সম্ভব হবে? সর্বশেষ নবম পে-স্কেলটা দেখুন। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে কিভাবে নিচে নামিয়েছে? এসব করে কি দেশের কোন লাভ হচ্ছে? Institution Building করতে হলে তো আপনাকে Right person in right place-এ নিয়োগ দিতে হবে। এই Institution Building-এ সফল হতে হলে ভারতের মত নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিশিয়ানদের থেকে আসতে পারে। আমাদের ক্যাডার সার্ভিস থেকে আসতে পারে। স্কুল এবং কলেজ শিক্ষকদের থেকে আসতে পারে। চিকিৎসকদের থেকে আসতে পারে। প্রকৌশলীদের থেকে আসতে পারে। It should be open, merit-based, and competitive।
মনে রাখতে হবে, সবায় তো আর ক্যাডার সার্ভিসের পরীক্ষা দেয় না। ধরুন, বাংলাদেশের যে ছেলেটি অথবা মেয়েটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। সে তো আর বিসিএস দেবে না। কিন্ত দেশের উন্নয়নে তো তার মেধা এবং স্কিল ব্যবহার করার প্রয়োজন আছে। তাকে সেই সুযোগ দেশকে দিতে হবে। যেটা ভারত করেছে। যেমন, ডঃ মনমোহন সিং তো আর ভারতের সিভিল সার্ভিসের ক্যাডার থেকে আসেনি। কিন্ত তিনি ভারতের Ministry of Finance-এর সচিব ছিলেন। আরকটি উদাহরণ যোগ করি। Gideon Rachman- এর লেখা “The Age of the Strongman: How the Cult of Leader Threatens Democracy around the World” বইটি পড়তে গিয়ে দেখলাম সেখানে Modi – Strongman Politics in the World’s Largest Democracy (2014) শিরোনামে একটি চ্যাপ্টার আছে। এই চ্যাপ্টারের ৭৯ পৃষ্টায় গিয়ে আমার চোখ আটকে যায়। ২০১৩-২০১৬ সময়ে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর হিসিবে দায়িত্ব পালন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Raghuram Rajan। আরও দেখতে পারেন ভারতের Asoka University ওয়েবসাইটটি। কি মানের শিক্ষক এখানে গবেষণা এবং পাঠদান করে? কিভাবে ভারত Institution Building করেছে তা বুঝানোর জন্য এসব উদাহরণ টানলাম। তাই, তাদের চন্দ্রযান চাঁদের মাটি স্পর্শ করবে তাতে অবাক হওয়ার কি আছে?
চার
বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে দরকার “Institution, Institution, Institution”। এই যে দেশের শেয়ার বাজার, ডিমের বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আমলাতন্ত্র, নির্বাচন এবং পার্লামেন্ট কোন কিছুই Effectively কাজ করছে না। কোন জায়গাতে জবাবদিহিতা নেই। স্বচ্ছতা নেই। সব কিছুই Politicised হয়ে গেছে। এসবে ফোকাস না করে ভারতের চন্দ্রযান-৩ নিয়ে আলোচনা করার দরকার আছে কি?
পথভ্রষ্ট-দিকভ্রান্ত-আত্মভোলা-ভোগবাদী জুম্ম সমাজকে নিকট অতীতের ইতিহাস স্মরণ করে দিতে চায়। এই প্রজন্মের অনেকে হয়তোবা জানেন না, ১৯৭৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান কেন এই পদক্ষেপ নিয়েছিল? আগে সহজ উত্তরটা দিয়ে দিই। পিসিজেএসএসের নেতৃত্বে জুম্মদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সশস্ত্র সংগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী অনেকগুলো কাউণ্টার ইন্সারজেন্সির কৌশল নিয়েছিল। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড একটি।
১৯৮৯ সালে সৈয়দ আজিজ আল আহসান এবং ভুমিত্র চাকমা “Problem of National Integration in Bangladesh: The Chittagong Hill Tracts” শিরোনামে একটি আর্টিকেল Asian Survey-তে প্রকাশ করেছিলেন। এই দুজন গবেষক ৯৬৯ পৃষ্টায় এম কিউ জামান এবং সুধীন কুমার চাকমার গবেষণার রেফারেন্স দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড যে জুম্মদের বিরুদ্ধে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর একটি ষড়যন্ত্র ছিল তা বলার চেষ্টা করেছেন।
“Sidetracking the political aspects, successive governments identified the problem of the Hill Tracts either as economic or as an issue of law and order. Accordingly, the Chittagong Hill Tracts Development Board was established in 1976 to attack the problem through economic means. An officer of the Chittagong Division of the Bangladesh army was made chairman of the Development Board, which undertook some projects such as construction of roads and highways and organization of cooperative farming for the tribal people. But the tribals had reservations about these projects; they considered the roads to have been strategically built for easy military movement and the so-called cooperative farming or "model village" projects as a tactic to bring tribal people together into "concentration camps." In a survey it was found that 87.9% of the tribal respondents were suspicious of the government's economic development plans and projects. They did not believe that these would change their lot but rather would facilitate the influx of outsiders.”
২০০২ সালে জোবাইদা নাসরীন এবং মাসাহিকো টগোয়া “Politics of Development: ‘Pahari-Bangali Discourse in the Chittagong Hill Tracts” শিরোনামে Journal of International Development and Cooperation থেকে একটি গবেষণা প্রবন্ধ পাবলিশ করেন। এই গবেষণা প্রবন্ধের ১০৪ পৃষ্টায় এই দুজন গবেষক পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড যে তৎকালীন সরকারের জুম্মবিরোধী একটি কৌশল ছিল তা বর্ণনা করতে গিয়ে Wolfgang Mey-এর লিখিত Genocide in the Chittagong Hill Tracts, Bangladesh থেকে নিচের অংশটুকু তুলে ধরেন।
“The CHTDB was established in 1976 by the late president Ziaur Rahman to fight the Shanti Bahini. It is a purely political organization to bribe the tribal. Loans are given for private purpose, to business and tribal leaders. They are showpieces of the Government. Yes, it is mostly apolitical bribe to tribal leaders to buy them off so that they would not help the Shanti Bahini’ (Mey: 1991).”
বুঝতে পারছেন, কেন তৎকালীন সরকার এই কৌশল হাতে নিতে হয়েছিল? উদ্দেশ্য একটাই, জুম্মদের শিক্ষিত অংশকে কিনে নিয়ে জুম্ম সমাজের ঐক্যে ফাটল ধরানো এবং সমাজের অগ্রসর অংশটিকে আন্দোলন বিমুখ করা। সোজা কথায়, “ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি”।
২০২৩ সালে এসে এরকম একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টির ইতিহাস জুম্মরা এত সহজে ভুলে গেল? এতই আত্মভোলা জুম্মরা? তাই, এই নিপীড়িত মানুষদের সমাজে ইতিহাস অধ্যয়ন এবং দর্শন চর্চা জরুরী হয়ে পড়েছে। অন্যথায়, পাহাড়ে আপনার কষ্টার্জিত সুদর্শন অট্টালিকাটা ঠিকই আছে, কিন্ত আপনার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেশের সমতলের পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িগুলো দেখলে অভাগা জুম্মদের বিকাশমান পুঁজিবাদী শ্রেণীর কথা মনে পড়ে। আর আমার অবুঝ মনে প্রশ্ন জাগে, এই দুলো দরিয়ে রাজনীতি বিমখু শ্রেণীকেও কি একই ভাগ্য বরণ করতে হবে? বিশ্বাস হচ্ছে না? সর্বশেষ জরিপটা দেখুন না, বিগত ১৫/২০ বছরে কত পারসেণ্টে চলে এসেছেন?
এটাও যুক্ত করতে চায়, পাহাড়ে ইন্সারজেন্সি শেষ হয়েছে। কিন্ত, অতীত এবং বর্তমান সব শাসক শ্রেণী জুম্মবিরোধী তার পূর্বের অবস্থান থেকে এক বিন্দুও সরে আসেনি। চুক্তি বাস্তবায়নে গড়িমসি করা, প্রতিনিয়ত জুম্মদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়া, জুম্ম নারীদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান জাতিগত সহিংসতা, জুম্ম দিয়ে জুম্মদের হত্যা করা, জুম্ম দিয়ে জুম্মবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে নেওয়া এই পলিসি দিয়ে রাষ্ট্র সেটা প্রমাণ করে যাচ্ছে। এছাড়াও, এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানকে প্রতিবছর জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক পার্মানেন্ট ফোরামে সরকারের প্রতিনিধি হিসিবে প্রেরণ করার মাধ্যমে জুম্ম দিয়ে জুম্মবিরোধী এবং আদিবাসী স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ চলমান রয়েছে যা সত্যিই উদ্বেগের এবং নিন্দনীয়। হতভাগা জুম্মদের হয়তোবা এবারও সেটা দেখতে হবে। ভাগ্যের লিখন যায় না খণ্ডন! চুক্তি পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের এই পদে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনা না করে সরকার প্রতিটি নিয়োগের মাধ্যমে যে পার্বত্য চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে সে কথা আপাতত এই লেখায় বাদই দিলাম।
“মর থুম হদা হল দে জুম্মউন মরিবার যে পথ দুজ্জন মাজারা উদি যাদে বজ যাদে পিত্তিমী বুগত্তুন লুগি যাদে আর বেজ সময় ন’লাগিবু। পোড়া হবাল জুম্ম আমি। মরিবং না বাজিবং হবর ন’পেই।”